মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ৭৩ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


          কায়েরীথ নতুন পোশাকে প্রাসাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাজকীয় গাম্ভীর্য ছুঁয়ে গেছে তার চলনে। চেহারায় ধরা পড়েছে আত্মবিশ্বাস। সেই আত্মবিশ্বাসী মুখ নিয়ে সে হেঁটে যাচ্ছে। প্রাসাদের প্রতিটি অলিন্দ ঘুরে ঘুরে দেখছে সে। কিন্তু মনের ভেতর জমে আছে অজানা প্রশ্ন। তাকে কি আদৌ দেহরক্ষী হিসেবে রাখা হবে? নাকি আরিসার মনে অন্য কোনো গোপন পরিকল্পনা আছে? অন্য বিজয়ীরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত। কায়েরীথ শুধু অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। অপেক্ষার এই ফাঁকে সে এসে পড়ে আরিসার কক্ষের সামনে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে কোনো দাসী, প্রহরী, কেউই নেই কক্ষের সামনে। নিরবতা ঘিরে আছে দোরের চারপাশ।

কায়েরীথ ধীরে ধীরে এগিয়ে দরজায় হাত রাখতেই অনুভব করলো দরজাটা সম্পূর্ণ বন্ধও নয়। সে কিছুটা দ্বিধায় ভুগলেও শেষমেশ দরজাটা ঠেলে খুলে ফেললো। চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল তার। আভিজাত্যের এক শিল্পগৃহ আরিসার শয়নকক্ষ। সুশোভিত আসবাব, ঝলমলে পর্দা, বিশাল একটা সোনালী কাঠের খাঁজ কাটা বিছানা, আর একটা বৃহৎ আরশি। কিন্তু কায়েরীথের চোখ স্থির হলো একটা চিহ্নে। প্রথমে বিছানার পাশে মেঝেতে সেটা নজরে এলো। তারপর কায়েরীথ বুঝতে পারলো ঘরের নানা প্রান্তে আলনায়, আয়নার পাড়ে, পর্দার কোণায় এই একই চিহ্ন বারবার ব্যবহার করা হয়েছে। ভ্রু কুঁচকে গেল তার। আর তখনই দোর খোলার আওয়াজ হলো। কায়েরীথ ধীর পায়ে নিঃশব্দে সরে গেলো এক কোণের দিকে। আয়নার পাশে থাকা জানালায় পর্দার আড়ালে চলে গেল সে। দরজা তখনো আধা খোলা। পর্দার আড়াল দিয়ে কায়েরীথ দেখতে পেলো রাজকুমারী আরিসা কক্ষে প্রবেশ করছেন। সাথে আরও কয়েকজন দাস দাসী। 

কেউ একজন প্রশ্ন ছুঁড়লো,
"রাজকুমারী! আপনি ওই সাধারণ ছেলেটাকে দেহরক্ষী করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন কেন?"

"দরকার ছিল তাই।আরিসা অদরকারে কোনো কিছুই করে না। "

একজন নিচু স্বরে বলে উঠলো,
"কিন্তু ছেলেটার তো কোনো যোগ্যতাই নেই, রাজকুমারী।"

"আমি ওকে যোগ্য করে তুলব।"
নির্ভার জবাব দিলো আরিসা।

পরের প্রশ্নটা কিছুটা কটাক্ষের ছোঁয়ায় বললো দাসী,
"তাহলে কি আপনি এমনটা করছেন কারণ আপনি ফেড্রিক পুত্রকে বিয়ে করতে চান না?"

কথাটি কানে পৌঁছাতেই দাঁড়িয়ে পড়লো রাজকুমারী।
দৃষ্টিতে আগুন আর কন্ঠে হিমশীতলতা নিয়ে বললো,
"আমি কাউকে বলিনি আমাকে নিয়ে ভাবতে। বাইরে যাও তোমরা। ডাকলে তবে এসো।"

ধমকটা বিদ্যুতের মতো কেঁপে উঠলো কক্ষের দেয়ালজুড়ে। সবাই নিঃশব্দে সরে গেলো। নির্মল অভিজ্ঞানকে ছোঁয়ার ধৃষ্টতা নিয়ে মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলো তারা। আরিসা ধীরে ধীরে বিছানায় বসে পড়লো।
একটি নিঃশ্বাস ফেললো সে‌। নিরব, ক্লান্ত অথচ রাজকীয় ধাঁচের সেই নিঃশ্বাস।

কায়েরীথ ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো পর্দার আড়াল থেকে। তারপর বিছানার পাশে দাড়িয়ে সেই অযাচিত , অদ্ভুত এবং রাজকীয় চিহ্নের দিকে তাকিয়ে শুধালো,
"এটা কিসের চিহ্ন?"

আরিসা চমকায়নি। সে আগেই আন্তাজ করেছিল কায়েরীথ এখানেই আছে। আরিসা বললো,
" আমার কক্ষে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করেছ এর শাস্তি কি হতে পারে জানো সেটা?"

"উমম! আপনিই বলুন!"

"আজীবন কারাগারে বসবাস!"

আরিসা উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে গেলো কায়েরীথের সম্মুখে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
"ভেবো না আমি তোমার উপর সহজ হচ্ছি। আমি শুধু তোমাকে সাহায্য করছি কারণ তার বিনিময়ে আমি কিছু অর্জন করবো।"

"তো আপনি বিবাহ করতে চান না এজন্যই আমাকে দেহরক্ষী হিসেবে চাইছেন?"

"হ্যাঁ! ইহাই সত্যি। আমার পিতা রাজি হয়েছে। কাল থেকে তোমার প্রশিক্ষণ শুরু করা হবে।"

"আপনার পিতা এতো দ্রুত এবং সহজে সম্মতি জানিয়ে দিলো? বেশ সন্দেহ হচ্ছে আমার।"

"তিনি সম্মতি দিয়েছেন কারণ প্রশিক্ষণের শেষে তিনি চান, তুমি এবং ফেড্রিক পুত্র সায়েরিনের মাঝে হোক এক হাড্ডাহাড্ডি দ্বন্দ্ব। সেই লড়াইয়ের ফলই নির্ধারণ করবে ভবিষ্যৎ।"

কায়েরীথের ভ্রু জোড়া কুঁচকে উঠলো, কপালে গভীর ভাঁজ। কণ্ঠে কঠোরতা ঝরল,
"আমি কেন আপনার জন্য এসব অযথা লড়াই করবো?"

আরিসা তখন এক কদম এগিয়ে এলো। তার চোখে তীক্ষ্ণতা ফুটে উঠেছে। সেই দৃষ্টিতে কায়েরীথের আকাশি চোখে বিঁধে থাকলো আরিসা। মুহূর্তেই ঘরে কিছু একটা বদলে গেলো। জানালার পাল্লা সপাট করে খুলে গেলো। উদ্দাম হাওয়া ধেয়ে এলো ঘরের ভেতর, রাজকুমারীর লম্বা চুলগুলো পাখনার মতো ছড়িয়ে পড়লো বাতাসে।

কায়েরীথ তাকিয়ে রইলো বিস্ময়ে। আরিসা আস্তে আস্তে হাত উপরে তুললো, হাওয়াকে থামিয়ে ধরলো এক মুঠোয়। তারপর সেই বাতাসের শক্তি কায়েরীথের দিকে ছুঁড়ে দিলো এক নিঃশ্বাসে। মুহূর্তেই কায়েরীথের চুল উলটে গেলো পেছনের দিকে। বাতাসের ধাক্কায় কায়েরীথ তাকাতে পর্যন্ত পারছিলো না। 

আরিসা মৃদু হেসে বললো,
"এর পরিবর্তে আমার সাহায্য পাচ্ছো। এর পরিবর্তে আমার সব শিক্ষা তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি এটাই কি যথেষ্ট নয়, ক্রুশ?"

হাওয়া থামলো। কায়েরীথ ও বুকে বাতাস ফিরে পেলো এবং আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল নাহলে যে পরিমাণে বাতাস ছুঁয়েছে তার মুখমণ্ডল নিঃশ্বাস যে বন্ধ হয়ে যায়নি তাই অনেক। কায়েরীথ শান্ত হয়ে চোখ সরিয়ে আবার চিহ্নটির দিকে তাকাল।

"এটা কিসের চিহ্ন বললেন না, রাজকুমারী?" 

আরিসা নীরবে চিহ্নটির দিকে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। মনে হলো পুরোনো কোনো স্মৃতি তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অতীতের গভীরে। তারপর ধীরে চোখ ফিরিয়ে কায়েরীথের দিকেই তাকাল।

"এটা এমন এক চিহ্ন যেটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহন করে নিয়ে চলেছে এই রাজ্য। এটি বেছে নেয় ভবিষ্যতের উত্তরাধিকারীকে। যার শরীরে এই চিহ্ন জাগ্রত হয় সেই হতে পারে আরহেনিয়ার পরবর্তী অধিপতি। আর এরকম তবে ভিন্ন ধরনের চিহ্ন আমার আভ্র ভাইয়ের মধ্যেও আছে। এমনকি আমার ভাইয়ের মধ্যেও আছে। আর অবশ্যই আমার শরীরেও একটি চিহ্ন আছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো ফেড্রিক পুত্র সায়েরিনের শরীরেও এমন চিহ্ন আছে। কিন্তু উনার চিহ্নটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের আর সেটাই আমার আরেকটি সন্দেহের কারণ।"

কায়েরীথ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। কোনো কথা বলল না। শুধু আরিসার কথাগুলো মস্তিষ্কে ভালোভাবে ধারণ করলো।

*******

যথারীতি কায়েরীথের প্রশিক্ষণ শুরু হলো। প্রথমে এড্রিয়ান ফেইথকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কায়েরীথকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। কিন্তু আরিসা নিজেই সেই সিদ্ধান্ত পাল্টে দিলো।এই ছেলেটাকে সায়েরিনের সমকক্ষ না বলাই ভালো। সায়েরিন থেকেও শ্রেষ্ঠ করে গড়ে তুলতেই হবে কায়েরীথকে। না, সায়েরিন মন্দ কেউ নয়। সুদর্শন, মিতভাষী, দক্ষ যোদ্ধা সব দিকেই প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু যদি তাকেই জীবনসঙ্গী করতে হয়, তবে আরিসার এই আরহেনিয়া রাজ্যে কী থাকবে? সব সিদ্ধান্ত, সব গৌরব, সব শাসন সায়েরিনের হাতে গিয়ে পড়বে। আরিসা নামমাত্র রাজ্য অধিকারী হয়ে থাকবে। সবাই ভাববে যা কিছু হচ্ছে সব সায়েরিনের কারণেই সম্ভব হয়েছে। আরিসা এসব কখনোই চায় না।

কিন্তু কায়েরীথ! সে সাধারণ এক যুবক, যার অতীত রহস্যে ঢাকা, যার চোখে আগুন, হৃদয়ে বিদ্রোহ। আরিসা সেদিন ই বুঝতে পেরেছিল এই ছেলেটাকে শাণ দিয়ে তুললে, সে একদিন ছুরি হয়ে উঠবে। ছিঁড়ে ফেলবে জঞ্জাল, গড়ে তুলবে কিছু নতুন। এই চিন্তার জন্যই কায়েরীথকে বেছে নিয়েছে আরিসা। তাছাড়া অন্য সবাই নিয়ম মানে। আর আরিসা? সে তো নিয়ম বদলাতে জানে। 

কায়েরীথের প্রথম দিনটাই ছিল দুঃস্বপ্নের মতো। সে খুব দুর্বল আর হরহামেশা প্রহার পাওয়ার কারণে অল্পতেই ব্যথা পেয়ে যাচ্ছিলো। শরীরটা ভেঙে চুরমার হয়ে পড়ছিল বারংবার। প্রশিক্ষণ চলছিল রাজমহলের সাধারণ মাঠে। এখানেই সাধারণত সকল তরুণদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে আরিসা কায়েরীথকে গোপন প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য মাঠের ছোট্ট একটি অংশ ধার নেয়। অর্থাৎ সেই অংশে কেউ আসতে পারবে না এটাই চায় রাজকুমারী।  

প্রথম দিন প্রশিক্ষণ শেষে ব্যথায় জর্জরিত এবং অবসন্ন হয়ে কায়েরীথ শুয়ে পড়েছিল বিছানায়। পরের দিন সূর্য মাথার ওপরে উঠে গেলেও এক চুলও নড়েনি সে। প্রতিটি শিরায় শিরায় আগুন লেগে গিয়েছিল তার। দেহের কোথায় ব্যথা নেই, বলা মুশকিল। চোখে ক্লান্তি ঝরে পড়ছিল আর ঠোঁটের কোণে নীরব কষ্ট।

আরিসা প্রথমে দাসীদের পাঠিয়েছিল ব্যথা সাড়াতে। মূলত ওরা ওষুধ লাগিয়ে দিত, পট্টি বেঁধে দিত কিন্তু কায়েরীথের আর্তনাদ থামছিল না। শেষে আর সহ্য করতে না পেরে রাজকুমারী আরিসা নিজেই গিয়ে দাঁড়াল কায়েরীথের সামনে। কোমল হাতে ছুঁয়ে দেখল তার ক্ষত। সেদিন প্রথমবারের মতো কায়েরীথের জন্য খুব খারাপ লাগছিল আরিসার। অতঃপর নিজের জাদুশক্তির ব্যবহার করে কায়েরীথের কিছুটা ব্যথা উপশম করে দিয়েছিলো সে। সবশেষে ব্যথা সাড়ানোর পর আরিসা আবারো কায়েরীথকে প্রশিক্ষণের জন্য উঠতে বলে। কায়েরীথের এতো ব্যথা আর এতো আর্তনাদের পর ও আরিসার চোখে দ্বিতীয়বার মায়া দেখা গেল না। শুধু ছিল কঠোর সংকল্প। আরিসা জানে এই যন্ত্রণা আর সহ্যসীমা সয়ে নিলেই গড়ে উঠবে যুদ্ধক্ষেত্রের বীর।

প্রতিদিন একই চিত্র। প্রশিক্ষণ শেষে কায়েরীথের দেহ নিস্তেজ, নিঃস্ব। কিন্তু সে থামে না। ব্যথা ভুলে আবারও দাঁড়িয়ে পড়ে। আর তাই দরকার হতো ভরপুর আহার। প্রতিদিন অজস্র খাবার পড়তো তার থালায়। এতে করে কিছু কর্মচারী বিরক্ত হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু রাজকুমারীর নির্দেশে মুখ খুলতে সাহস পায়নি কেউ। এই সংগ্রামে, কায়েরীথের দেহ ভেঙে পড়ছে দিনে দিনে। কিন্তু ওর চোখে জন্ম নিচ্ছে এক নবজাগরণের জ্যোতি। অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে ভর করে সে ক্লান্ত শরীরের মধ্যে দিয়েও আত্মস্থ করে নিচ্ছে একের পর এক কলা-কৌশল। অস্ত্রচালনা থেকে শুরু করে প্রতিপক্ষের মুদ্রা বুঝে নেওয়া সবকিছুই সে মনোযোগ দিয়ে শিখছে।

আরিসা নিজ হাতে তাকে শেখাচ্ছে জাদুবিদ্যার প্রাথমিক পাঠ, প্রতিটি মন্ত্র, প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ জাদু যাতে কায়েরীথের হাতে ধরা দেয় এক নতুন শক্তির বীজ।এইসবের খবর পৌঁছেছে সায়েরিনের কানে। সায়েরিন তো রাগে ফেটে পড়ছে। ওর ভেতর জ্বলে উঠেছে হিংসার আগুন। রাজকীয় অহংকারে ঘা লেগেছে ওর।

"আমি ফেড্রিকপুত্র!"
সে বারবার নিজেকে স্মরণ করাচ্ছে।
"আমার প্রতিপক্ষ সেই ছেলেটা? অসম্ভব! এই লড়াই আমি হারতে পারি না!"
তারপর থেকে সেও দ্বিগুণ উদ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করে।

একদিন আরিসা গুরুত্বপূর্ণ তীরবিদ্যা শেখাচ্ছিলো কায়েরীথকে। হঠাৎ প্রশিক্ষণের মধ্যেই ঘটে যায় এক দুর্ঘটনা। কায়েরীথ অসাবধানতাবশত ছুঁড়ে দেয় একটি তীর। যা সোজা গিয়ে বিঁধে এক ছোট্ট নিরীহ পাখির বুকে। পাখিটি মাটিতে পড়ে যায় নিথর নিষ্প্রাণ হয়ে।

আরিসা তো প্রচন্ড রেগে যায়। কারণ পশুপাখিদের সে খুব ভালোবাসে আর তারাও যথাযোগ্যভাবে সে ভালোবাসা ফিরিয়ে দেয়। আরিসার চোখ রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে ক্রোধে। 
সে গর্জে উঠে বলে,
"তোমার শক্তি অর্জনের জন্য যদি কারো প্রাণ নিতে হয়, তবে সেই শক্তি মূল্যহীন, ক্রুশ!এই রাজ্যের ভবিষ্যৎ রক্ষার অর্থ অন্ধ হয়ে হত্যা নয়!"

কায়েরীথ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। চোখের দৃষ্টি পড়লো রক্ত লেগে থাকা সেই ছোট্ট পাখিটার উপর যার ডানাগুলো এখন নিশ্চল এবং দেহখানি নিথর হয়ে পড়ে আছে ভূমির উপর।

কায়েরীথ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
"সামান্য পাখিই তো। ভুলবশত শরীরে লেগে গেছে। আমি তো আর ইচ্ছে করে কিছু করিনি। আপনি এতো নরম হলে রাজ্য কীভাবে চালাবেন?"

আরিসা চোখ সরু করে তাকাল,
"পশুপাখিরা কোনো সামান্য নয়, কায়েরীথ। তারা এই প্রাকৃতিক জগতের অংশ। জীবন শুধু মানুষের নয়, সকল প্রাণের। তাদেরও অধিকার আছে আকাশে ওড়ার, নিঃশ্বাস নেওয়ার, বাঁচার। সতর্ক হও। আবার এমন হলে আমার হাতে তোমার মৃত্যু অনিবার্য! কারণ আমি দুর্বলদের মৃত্যু দেখতে পারি না। "

কায়েরীথ স্তব্ধ হয়ে যায়। ওর অহংকার মুহূর্তেই গলে যায় অনুতাপের স্রোতে। সে ধনুক হাতে নিয়েই ধীরে ধীরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে পাখিটার পাশে।
নরম স্বরে বলে উঠে,
"আপনি আমার ব্যথা সাড়িয়েছিলেন। এই পাখির ব্যথা কিভাবে সাড়াবো আমি? আমাকে শিখিয়ে দিন রাজকুমারী। আমি ভুল করতে চাই না আর।"

আরিসা নিশ্চুপ হয়ে কায়েরীথের কাছে এগিয়ে গেলো। অতঃপর নিচুতে ঝুঁকে পাখিটিকে পরীক্ষা করলো। তারপর নিচু স্বরে বললো,
"মৃতদের ব্যথা সারানো যায় না, ক্রুশ। মৃতরা তো এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়। তাদের ফেরানো সম্ভব নয় তবে একটা পথ আছে। একটা অন্ধকার, বিপজ্জনক পথ।
যেখানে মৃত্যু আর জীবনের সীমারেখা মিলেমিশে যায়।
তবে সেই পথ শুধু তাদের জন্য, যারা মূল্য দিতে প্রস্তুত।"

কায়েরীথ মৃদু গলায় শুধায়,
"কি সেই মূল্য?"

আরিসা থেমে যায়। আরিসার চোখে উদ্ভাসিত হয় রহস্যময় দীপ্তি,
"নিজের একটা অংশ হারিয়ে ফেলতে হয়। কখনো সেই অংশ আর ফেরে না।"

"মানে?"

"এই কথা সকলকে বলা যায় না।" 

আরিসা আবারো নিঃশব্দে বললো, 
"তবে তুমি আমার দেহরক্ষী হবে, তাই তোমার ও জানাটা জরুরি। আমাদের রাজপ্রাসাদের যে বৃহৎ হলঘর আছে তার নিচে আছে এক লুকানো কক্ষ যেখানে প্রবেশ করতে হয় খাবারের ঘরের এক অদেখা দরজা দিয়ে। সেই কক্ষে রাখা আছে এক নীল পাথর। কোনো সাধারণ পাথর নয় সেটি। সেই নীল পাথরের আলোয় গোটা ঘর আলোকিত থাকে। কেউ যদি পাথরটি শরীরে ধারণ করে তবে চাইলেই অগণিত বছর বেঁচে থাকতে পারে এই পৃথিবীতে। সে শক্তি দিয়ে প্রাণ বাঁচানোও সম্ভব তবে শুধুই নিজের, অন্যের নয়। হ্যাঁ অন্যের ও প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। কিন্তু অন্যের প্রাণ বাঁচাতে গেলে নিজেকে সহ্য করতে হয় মৃত্যু কষ্ট! যা মারা যাওয়া থেকেও বেশি ভয়ংকর। 

অনেক বছর আগে, আমাদের এক পূর্বপুরুষ ল্যুমিস নদী থেকে এই পাথর সংগ্রহ করেন। তিনি তা শরীরে ধারণ করে হলেন অমর। কিন্তু সাধারণ মানুষের শক্তি শুষেই তাকে বাঁচতে হতো। অনেক অনেক বছর পর এক সময় নিজেই ক্লান্ত, বিরক্ত এবং ব্যতিব্যস্ত হয়ে আবার ফিরে যান সেই নদীতে। জীবনের অবসান ঘটিয়ে আসেন‌ সেখানে। নীল পাথরটিও ফিরে যায় সেই নদীর তলে।
তার মৃত্যুর পরে উনার পুত্র আবার সেই অমৃত শক্তির অধিকারী পাথরটি উদ্ধার করে সুরক্ষিত রাখেন রাজপ্রাসাদে। সময়ের সাথে সাথে অনেক রাজা এসেছেন কিন্তু কেউ আর সেই পাথরের ছোঁয়া নেননি। শুধুমাত্র রক্ষা করে গেছেন সকলে। কারণ একবার যদি এটা ভুল হাতে পড়ে পৃথিবী আর আগের মতো থাকবে না। রাক্ষস হয়ে উঠবে যে-ই তা ধারণ করবে। আর পরবর্তীতে আমাকেও এই পাথরটি রক্ষা করতে করতে জীবন পার করতে হবে।"

কায়েরীথ শান্ত কণ্ঠে শুধালো,
"কিন্তু এই অমূল্য পাথর যদি ল্যুমিস নদীর অন্তর্গত হয়, তবে সেটাকে সেখানে রেখেই বা রক্ষা করা যেত না? রাজপ্রাসাদে এনে লুকিয়ে রাখার কী দরকার ছিল?"

আরিসা চোখ নামিয়ে ধীরে বললো,
"এই প্রশ্ন বহুবার উঠেছে, বহু বইয়ে লেখা হয়েছে। কিন্তু উত্তর একটাই। যদি ভুল মানুষের হাতে পড়ে? যদি কেউ শক্তির মোহে পড়ে ওটা শরীরে ধারণ করে? তখন সে আর মানুষ থাকে না, রূপ নেয় এক ভয়ংকর রাক্ষসে।তখন এই পৃথিবী, যা এখনো কোনোভাবে ভারসাম্য বজায় রেখে চলছে, তা এক বিশৃঙ্খল নরকে পরিণত হবে। এই কারণেই রাজপ্রাসাদের গোপন কক্ষে, সবচেয়ে সুরক্ষিত জায়গায় রাখা হয়েছে পাথরটি। ল্যুমিস নদী মুক্ত, কিন্তু এই পাথর নয়। আর মনে রেখো!" 

আরিসার কণ্ঠ গভীরে প্রবেশ করলো,
"তুমি আমি কেউই পাথরটিকে ধারণ করতে পারবো না। কারণ তা রাজ্যের নীতি বিরুদ্ধ হবে। আমরা শুধু সুরক্ষা দিতে পারবো।"

"কিন্তু পাথরটিকে ধারণ করার উপায় কী?"
কায়েরীথ অনেকক্ষণ সময় ব্যয় করে অতঃপর এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো।

"তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু দরকার হয় না। শুধু মানুষ হলেই চলে। আর একটা হৃদয় দরকার হয় যা খুবই পাষাণ!"

"মানে? এখন যদি আমি নীল পাথরটিকে ধারণ করতে চাই। করতে পারবো?"

আরিসা মাথা নাড়ালো।
"অবশ্যই! তোমাকে শুধু পাথরটি নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কিছু কথা বলতে হবে। এতটুকুই। তবে আমি সম্পূর্ণ সঠিকভাবে বলতে পারছি না কারন অনেক আগে যা হয়েছিল তাই আমি জানি। যাই হোক এসব জেনে আমাদের লাভ নেই।"

কায়েরীথ উঠে দাঁড়ালো। ক্ষুদ্র চোখ নিয়ে আবারো জিজ্ঞেস করলো,
"কথাগুলো যে বলতে হবে আপনি সেই কথাগুলো জানেন?"

রাজকুমারী আরিসা এবার কায়েরীথের কথায় একটু চমকে উঠলো। সন্দেহের সহিত মাথা নাড়িয়ে বললো,
"হ্যাঁ। কেনো?"

কায়েরীথ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আচমকাই খুব জোরে হাসতে লাগলো সে। আরিসা তো এই হাসি দেখে অদ্ভুতভাবে চেয়ে রইল। চোখ মুখ কুঁচকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই কায়েরীথ আরিসার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললো,
"আপনি এতো কিছু জানেন কিন্তু সেই বস্তুটা নিজের শরীরে ধারণ করেননি ভেবে খুব হাসি পেলো।"

"আমি কোনো লোভী না। আমাকে যা শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল তা নিয়েই বড় হয়েছি। আর হ্যাঁ তোমার তো কম স্পর্ধা না আমার উপর হাসছো। এজন্য তোমাকে শাস্তি পেতে হবে। যাও পুরো মাঠ দৌড়ে আসো।"

"হ্যাঁ?? এটা কিন্তু ঠিক না, রাজকুমারী!"

আরিসা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো কায়েরীথের দিকে। এদিকে উপায় না পেয়ে কায়েরীথকে দৌড় শুরু করতে হলো।
·
·
·
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp