ধারণা করা হয়, আরহেনিয়ার রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে গোপনে লুকিয়ে আছে এক অমৃত শক্তি যা অগণিত বছর বেঁচে থাকার উপায় ধারণ করে। প্রাচীন যুগের শাসকেরা কখনোই সেই শক্তিকে ব্যবহার করেননি বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা একে রক্ষা করে এসেছেন। সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এখন এর রক্ষক অ্যালারিক ফেইথ। এই কারণেই আরহেনিয়ার রাজার আসনে বসার আগে প্রথম শর্ত দয়াশীলতা। তাকে হতে হয় নিঃস্বার্থ, ত্যাগের মানসিকতাসম্পন্ন আর অবশ্যই লোভ থেকে মুক্ত। কারণ অমৃত শক্তি রক্ষাকারীর দায়িত্ব কেবল তাকেই মেলে যার হৃদয়ে স্বার্থ নেই। আর এই বিশুদ্ধতার সুনিশ্চিত প্রমাণ খোঁজা হয় জন্মের পরপরই।আরহেনিয়ার প্রতিটি রাজবংশীয় সন্তানের পিঠে খোঁজা হয় চিহ্ন যা বলে দেয়, কে হবে প্রকৃত রক্ষক, কে পারবে অমৃতের রক্ষার ভার বহন করতে।
আরহেনিয়ার অলিগলিতে, আগুনের পাশে বসা বৃদ্ধের মুখে কিংবা নদীর ধারে শিশুরা খেলতে খেলতেই শুনে ফেলে এই অমৃত গাথা। তবে এই কথা কাহিনীর পিঠ পেছনে প্রশ্নও কম করা হয় না। কেউ কেউ ভাবে এই শক্তির অধিকারী হয়েই বা কী লাভ? এত বছর বাঁচার পরও যদি অন্তরটা একা থাকে? আবার কেউ বলেন, এসব গাঁজাখুরি গল্প! জন্ম যখন আছে, মৃত্যু থাকবে না কেন? আপাতত এই রহস্যের সত্য কিছুই প্রকাশ পায়নি। গল্প হয়, কিন্তু প্রমাণ নেই কোথাও।কারণ প্রাসাদ বাসী এই ব্যাপারে খোলাখুলি কখনো কথা বলেনি।
অ্যালারিক ফেইথ আজ নিজে এসেছেন মেয়ের কক্ষে। একেবারে সেদিনের রাজসভার ঘটনার পর থেকে আর কোনো সরাসরি কথা হয়নি বাপ মেয়ের। শুধু দাস-দাসীদের মাধ্যমে আদানপ্রদান হয়েছে প্রয়োজনীয় বার্তা। কিন্তু আজ তিনি নিজেই দাঁড়িয়ে আছেন সেই চেনা দরজার সামনে। ভেতরে প্রবেশের আগে কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকলেন। হয়তো ভেবে নিচ্ছিলেন কী বলবেন, কীভাবে শুরু করবেন। কারণ সব সম্পর্কের মাঝেই কিছু অপূর্ণতা জমে থাকে, আর একদিন সেগুলো স্পর্শ করতে হয় নিজ হাতেই।
দরজায় হালকা ঠকঠক শব্দ তোলেন অ্যালারিক ফেইথ। প্রায় পাঁচ মিনিট পর খুলে যায় দরজা। আরিসা দাঁড়িয়ে আছে চোখে বিস্ময় নিয়ে। বাবাকে দেখে অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা নিচু করে শ্রদ্ধা জানাল। তারপর একপাশে সরে দাঁড়াল। ভেতরে ঢোকার সুযোগ করে দিলো। অ্যালারিক ধীরে ধীরে পা ফেললেন ভেতরে। চোখ বোলালেন চারদিকে। অনেকদিন পর এসেছেন এই কক্ষে। দেয়ালের রঙ, জানালার পর্দা, সাজসজ্জা সবকিছুতেই এসেছে নীরব পরিবর্তন। তিনি হাঁটতে লাগলেন। তারপর থেমে মৃদু স্বরে বললেন,
“আরিসা, হঠাৎ প্রাসাদে কর্মী নিয়োগের কথা বললে কেন? বিষয়টা আমি এড্রিয়ানের মুখে শুনলাম।”
আরিসা কক্ষের দরজা ধীরে বন্ধ করে বাবার পেছনে এসে দাঁড়াল। অ্যালারিক জানালার পাশে রাখা টেবিলের উপর রাখা একটি পুরনো চিত্রের দিকে তাকিয়ে আছেন যে চিত্রকর্মে ছোট্ট আরিসা উনার কোলজুড়ে বসে হাসছে।
আরিসা বাবার চোখ অনুসরণ করে সেই চিত্রের দিকে দৃষ্টি রাখলো। নিচু স্বরে উত্তর দিলো,
"প্রাসাদের নিরাপত্তা এখন আগের মতো নেই, বাবা। আগত ঝুঁকি বুঝে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া দরকার ছিল। তাছাড়া!"
আরিসা থামল। নিঃশ্বাস নিলো ধীরে ধীরে। ফিসফিসিয়ে বললো,
" তাছাড়া একজনকে অন্দরে প্রবেশ করার জন্য দরকার ছিল এই নাটক! সেই বিশেষ একজন! আমি প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে শিখিনি যে। দুঃখিত, মহামান্য!"
অ্যালারিক মাথা নাড়িয়ে বললো,
"ঠিক আছে। আমি তোমার মতামতকে সম্মান করি। কিন্তু মনে রেখো এই রাজ্যের ক্ষতি হয় এমন কিছু করো না।"
"জ্বি, মহামান্য! আপনি চিন্তা করবেন না।"
অ্যালারিক এগিয়ে এসে বিছানার এক ধারে বসলেন। রাজপোশাকের ভারে তাঁর চলনে গাম্ভীর্যতা ফুটে উঠছিল আর মুখমন্ডল জুড়ে জমে থাকা ঘন দাড়ি আর কাঁধ ছোঁয়া চুলে ফুটে উঠছিল রাজকীয় দৃঢ়তা। তিনি মুখ তুলে তাকালেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নিজের কন্যার দিকে। কণ্ঠস্বরে কোমল এবং বহুদিনের জমে থাকা একটুখানি প্রশ্রয় মিশিয়ে বললেন,
“রাগ করেছ নিজের পিতার উপর?”
আরিসা চোখ নামিয়ে বলল,
“যার নিজের মেয়ের উপর বিশ্বাস নেই, তার সঙ্গে রাগ করে লাভ কী? একে রাগ বলা যায় না, এটা অভিমান।”
অ্যালারিক গভীরভাবে তাকালেন। তারপর বললেন,
“তুমি আরহেনিয়ার ভবিষ্যৎ, আরিসা। তোমাকে রক্ষা করা পিতা হিসেবে নয়, রাজা হিসেবেও কর্তব্য। আর এজন্যই আমি মনে করি তোমার বিয়ে এখন খুবই জরুরি। আমি কথা দিচ্ছি, তোমার বিয়ের পরদিনই তোমার রাজ্যাভিষেক হবে। রাজ্যের একাংশের দায়িত্ব তোমার হাতে তুলে দেবো।”
আরিসা গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
"আপনি যদি আমার পিতা হয়ে আমায় বিশ্বাস না করেন, তবে এই রাজ্যভার কিভাবে আমার হাতে তুলে দেবেন? তখন কি আমার সিদ্ধান্ত, আমার ক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে না?"
রাজা কঠোর কণ্ঠে বললেন,
"আরিসা, যা জানো না, তা নিয়ে অযথা তর্ক করো না। ফেড্রিক ঠিকই বলেছিলো, তোমার জন্মের পরপরই আমরা জেনেছিলাম, তুমি এক মহীয়সী নারী হবে। কিন্তু তোমার এই মহত্বই তোমার ধ্বংস ডেকে আনবে। যাঁরা তোমায় ভালোবাসবে, তারাই তোমায় আঘাত করবে। তাই তোমার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া অতীব জরুরি।"
একটুখানি হেসে যোগ করলেন,
"ফেড্রিকপুত্র সায়েরিন একমাত্র যোগ্য পাত্র। বিদ্বান, দক্ষ, বিশ্বস্ত। রাজ্য ও তোমার নিরাপত্তা দুটোই সে রক্ষা করতে পারবে।"
আরিসা ঠোঁট উল্টে হেসে বললো,
"আমার রক্ষার জন্য শুধু আমি এবং আমিই যথেষ্ট। কিন্তু আপনি যদি রাজ্যরক্ষার দায় নিয়ে সন্দিহান হন, আর সেই ভার ফেড্রিকপুত্রের হাতে তুলে দিতে চান তাহলে সেটা একেবারেই ভিন্ন বিষয়।"
অ্যালারিক রাগ চেপে রাখতে পারলেন না। উনার চোখে জ্বলজ্বল করছিল রাজশক্তির কঠোরতা,
"ফেড্রিকপুত্র লোভী নয়। সে আমার দেখা সবচেয়ে সৎ, বিনয়ী ও বিশ্বাসযোগ্য পুরুষ। আমার বিশ্বাসের অপমান কখনোই করবে না।"
একটুখানি থেমে আরও কঠোর গলায় বললেন,
"সামনের মাসের অর্ধাঅর্ধিতে তোমাদের বিয়ে হবে। কাল সে আসবে। তোমার উচিত ভালোভাবে তার সাথে কথা বলা। সায়েরিন তো ছোটবেলা থেকেই তোমাকে পছন্দ করে এসেছে। এখন সময় এসেছে সেই সম্পর্ককে নতুন পরিচয়ে বেঁধে ফেলার। নিজেকে প্রস্তুত করো, আরিসা।"
অ্যালারিক ফেইথ প্রস্থান করলেন। দরজা ধীরে ধীরে বন্ধ করলো আরিসা। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে থেকে সে নিজের কক্ষের নরম বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল।
কানে ভেসে উঠল বাবার কথাগুলো।
"সায়েরিন ছোটবেলা থেকে তোমাকে পছন্দ করে।"
হঠাৎ করেই জোরে হেসে উঠল আরিসা।
"আমাকে পছন্দ করে! কিন্তু আমি কি তাকে পছন্দ করি?"
আরিসা কি আসলে কাউকে ভালোবেসেছে কখনো?
আচ্ছা, কেউ কি কখনো জেনেছে, আরিসার মন কোথায় থমকে আছে?
আরিসা মিনমিনিয়ে বললো,
"আমার পছন্দের কোনো মূল্য নেই কারো কাছে। আমি কী চাই সেটা কেউ জানতে চায় না। আমি শুধুই একটা রাজ্যভার বইবার পাত্র! একটা মেয়ে আর কিছু না।"
আরিসা নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো।
*******
কায়েরীথ প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজই কর্মী নিয়োগ হবে রাজপ্রাসাদে। দীর্ঘদিন পর এমন একটি সুযোগ এসেছে যেখানে প্রতিটি আগতকে দিতে হবে শক্তির পরীক্ষা। আর অপেক্ষা নয়। ব্যথা-জর্জর শরীর নিয়েও তাকে যেতে হবে। কারণ এই সুযোগ যদি হারিয়ে ফেলে তবে কবে আবার আরেকটা এমন দিন আসবে তা নিয়ে সন্দেহ। আবারো পেছনে পড়ে থাকবে সে। বাকি হাজার মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যাবে চিরতরে। প্রাসাদের বাইরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে অসংখ্য চোখ ঝলসে উঠছে আশায়। বিশেষ করে সেইসব মানুষ যাদের কোনো পরিবার নেই, যাদের ঘরে আগুন ধরানোর মতো রোজগার নেই, যারা প্রতিদিন ক্ষুধা আর অপমানের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছে তাদের কাছে এই কর্মসংস্থানের ডাক স্বপ্নের দরজার চাবি।
আর প্রাসাদের ভেতরে একবার ঢুকতে পারা মানেই শুধু চাকরি নয় এক নতুন জীবন। সুরক্ষা। সম্মান। খাওয়া-পরা। থাকার জায়গা। আর তার চেয়েও বড় কথা নিজেকে প্রমাণ করার একটা শেষ সুযোগ। তাছাড়া কায়েরীথের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কার্য এই প্রাসাদের মাধ্যমেই পূর্ণ হবে।
সকাল ঠিক সাড়ে দশটায় প্রাসাদের গেইট ধীরে ধীরে খুলে দেওয়া হলো। সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে ভিতরে ঢুকলো কায়েরীথ। প্রথম রাউন্ড দৌড় প্রতিযোগিতা। এই রাউন্ডে যারা জিতবে তারাই পাবে সামনে এগোনোর সুযোগ।
কায়েরীথের কাছে দৌড় কোনো নতুন বিষয় নয়।
প্রতিদিন তাকে পালাতে হয়, কখনো চুরি করে, কখনো জীবন বাঁচাতে। পা আপনেই জানে কোন পথে দৌড়ালে ধরা পড়বে না। তাই দৌড় প্রতিযোগিতা কায়েরীথের কাছে বা হাতের খেলা।
প্রতিযোগিতার একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে সাজানো চেয়ারে বসে রয়েছেন এড্রিয়ান ফেইথ। তার পাশের চেয়ারে রাজকুমারী আরিসা। দৃষ্টি সোজা কায়েরীথের দিকে স্থির। এই ছেলেটার জন্য ই এতো বড় প্রতিযোগিতা হচ্ছে। অনেক বছর পর পর সাধারণত একবার হয় এমন প্রতিযোগিতা। এইবার করার কোনো পরিকল্পনা ছিল না তাদের কিন্তু আরিসা চাইছে তাই হচ্ছে এইবার। আভ্র এসে বসলো আরিসার পাশে। সেদিন আভ্রকে রাজি করানোটা ছিল আরিসার জন্য সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। শহরের এক সাধারণ, শান্ত স্বভাবের মেয়ের সাথে আভ্রর কথা বলিয়ে দিতে হয়েছিল তাকে। মেয়েটিকে আভ্র আগে থেকেই চিনত, কিন্তু লজ্জা আর দ্বিধায় কখনো সাহস করে এগিয়ে যেতে পারেনি। কায়েরীথের সাথে বাইরে বের হওয়ার পরদিন আবারো এক দাসী এবং আভ্র ভাইয়ের সাথে ছদ্মবেশে লুকিয়ে বাইরে বের হয়েছিল সে। আরিসা নিজের সব ধৈর্য, বুদ্ধি আর মনের জোর একসাথে করে নেমেছিল এই কাজে। সহজ ছিল না কিছুই। অবশেষে, মেয়েটির চোখে আভ্রর জন্য প্রেমের পরশ দেখে সব ক্লান্তি উড়ে যায়। প্রথম দেখাতেই মেয়েটি হৃদয় দিয়ে ভালোবেসে ফেলেছিল আভ্রকে। এরপর কক্ষে এসে অনেক দ্বিধার পর আভ্র রাজি হয়েছিল আরিসার প্রস্তাবে। কিন্তু সব চেষ্টার পরও শেষরক্ষা হলো না। সেই তো আভ্র ভাই নিজের বাবাকে বলেই দিলো কর্মী নিয়োগ দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ আরিসা করেছে। এইসব আরিসার পরিকল্পনা।
প্রথম প্রতিযোগিতা বিশ মিনিটের মধ্যেই শেষ হলো। কায়েরীথ ঠিক সময়মতো পার পেয়ে গেলো। পরের রাউন্ডের জন্য নির্বাচিত হলো সে। নিঃশ্বাস ফেলার মতো ফুরসত মিললো প্রতিযোগীদের। এক ঘণ্টার বিরতিতে সবাইকে খাবার দেওয়ার আয়োজন করা হলো। এই ফাঁকে এল ফেড্রিক পুত্র সায়েরিন। রাজকীয় পোশাকে মোড়ানো তার গা শিরশিরে শ্যামলা গড়নের দেহ। ফুরফুরে কালো চুল আর সেই চোখ! যেই চোখের গভীরতায় হাজারো রমণী নিমেষে গলে যায়। কিন্তু যার জন্য তার এত উন্মাদনা, সে মেয়েটি তো তার দিকে ফিরেও চায় না।
সূর্যের আলোয় সায়েরিনের চেহারা আরও দীপ্তিময় হয়ে উঠেছে। এক হাতে তার লম্বা তলোয়ার, অন্য হাতে একটি কাপড়ের ব্যাগ। চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখতে লাগলো সে। হঠাৎ তখনই দূরে নজরে পড়লো এক প্রতিযোগী যার আপাতত সাহায্যের প্রয়োজন। দ্বিধা না করে তলোয়ার খাপে ভরে ছুটে গেলো সায়েরিন। নিঃশব্দে, নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করলো। সবাইকে পাশে রেখে একে একে সহায়তা করতে লাগলো। তাকে দেখে মনে হলো এক অনন্ত দায়িত্বের ভারে জন্মেছে সে। তারপর কাজ শেষে নিঃশব্দে ফিরে এলো আরিসার কাছে।
রাজকুমারী আরিসার পাশে বসে থাকা আভ্রকে ইশারা করলো উঠে যাওয়ার জন্য। আভ্র চোরা চাহনি দিলো, মুখে হাসি ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো। পিঠ চাপড়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
"আমাদের প্রিন্সেস কিন্তু সহজে পাত্তা দেয় না। মিষ্টি কথায় গলে না সে। তাই ধীরে সুস্থে ভাই!"
সায়েরিন হেসে মাথা নাড়লো। কিছুটা কাছে এগিয়ে জড়িয়ে ধরলো আভ্রকে ফিসফিসিয়ে বললো,
"ধন্যবাদ, আভ্র! আমি চেষ্টা করবো।"
আভ্র কয়েকবার পিঠ চাপড়ে কেটে পড়লো। প্রতিযোগিতার বাহানায় তার প্রিয়তমা প্রাসাদে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়েছে যা হঠাৎ ই চোখে ধরেছে আভ্রর। মেয়েটার সাথে দেখা করতে হবে ভেবে দ্রুত কথা সাড়লো সে। সায়েরিন নিঃশব্দে এসে আরিসার পাশে বসলো। আরিসা চোখ ফেরাল না, তার দৃষ্টি সামনে নিবদ্ধ। পরবর্তী প্রতিযোগিতা শুরু হতে চলেছে। কায়েরীথকে জিততেই হবে। এই জয় তাকে প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশের পথে একধাপ এগিয়ে দেবে। হার মানেই নতুন পরিকল্পনা! নতুন ঝুঁকি! যেটা আরিসা কখনোই চায় না। সায়েরিন চুপচাপ তাকিয়ে রইল আরিসার দিকে। আরিসার চোখের তীক্ষ্ণতা দেখে তার মুখে এক মুচকি হাসি খেলে গেল।
এই রাউন্ডই শেষ। পঞ্চাশজনের ভেতর থেকে বেছে নেওয়া হবে মাত্র দশজনকে। এবার পরীক্ষা বুদ্ধিমত্তার। প্রতিযোগীদের হাতে তুলে দেওয়া হলো একটি করে কাগজ। তাতে লেখা এক একটি ধাঁধা। ধাঁধার সূত্র ধরে এগিয়ে যেতে হবে সামনে, খুঁজে বের করতে হবে নির্দিষ্ট এক বস্তু। এই প্রতিযোগিতা রাখার কারণ প্রাসাদের অভ্যন্তরে অনেক অলৌকিক বিষয় ঘটে থাকবে। সেগুলো এই কর্মীগণ সঠিকভাবে সামলাতে পারবে কিনা এবং এই পরিবেশের সাথে মিলিয়ে চলতে পারবে কিনা আর নিজের বুদ্ধি খাটাতে পারবে কিনা তা যাচাই করার জন্য।
সকলকে আলাদা আলাদা জায়গা ছেড়ে দেওয়া হলো। কায়েরীথ কাগজটি ধীরে ধীরে খুললো।
ধাঁধা লেখা,
"যেখানে মেঘ ছুঁতে চায় ভূমি,
যে শব্দের শুরুতেই 'ম',
সেখানে দাঁড়িয়ে আছে কালো পাথরের শিখর,
যার বুকে লুকানো শুভ্রতা।"
কায়েরীথ বারবার পড়তে লাগলো প্রতিটি শব্দ। মেঘ ছুঁতে চায় ভূমি! কোথায় এটা? নদী? না নদীতে তো দিগন্ত এসে মিলে যায়। মেঘ ছুঁয়ে যায় তো পর্বতে। আর যার শব্দের শুরুতেই ম আছে? কালো পাথরের শিখর? শুভ্রতা! এর অর্থ বরফখণ্ড! অর্থাৎ মেনিস পর্বতমালা। এখানেই প্রায় সময় বরফে ঢাকা থাকে। কায়েরীথ ছুটে গেলো মেনিসের পথে।
মেনিস পর্বতমালার উঁচু-নিচু পথ ধরে নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে কায়েরীথ। বাতাসে পাতার মৃদু শব্দ! দূরে কোনো পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ। তার চোখ সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াচ্ছে আশেপাশে প্রতিটি পাথর, প্রতিটি ছায়া তার কাছে রহস্যময় ঠেকছে। চোখ সরাতে পারছে ক্ষুদ্র পাতা হতেও! একসময়, একটি পাথরখণ্ডে বড় একটি বিন্দু চিহ্ন চোখে পড়লো আর থেমে দাঁড়ালো কায়েরীথ। কৌতূহলে ঝুঁকে পড়লো সেই বিন্দুতে। এগিয়ে গেলো সে পাথরের দিকে। পাথরটি সরাতেই নিচে পাওয়া গেলো একটি খাম! যার চারপাশে রয়েছে মায়াবী সুরক্ষা কবজ। এজন্যই পাথরের নিচে থাকা সত্ত্বেও খামের উপর কোনো প্রকার আঁচ লাগেনি। সতর্কভাবে তুললো খামটি। খামের ভেতর লুকিয়ে আছে আরেকটি ধাঁধা।
এক ধাপে শেষ নয় পথটি! আরও এক ধাপ বাকি।
"যেখানে ছায়া পড়ে ঢালে,
তপ্ত সূর্য মুখ লুকায় ক্লান্ত বিকেলে।
নিঃশব্দে পড়ে আছে ধূসর প্রহর,
তুমি খুঁজে পাবে তাকে! পেছনের বাঁকে,
যেখানে বাতাস থেমে দাঁড়ায় বড় পাথরের চূড়ায়।"
ধাঁধা টি পড়ে শরীরে শীতল স্রোত বইতে লাগলো কায়েরীথের। বুক ধুকপুক করছে। সময় আর কতক্ষন বাকি বোঝা যাচ্ছে না। দশজন কি হয়ে গেলো এই নিয়েও চিন্তায় আরো মাথা কাজ করছে না কায়েরীথের।
·
·
·
চলবে.........................................................................