!!৬!!
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। বেলকনির দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে চারু। চোখ-মুখ গম্ভীর। ভ্রু যুগল কুঁচকানো। একটু পর পর ঠান্ডা শীতল হাওয়া এসে শরীরকে কাঁপিয়ে তুলছে। চারু দৃষ্টি আকাশের দিক থেকে সরিয়ে বাড়ির সামনে তাকায়। গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে লোকমান রহমান ও তার ফুপু বিদায় দিচ্ছেন, শাজান সিকদার ও তার পরিবারকে। ওরা তিনজন গাড়িতে উঠে বসামাত্র গাড়িটা বাতাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হুরহুর করে চলে গেল। চারু তপ্ত শ্বাস ফেলল। চারু চোখ সরালো। বাড়ি থেকে একটু দূরে একটা বিশাল বড় আম গাছ। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে ওইখান টায় কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল চারু। চোখ দুটো সরু করে চাইল। আশবিন। হ্যাঁ আশবিন! ও ওখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন? মনে হচ্ছে কোনো পাথরের মূর্তি। সহসা আশবিন মাথা তুলে তাকালো চারুর বারান্দার দিকে। আচমকা তাকায় থমকে উঠল চারু।
আশবিন কিংকর্তব্যবিমুঢ় দাঁড়িয়ে আছে। লোকমান রহমান বাড়ির ভেতর চলে যেতেই আশবিন হাতের ইশারায় চারুকে নিচে আসতে বলে। চারু ডানে-বামে মাথা নেড়ে তাত্ক্ষণিক রুমের ভেতর চলে গেল। বিছানার উপর বসে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। হৃৎস্পন্দন বাড়তে লাগল। ধুকপুকানির আওয়াজ শুনতে পেল চারু। কোনো ছেলের সাথে কথা বলতে দেখলেই আশবিন তাকে পেটায় সেখানে সে যদি জানতে পারে ওকে একজন দেখতে আসছে তাহলে ও কী করবে? ভাবতে শরীরে কাঁটা ফুটলো যেন।
হঠাৎ ক্রিংক্রিং শব্দে ফোন বেজে উঠল। ঘাড় ঘুরিয়ে বিছানার উপর থেকে ফোনটা নিল সে। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে আশবিন এর নাম। চারু শুঁকনো ঢোক গিলে নেয়। কলটা কেটে ফোনটা আবার বিছানার উপর উল্টো করে রাখে। সশব্দে ফোন আবারও বেজে উঠল। চারু জানে সে যতক্ষণ কল রিসিভ করবে না ততক্ষণ আশবিন ওকে কল করবে। চারু কল রিসিভ করল। আশবিন কিছু বলার আগে চারু তটস্থ ভঙ্গিতে শুধালো,
'কি চাই? বার বার কল দিচ্ছেন কেন?'
আশবিন চোয়াল শক্ত করে। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, 'অনেক সাহস হয়েছে না? আমার কল কাটার সাহস কে দিয়েছে তোমাকে? দুই মিনিট সময় দিচ্ছি,কথা আছে জলদি নিচে আসো।'
চারু থতমত কণ্ঠে বলল, 'পারব না। আব্বা বাসায় আছেন। দেখলে বকা দিবেন।'
আশবিন শক্ত গলায় ধমক দিয়ে বলল, 'চুপচাপ নিচে আসো। আমাকে বাধ্য কোরো না উপরে আসতে। আমি ভয় পাই নাকি তোমার বাপকে?'
চারু কান থেকে ফোন নামিয়ে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। হাত বাড়িয়ে ওড়নাটা টেনে গলায় পেঁচিয়ে বাড়ির বাইরে এল। ততক্ষণে আশবিন গেইটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। চারুকে দেখামাত্র আশবিন শক্ত গলায় বলল, 'এইমাত্র যে গাড়িটা গেল। ওরা কেন এসেছিল?'
চারু বিচলিত হয়। থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করল, 'কেন? যেই আসুক। তাতে আপনি কী?'
আশবিন ধমকে উঠল। উচ্চগলায় বলল, 'কথা পেঁচাচ্ছো কেন? সোজা কথার সোজা উত্তর দিতে পারো না?'
চারু আহত চোখে তাকিয়ে আছে। আশবিনের হঠাৎ করে হলো কি? সে কখনো চারুর সাথে এই টোনে কথা বলেনি। চারু মাথা নিচু করে ফেলল। আশবিন হালকা আকাশে রঙের শার্ট পরেছে। শরীরের সাথে আঁটসাঁট ভাবে লেপ্টে রয়েছে শার্টটা। চারুর কোঁকড়া চুলগুলো পিঠে পড়ে আছে। আলগোছে চুলগুলো হাতের সাথে পেঁচিয়ে কাঁকড়া দিয়ে বেঁধে নিল। আশবিন আকাশের দিকে তাকিয়ে গভীর শ্বাস ছাড়ল। ফুলহাতা শার্ট কনুই পর্যন্ত ভাজ করতে করতে জিজ্ঞেস করল, 'প্রশ্ন করেছি কানে কথা যাচ্ছে না?'
চারু থমথমে গলায় বলল, 'মন্ত্রী শাজান সিকদার আর তার স্ত্রী ও ছেলে এসেছিল।'
আশবিন রুক্ষ গলায় করল, 'কেন এসেছিল?'
চারু ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, 'আমায় দেখতে এসেছিল। বিয়ের পাকা কথাও হয়ে গেছে।'
আশবিন শক্ত করে হাত দু'টো মুষ্টিবদ্ধ করল। রাগে শরীর কাঁপছে। আশবিন হুট করে চারুর হাতটা চেপে ধরে। মৃদু আর্তনাদ করে উঠল চারু। আশবিন চোখ বন্ধ করে ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,
'তুমি এই বিয়ে করবে না। বাসায় গিয়ে সোজাসুজি না করে দিবে। তুমি শুধু আমার। আমি বেঁচে থাকতে তোমাকে কেউ আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না। কেউ না।'
চারু চোখ তুলে তাকিয়ে একপলক দেখে তৎক্ষনাৎ চোখ নামিয়ে ফেলল। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করছে তার। সে জানত, ওর বিয়ের খবর শুনলে আশবিন উন্মাদ হয়ে যাবে। চারু আশবিনের হাতটা ছেড়ে দিয়ে দ্রুত যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। আশবিন রাগান্বিত গলায় বলল, 'তোমার ভাগ্যে শুধু আমার নাম লেখা। তোমার সবটা জুড়ে আমি থাকব। কেবল আমি।'
চারু সরল গলায় বলল,
'আমি ভেতরে যাই?'
সংবিৎ ফিরে পেল আশবিন। উপর-নিচ মাথা নাড়ল। চারু নিশ্চল পায়ে চলে গেল। আশবিন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে চটজলদি কাউকে কল করল। মুখটা বিভৎস ভাবে কুচকে বিরক্তির সাথে চলে গেল।
!!৭!!
সিকদার বাড়ির চেহারাটা এক ঝটকায় বদলে গেছে। কেউ আন্দাজ করতে পারছে না কি হচ্ছে। সবার মুখের অবস্থা থমথমে। আফনান এর বিয়ে ঠিক হয়েছে। খুশির খবরে সবার চেহারায় আনন্দ উল্লাস ফুটে উঠেছিল। হঠাৎ আশবিনের আগমনে সবার আনন্দ টুকু গ্লানিতে পরিণত হয়েছে। সোফিয়া খাতুন থমকালেন। ভয়কাতুরে দৃষ্টিতে আশবিনের দিকে তাকিয়ে আছে, ছেলেটার রাগ জেদ সম্পর্কে সোফিয়া জানেন। রাগের বশে কখন কি করে বসে তার ঠিক নেই। সোফিয়া নিশ্চুপ। সোফিয়া শুকনো ঢোক গিললেন। আশবিন রেগে আছে কেন? তার এখানে আসার কারণটাই বা কী? মারাত্মক প্রয়োজন না হলে সিকদার বাড়ির আশেপাশেও সে আসে না। তবে আজ কী? তথ্য জানার আগ্রহ কিছুতেই দমাতে পারছেন মা সোফিয়া। শাজান সিকদার কথা বলছেন না। দুই ছেলের মুখ থেকে কথা শোনার জন্য তাকিয়ে আছে। হঠাৎ সোফিয়ার কণ্ঠ শুনে তার দিকে তাকায় শাজান। সোফিয়া ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, 'তোমার ছেলে কেন এসেছে? কি চায় সে? তুমি একবার জিজ্ঞেস করো। ওদের দুই ভাইকে দেখে মনে হচ্ছে একজন আরেকজনের রক্তের পিপাসু হয়ে গেছে।'
শাজান সিকদার ঠোঁট নাড়িয়ে বললেন, 'আমি জানি না সোফিয়া ও কেন এসেছে। ওরা কি বিষয়ে কথা বলছে? তুমি শুনতে পাচ্ছো কি?'
সোফিয়া 'না' সূচক মাথা নাড়ল। তিনি শুনতে পাচ্ছেন না। শাজান সিকদার ঢোক গিললেন। কি চলছে তার দুই ছেলের ভিতর? ওরা কি নিয়ে কথা বলছে?
আশবিন চোয়াল শক্ত করে। বাবা-মাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ আফনানের শার্টের কলার চেপে ধরল। তখনই পরিস্থিতি হঠাৎ স্রোতের বিপরীতে বইতে লাগল। আশবিনের আচমকা আক্রমণের অপেক্ষায় ছিল যেন আফনান। রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল আফনানের ওষ্ঠদ্বয়ে। সে মেরুদণ্ড টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে। আশবিনের কাজ দেখে শাজান সিকদার ও সোফিয়া ওদের পাশে এসে দাঁড়ায়। ছোটো ছেলের হাত টেনে ধরে বললেন, 'আশবিন কি বেয়াদবি করছো? রাস্তায় থেকে থেকে ছোটোলোকদের মতো কাজ করছো। ও তোমার বড় ভাই। ছাড়ো বলছি।'
আশবিন ছাড়লো না। বাবার কথা কানে তুললো না মোটেও। আশবিন মুখ থেকে বলল, 'আমি ওর জান নিয়ে নেবো। ওর সাহস হয় কি করে আমার প্রাণের দিকে হাত বাড়ানোর। আমার জীবনের সব সুখশান্তি ও নিজের করে নিয়েছে। কিন্তু এই বার আমি আর সেটা হতে দেবো না।'
শাজান সিকদার ভ্রু কুঞ্চিত করলেন। ছেলের কথা তার মাথার উপর দিয়ে গেল যেন। কিসের প্রাণ? আশবিন ঘটনা তাদের বলল। সবশুনে শাজান সিকদার দোটানায় পড়ে গেল। তার দুটো ছেলে একটা মেয়ের জন্য লড়াই করছে। এক ভাই আরেক ভাইয়ের প্রাণ নিতে উঠেপড়ে লেগেছে। শাজান সিকদার ভারী নিঃশ্বাস ফেলল। বললেন, 'ঠিক আছে। আমি দেখছি কি করা যায়।'
আশবিন চেঁচিয়ে বলল, 'চারু আমার। শুধু আমার। ওর দিকে হাত বাড়ালে আপনার বড় ছেলের অস্তিত্ব আমি দুনিয়া থেকে মুছে দিবো।'
আফনান শান্ত গলায় বলল,
'আমার জন্য বাবা আপনি তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। আমার বিয়ে তার সঙ্গেই হবে। আর যদি না হয়, আপনার সাম্রাজ্য ধূলিসাৎ করে দেবো।'
আশবিন তেড়ে এল। সহসা কয়েক জোড়া চোখকে বিস্ময়াভিভূত করে দিয়ে আফনান তার পিছনে প্যান্টে গুজে রাখা পিস্তলটা বের করে আনলো। হঠাৎ সেটা আশবিনের কপালে ঠেকিয়ে বলল,
'আমার সাথে খেলতে আসলে মৃত্যুকে গলা লাগাতে হবে। আমি যা চাই। সেটা যেকোনো উপায় নিজের করে নেই। তুই এই গল্পের হিরো আর আমি ভিলেন। যেখানে আমি ভিলেন, সেখানে নায়ক-নায়িকাকে পাবে ভাবাও মূর্খতা।'
আশবিনের চাহনিতে ক্রোধ। আফনানের কথাশুনে রাগের চোটে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। আশবিন খিটখিটে মেজাজে সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দেয়, 'আমি বেঁচে থাকতে সম্ভব নয়।'
আফনান হাসল। মাপা হাসি। কপাল কুঁচকে ফেলল, 'পিস্তলের সামনে দাঁড়িয়ে এই কথা একদম বেমানান।'
শাজান সিকদার ধমক দিয়ে উঠলেন। আশবিন বাবার দিকে তাকিয়ে কণ্ঠে তেজ বজায় বলল, 'আপনার ছেলেকে সাবধান করে দিন আব্বা। আমার ভালোবাসার দিকে হাত বাড়ালে তাকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবো। আগুন নিয়ে খেলছে।'
আফনান মাথা নিচু করে বাঁকা হাসি দিল। আফনান উচ্চস্বরে বলল, 'যেদিন সে আমার গাড়িতে উঠে বসেছিল, সেদিন থেকে সে আমার হয়ে গেছে। তার সামনে আগুন আছে নাকি পানি সেটা আমার দেখার বিষয় না।'
আশবিন কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
'ও কোনো জড়বস্তু না যে তুই বলি আর ও তোর হয়ে গেল।'
আফনান ঠোঁট টিপে হাসল। সহাস্যে বলল,
'প্রসেস চলছে ব্রো।'
·
·
·
চলবে........................................................................