গভীর এই গুহার নিঃস্তব্ধতায় শুধু কাঠ পোড়ানোর কড়কড় শব্দ। আগুনের লেলিহান শিখা মাঝে মাঝে আলো ছুঁড়ে দিচ্ছে ভেনোরার ক্লান্ত মুখে। সে চোখ বন্ধ করে ধ্যানস্থ অবস্থায় আছে। সমস্ত যন্ত্রণা সত্ত্বেও নিজেকে ধরে রাখার শেষ চেষ্টায় রত। পিঠে জরিবুটির পাতাগুলো শুকিয়ে কাঠ কাঠ হয়ে যাচ্ছে। তবুও ব্যথার উত্তাপ কমেনি। প্রতিটি নিঃশ্বাসে শরীর ভেঙে পড়ছে ভেনোরার। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ সেই ব্যথা এমন চূড়ায় ওঠে যায় যে ঠোঁট কামড়েও দমন করা যায় না। কণ্ঠ থেকে চিৎকার বেরিয়ে আসে অনিচ্ছায়। চোখ বন্ধ করে ভেনোরা সেইদিনের কথাই মনে করছে। মনে করছে সেই ঈগলটিকে। মন থেকে খুব করে ডেকে যাচ্ছে তাকে। আজ নিজের ভুলের জন্য ই তার একটা পাখনা হারিয়ে ফেললো। কিন্তু যে পাখনা তার ছিলই না, তার ক্ষত এত গভীর কেন? কেনো এতো কষ্ট হচ্ছে? এই প্রশ্নই এখন তার সমস্ত ধ্যানের কেন্দ্রে। চিন্তা করতে করতেই একটা আওয়াজ হলো চোখের সামনে। ভেনোরা ধীরে ধীরে চোখ খুললো। তার ফর্সা মুখ তীব্র ব্যথায় লাল রঙ ধারণ করেছে। চোখের সামনে আবির্ভাব ঘটলো কালো পোশাক পরিহিত একজন নারীর। ভেনোরা ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেললো। আগুনের আলো নারীটির চোখে রহস্যময় দীপ্তি ফুটিয়ে তুলেছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো তার মুখে অন্ধকার! মুখমণ্ডল দেখা যাচ্ছিল না। শুধু চোখ দুটোই চমকে দিচ্ছিল। ভেনোরা তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে বিস্ময় নিয়ে অপলক তাকিয়ে আছে নারীটির দিকে।
লম্বা কালো পোশাক পরিহিত নারীটি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে আগুনের পাশে বসে পড়লো। তার আচরণে মনে হলো ভেনোরার বহুদিনের পরিচিত কেউ সে। গম্ভীর কণ্ঠের অধিকারী মুখ খুললো,
"তুমি আমাকেই ডাকছিলে তাইতো?"
ভেনোরা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
"যে আমাকে ঈগলের শক্তি দিয়েছে সে কি আপনি?"
নারীটি মাথা নাড়লো।
"হ্যাঁ। আমার শরীরে ঈগলের শক্তির সময় ফুরিয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুর পূর্বে সেই শক্তি বিলিয়ে দিয়েছিলাম তোমাকেই। ঈগলের শক্তি কখনোই সাদামাটা কোনো প্রাণের গায়ে যায় না। এটা সেইসব আত্মাদের খোঁজে চলে যারা ভিন্ন গুণসম্পন্ন, দিকভ্রষ্ট, যারা নিজের পথ খুঁজে পায়নি কিন্তু যে হৃদয়ে এখনও কিছু একটার খোঁজ থেকে যায়। তুমি তেমনই এক আত্মা, ভেনোরা। আমি জানি তুমি ভবিষ্যৎ আন্দাজ করতে পারো। কিছু ঘটে যাওয়ার আগেই তুমি বলে দিতে পারো কি হতে যাচ্ছে। কিন্তু এই শক্তি কি কাজে লাগতে হবে তা তুমি জানতে না। তাই আমার পরে তুমি এই শক্তির ধারক হয়েছো। একদিন তুমিও নিজেই বুঝবে কার শরীরে এই শক্তি দিয়ে যেতে হবে। যেদিন সেই মানুষকে খুঁজে পাবে সেদিনই শেষ হবে তোমার এই জীবনের অধ্যায়।"
ভেনোরা বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। আচমকাই বললো,
"আমার একটা পাখনা!"
"জানি! তা ঠিক করতেই তোমার কাছে আসতে হলো। আমি সাধারণত কারো সম্মুখে সহজে ধরা দেই না। কিন্তু তোমার কষ্ট দেখে নিজেকে আটকাতে পারলাম না। আমি জানি একদিকে তোমার হৃদয় ভেঙ্গে গেছে অন্যদিকে তুমি নিজের কাছের মানুষের হাতে আঘাত পেয়েছো যা কষ্ট করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।"
ভেনোরা চুপ করেই রইল। নারীটি একটু সরে বসতেই আগুনের আলোয় তার মুখ দেখা গেলো। ভেনোরা ভয় পেয়ে পিছনে সরে গেলো। নারীর চেহারায় রয়েছে ভরপুর লম্বা লোম। ঘন লোমের কারণে ভয়ংকর দেখতে সে। ভেনোরা ভড়কে উঠে দাঁড়ালো। কয়েক পা পিছিয়ে গেলো সে। নারীটি হেসে ফেললো ভেনোরার কর্মকান্ডে। ভেনোরার সামনে এসে তার কাঁধে হাত রেখে ফিসফিসিয়ে বললো,
"ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মৃত্যুর পর আমি ভয়ংকর হয়ে গেছি। সেসব কথা থাক। আমি নিজেকে ব্যবহার করে তোমাকে আরেকটি পাখনা ফেরত দিবো। তুমি যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাউকে সাহায্য করতে চাও সেটা ব্যবহার করতে পারো কিন্তু আবারো ধোকা খেয়ে নিজের ক্ষতি করো না। নাহলে আবারো এই পাখনা চলে যাবে আর তোমাকে একটি পাখনা দিয়েই সারাজীবন কাটাতে হবে। আর এই এক পাখনা তুমি কাউকে দিয়েও যেতে পারবে না। তোমাকে আজীবন এই ভুবনে কষ্টের মাঝে বসবাস করতে হবে।"
ভেনোরা চিন্তিত হয়ে মাথা নাড়লো। আর সেই নারীটি কিছু সময় নিলো। নিজের হাত ভেনোরার পিঠে রেখে শক্তি ব্যবহার করে পাখনাটি ফিরিয়ে আনলো। ভেনোরা এই সময়টাতে চোখ বন্ধ করে ছিলো। যখন ই চোখ খুললো সেই নারীকে আর খুঁজে পেলো না সে। দ্রুত চারপাশে চোখ বোলালো সে। কিন্তু নারীটির দেখা আর মিললো না।
*******
অনন্যা বাড়ি থেকে বেরিয়ে চারদিকে সতর্ক চোখে তাকালো। কালো রঙের সূক্ষ্ম ডিজাইনে খচিত সালোয়ার কামিজে তার পুরো শরীর ভিজে চুপচুপে। বৃষ্টির ধারায় ললাট বেয়ে চুলের গোছা পড়ে রয়েছে চোখের সামনে। প্রতিটি ফোঁটা আরিসারূপী অনন্যার দেহে এক একটি ব্যথার দাগ এঁকে দিচ্ছে। চোখ দুটো বাজপাখির মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে কৌশিককে। ঘন অন্ধকারের ভেতরেও তার দৃষ্টি চিরে চলে যাচ্ছিল বহু দূর পর্যন্ত। কিছুক্ষণ আগেই একটি সিএনজিতে করে এই জঙ্গলের পাশের রাস্তায় নেমেছিল তারা। এখন চারদিকে তাকিয়ে যানবাহনের কোনো চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না। টেলিভিশনে নিউজ হচ্ছে । সকলকে বাসায় থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে। অন্তত যতক্ষণ না পর্যন্ত বৃষ্টিটা না কমে সকলে যেন বাসায় থাকে এই নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে খবরে। এইজন্যই হয়তো যানবাহনের আনাগোনা বন্ধ হয়ে গেছে চারপাশে। সেই সিএনজি জোগাড় করতেও নোহারাকে তখন কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল সিএনজির লোকটাও হয়তো ইতিমধ্যে বাড়িতে ফিরে গেছে।
অনন্যা হাঁটতে হাঁটতে ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলো। ভেতরে ঘোর কাজ করছিল মনে হচ্ছিল কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে বিপরীত দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কৌশিকের বাড়ির উল্টো দিকেই পা বাড়ালো সে। ঘন জঙ্গল শুরু হয়েছে সেদিকটায়। কাদা মাটির ভেতর পা ডুবিয়ে অনন্যা এগিয়ে যেতে লাগলো। পায়জামা কাঁদায় ভরে গেছে। হাঁটা কষ্টকর হয়ে পড়েছে কিন্তু সে থামলো না। পেছন ফিরে তাকানোর মতো মনঃস্থিরতা তার ছিল না।
অবশেষে জঙ্গলের ভেতর লুকিয়ে থাকা একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। বাড়িটির চারপাশে ছিল দুই জন সিকিউরিটি গার্ড যারা বৃষ্টির কারণে ছোট্ট একটি ছাউনি ঘরে দাঁড়িয়ে ছিলো।
একজন ফিসফিসিয়ে বলছিলো,
"আগের মাসের স্যালারি এখনো দেয়নি, স্যার!"
"আমিও পাইনি, ভাই!"
লোকটি চিন্তিত গলায় বললো,
"অন্যবার তো মাস শুরু হওয়ার সাথে সাথে ব্যাংকে টাকা এসে পড়ে। এবার স্যারের কি হলো ঠিক বুঝতে পারছি না।"
"তুমি স্যারকে একটা কল দাও।"
"পাগল হইছো নি, মিয়া? স্যারের সামনে যাইতেই আমার ঢর করে। হেয় যখন চোখের সামনে বাড়িতে ঢুকে আমার বুক ধড়ফড় করে। কয়েক দিন আগের খবর শুনছো নি? ওই যে ওই বাড়ির সিকিউরিটি গার্ডের কথা?"
দ্বিতীয় লোকটি মনে করে উত্তর দিলো,
"না কি হয়েছিল? শুনেছিলাম তো বজ্রপাতে মারা গেছে!"
"আরে না। একজনের কাছে শুনলাম স্যার ই আসলে কিছু করেছিলো। স্যার তো আমাদের মতো সাধারণ না।"
"তাই নাকি? কি বলছিস! আমার তো খুব ভয় করছে। স্যালারির কথা বাদ দে। বাসায় চলে যাই।"
"না না। এটা ঠিক হবে না। স্যারের সাথে কথা বলেই যাওয়া উচিত।"
এর মাঝেই অনন্যাকে দেখতে পেলো দুজনে আর সাথে সাথেই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো তারা। অনন্যা কিছু না বলেই ভেতরে ঢুকে গেল। আজ আর কেউ অনন্যাকে বাধা দিলো না। শেষবার যখন অনন্যাকে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিল তখন তারা বুঝেছিল এই মেয়েটির এখানে প্রবেশের অনুমতি আছে।
অনন্যা কঠোর মুখে এবং ঠান্ডা চোখে সামনে পা বাড়িয়ে হাঁটতে লাগলো। প্রবেশ করলো সেই একতলার বাড়িটিতে। অন্ধকার সম্পূর্ণ বাড়িটি। অনন্যা বাল্বের সুইচ খুঁজে আলো জ্বেলে দিলো। ধীরে ধীরে পুরোনো সেই বাড়ির দেওয়ালের অলিগলিতে চোখ বোলাতে লাগলো। চোখে ধরা দিলো বুকশেলফ। আর বুকশেলফের মধ্যে বইগুলো। বাড়ির বুকশেলফের দিকে খানিক সময় তাকিয়েই সে পথ বদলে ফেললো। কোনো কৌতূহল কাজ করলো না বইগুলোর প্রতি। এগিয়ে গেলো গলিপথের দিকে যেখানে সারি সারি দরজা লুকিয়ে ছিল মনে হচ্ছিল অতীতের শত কাহিনি আছে সেখানে। তৃতীয় দরজার সামনে এসে থামলো অনন্যা। ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে দরজাটা খুলে ফেললো।
রুমটা ছিল প্রায় ফাঁকা। দেয়ালঘেঁষে দাঁড়িয়ে কয়েকটি পুরনো আলমারি শুধুমাত্র। অনন্যা কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো মনে হলো এখানেই কিছু একটা জিনিস তাকে আহ্বান করে চলেছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য। অনন্যা অতঃপর চিন্তিত মুখে এগিয়ে গেলো একটিমাত্র আলমারির দিকে। প্রথমে খোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো সে। কিন্তু দুই হাতে শক্ত করে ধরে আবার চেষ্টা করলো। তাও খোলা সম্ভব হলো না। মনে হচ্ছিল কোনো এক শক্তি দিয়ে বাঁধানো এই আলমারি। অনন্যা রূপী আরিসা তাই নিজের শক্তি ব্যবহার করলো আর এক ধাক্কায় খুলে ফেললো আলমারির দরজা।
আলমারি খুলতেই চোখ ধাঁধানো নীল এক আলোর রেখা বেরিয়ে এলো যেন আকাশের আলো পড়েছে এই জমিনে। অনন্যা আলোর তীব্রতা সামলাতে চোখে হাত চাপা দিলো। কয়েক মুহূর্ত পর ধীরে ধীরে সে আলো সয়ে এলো। আলমারির ভেতরে ছিল মাত্র দুটি বস্তু! একটি প্রাচীন ধনুক আর একটি রূপালি কিনারাওয়ালা তলোয়ার। বস্তু দুটো দেখতেই চোখ বড় হয়ে এলো অনন্যার। এগিয়ে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তলোয়ারটি হাতে তুললো সে। সাথে সাথে নীল বিদ্যুতের রেখা ছুটে গেলো সম্পূর্ণ তলোয়ার জুড়ে। অনন্যার হাতের স্পর্শে জেগে উঠলো ঘুমন্ত অস্ত্রটি। এটাই ছিল আরিসার তলোয়ার। অনন্যার মুখে মুচকি হাঁসি ফুটে উঠলো। তলোয়ারটি হাতে পেয়ে ধীরে ধীরে তার সকল শক্তি জাগ্রত হতে শুরু করেছে। তলোয়ারটির গা ধীরে ধীরে হাত দিয়ে স্পর্শ করলো অনন্যা। তলোয়ারের প্রতিফলনে ফুটে উঠতে দেখা গেলো। আরিসার সেই পুরাতন রূপ যে কিনা দাঁড়িয়ে আছে অনন্যার শরীরের ভিতর।
অনন্যা দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালো। তলোয়ারটি অপর দুই আলমারির দিকে তাক করলো সে। সাথে সাথেই আলমারির দরজা গুলো সপাট আওয়াজ করে খুলে গেলো। ধরা দিলো আরহেনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ কিছু বস্তু, বই পুস্তক আর কিছু সৈন্যদের সরঞ্জাম। অনন্যা এগিয়ে গেলো দরকারি কিছু আছে নাকি তাই দেখলো সে। কিন্তু চোখ বুলিয়ে তেমন কিছু মনে ধরলো না শুধু একটা মুক্তোর নেকলেস ছাড়া। এই মুক্তোর নেকলেসটি সায়েরিনের কাছ থেকে পাওয়া উপহার ছিল। আরিসা তাকে খুব অবহেলা করেছিলো। কিন্তু তখন যদি সায়েরিনের সাথে তার বিবাহ হতো, সংসার হতো আর রাজ্য সামলানোটা একসাথে ঘটতো এখন এই দিন দেখতে হতো না। আরিসা শান্তিপূর্ণভাবে আরহেনিয়াতে জীবন যাপন করতে পারতো। রাজা অ্যালারিক ফেইথ বেঁচে থাকতো। তার ভাইয়েরা সুন্দর করে তাদের জীবন কাটাতে পারতো। আভ্র ভাইয়ের জন্য খুব কষ্ট হয় আরিসার। ভাইদের মধ্যে আভ্র ভাই ই ছিল যে একমাত্র বিশুদ্ধ এবং সুন্দর মনের একজন পুরুষ। আরিসার কারণে তাকেও এই জীবনটা খোয়াতে হলো। শত্রুদের কোনো না কোনোভাবে আটকানোই যেত। কারো প্রাণহানি হতো না। কিন্তু দানব! যার মন নেই, যে নিজের হুশ জ্ঞানে নেই,কি করছে তা নিয়ে জ্ঞাত নয় তাকে কী করে আটকানো যায়??
আভ্র ভাই চিন্তা করেছিলো আরিসার বিয়ের পর পর পছন্দের মেয়েটির সাথে বিয়ের কথা সকলের কাছে তুলে ধরবে। কেউ রাজি না হলেও সে বিয়ে করেই ছাড়বে কিন্তু তাও হলো না। সেই মেয়েটিও নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে হারালো আর আভ্র ভাই নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিলো আরহেনিয়ার নামে। অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে এলো এই এক তলা বাড়ি থেকে। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আবারো ঘুরে তাকালো। সেই বাড়িটির দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখলো। নিজের চক্ষু দ্বয় স্থাপন করে কিছু একটা চিন্তা করতে লাগল। বাড়ির অবকাঠামো দেখে আচমকা মনে হলো এই বাড়িটা এখানে থাকার কথা নয়। কিছু একটা ভিন্ন মনে হচ্ছে অনন্যার। বাড়ির মূল অবকাঠামো দেখলেই বোঝা যাচ্ছে এটা এখানকার নয়। অনন্যা তলোয়ারটি নিচে রেখে নিজের শক্তি প্রয়োগ করলো সেই বাড়ির উপর। সময় এবং শক্তির দ্বন্দ্বে বাড়িটি হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। অনন্যা রূপী আরিসা বুঝতে পারলো এই বাড়িটা শুধু চোখে দেখানো ভ্রম। এই ভূমিতে কোনো বাড়ি তৈরি করা হয়নি। এটি বেড়া দেওয়া একটি খোলা মাঠ ছিল। যার মধ্যে শক্তি ব্যবহার করে ভ্রম তৈরি করেছে কায়েরীথ। বাড়ির ভিতরের জিনিসপত্র গুলো অন্য কোনো স্থানের। কোনো এক স্থানের একটি বাড়ির চিত্র যেখানে এসব আসবাবপত্র রাখা রয়েছে। অনন্যা রূপী আরিসা হাসলো। নিঃসন্দেহে কায়েরীথ বেশ বুদ্ধিমান।
অনন্যা হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে এলো। এখন বৃষ্টি নেই বললেই চলে। মাঝে মধ্যে বজ্রপাত হচ্ছে এই যা! সিকিউরিটি গার্ড গুলো নেই। নিশ্চয়ই বৃষ্টি কমতে দেখে শেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাড়ির পথ ধরে হাঁটবার। অনন্যা কিছুটা এগিয়ে আসতেই থমকে দাঁড়ালো। চোখের সামনে পরিচিত একজনের মুখ দর্শন হয়ে গেলো তার। যদিও মুখমণ্ডল পরিচিত নয়। কিন্তু তার চোখ দুটো! চোখ দুটো আরিসার খুব পরিচিত। খুব ভালো করেই চেনে তাকে। অনন্যা কিছুটা এগিয়ে আসলো। বাকি রাস্তা সামনের পুরুষ ই কমিয়ে দিলো।
অনন্যা মুখ খুললো,
"আপনি এখানে?"
সামনের মানুষটি মুখ খুললো। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বললো,
"আমি তোমার পিছু পিছু কৌশিক স্যারের বাড়ি এসেছিলাম। কিন্তু গার্ডরা ঢুকতে দিচ্ছিল না। তাই বেরিয়ে এসেছিলাম। তারপর হঠাৎ দেখলাম তোমাকে এই দিকটায় আসতে। তোমার পিছু নিলাম আর এখানে এসে পৌঁছালাম। তোমার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিল। কিন্তু এসে যে ভিন্ন কিছু দেখতে পাবো বুঝিনি।"
"রাজকুমার সায়েরিন! তাই তো? ঠিক বলছি তো আপনার পরিচয়?"
আরণ্যক চোখ বড় বড় করে তাকালো। মাথা নাড়ালো জোর কদমে। দ্রুত গতিতে বললো,
"না! আমি আরণ্যক!"
"উঁহু না। আপনার আঁখি দুটোই বলে দিচ্ছে আপনিও আমার মতো প্রতিশোধের খোঁজে আবারো এই পৃথিবীতে এসেছেন।"
"প্রতিশোধ?"
আরণ্যক নিজের কান চেপে ধরে নিচু কণ্ঠে উচ্চারণ করলো শব্দটা। অনন্যা এগিয়ে আসলো। মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। আরণ্যকের কাঁধে হাত রেখে বললো,
"হ্যাঁ, রাজকুমার। আমরা এই পৃথিবীতে কায়েরীথকে শেষ করতে এসেছি। "
আরণ্যক চোখ তুলে বললো,
"কে কায়েরীথ?"
"এখনকার কৌশিক তখনকার কায়েরীথ।"
এই উত্তরের ভার আরণ্যকের পুরো শরীরকে মাটির দিকে টেনে নিল। কাঁদা-মাখা ভেজা মাটিতেই ধপ করে বসে পড়লো আরণ্যক। প্যান্ট ছুঁয়ে গেলো জমে থাকা বৃষ্টির পানি আর কাঁদার স্তর। মাটি, জল আর হাওয়ার গন্ধে সে নিজেকে মিশিয়ে ফেললো প্রকৃতির সাথে। দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলো সে। চারপাশের পৃথিবীটা হঠাৎ করে এলোমেলো লাগছে সবকিছু। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। অনন্যার এই কণ্ঠটা বারবার কানে বাজছে। অচেনা তবু হৃদয়ের খুব গভীর কোনো চেনা অনুভব তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে বারবার। যেন কোনো এক অতীত জন্মের মুগ্ধতা মিশে আছে তাতে। কখনো শোনেনি কিন্তু তারপরও মনে হচ্ছে একসময় এই কণ্ঠে সে মাতাল ছিল। আর সায়েরিন শব্দটাও উচ্চারিত হতেই আরণ্যকের শরীরের প্রতিটি রোমকূপ সজাগ হয়ে উঠলো। কোথা থেকে যেন সেই পুরোনো স্মৃতিরা ভেসে আসছে। রক্ত, ছায়া, অন্ধকার আর অপ্রাপ্তির গভীর ব্যথা ভেসে উঠছে। চোখের কোণে স্মৃতির জল জমে উঠছে। নিজের পুরনো জীবন, আপনজনদের হারানোর সেই যন্ত্রণা আজ আবার ফিরে এসেছে। পুরোনো স্মৃতিগুলো একে একে চোখের কোণ বেয়ে ধরা পড়ছে। মনটা কেমন বিষিয়ে উঠছে। পুরাতন জীবনে নিজের আপনজনদের মৃত্যু দু'চোখে সহ্য করতে পারছে না আরণ্যক।
অনন্যা নিচুতে ঝুঁকে আরণ্যককে সাহায্য করলো। তার হাতের উপর হাত রেখে সবটা মনে করতে সাহায্য করলো। বেশ অনেকক্ষণ কেটে গেছে আরণ্যক চুপ হয়ে পড়েছে। অনন্যা আরণ্যকের বরাবর বসে বললো,
"আপনি কি আমার সাথে থাকবেন, রাজকুমার সায়েরিন?"
আরণ্যক চোখ খুললো। চোখের সামনে অনন্যার শ্যামসুন্দর মুখখানা দেখে একদিকে তার হৃদয়ে ছ্যাত করে একটা ছ্যাকা লাগলো আবার অন্যদিকে মনটা প্রচন্ড কষ্টে ভরে গেলো। শুধু তার জন্যই আরহেনিয়ার অবস্থা করুণ হয়ে পড়েছিল। সে আর কি সাহায্য করবে?? সে-ই তো ধ্বংসের শুরুর সুযোগ করে দিয়েছিলো।
আরিসা মুচকি হেসে আবারো বললো,
"চিন্তা নেই। আমার কর্মে সঙ্গ দিলে আপনার কষ্ট, আফসোস, হৃদয়ের জ্বালাপোড়া সবটাই কমে যাবে।"
আরণ্যক মাথা নাড়িয়ে বললো,
"তুমি যা করতে বলবে তাতেই রাজি আছি আমি। কিন্তু এই কর্মে তুমি একাই যথেষ্ট। তোমার চেয়ে অতি শক্তিধর তো আমি নই,আরিসা!"
অনন্যা মিষ্টি হেসে বললো,
"আমার সঙ্গ দিতে বলেছি। এর থেকে বেশি কিছুই দরকার নেই আমার।"
আরণ্যক স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল। স্নিগ্ধ শ্যামল তার মুখখানা অন্ধকারের মাঝেও উজ্জ্বল হলো। অনন্যার মুখের অল্প হাসিও বুঝিয়ে দিলো অনেক বছর আগে সে কায়েরীথকে সাহায্য করে যে ভুলটা করেছিল সেই ভুলের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সময় এসে গেছে।
·
·
·
চলবে.......................................................................