স্মরণ তার রুমে বসে হাতে মলম লাগাচ্ছে। আর কটমট দৃষ্টিতে নীলিমার দিকে তাকাচ্ছে। নীলিমার নখের আচঁড়ে তার হাতের চামড়া ছিলে গিয়েছে বেশ খানিকটা। সেখানেই জ্বালাপোড়া করছে, ছোপ ছোপ র' ক্ত বের হচ্ছে। চিনচিনে ব্যাথায় হাতটা বারবার কুঁকড়ে আসছে তার। নীলিমা একটু দয়াবশত নিজ হাতে মলম লাগিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু স্মরণ আতঙ্কিত গলায় তখন বলেছিলো,
" একদম ছোঁবে না আমাকে। এটা মেয়ে মানুষ নাকি কোনো জংলির নখ! এত বড় নখ কে রাখে শুনি? আরেকটু হলে আমার হাতের ইন্না-লিল্লাহ হয়ে যেতো! "
নীলিমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে স্মরণের মলম লাগানো দেখছে। তার একটু খারাপ লাগছে অবশ্য। কিন্তু এই খারাপ লাগাকে ছাপিয়ে তার এক ধরণের পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। কেননা শুধুমাত্র স্মরণের জন্যই সে নাক ফুটো করেছে, নয়তো এই অসহ্যকর ব্যাথার জ্বালা এই বয়সে এসে স্বেচ্ছায় কখনও আপন করে নিতো না। এখন স্মরণের জন্য তার নাক ফুটো করতে হয়েছে, ব্যাথা সহ্য করতে হয়েছে। তাহলে স্মরণ আরামে থাকবে কেনো! তাকেও একটু ব্যাথা সহ্য করতে হবে।
স্মরণ হাতের জ্বালাপোড়ায় মৃদু গোঙাচ্ছে আর নীলিমার দিকে তীক্ষ্ণ কটমট দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। নীলিমা এবার ভ্রু কুঁচকে খানিক তেজীয়ান গলায় বললো,
" ওমন করে তাকাচ্ছেন কেনো শুধু? দোষ কি আমার? আমি কি আপনাকে হাত এগিয়ে দিতে বলেছিলাম? বলিনি তো। তাহলে হাত এগিয়ে আমাকে ধরলেন কেনো। ধরলেনই যখন তাহলে একটু ব্যাথাও সহ্য করুন। "
স্মরণ খেঁকিয়ে উঠে বললো,
" আমি কি ইচ্ছে করে তোমার হাত ধরতে গিয়েছিলাম? আমাকে মা-চাচিরা জোর করেছিলো বলেই গিয়েছিলাম তোমার কাছে। "
এই শুনে নীলিমা এবার তেতে উঠলো। কোমড়ে হাত রেখে ক্রোধান্বিত গলায় বললো,
" এর মানে কি! তারা জোর না করলে আপনি আমার কাছে আসতেন না? দূর থেকেই আমার কষ্ট দেখে যেতেন! এত বড় স্বার্থপর আপনি!"
স্মরণীয় ভ্যাবাচ্যাকা খেলো মুহূর্তেই। নীলিমার গলার স্বরভঙ্গি পাল্টে যেতে দেখে অবাক কণ্ঠে বললো,
" আশ্চর্য! এখানে স্বার্থপরতার কথা কোথ থেকে টপকালো?"
নীলিমা গাল ফুলিয়ে পূর্বের ন্যায় বললো,
" স্বার্থপর নয়তো কি! আপনার জন্য আমি কষ্ট সহ্য করে নাক ফুটো করলাম। আর আপনি বলছেন মা চাচিরা না বললে আপনি আমার কাছেই আসতেন না!"
স্মরণ এবার সব ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ভ্রু কুঁচকে শুধালো,
" আমার জন্য? আমি একবারো তোমাকে নাক ফুটো করতে বলেছি?"
নীলিমা প্রত্যুত্তরে ভারী বিস্ময় নিয়ে বললো,
" বিয়ের রাতে একটা ডায়মন্ডের নোসপিন গিফট করলেন। আর এখন বলছেন আপনি আমাকে নাক ফুটো করতে বলেননি! আপনি তো দেখি মস্ত বড় পল্টিবাজ। ইয়া আল্লাহ, এ কোন লোকের সাথে আমার সংসার পাতিয়েছো তুমি? বিয়ের দুদিনও হলো না, অথচ তার মন থেকে সব মায়াদয়া চলে গেলো!"
বলেই সে একই সাথে উষ্ণ মেজাজ ও মন খারাপ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। স্মরণ ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে রইলো। নীলিমার এই অদ্ভুত আচরণে সে যারপরনাই বিস্মিত হলো। বন্ধুদের কাছে শুনেছিলো, মেয়েদের মুড স্যুইং হয়। কিন্তু তাই বলে এত ভয়ংকর পর্যায়ের মুড স্যুইং হয় এটা স্মরণের জানা ছিলো না। সে অসহায় কণ্ঠে দু হাত তুলে বললো,
" ইয়া আল্লাহ, এ আমাকে কোন মুসিবতের ট্যাংকির ভেতর ছুঁড়ে ফেললে! মেয়ে মানুষের মন বুঝা বড় দায়। নীলিমার মন বুঝে উঠার আগেই কেনো আমার কপালে বিয়ে লিখলে! এ আমি কোন অথৈ সাগরে এসে পড়লাম আল্লাহ!"
বলে সে হাত নিচে নামালো। বিছানায় এসে ধপ করে বসে ঝিমানো গলায় বিড়বিড় করলো,
" ভবিষ্যত নিয়ে তো এখন ভারী চিন্তায় আছি আমি। নাহ,এভাবে সংসার স্থায়ী করা সম্ভব নয়। অভিজ্ঞ কারোর কাছ থেকে পরামর্শ নিতে হবে। "
এই বলতে বলতে তার সাজিদের কথা মাথায় এলো। তার সমসাময়িক এই একজন ব্যক্তিই আছে যে তাকে সঠিক পরামর্শ দিয়ে উদ্ধার করতে পারবে। নচেৎ বাপ চাচাদের কাছে জিজ্ঞেস করলে পিঠে যে দু চারটা ঘা পড়বে এতে সন্দেহ নেই। তারা হয়তো বলবে, 'আমাদের মেয়েকে সামলাতে পারিস না তো প্রেম করেছিস কেনো? আর বিয়েই বা করলি কেনো?' এখন তাদের কে বুঝাবে প্রেম হলো দিল্লির লাড্ডু। যেটা খেলেও পস্তাবে, না খেলেও পস্তাবে!
************
রাতের খাবার খেয়ে যেখানে সবাই নিজ নিজ রুমে চলে গিয়েছে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়ার জন্য, সেখানে স্মরণ ও সাজিদ উঠোনে বসে আছে। এই রাতে তাদের দুজনকে উঠোনে দেখে আনিস সাহেব জিজ্ঞেস করেছিলেন,
" এত রাতে উঠোনে কি করছিস স্মরণ? "
স্মরণের জবাব ছিলো,
" জীবনমুখী আলোচনা করছি বাবা। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।"
আনিস সাহেব পরে এ নিয়ে আর ঘাঁটাননি। তবে ভেতরে এসে চোখের সামনে যাকেই পেয়েছেন তাকেই বলেছেন, স্মরণ ও সাজিদ এই রাতে উঠোনে বসে জীবনমুখী আলোচনা করছে। অবশ্য তাঁকে জীবনমুখী আলোচনার বিষয়বস্তু জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলতে ব্যর্থ হোন৷
স্মরণ ও সাজিদ পাটি বিছিয়ে বসে আছে। মাথার উপর আজ তারার মেলা বসেছে। সাজিদ দু হাত পিছনে হেলান দিয়ে বসে তারা দেখছে। স্মরণও ঠিক একই কাজ করছে। তবে সে বেশিক্ষণ তারা দেখতে পারলো না। বড্ড অধৈর্য্য গলায় বললো,
" সাজিদ ভাই, আমাকে উদ্ধার করুন দয়া করে। বিয়ের দুদিনেই আমি দিশেহারা হয়ে পড়েছি। নীলিমার আচরণ আমার কাছে সাসপেন্স থ্রিলার বইয়ের চেয়ে কম মনে হচ্ছে না। "
সাজিদ আকাশের দিকে চেয়েই দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অতঃপর বিজ্ঞ ব্যক্তিদের ন্যায় ঠোঁটে একটু হাসি এনে সোজা হয়ে বসলো। এ মুহূর্তে নিজেকে বিশাল মাপের একজন জ্ঞানী লোক মনে করছে সে। তার চাহনি, অঙ্গভঙ্গিমা সবকিছুই অভিজ্ঞ লোকের ন্যায় দেখাচ্ছে। ভাবখানা তার এমন যে বৈবাহিক বিষয়ে সে পিএইচডি অর্জন করে এসেছে।
সাজিদকে দেখে মনে হচ্ছে, সে একজন কবি, যে জীবন, উঁহু বৈবাহিক জীবন সম্পর্কে পূর্ণ অভিজ্ঞ। শুধু হাতে একখানা সিগারেট, একটা ডায়েরি ও কলম, আর চোখে মোটা ফ্রেমের চশমার কমতি আছে। নচেৎ ষোলকলা পূর্ণ হতো।
সাজিদ যেনো কল্পনায় সিগারেটের ধোঁয়া উড়ালো। অতঃপর বললো,
" এত বিচলিত হবে না স্মরণ। সংসারের মূল মন্ত্র হলো ধৈর্য্য। স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই ধৈর্য্যের প্রয়োজন আছে। "
স্মরণ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
" কিন্তু যা মনে হচ্ছে, ধৈর্য্য একার আমারই ধরতে হবে। নীলিমা মাঝে মাঝেই যেমন ছ্যাঁত করে উঠে তাতে আমি ধৈর্য্য হারালে সংসার টিকবে না মনে হচ্ছে। "
সাজিদ মৃদু হাসলো। সময় নিয়ে বললো,
" নওরীনও প্রথম দফায় এমন ছ্যাঁত-ছুঁত করে উঠতো। পরে আমি ওকে সময় দিয়েছি। তারপর দেখলাম ও ধীরেধীরে নরম হচ্ছে, ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিচ্ছে। "
স্মরণ বোধহয় এবার একটু আশার আলো দেখতে পেলো। জিজ্ঞেস করলো,
" তা স্ত্রীর এই ধৈর্য্য আসতে কেমন সময় লাগতে পারে?"
" উমম, তার নির্ভর করে তোমার স্ত্রী, অর্থাৎ আমার শালিকা, অর্থাৎ নীলিমার উপর। যেকোনো ঝগড়ার পর তার যদি তোমার উপর একটু মায়া হয় তাহলে নিজের কাজে সে অনুতপ্ত হবে। ভাববে, তাকে একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে। নরম হতে হবে। "
" এক্ষেত্রে করণীয় কি সাজিদ ভাই? মানে আমি এমন কি করবো যেনো আমার উপর নীলিমার একটু মায়াদয়া হয়?"
সাজিদ এবার একটু গলা পরিষ্কার করলো। ধীরে কাশি দিয়ে বললো,
" তোমার কাজ হবে, নীলিমার 'হ্যাঁ' এর সাথে হ্যাঁ মেলানো, 'না' এর সাথে না মেলানো। ও যেটাকে সঠিক বলবে, সেটাকে সঠিক বলা। ভুলকে ভুল বলা। ও যেদিকে যাবে সেদিকে যাওয়া। ও যদি নীলকে লাল বলে, তুমিও ওর সাথে তাল মিলাবে।"
স্মরণ হতবাক হয়ে রইলো সাজিদের পরামর্শ শুনে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
" এসব কি বললেন সাজিদ ভাই? এ কি আদৌ সম্ভব? "
সাজিদ হাসলো। স্মরণের পিঠে চাপড় মে' রে বললো,
" সবই সম্ভব বাছা, সবই সম্ভব। যদি সংসার টেকাতে চাও তাহলে আমার কথা মেনে নাও।"
" তাই বলে চোখ থাকতেও এভাবে অন্ধ হয়ে যাবো!"
" প্রেমে পড়লে সবাই অন্ধ হয় বাছা। তুমি তো প্রেমেরও একশ ডিগ্রি উপরে কাজ করে বসে আছো। প্রেমের পরিণতি দিতে বিয়ে করেছো। আর সেখানে তুমি এসব মানতে চাও না! আচ্ছা, তোমার ইচ্ছে কি? নীলিমাকে ছেড়ে দেয়া? বিয়ে ভেঙে দেয়া?"
" না না, আস্তাগফিরুল্লাহ, কি বলছেন সাজিদ ভাই! গত কালই তো মাত্র বিয়ে হলো। আজই যদি এসব বলেন তাহলে......"
" তাহলে আর কি? সব কিছু স্মুদলি চাইলে এটুকু স্যাক্রিফাইস করতেই হবে। না হয় রোজ রোজ সংসারে অশান্তি লেগে থাকবে।"
স্মরণ হাল ছেড়ে দিলো। বুক চিঁড়ে তার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। এই যদি হয় বৈবাহিক জীবনের সূচনা, তাহলেও সামনে যে কি হতে চলেছে তা ভেবেই আত্মা কেঁপে উঠলো তার। সে ভাবলো, এটাই কি তবে সুখী দাম্পত্য জীবনের রহস্য? তার বাবা-মা, চাচা-চাচী, ফুপা-ফুপি সবাই কি ভেতরে ভেতরে এমন? সবাই কি স্ত্রীর হ্যাঁ'তে হ্যাঁ, না'তে না মেলাতো? ভেবে পেলো না স্মরণ।
***************
ঈদের দিন রাতে পাড়া প্রতিবেশী নিয়ে নীলিমার মেহেদির অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। মেহেদি আর্টিস্ট ডাকা হয়েছে শহর থেকে। কারণ গ্রামে কেউই আপাতত প্রফেশনালি মেহেদি দিতে পারে না। তাই স্মরণ নিজের টাকা খরচ করে শহর থেকে মেহেদি আর্টিস্ট নিয়ে এসেছে।
এই মেহেদির অনুষ্ঠান শেষ করতে করতেই রাত ১১টা পার হলো। কাল হলুদ,পরশু বিয়ে। নীলিমা বুঝেছে আগামী ৩/৪ দিন তার চোখে ঘুম জুটবে না। এই বিয়ের অনুষ্টানের আগ পর্যন্ত আবার স্মরণ, নীলিমাকে আলাদা রাখা হয়েছে। এমনটা না করলে বলে বিয়ের আমেজ আসবে না। তাই আবারো বিয়ের আগে যে যেমন ছিলো তেমন পরিবেশ ফিরিয়ে এনেছে সবাই। কিন্তু স্মরণ ও নীলিমা সে পরিবেশে টিকতে পারেনি। তারা দুজনের একজনও ভুলতে পারেনি যে তারা বিবাহিত। এ কারনেই রোজ সুযোগ পেলেই যখন তখন একটুখানি ছোঁয়াছুঁয়ি চলছে দুজনের মাঝে। চলছে মিষ্টি প্রেম আলাপন৷
মেহেদি অনুষ্টান শেষে ক্লান্ত শরীরে যে যার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। মানতাসা এখনও শ্বশুর বাড়ি থেকে আসেনি বলে তার রুমে নীলিমা ও রাফা থাকছে। সারাদিন কাজ,দৌড়াদৌড়ির ফলে রাফা শুয়ে পড়ার পরপরই ঘুমিয়ে পড়েছে। ওদিকে নীলিমার চোখে ঘুম নেই। কেননা সেই সন্ধ্যা হতে স্মরণের সাথে দুদন্ড কথাও হয়নি। এখন একটুখানি দেখা করার জন্য, দু চারটা কথা বলার জন্য তার মন আঁকুপাঁকু করছে। কিন্তু দু হাতে মেহেদি থাকার ফলে সে না পারছে ফোন করতে, না পারছে দরজা খুলে বাইরে বের হতে।
সে বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। এর মাঝে হঠাৎ জানালায় ক্ষীণ শব্দের ঠুকঠুক আওয়াজ এলো তার কানে। বুঝতে বাকি রইলো না এটা স্মরণ করছে। সে দ্রুত উঠে পড়লো শোয়া থেকে। জানালার কাছে গিয়ে দেখলো জানালার ছিটকানি খোলা। একটুখানি ভিজিয়ে রাখা শুধু। সে এপাশে থেকে বাহু বাড়িয়ে জানালায় আলতো ধাক্কা দিতেই জানালা খুলে গেলো।
জানালা খুলতেই স্মরণের ব্যাকুল হাসি দেখে তার অস্থির হৃদয় স্থির হলো। মন আঙিনায় এক রাশ শীতল হাওয়া খেলে গেলো মুহূর্তেই। বিনিময়ে সে-ও মুচকি হেসে বললো,
" এতক্ষণে এসেছেন তবে! "
" হুম! চলে এলাম তোমার টানে। "
নীলিমা ক্ষীণ অভিমানী সুরে বললো,
" এসেছেন কেনো শুনি? না এলেই পারতেন। "
স্মরণ এবার প্রগাঢ় গলায় বললো,
" আজ আমি লুটপাট চালাতে এসেছি আমি। "
নীলিমা এ কথার অর্থ বুঝতে পেরে লাজুক স্বরে বললো,
" লুট করে নেয়ার মতো কিছুই নেই এখানে। ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে এসেছেন। "
স্মরণও পাল্টা জবাবে ঈষৎ বক্র হেসে বললো,
" কেনো? এই যে আছে। আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে সে! আজ তোমাকে লুট করে নিয়ে যাবো বউজান!"
.
.
.
চলবে........................................................................