বজ্রমেঘ - পর্ব ১৭ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প


          হাতে একটা ইলেকট্রিক শেভিং সেট। যান্ত্রিক একটা শব্দ বেরোচ্ছে। শেভিং সেটটা কানের পাশ দিয়ে চুল ছেঁটে নিচ্ছে। সামনের আয়নায় যে প্রতিবিম্বটি ফুটে আছে, তা এখন আর শান্ত নেই। একটা অমানবিক ভয়াবহতা ওই মুখে স্পষ্ট। রাগের উত্তপ্ত তেজ খুব সাবধানে সামালানো। যেন একটু এদিক ওদিক হলে ভয়ানক বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে। বাইরে আকাশ অন্ধকার করা বৃষ্টি। কালরাতের বাদলা ভাব এই সকালেও কাটেনি। এখনো ব্যাপারটা ভুলতে পারছে না শোয়েব। চোখের সমুখ থেকে হটাতে পারছে না ওই দৃশ্যটা। মনে পড়লেই তার দুই চোয়ালের প্রখরত্ব আরো কঠিনত্বে ধরা দেয়। দাদী এমন একটা বিষাক্ত কাজ কী করে করলেন? কীভাবে চিন্তা করলেন ওই বিপজ্জনক অংশটা ঘাঁটানোর? উনি কী ভুলে গেছেন কেন উনার প্রাণপ্রিয় নাতী পরিবারটা পরিত্যাগ করেছে? আর কেন-ই বা সে ব্যবসায়িক মহলে না ঢুকে এমন খাপছাড়া বন্য জঙ্গলে পড়ে আছে? এমন আশ্চর্যজনক কাণ্ড তিনি কী করে ঘটান! দাঁতে দাঁত চেপে আরো একবার নিজেকে ঠাণ্ডা বানাল শোয়েব ফারশাদ। নিজেকে বোঝাল, এভ্রিথিং ইজ অলরাইট। নাথিং হ্যাজ গন ইরিটেব্যাল। কালরাতে যা যা ঘটেছে, তা এই পর্যন্ত-ই। সকালে ভুলে যাওয়াই শ্রেয়। অগ্রাহ্য করা তার বৈশিষ্ট্যসূচক কর্তব্য। বেসিনের উপর নরম চুলগুলো ছেঁটে ছেঁটে পড়ছে তার। চুলগুলো ক্রু কাট শেপে কেটে নিচ্ছে। কেবল এক সপ্তাহ চুলে শেভিং রেজারটা পড়েনি, আর তাতেই মনে হচ্ছে বেপরোয়া চুল তার কপাল ঢেকে দিচ্ছে। গম্ভীর একটা শ্বাস ছেড়ে গোসলের জন্য প্রস্তুত হল শোয়েব ফারশাদ। ভোর পাঁচটা বিশ মিনিট। শাওয়ারের নব মোচড়ে অবিরাম ধারার বৃষ্টিতে ভিজতে লাগল সে। দুচোখ বন্ধ, মাথাটা সামনের দেয়ালে ঠেকানো, তার মসৃণ পেশিবল পিঠ বেয়ে স্বচ্ছ জলের ধারা গড়িয়ে নামছে। পার্বত্যাঞ্চলের ঠাণ্ডা বরফ পানি, গায়ে একফোঁটা পড়লেই শিরশির করে উঠে, অথচ সেই পানিতে সিক্ত হয়ে স্বাভাবিক মস্তিষ্কে ভাবছে বন মানুষ। মেয়েটাকে আশ্রয় দিয়েছে সে, নিজের ঘরটা দিয়ে দেয়ার কাজটাও করেছে, অথচ তার ব্যাপারে এখনো কিছু জানেনি। জানার চেষ্টাটা অবশ্য করা যায়, কিন্তু প্রয়োজন বোধ করছে না। আজ নয়ত কাল পুরো দলটাকে বিদায় দিতে হবে। সেফ এক্সিট দেখলে ওদের ঢাকাগামী পথে বুঝিয়ে দেবে। সেখানে কাউকে নিয়ে জানার দরকারটা কী? 

বাথরুম থেকে বেরুতেই ধৌত পরিচ্ছন্ন পোশাক পড়ল শোয়েব। আসমানী নীল শার্ট, কালো গ্যাবার্ডিন প্যান্ট। ঘর বেরিয়ে যেই সিঁড়িপথে হাঁটা দিবে, ঠিক তখনই অনুভব করল থামা দরকার। একটা ক্ষীণ শব্দ শোনা যাচ্ছে। বাইরে মুষলধারার বৃষ্টি, দূরে কোথাও বজ্রাঘাতের শব্দ। সব মিলিয়ে ক্ষীণ সুরটা বারবার চাপা পড়ে যাচ্ছিল। কী মনে করে পায়ের দিক পরিবর্তন করল শোয়েব। কালরাতে অন্যমনষ্ক হয়ে এই ঘরের কাছে এসে পড়েছিল, কিন্তু আজ পূর্ণ সজাগে দরজায় ডানহাত বসিয়ে ঠেলে দিল সে। সমস্ত ঘর চাপা অন্ধকারে ডুবোনো। একটা মিহি আলোর রেখা কোত্থেকে যেন হালকা ফরসা ভাব এনেছে। সেই ক্ষীণ আলোকে চোখ বুলিয়ে কপালে অজস্র কুঞ্চন নিয়ে ভেতরে ঢুকল শোয়েব। ফিনফিনে পর্দার ওপাশে গুটিশুটি পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে ও। মুখটা ওদিকের জানালায় ঘুরানো। পিঠটা এদিক বরাবর রাখা। ভীষণ স্বচ্ছ ও পাতলা পর্দাগুলো উড়ে উড়ে শয্যাশায়িণীর সবটুকু অবয়ব দৃশ্যমান করে দিচ্ছে। পার্বত্যাঞ্চলে ভোরের তাপমাত্রা ভয়ংকর নিম্ন হয়ে যায়। শীতে তিরতিরে কাঁপন ধরে। চামড়া কাঁটা দিয়ে উঠে। দ্রুত উষ্ণতা পেতে ভারী কম্বল বা লেপ চটপট গায়ে চড়াতে হয়। কিন্তু সেরকম কিছু না পেয়ে একটা মোটা টাওয়েল গায়ে জড়িয়েছে ও। তাতে লাভ কিছুমাত্র হয়নি, তা সুস্পষ্ট। সাদা তোয়ালের নিচে অনবরত কাশছে, কাঁপছে, ঘুমের ঘোরে নড়ছে মেয়েটা। চোখ সয়ানো আঁধারে ওরকম পরিস্থিতিটা দেখতে পেয়ে এক সুযোগে আলমারিটা খুলে ফেলল শোয়েব। একেবারে নিচের দিক থেকে ভারী কম্বলটা টেনে বের করল। কম্বলটা মেলার আগে তোয়ালেটা যখন সরিয়ে দিচ্ছিল, তখন খুব অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখে থমকে গেল। তার কুঞ্চিত কপাল সহসা আস্তে আস্তে মসৃণ হয়ে ফুটল। একটা বালিশ ওইটুকু বুকের মধ্যে জাপটে ধরে আছে। তাতে মুখ গুঁজে কিছু যেন খুঁজছে। যেমনটা ছোট বাচ্চা মায়ের ওম পেতে, ওম খুঁজতে করে থাকে। দুহাতের মুষ্টিটা এমন দৃঢ় করে পাকানো, যেন বালিশটা কোনো মানুষ। এই মানুষটাকে মুঠোবন্দি করে না ধরলে হারিয়ে যাবে। এমন জায়গায় হারাবে, যেখান থেকে আর কক্ষণো ফিরে আসবে না। ঘুমের মধ্যে কী কিছু দেখছে? খারাপ, ভয়াবহ, বিপজ্জনক? ব্যাপারটা মনে পড়তেই কম্বলটা আস্তে করে জড়িয়ে দিল। এক মুহুর্ত চিন্তা করে পাশে বসল ওর। দাদীকে একবার ডেকে আনা দরকার, কিন্তু কালরাতের ঘটনাটা সহনশীল নয়। জোরে একবুক শ্বাস ছেড়ে খুব শান্ত গলায় ডাকল শোয়েব, 

  - শুনতে পাচ্ছ? 

এক মুহুর্ত সম্পূর্ণ স্থির। কোনো কাজ হল না তাতে। বিপজ্জনক কিছু একটা এখনো ও দেখছে। কপালে একটা রগ দপদপ করে কাঁপছে। ডাকটা ব্যর্থ বুঝতে পেরে সামান্য ঝুঁকল শোয়েব। হালকা ভাবে নিজের ডানহাতটা ওর মাথায় স্পর্শ করল। নিরাপত্তার অনুভূতিটুকু বোঝাতে স্থির গলায় মৃদু স্কেলে বলতে লাগল, 

  - শুনতে পেলে জেগে ওঠো। তুমি অবাস্তব কিছু দেখতে পাচ্ছ, যা সত্যি নয়। জেগে ওঠো শাওলিন। যদি আমার কথা শুনতে পাও, চোখ খুলে তাকাও। 

ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের ভেতর কেউ অস্থির হয়ে গেলে, এভাবেই একসময় সাহায্য করতো সে। ঘুমের ঘোরে প্রায়ই দেখা যেত, কেউ না কেউ গোঙাচ্ছে। কেউ ভয় পাচ্ছে। কেউ অশান্ত হয়ে যাচ্ছে। অন্যান্যরা ধমকে তাকে জাগাতে গেলে শোয়েব করতো তার উলটো। সেই মানুষগুলোকে সাহায্য করতো সরল ভঙ্গিমায়। আজও তার সেই শান্ত, নিরাপদ কণ্ঠে ঘুম ভাঙল শাওলিনের। মাথায় আলতো এবং সাবধানী হাতের স্পর্শ পেয়ে অস্থির অবস্থা একটু একটু করে ঘুচল। মাথা ঘুরিয়ে ডানে চাইতেই চশমা আঁটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মুখটা দেখতে পায় ও। অন্যসময় হলে আচম্বিতে ঝটকা মেরে উঠে বসতো। কিন্তু আজ মনের ভারসাম্য কিছুটা বেসামাল। মস্তিষ্কের কোষ লণ্ডভণ্ড। বুকের মধ্যে তীব্র প্রচণ্ড ধড়ফড় হচ্ছে। ওই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মুখটা মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে বলল, 

  - নিরাপদে আছ। কিছু হয়নি। তুমি দুঃস্বপ্ন দেখেছ, যেটা সম্পূর্ণই অবাস্তব। ভয় পেয়ো না। 

কথার এমন শীতল স্পর্শে চোখ বুজল শাওলিন। মাথাটা ঠাণ্ডা করার জন্য স্থির হল ও। কপালের ডানপাশে এখনো একটা রগ চিলিক দিয়ে যাচ্ছে। কেমন অদ্ভুত ধরণের খারাপ লাগছে, বলে উঠতে পারল না। এটা প্যানিক অ্যাটাক বা পিটিএসডি সমস্যা কিনা বুঝে উঠতে পারল না। কানের কাছে আবার শুনতে পেল সেই নির্ভয়ী সুর, 

  - গভীর শ্বাস নাও। শিথিল হও। বাইরে ভোর হয়ে গেছে। চাইলে তুমি ভোরের প্রকৃতি দেখতে পারো। এখানে চমৎকার বৃষ্টি হচ্ছে। বন বাংলোর পেছন দিকে ঘন জঙ্গল আছে একটা। জায়গাটা বৃষ্টির সময় উপভোগ্য হয়।  

মাথার ঘোলাটে ভাব একটু একটু করে কমতে লাগল ওর। কিছুটা স্বস্তি অনুভব হচ্ছিল। বুকের উপর থেকে এক মণের পাথরটা নেমে গেছে। এখন স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নিতে পারছে ও। ঢোক গিলে চোখদুটো আবারও মেলল শাওলিন। চশমা পড়া শীতল মুখটা দেখতে পেল ও। পড়নে আসমানী নীল শার্ট। চুলগুলোয় হালকা ভেজা ভাব। একটা দৃঢ়তাপূর্ণ আধিপত্য এখনো ওই মুখে বিদ্যমান। লোকটার ভেতর কোথাও এতটুকু ধমকানি ভাব নেই, দাম্ভিকত্ব নেই, কটাক্ষ ছাপ নেই, কাউকে অপমান করার প্রবণতাটাও শূন্য। কেমন যেন ফেনিভ সমুদ্রের মতো শীতল, যেন হাতে ছুঁয়ে দেখলে মন আকৃষ্ট হয়। চোখে চেয়ে দেখলে শান্তি শান্তি লাগে। অনুভবে মাখলে মদির মিশ্র আভা দেয়। শাওলিন কিছুটা হালকা অনুভব করলে ধীরস্বরে বলল, 

  - আপনাকে ধন্যবাদ। আমি খুব অবাক হয়েছি, আপনি যে কীভাবে বুঝতে পেরেছেন আমি ভয়ানক দুঃস্বপ্নে আক্রান্ত। এটা আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছিল। আরো একবার নিঃশব্দে উদ্ধারের জন্য ধন্যবাদ অফিসার ফারশাদ। 

মেয়েটার সরল স্বীকারোক্তিতে নিশ্চুপ রইল। ঠোঁটের আগায় উত্তর করল না কিছু। শুধু অপলকে দুটো নীল শান্ত চক্ষু মেলে চেয়ে রইল ফারশাদ। বারবার নিজের কর্ণকুহরে শুনতে পাচ্ছে বহুল ব্যবহৃত নামটা। যে নামটা তার সবচেয়ে কালো অধ্যায়, কালো অংশের, কালো জীবনের এক ভয়াল স্মৃতি বহন করে। মাথায় হাত বুলিয়ে চিন্তা করে, একবার কী বলবে, এই নামে ডেকো না তুমি? পরক্ষণে চিন্তাটা বাতিল করে মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে। দুটো মায়াবী কালো চোখ, যেন দিঘির মতো টলটল, নির্মল, পবিত্র। ওই চোখের দিঘিতে নিজের প্রতিচ্ছবি যেন দেখতে পাওয়া যায়। যেন পড়তে পারা যায় ওই দুটো আয়নার মতো চোখ। দুটো ওষ্ঠযুগল একদিনের পরিচর্যায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে। গোলাপ ফুলের মতো রঙ ফুটিয়েছে ও দুটো। ছোট্ট থুতনির নিচটায় আঁচড় লেগেছিল, সেটিও এখন শুকনো প্রায়। নিজের হাতটা আস্তে করে সরিয়ে নিল শোয়েব। চোখদুটো তখনো ওই দিঘির চোখে আবদ্ধ রেখে বলল, 

  - তুমি অনেকটাই সুস্থ। তোমাকে সুস্থ দেখে ভালো লাগছে। যদি তুমি চাও, এখন তোমার বন্ধুদের সাথে আশেপাশে কোথাও ঘুরে আসতে পারো। খাগড়াছড়ির অবর্ণনীয় সৌন্দর্যে গত পরশুর স্মৃতিটা ভুলিয়ে রাখতে পারো। তুমি কী যেতে ইচ্ছুক? 

বাইরে তখন মেঘে কেটে এসেছে। ভোরের আলো ফুটে চারদিক মৃদু মৃদু ফরসা। একটা অলৌকিক সৌন্দর্য ওই পার্বত্যাঞ্চলের বন বাংলোর ঘরে শাওলিনকে অত্যাশ্চর্য অনুভূতি দিল। এমন অনুভূতি, যা হৃদয়ে সুপ্ত, শব্দে অব্যক্ত, বুকের মধ্যিখানে কাঁপন উঠানো। বন কর্মকর্তার অমন স্বাচ্ছন্দ্য বাক্যে নিজের উচাটন সুর গোপন করে বলল, 

  - সম্ভব? 

  - সম্ভব। 

  - আশেপাশে পাহাড় . .
  
  - সব আছে। 

কথা শোনার পর এক মিনিট ভাবল শাওলিন। ততক্ষণে শোয়া থেকে উঠে বসেছে ও। গায়ে যে নরম ভারী কম্বল তা সে খেয়াল করেনি। পড়নে কাল বিকেলের সেই ঘটনাবহুল পোশাক। গাঢ় ছাই রঙের সুতির শাড়ি, শাড়ির পাড়টা বেশ মোটা এবং কালো। ব্লাউজটা ছোট হাতায়, রঙটা পাড়ের মতোই কালো বর্ণ। চোখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল শোয়েব। মুখ ফুটে কিছু না বললেও শাওলিন বুঝতে পারছিল, এই শাড়িটাতে কোনো সমস্যা আছে। যার দরুন, কাল রাতেও খাবারের টেবিলে সুস্থির থাকেনি লোকটা। পানির গ্লাসটা ডানহাতে খামচে টেবিলের উপর ভয়ংকর একটা আছাড় মেরে গেছে। উপস্থিত সকলেই তখন বিদ্যুৎপৃষ্ট! ঘটনার আকস্মিকতা ঠাহর করতে পারেনি কেউ। একমাত্র ফাতিমা নাজ এবং অধরার মুখ ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গিয়েছিল। আর একটা কথাও কেউ তখন বলেনি। বুদ্ধি করে কিছুটা স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল শাওলিন, 

  - আপনি কী কোনোভাবে শাড়ি পরার জন্য উপর বিরক্ত? 

চোখ ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকাল শোয়েব। আপাদমস্তক আরো একবার চোখ বুলিয়ে সত্যটাই বলল, 

  - শুধু এই শাড়িটার উপর বিরক্ত। শাড়ি পরাটার উপর বিরক্ত না। বাঙালি হিসেবে তোমাদের জন্য শাড়ি পোশাকটা সুন্দর। আমার এটা ভালো লাগে। 

শেষের কথাটা শুনে তৎক্ষণাৎ ঢোক গিলল শাওলিন। অনুভব করতে পারল, এই ভদ্রলোক কিছু কিছু জায়গায় যথেষ্ট সোজাসাপ্টা। স্টেইট ফরোয়ার্ড কথাটার মতো সরাসরি সত্য চটপট বলে দেয়। কিন্তু সে কী জানে এভাবে মেয়েদের সামনে শাড়ির আলাপন তুললে কিছু অদ্ভুত বিষয় হয়? যা বাক্য দিয়ে, শব্দ দিয়ে তেমন ব্যাখ্যা করা যায় না? শাওলিন প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দিতে অন্যদিকে মোড় নিয়ে বলল,  

  - আমার বন্ধুরা আজই পোশাকের ব্যবস্থা করবে। আশাকরি আপনার জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি ঘটবে না। যদি আপনার ভাবী বা দাদী একবার আমাকে বলতেন এটাতে কোনো সমস্যা আছে, আমি এটা পরা থেকে --- 

কথাগুলো একমনে বলে চলছিল শাওলিন। কিন্তু খেয়াল করেনি ততক্ষণে শোয়েবের চোখ অন্যদিকে ঘুরেছে। গ্যাবার্ডিন প্যান্টের ডান পকেটে মৃদু ভাইব্রেশনে কিছু কাঁপছিল। লাগাতার ডিভাইসটাকে অগ্রাহ্য করে ওর কথাই মূলত শুনছিল। কিন্তু যখন বুঝতে পারল, কলটা একবার নয়, বরং বারবার আসছে, তখন কিছুটা ধৈর্যের চ্যুতি ঘটিয়ে ফোনটা রিসিভ করে সে। কানে ফোন ঠেকিয়ে 'হ্যালো হুঁ' কোনোকিছু না বলে নিঃশব্দে উঠে পরেছিল শোয়েব। এদিকে শাওলিনও বুঝতে পারেনি, এই নীরবতার মাঝে কখন যে লোকটা উঠে চলে গেছে। যখন কথা শেষ করে ডানদিকে চোখ তুলল, ততক্ষণে বুঝতে পারল ঘর খালি। আশেপাশে কেউ নেই। কী ভয়াবহ! 

——————

কালরাতে যে ভুলটা তিনি করেছেন, তার দরুন মুখটা এখনো অন্ধকার। নাতী উনার ঘরে একবারও এল না। তিনি সাতসকালে ভেবেছিলেন, আজ ওর সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে পছন্দের ফ্রুর্ট কাস্টার্ডটা বানিয়ে খাওয়াবেন। কিন্তু খাওয়ানো তো দূর থাক, উনার ভদ্রোচিত নাতী বন বিভাগের জঙ্গল সার্ভেতে চলে গেছে। সঙ্গে নিয়ে গেছে দুটো গোলা-বারুদকে। পার্থ এবং রাফান। বাড়িটা এখন ভরে আছে এক দঙ্গল ছেলেপিলেদের কণ্ঠে। তরুণ প্রাণের উচ্ছ্বাস হঠাৎ হঠাৎ হাসির স্বরে ধরা দিচ্ছে। তবে হাসি দেখেনি ওই অদ্ভুত ঠাণ্ডা মেয়েটির মুখে। আহত, ব্যথায় জর্জরিত, পায়ে পাতলা ব্যাণ্ডেজ নিয়ে ও এখনো আছে নিজের ভূমিকায়। প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়, কথা শুধালে জবাব রাখে, জানতে চাইলে ততটুকুই প্রত্যুত্তর। অথচ, সেদিন রাতে যখন ছেঁড়া, ময়লা, রক্তে মাখা পোশাকটা বদলে দিয়েছিলেন, তখনি উনার চোখে চরম বিস্মিত ব্যাপারটা ধরা পড়ে। কোনো এক বিচিত্র কারণে ওই ব্যাপারটা কারুর সঙ্গেই আলাপ করেননি তিনি। শোয়েবের কাছেও নয়। এমন সময় উনার ঘরের দুয়ারে মৃদু ঠকঠক করাঘাত পড়ল। তিনি চশমা চোখে দরজা বরাবর তাকালেন। গম্ভীর মুখে এক পশমা বৃষ্টির মতো হাসি দিয়ে বললেন, 

  - এসো। খুব ভালো হলো তুমি এলে বলে। বসো। কাছের ওই চেয়ারটা টেনে বসো। 

দরজা ছেড়ে প্রবেশ করেছে শ্রেষ্ঠা। নাশতা পর্ব চলাকালে কেন জানি এই বৃদ্ধা ওকে কথা বলার জন্য ডেকেছিলেন। কিন্তু কী কারণে ডাকতে পারেন তা এখনো উদঘাটন হয়নি ওর। হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা কালো লং টিশার্টে ঢোলা জাতীয় প্যান্ট। চুলগুলো খুব উঁচু করে খোঁপা বাঁধা। গলায় কালো ওড়নাটা এক প্যাঁচ দিয়ে বুকের দুপাশে ঝুলিয়ে রাখা। পুরোপুরি স্মার্ট ভঙ্গিতে একটা চেয়ার টেনে বসল ও। মৃদু গলায় স্পষ্ট আত্মবিশ্বাসী সুরে বলল, 

  - জ্বী, আন্টি। আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন? 

ফাতিমা নাজ সাবধানে শুধরে দিয়ে বললেন, 

  - আমাকে দাদী, দাদু বলতে পারো। আমি তোমাদের দাদু বয়সি মানুষ। তা তোমাকে ডেকেছিলাম একটু গল্পগুজব করার জন্য। তোমাদের ব্যাপারে জানার জন্য। তোমরা এতোগুলো মানুষ বাড়ি ছেড়ে এভাবে ট্যূর দিচ্ছ, ঘুরতে ফিরতে সময় দিচ্ছ, এসব নিয়েই কথাবার্তা। 

শ্রেষ্ঠা মুচকি হাসিতে জবাব দিয়ে উঠল, 

  - আমরা ক'জন হলে আর হোস্টেলে থাকি দাদী। বলতে পারেন, বাড়ি ছাড়া সবার জীবন কিছুটা অন্যরকম। পড়াশোনার বাইরে এভাবে একটা ট্যূর দিলে আমাদের যাঁতাকলে পিষ্ট জীবন কিছুটা স্বস্তির হয়। তার মধ্যে ধরুন, একাডেমিক চাপে আমরা সবাই সারাটা বছর ঘুম হারা থাকি। এজন্য মাঝে সাঝে যাদের ফ্রি পাই, তাদের একত্র করে সংঘবদ্ধ একটা ট্যূর দিই। 

  - বেশ চমৎকার। ভালো লাগল তোমার কথা শুনে। এটা সত্যি বলেছ, তোমাদের যুগে পড়াশোনার বাইরে যে জগতটা রয়েছে, সেখানে উপর্যুক্ত বিনোদন মাধ্যম থাকা চাই। মাঝে মাঝে প্রকৃতি ভ্রমণ আমাদের মনের চোখটা খুলে দেয়। শ্রেষ্ঠা, তোমাকে যদি একটা একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি, বলবে? 

এবার কিছুটা ঘাবড়ে গেল শ্রেষ্ঠা। তবে মুখের ভঙ্গিতে তা এতটুকু প্রকাশ পেল না। উনি আবার কী প্রশ্ন করতে যাচ্ছে? শ্রেষ্ঠা হাসিমুখে বলল, 

  - নিশ্চয়ই। আমি যথাযথ চেষ্টা করব উত্তরটা দিতে। 

কথাটা শোনার পর গম্ভীরভাবে দম নিলেন ফাতিমা। এবার তিনি যে প্রশ্নগুলো করতে যাচ্ছেন, তার যথাযথ উত্তর পাবেন তিনি। ফাতিমা নাজ স্বাভাবিক গলায় প্রশ্নটা করলেন, 

  - শাওলিনের কী গার্ডিয়ান নেই? ওর বতর্মান দেখভালের দায়িত্ব কে পালন করছে? 

আচমকা ও দুটো প্রশ্ন শুনে হাসি নিভল শ্রেষ্ঠার। মুখে ছড়িয়ে পড়ল একরাশ বিষণ্ণতা। চোখে বিষাদ ঘনানো আঁধার নিয়ে মাথা নিচু করল ও। ঠোঁটের ওপর জিভ বুলিয়ে শান্তভাবে বলল, 

  - আপনি ব্যাপারটা কী করে বুঝলেন? মানে, আমরা . . আমরা কখনো ওর ব্যাপারে খোলাখুলি আলোচনা করি না। এটা ওর পছন্দ না। ও এটা জানতে পারলে কষ্ট পাবে। 

ফাতিমা নাজ সঙ্গে সঙ্গে বুঝিয়ে বলে উঠলেন, 

  - না না, ভুল ভাবলে তুমি। আমি ওরকম কিছু বোঝাচ্ছি না। আমার কাছে সত্যি বলতে ওকে খুব অন্যরকম লেগেছে। ও তোমাদের সঙ্গে জড়িত, কিন্তু তোমাদের মতো না। তাই কিছু বিষয়ে অদম্য কৌতুহল জেগেছে বলব। 

শ্রেষ্ঠা এবার মুখ তুলে তাকাল। বৃদ্ধার বাহ্যিক অভিপ্রায়টা বুঝে নিয়ে হালকা স্বরে বলল, 

  - ওর একমাত্র গার্ডিয়ান ভাবী। যাকে ও মণি বলে ডাকে। ভাবীর সঙ্গে ওর সম্পর্কটা ঠিক মায়ের মতো। ওর ভাই যখন বিয়ে করেছিল, তখন ওর বয়স খুবই অল্প। পাঁচ বা তারও কম হলে হতে পারে। আমার স্পষ্ট খেয়ালে নেই। এরকম একটা বয়সে ও ওর ভাবীকে পায়। ভাবীর কাছেই মূলত মানুষ হয়। ওর কাছে ওই একজন মণি ছাড়া আর কেউই নেই। 

খুব আশ্চর্য হয়ে কথাগুলো শুনলেন তিনি। কল্পনাও করতে পারেননি, অতটুকু একটা মেয়ে পিতা-মাতাহীন আশ্রয়ে আছে। তাদের ছায়া না পেয়ে ভাবীর কাছে গচ্ছিত রয়েছে। তার খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, ঠিক কোন কারণে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মটা বিফলে গেল? ঠিক কী কারণে নিজের জন্মদাত্রীর কাছে ছায়াটুকু পায়নি ও? কী এমন কারণ ছিল? উনার কোলে শাড়ির আঁচলে একটা ডায়েরি ঢাকা। ডায়েরিটায় অনবরত হাত বুলাচ্ছেন তিনি। গতকাল সারাটা দুপুর একটু একটু করে পড়েছেন। কিন্তু সামনে এগোনোর দুঃসাহস উনার হয়নি। একবুক হতোদ্যম শ্বাস জিজ্ঞেস করলেন ফাতিমা, 

  - পড়াশোনা কীভাবে করছে? 

  - ওর দাদা . . মানে ওর ভাই যতটুকু রেখে যেতে পেরেছে। আর ওর ভাবী সরকারি কলেজের অধ্যাপিকা। উনি সবটা নিজের হাতে দেখাশোনা করছেন। কোথাও এখনো অবধি কমতি রাখেননি। 

  - ঢাকায় তোমরা একসঙ্গে থাকো? 

  - না। আলাদা আলাদা। ও আগে থাকতো মৌলভীবাজার। এরপর পড়াশোনার জন্য চলে আসে ঢাকায়। একটা হোস্টেলে উঠেছিল। কিন্তু বেশিদিন থাকতে পারেনি। হোস্টেলের এলাকাটা ভালো ছিল না। এখন ওর ভাবী সবটা গুছিয়ে দিয়েছেন। একটা ফ্ল্যাটে একজন বৃদ্ধ পরিচারিকার সঙ্গে আছে। 

এবার খুব সাবধানে প্রশ্নটা করলেন ফাতিমা। আস্তে করে শুধালেন, 

  - ওর মা কী মারা গেছে? 

  - ওর মা আত্মহত্যা করেছে। 

—————

আকাশে ধীরে ধীরে বেগুণি রঙ ধরেছে। সন্ধ্যার মায়াবী রূপে মনটা মুগ্ধ হয়ে যায়। পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরছে নীড়ের দিকে। তাদের কিচিরমিচির আওয়াজে কান রাখা দায়। ওদিকে পূবের সূর্য লাল সিঁদূর ছড়িয়ে ডুবে গিয়েছে। আকাশে লক্ষ তারায় ঝিকিমিকি করছে নক্ষত্রমণ্ডল। বাংলোয় বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন। কাছাকাছি একটা বৈদ্যুতিক খাম্বায় সমস্যা হওয়াতে আজ বিদ্যুৎ মশাই আসবে না। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত হচ্ছে সেগুফতা। ঠাস করে বাঁ বাহু একটা চড় কষাল। লাভ হল না। মশার বাচ্চা মরেনি। রাগে হুঙ্কার দিয়ে প্রচণ্ড ফুঁসে উঠল সেগুফতা, 

  - অ্যাই রোকেয়া! রোকেয়া! কোথায় আছিস? এক্ষুণি এদিকে আয়!

অমন জলদ্গম্ভীর হুঙ্কারে রোকেয়া অবশ্য এল না। দরজা একটু ফাঁক করে চুপি দিল মিথিলা। ঘরে ঘরে হারিকেন বা মোমের উজ্জ্বল আলো। চমৎকার একটা আনন্দ আভা ফুটে আছে দ্বিগ্বিদিক। মিথিলা দেখল, সেগুফতার ঘরে শুধু চার্জার লাইটের আলো। কোনো মোমবাতি, হারিকেন বা কুপি জ্বালানো নেই। মিথিলা ঠোঁটের হাসিটা নিভাতে নিভাতে বলল, 

  - আপনি দেখি চার্জার লাইট ধরিয়ে রেখেছেন? 

  - তো? 

  - তো কিছু না। একটা ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি। 

  - কী কথা? যা বলার দ্রুত বলে প্রস্থান হও। 

  - কাল পাহাড়ি মানুষদের উৎসব আছে একটা। বৈসাবি উৎসব। শোয়েব সেখানে ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার হিসেবে ইনভিটেশন পেয়েছে। আমরা যাচ্ছি সবাই। আপনি যাবেন? 

চোখ খাটো করল সেগুফতা। ডানহাতের নখ দিয়ে বাঁহাতের চামড়া ঘ্যাচর ঘ্যাচর করে চুলকাচ্ছে। কী যেন একটা আঁচ করে অনুমান গলায় বলল, 

  - আমরা বলতে কারা? ওই সাতজনের দলটা আবার যাচ্ছে নাকি? 

  - জ্বী, সবাই যাচ্ছে। গুলজার সাহেব যদি সময় পান যাবেন, তিনি যাবেন। আর উনার মেয়ে ইলহাম যাচ্ছে। উৎসবের পর শোয়েব সবাইকে কোথায় যেন ঘুরতে নিয়ে যাবে। 

  - কোথায়? 

  - বলেনি। হতে পারে খাগড়াছড়ির সাজেক ভ্যালি!

কথাটা শোনার পর থমথম করছিল মুখ। সেগুফতা যে খুশি হয়নি তা বোঝাই যাচ্ছিল। কিন্তু তার চেয়ে বেশি অপেক্ষা করছিল, একটা নিয়তি চালিত সংযোগ। ওরা কেউ জানে না সাজেকের ভূমি কী আনতে চলেছে। কী অকল্পনীয় যোগ-সাজশ অপেক্ষায় আছে ওদের। কী হবে সাজেকের বুকে? ভীতিকর নাকি ভয়ংকর? জানা নেই!
.
.
.
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp