বহু বহু বছর আগের কথা। তখন বাংলা ছিল প্রায় নিশ্চিহ্ন, ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল বাংলার পূর্বপুরুষেরা। বাংলার উৎপত্তি তখনো হয়নি। ঠিক সেসময় পৃথিবীর এক কোণে আরহেনিয়া নামক রাজ্যে রচিত হচ্ছিল ভিন্ন ইতিহাস। এই আরহেনিয়াতে তিনটি অপূর্ব ও চোখ জুড়ানো স্থান রয়েছে যেগুলো রাজ্যের প্রাণ হিসেবে পরিচিত।
প্রথমটি, দেশের উত্তরে হুডো শহরের অভ্যন্তরে অবস্থিত মেনিস পর্বতমালা। ধবধবে বরফে মোড়ানো এই পর্বতশ্রেণি আকাশ ছুঁতে চায়। আর হুডো শহরকে পাহারা দেয় চিরকাল। দ্বিতীয়টি, দেশের মাঝ বরাবর বয়ে যাওয়া ল্যুমিস নদী। এটি আরহেনিয়ার সবচেয়ে শীতল ও স্বচ্ছ নদী যার পানি এতটাই নির্মল যে তলদেশ পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। রাতের বেলা নদীর জলে নীলচে আলো জ্বলে ওঠে যা রহস্যময় মোহ সৃষ্টি করে। এই নদীকে ঘিরে প্রচলিত আছে বহু লোককথা যার মধ্যে বেশিরভাগই আরহেনিয়ার রাজপরিবারকে কেন্দ্র করে।
আর তৃতীয়, দেশের দক্ষিণে অবস্থিত নারা শহরের বিস্তৃত সোনালী সমভূমি। এই জমিতে ফলে অপূর্ব স্বর্ণরঙা ফসল যা সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করে। ঠিক মনে হয় স্বর্ণখণ্ড ছড়ানো মাটির উপর। এই স্থানকে বলা হয় গোল্ডেন ভ্যালী। এই তিন স্থানেই লুকিয়ে আছে আরহেনিয়ার সৌন্দর্য রহস্য আর ঐতিহ্যের গভীর শিকড়।
আরহেনিয়ার রীতি একটু ভিন্ন। রাজপ্রাসাদের সন্তানদের বাইরে চলাফেরা সাধারণের মতোই স্বাভাবিক। কেউ তাদের দেখে মাথা নত করে। কেউ ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধা জানায়, তবে অতিরিক্ত আনুগত্যের প্রয়োজন পড়ে না। এখানকার মানুষ রাজবংশের কৌলিন্যকে স্বীকৃতি দেয়, কিন্তু তোষামোদ করে না। কারণ আরহেনিয়ার মূল বৈশিষ্ট্য সম্মান অর্জন করতে হয় নিজের গুণে, জন্মে নয়। তবে, রাজসন্তানদের ব্যক্তিত্বে যে এক ধরনের দাপট থাকে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
কায়েরীথ নামের সেই যুবকের পায়ে খয়েরি রঙের মলিন সুতির প্যান্ট। কিছু কিছু স্থানে মাটি লেগে আছে আর হাঁটুর অংশ টায় ছেঁড়া রয়েছে, ছিলেও গেছে বোধহয় হাঁটুর স্থানটা। শরীরেও চাপা বাদামী কাপড় যার গলার কাছ ও হাতার দিক ছিঁড়ে গেছে অনেক আগেই। ঘাড়জুড়ে অসংখ্য কাঁটার আঁচড়, কিছু কিছু জায়গায় তো দাগ রীতিমতো জমাট রক্তে রূপ নিয়েছে। ছেঁড়া জামার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় পিঠেও ছড়িয়ে আছে যন্ত্রণার দাগ মার। ইহা শাস্তি আর ত্যাগ ছাড়া আর কিইবা হবে।
এই অবস্থাতেই ছেলেটি নিরলস গতিতে দৌড়ে উঠছে মেনিস পর্বতের বুক বেয়ে। অথচ সেই ঠান্ডায় আরিসা, রাজসন্তান হয়েও, ভারী পোশাকে কাঁপছে অল্প স্বল্প। আরিসার ঠোঁট ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। হাতজোড়া জমে যাচ্ছে। অথচ সামনে চলতে থাকা কায়েরীথের চোখে-মুখে সেই কষ্টের ছিটেফোঁটাও নেই। তাকে দেখেই বোঝা যায় কোনো বরফের পাহাড় নয় বেয়ে উঠছে তার চিরচেনা পথ।
আরিসা বিস্ময়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ তুলে তাকাল চারপাশে। মনে হতে লাগলো অপার্থিব সৌন্দর্যে মোড়ানো প্রকৃতির কোণেরা তাকে নিঃশব্দে আহ্বান জানাচ্ছে। হিমেল বাতাসে ভেসে আসা অরণ্যের গন্ধ, গাছের ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে থাকা পাখিদের আনন্দময় কলতান, আর দূরে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ল্যুমিস নদীর শাখা থেকে ভেসে আসা নির্মল জলের কলকল শব্দ। সবকিছু মিলিয়ে এক অদ্ভুত আবেশে জড়িয়ে ধরল তাকে। এতদিন ধরে এই সমস্ত সৌন্দর্য থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। রাজপদের নামে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল দেয়ালের ভেতরে। সেই ভাবনায় বুকের ভেতর হালকা একটা কান্না জমে উঠল। কখনো কি প্রাসাদের বাইরে প্রকৃতিকে এভাবে অনুভব করার অনুমতি ছিল তার? উত্তরটা না। এভাবেই ভুল ছিল সবকিছু। কখনো কখনো মনে হচ্ছিল, যদি এমন এক সাধারণ পরিবারের মেয়ে হয়ে জন্মাত। যেমন কায়েরীথের মতো তবে অন্তত নিজের মতো করে নিঃশ্বাস নিতে পারত সে।
পাথরের খাঁজে খাঁজে ওঠার সময় আরামদায়ক রাজপোশাকের নিচে তার সোনালি বুট বারংবার প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। কিছু ইট পাথরের উপর পা রাখতেও কষ্ট হচ্ছিল তার। অথচ কায়েরীথ কোন ক্লান্তি ছাড়াই এগিয়ে চলেছে সামনে। আরিসা থেমে থেমে হাঁপায় আর ভাবতে থাকে কার আসলে বেশি স্বাধীনতা? যিনি রাজরক্ত নিয়ে জন্মেছেন, না যিনি প্রকৃতির রক্তে গড়া?
আরিসা থেমে দাঁড়ালো। আচমকাই এক পা ফসকে যেতে গেলো পাথরের ধার ঘেঁষে। ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে একজোড়া দৃঢ় হাত তাকে ধরে ফেললো। কায়েরীথ। তার ধুলোমাখা মুখটা কাছে চলে এলো, চোখের উপর অগোছালো ময়লা চুল। মুখের কোণে হালকা হাসি আর চোখ দুটো! সে চোখ তো সম্পূর্ণ আকাশেরই প্রতিচ্ছবি। স্বচ্ছ, গভীর আর অপার রহস্যে ভরা আঁখি দ্বয় দেখে খেই হারিয়ে ফেললো রাজকুমারী। কায়েরীথের ঠোঁটের উপরে সদ্য গজানো গোঁফের রেখা কিশোর থেকে তরুণে পা রাখার জানান দিচ্ছিল তাকে।
আরিসা কিছু বলার আগেই কায়েরীথ মাথা সামান্য কাত করে চতুর গলায় বলল,
"আমি দরিদ্র হতে পারি, কিন্তু সৌন্দর্যের অধিকারী হওয়াটা তো আর থেমে থাকেনি, তাই না রাজকুমারী? না হলে রাজবংশের এত ঐশ্বর্য ছেড়ে আপনি এই পাহাড়ে এসে আমার চোখে এভাবে তাকালেন। আমি তো ধন্য।"
আরিসা চটজলদি নিজেকে গুছিয়ে নিল। চোখে গরম রাগ নিয়ে ফিরে তাকালো কায়েরীথের দিকে। কিন্তু কোনো কথা বলল না। ওর দৃষ্টির ঝলকটুকুই যথেষ্ট ছিল। এরপর আবারও সামনে হাঁটতে লাগলো। এমন ভাব টুকু করলো যে কিছুই হয়নি। প্রশ্নের উত্তর দেওয়া রাজকুমারীর কাছে সময়ের অপচয় মনে হলো। প্রাসাদে ফিরতে হবে। সময় বয়ে যাচ্ছে। কে জানে দাসীরা এখনও পর্যন্ত সব সামলাতে পারছে কি না।
মেনিস পর্বতের আধো বরফে ঢাকা আঁকাবাঁকা পথ ধরে আধাঘণ্টার মধ্যে উপরে উঠে আসলো তারা। পাহাড়ের চূড়ায় এসে পৌঁছেছে দুজনে। চারপাশে হিমের নিঃশ্বাস, আকাশ ছুঁয়ে থাকা গাছ, আর দূর থেকে ভেসে আসা ল্যুমিস নদীর গুঞ্জন। আরিসা চুপচাপ নিঃশব্দে চারপাশটা নিরীক্ষণ করে যাচ্ছে। কায়েরীথ তার ভাঁজ করা হাত নিয়ে নিরবে তাকিয়ে থাকলো আরিসার দিকে। রাজকুমারীকে দেখে মনে হচ্ছে সে আনন্দিত হওয়ার মতো কিছু পাচ্ছে না। অদ্ভুত অস্পষ্টত অনুভব কাজ করছে কায়েরীথের ভেতর। কায়েরীথ ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেললো। একসময় সে আর অপেক্ষা না করে একটু দূরের এক গাছের ছায়ায় বিশ্রামের জন্য এগিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু হঠাৎই কানে বাজলো তলোয়ারের তীক্ষ্ণ ধারের শব্দ। পা থেমে গেলো কায়েরীথের।
রাজকুমারী আরিসা নেভুনিকা তলোয়ার তুলে কায়েরীথের গর্দনের ঠিক সামনে স্থাপন করলো। চোখে তীব্র দৃঢ়তা এবং কণ্ঠে তীক্ষ্ণতা মিশিয়ে বললো,
"কে তুমি? কী তোমার পরিচয়?"
কায়েরীথ হালকা বাঁকা হাসি দিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। আরিসা থেমে থাকেনি। সে আরো বললো,
"তোমার বাচনভঙ্গি, উচ্চারণ এতো নিখুঁত! তুমি কোনো সাধারণ দরিদ্র ঘরের ছেলে হতে পারো না।"
কায়েরীথ মাথা এক পাশে হেলিয়ে নরম গলায় জবাব দিল,
"আমি কি কখনো বলেছি আমি দরিদ্র ঘরের সন্তান?"
আরিসার কণ্ঠে এক চিলতে দ্বিধা,
"না, কিন্তু..."
কায়েরীথ থেমে থাকা কথাটি শেষ করল নিজেই,
"আমি শুধু বলেছিলাম আমি দরিদ্র।"
কায়েরীথের ঠোঁটের কোণে আবারও সেই রহস্যময় হাসি।
আর আরিসা দৃষ্টিতে চমক নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
"কে তুমি?"
কায়েরীথ মৃদু হাসলো। চোখ তুলে তাকালো দূরের নীল বিশুদ্ধ আকাশের দিকে। বলল,
"মূল্যবান সময় ব্যয় করে আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি, প্রশ্নের উত্তর দিতে নয়। মনে আছে তো, আপনার কথা ছিল প্রাসাদে ঢোকার ব্যবস্থা করে দেবেন?"
আরিসা চোখ নরম করেনি। বরং ঠাণ্ডা গলায় বলল,
"তোমাকে মেরে ফেললে প্রাসাদে ঢুকবে কীভাবে?"
কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎবেগে তলোয়ার নিয়ে ছুটে এল রাজকুমারী। কায়েরীথ এক লাফে সরে গেলো পাশে। আরিসার ধারালো আক্রমণ একের পর এক মাটিতে পড়ে চারপাশের শুকনো পাতা আর বরফের কণা বাতাসে ছড়িয়ে গেলো। গাছের একেকটি ডালে তলোয়ারের ছোঁয়া লাগতেই ডাল ভেঙে পড়ে যাচ্ছিল।
কায়েরীথ দ্রুত এবং ক্ষিপ্র পদক্ষেপে প্রতিটি আক্রমণ এড়িয়ে যেতে লাগলো। কায়েরীথের গতি ছিল একদম উড়ন্ত হাওয়ার ঝাপটা। আরিসার প্রতিটি আক্রমণ এড়িয়ে শেষমেশ এক নিখুঁত মুহূর্তে পিছন দিক দিয়ে এগিয়ে এসে পুরোদমে তার তলোয়ার ছিনিয়ে নিলো। আরিসা চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গেই তার লম্বা বেণী যুক্ত চুল লাফিয়ে উঠলো। সেকেন্ডের মধ্যেই কায়েরীথ আরিসার বুকের সামনে ঠান্ডা ধাতব অস্ত্রের শীতল স্পর্শ উঠিয়ে দিলো।
রাজকুমারীর দিকে তলোয়ার তাক করে কায়েরীথ গম্ভীর এবং ঠাণ্ডা গলায় বললো,
"এবার অস্ত্র আমার হাতে, প্রিন্সেস।"
আরিসা দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইল। হাতের মুঠো দুটো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেছে। মাথার শিরা উপশিরাগুলো আগুনের মত দপদপ করছে তার।
*****
সন্ধ্যার অন্ধকার মাত্র গাঢ় হতে শুরু করেছে। রাজকুমারীর তখন দম ফেলারও সুযোগ নেই। কায়েরীথের সঙ্গে দ্বন্দ্বে অংশ নিতে গিয়ে বেশ কিছু মূল্যবান সময় হারিয়ে গেছে। শান্ত হলে নীরবতা জমেছিল দুজনের মাঝে। দুজনেই বসেছিল মেনিস পর্বতের শীতল পাথরে। অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ আরিসা চমকে উঠলো সূর্যের অবস্থান দেখে বুঝতে পারলো সময় ফুরিয়ে আসছে।
তারপর শুরু হলো ছোটাছুটি। তাড়াহুড়ো করে পৌঁছালো প্রাসাদের সীমানার শেষ প্রাচীরের কাছে। প্রাচীরের দেয়ালে উঠতে গিয়ে কায়েরীথ এগিয়ে এসে নীরবে সাহায্যের হাত বাড়ালো আরিসার দিকে। অনেক কষ্টে, ধীরে ধীরে আরিসা প্রাচীরের ওপরে উঠলো। অন্য পাশে নামার ঠিক আগমুহূর্তে কায়েরীথ রাজকুমারীর হাত চেপে ধরলো।
আকুতি মেশানো গলায় বললো,
"আপনার প্রতিজ্ঞা ভুলে যাবেন না। আমাকে অন্দরে প্রবেশ করার দায়িত্ব কিন্তু আপনার হাতে।"
আরিসা সরু চোখে একবার কায়েরীথের দিকে তাকিয়ে ধীরপায়ে দেয়ালের বিপরীত পাশে নেমে পড়লো। জামার ভিতর আলগা করে রাখা একটি পাতলা কাপড় টেনে নিয়ে মাথায় জড়িয়ে ফেললো যাতে কেউ ওকে চিনতে না পারে। তারপর নিঃশব্দে ছায়ার মতো সরে প্রহরীদের চোখ এড়িয়ে প্রাসাদের পেছনের পথে এগিয়ে গেলো।
এদিকে কায়েরীথ দাঁড়িয়ে ছিল সেই প্রাচীর ঘেঁষেচোখে বিরক্তি নিয়ে। হঠাৎই প্রচন্ড রাগে মুষ্টিবদ্ধ করা হাত তুলে দেয়ালে সজোরে ঘুষি বসিয়ে দিলো। সাথে সাথেই ব্যথায় মুখ বিকৃত হলো তার,
"আঃ!"
একটি দীর্ঘশ্বাসে মিশে যাওয়া উচ্চারণ।
কায়েরীথের শব্দ শুনে পাশ থেকে এক প্রহরী ছুটে এলো। কায়েরীথের সামনে এসে প্রশ্ন করলো,
“কে ? কী চাই এখানে?”
কিন্তু কায়েরীথ কোনো উত্তর দিলো না। মাথা নিচু করে নিঃশব্দে উল্টো পথে হাঁটতে লাগলো। পেছনে রেখে গেলো রাজকুমারীর উপর জন্মে যাওয়া তপ্ত রাগ।
একদিন কেটে গেছে সেই সন্ধ্যার পর। সেদিন কায়েরীথ রাজপ্রাসাদের সামনে থেকে আসার পর যখন চেনা জনমানবের পা রাখে তখনই সামনে পড়ে সেই তিন লোক। যারা কায়েরীথকে মারার জন্যই বসেছিল। চোখাচোখি হতেই কায়েরীথ বুঝে গিয়েছিল আর কোনো পালানোর পথ নেই। সে কিছু বলেনি আর তখন। দেহের সবটুকু শক্তি আর অভিমান নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। পরিস্থিতি মেনে নিলো। শুধু এটুকু নিঃশব্দে বলে দিলো,
"আসো, শেষ করো যা করবার।"
তিন জন লোক এগিয়ে এলো। ধীরে ধীরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো কায়েরীথ। ঘুষি, লাথি, চড় আর অশ্রাব্য গালিতে তার শরীর ক্ষতবিক্ষত হলো। ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝরলো। পিঠের পুরোনো ক্ষত আবার খুলে রক্ত নামলো। তবুও কায়েরীথ কোনো শব্দ করলো না। প্রতিবাদ করলো না। এই পৃথিবীতে আর কাউকে বিশ্বাস করার ইচ্ছা নেই তার।
হুডো শহরে আজকের শীত একটু বেশি কাঁপুনি ধরানো। বাতাসে হিমের ছোঁয়া আর পায়ের নিচে কুয়াশার চাদর। এমন ঠান্ডার ভেতর কায়েরীথের জীর্ণদেহটা আরও নিস্তেজ, আরও একলা। রাস্তার ধারে শীতের পিঠা বিক্রি করা এক বৃদ্ধা মহিলার চোখে পড়ে যায় তার করুণ অবস্থা। কায়েরীথকে দেখে মায়ায় ভরে ওঠে তার মুখ। তিনি নিজের ছোট্ট কুড়ে ঘরে ডেকে নেন ছেলেটিকে। যদিও এটা নতুন কিছু নয়। মাঝে মাঝেই এমন করে ডেকে নেন তিনি। ব্যথা সাড়িয়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। ভেষজ জরিবুটি লেপন করে দেন।কয়েরীথ ব্যথায় চিৎকার করতে থাকে তখন। এটাই তো সত্যি ব্যথা পাওয়া তো কোনো কঠিন ব্যাপার নয়, ব্যথা সাড়ানোটাই ধৈর্য্য আর সময়ের ব্যাপার যেটা কায়েরীথের মধ্যে নিতান্তই কম।
কায়েরীথের নিজের কোনো আশ্রয় নেই। না ঘর, না পরিচিত ঠিকানা। হুডোর অলিগলি, পাহাড়ের পাদদেশ, নদীর ধার সবই তার চেনা, কিন্তু কোথাও সে বাঁধা নয়। বৃদ্ধার থেকে নতুন পোশাক পায় কায়েরীথ। পরিধান করে আবারো চলে যেতে চায় সে।
প্রতিদিনের মতো আজও বৃদ্ধা বলেন,
“থাক না এবার আমার ঘরেই, আর কতো এভাবে?”
কিন্তু কায়েরীথ মাথা নাড়ে। নিশ্চুপ থাকে প্রতিউত্তরে। সম্পর্ক বিষয়টা তো অভিশাপ তার জন্য। সে মিনমিনিয়ে বলে উঠে,
“আমি বোঝা হয়ে থাকতে চাই না কারো জন্য।”
বৃদ্ধার কুঁড়ে ঘরের উষ্ণতা ছেড়ে কায়েরীথ যখন বেরিয়ে আসে তখন বাতাসে ভাসছিল কুয়াশার নরম গন্ধ। ঠান্ডায় শরীর জড়সড় হলেও কায়েরীথের দৃষ্টিতে ছিল অদ্ভুত স্থিরতা। ধীরে ধীরে শহরের গলিপথ ধরে হাঁটতে থাকে সে। কিছুটা এগিয়ে যেতেই এক মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন মানুষের গলা ভেসে আসে কানে। তারা উত্তেজিত গলায় বলাবলি করছে রাজপ্রাসাদে নাকি কিছু কর্মী নিয়োগ চলছে। কেউ বলছে পরিচারক, কেউ বা পাহারাদার, কেউ কেউ তো আবার সরাসরি রাজকুমারীর ঘরের দায়িত্ব পাওয়ার আশাও করছে।
কায়েরীথ থমকে দাঁড়ালো। আচমকা মনে হলো এই তো সুযোগ। অন্দরমহলে প্রবেশের দরজা হয়তো এখানেই খুলে যেতে পারে। পথচলতি শহরটা আর তখন আগের মতো মনে হলো না কায়েরীথের কাছে। সব নতুন আর সম্ভাবনাময় মনে হতে লাগলো। একটি সুযোগের হাতছানি যা বদলে দিতে পারে কায়েরীথের জীবনের রূপরেখা।
বোনাস-
এক দমকা কালো বাতাস ছেয়ে গেলো হাসপাতালের করিডোর। কোণের একটা বেঞ্চে চুপচাপ বসে ছিল আরণ্যক। হঠাৎ সেই অচেনা বাতাসের স্পর্শে তার মন কেমন করে উঠলো। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে সে উঠে দাঁড়ালো। দুপুরে বাড়ি গিয়ে সন্ধ্যায় আবার ফিরে এসেছিল। অনন্যাকে এখনও ঠিকমতো দেখা হয়নি। রুমের বাইরে কৌশিক স্যার ছিলেন, তাই কাছে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
কিন্তু এখন পরিস্থিতি অস্বাভাবিক। ভেতরের কেবিন ঘিরে একটু একটু করে ভিড় জমেছে। আরণ্যক দ্রুত এগিয়ে গেলো। নোহারার বয়ফ্রেন্ডকে এক দৌড়ে ভেতরে ঢুকতে দেখা গেলো। কিছুক্ষণ পর চিকিৎসকদের একটা দল সেখানে ঢুকলো। কোনো জরুরি থেরাপি চলছে যেন।
নোহারার বয়ফ্রেন্ড বাইরে বের হলো কিছুক্ষণ পর। মুখে চিন্তা চিন্তা ভাব। আরণ্যক ধীরে ধীরে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো নিচু গলায়,
"কি হচ্ছে এখানে? অনন্যা ঠিক আছে তো?"
নিক এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,
"অনন্যা ঠিক আছে এটা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি কিন্তু কৌশিক!"
বাকি শব্দগুলো যেন ওর গলায় আটকে গেল। তারপরই তাড়াহুড়ো করে পকেট থেকে ফোনটা বের করলো। কারও নম্বরে ডায়াল করে কানে ধরলো। ওপাশে কল ধরতেই গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
"ভেনোরা কোথায়?ওকে তাড়াতাড়ি বলো। কৌশিকের জীবন এখন সংকটাপন্ন!"
নিকের চোখে তখন ঝড় বইছে ঠোঁট কাঁপছে আর আশেপাশে নিঃশব্দে ঘনীভূত হচ্ছে শোকাতুর উত্তেজনা। আরণ্যক কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। কৌশিক স্যারের আবার কী হতে পারে? নিক হঠাৎই বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। আরণ্যকও নীরবে তার পিছু নিলো। হসপিটালের রিসিপশনে এসে পৌঁছাতেই চোখে পড়লো টেলিভিশনের পর্দা। ভেসে আসছিল উদ্বেগজনক খবরের কণ্ঠস্বর। নিক থেমে গেলো সেই খবর শুনে। আরণ্যক ও তাই,
টেলিভিশনের পর্দা থেকে ভেসে এলো ঘোষণার মতো স্বর,
"আকাশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বজ্রপাতে হাহাকার অবস্থা। এরই মাঝে ঢাকার কিছু রাস্তায় মৃত মানুষদের পড়ে থাকতে দেখা গেছে। অনেকের মতে, বজ্রপাতেই এই মৃত্যু। কিন্তু বিশিষ্ট পর্যবেক্ষকদের ধারণা ভিন্ন। জানা গেছে, মৃত্যুর পর মৃতদেহের শরীর কালচে হয়ে যায়। দেহ থেকে বের হয় ধোঁয়া। প্রশ্ন হচ্ছে, এ কেমন বজ্রপাত? এমনটা কেনো ঘটছে? মৃত্যুর পেছনে কি কোনো ভিন্ন কারণ রয়েছে? জানতে হলে সাথেই থাকুন আমরা জানাবো পরবর্তী আপডেট।"
নিক ফিসফিসিয়ে বললো,
"কৌশিক ইজ অন ফায়ার! হি উইল ডিস্ট্রয় এভরিথিং! আর এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম আমরা।"
·
·
·
চলবে.........................................................................