তাবাসসুম ফ্রেশ হয়ে বসার ঘরে আসল। দেখল, মমতা বেগম, মুনায়া বেগম গল্প করছেন। তাদের পাশের সোফায় বসে শাফান ভাই টিভি দেখছেন। তাবাসসুম সবাইকে একবার খেয়াল করে, এগিয়ে গেল মমতা বেগমের দিকে। মমতা বেগম তাবাসসুমকে কাছে ডাকলেন।
“এদিকে আয় তো।”
তাবাসসুম মমতা বেগমের পাশে গিয়ে বসল। মমতা বেগম তাবাসসুমের থুতনিতে হাত রেখে বললেন—
“মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে, দেখেছিস? সারাদিন না খেয়ে আছিস৷ মা তো বকবেই। এখন এখানে চুপটি করে বস, আমি খাইয়ে দিচ্ছি তোকে৷”
মমতা বেগম উঠতে নিলে, মুনায়া বেগম তাকে আটকালেন। নিজে খাবার বেড়ে এনে, মমতা বেগমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন—
“আমার কথা কি সে শোনেন? নিজের যা ইচ্ছা তাই করছেন। আর কিছু বললেই, ভয় দেখাচ্ছেন ফুফুর বাড়ি চলে যাবেন আবার। আমি কি আটকিয়ে রেখেছি আপা? যাক। ভালো না লাগলে এখনই আপনাদের সাথে চলে যাক।”
মুনায়া বেগমের কন্ঠে স্পষ্ট মন খারাপের আভাস। মমতা বেগম হাসলেন এতে। তাবাসসুম মায়ের নিকট এসে গলা জড়িয়ে ধরে বলল—
“তুমি বললেই হলো নাকি? আমি ভাবছি আর যাবোই না ফুফুদের বাসায়। এখান থেকেই ভার্সিটি যাবো৷”
তাবাসসুমের কথায় শাফান আড়চোখে তাকালো তাবাসসুমের দিকে। মমতা বেগম কিছু বলতে নিলে, তাবাসসুম চোখ টিপে দিল। মমতা বেগম হাসলেন পুনরায়৷ মুনায়া বেগমকে বললেন—
“আর রেগোনা ভাবি। মেয়ে দেখো তোমাকে ছাড়া আর যাবেনা।”
“সত্যি মা আর যাবোনা।”
মুনায়া বেগম মেয়েকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বললেন—
“হয়েছে, হয়েছে। আমার জন্য তোমার আর এত কষ্ট করতে হবে না। ফুফুর বাড়িতেই থেকো। এখন যাও খেয়ে নাও।”
তাবাসসুম মুনায়া বেগমের গালে ফট করে একটা চুমু খেয়ে, মমতা বেগমের পাশে এসে বসে পড়ল৷ মুনায়া বেগম মৃদু হেসে চলে গেলেন সেখান থেকে। মমতা বেগম তাবাসসুমকে খাইয়ে দিতে শুরু করলেন।
শাফান তাবসসুমের থেকে চোখ ফিরিয়ে এবার টিভিতে মনোযোগ দিল। তৎক্ষনাৎ তার মনোযোগ চ্যুত হলো, কলিংবেলের শব্দে। শাফান ভ্রু কুঁচকে নিল।
মুনায়া বেগম রান্নাঘর থেকে আওয়াজ তুলে বললেন—
“তোহা দেখতো কে এসেছে।”
তাবাসসুম ফুফুর পানে একবার তাকালো। ঠোঁট উল্টে উঠে দাঁড়ালো। খাওয়ার সময় আবার কার এতো বিরক্ত করার প্রয়োজন পড়লো।
তাবাসসুম দরজা খুলে মুখের সামনে রুশানকে দেখে দুরে সরে আসলো৷ চোখ ছোট ছোট করে তাকালো রুশানের দিকে। মৃদু চেচিয়ে উঠে বলল—
“আপনি এখানে কেন?”
তাবাসসুমের মৃদু চিৎকারে মমতা বেগম আর শাফান তাকালো দরজার পানে। রুশান বোধহয় বিরক্ত হলো। এই মেয়ের সমস্যাটা কোথায়? সবসময় এমন চিল্লিয়ে কথা বলার দরকার কি? ফাজিল কোথাকার৷ রুশান দাঁতে দাঁত চেপে বলল—
“নিশ্চয়ই আপনার সাথে দেখা করতে আসিনি।”
তাবাসসুম মুখ ভেঙালো। রুশানকে দরজায় রেখে চলে আসলো আগের জায়গায়। রুশান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খেয়াল করল তাবাসসুমকে। ফাজির মেয়ে ভিতরেও ঢুকলে বললো না ওকে। অবশ্য এমন ঝগড়াটে, ক্ষ্যাপা হরিণীর থেকে কি বা আশা করা যায়।
মুনায়া বেগম রান্নাঘর থেকে জিজ্ঞেস করলেন—
“কে এসেছে রে?”
তাবাসসুম ত্যাড়া কন্ঠে বলল—
“তোমার বাবা এসেছেন?”
মুনায়া বেগম রান্নাঘর থেকে দৌড়ে বের হলেন। দরজার সামনে এসে দেখলেন রুশান দাঁড়িয়ে আছে৷ আটকে রাখা দম এতক্ষণে ছাড়লেন তিনি। তার বাবা মারা গেছেন আরও সাত বছর আগে। তার শ্বশুর মারা গেছেন তার বিয়েরও আগে। কিন্তু হঠাৎ মেয়ের মুখে 'তোমার বাবা আসছে' শুনে কেন যেন হঠাৎ মুনায়া বেগম থমকে গিয়েছিলেন।
মুনায়া বেগম মেয়ের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকানোর চেষ্টা করলেন৷ পারলেন না। তার বুকে একফালি কষ্ট উঁকি দিল। বাবার কথা হঠাৎ মনে পড়ল৷
মুনায়া বেগম রুশানের পানে তাকালেন এবার। ছেলেটার চোখে-মুখে কি যে মায়া! তাইতো বাবা বলে ডাকেন। মুনায়া বেগম হাসিমুখে বললেন—
“ভিতরে এসো বাবা।”
রুশান মৃদু হাসল। বলল—
“ভিতরে যাবো না আন্টি। আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।”
“বাইরে থেকেই কথা বলবে কেমন দেখায় বাবা? ভিতরে এসে বসো।”
রুশান ইতস্তত করে বলল—
“আসলে আন্টি একটু তাড়া ছিল, তাই ভিতরে যেতে চাচ্ছিলাম না। আপনি ভাড়ার টাকাটা রাখুন।”
রুশান হাত বাড়িয়ে টাকাটা দিল। মুনায়া বেগম বললেন—
“এত তাড়া ছিলনা বাবা। তোমার সমস্যা থাকলে এখন দেওয়ার প্রয়োজন নেই। রাখো তুমি।”
রুশান হাসি মুখে বলল—
“সমস্যা নেই আন্টি। বাবা পাঠিয়ে দিয়েছেন। আপনি রাখুন।”
মুনায়া বেগম টাকাটা নিলেন। বললেন—
“ভিতরে আসলে না।”
“অন্য একদিন আন্টি। আসি।”
রুশান চলে গেল। মুনায়া বেগম ভিতরে ঢুকলেন৷ ভিতরে আসতে মমতা বেগম চোখ ছোট ছোট করে বললেন—
“ছেলেটা কে ভাবি?”
“ওই দোতালায় নতুন ভাড়া এসেছে।”
“একা থাকে?”
“হ্যাঁ।”
“বিয়ে করবে না?”
তাবাসসুম ভাত চিবোতে চিবোতে বলল—
“তুমি কি আবার ঘটকালি শুরু করবে নাকি ফুফু? মোটেও করো না। এই ছেলে একদম ভালো না বলে দিচ্ছি। পুরোই বেয়াদব। অসভ্য লোক। জেনেশুনে কোনো মেয়ের কপাল পুড়িয়ো না।”
মুনায়া বেগম মেয়েকে ধমক দিলেন।
“চুপ কর। ওত ভালো ছেলেটার নামে কি বলছিস এসব?”
“ভালো না ছাই। কচু একটা। ফুফু আমি কিন্তু বলে দিচ্ছি, এই ছেলেকে যে মেয়ে বিযে করবে সেই মেয়ের কপাল পুড়বে। দেখে নিও।”
“আহা! তোহা।”
তাবাসসুম মুখ ভেঙালো। তার মায়ের কি দরদ ওই বেয়াদব ছেলেটার প্রতি। হুহ। ঝগড়াটে লোক একটা।
তাবাসসুম সোফা থেকে উঠে দাড়ালো। মমতা বেগমকে বলল—
“আমি আর খাবোনা ফুফু।”
বলেই হাঁটা ধরল তাবাসসুম। টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে পানি খেল। মমতা বেগমের কাছে এসে আঁচল দিয়ে মুখ মুছে নিজের ঘরের দিকে চরণ ফেলল। তাবাসসুম শাফানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শাফান গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন ছুড়ল—
“তুই ছেলেটাকে এতো চিনিস কিভাবে? খুব সুন্দর আচার-আচরণের দিক তুলে দিলি।”
তাবাসসুম মুখ বাকিয়ে বলল—
“বাড়িতেই তো থাকে শাফান ভাই। চিনবো না?”
“এত চেনার দরকার কি? ছেলেটার সাথে কথা বলিস?”
শাফান ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল। তাবাসসুম এবার রুশানের প্রতি রাগ প্রকাশ করে বললো—
“বলতে চাইনা শাফান ভাই। বলতে হয়। উনাকে দেখলে মুখ দিয়ে কথা আপনা-আপনি বের হয়ে যায়।”
শাফান শান্ত স্থির দৃষ্টিতে তাবাসসুমের রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে, শান্ত স্বরে আদেশস্বরূপ বললো—
“আর বলবি না কথা।”
“কেন?”
“আমি বলেছি তাই। তাছাড়া ছেলেটাকে সুবিধার মনে হলো না। বুঝতে পারছিস আমার কথা?”
তাবাসসুম মাথা নাড়ল। আচ্ছা বলে পুনরায় পা বাড়ালো নিজের ঘরের দিকে।
·
·
·
চলবে……………………………………………………