মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ৭৭ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


          নিজেদের বাড়ির বিপরীত পাশে ছড়িয়ে থাকা ঘন জঙ্গলের গভীরে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিশাল উদ্ভিদ। উদ্ভিদের মোটা ডালপালা চারদিকে প্রসারিত। দেখে মনে হয় নিজস্ব এক রাজত্ব গড়ে তুলেছে উদ্ভিদটি। পুরু, বৃহৎ পাতাগুলো বিস্তৃত হয়ে অনেকটা স্থান ঢেকে রেখেছে। তবুও বৃষ্টির পানি থামাতে পারেনি। পাতার ফাঁক গলে টপটপ করে ঝরে পড়ছে বৃষ্টির পানি। ভিজিয়ে দিচ্ছে কৌশিকের সারা দেহ। কৌশিক বসে আছে সেই উদ্ভিদের ছায়ায়। নীরব এবং অবশ তার আচরণ। শরীরের শিরা-উপশিরাগুলো আবার সেই অস্বাভাবিক নীল রঙে রঞ্জিত। যেন রক্তের পরিবর্তে বিষ বয়ে চলেছে শিরা উপশিরাগুলো। অন্তরে মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার দাহ কিছুটা প্রশমিত হয়েছে বটে। কিন্তু শান্তি! শান্তি নামক অনুভূতি তো এখনো অনেক দূরের নামহীন স্বপ্ন ই রয়ে গেছে। কৌশিকের মুখভরা যন্ত্রণা। চোখের গভীরে অশান্ত ও অনড় শূন্যতা।

বহু বছর আগে কৌশিক কোনো নতুন জীবন ফিরে পায়নি। শৈশব থেকেই তার জীবনে ছিল কেবল শাস্তি। কিন্তু সে হয়তো সয়ে নেওয়ার শক্তি নিয়েই জন্ম নিয়েছিল। তাই তো সবটাই সয়ে নিয়েছে কৌশিক।
প্রথমে পরিবারের চিরতরে হারানো, তারপর হুডো শহরের কিছু মানুষের অবর্ণনীয় অত্যাচার। প্রতিশোধের নেশায় ধীরে ধীরে সে মানুষ হতে ভুলে গিয়েছিল। আর সবচেয়ে বড় শাস্তি ছিল অমৃতশক্তিকে নিজের শরীরে ধারণ করা। অজানা আতঙ্কে কৌশিকের চোখের কোণে জমে উঠল অশ্রু। কৌশিক উপরে তাকালো। ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টির পানিকণা তার অশ্রু ধুয়ে দিলো। কৌশিক মুচকি হাসলো। কিন্তু হৃদয়ে ব্যথা তো রয়েই গেল।
সেদিন রাজকুমারীকে মেরে ফেলার পর কৌশিক বসেছিল রাজার সিংহাসনে। নিজের হুশ হারিয়ে ফেলেছিল বহু আগেই। শক্তির বোঝা ওর শরীরে এমন এক বিকট প্রভাব ফেলেছিল যে সে এক ভয়ঙ্কর লোভের দাসে পরিণত হয়েছিল। রাজার আসনে বসার পর আরহেনিয়ার রাজ্য ধীরে ধীরে শূন্য হতে শুরু করে।
কারণ কৌশিক তখনকার কায়েরীথ সেই রাজ্যটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে ফেলছিল। যেই সাহস করে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করত কায়েরীথের এক আঙুলের ইশারাতেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ত।

এভাবেই কৌশিক! অথবা কায়েরীথ সময়কে সাক্ষী রেখে হিংস্র এবং ভয়ঙ্কর এক দানবের নামে পরিচিতি পেয়েছিল। অনেক বছর সে আরহেনিয়াতেই ছিল। সেই শক্তির বশে রাজ করছিলো। আরহেনিয়ায় মানুষ তখন কম ছিল বটে। তবু কৌশিক বেশ কয়েক বছর এক ধরনের মিথ্যা সুখের ভেতরেই কাটিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই অমিত শক্তির উপর আস্তে আস্তে নিজের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায় কৌশিক। আর তখনই ভেতর থেকে প্রচন্ডরূপে ভেঙে পড়ে সে। একদম যেরকমটি হয়েছিল আরহেনিয়ার পূর্বপুরুষের সাথে। কৌশিক বুঝতে পেরেছিলো সে যা কোনোদিন চায়নি তাই সে করে ফেলেছে এই কয়েক বছর। সে তো কখনো কারও উপর অত্যাচার করতে চায়নি। কখনো কোনো নির্দোষের প্রাণ কেড়ে নিতে চায়নি। তবুও করেছে। নিঃসংকোচে এবং নির্দয়ভাবে করে ফেলেছে সে। আর এই উপলব্ধিই তাকে ভেতর থেকে ছিঁড়ে ফেলছে। নিজের উপর ধিক্কার জানিয়ে অসংখ্যবার ভেবেছে ল্যুমিস নদীর গভীরে গিয়ে সব শেষ করে দেবে। তবু বেঁচে থেকেছে। কিন্তু কেন? কৌশিক নিজেও জানত না স্পষ্ট করে। শুধু মনে হত কোনো এক অজানা উদ্দেশ্য এখনো তার জীবনের পাতায় লেখা রয়ে গেছে।

ধীরে ধীরে দুনিয়ার বদলে যাওয়া দেখলো কৌশিক। নিজেকে সময়ের সাথে সাথে নতুন ভাবে তৈরি করলো এবং নিজের শক্তিকেও নিয়ন্ত্রণে রাখলো। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য মানুষের প্রাণ নেওয়াও বাঞ্ছনীয় ছিল যা কৌশিকের কাছে অপছন্দনীয় একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকার লোভ সে সামলাতে পারেনি। আর সেই অজানা উদ্দেশ্য হয়তো রাজকুমারী আরিসার অপেক্ষা করাই ছিল। কিন্তু ভাগ্যের আশ্চর্য খেলায় এগিয়ে এলো অনন্যা। অনন্যাকে বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে এখন নিজেকেই শেষ করে ফেলছে কৌশিক। কিন্তু এতে কোনো আফসোস নেই কৌশিকের। সবচেয়ে বড় আফসোস হচ্ছে মানুষের প্রাণও শেষ করে দিচ্ছে নিজের অজান্তেই। এ কি সত্যিই জীবন? নাকি এক অন্তহীন অভিশপ্ত যাপন!

কৌশিক উঠে দাঁড়ালো। আচমকা দূর থেকে অনন্যার কণ্ঠস্বর কানে ভেসে উঠল। কৌশিক চমকে উঠলো। চোখ ঘুরিয়ে চারপাশে তাকালো। মনের অন্তরে অজানা আশঙ্কারা ঘুরঘুর করতে লাগলো। অনন্যার মনের আওয়াজ এখনো কানে বাজছে। কিন্তু এর অর্থ কি অনন্যার জ্ঞান ফিরেছে আর কৌশিককে খুঁজতেই বাড়ি ফিরছে সে? কৌশিক দেরি করলো না। নিজের সমন্বিত শক্তি ব্যবহার করে বাতাসের মাঝে মিলিয়ে গেলো সে। 

******

নিক বাসায় এসেও বারবার ভেনোরাকে ফোন করে চলেছে। মাথা কাজ করছে না তার। এদিকে লারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কৌশিকের সেই ভয়ংকর রূপ দেখে ভেঙে পড়েছে সে। কৌশিক নাকি বাসায় এসেছিল। দানবের মতো সবকিছু তছনছ করে দিয়ে চলে গিয়েছিল। লারার কোনো ক্ষতি করেনি এটাই অনেক। তামং লারাকে নিয়ে হসপিটালে ছুটছে। নোহারার সাথেও কথা হয়েছে নিকের। জানা গেছে অনন্যার নাকি জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু কৌশিকের কোনো খোঁজ নেই। দুই পাগলকে নিয়ে এতোদিন একসাথে ছিল নিকোলাই ভেস্পার। এখন তাদের একজন হুট করে হারিয়ে গেছে। তো আরেকজন কিছু একটা করে বেড়াচ্ছে যা সামলানোই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা সামলানোর জন্য প্রথম পাগলকেই দরকার। কিন্তু নেই! ভেনোরাকে পাওয়া যাচ্ছে না।

বৃষ্টির মধ্যে ভিজে কোনো মতে বাড়িতে ফিরেছে অনন্যা। সাথে এসেছে নোহারাও। বাড়িতে প্রবেশ করেই অন্য কোথাও ধ্যান না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরের রুমের দিকে চলে যায় অনন্যা। নিক কয়েকবার বলেছিল, কৌশিক বাড়িতে নেই। তবুও শুনলো না মেয়েটা। নিজের চোখে না দেখা পর্যন্ত অনন্যার শান্তি নেই। হয়তো বুকের ভেতরকার সেই দুঃসহ শূন্যতার জন্যই এমনটা করছে অনন্যা। নিকের ও খুব ভয় করছে। কৌশিকের কি হবে তাই নিয়েই তার সব চিন্তা। 

নোহারা চিন্তিত মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে নিকের দিকে। চোখের পাতা দুটো নড়ছে না। স্থির হয়ে আছে সামনের মানুষটির দিকে। সামনের মানুষটির চিন্তা সেও খুব ভালোভাবে পড়তে পারছে। কিন্তু পরিস্থিতি যে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে যাচ্ছে। নোহারা ভাবতে ভাবতেই নিক ওর দিকে তাকালো আর আচমকাই এগিয়ে এসে নোহারাকে জড়িয়ে ধরলো। নোহারা চমকে উঠলো। অপ্রত্যাশিত ছিল এই জড়িয়ে ধরা। বুঝতে পারেনি এই অসময়েও নিক এমনটা করে বসবে।

নিক নোহারার কাঁধে মাথা রাখলো শক্ত করে। ধীরে কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বললো,
"লিটেল গার্ল, কিছু বুঝতে পারছি না আমি।"

নোহারাও ধীর কণ্ঠে বললো,
"সব ঠিক হয়ে যাবে।"

"এতো সহজে ঠিক হওয়ার নয়, নোহারা।
যদি সবকিছু এত সহজ হতো, তাহলে তো ভালোই ছিল। কৌশিকের কর্মকাণ্ড যদি কারো কাছে ধরা পড়ে ওকে নিয়ে তো বড় বড় নিউজ হবে। ইতিমধ্যে অনেকে আঁচ করতে শুরু করেছে এটা কোনো সাধারণ মানুষের কাজ নয়। কোনো মানুষরূপী দানবের কাজ। আর কৌশিক যা করে বেড়াচ্ছে তা তো ঠিক নয়।"

নোহারা নিকের পিঠের উপর দুই হাত রেখে আঁকড়ে ধরলো। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
"তোমরা তো শুরু থেকেই এসব করছো। কৌশিক স্যার আগে যা করতো ধীরে-সুস্থে করতো। এখন কেবল তার গতি বেড়ে গেছে এইটুকুই পার্থক্য। তাহলে তখন যা করেছিল সেটা ঠিক ছিল? এখনই বা কেন ভুল?"

নিক চুপ করে গেলো। নোহারার কথার উপর আর কোনো কথা খুঁজে পেল না। কিন্তু প্রশ্নটা বুকের ভেতর ছুরির মতো বিঁধে রইলো। এই পৃথিবীতে কি তাদের আর থাকার কোনো অধিকার আছে? সময় কি এসে গেছে চলে যাওয়ার? আর ভেনোরা? ভেনোরাই বা কোথায়?
ভেনোরাকে তো একমাত্র কৌশিকই ডেকে আনতে পারতো। তবে কি ভেনোরাও কোথাও হারিয়ে গেলো?

******

অনন্যা কৌশিক স্যারের রুমে এসে ঠেস মেরে দাঁড়িয়ে আছে। পা দুটো আর চলছে না। স্যার নেই রুমে। জিনিসপত্র উল্টেপাল্টে পড়ে আছে। মেঝেতে ভাঙাচোরা কিছু জিনিস। আঁধার ঘরের ভেতর তীব্র শূন্যতা চিৎকার করছে। মনে হচ্ছে এই রুমের ভেতর দিয়ে বড় এক ঝড় বয়ে গেছে। কৌশিক স্যার এখানে এসেছিলেন। তার নিঃশব্দ সাক্ষ্য রয়ে গেছে। কিন্তু এখন কোথায় তিনি? কি অবস্থায় আছেন? অনন্যার বুকের ভেতর হাহাকার করতে লাগলো। তিনি তো ওকে সুস্থ করে দিয়েছিলেন। তবে নিজে এতো কষ্ট নিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলেন? খুব কী ভয়ংকর যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি?

অনন্যা চায় সেই কষ্টের ভার ভাগ করে নিতে। চায় তাঁর পাশে দাঁড়াতে। কিন্তু কেনো বারবার কৌশিক স্যার নিজেকে এভাবে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেন? কেনো বারবার অনন্যাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেকে এতো নিঃশেষ করে দেন তিনি? হঠাৎ মনে হলো ওর রুমেও তো থাকতে পারে। 

অনন্যা ছুটে গেলো নিজের রুমে। অনন্যার রুমের দরজাটাও খোলাই ছিল। ধীরে ধীরে রুমে প্রবেশ করলো সে। বুকটা ধড়ফড় করছিলো কিন্তু রুমে এসে হতাশ অনুভব করলো অনন্যা। কেউ নেই এই রুমে কেউ নেই। অনন্যা বিছানায় এসে ধপ করে বসে পড়লো। নিজের মাথার ব্যান্ডেজটা টেনে ছিঁড়ে ফেললো। বিরক্ত লাগছে তার। কিছুই ভালো লাগছে না। কৌশিক স্যারের অগোছালো কথাগুলো বারবার মনে পড়ছে। কানে বাজছে প্রতিটি কথা। এই তো কিছুদিন আগেই লোকটা প্রকাশ্যে অনন্যাকে ভালোবাসি বললো। অথচ প্রথম প্রথম বলতো মানুষেরা বোকা ! বোকা বলেই তারা ভালোবাসতে জানে। কিন্তু শেষমেশ লোকটা বোকা হয়েই গেলো তাই না? এজন্যই তো অনন্যাকে বাঁচানোর জন্য আবারো নিজেকে ব্যবহার করলো। 

অনন্যা হেসে ফেললো। চোখ তুলে সামনে তাকালো সে। আর তাকাতেই তার নজর আটকে গেলো আলমারির দিকে। একটি সাদা আলো আলমারির কোণ থেকে বেরিয়ে আসছে কিন্তু আলমারির ভিতরে এমন কিছু তো নেই যে আলো জ্বলে উঠবে। অনন্যা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো সামনে। আলমারি খুলে ফেললো। আলমারি খুলতেই তীব্র আলোর ঝলক চোখে এসে পড়লো। আলোর তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে অনন্যা নিজের চোখে হাত রাখলো। সময় নিয়ে ধীরে ধীরে হাত সরিয়ে সামনে তাকালো। আর তখনই তার চোখে পড়লো কৌশিক স্যারের সেই তিনটি গোলাপ যা একদিন সাদা গোলাপ ফুলে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল আর এখন সেটা আলোর মতো ঝলমল করছে।

অনন্যা ভ্রু কুঁচকে সাদা গোলাপের দিকে এগিয়ে গেলো।নিজের হাত রাখতেই গোলাপের ধারালো কাঁটা তার আঙুলে ঢুকে গেলো আর রক্ত ঝরলো। আঙুলের মধ্যে তীব্র ব্যথা অনুভব করলো সে। তারপর দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো। হাত ঝাড়া দিলো কিন্তু রক্তের ধারা থামলো না।
অবিশ্বাস্যভাবে তার আঙুল থেকে রক্ত পড়ে যেতে লাগলো। অনন্যা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। কি করবে বুঝতে পারছিলো না। কিন্তু কিছু একটা ঘটে যাচ্ছিল যা সে প্রত্যাশা করেনি। হাতের রক্ত ঝরানোর ফলে সেই সাদা গোলাপে কয়েক বিন্দু রক্ত পড়তেই
চারপাশের আবহাওয়া বদলে গেলো। হাওয়া ভারী হয়ে উঠলো মাটিতে এক ঠাণ্ডা পরিবেশ ফিরে এলো। অনন্যা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।মনে হলো পৃথিবী থেমে গেছে এই মুহূর্তে আর ওর চারপাশে অজানা শক্তি গুঞ্জন তুলছে।  

অনন্যা চোখের পলক ঝাপটালো। মূহুর্তের মধ্যেই তার মণি দুটোয় অন্য কিছু ভেসে উঠলো। হসপিটালের বিছানায় শুয়ে থাকা সেই অতীতের স্মৃতিগুলো উজ্জীবিত হয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে অনন্যার আচরণ পরিবর্তন হয়ে যেতে লাগলো। তার শরীরে এবং মস্তিষ্কের অলিগলি জুড়ে এখন শুধু রাজকুমারী আরিসা বিষাক্ত পোকার মতো আক্রমণ করে বসলো। রাজকুমারী আরিসা নিয়ন্ত্রণ করে ফেললো অনন্যাকে । যেই ফুলগুলোয় কৌশিক নিজের অনুভূতি রেখে গিয়েছিল ঠিক সেই ফুলগুলোই কাজে লাগিয়েছে রাজকুমারী আরিসা। বেশ অনেকদিন আগে বজ্রপাতের রাতে কৌশিক একজন সৎ এবং বিশ্বাসযোগ্য এক মানুষের প্রাণ নিয়েছিল। আর সেই সৎ মানুষের প্রাণ নেওয়ার কারণে আরিসা কারণ খুঁজে পেয়েছিলো কৌশিককে মেরে ফেলার। আরিসার প্রতিজ্ঞাও ছিল প্রথম কারণ কিন্তু দ্বিতীয় কারণ ছিল বিশুদ্ধ কোনো মানবকে মেরে ফেলা। এই পৃথিবী মিথ্যায় ভরপুর। সকলেই কোনো না কোনো খারাপ কাজ করেছে। সকলেই পরে গিয়ে তাদের ফল পাবে। কিন্তু যে বিশুদ্ধ যার কোনো লোভ ছিল না, যে কোনোরূপ হিংসায় ছিল না তাকে মেরে ফেলা মানে অনেক বড় দুর্গতি ডেকে আনা। আর ঠিক সেই কারণে কৌশিকের সেই লাল গোলাপ সেদিন সাদা গোলাপে পরিণত হয়েছিল। আর রাজকুমারী আরিসা খুঁজে পেয়েছিল কারণ আর খুঁজছিলো সুযোগ। আর এসে গেছে সেই সুযোগ।

অনন্যা অনিয়ন্ত্রিতভাবেই নিজের রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সটান হয়ে হাঁটতে লাগলো সে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে দেখলো একজন ফর্সা ধরনের বলশালী পুরুষ দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো তার দিকে। নিক নরম গলায় বললো,
"বলেছিলাম তো পাবে না রুমে। তাও শুনলে না আমার কথা।"

"কোথায় সে?"
অনন্যার চোখের দৃষ্টি ভিন্ন এবং কঠোর দেখাচ্ছে হঠাৎ। নিক সন্দেহের সহিত তাকালো। পাশে নোহারাও দাঁড়িয়ে ছিল। সে এগিয়ে বললো,
"অনন্যা, বাদ দে। বাসায় চল। তোর শরীর ঠিক নেই।"

"আমি জানতে চেয়েছি কোথায় সে?"
অনন্যা কঠোর গলায় আবারো প্রশ্ন করে বসলো। নিজের দিকেই তাকিয়ে ছিল অনন্যা। তাই নিক হাত নাড়িয়ে বললো,
"তোমার হাসবেন্ড কোথায় সেটা তুমিই ভালো বলতে পারবে।"

অনন্যা আরো জোরে চিৎকার করে বললো,
"আমি যদি জানতাম এক্ষুনি এই দুই হাত দিয়ে পিষে ফেলতাম। কিন্তু জানি না আমি। তাই জানতে চাইছি কোথায়! কোথায় ওই অমানুষটা?"

নিক আর নোহারা স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলো। অনন্যার এরকম অদ্ভুত কথাবার্তা দুজনের কারোরই মাথায় ঢুকছে না। আর যেই মানুষটিকে অনন্যা ভালোবাসতো এখন তাকেই মেরে ফেলতে চাইছে? এ কেমন কথা? নোহারা এগিয়ে অনন্যার কাঁধে হাত রেখে বললো,
"শোন আমার মনে হচ্ছে তোর কোনো সমস্যা হয়েছে। বাসায় চল। একটু ঘুমিয়ে নিবি আয়।"

অনন্যা দাঁত কিরমির করে তাকালো নোহারার দিকে। তীক্ষ্ণ সেই দৃষ্টি শরীরে চাবুক মারার মতো লাগলো নোহারার কাছে। নোহারার মনে হলো এটা অনন্যা নয়। অনন্যা কখনো ওর দিকে এমন করে তাকায়নি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনন্যা নোহারার গালে চড় মেরে বসলো। নোহারা স্তব্ধ হয়ে গেলো।

"আপনাকে মুখ খুলতে কেউ বলেছে?" অনন্যা কঠোর গলায় বলে উঠলো। "যাকে আমি জিজ্ঞেস করেছি, সে কেনো উত্তর দিচ্ছে না? আমি কথার মাঝে বিরক্ত করা একদম অপছন্দ করি।"

নিক দ্রুত নোহারাকে গিয়ে ধরলো। অনন্যার দিকে তাকিয়ে বললো,

"এই মেয়ে তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? ওকে মারলে কেন?"

অনন্যা নিকের কথার কোন উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। নোহারা নিজের গালে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। অনন্যা কখনো এমন করেনি ওর সাথে। ওদের দুজনের সম্পর্কটা বোনের মতো ছিল। অথচ আজ সেই হাতটাই ওর গালে এতো জোরে চড় বসালো। ভাবতেই কান্না এসে পড়ছে। চোখ ইতিমধ্যেই ছলছল করা শুরু করে দিয়েছে। 

নিক নোহারার গালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
"মেয়েটা হয়তো খুব শকে আছে।"

নোহারা নিচু গলায় বললো,
"না, সন্ধ্যা ব্রো। এই মেয়েটা অনন্যা হতেই পারে না। অনন্যা আমার সাথে এমন কখনো করতে পারে না। অনন্যা আমার উপর বিরক্ত হতে পারে, রাগতে পারে কিন্তু মারতে কখনোই পারে না। মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে।"

নিক চিন্তিত হয়ে পড়লো। অনন্যার কথাবার্তায় এখন তার ও মনে হচ্ছে এটা অন্য কেউ।
·
·
·
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp