নীলাম্বরে রৌদ্দুরের হাতছানি - পর্ব ১২ - বেলা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


          সরোজপুর বাজারের এক জিলেপির দোকানের মালিক মন্টু মিয়া। আশেপাশে আরো কতকগুলো জিলেপির দোকান আছে ‌ তারা দিনের তিনভাগই মাছি মারলেও মন্টু মিয়ার দোকানে খোদ্দেরের অভাব পড়ে না। ভদ্রলোকের মুখের কথায় মধু ঝরে কি না। তেলে তেলে একেবারে ভেজে নেয় মানুষকে। সিনান সালেহ হাস্যোজ্জ্বল মুখে দোকানে গিয়ে দাঁড়ায়। সালাম দিয়ে বলে,

" চাচা ভালো আছেন নি?"

মন্টু মিয়া স্বভাব সুলভ চমৎকার হাসেন। পাশে টুল টেনে সিনানের হাত ধরে বসিয়ে বলেন,

" আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি বাপজান। তুই কেবা আছু? দিন দিন শুইখা কাঠ হইতেছিস সাথে মেজাজটাও খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে।"

সিনান অপ্রস্তুত হাসে। মেজাজ ধরে রাখা দায়। তবুও খ্যাক করে না উঠে কন্ঠে নমনীয়তা ঢালার চেষ্টা করে,

" আছি আলহামদুলিল্লাহ। আপনের সাথে দেখা করবো করবো করেও করা হয় নি। সেদিনের জন্য আমি বড্ড কৃতজ্ঞ। আপনি আমাদের স্বেচ্ছাসেবক দলের জন্য মুক্ত হাতে দান করলেন। আপনার দেখা দেখি অনেকেই এগিয়ে এসেছে। ধন্যবাদ চাচা!"

মন্টু মিয়া আবারও হাসেন। আগত খোদ্দেরকে আপ্যায়ন করে সিনানের উদ্দেশ্যে বলেন,

" তুই পর ভাবলেও আমি তোরে ঘরের পোলা ভাবি। তোর বাপ আমার মামাতো ভাই। মামা মামীর সাথে কত ভালো সম্পর্ক ছিলো। কত আদর করতো। তোর বাপের সাথেও এখনো মিল শতভাগই। অথচ তোরা গোনায় ধরিস না। কষ্ট পাই বহুত। তয় তোরে মনপ্রাণ দিয়েই ভালোবাসি।"

" তেমনটা না চাচা। নিজ কাম কাজে ব্যস্ত থাকি। সেভাবে আসা যাওয়া হয় না। তবে এখন প্রায়ই আসবো আপনাকে বিরক্ত করতে।"

সিনানের কথায় ভদ্রলোক দাঁত দেখিয়ে হাসেন।

" যখন মন চাইবো আইবি। কোনো দরকার পরলে বা বিপদে স্মরণে রাখিস তোর এই চাচারে সর্বদা কাছে পাবি।"

সিনান মাথা নাড়লো। ভদ্রলোক নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। সিনান সেখানেই বসে থাকে চুপচাপ। মিন্টু মিয়া তাঁর হাতে জিলেপি ধরিয়ে দিয়ে বলে,

" সুরের বিয়ের কথাবার্তা তো অনেক হইলো। কিন্তু আগাইলো না। মাইয়াডা কত নম্র ভদ্র। আমার অবিয়াত্ত্যা পোলা থাকলে আমিই নিতাম। আসলে দুনিয়ায় ভালো মাইয়ার কদর কই। শুনলাম দেখতে আসার পর আর খোঁজখবর নেয় না। আমার সন্দেহ হয় কেউ ভাঞ্জি দেয়। নাহলে মেয়ে তো খারাপ না।"

ব্যাপারটা সিনান খতিয়ে দেখেছে । সুর দেখতে শুনতে খারাপ না, না কোনো বাজে অভ্যাস আছে। তবুও কেন বারবার ভেস্তে যায় সমস্ত প্রস্তাব! আর কেউ ভাঞ্জি দিলেও কেন দিবে? কিসের শত্রুতা। মন্টু মিয়া প্রসঙ্গ পাল্টে বলেন,

" ওসব নিয়ে পড়ে কথা হবে সিন। আমার হাতে বেশ কিছু ভালো প্রস্তাব আছে। এখন তোর খবর বল? দিন কাল কেমন চলছে?"

" আলহামদুলিল্লাহ। চলছে কোনোরকম। গ্যারেজে বসে বসে মাছি তাড়াই এখন। খোদ্দের আসে কালে ভাদ্রে। ওদিকে বাজারে আগুন ধরছে। ভাবছি গ্যারেজ বন্ধ করে দিয়ে নতুন ব্যবসা ধরবো। কিন্তু পুঁজি পাবো কই?"

সিনানের কথায় ভদ্রলোক অল্প হেসে বলেন,

" টাকাই তো টাকা ভাতিজা! টাকা ছাড়া দুনিয়া অচল। টাকা ছাড়া মানুষ অমানুষ হয়ে যায়। আবার টাকা পেলেও মানুষ অমানুষ হয়ে যায়।"

কথাটা মন্দ বলে নি ভদ্রলোক। সিনান রয়ে সয়ে বসে ভাব জমায় ষোলো আনা। হাতে হাতে বেচাকেনা করতেও সাহায্য করে।

°°°°°°°°°°°°°°

পিঁড়িতে বসে তেলে পিঠা ভেজে চলেছে সুরেলা। একটু পরপরই মাথার ওড়না আরেকটু করে টেনে নেয়। গায়ের ওড়না টেনে টুনে ঠিক করে। অস্বস্তিতে বুঁদ পা থেকে মাথা অবদি। মনে হচ্ছে কম্বলে নিজেকে ঢেকে রাখতে। কেমন করে তাকায় আছে যেন গিলা ফেলবো। অসভ্য লুচ্চা। ইচ্ছে তো করছে ওই নিষ্পলক চোখ দু'টোয় আঙুল ঢুকায় দিতে। মনে মনে বিড়বিড় করে সুরেলা। গরম তেল থেকে পিঠা তুলে পাতিলে রাখতেই রূপসা, ইকরা, ইয়ামিন হুমরি খেয়ে পড়ে। সুরেলা নমনীয় সুরে সাবধান করে। ইকরাম উল্লাহ হেসে বলেন,

" আমার বাচ্চা দু'টোর কথা মানা যায় কিন্তু রূপসা? এতো ইকরার থেকেও বেশি বাচ্চামো করে দেখছি। শালি সাহেবা ফুরিয়ে যাচ্ছে না। আরো বানাবে তো?"

রূপসা পিঠায় কামড় বসিয়ে বলে,

" বড় দুলাভাই। সুর আপার হাতের পিঠা মানে মধু মধু। আমার তো খুউব পছন্দ। ধৈর্য ধরতে পারবো না বাপু!"

সুরেলা আড়চোখে চায় তাঁর দিকে। তাঁর প্রশংসা করছে মেয়েটা?হজম করতে অসুবিধা হলেও সহ্য করে নেয় সুরেলা। মেয়েটার সব কিছুই অসহ্য লাগে। ন্যাকাষষ্ঠি কোথাকার ।রূপসা মিষ্টি হেসে পাতিল থেকে একটা পিঠা তুলে নিয়ে যায়। গরম হওয়ার দরুণ একবার ডান হাতে তো একবার বাম হাতে রদবদল করছে। সে ছুটে সবার থেকে দূরে চাদর মুড়িয়ে বসে থাকা নওরিজের দিকে বাড়িয়ে দিল পিঠা খানা। ব্যস সুরেলার সারা অঙ্গ যেন জ্বলে উঠলো। কি দরদ হবু জামাইয়ের জন্য! যত্তসব ঢং! সুরেলা মনে মনে পিন্ডি চটকে আড়চোখে চায় লাট সাহেবের দিকে। চার চোখের মিলন হয়। সুরেলা অতি সুক্ষ্মভাবে অবজ্ঞা করে নিজ কাজ করে যায়। নওরিজ মাহবুব তপ্ত শ্বাস ছেড়ে নজর হটায়। ঠোঁট বাঁকিয়ে রূপসার উদ্দেশ্যে বলে,

" একবার ডান তো আরেকবার বা হাত! হাত ধুয়েছিস সাবান দিয়ে?"

রূপসা বাড়ন্ত পিঠা গুটিয়ে নিজেই কামড় বসায়। ভেংচি কেটে বলে,

" খেতে হবে না তোমার। হাত ধুয়েছিস সাবান দিয়ে! বলি আমার হাতে কি ময়লা লেগেছে নাকি?"

" সামনে থেকে সর। নইলে কিল একটাও মিস যাবে না।"

হুমকিতে রূপসা গাল ফুলিয়ে চলে আসে। কারো ভালো করতে নেই। ভেবেছিল সুর আপার হাতের পিঠা খেয়ে রিজ ভাই খুশি হবে। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হবে। অথচ বলে কি না হাত ধুয়েছিস? রিজ ভাই নিশ্চয়ই বিয়ের পর চুমু খাওয়ার আগেও বলবে এই সুর ব্রাশ করেছিস? ভাবতেই লজ্জায় লাল হয় কিশোরী। সাথে সুর আপার জন্য দুঃখও হয়। সে সুরেলার পাশে পিঁড়িতে বসে যায় ‌। হাতে হাতে টুকটাক সাহায্যও করে। নওরিজ মাহবুব সেখানেই বসে তাকিয়ে রয় বাঁকা চোরা নজরে।শখের নারীকে চোরা চোখে দেখার আনন্দানুভূতি বড্ড মিষ্টি। ওই বাটিতে রাখা পাটালি গুঁড়ের চেয়েও একসের বেশি মিষ্টি। 

বারান্দায় চেয়ার পেতে বসা ইকরাম উল্লাহ ছেলে মেয়েদের গরম পিঠা ফু দিয়ে ঠান্ডা করে মুখে দেয়। এরই মাঝে ছামিনা বেগম উপস্থিত হয় বারান্দায়। রূপসাকে পাঠায় ছবি ও সাদমানকে ডেকে আনতে। নিজে সুরেলার পাশে বসে অল্প হেসে বলে,

" কেমন আছো? আজকাল আসো না আমাদের বাড়িতে। আগে তো যেতেই চাইতে না।"

" আলহামদুলিল্লাহ। সময় পাই না তাই আসা হয় না।"

সুরেলার কেমন যেন বিরস জবাব। ছামিনা বেগম আর কথা বাড়ালেন না। মেয়েটাকে ছেলের বউ হিসাবে অপছন্দ না; আবার পছন্দও না। দেখতে একটু শ্যামলা, সাধারণ হলেও চোক্ষু শীতলতার আবেশে যেন বশীভূত করে দিবে। দোষের মধ্যে তাঁর কাছে মনে হয় কেমন যেন কাঠ খাট্টা ধরনের। কথায় রসকষ নেই। ভাইয়ের মতোই কিছুটা। তিনি চুপচাপ প্লেটে পিঠা নিয়ে বাড়ির বড় ঝি জামাইকে দেন। তন্মধ্যে বাড়ির মেইন ফটক পেরিয়ে এগিয়ে আসে রওশন আর সাদমান। সুরেলাকে দেখে রওশন অবাক হয়। সাথে খুশিও হয়। অনাকাঙ্ক্ষিত দর্শন এতো মিষ্টি? গম্ভীর মুখো সাদমান খেয়াল করে ব্যাপারটা। ভ্রু কুটিতে ভাঁজ ফেলে ধীমান স্বরে শুধায়,

" ইনিই সুরেলা?"

রওশন মৃদু কেশে সায় জানালো। সাদমান সুরেলাকে দেখে বলে,

" উনি দেখতে তো ভালোই। রূপালী যে বলল কালো, ঝগরুটে। সাথে হিংসুটেও!"

" ওর কথা বাদ দিন তো। ছোটবেলায় একসাথেই খেলতো। খেলায় না পারলে ঝগড়া লাগিয়ে দিতো সুরেলার সাথে। সুরেলা ঝগরুটে না তবে অন্যসবার মতো মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে না কাঠ কাঠ কথা বলবে।"

রওশনের কথায় সাদমান ঠোঁট চোখা করে ওহ্ বলে চুপ করে যায়। রূপালী ঝগরাও করতে জানে? কই কখনো নজরে আসে নি তো! শান্ত মিনি বিড়ালের মতো মিউমিউ করতেই দেখেছে এতকাল। রওশন এগিয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে হেসে বলে,

" বাহ্ বাড়িতে পিঠা পুলির ধুম পড়েছে দেখছি! মেন্যুতে কি কি আছে? পিঠার জন্য লাইন ধরতে হবে নাকি সুরেলা?"

" ভাইয়া লাইন ধরতে হবে না। বসে পড়ুন আপনিও পেয়ে যাবেন। আপনাদের পিঠা বানিয়ে খাওয়াতেই আমার আগমণ।"

সুরেলার শান্ত জবাব। ছামিনা বেগম সাদমানকে বসতে বলে প্লেটে পিঠা ধরিয়ে দেয়া। সাদমান প্লেট হাতে নিয়ে বসে থাকে। মুখে দেয় না। ইকরাম উল্লাহ তাঁর পাশেই বসে। ইশারায় খেতে বলে। ভদ্রলোক ক্ষীণ মাথা নাড়ে প্রত্যুত্তরে। রওশন গিয়ে নওরিজের পাশে বসে টুকটাক কথা বলে। নওরিজ শুনে কম হাঁচি দেয় বেশি। নাক মুখ রক্তিম হয়ে আছে। ব্যাকুল নয়ন বারে বারে একদিকেই ঘুরে ফিরে। অথচ নিষ্ঠুর রমনী যেন আজ চিনেও চেনে না। দিন দিন কেমন রসকষহীন হয়ে যাচ্ছে ভাইয়ের মতো। নাহ্ আর অপেক্ষা নয়। এখন ঘরে তোলার পালা। 

দক্ষিণা দুয়ার হতে নওরিন এগিয়ে আসে; তার হাতে স্টিলের গ্লাস। রূপসা বোনের হাত ধরে নওরিনের পিছু পিছু আসে। রূপালী ওরফে ছবি বারান্দায় তাকায়। গম্ভীর মানবের শান্ত নজর পড়তে অসুবিধা হয় না। বোনের হাত ছেড়ে গুটি পায়ে এগিয়ে যেতেই সাদমান তাঁর অপরপাশে চেয়ার টেনে বসতে ইশারা করে। রূপালী বাধ্য মেয়ের মতো চুপটি করে বসে যায়। সাদমান হাতের প্লেট হতে একটা পিঠা নেড়েচেড়ে দেখে। হালকা গরম ভাব। পিঠা টা রূপালীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

"খাও?"

রূপালী অনিচ্ছা সত্ত্বেও কামড় বসায়। পাশ থেকে ইকরাম উল্লাহ টিপ্পনী কেটে বলে,

" ছোট শালা বাবু, বড় শালাবাবু? সাদমানের থেকে শিখে রাখো কিভাবে বউয়ের কেয়ার করতে হয়। আমি কতবার বললাম পিঠা খেতে। নাহ! ভদ্রলোক পিঠা হাতে বসে রইলেন। এখন বুঝলাম রহস্য। আহা ভালোবাসা!"

বিষম খায় রূপালী। সাথে বড় ভাই বোনদের সামনে লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।ছামিনা বেগম পানির গ্লাস নিয়ে এগিয়ে আসে। মেয়ের মুখে ধরবে এমন সময় সাদমান গ্লাসটা নিজ হাতে নিয়ে রূপালীর মুখে ধরে। মাথায় আলতো চাপ দিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধায়,

" ঠিক আছো?"

ছবির ধূসর অম্বরে রঙিন বসন্তের ছাপ। যা প্রায়শই দেখা যায় তবে নীরব মান অভিমানের চাপায় পিষ্ট হয়। রূপালি হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো। সাদমান পকেট থেকে রূমাল বের করে চোখের কোনায় চিককিচ করা নোনাজল মুছিয়ে বলে,

" আস্তে ধীরে খাও রূপালী।"

ছামিনা বেগমও খানিকটা তুষ্ট হন। নাহ্ মেয়ের জামাই মেয়েকে অযত্নে রাখে না। এটা শুরু থেকেই দেখা যায়। তবে ছেলেটা অতিরিক্ত চাপা স্বভাবের। এটাই যা সমস্যা। ছামিনা বেগম সরে এসে আবারও সুরেলার পাশে পিঁড়িতে বসেন।

 নওরিন এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখছিল সবটা‌। হাতে থাকা স্টিলের গ্লাসটা ভাইয়ের দিকে বাড়িয়ে বলে,

" তুলসী পাতার রস।অল্প পানি, লবণ পরিমাণমতো দিয়ে গরম করে এনেছি। খেয়ে নি ঠান্ডা কাশি কমে যাবে।"

নওরিজ গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। নওরিন বিরক্ত হয় ঢের।

" গ্লাস ভালোভাবে ধুয়েই এনেছি। খেয়ে উদ্ধার কর ভাই আমার।"

নওরিজ নাক মুখ খিঁচে এক চুমুকে খেয়ে নিল রস টুকু। গলাধঃকরণ করেই মুখ বিকৃত করে বলে,

" উমম.. খুবই বিশ্রী সাথে তেতো!"

" একটু তেতো তো হবেই। তবে বউ খাইয়ে দিলে মিষ্টি লাগতো। তাছাড়া অসুখে পড়েছো মা বোন কতদিক দেখবে? একঠা বউ থাকলে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতো। একটু পর পর জ্বর মাপার বাহানায় কপাল ছুঁয়ে দিতো। যত্ন করে খাবার খাইয়ে ওষুধ মুখ পুরে দিতো। আর.."

ইকরাম উল্লাহকে থামিয়ে দেয় নওরিজ মাহবুব। আড়চোখে সুরেলাকে একপল দেখে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,

"দুলাভাই এভাবে লোভ লাগালে তো বউ ছাড়া থাকা দায়।"

সুরেলার কান সজাগ থাকলেও চোখে মুখে কোনো প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না। ছামিনা বেগম অল্প হাসেন। ইকরাম উল্লাহ টিপ্পনী কেটে খোঁচাখুঁচি করতে শুরু করে। নওরিন তাকে থামিয়ে কুঞ্চিত কপালে বলে,

"তাহলে মেয়ে দেখা শুরু করি? আমার মামা শ্বশুরের একটা মেয়ে আছে। দাঁত গুলো সাদা ধবধবে। আগেরটার মতো হলদেটে নয়। তুই বললে কথা পাড়বো।"

সুরেলা কাজে মনোনিবেশ করলেও খরগোশের ন্যায় কান এদিকেই। মেয়ে দেখতে হবে কেন? আছে তো ওই দুলালি রূপসা। তাকেই তো গিন্নী মা ছেলের বউ করবেন। ছামিনা বেগম হেসে বলল,

" রিজ বাবা? তুমি বলছো একথা? তোমার কোনো পছন্দ আছে না কি? থাকলে বলো এখনি তুলে আনি?"

  নওরিজ খানিকটা বিব্রত বোধ করে। চাচির সামনে এভাবে বলা অনুচিত হয়েছে বোধহয়। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,

" না চাচি আম্মা। এমন কেউ নেই। আমি তো আপনাদের ভরসায় বসে আছি!"

ছামিনা বেগম খুশি হন। ভাবীর ভাগ্য ভালো। সব মায়েরাই তো চায় নিজ চাঁদের টুকরোর জন্য দেখে শুনে, বেছে ঘরনী আনতে। যে ঘরনী মা ছেলের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করবে না‌; ছেলেকে আঁচলে বেঁধে মায়ের থেকে দূর করবে না। তিনি হেসে বলেন,

" গিন্নী আপা তোমার জন্য হিরে বেছে আনবে দেখে নিও। রূপে গুনে গৌরবে তোমার মতোই হবে সেই সুনয়না।"

নওরিজ আবারও হাঁচি দেয় শব্দ করে। তাঁর তো হিরে জহরতের দরকার নেই! তাঁর এক স্বচ্ছ মনের মালিক চাই। আঙুল উঁচিয়ে চোখ পাকিয়ে শাসাবে এমন একটা ঝগরুটে চাই। হাসির সঙ্গী সুহাসিনী চাই। তাঁর যত্নে সব ভুলে সর্বদা মুখিয়ে রবে এমন একটা যত্নশীল চাই। তার বিপদকে ভয় পাবে এমন এক ভিতু চাই। তাঁর সাহসে পরিণত হবে এমন এক সাহসী চাই। এসব জানানোর পর মুখ ভেঙ্গিয়ে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যে লুইচ্চা বলবে তাঁর ওই বৃদ্ধাঙ্গুলির মালকিনকে চাইই চাই।

"রিজ ভাই কি ধুরন্ধর তুমি! মা চাচির ভরসায় বসে আছো তাই না? অথচ তলে তলে সাদা খামে প্রেমপত্র, পুষ্প! ভালো হয়ে যাও ভালো হতে পয়সা লাগে না!"

রওশনের কথায় ভাবনাচ্ছেদ ঘটে নওরিজের। আলগোছে নজর হটিয়ে রওশনকে চোখ রাঙানি দেয়। মাঝখান থেকে ইকরাম উল্লাহ আবারও টিপ্পনী কেটে বলে,

" সত্যিই নাকি রিজ বাবু? তোমাকে তো রকসষহীন ভাবতাম। সে যাক কোনো ব্যাপার না। তোমার মতো রসকষহীন মানুষ আবার বেশি রোমান্টিক হয়।যাকে বলছ ছুপা রুস্তম। এখন বিয়েটা সেরে ফেলো। তোমার জন্য বেচারা রওশন বিরহের আগুনে পুড়ছে। সে অতি নিকটে তবুও কাছে টানতে পারছে না।"

ছামিনা বেগম বাহানা দেখিয়ে চলে যান। বাচ্চারা রসিকতায় বিব্রত বোধ না করে তাই। রওশন বিব্রত বোধ করে। কিছু বলবে নওরিজ তাঁর আগেই বলে ওঠে,

" আমি কি ওকে মানা করেছি বিয়ে করিস না?"

" বড় ভাইকে রেখে ছোট ভাই কিভাবে বিয়ে করবে। লোকে নিন্দে করবে না?"

হঠাৎ সাদমানের কথায় সবাই একটু অবাকই হলো। ভদ্রলোক অতি দরকার ছাড়া কথা বলেন না। বোমা ফাটালেও না। নওরিজ উঠে আসে। গায়ের চাদরটা ভালোভাবে মুড়িয়ে রুমালে নাক ডলে বলে,

" মন্দ বলেন নি সাদমান ভাই। এমনিতেও আজকাল ঘরটাও ঘরনীর জন্য হাহাকারে ধুঁকছে। যাই বয়রার সাথে কথা বলে আসি। নতুন পালকির ব্যবস্থা করতে।"

সত্যি সত্যিই বেরিয়ে যায় মেইন ফটক পেরিয়ে। সুরেলা কোনা চোখে তাঁর প্রস্থান দেখে নিজ কাজে মন দেয়। যত দ্রুত সম্ভব এই অসহ্যনীয় প্রাসাদ থেকে বেরোতে পারলেই বাঁচে। 

°°°°°°°°°°°°°

দামিনী উঠোনের তুলসী গাছে জল ঢালে পিতলের ছোট্ট পাত্র হতে। সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালিয়ে দুই হাত তুলে প্রণাম করে প্রার্থণা নিবেদন করে। 

নরম কুশন কোলে নিয়ে বসে শুক্কুর আলী। কুচকুচে গোঁফ পাকিয়ে নেশাতুর চোখে চায় সম্মুখের রমনীর পানে। দুধে আলতা গায়ের রং যেন চোখ পাকিয়ে আহ্বান করছে। সদ্য স্নান সেরে বেরিয়ে আসা রমনীর দীর্ঘ কেশলয় হতে চুঁইয়ে পড়া টপ টপ পানিতে যেন তৃষ্ণা বেড়ে কয়েকগুণ। ঘনঘন ঢোক গিলে শুক্কুর আলী‌। দামিনীর আগমনে শুকনো কেশে গলা পরিষ্কার করে শুধায়,

" কেমন আছো দামিনী? বয়স বাড়লে নারীর সৌন্দর্য, যৌবন ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে পড়ে। তোমার দেখছি কিশোরী থেকে যেন যৌবনের দিকে পা বাড়াচ্ছো। সৌন্দর্য যেন বেড়ে শতগুন! এই লাস্যময়ী রূপের রহস্য উন্মোচন হবে কি?"

দামিনী খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে তাঁর কথায়। সম্মুখের রাজকীয় কেদারায় বসে গা এলিয়ে দেয়। মধ্যবয়সী মহিলা শুপ্রা পান বানিয়ে এনে প্রথমে দামিনীর হাতে দেয়। পান মুখে পুরে শুক্কুর আলীকে পান দিতে ইশারা করে বলে,

" কাকা আমি দামিনী শান্ত তটিনী। রহস্য খুঁজবেন না। গুম হয়ে যাবেন। কি বলতে এসেছেন জলদি বলে কেটে পড়ুন। পুরুষ মানুষ বেশিক্ষণ দেখলে গা জ্বলে ওঠে আমার। পুরে ছারখার হয়ে যাবেন!"

শুক্কুর আলী পান মুখে নেয় না। নারী জাত যে বড্ডো সন্দেহভাজন! বিশ্বাস করলে তো মরলে। সে দাঁত কেলিয়ে বলে,

" দামিনী বলছে একথা? তুমি আগুন হলে পুরুষ হাসি মুখে ছাই হয়ে যাবে।"

"ফালতু কথা ছেড়ে আসল কথায় আসুন।"

দামিনীর বিরক্ত মাখা গলায় শুক্কুর আলী হেসে বলেন,

" রাগ কেন করছো দামু? কতদিন পর দেখা পেলাম তোমার। তুমি তো এখন চাঁদের হাঁট হয়ে গেছো। দেখাই দাও না। কতদিন এসে ফিরে গেলাম। শুপ্রা শুধু বলে বিজি আছো বিজি আছো! এতো কিসের ব্যস্ততা তোমার?"

দামিনীর মেজাজ চটে যায়। পানের পিক ফেলে বলে,

" আমি তোর ঘরের বউ না যে যখন ইয়াদ করবি দেখা দিবো! আর একটা ফালতু কথা বললে কুত্তার মতো ঘার ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো।"

শুক্কুর আলী একটু অপমান বোধ করেন। তবে আমলে নেয় না। সুন্দরীদের মুখ থেকে গালি বা অপমান অমৃতের মতোই লাগে। তিনি মোদ্দা কথায় আসেন,

" কুঁড়া গাঁয়ে প্রতিবারের মতো এবারও বৈশাখী মেলা বসবে। যদিও কিছু সমস্যার কারণবশত বৈশাখ মাস পেরিয়ে জৈষ্ঠ্যের শেষ ক'দিন। আষাঢ় মাসেই হবে মেলাটা। আমরা যাত্রাপালার আয়োজন করবো। সব বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। মেলারও দেরি নেই খুব একটা দিন। তোমার পাত্তা পাচ্ছিলাম না। তুমি কি বলো? যাত্রার আসল মুখ কিন্তু তুমি।"

দামিনী ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। দু পা তুলে রয়ে সয়ে বসে। হাতের রেশমী চুরি নড়াচড়া করতে করতে বলে,

" তাই বুঝি?"

শুক্কুর আলী হেসে সায় জানান। দামিনী আবারও পানের পিক ফেলে লাল টকটকে অধর নাড়িয়ে বলে,

" আমার বকশিশ কত?"

" গতবার পাঁচহাজার চেয়েছিলে। এবার খুশি হয়ে সাত হাজার দিবো।"

" খুবই ভালো। গতবার তো আমি বেকুব ছিলাম। সাদাসিধে মনে জব্বর পারফরমেঞ্চ দিলাম। বস্তা বস্তা টাকা ঘরে নিলেন আপনারা। আমারে পাঁচ হাজার দিয়ে ভাগাই দিলেন। এবার বিশ হাজার ডিমান্ড থাকবে। জলসা জমজমাট হলে সেটা বাড়বে বৈ কমবে না। রাজি থাকলে কথা আগাবেন। নইলে ওই যে বের হওয়ার রাস্তা?"

বাড়ির গেইটের দিকে আঙুল তাক করে দেখায় দামিনী। শুক্কুর আলী যেন ঝটকা খায়। বিশ হাজার? মগের মুল্লুক নাকি! সামান্য নাচনে ওয়ালীর এতো চাহিদা? সে থমথমে গলায় বলে,

" ভাং খাইছো নি দামু? বিশ হাজার তো জীব্বনে চোক্ষে দেখলাম না। পুরা জলসা মিলাইয়া বিশ হাজার হইবো কিনা সন্দেহ! তার উপর সিজন শেষ হয়ে গেছে। বাদল আটক্যা নিলে মাথায় বাড়ি! তুমি কও তো হাজার দশেক দিবো। এর বেশি আমি পারবো না ।"

" ওই যে রাস্তা। যান?"

দামিনীর ফুরফুরে গলা। দশ হাজার পর্যন্ত যখন এসে গেছে, বিশে যেতে খুব সময় নেবে না ভদ্রলোক। সে শুপ্রাকে পানি আনতে বলে। শুপ্রা খুশি মনে যায় পানি আনতে। এই না হলো দামু! একেবারে আগুন। সে পানি এনে দিলে দামিনী কুলকুচি করে বলে,

" আরে কাকা যাচ্ছেন না কেন? আমি একটা কাজে বেরোবো তো। যান যান?"

শুক্কুর আলী ঠায় বসে রয়। দামিনীকে হাত ছাড়া করা বোকামি।আবার বিশ হাজার টাকাও অনেক বেশি। 

" দামু এমন করো ক্যান? আমাদের দিকটাও একটু বোঝো। আচ্ছা আমি বড় ভাইয়ের সাথে কথা কইয়া তোমারে আরো কয়েক টাকা বাড়াই দিবো নে!"

শুক্কুর আলীর কথায় দামিনী স্মিত হাসে। উঠে দাঁড়িয়ে কোমড় ঠিক করে হামি তুলে বলে,

" এক কাজ করো কাকা। তোমার বড় ভাইরেই পাঠাই দিও। তারে চোক্ষের দেখাও দেখলাম না এ পর্যন্ত। আমি কিন্তু অতিথি আপ্যায়ন করতে ভালোবাসি।"

শুক্কুর আলী ভাবনায় পড়ে। দোনামোনা গলায় বলে,

" বড় ভাই এইসবে জড়াইবো না। তাঁর দিক দিশা আলাদা। আমাদের খালি মুনাফা দেয় জলসা সাজাইতে। এই তাঁর কাজ। তুমি চিন্তা কইরো না। আট হাজার দিয়া গেলাম। বাকি আট দিবো নে। তারপর জলসা হিট হইলে আরো পাইবা। আর কথা বইলো না।"

শুক্কুর আলী এগিয়ে এসে দামিনীর ভেজা পিঠে হাত বুলিয়ে বলে। দামিনীর ইচ্ছে করে জায়গা মতো লাগিয়ে দিতে! ইচ্ছে কে দমিয়ে রেখে টাকা গুলো হাতে নেয়। মুচকি হেসে শুক্কুর আলীর হাতের মুঠোয় থাকা পানটা লোকটার মুখে পুরে দেয়। শুক্কুর আলীর সন্দেহ গেলো কাঞ্চিতলায়! এ তো পান নয়! এ যে অমৃত সুধা!

শুক্কুর আলীকে বিদায় দিয়ে দামিনী লন্ঠণ হাতে বেরিয়ে পড়ে। সঙ্গী শুপ্রা। গায়ের কালো চাদরে মুখটা ঢাকা দু'জনের। টিমটিমে বাতির আলোয় সাবধানে পা ফেলে। রাত খুব একটা গভীর হয় নি; সবে সাঁঝ ফুরোলো। বাঁশঝাড় পেরিয়ে কালি মন্দিরের পেছনের পুকুরের কিনারা ঘেঁষে হাঁটে। একটা ছোট্ট কুটিরের সামনে দাঁড়িয়ে পা থমকায়। এক রূগ্ন বৃদ্ধা বসে খুঁক খুঁক করে কাশছে। মেঘে ঢাকা ক্ষীণ জোৎস্নার আলোয় হাড্ডিসার রূগ্ন দেহখানা দেখে দামিনীর চোখ ভিজে ওঠে। অস্ফুট স্বরে ডেকে ওঠে,

" বাবু?"

গলার আওয়াজ ক্ষীণ হলেও বৃদ্ধার কর্ণগহ্বরে পৌঁছায় সে ডাক। তালপাতার হাত পাখা থেমে যায়। ঘার ঘুরিয়ে বলে,

" কে ডাকলো? ললিতা বেরিয়ে আস দিকিনি। কেউ এসেছে বোধ হয়!"

ঘর হতে বেরিয়ে আসে এক বয়স্ক মহিলা। আটপৌরে মলিন শাড়ি। হাতে শাখাবালা জ্বল জ্বল করছে। দামিনী আর দাঁড়িয়ে থাকে না। ছুটে আসে মায়ের কাছে। তবে মায়ের বুকে ঠাঁয় মিলে না। ললিতা বেগম থমথমে মুখে বলেন,

" আর কোনো অমঙ্গল বাকি আছে? অলক্ষ্মী পেটে পুরে ছিলাম। তাঁর শ্রাপে আজ নিঃস্ব আমরা। জেলে পারায় একঘর হয়ে জীবন পার করছি। মরলে মুখে আগুন দেওয়ার মানুষ নাই। ওরে যাইতে কন? মান সম্মান তো কিছুই রাখে নাই। মানষে দেখলে জিন্দা পুড়াইবো।"

দামিনী মুখে আঁচল গুঁজে কেঁদে ওঠে। বৃদ্ধা নিবারণের বুকটা কাঁদে মেয়ের জন্য। তবুও দুর ছাই করে তাড়িয়ে দেন। কেউ দেখলে যে রক্ষে নেই।

°°°°°°°°°°°°°

রঙিন টিভিতে বাংলা সিনেমা চলছে। সিনেমার নাম 'গোলাপি এখন ঢাকায়' ! সুরেলা কৌতুহল মনে বসে বসে টিভি গিলছে। ভালোই লাগছে দেখতে। তাদের বাড়িতে টিভি নেই। শুধু বাড়িতে কেন? আশেপাশের দশ বাড়িতেও নেই। মোল্লার মুদি দোকানে আছে চৌদ্দ ইঞ্চির একখানা টিভি। ছোটবেলায় শাপলারে নিয়ে একবার দেখতে গিয়েছিলো। তখন অবশ্য সাদাকালো ছিলো টিভিটা। দিন দুনিয়া ভুলে শুক্রবারে বিটিভিতে চলমান ছবিতে মেতে ছিলো। সন্ধ্যার দিকে ভাই এসে মারতে মারতে বাড়ি নিয়ে গেলো। সারাটা রাস্তায় ঠাস ঠাস করে চড় মেরেছে পিঠে। শাপলা তো ভয়ে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছিলো। তারপর আর টিভি দেখে নি কখনো। ভয়ে দেখার ইচ্ছে জাগেনি। তবে শাপলার মায়ের বাটন ফোনের ম্যামরিতে ইত্যাদি, ছবি, নাটক ভরে আনে। প্রায়শই ঘুমের বাহানা দেখিয়ে সে শাপলা দের বাড়িতে রাতভর ছবি দেখে; সঙ্গী শাপলা। এ কথা ভাই জানলে খবর করে দিবে। সুরেলা রয়ে সয়ে বসে নরম গদিতে। পিঠা বানানো শেষ তবে সন্ধ্যা গড়িয়ে আসায় যেতে পারছে না। রওশন ভাই কোথাও বেরিয়েছে আসলেই পৌঁছে দিবে। তার পাশেই রূপসা বসে চিপস খাচ্ছে আর টিভি দেখছে। মাঝে মাঝে তাকে বলছে কার নাম কি। নায়কের নাম ইলিয়াস কাঞ্চন, নায়িকা চম্পা। আর যে মহিলাটা বেশি বেশি কাঁদছে তাঁর নাম ববিতা। তাঁর আহাজারিতে ভরপুর কান্না দেখে রূপসার চোখগুলোও ছলছল করছে। সুরেলা ঠোঁট চেপে হাসে। মেয়েটা অতি মাত্রায় আহ্লাদী আর বাচ্চামো স্বভাবের। আজ প্রথমবারের মতো মনে হলো নাহ্ মেয়েটা অতটাও খারাপ না। তবে খুব বেশী বিরক্তিকর। এই যে একটু পরপরই প্যান প্যান করছে রিজ ভাই হ্যান রিজ ভাই ত্যান! সে পারে না ছুটে বেরিয়ে যেতে। অসহ্য। এর মাঝেই ঘরে উপস্থিত হয় এ বাড়ির কাজের মহিলা। সুরেলার উদ্দেশ্যে বলে,

" আপনেরে বড় গিন্নী ডাকে। জলদি আইয়েন?"

বলে তার মতো সে চলে যায়। সুরেলা আহম্মকের মতো বসে থাকে। রিনা খান আবার ডাকলো কেন তাঁকে? মহিলারে দেখলেই তাঁর গায়ের কাঁটা দাঁড়িয়ে যায়। এমন ভাবে তাকায় যেন সে তাঁর বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে। সুরেলা রূপসার দিকে চায়। মেয়েটা ঘন ঘন ওড়নায় চোখ মুছছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে আসে ঘর ছেড়ে। দক্ষিণ দিকের বারান্দার দিকে পা বাড়ায়। কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই পা থমকায়। চোখ তাঁর কপালে উঠে। সম্মুখে দরজায় ঠেস দিয়ে দন্ডায়মান নওরিজ মাহবুব। মুখটা অস্বাভাবিক মাত্রায় গম্ভীর। ফর্সা নাকটা টমেটোর মতো লালা আকার ধারণ করেছে। গভীর নয়নাভিরাম হলদেটে ভাব দেখা যায়। গভীর নয়ন যুগলের শান্ত চাহনিতে কিছু একটা আছে যা সুরেলার পা থেকে মাথা অবদি নাড়িয়ে দিলো। শুকনো ঢোঁক গিলে আশেপাশে তাকায়, কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।

" সুর দেখ কি হাল করে ছেড়েছিস আমায়। আমি জ্বলছি অদৃশ্য আগুনে তবুও তনুমন উষ্ণতা খুঁজে বেড়ায়!"

গমগমে সুরে বলে নওরিজ মাহবুব। সুরেলা চোরের মতোন এদিক ওদিক চায়। কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। নওরিজের কথা কানে বাজতেই দাঁত কেলিয়ে বলে,

" জিনে আছর করছে আপনেরে। ঝাঁটার বাড়ি খাইলে ঠিক হবেন। নইলে হেকমত হুজুরের পানি পড়া আইনেন। পানি দিলে আগুন নিইভা যাইবো নে!"

শেষোক্ত বাক্য দাঁতে দাঁত চেপে বলে। নওরিজ গায়ের চাদরটা একপাশ থেকে সরিয়ে এক হাত মেলে আবারও প্রত্যুত্তর করলো,

" জিনে না এক কৃষ্ণ কায়ার আছর লেগেছে। তাকে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করতে না পারলে এ আগুন নিভবে না।"

সুরেলার কান গরম হয়ে ওঠে। কপোল জোড়ায় রক্তিম কৃষ্ণচূড়া ফুটে উঠেছে। কি বেহায়া! কি নির্লজ্জ ভঙ্গিতে গতর দেখাচ্ছে। মনে মনে তওবা কাটে সুরেলা। ঘন ঘন এদিক ওদিক তাকিয়ে উল্টো পথে পা বাড়ায়। চাপা স্বরে হিসহিসিয়ে বলে,

" শালা লুইচ্চা ব্যাটা মানুষ! খালি গতর দেখাইয়া বউয়ের হক নষ্ট করে। ওই বুকে পাথর চাপা পড়ুক।"

বিড়বিড় করে হাঁটতে থাকে সুরেলা। কোথায় যাচ্ছে কোনদিকে যাচ্ছে ধ্যান নেই। মস্তিষ্ক জুড়ে অনাকাঙ্খিত দর্শন ঘুরে বেড়ায়। যেন এখনও চোখের পাতায় লুকোচুরি খেলে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে অসাবধানতাবশত ধাক্কা লাগে কিছু একটার সাথে। হুঁশে ফেরে সুরেলা। পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। তবে সামনের মানবীকে দেখে পূর্বের তুলনায় আরেকটু বেশি শক খেলো যেন। মেঝেতে পড়ে থাকা দই চিড়ের বাটিটা উবু হয়ে পড়ে আছে। সুরেলা ভয়ে ভয়ে সেটা তুলে নেয়। দই চিড়ে মাখা নষ্ট হয়ে গেছে। সে খালি বাটি তুলে আমতা আমতা করে বলে,

" আমি খেয়াল করি নাই গিন্নী মা। ভুল হয়ে গেছে!"

বলে মাথানত করে নেয়। দেখে হাঁটা উচিত ছিলো তাঁর। রেবেকা বানু শক্ত চোয়ালে দাঁত কিড়মিড় করে। ইচ্ছে করে থাপ্পড়ে গাল লাল করে দিতে। নিজের হাত সংযত করে নেন তিনি। গাল লাল করার চাইতেও ধারালো অস্ত্র আছে তো! তিনি ঠোঁট বাঁকিয়ে মিষ্টি হেসে বলেন,

" তা খেয়াল করবে কেন? আসলে হয় এমনটা। কি যেন বলে? ময়লা আবর্জনা থেকে খুঁটে খাওয়া কুকুর মাংস ভাত পেলে দিন দুনিয়া ভুলবেই তো! এখনি পরিষ্কার করে দিবি মেঝে!"

সুরেলার মুখের উপর যেন কেউ থুতু ছিটিয়ে দিলো এমন অনুভূত হয়। রাগে অপমানে নোনাজল জমে যায় কান্তিমান নয়ন যুগলে। সুরেলা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নেয়। রেবেকা বানু চলে যাবে পেছন থেকে রওশনের গলা ভেসে এলো।

" চাচি আম্মা? কি হয়েছে?"

বলতে বলতে এগিয়ে আসে। সুরেলার নতমুখ দেখে কপাল কুচকায়। রেবেকা বানু হেসে বলেন,

" চোখ কান আসমানে রেখে হাঁটলে উষ্ঠা খাবেই তো। পরিষ্কার করিস সুর? আমার ছেলেটা দেখলে জমেলা'কে ধমকাবে আবার।"

রওশন সুরেলার দিকে তাকায়। মামলা সুবিধার ঠেকছে না। চাচি কি সুরেলাকে কথা শুনিয়েছে? হয়তোবা। রেবেকা বানু চলে যান হনহনিয়ে। দু'টো কথা শুনিয়ে একটু শান্তি শান্তি লাগছে তাঁর। রওশন সুরেলার হাত থেকে বাটিটা নিয়ে রেখে দেয়। স্মিত হাসার চেষ্টা করে বলে,

" চাচি কথা শুনিয়েছে? ওনার কথায় কিছু মনে করো না সুরেলা। চলো এগিয়ে দিয়ে আসি। সিন এসেছে তোমাকে নিতে।"

সুরেলা মাথা নাড়লো কোনোমতে। এই জাহান্নামে আর এক মুহূর্তও নয়। তাঁরা পা বাড়ায়, পেছন থেকে ডাক পড়ে। নওরিজ এগিয়ে আসে। সুরেলার পাশে দাঁড়িয়ে রওশনকে উদ্দেশ্যে করে বলে,

" আমি এগিয়ে দিয়ে আসি। সিনের সাথেও কিছু কথা আছে। তুই যা সাদমান ভাই খুঁজেছিল তোকে!"

" সময় লাগবে না তো। সিন অন্দরমহলের বাইরেই দাঁড়িয়ে.."

" আমি পৌঁছে দিচ্ছি তো‌। তুই যা না ভাই?"

নওরিজের বিরক্ত হয়েই বলে। রওশন অনিচ্ছা সত্ত্বেও চলে যায়। যত হোক বড় ভাই! কথা অমান্য করলে কেমন দেখায় না? রওশন চলে যেতেই নওরিজ মাহবুব সুরেলার পানে তাকায়। শুকনো মুখটা দেখে বলে,

" সামনে হাঁট?"

সুরেলা পা বাড়ায় লম্বা লম্বা করে। নওরিজ একটু দূরত্ব রেখে পিছু হাঁটে। কন্ঠ খাদে নামিয়ে শুধালো,

" দেখে হাঁটতে পারো না? লেগেছে কোথাও?"

নরম গলা তাঁর। তার উপর তুমি সম্বোধন। সুরেলার চিঠির কথা মনে ভাসে। সেখানেও তুমি সম্বোধন করেছিল। হাসি পায় তাঁর। মায়ে কতটা মিষ্টি ভাষায় অপমান করলো; আর ছেলে জিজ্ঞাসা করছে ব্যথা পেয়েছে কি না! তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে নাক ডলে বলে,

" লাগছে তো। খুব জোরেই লাগছে।"

কন্ঠে কেমন হেয় সুর। নওরিজ ছোট্ট করে শুধালো,

" আম্মা কিছু বলেছেন?"

সুরেলা থেমে যায়। ঘার ফিরিয়ে তাকায় লোকটার পানে। নওরিজ বরফ শীতল শান্ত চাহনির প্রেক্ষিতে চোখ বুজে নেয়। বুঝতে বাকি থাকে না আম্মা কথা শুনিয়েছেন। চোয়াল শক্ত হয় তার। 

" নত মুখী সুরেলা হয়ে আর এ বাড়িতে আসবে না, ছোট্ট করে বলে দিলাম। পা বাড়াও?"

শান্ত গলার আদেশ বানী সুরেলার পোড়া গায়ে যেন নুনের ছিটা। পারে না দৌড়ে বেরিয়ে যেতে। নয়ন যুগ্ম বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে। নোনাজলে ভিজে চুপচুপে কপোল। সুতি ওড়নার ঘর্ষণে রক্তিম হয়ে আসে। অল্প সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দেখা হয় ছামিনা বেগমের সাথে। একটা ছোট্ট পুঁটলি বেঁধে তাঁর দিকে বাড়িয়ে বলেন,

" সাবধানে যেও। এখানে কিছু পিঠা আছে শান্তি আপারে দিও।"

সুরেলা হাতে নেয় না। থমথমে মুখে বলে,

" আম্মায় পিঠা খায় না।"

কথা শেষ করে অপেক্ষা করেন না। ছামিনা বেগম একটু অসন্তুষ্ট হন। এই মেয়ের এই দেমাগ দেখলে রাগ হয় তাঁর। বড়দের সাথে কথা বলতে শেখে নি। 

সুরেলা বেরিয়ে আসে মেইন ফটক পেরিয়ে। ভাইকে দেখে ছুটে যায়। নওরিজ গম্ভীর মুখে পিছু পিছু হাঁটে। সৌজন্যবোধকে ধিক্কার জানিয়ে ভনিতা ছাড়াই সিনানকে বলে,

" ছোট খুকি না তোর বোন। আর না তুই অচল যে বোনকে অন্যের বাড়িতে ফরমাইশ খাটাতে পাঠাবি।"

সিনান কপাল কুঁচকে বোনের দিকে চায়। সুরেলার সমস্ত রাগ অভিমান, অপমান বোধ এবার ভয়ে পরিণত হয়। সে ঢোক গিলে ভাইয়ের হাত শক্ত করে চেপে ধরে। সিনান রাগে না যাত্রায়।কথার মানে বুঝতে না পারলেও কিছুটা আন্দাজ করতে পারে। তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,

" আপনে গোরে ফরমাইশ খাটার লোকের অভাব নাই। তবুও ঘুরে ফিরে এই ঝিয়ের ডাক পড়ে ক্যান বুঝি না বাপু! ডাক দিবেন না, আইবো না। ডাক দিবেন, না আইলে সালেহউদ্দিনের কাছে বাঁকা ত্যাড়া কথা কইবেন। উনি বাড়ি গিয়া তাফালিং (গরম) দেখাইবো! হ্যান ত্যান হুমকি দিবো।"

"সেটা একান্তই তোদের পারিবারিক ব্যাপার। ছোট নেই সুর। আশাকরি বুঝতে পারবি।"

নওরিজের বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে। সিনান আর তর্কে যায় না। বোনের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। সুরেলা পুতুলের মতো পা মেলায়। নিজেকে বোঝা ছাড়া কিছুই মনে হয় না তাঁর। 

নওরিজ চাদরিটা ভালোভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে। এদিকে ওদিকে না তাকিয়ে সরাসরি মায়ের ঘরে যায়। রেবেকা বানু ঘরে বসেই পান বানাচ্ছিলেন। ছেলেকে দেখে মিষ্টি হেসে বলে,

" রিজ? এদিকে আয় আব্বা! জ্বর কমেছে কি? তোর আব্বারে বলছি আসার পথে ডাক্তাররে সাথে আনতে।"

নওরিজ ভেতরে ঢুকে মায়ের মুখোমুখি দাঁড়ায়। শক্ত চোয়ালে বলে,

" খুব অহংকার আপনার তাই না আম্মা? আপনার অহংকার আপনার উপর ভারী না পড়ে। ভালো কথা বলতে না পারলে চুপ থাকার চেষ্টা করবেন। শান্তি পাবেন।"

রেবেকা বানু স্থীর হয়ে বসে রয় । মুখে থাকা পানটাও চিবোতে ভুলে যান। নওরিজ আর অপেক্ষা করে না। হনহনিয়ে বেরিয়ে যায় কামরা হতে।
.
.
.
চলবে.....................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp