মেঘলা আকাশ জ্বলে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে। শব্দ বিহীন বিদ্যুতের ঝলক রাতের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। বিদ্যুৎতের পরলোকগমনে পুরো গাঁ আলো আঁধারিতে ডুবে। মেলায় দোকান পাঠ যেখানে বন্ধ করায় ব্যস্ত সকলে,সেখানেই যাত্রাপালার তাঁবুতে সবে উদ্বোধন হলো। বিদ্যুতের অনুপস্থিতিও থামাতে পারে নি। সারি সারি লন্ঠনের সোনালী আলোয় আলোকিত যাত্রাপালার মঞ্চ। ঢাক, ঢোল, একতারা, হারমোনিয়াম সহ দেশীয় বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বেজে চলেছে। শিল্পী তাঁর সুরেলা গলায় সুর তুলেছে বেশ।এক কুড়ি বছরের রমনী নাচের মুদ্রা তুলছে দক্ষ ভঙ্গিতে। দর্শকের কেউ কেউ উপভোগ করছে তো কেউ বিরক্ত বোধ করছে। একদল কিশোর যুবকের দল তাঁবুর এককোণায় জড় হয়ে সিগারেট টানছে আর দেশীয় পানি ভাগাভাগি করে ঢকে ঢকে গিলছে। নওরিজ মাহবুবের বাজপাখির ন্যায় ধারালো চাহনি কিশোর ছেলেদের উপরেই নিবদ্ধ। কি অবলীলায় ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। যতদিনে বুঝতে শিখবে এই ক্ষণিকের মোহ কেটে বেরোনোর জন্য ছটফট করবে কিন্তু বেরোনোর পথ কাঁটায় কাঁটায় পরিপূর্ণ।
" ওরা তো পথভ্রষ্ট হয়ে ওদিকে ঝুঁকেছে। সঠিক সময়ে কড়া শাসন পেলে শুধারানোর চান্স আছে। ওদের দিকে নজর না দিয়ে ওদিকে চোখ রাখো রিজ! ওই যে কালো রুমাল মাথায় বেঁধে রাখা কিশোর ছেলে গুলোকে দেখছো?"
সাদমানের কথায় নওরিজ মঞ্চের বাম কোণের দিকে তাকায়। কিছু কিশোর ছেলে মাথায় কালো পট্টি বেঁধে নিয়েছে যেন সকলের ভিড়ে চিহ্নিত করা যায়। নওরিজ এগিয়ে যায় ধীর গতিতে। কোণায় রোগা পটকা এক লোক ছেলেদের কানে কান পড়া দিচ্ছে। হাতে হাতে কিছু গুজে দিয়ে সাবধান করছে বারবার।
" তোমার হবু শ্বশুর মশাই রিজ।"
গলা খাঁকারি দিয়ে বলে সাদমান। নওরিজ চোখের রঙিন চশমাটা নাকের ডগায় নামিয়ে চোখ উল্টিয়ে চায়। সত্যিই তো, ওটা যে সালেহ চাচা। দৃষ্টি স্থির রেখে জবাব দেয়,
"আমি জানি সে এসবে ভালোভাবেই জড়িত। মিন্টু মিয়ার সাথেও গলায় গলায় ভাব ওনার। ভালো কথা মিন্টু মিয়াকে কিন্তু দেখলাম না সাদমান ভাই?"
সাদমান নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে, "সে চুনোপুঁটি নয় যে কিনারায় এসে বড়শির টোপ গিলবে। গভীর জলের মাছ সে। কাঁদা নিয়ে খেলবে তবে গায়ে মাখার চান্স নেই বললেই চলে। চুনোপুঁটি ছেড়েছে তারাই রাজ করছে কিনারায়। তবে বাপেরও বাপ থাকে রিজ। সেই বাপটাকেই খুঁজে বের করতে হবে। সে এখানে আসার ভুল করবে না মোটেও।"
নওরিজ হুডির টুপিতে মাথা ঢেকে নেয়। বাঁকা হেসে বলে,
"সাদমান ভাই? ধারনা ভুল আপনার। রাঘব বোয়াল আশেপাশেই ঘুরছে। আমরা তাকে দেখছি কিন্তু চিনতে পারছি না।"
সাদমান প্রশ্নাতীত চাহনী নিক্ষেপ করে। রিজ বাঁকা হেসে ভিড়ে হারিয়ে যায়। সাদমান কুঞ্চিত কপালে আশেপাশে চোখ বুলায়।
°°°°°°°°°°
" ও সিন ভাই, বাড়ি যাইবা কহন? আমার ঘুম পাইতাছে!"
সাথে সাথেই মাথায় চাটা পড়ে। শফি ঠোঁট চোখা করে মাথা ডলে। বিরক্ত মুখে বলে, "সবসময় মারবা না সিন ভাই! সুর আপারে মাইরা মন মেজাজ আসমানে চড়ছে আমার মারলে মেজাজ নিচে নামবো? আমার বুঝি লাগে না?"
সিনান ঠাস করে চড় মারে পিঠে। শফি পিঠ বাঁকিয়ে মুখ কুঁচকে নেয়। ক্ষোভ ঝেড়ে বলে,
" আমি কি সরকারি মাল লাগি? নাকি আমার চামড়া গন্ডারের? বাল সবসময় খালি মারবো।"
" তো কি তরে চুম্মা খামু?"
সিনানের ভাবলেশহীন গলায় শফি মুখ বাঁকিয়ে বলে, "সে তো তুমি তোমার বউরেও খাইতা না। কালক্রমে খাইলেও বউ আর ঘরে থাকতো না। তোমার যা বিষের লাহান জবান। বেচারি পটল তোলার আগেই আল্লাহর পেয়ারি হইয়া যাইবো।"
সিনান মলিন হাসে। বোনটাকে মেরেছে নাস্তে তাঁর মনটা ভালো যাচ্ছে না। ছোটবেলায় এদিক সেদিক হলে মারতো তবে এখন বোন বড় হয়েছে। ওভাবে মারা ঠিক হয় নি!
" চল ওদিকটায় গিয়ে দাঁড়াই। ভালো দেখা যাইবো।"
বলে সিনান শফিকে টেনে নিয়ে যায়। শফি সন্দেহ মনে শুধায়,
" সিন ভাই সত্যি কইরা কও দেহিন? সার্কাসের পঁচা মাইয়াগোরে দেখার লাইগা এতো উতলা ক্যান হইলা? আম্মা কয় এগুলা ভালা না। আল্লাহ পাপ দিবো। চোক্ষের ভিতর গরম শিক ঢুকাইবো।"
"এমনি আইলাম। পঁচিশ বছরের জীবনে কোনদিন ফুরসত পাই নাই এদিক সেদিক ঘোরার। আজ একটু শখ জাগলো। মন্টু চাচাও মুফতে টিকিট ধরাই দিলো। আর ওতটাও খারাপ না। ভালোই তো নাচতেছে একদম সিনেমার মতো। সিনেমার নায়িকাগোরে তো চোখের তারায় বসায় থোস এরা কি দোষ করলো? দু'জন কাজের মধ্যে তফাৎ টা কই?"
অবুঝ শফি বড়দের মতো মাথা নাড়ে। সিনান হেসে আবারও মাথায় গাট্টা মারতেই শফি ছাগলের মতো মুখ বানিয়ে এক হাতে লন্ঠণ ও অপর হাতে সিন ভাইয়ের বাহু জড়িয়ে হাঁটে। হঠাৎ মঞ্চের এক কোণায় চেনা পরিচিত কাউকে দেখে শফি আঙ্গুল তাক করে দেখায়,
" সিন ভাই? ওইটা চাচা না?'
শহির দেখানো দিক নির্দেশনায় তাকায় সিনান। জন্মদাতাকে দেখে অবাক হয় না, তবে আফসোস হয় ঢের। বিতৃষ্ণা জাগে সবে। শফির হাত টেনে নিয়ে এগিয়ে যায় সেদিকে।
সালেহউদ্দিন হাসিমুখে কথা বলছেন গাঁয়ের চেনা পরিচিত লোকদের সাথে। যাত্রপালার নাম শুনে দিনে নাক সিঁটকিয়ে দু'টো জ্ঞান বিলিয়ে দিলেও রাতে কাছা মেরে চুপিচুপি এসে হাজির। বুড়ো জোয়ান কেউ বাদ নেই। মনে হচ্ছে আশপাশের প্রায় সব পুরুষ, যুবক, কিশোর এসেছে। সালেহউদ্দিন ছেলেকে দেখে হাসেন। কাছে ডেকে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। লজ্জায় সিনানের মুখচোপা থমথমে। সালেহউদ্দিন ছেলেকে নিয়ে একটু নিরিবিলিতে যায়। পকেট থেকে কড়কড়া কিছু নোট বের করে ছেলের পকেটে গুঁজে দিয়ে বলে,
" মন্টু ভাই কইছিলো তুই আইবি, আমি বিশ্বাস করি নাই। কিন্তু তোরে দেইখা কি যে খুশি লাগতেছে বাপ! ওই নাচগান তো উছিলা মাত্র। জনসমাগম মানেই পকেট পুরা হইবো। তুই আমার সাথেই থাকিস আচ্ছা?"
সিনান অনেক কষ্টে নত মাথা কাত করে সায় জানালো। সালেহউদ্দিন খুশি হয়ে ছেলের হাতে আরো কিছু টাকা ধরিয়ে দেয়। শক্ত মুঠোয় টাকা গুলো মুচড়ে ধরে সিনান। 'আসছি' বলে শফিকে টেনে নিয়ে যায়। হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয় নোনাজলে ভিজে জলন্ত চোখজোড়া ভিড়ভাট্টায় কেউ খেয়াল না করলেও শফির নজরকাড়ে। সিন ভাইকে সেই ছোট্ট থেকে দেখে আসছে সে। বাবার না ফেরার দেশে পাড়ি জমানোর পরে ছোট্ট শফি সেই যে সিনান নামক খিটখিটে লোকের সাথে জুড়ে গেলো! তাঁর বন্ধু, ভাই এই এক সিন ভাই। বকুক, মারুক, তাঁর উপর খ্যাক খ্যাক করুক তবুও দূরে গেলে ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত হয়, রাগও লাগে তবে সময়ের সাথে তা উবে গিয়ে স্নেহটা চোখে ভাসে।
" ও সিন ভাই? চলো বাড়ি যাই? ভাল্লাগতাছে না!"
শফির কথায় সিনান যেন আটকে রাখা শ্বাস ছাড়লো। টাকা গুলো পকেটে রাখে। স্বার্থপর জীবনে বেঁচে থাকতে হলে টাকা নামক এই বিষাক্ত বস্তুটাকে কদর করতেই হবে।
" শফি রিজ ভাই কইছিলো ওই লোক নেশার বড়িটরি, গাঁজাটাজা বেঁচে। আমি বিশ্বাস করি নাই জানোস? বুক ফুলাই কইছিলাম, বাজে লোকের খপ্পরে পইড়া মদ পানি গেলে তয় ওসবে জড়াইবো না। মা'রে জিগাইলাম আমতা আমতা করলেও মানা করলো। ওসবে নাই। কিন্তু দেখ? লোকটা মুখ দেখানোর জো রাখলো না। আমার না সব জ্বালাই দিতে মন চাইতেছে। সুর না থাকলে কবে পালাই ভিনদেশে পারি দিতাম। বোনডারে ঘার থাইক্যা নামাই। তারপর চইল্যা যামু যেদিক দু'চোখ যায়।"
শফির বুকটা ছ্যাত করে ওঠে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
" তুমি গেলে আমার কি হইবো সিন ভাই? মা শাপলা ওগোরে কে দেখবো?"
সিনান দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মুখটা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে,
" চল? হারিকেন আছে তো হাতে? ফালাই দেস নাই আবার?"
সিনানের কথায় শফি দাঁত কেলিয়ে বা হাত উঁচুতে তুলে হ্যারিকেন দেখায়। দু'জনে যাত্রাপালা থেকে বেরিয়ে আসবে তখনি কারো কাঁধের সাথে ধাক্কা লাগে। সিনানের বুঝতে বাকি না ধাক্কাটি ইচ্ছাকৃত। খ্যাক করে বলে ওঠে,
" চোখ কি পকেটে ঢুকাই হাঁটোস হুমুন্দির বাচ্চা?"
নওরিজ মুখের মাস্কটা নামিয়ে নেয়। নির্বিকার চিত্তে পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলে,
" তোকে তো আলাভোলা নাদান ভেবেছিলাম। এখানে কি করছিস সিন? আবার বাচ্চা ছেলেটাকেও টেনে এনেছিস!"
নওরিজ কে দেখেও সিনানের মাঝে ভাবান্তর দেখায় না। মুখটা বিরক্তিতে মাখা। কর্কশ গলায় বলে,
"আমি আবার কবে নাদান ছিলাম? আগাগোড়াই গন্ধযুক্ত মানুষ। আর শফি কোন দিক দিয়ে বাচ্চা? আপনের বোন রূপসারে বউ বানানোর স্বপ্ন দেখে সে। যাক গে, আপনে তো ভদ্দরলোক। নিশ্চয়ই পথ ভুলে চলে এসেছেন তাই না?"
নওরিজ সুক্ষ্ম চোখে চায়। মেজাজ চড়া বোঝাই যাচ্ছে। বোনটাও ভাইয়ের গুনে গুণান্বিতা! সে মাস্কে পুনরায় নিজেকে আড়াল করে নিয়ে বলে,
" শোন তোর দলের প্রথম কাজ আমি দিবো। ঠিকঠাক ভাবে করতে হবে। সব খরচাপাতি আমার তরফ থেকে। দলবল ডেকে কাল সন্ধ্যায় এক হয়ে আমাকে কল করিস বুঝাতে পেরেছি?"
অনিচ্ছা সত্বেও স্বীকারোক্তি দেয় সিনান। নওরিজ মাহবুব কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে সিনানের থমথমে মুখ পানে তাকায়। ব্যাপারটা কি? সিনান যেন পালিয়ে যাওয়ার অবকাশ খুঁজে বেড়ায়। ব্যাস্ততা দেখিয়ে শফিকে নিয়ে চলে যায় ঝড়ের গতিতে।নওরিজ হয়তো বুঝতে পারলো শালাবাবুর মেজাজ কেন চড়ে! সে ভিড়ে সাদমানকে খুঁজে বেড়ায়। হঠাৎ বুড়ো জোয়ান সকলে উল্লাসে ফেটে পড়ে। এদিকে ওদিকে ঘুরা ফেরা করা সবাই মৌচাকে আকর্ষিত হয়। মঞ্চের সম্মুখে ভিড় জমে যায়। নওরিজ কৌতুহল মনে তাকিয়ে রয় মঞ্চের গোলাপি পর্দায়। বাঁশির লম্বা সুরে সুরে পর্দা সরিয়ে দেওয়া হয়। সকলের চোখের পর্দায় সেই লাস্যময়ী নারীর পেছনের কায়া ঝলমল করে। তাঁর ফুলে সজ্জিত লম্বা বেনুনী সুডৌল কোমড় জড়িয়ে হাঁটু ছুঁই ছুঁই করছে। মঞ্চের মেঝে ছুঁই ছুঁই ঘাগড়া একটু উপরে তুলতেই পায়ে বাঁধা ঘুঙুর দৃশ্যমান হয়। রুম ঝুম তান তুলে ঘুঙুর গেয়ে ওঠে পায়ে পায়ে। উপস্থিত দর্শক যেন বশীভূত হলো। হাউকাউ শব্দ বিলীন হয়ে শুধু ঘুঙুরের মন পোড়া সুর। সবাই মোহিত দৃষ্টি স্থির ওই আলতা পড়া পায়ে। চোখের পলকে নারী কায়া তাঁর সুশ্রী চেহারার দর্শন দেয়। লাল টকটকে অধরে নজরকাড়া হাসি লেপ্টে। কাজলের টানে আঁকা কালো আঁখিযুদ্ম ধারালো চাহনিতে তাকায় দর্শকদের পানে। নওরিজ মাহবুব ক্ষণিকের জন্য থমকায়। সে কি ঠিক দেখতে পেলো? মঞ্চ মাতিয়ে রাখা লাস্যময়ী নারী আপন জাদুতে দর্শকের মন কাড়ে বাউলা গানের তালে তালে। নওরিজ বিস্ময় নিয়ে দেখে যায়। কাঁধে কারো হাত টের পেয়ে ঘার বাঁকিয়ে চায়। অবাক সুরে বলে,
" সাদমান ভাই? মিনী এখানে?"
°°°°°°°°°°°°°°°
হুতুম পেঁচার অদ্ভুত ডাক। বাঁশ বাগানে উঁকি দেওয়া শশধর লাজুক চোখে তাকিয়ে আছে। বাঁশঝাড়ে ঝুলছে বাদুড়। তাদের ডানা ঝাপটানো সুর বড্ড ভুতুড়ে। শুকনো বাঁশ পাতা মাটিতে পড়ে থাকায় পা ফেলতেই ঝনঝনা শব্দের উদ্ভব ঘটে। পায়ের মালিক সজাগ হয়। টিপে টিপে পা ফেলে এগিয়ে যায় উত্তর মুখী জানালার পাশে। বন্ধ জানালা দেখে মানবের মুখটা বিরক্তিতে তিক্ত হয়ে আসে। তবে ঘুন ধরা কাঠের জানালায় টোকা দিতেই ঘ্যার ঘ্যার শব্দ হয়। জানালার খিল আটকানো হয় নি। মানব আলগোছে জানালার পাল্লা ফাঁক করে। মেঘে ঢাকা শেষ রাতের জোৎস্না পা টিপে টিপে ঘরে প্রবেশ করে। অন্ধকার ঘরে ক্ষীণ আলোর সঞ্চার হয়। সেই আলোতে চৌকিতে শুয়ে থাকা মানবীর পা জোড়া দৃশ্যমান হয়। ঢিলেঢালা সালোয়ার একটু উপরে উঠেছে। জানালার শিকের ফাঁকে হাত গলিয়ে দেয় মানব।রূপোর নুপুরে সজ্জিত পা ছুঁয়ে দেয় তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে। ঘুমন্ত রমনীর কম্পন অনুভব করে বাঁকা হাসে ব্যাক্তিটি। উষ্ণ খড়খড়ে হাতের ঘর্ষণে নড়েচড়ে ওঠে রমনী। তাঁর নড়াচড়া টের পেতেই মানব পায়ের গোড়ালি মুঠোয় ভরে সজোরে টান মারে।
ধড়ফড় করে উঠে পড়ে সুরেলা। পা টানে নিজের দিকে। বাঁধা পেয়ে আত্নায় পানি শুকিয়ে যায়। ভয়ে কন্ঠস্বর রোধ হয়ে আসে। সর্বোচ্চ শক্তি খাটিয়ে পা টেনেও ছাড়া পায় না। ভয়ে চিৎকার দিবে খুব করে চেনা হাতের হাতঘড়ি দেখে চোখে মুখে বিস্ময় খেলে বেড়ায়। গায়ের কাঁথা টেনে একাংশ মুখে গুঁজে। হায় আল্লাহ! জানালার ধারে দন্ডায়মান মানব ফিসফিসিয়ে বলে,
" এই সু্র? আমি নওরিজ। ভয় পেয়েছিস?"
সুরেলার মেজাজ যেন আগুনের ফুলকি। সাপ মুখের সামনে ধরে বলে, দেখ সাপের সুরত। সুরেলা ওতশত ভাবে না। পাশে মৃদুস্বরে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন শান্তি বেগম। সে মাকে ঠেলে দেয়। শান্তি বেগম সজাগ হতে সময় নেন না। ধড়ফড় করে উঠে বসে। সুরেলা চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলে,
" ও মা? ওই দেখ খিড়কির ওইপাশে চোর দাঁড়াই আছে!"
বলতে দেরি শান্তি বেগমের চিল্লাচিল্লির ধাপ শুরু হতে দেরি হয় নি। চিল্লিয়ে 'চোর আইছে সিন, ধর ধর বেডারে' বলে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বসে থাকে। সুরেলা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে মায়ের কান্ডে। ভয়ে কাঁপছে ঠকঠক করে। এখনি ফিট না খেয়ে বসে।
জানালার ওপাশে দন্ডায়মান ব্যাক্তি ভাব প্রকাশের অবকাশ পায় না। সুরেলার পা ছেড়ে চোয়াল শক্ত করে বেরিয়ে যায়। ধরা পড়লে মান ইজ্জত ধুলোয় গড়াগড়ি খাবে। কত বড় সাহস তাকে চোর বলে গনধোলাই খাওয়ানোর পাঁয়তারা করে! হাতের কাছে পাক একবার, নানীর নাম স্মরণ করিয়ে দিবে। আহা কি রোমাঞ্চকর মুহূর্ত! তাঁর গায়ের রোমকূপ খাঁড়া হয়ে ওঠে।
সুরেলা হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে আসে। জানালার শিক ধরে উঁকি ঝুঁকি দেয়। মনে মনে তুলোধুনো করে। লুইচ্চা লোক! খুঁতখুঁইত্যা লাট সাহেব পলাইলি ক্যান? কয়েক কেজি জামাই আদর খাইয়া যাইতি!
°°°°°°°°°°
ভ্যান চালক প্যাডেল ঘুরিয়ে খান বাড়ির সামনে ভ্যান থামায়। দারোয়ানকে দেখে হেসে বলে,
"গিন্নী মায়ের বড় বোন হয়। আসেন মাল ছামানা নিয়া যাইতে সাহায্য করেন।"
দারোয়ানের মুখচোপা দেখে ঠাহর করা গেলো না বিশ্বাস করেছে কি না! সেভাবেই দাঁড়িয়ে গোঁফ মুচরাচ্ছে। ভ্যান চালক বিরক্ত হয়। এখন এসব তাকেই টেনে নিতে হবে।
ভ্যান থেকে নামে এক রমনী। জ্বল জ্বল চোখে গেইটের খোলা অংশ দিয়ে বাড়ির ভেতরে উঁকি দেয়। কত্তো বড় বাড়ি! যেন কোনো রাজপ্রাসাদ! কিশোরী আনন্দে আত্মহারা হয়ে শুধায়,
" আম্মা? এইডা রিজ ভাইয়ের বাড়ি?"
কিশোরীর আম্মা মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে বলে,
" হ আরিফা। পছন্দ হইছে শ্বশুর বাড়ি?"
আরিফা লজ্জা পায়। লাল ওড়নায় মুখ ঢেকে কোনমতে মাথা নাড়লো। রাহেলা বানু মেয়ের রক্তিম গাল টিপে বলে,
" রাজ কপাল পাইছোস রিফা। রিজের বউ মানে এই রাজপ্রাসাদের রানি তুই। রাজার হালে থাকবি।"
লজ্জায় আরিফা পারে না মাটিতে মিশে যেতে। রাহেলা বানু হেসে ভ্যান চালককে ব্যাগপত্র নিয়ে পিছু আসতে বলে। দারোয়ান তাদের ভেতরে ঢুকতে দিতে চায়না। রাহেলা বানু যেন জ্বলে ওঠেন।
" যতবড় মুখ নয় তত বড় কথা! চিনোস আমারে ফকিন্নীর বাচ্চা? এ বাড়ির বড় গিন্নীর বড় বোন আমি। রিজের বড় খালা। ক'দিন পর শাশুড়ি আম্মা হমু।"
মধ্যবয়সী মহিলার দাপট দেখে দারোয়ান দমে খানিকটা। বড় গিন্নীর আত্মীয়? বড় গিন্নীর কানে উল্টাপাল্টা কিছু বললে তাঁকে হারিকেন ধরতে হবে। সে আর বাঁধা দেয় না। আরিফা মায়ের পিছু হাঁটে। লাল ওড়নাটায় ভালো করে গতর ঢেকে নেয়। ভেতরে অনেক বেগানা পুরুষ। এরা কারা? এ বাড়ির কাজের লোক? এতো কাজের লোক? বাপরে! সে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সব। নজরে বিঁধে শান বাঁধানো পুকুর ঘাট। আনন্দে তাঁর চোখ জ্বল জ্বল করে। স্বচ্ছল টলমলে পানি দেখে এখনি ঝাপ দেওয়ার শখ জাগে। সে বিড়বিড় করে বলে,
" প্রিয় পুকুর, আমি অতি শিঘ্রই তোমাকে আলিঙ্গন করবো। তুমি কিন্তু ভাসিয়ে নিও প্রণয়ের জোয়ারে!"
হঠাৎ পুকুরের পানি থেকে এক পুরুষ মানুষ বেরিয়ে আসে। সাঁতরে ডাঙায় উঠে আসে সিঁড়ি বেয়ে। তাও আবার খালি গায়ে। আরিফার চোখের আকার বড় হয়। খোলা বুক দেখে কান গরম হয়। নজর লুকিয়ে হাঁসফাঁস করে। কি লজ্জা কি লজ্জা! এই কি রিজ ভাই? সে মাকে বলতে চায় তবে লজ্জায় বলতে পারে না। মায়ের পিছু পিছু বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলো সে। কি মনে করে ফিরে এসে আবারও উঁকি দিয়ে দেখে যায় পুরুষ মানুষটাকে!
রেবেকা বানু ছাদের রশিতে কাপড় মেলে দিচ্ছিলেন। কাজের মেয়েটার ডাকে কাজ অধরা রেখে নিচে নেমে আসেন। বসার ঘরে বোনকে দেখে খুশিতে আপ্লুত হয়ে ওঠেন। ছোট বোনদের সাথে সখ্যতা সবসময়ই ছিলো। বড় আপার সাথে তেমন ভাব নেই। বড় বলে বেশ শাসনে রাখতো। বিয়ের পর আপার সাথে যোগাযোগটা অনেক কমে গেছে। সে এগিয়ে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরে কুশল বিনিময় করে। রাহেলা বানু বোনের আপাদমস্তক দেখে অবাক স্বরে বলে,
"রেবু তুই না দিন দিন আরো সুন্দর হচ্ছিস! চুলগুলো ওহনো কাইলা কুচকুচা। আর দেখ আমার পাহা চুলের মাঝে দুই একটা কাইলা চুল!"
রেবেকা বানু একটু লাজুক হাসে। চুল এমনি এমনি তো কালো হয় নি! কি সব হেয়ার প্যাক এনে দেয় মেয়ে নওরিন, সেগুলো দিয়েই এমন। সে লম্বা চুল হাত চালিয়ে খোঁপা বেঁধে নেয়।
" কি যে বল না বুবু! বাচ্চারা শুনলে কি ভাববে? তোমার আসতে অসুবিধা হয় নি তো?"
রাহেলা বানু পান খাওয়া টকটকে দাঁত দেখিয়ে হেসে বলে,
" না কুনো অসুবিধা হয় নাই। আরিফ ভ্যানে তুইল্যা দিছিলো। একটানে আইলাম। কই? কাউরে দেখি না তো! নোমান, রমজান, তোর ছোট জা কই? রিজ বাবা সহ বাড়ির আর বাচ্চাগুলাই বা কোনে? কাউরেই তো দেখলাম না!"
আরিফ ভদ্রমহিলার ছেলে। রেবেকা বানু হেসে বলে,
" ওরা তো এখনো ঘুম থেকেই ওঠে নি। ছামিনা বোধহয় রসুই ঘরে। আমার রিফা মা কই দেখি?"
মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আরিফা আরেকটু জড়সড় হয়। এই রিজ ভাইয়ের আম্মা? তাঁর খালা হয়? সে মিনমিনে গলায় সালাম দিলো। রেবেকা বানু বোনকে ছেড়ে বোন ঝিয়ের পাশে দাঁড়ায়। থুতনি ধরে পরখ করে মুখ চোপা। খুব বেশি খুশি হতে পারেন না তিনি। আছে কোনকরম। রূপসার মতো আগুন সুন্দরী না। তবে ফকিন্নীর ঝিয়ের থেকে ছেলেকে বাঁচাতে তিনি রিফাকেও মেনে নিবেন।
" কোন ক্লাসে পড় তুমি রিফা?"
" এসএসসি পাশ করছি কলেজে ভর্তি হবো।"
রেবেকা বানুর কপালে ভাঁজ পড়ে। এসএসসি পাশ অবদি ঠিক আছে আবার কলেজে ভর্তি হবে কেন? মেয়ে মানুষ ওত পড়াশোনা করে কি করবে? রাহেলা বানু হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
" মাইয়াডা পড়াশোনায় ফাস্ট কেলাস রেবু। মেট্টিকে ওগের ইস্কুলে ফাস্ট হইছে। কলেজে ভর্তি হইবো। পড়াশোনার খুব শখ। আসলে টাকা পয়সার সমস্যা জানোসই তো। তোর দুলাভাই মরে তো শান্তিতেই আছে। আমার হইছে জ্বালা। পেটের ছল বউ পাইয়া পর হইছে। রিফারে তোর কাছে সইপ্যা দিমু একটু বিএ পাশ করাইস। ওর বাপের খুব শখ আছিলো ছেলে মেয়েরে পড়াইবো।"
রেবেকা বানু হাসার চেষ্টা করে। তাঁর ঘরে আসতে চাইলে পুঁথি বিদ্যা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। তাঁর কাছে পড়াশোনা করা মেয়ে আর কাল সাপ দু'টোর মাঝে ফারাক নেই। এরা খুব চালাক হয়। ছেলেকে আঁচলে বেঁধে নিয়ে তাকে বুড়ো আংগুল দেখাবে।
°°°°°°°°°°
বাড়ির পেছনের ছোট্ট পুকুর ঘাট ঘেঁষে দন্ডায়মান বড় আমগাছ। সেই আম গাছের ডালে বাঁধানো রশিতে উদাসী মনে দোল খাচ্ছে সুরেলা। নির্জন এদিকে দুপুরে মানুষের আনাগোনা খুব কম। সবার ধারনা এই ভর দুপুরে ভুতুড়ে কর্মকাণ্ড লক্ষনীয়। শোনা যায় কয়েক যুগ আগে এই পুকুরে কাপড় কাঁচতে এসে এক বুড়ি পানিতে ডুবে মারা যায়। তারপর থেকেই এই পুকুরে এক ধুদ্দুরি বুড়িকে কাপড় কাঁচতে দেখা যায়। তবে এগুলো সবই শোনা কথা। সুরেলা কখনো দেখে নি। তাই বিশ্বাস করে না। তবে একাকী আসতে ভয় হয়। তবে আজ যেন ভয়টা মনে গ্রাস করতে পারে না।নীলাম্বরের মতো তাঁর মনের কোণেও মেঘ জমেছে। শূন্যে ঝুলে স্বচ্ছ পানিতে নিজ প্রতিচ্ছবি দেখে যায় সুরেলা। কোমড় ছড়িয়ে ঘন কালো কেশ রাশি বাতাসে এলোমেলো উড়ছে। গায়ের মলিন ওড়নাটা ছিনিমিনি খেলছে। হঠাৎ থেমে যায় সুরেলা। নিজে থামে নি, কেউ থামিয়ে দিয়েছে। ভয়ে লোমকূপ জেগে ওঠে। কারো উষ্ণ শ্বাস বাড়ি খায় ঘারে। পিঠ উষ্ণ কিছুর সাথে লেপ্টে যায়। বুকটা বেইমানি করে বসে। ধ্বক ধ্বক শব্দে যেন ঢোল পিটিয়ে এহলান করছে।
"ডার্লিং?"
সেই চেনা পরিচিত সম্বোধন। ভুতের ভয় মাথা থেকে নামলেও নতুন ভয় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।যা কন্ঠস্বর রোধ করে দেয় নিমিষেই। নওরিজ মাহবুব রশিটা শক্ত করে ধরে আরেকটু কাছে টানে। রেশমী চুলে নাকের ডগা ছুঁয়ে দেয়। নারিকেল তেলের ঘ্রাণ নাকে বাজতেই সরিয়ে নেয় মুখ। থুতনির সহায়তায় চুল গুলো সরিয়ে ডান কাঁধে মুখ নামিয়ে নেয়।
ধারালো খোঁচা দাঁড়ির আক্রমণে সুরেলা পরনের কামিজ খাঁমচে ধরে। ভয়ংকর গালি গলা অবদি এসেও আঁটকে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যায়। নওরিজ মাহবুব কানের বালিতে নাকের ডগা ছুঁয়ে রাশভারী স্বরে বলে,
" কাল রাতে চোর বলে ধাওয়া খাইয়ে খেদিয়ে দিলি। এখন চুরি করে নিয়ে যাই?"
থেমে মুখটা কানের কাছে নিয়ে যায়। ঠোঁট চোখা করে ফু দেয় কর্ণগহ্বরে। সুরেলা মৃগী রোগীদের মতো কেঁপে ওঠে। নওরিজ ফিসফিসিয়ে বলে, "কি চুরি করবো শুনবি না?"
আবারও থেমে যায় ক্ষণপলের জন্য। রশি ছেড়ে ধাক্কা দেয় পিঠে। সুরেলা ভয় পেলেও রশি ছাড়েনা বিধায় দোল খেয়ে আবারো পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে। নওরিজ মাহবুব আবারও আঁটকে নেয়। সুরেলার বিবর্ণ মুখশ্রী দেখে বাঁকা হেসে বলে,
" তোকে চুরি করে নিয়ে যাবো। এই এক মিনিট... তুই তো আগাগোড়াই নওরিজ মাহবুব খানের। চুরি করার কি প্রয়োজন?"
সুরেলা রশি ছেড়ে নামতে নিবে বাঁধ সাধলো নওরিজ। রশি ছেড়ে কোমড় চেপে ধরে একহাতে। খানিকটা রাগি আওয়াজে বলে,
"তিড়িং বিড়িং করবি তো পুকুরে ছুঁড়ে ফেলবো। একদম চুপ? রাতের কথা ভুলি নি আমি সুর!"
" কাজ টা ঠিক করেন নাই রিজ ভাই?"
সুরেলার কন্ঠে ক্রোধ উপচেপড়া। নওরিজ এক হাতে চুলগুলো সরিয়ে সামনের দিকে দেয়। কাঁধে ঠোঁট চেপে ফিসফিসিয়ে বলে,
" কি ঠিক করি নি সুর?"
সুরেলা ছিটকে সরে যায়। রাগে লজ্জায় মুখ চোপা টকটকে হয়ে আছে। চোখের কোণায় ক্ষোভ জমায়িত। রাগে কাঁপছে হ্যাংলা পাতলা তনু।
"আপনি আপনি একটা.."
রাগে কন্ঠ স্বর জড়িয়ে আসে সুরেলার। নওরিজ একহাত পকেটে হাত পুরে এগিয়ে আসে গম্ভীর মুখে। অপরহাতে ঘার ডলে বলে,
"আমি মানুষটা সাদাসিধা নই; খুবই ভয়ংকর সুরেলা সালেহ। তোমার উপর চোখ পড়েছে মানে তুমি আমার। আর কোনো কথা নয়। এটাই শেষ কথা। আর যতদূর জানি তোমার মনেও এই ভয়ংকর লোকেরই বাস। সো যাস্ট চিল ডার্লিং?"
মেঘ গুড়গুড় করে ওঠে। দু তিনবার গর্জে বরষে ভিজিয়ে দেয় ধরনী। ভিজে যায় সুরেলা, ভিজে সম্মুখের মানব। নাক টানে সুরেলা। দু কদম এগিয়ে ভয়ঙ্কর কাজ করে। বলিষ্ঠ বুকে ধাক্কা দেয় সর্বশক্তি দিয়ে। হঠাৎ আক্রমণ নওরিজের ভাবনার বাহিরে। তাল সামলাতে না পেরে পুকুরে পিছলে পড়ে। যেন কলাগাছ ভেঙে পড়লো। নওরিজ মাহবুব খানিকটা নাকানিচোবানি খেয়ে মাথা তুলতেই কিছু এসে মুখে বাড়ি খায়। উটকো উদ্ভট গন্ধে জ্ঞান হারানোর উপক্রম তাঁর। সুরেলার হাতের গোবর বৃষ্টির পানিতে চুঁইয়ে পড়ে। দৌড়ে চলে যায় বাড়ির দিকে।
°°°°°°°°°°°°°°°
খান বাড়ির অন্দরমহলের ছোট্ট বারান্দায় আড্ডা বসেছে। ছোট বড় সবাই উপস্থিত। হাসি মজায় মুড়ি মাখার মুঠোর সাথে মেতেছে বৃষ্টির ছন্দে। টিপ টিপ বৃষ্টির ছন্দপতনে ছোট্ট বারান্দায় পানি জমেছে। টলমল পানির হাসির ঝলক দেখে রূপালির লোভ জাগে বৃষ্টির পানিতে লাফানোর। নিজের উঁচু পেক দেখে ইচ্ছেকে দমিয়ে নিলেও বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারে না। উঠে যাবে কেউ হাত ধরে বসিয়ে দেয়। হাতটা আর ছাড়ে না। ঠান্ডা আবহাওয়ায় উষ্ণ হাতের ওম ভালো লাগে বেশ তবে হাতের মালিকের গম্ভীর মুখ দেখে ভালোলাগা উবে যায়। জোর খাটিয়ে ছাড়িয়ে নেয় হাত। একটু হাসলে কি সমস্যা? নাকি বৃষ্টির জন্য বাড়ি ফিরতে পারছে না বলে মায়ের খোকার মুখে আঁধার নেমেছে! সাদমান হাত গুটিয়ে নেয়। কন্ঠ খাঁদে নামিয়ে বলে,
"আমরা বিকেলেই রওনা হবো। বৃষ্টিতে সমস্যা হবে না। গাড়ি আসছে। আম্মা ফোন করেছিলো। ঝড় বইছে সেখানে। জলদি ফিরতে বলেছে।"
রূপালীর মুখটা মলিন দেখায়। অভিমানটাও করতে ইচ্ছে করে না। মান অভিমান তাঁর সাথেই হয় যে অভিমান বুঝে তা মিটাতে আকাশ জমিন এক করে দেয়। এ লোক তো অনুভূতিহীন। বউয়ের রাগ অভিমানে কিচ্ছু যায় আসে না।
" আপু, ছোট দুলাভাই, রিফা আপু লুডু খেলবেন সবাই? অনেক মজা হবে! আনবো?"
রূপসার উচ্ছ্বসিত গলায় বলে ওঠে। সাদমান ছোট্ট করে মানা করে দেয়। সে খেলবে না। ছবিও খেলতে পারবে না। রূপসার রাগ হয় প্রচুর। নিজে তো খেলবেই না আপুকেও খেলতে দিবে না। বড় দুলাভাই, নওরিন আপু থাকলে ভালো হতো। আর রিফা আপু তো লজ্জায় লাল নীল হয়ে বসে আছে। রূপসা গোমড়া মুখে বসে থাকে। নোমান মাহবুব ভাতিজির গোমরাহ মুখ দেখে হেসে বলেন,
" রূপসা আম্মা, যাও লুডু আনো। আমি আর তুমি খেলবো।"
রমজান মিয়াও খেলবে জানান। রূপসা খুশি হয়ে চলে যায় লুডু আনতে। বারান্দার এক কোণায় মায়ের পাশে পিঁড়িতে বসে আরিফা রূপসার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়। মেয়েটা দেখতে একদম পুতুলের মতো সুন্দর। আর তোতা পাখির মতো কথা বলে। বেশ লাগে দেখতে। রূপসা চলে যেতেই আরিফা ঘার ফেরায়। উত্তর দিকের দরজায় চোখ পড়তেই রওশনকে চোখে পড়ে। সকালের দৃশ্য মনে পড়তেই লজ্জায় লাল হয় মুখশ্রী। ইশ্ লোকটাকে রিজ ভাই ভেবেছিল অথচ উনি রিজ ভাইয়ের চাচাতো ভাই রওশন মাহবুব; রূপসার বড় ভাই। আরিফা নজর সরিয়ে নিলেও বেহায়া চোখ ঘুরে ফিরে সেদিকেই চলে যায়। ইশ্ কী লজ্জা জনক ব্যাপার! রিজ ভাইয়ের সাথে তাঁর বিয়ে হলে লোকটা তাঁর দেবর হবে। আর তার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে সে! লজ্জায় নিজের কাছেই কেমন লাগে।
রওশন খেয়াল করে আরিফার লজ্জা পাওয়া। ভ্রু কুঁচকে যায়। এই মেয়ে কথায় কথায় এতো লজ্জা কোথা থেকে আনে? এসেছে নাস্তে লাল টমেটো হয়েই বসে আছে। রেবেকা বানু ও ছামিনা বেগম চা বিস্কুট নিয়ে উপস্থিত হয়। সবার ভিড়ে ছেলেকে না দেখতে পেয়ে বলেন,
" এই রিজ এখনো ফিরলো না। সেই সকাল ভোর থেকেই গায়েব! কোথায় গেছে বলেছে কিছু?"
নোমান মাহবুব চায়ের কাপ হাতে নেন। ছেলের প্রসঙ্গ আসতেই মুখটা গম্ভীর হয়ে আসে।
"সে কারো কথা শোনে? নিজ মন মর্জিমাফিক চলবে। বাপ চাচার পরামর্শ কানে তুলেছে এ জনমে?"
রেবেকা বানুর কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে। ভদ্রলোক ছেলের প্রশংসা করতে কখনো হয়রান হয় না সেই লোক এ কথা বলছে। কি হয়েছে আবার? তিনি স্বামীর দিকে তাকায় সন্দেহভাজন চোখে। নোমান মাহবুব হতাশ চোখে চায়।
রওশন এগিয়ে এসে চাচির হাতের চা নিয়ে চাচার পাশে বসে আয়েশ করে। চায়ের কাপে গলা ভিজিয়ে সাহস জোগায়। নোমান মাহবুব ভাতিজার ভাবভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারে কি বলতে চাইছে। তিনি রমজান মিয়ার দিকে তাকায়। রমজান মিয়াও ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে। ছেলের উপর বিরক্ত প্রকাশ করে বড় ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলেন,
" ভাই আমি কি বলবো, কি করবো বুঝতে পারছি না। ছেলেকে বুঝিয়েও তো কাজে দিচ্ছে না। আপনি একটু দেখুন না? ও প্রস্তাব পাঠানোর কথা বলছে ওই মেয়েটার বাড়িতে।"
ছামিনা বেগম সুযোগ হাতছাড়া করেন না। ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, "আমার রওশন কখনো কোনো কিছুর জন্য জেদ করে নি। প্রথমবার মুখ ফুটে কিছু চেয়েছে বড় ভাই। আশা করি আপনি ওর আবদার ফেলবেন না। আমার ছেলেটা শেষ হয়ে যাবে। রিজ তো বুঝদার ছেলে ঠিক মানিয়ে নিতে পারবে।"
নোমান মাহবুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছু বলবেন এমন মুহূর্তে অন্দরমহলের প্রবেশ দ্বার কারো আগমন বার্তা দেয়। ভেজা গায়ে এগিয়ে আসে নওরিজ মাহবুব। মেঝে ভিজে যায় গা বেয়ে পড়া পানিতে। রেবেকা বানু হায়হুতাশ করে বলেন,
" আব্বা ভিজেছেন কেন? আবারও অসুখে পড়ার পাঁয়তারা তাই না? ইশ্ জলদি ঘরে যান আমি গরম পানি দিচ্ছি গায়ে ঢালবেন।"
নওরিজ মাহবুব ছোট উঠোনে নেমে আসে। আবারও বৃষ্টিরা ভিজিয়ে দেয় গতরখানি। মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,
" আগে কথাটা একটু ক্লিয়ার করে নি! চাচি আম্মা, চাচাজান, রওশন আম্মা সবাই শুনবেন মনোযোগ দিয়ে।"
রওশন উঠে দাঁড়ালো। রিজ ভাই কি বলবে শোনার ইচ্ছা জাগে না। চলে যাবে নওরিজ গম্ভীর সুরে থামতে বলে। বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
" পয়গাম পাঠানো হবে। খুব শিগগিরই। কাল বা পরশু যেদিনই হোক। ব্যাপারটা খুবই শ্রুতিকটু শোনায়। দুই ভাই এক মেয়ে.."
ব্যাপারটায় কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না নওরিজ। কিন্তু কিছুই করার নেই। ছোট শ্বাস ফেলে বলে,
" আমি আগেও বলেছি সুরেলা সালেহ খান বাড়িতে বড় বউ হয়ে আসবে। রওশন তুই আমার ছোটভাই কথাটা বলতে আমি কতটা লজ্জায় পড়ছি বোঝাতে পারবো না। তবুও বলছি ভুলে যা তাকে। সে না তোর ছিলো, না কখনো হবে।"
"ভুলে যাওয়া এতোটাই সহজ? তাহলে বলি তুমি ভুলে যাও রিজ ভাই? ছোট ভাইয়ের জন্য এটুকু করতে পারবে না?"
রওশনের কন্ঠে নেই দ্বিধাবোধ। সে জানে রিজ ভাইকে। সেই ছোট থেকেই। প্রাপ্তির ঝুলিটা যে ফাঁকা রবে তা বুঝতে বাকি থাকেনা। হাসি পায় নিজ ভাগ্যের ওপর। নওরিজ মাহবুব গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে। নোমান মাহবুব উঠে এসে ভাতিজার কাঁধ জড়িয়ে বলে,
"তোর জন্য পুরো সাত গাঁ ঘুরে লাখে একটা মেয়ে আনবো রওশন। মেয়েকে দেখে সুরেলা নামে কাউকে চিনতিস বলতেই পারবি না।"
রওশন হাসে। সেই হাসিতে তাচ্ছিল্য ঠিকরে বেরিয়ে আসে। নওরিজের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বলে,
" এটা কোনো ছোট খেলনা গাড়ি নয় যে একটার বদলে দশটা এনে দিলেই ভুলে যাবো। ভালোবেসেছি বলেই তাকে পেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। কখনো কখনো অপূর্ণতাই বেশিই সুন্দর দেখায়। শুভকামনা রিজ ভাই!"
রওশন উত্তর মুখী দরজা দিয়ে চলে যায় ভেতরে। আরিফা সজল চোখে তাকিয়ে দেখে লোকটার প্রস্থান। আশ্চর্য তাঁর কেন কান্না পাচ্ছে? রাহেলা বানু বেজায় চটে যান। রেবেকা ফোন করে প্রস্তাব দিলো বিধায় তাঁরা এসেছে অথচ এখানে দেখছি আরেক রঙ লীলা চলছে। ছবি বাড়ন্ত পেটে হাত রেখে ভাইয়ের পিছু পিছু যায় ধীর পায়ে। সাদমান বারন করলেও শোনে না। রূপসা লুডু বুকে জড়িয়ে এক কোণায় দাঁড়িয়ে। ভাইয়ের জন্য মনটা কাঁদে। এই এক সুর আপার মধ্যে কি আছে? রেবেকা বানু এতক্ষণ অনেক কষ্টে চুপ থাকলেও এবার আক্রোশে ফুঁসে ওঠেন।
" রিজ ওই ফকিন্নীর ঝিয়ের মধ্যে কি আছে? না আছে চেহারা সুরত না কোনো গুন। ভাইয়ের মতোই বেয়াদব। ওর মা আমাদের বাড়ি কাজ করতো। ওর বাপ তো আরেক জোচ্চুর। পা চাটা চামচা। তুই সেই মেয়ের জন্য পাগল হলি? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না আমার ছেলের অধঃপতন। ছোট থেকেই দেখে আসছি আমার ছেলের পছন্দ। কেউ আঙ্গুল তুলতে পারবে না। আর সেই তুই কি না? এখনো সময় আছে রিজ ওসব থেকে বেরিয়ে আয়। মাটি থেকে নজর তুলে উপরে দেখ। ওই মেয়ে তোর নখেরও যোগ্য না..."
মা'কে থামিয়ে দেয় নওরিজ। গম্ভীর ভারী গলায় বলে,
"তাঁর মাঝে কিছুই নেই। সে সাধারণ, আর তাঁর সাধারণ ভাবভঙ্গি আমাকে টানে। আপনার ছেলের পছন্দ নয় সে। সে আপনার ছেলের জীবনের একটা অংশ।"
থেমে হালকা হাসার চেষ্টা করে বলে," আম্মা অনুরোধ আপনি বাংলা সিনেমার মতো বিষ খাবো হ্যান ত্যান হুমকি দিবেন না। জীবনটা আমার। তাই আমার মতো উপভোগ করতে দিন। শুধু স্নেহের হাতটা মাথায় রাখবেন।"
" আমি কখনোই তাকে মেনে নেবো না রিজ। ওই মেয়ে এ বাড়িতে ঢুকলে আমি গৃহ ত্যাগ করবো।"
রেবেকা বানু থমথমে গলায় বলে। দূরে দন্ডায়মান রূপসা মিহি সুরে হেসে দেয়। চাচি আম্মার হুমকিটা সিনেমার মতো শোনালো না? বেশ কয়েক জোড়া চোখ তাঁর দিকে তাকিয়ে। রূপসা আমতা আমতা করে কেটে পড়ে। নওরিজ মাহবুব হেসে বলে,
" ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর আম্মা। তবে মনে হচ্ছে শিঘ্রই বউ শাশুড়ির যুদ্ধ নামক ধারাবাহিক খান বাড়ির পর্দায় আসছে।"
"রিজ? এসব তুই বলছিস? আমার বিশ্বাস করতে অসুবিধা হচ্ছে। নিশ্চয়ই.."
" হ্যাঁ আম্মা কিছু একটা জাদু তো করা হয়েছেই। ওঝা ডাকতে পারেন!"
রেবেকা বানুকে থামিয়ে নওরিজ বলে ওঠে। বৃষ্টির গতি কমে আসছে ধীরে ধীরে। নওরিজ নাক ডলে। আবারও জ্বরের খপ্পরে পড়তে হবে মনে হচ্ছে। রেবেকা বানু রাগে গজগজ করতে করতে আরো অনেক কিছুই বলে। নওরিজ সবটা উপেক্ষা করে দক্ষিণা দুয়ারের দিকে পা বাড়িয়ে নোমান মাহবুবের উদ্দেশ্যে বলে,
" তাড়াতাড়ি পুত্রবধূ ঘরে তোলার বন্দোবস্ত করুন আব্বা। কাল গিয়ে নাকশলা পড়িয়ে দিনক্ষণ ঠিক করে আসবেন!"
নোমান মাহবুব বিরক্ত মুখে বলে, "আজকে গেলে আরও ভালো হবে না?"
নওরিজ ঘার ফিরিয়ে বলে, "না! আম্মার মাথাটা ঠান্ডা হওয়ার সময় তো দিবেন! নইলে ব্লাস্ট হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।"
আরিফা ফিক করে হেসে দেয়। রেবেকা বানুর শাণিত চাহনিতে ওড়নায় মুখ লুকিয়ে নেয়। নওরিজ মাহবুব হেসে চলে যায় ঘরে। রেবেকা বানু আক্রোশে ফেটে পড়েন ছেলের কথায়। নোমান মাহবুব বিরক্ত হয়ে চলে যান।
.
.
.
চলবে.....................................................................