স্টে উইথ মি - পর্ব ১৭ - নুসরাত জাহান বৃষ্টি - ধারাবাহিক গল্প


          এক সপ্তাহ পর। মেহুল সবে ভার্সিটি থেকে ফিরেছে। শরীরে ক্লান্তি যেন চেপে বসেছে। সদর দরজা পেরিয়ে ড্রয়িং রুমে আসতেই চোখে পড়ে নানা ভাই সোফায় বসে টিভি দেখছেন। টিভির পর্দায় সংবাদ পাঠিকা খবর পড়ছে।

আতাউর মির্জা নাতনিকে দেখে বললেন, "চলে এসেছো, নানা ভাই?"

মেহুল ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বলল, "হ্যাঁ, নানা ভাই।"

আতাউর মির্জা মাথা নেড়ে বললেন, "ঠিক আছে যাও ফ্রেশ হও গিয়ে।"

মেহুল মাথা নেড়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই পা জোড়া থমকে যায়। তার চোখ টিভির পর্দায় আটকে গেছে। ঝাপসা করা লাশের পাশে একদিনের এক পরিচিত মুখ! এই মুখ মেহুল ভুলে নি এখনও। মেহুলের পুরো দৃষ্টি টিভির পর্দায় স্থির হয়ে গেল। এক সপ্তাহ আগে বাসে যে ছেলেটা তাকে হ্যারাস করেছিল, আজ তার লা শ পাওয়া গেছে জঙ্গলে! সংবাদ পাঠিকা অর্নগল বলে যাচ্ছে, “লা শের শরীরে ক্ষত দেখে বোঝা যাচ্ছে, কোনো হিং স্র জ ন্তু বা জা নো য়ার আক্রমণের শিকার হয়েছে আর তার কারণেই মৃত্যু হয়েছে তার।”

মেহুলের শরীরে শীতল স্রোত বয়ে গেল। ভয় আর অবিশ্বাস একসাথে চেপে ধরল তাকে। মাথা কাজ করছে না। কী হচ্ছে তার চারপাশে? ছেলেটা জঙ্গলে কী করতে গিয়েছিল? কেউ কি ওকে হ ত্যা করে জঙ্গলে ফেলে গেছে? কিন্তু সংবাদ পাঠিকা তো বলছে, কোনো জ ন্তু জা নো য়ার আক্রমণ করেছে! মেহুলের মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে আসছে।  

হঠাৎ সদর দরজার দিকে চোখ গেল মেহুলের। শেরাজ ঢুকছে, ফোনে কিছু একটা দেখছে। ফর্মাল পোশাকে আছে সে। বোঝা যাচ্ছে অফিস থেকে আসছে। শেরাজ চোখ তুলে সামনের দিকে তাকায়। মেহুলকে তার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে নিয়ে পদচরণ থামিয়ে ফেলে। মেহুল ধীরে ধীরে শেরাজের দিকে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবার টিভির পর্দায় তাকাল। যেন শেরাজকে ইশারা করলো মেহুল খবরটা দেখার জন্য। শেরাজও তাকাল টিভির পর্দার দিকে। পরক্ষণেই দু ভ্রু উঁচু করে নেয়। তার ঠোঁটে অদ্ভুত এক হাসি ফুটল। জিভ দিয়ে দাঁতের ওপরের পাটিতে ঘষা দিয়ে "চ" সূচক শব্দ উচ্চারণ করলো। তারপর নিঃশব্দে হাঁটা দিল ওপরের দিকে। যাওয়ার সময় একবারও পেছন ফিরে তাকায়নি।

মেহুল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে শেরাজের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। কেন জানি কিছু একটা হলেই তার মনে সন্দেহ হয় শেরাজকে নিয়ে। তার অবচেতন মন বলে যাচ্ছে, শেরাজ ভাই এর পেছনে নেই তো? কিন্তু শেরাজ ভাই কি এতটা নির্মম আর হিং স্র হতে পারে? নাকি সে ভুল ভাবছে? মেহুলের মনে ধোঁয়াশা জমতে লাগল...।

শেরাজ নিজের রুমে ঢোকেই দরজা লাগিয়ে দিয়ে গা থেকে কোটটা খুলে সোফায় ছুঁড়ে ফেলে চিত হয়ে শুয়ে পড়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠে এক সপ্তাহ আগের করা তার নির্মম এক কাজ।  

শেরাজ যাকে ধরে এনেছে ওর নাম নাদিম। পরিবার বলতে কেউ নেই আর থাকলেও পরিবারের মানুষ নাদিমের কার্যকলাপের জন্য অতিষ্ট। নাদিম থরথর করে কাঁপছে। বিকাশ ছুরি হাতে এগিয়ে যেতে নিলে হঠাৎ শেরাজ কণ্ঠ কঠোর করে বলল, "দাঁড়া!"

শেরাজের গম্ভীর কণ্ঠে যেন নাদিমের শরীরের রক্ত চলাচল আবার স্বাভাবিক হলো। ভরসার স্বরে বলে উঠল, "আপনি... আপনি আমায় ছেড়ে দিচ্ছেন? আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন?"

শেরাজের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটল। যেন নাদিমের কথাগুলো শুনে প্রচণ্ড মজা পেলো। শেরাজ ধীরস্থির ভঙ্গিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল, প্যান্টের পকেটে দু'হাত গুঁজে নিয়ে চোখে রহস্যময় দৃষ্টি এনে বলল, "উমম... ক্ষমা করে দেবো, যদি ক্ষমা শব্দটা চাইনিজ ভাষায় বলতে পারিস তাহলে।"

নাদিম হতভম্ব হয়ে গেল, "মানে?"

শেরাজ হাসল, "বাংলা বুঝিস না?"

নাদিম বুঝলো তার নিস্তার নেই। তার মুখ থেকে কান্না মিশ্রিত অনুনয়ের শব্দ বের হচ্ছে। শরীর ঘামে ভিজে গেছে, কপাল বেয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। শেরাজ ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে এসে নাদিমের সামনে দাঁড়াল। হাতে ছোট্ট একটা ছুরি তুলে নিয়ে আঙুলের ডগায় ঘুরাতে ঘুরাতে বলল, "তোকে কোন পন্থায় শাস্তি দেওয়া উচিত আনার বল তো?"

নাদিম আতঙ্কে মাথা নাড়তে লাগল, "আমায় ক্ষমা করে দিন দয়া করে!"

শেরাজ এক হাত নাদিমের কাঁধে রাখল আর অন্য হাতে ধরা ধারালো ছুরিটা ধীরে ধীরে নাদিমের গালে চেপে ধরে চোখে চোখ রেখে ফিসফিস করে বলল, "একটু টু শব্দ করলেই গাল কাটার পরির্বতে গলাটা কেটে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিবো তাই একদম সাইলেন্ট।"

নাদিমের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম, শিরাগুলো ফুলে উঠেছে আতঙ্কে। দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ, আঙুলগুলো এতটাই শক্ত করে চেপে রেখেছে যে গিঁটগুলো থেকে শব্দ আসছে। পায়ের আঙুল খিঁচে গেছে, সারা শরীর অসহ্য যন্ত্রণায় কেঁপে উঠছে। দাঁত কামড়ে নিজেকে কোনোরকমে সামলে রেখেছে, শ্বাস আটকে রেখেছে যদ্দুর সম্ভব। তবুও, গলা থেকে মৃদু এক বিকৃত শব্দ বেরিয়ে আসছে।

শেরাজ ঠোঁটের কোণে হালকা একটা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে পুনরায় ফিসফিস করে বলতে শুরু করল, "কেমন লাগছে ভালো নাকি মন্দ? একটা মেয়ে যখন ভয়ে কুঁকড়ে যায়, অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে তখন কি মেয়েটার অবস্থা দেখে মজা পাস তোরা? মেয়েটার কাঁপতে থাকা শরীর দেখে কি আনন্দ পাস?"

নাদিমের গাল বেয়ে গরম রক্তের ধারা নেমে আসছে, ফোঁটা ফোঁটা রক্ত মেঝেতে পড়চ্ছে। তার গলা থেকে বেরিয়ে আসছে দমচাপা, কাঁপুনি ধরা এক আর্তনাদ—যেন ব্যথা আর ভয় একসঙ্গে গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে আটকে গেছে। শেরাজ ছুরিটা সরিয়ে নিতেই নাদিম জোরে নিঃশ্বাস ফেলে। শেরাজ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বিকাশের দিকে তাকিয়ে বলল।

"অনেকদিন হয়ে গেলো, টাইটানকে দেখি না... ওকে নিয়ে আয়।"

বিকাশ চমকে উঠে বলল, "টাইটান? ওকে দরকার কী এখানে?"

শেরাজের চোখ ধীরে ধীরে রক্তলাল হয়ে উঠল। বিকাশ মুহূর্তেই চোখ ফিরিয়ে নেয়, বুকের মধ্যে ধকধক করতে থাকে।

শেরাজ দাঁত চেপে গর্জে উঠল, "কোনো প্রশ্ন নয়। শুধু হুকুম পালন করবি আমার।"

বিকাশ মাথা নাড়ল সম্মতির ইশারায়। শেরাজ মাথা কাত করে ঠান্ডা গলায় বলল, "টাইটানকে নিয়ে আয় এক্ষুণি। অনেক দিন হলো ও তাজা, গরম রক্তের আর কাঁচা মাংসের স্বাদ পায় না।"

বিকাশ দ্রুত সরে গেল। রক্তের স্বাদ... কাঁচা মাংস! কথাটা শোনা মাত্র নাদিমের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। কে এই টাইটান? মানুষ, নাকি কোনো দানব? নাদিমের বুক ধড়ফড় করতে লাগল, গলা শুকিয়ে কাঠ। মনে হলো, গলার কাছ থেকে ধীরে ধীরে অক্সিজেন নিংড়ে নেওয়া হচ্ছে। নাদিম বুঝে গেছে—আজ রাতেই তার জীবন শেষ হতে চলেছে…।

নাদিম মরিয়া হয়ে হাত-পা নাড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু শরীর যেন জমে গেছে। ভয় তার রক্ত বরফের মতো জমাট বেঁধেছে। শেরাজ ধীর পায়ে তার সামনে ঘুরতে লাগল, হাতে থাকা ছুরিটা আঙুলের মাঝে ঘুরিয়ে খেলছে, তার চোখে অদ্ভুত এক উত্তেজনা।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিকাশ ফিরে এল। কিন্তু সে একা নয়। তার পেছনে ছায়ার মতো নেমে এলো এক বিশাল কায়া। টাইটান এসেছে। টাইটানকে দেখামাত্র শেরাজ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল, দু’হাত মেলে ধরল সামনে। টাইটান যেন মুহূর্তেই চিনে ফেলল তাকে। এক দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল শেরাজের বুকে। আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে শেরাজকে টাইটান। টাইটান—জার্মান শেফার্ড জাতের এক বিশালদেহী কুকুর। সে শুধু কুকুর নয়, শেরাজের আত্মার সঙ্গী। তার সঙ্গেই টাইটানকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে। প্যারিসে থাকার সময় শেরাজ যখন নিঃসঙ্গতায় ডুবে থাকত, তখন একমাত্র সঙ্গী ছিল টাইটান। প্রতিদিন বাসায় ফেরার সময় জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত, লেজ নাড়ত উন্মাদ আনন্দে। খেলায়, হাঁটতে বের হওয়ায়, নিরব সময় ভাগাভাগিতে সবখানেই টাইটান ছিল তার ছায়ার মতো। শেরাজ হাসতে হাসতে বলল।

"আহা, থামো এবার আর কত আদর করবে?"

টাইটান শেরাজের কথায় থেমে গেল। শেরাজ চোখ ঘুরিয়ে তাকাল নাদিমের দিকে। টাইটানের চোখও ধীরে ধীরে ঘুরে গেল সেই দিকেই। নাদিম শুকনো ঢোক গিলল। 

শেরাজ ঠোঁটের কোণে এক বাঁকা হাসি টেনে টাইটানের দিকে তাকিয়ে বলল, "কেমন?"

টাইটান কি বুঝলে‌ কে জানে সে দু পাশে মাথা নাড়াতে লাগলো। সমান তালে লেজও নাড়াচ্ছে। তার চোখে ছিল আগ্রহ আর উত্তেজনার ঝিলিক। শেরাজ ঝুঁকে গিয়ে টাইটানের কানে কানে ফিসফিস করে কিছু একটা বলল। টাইটানের চোখের ভাষা মুহূর্তেই বদলে গেল। শেরাজ ধীরে উঠে দাঁড়াল, চোখ সরিয়ে নিয়ে বিকাশকে বলল। 

"ওর হাতের বাঁধন খুলে দে।"

কথাটা শুনেই নাদিম কেঁপে উঠল। তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে? নাদিমের চোখে মুখ এক নিমিষেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বুক ভরে শ্বাস নিল, চোখে কৃতজ্ঞতার ছাপ—হয়তো সত্যিই রেহাই পেয়ে যাচ্ছে! কিন্তু তার ভাবনা যে সম্পূর্ণ ভুল তার ভাবনার থেকেও ভয়ংকর কিছু ঘটতে চলেছে তার সাথে যা তার কল্পনারও অতীত। বিকাশ ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে নাদিমের হাতের বাঁধন খুলে দিল।

নাদিম উঠে বসার চেষ্টা করতেই শেরাজ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, "যা, তোকে ছেড়ে দিলাম। নিজেকে পারলে বাঁচিয়ে নেয়।"

বিকাশ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ প্রশ্নবিদ্ধ, স্যার ঠিক কী করতে চাইছে নাদিমের সাথে? এদিকে নাদিম ধীরে ধীরে কয়েক কদম এগিয়ে যায়। হঠাৎই সে দৌড় দেয়, যেন বাঁচার শেষ চেষ্টা। দরজার কাছে পৌঁছে গিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করে পালানোর জন্য। ঠিক তখনই সে স্থির হয়ে যায়। চোখ দুটো বড় হয়ে যায়, ভয় আর অবিশ্বাসে পূর্ণ তার চোখ। সামনের দিকে ফিরতেই কিছু বুঝে ওঠার আগে টাইটান ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। এক বিশাল ওজনের ধাক্কায় নাদিম মুখ থুবড়ে পড়ে যায় মেঝেতে। বিশাল দেহের টাইটান নিজের সর্বশক্তি দিয়ে কামড়ে ধরে নাদিমের পু রু ষা ঙ্গ। ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে ছিড়ে নেয় নাদিমের পু রু ষা ঙ্গ। বিকাশ চোখ বড় বড় তাকিয়ে দেখছে এই দৃশ্য। বিস্ময়ে থমকে গেছে সে। নাদিম গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। নাদিমের আর্তনাদ পুরো ঘর কাঁপিয়ে তোলে। গলার শিরাগুলো ফুলে উঠে নীলচে হয়ে উঠছে। চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে। নাদিম ছটফট করে হাত-পা ছুড়ে মাটিতে আঘাত করে যাচ্ছে ব্যথায়, ভয় আর অসহ্য যন্ত্রণায়। আর টাইটান? সে ঠান্ডা ও নিষ্ঠুরভাবে শেরাজের “হুকুম” পালন করছে। শেরাজ পেছনে দাঁড়িয়ে, ঠোঁটের কোণে এক নির্মম শান্তির ছায়া নিয়ে দৃশ্যটা দেখছে। নিঃসঙ্গ এই রাতে যেন মৃত্যু নিজেই নিঃশব্দে নেমে এসেছে নাদিমের জীবনে। 

টাইটান হঠাৎ থেমে যায়। বিশাল শরীর নিয়ে ধীরে ধীরে ফিরে এসে শেরাজের সামনে দাঁড়ায়। ওপাশে, মেঝেতে পড়ে আছে নাদিম—মরণযন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এ যেন মরণ যন্ত্রণার থেকে আরও ভয়াবহ এক যন্ত্রণা। তার শরীরজুড়ে রক্তের দাগ, পাঁজরের ভেতর যেন আগুন জ্বলছে, গলা শুকিয়ে কাঠ। মুখ থেকে অনবরত অস্পষ্ট আর্তনাদ বেরোচ্ছে যেন কেউ না শোনা পর্যন্ত সে থামতে পারছে না।

টাইটানের মুখ থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে মাটিতে। রক্তের ফোঁটা এক অদ্ভুত ছন্দে মাটির বুকে নেমে আসছে। শেরাজ টাইটানকে চোখ দিয়ে এক ঠান্ডা, তৃপ্ত ইশারা করে। টাইটান মাথা নিচু করে শেরাজের পায়ের কাছে এসে দাঁড়ায় আর নিজের মুখ থেকে রক্তমাখা ছিন্ন সেই অঙ্গটা বের করে শেরাজের পায়ের সামনে রেখে দেয়। শেরাজ ঠোঁটে এক বিকৃত তৃপ্তির হাসি টেনে নেয়। সে তাকায় বিকাশের দিকে। গলায় হালকা শীতলতা মেশানো স্বরে বলে, "বিকাশ, এসিড নিয়ে আয়।"

বিকাশ দাঁড়িয়ে থাকে, একদৃষ্টতে চেয়ে, যেন শরীর জমে গেছে। শেরাজ এবার চেঁচিয়ে ওঠে, "বিকাশ! কি বলেছি শুনতে পাসনি? এসিড নিয়ে আয় এখনই!"

বিকাশ চমকে ওঠে, এলোমেলো পায়ে পেছনের ঘরের দিকে দৌড় দেয়। তার শ্বাস ভারী, মুখ কাগজের মতো ফ্যাকাশে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ফিরে আসে—হাত কাঁপছে, তবু যতটা সম্ভব দ্রুত নিয়ে আসে সেই ছোট্ট কিন্তু ভয়ঙ্কর বোতলটা।

শেরাজ তখনও ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে, যেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটা মুহূর্তই তার পরিকল্পনার নিখুঁত বাস্তবায়ন।
 
শেরাজ ধীরে ধীরে গ্লাভস পরল দুই হাতে। তার চোখ স্থির, ঠান্ডা।
বিকাশ তার দিকে বাড়িয়ে দিল এসিডের ছোট্ট কাচের বোতলটা। শেরাজ বোতলের মুখ খুলল। তারপর নীরবে ঝুঁকে গিয়ে নিচে পড়ে থাকা রক্তমাখা ছিন্ন অঙ্গটির ওপর ঠেলে দিলো। ভেসে এলো হিসহিস এক শব্দ। মুহূর্তের মধ্যে এসিড পেয়ে অঙ্গটা ঝলসে যায়। অঙ্গটি থেকে কুয়াশার মতো ধোঁয়া ভাসতে থাকে। অঙ্গটি বিকৃত হয়ে পুড়ে যেতে শুরু করল। নাদিম যন্ত্রণার শ্বাস আটকে মাথা ঘুরিয়ে দৃশ্যটা দেখল। তার চোখ রক্তলাল হয়ে আছে। শেরাজ নিঃশব্দে ঘাড় বাঁকিয়ে একবার নাদিমের দিকে তাকাল, তারপর বোতলের পুরো এসিডটা অঙ্গটার উপরে ঠেলে দিলো। অঙ্গটা এখন এক বিকৃত, পচা মাংসপিণ্ডে রূপ নিয়েছে। শেরাজ বোতলটা ফেলে দিল একপাশে। তার ঠোঁটে সেই চিরচেনা ঠান্ডা হাসি খেলে উঠল। সে ফিরে তাকাল বিকাশের দিকে আদেশ করলো।

"তোল ওকে।"

বিকাশ ঠোঁট ভিজিয়ে এগিয়ে গেল। মেঝেতে পড়ে থাকা রক্তাক্ত, আধমরা নাদিমকে টেনে তুলে বসিয়ে দিল দেয়ালের সঙ্গে।নাদিমের চোখ অর্ধনিমীলিত। তার শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে, চোখে ধোঁয়াটে ঝাপসা চেহারা ভাসছে। শেরাজ হাতে তুলে নিল একটি চিমটা। চিমটার ফাঁকে, এসিডে গলে বিকৃত হয়ে যাওয়া সেই অঙ্গটি ধরল। ধীরে ধীরে, শেরাজ এগিয়ে আসে নাদিমের দিকে। নাদিমের চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে তবুও, সে দেখতে পাচ্ছে এই শেরাজ নামক দানবটা তার দিকেই আসছে, হাতে ধরা এক বিকৃত বিভীষিকা নিয়ে…।
 
শেরাজ ধীরে ধীরে নাদিমের সামনে এসে বসে। ঠোঁটে জমাট বাঁধা ঠান্ডা এক নিষ্ঠুরতা। শীতল গলায় ফিসফিস করে বলল,"হাঁ কর।"

নাদিম নিভে আসা চোখে তাকিয়ে থাকে। চোখের পাতা কাঁপছে, কিন্তু শরীর নড়ে না। ঝাপসা চোখে একবার দেখলো ঝলসে যাওয়া অঙ্গটাকে। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনা জল। শেরাজ হঠাৎ বাঁ হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরে দাঁত দাঁত চেপে বলে উঠল, "হাঁ কর বলছি! দেখ, তোর জন্য কী সুস্বাদু খাবার এনেছি আমি! জীবনে কখনও খাস নি এমন কিছু জীবনের শেষ মুহূর্তে তোর এটা খাওয়া দরকার!"

কিন্তু নাদিম মুখ খোলে না। তার যে শরীর মন দুটোই অসাড় হয়ে গেছে। মারবেই যখন তাকে তাহলে একবারেই মেরে ফেলুক এভাবে তিলে তিলে মারছে কেন? শেরাজ ঠোঁট ফুলিয়ে হালকা গলায় বলে, "খাবি না? ঠিক আছে... পস্তাবি কিন্তু এই আমি বলে দিলাম।"

নাদিমের ঘাড় দুলছে। শেরাজ "চ" সূচক শব্দ উচ্চারণ করে চোখে একরাশ বিদ্রুপ নিয়ে বলল, "কই বাত নেহি... খেতে হবে না। তবে তোকে একজন খাবে।"

শেরাজ মুখ ঘুরিয়ে সুরে সুরে ডাকল, "টাই-ই-টান..."

ছায়ার মতো এসে দাঁড়ায় টাইটান শেরাজের পাশে। শেরাজ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, চিমটা ফেলে দেয় মাটিতে। বিকাশ নিঃশব্দে দূরে সরে যায়। শেরাজ মাথা নিচু করে টাইটানের গায়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কণ্ঠে এক অদ্ভুত মমতা।

"ওকে একটু আদর যত্ন করো টাইটান। বেশি আদর যত্ন করবে না কিন্তু মনে থাকবে।"

টাইটানের চোখে যেন আগুন জ্বলে ওঠক। পরমুহূর্তেই সে গর্জে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে নাদিমের উপর। শেরাজ ধীরে ধীরে পেছনে মুখ ফেরায়। পেছন থেকে ভেসে আসে নাদিমের আর্তনাদ। একটা আর্ত চিৎকার—জীবন বাঁচানোর শেষ আকুতি। ঘরের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে সেই কণ্ঠস্বর আর শেরাজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে যেন কিছুই হচ্ছে না তার আশেপাশে।

শেরাজ চোখ মেলে তাকায়। ফিরে আসে অতীত থেকে। বিছানার ওপর থেকে ফোনটা হাতড়ে নিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দ্বারা ফোনের লক খুলতেই ভেসে উঠে মেহুলের চাঁদমুখ খানা। শেরাজ হাসে, তৃপ্তি নিয়ে হাসে। চোখের পলক ফেলে গভীর কণ্থে বলল।

"আই স্বেয়ার জান। তোর দিকে যেই হাত বাড়াবে তাকে আমি শেষ করে দিবো। তোর জন্য আমি হাজার হাজার অপরাধ করতে রাজি। তোর জন্য যত দূর যেতে হবে আমায় তত দূর যাবো এক নিঃশ্বাসে।"
·
·
·
চলবে.................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp