এত বড়ো ঝড় এই রাজ্যে এর আগে কখনো আসেনি বোধহয়। উতলা নদীর স্রোত। এই ধ্বংসাত্মক প্রকৃতি রাজ্যবাসীর কাছে নতুন। রানির কাছেও নতুন। আজকের ঝড়ে রানি কামিনীকাঞ্চনেরও বুকের জমিনে কত বড়ো বড়ো দুঃখ আছড়ে পড়লো। শুভ্র বসন বৃষ্টির জলে তার গা চেপে ধরেছিলো। রাজ পুরোহিত মন্ত্র অব্দি ভালো করে উচ্চারণ করতে পারছিলেন না। এমন প্রলয়ঙ্কারী বাতাস, বৃষ্টি সব ভুলিয়ে দিচ্ছে যেন।
রানির মাথার উপর আজ কোনো ছত্রছায়া নেই। তিনি নিজেই প্রত্যাখ্যান করেছেন ছত্রছায়া দেওয়ার প্রস্তাব। অন্ধকারে নদীর কূলটি বড়োই রহস্যময় লাগল। প্রদীপের আগুন ঝড়োয়া হাওয়ায় প্রায় প্রাণ ফুরিয়ে যাওয়ার মতন ক্লান্ত। আলো দিচ্ছে নামমাত্রই। নদীর কল্লোল ধ্বনি, ঝড়ের বেপরোয়া বাতাস আর পুরোহিতের উচ্চস্বরের মন্ত্র এক স্মৃতিচারণ করার মতন দৃশ্য তৈরি করল।
যেহেতু শিশুটির অন্তেষ্টিক্রিয়া করার জন্য কেউ নেই তাই সবটাই করছেন রানি। মন্ত্র উচ্চারণ করার সময় তার কণ্ঠের কম্পন বেশ ঠাহর করা যাচ্ছে। কাঁদছেন কি-না বুঝার উপায় না থাকলেও বেশ গাঢ় ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই বুঝা যাবে কতটা বিষাদ সেই কণ্ঠে।
অবশেষে সকল কার্য সম্পাদন করে শিশুটিকে ছোটো, শক্তপোক্ত কাঠের নৌকায় শুইয়ে, ভাসিয়ে দেওয়ার পালা এলো। পুরোহিত বললেন,
“রানি, এখন ওকে ভাসিয়ে দিয়ে অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করুন।”
রানির কান অব্দি সেই কথা যেন পৌঁছালো না। পৌঁছালেও তিনি সাড়াশব্দ করলেন না। রানির থেকে কয়েক হাত দূরেই দাঁড়ানো হ্যাব্রো৷ হ্যাব্রোর আরেক পাশে দাঁড়ানো হেমলক পিয়ার্স।
রানির আজকের অদ্ভুত আচরণ চোখ এড়ায় না কারো। মন্ত্রীমহোদয় তো বেশ বিরক্ত হলেন। বিড়বিড় করে বিরক্তিও প্রকাশ করলেন। কে জানে, কখন বজ্রপাত হয়! যদি গায়ে পড়ে বজ্রপাত? বাঁচবেন আদৌ? রানির না-হয় নিজের প্রাণের প্রতি মায়া নেই কিন্তু তার তো আছে।
রাজ পুরোহিত আবারও বললেন, “রানি, নদীর স্রোত বাড়ছে। শিশুটিকে এখুনি ভাসিয়ে দিতে হবে।”
রানির ঘোরগ্রস্থ দৃষ্টি। উন্মনা স্বরে বললেন, “হ্যাঁ?”
হ্যাব্রো এবার এগিয়ে এলো। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “রানি, শিশুটিকে নৌকায় রাখুন। ওর শেষ কাজটি সম্পন্ন করুন। নদীর স্রোত আরও বেড়ে গেলে তো সমস্যা হবে।”
রানি তাকালেন হ্যাব্রোর দিকে। আজ তার চোখে নেই কোনো হিংস্রতা। নেই ঐশ্বর্য। আছে কেবল পরম মায়া, বাচ্চাটিকে বুকে আগলে লাখার আকুতি। কিন্তু প্রকৃতির কাছে যে মানুষ মাঝে মাঝে বড়ো অসহায় হয়ে পড়ে! চাইলেও কি মৃত মানুষকে ধরে রাখা যায়? ক্ষমতাশালী রানিও প্রকৃতির নিয়মের কাছে অসহায় যে।
রানির চোখ জ্বলজ্বল করছে। কাছ থেকে বেশ বুঝা যাচ্ছে তিনি বহুক্ষণ কেঁদেছেন। চোখগুলো রক্তিম বর্ণ হয়ে আছে।
ছোটো ফুলে সজ্জিত নৌকাটিতে শিশুটিকে যত্নে রাখলেন রানি। যেন একটু হেরফের হলেই বাচ্চাটির ঘুম ভেঙে যাবে। কী নিষ্পাপ মুখটি!
রানি অস্ফুটস্বরে বিরবির করে উঠলেন। বললেন, “সৃষ্টিকর্তা, তোমার প্রতি আমার আরও একটি অভিযোগ জমা রইলো। আমি সব জমিয়ে রেখেছি। শোক, সুখ, দুঃখ। সব।”
এরপর ভাসিয়ে দেওয়া হলো দীর্ঘ নদীর বুকে নৌকাটি। স্রোতের তালে তালে, দুলতে দুলতে নৌকাটি গন্তব্য ধরল। হয়তো স্বর্গের দিকে। স্বর্গের সুন্দর ফুলটি সেখানটাই ফিরে যাচ্ছে।
রানি কাঁদলেন। খুব গোপনে। যেই কান্নাদের নিজস্ব শব্দ নেই, বর্ণ নেই। আছে কেবল এক বুক যন্ত্রণা, ব্যথা৷
৪০…..
রাজপ্রাসাদে আজ নীরবতা। কেউ ভুল করেও রা করছে না। রানির তীব্র শোককে তারাও সাদরে গ্রহণ করেছে। এই ঘটনায় প্রাসাদের দাস-দাসীর মনে একটি ধারনা ঠিক রোপণ করতে পারল। রানি যে হৃদয়হীনা নন তা সবার কাছেই আজ স্বচ্ছ। নয়তো একটি অজানা, অপরিচিত শিশুর জন্য এমন শোক কি করতেন তিনি?
প্রাসাদে আজ নিরামিষ রান্না হয়েছে। রাজপুত্র কিংবা রাজকন্যা গত হওয়ার পর রাজপ্রাসাদ শোক পালন করতে নিরামিষ খায়৷ আর রাজরানি খান দই, মিষ্টি। সেই নিয়মটিই মানা হলো শিশুটির বেলাতে। সে রাজপুত্র নয় তবুও তার বিদায় হলো জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে।
রানির ঘরের আলো ক্ষীণ৷ কেদারায় বসে ঢুলছেন তিনি। আজ মদ্যরসও পান করেননি৷ শিশুর মৃত্যুর পর কোনো মাতাই তো মদ্যরস পালন করতে পারেন না। রানিও করবেনই বা কীভাবে?
“সখী, আহার করবে না? কাল থেকে এ অব্দি কিছুই তো খেলে না। দুর্বল হয়ে যাবে তো।”
যামিনীর আগমন ও কথাতেও হেলদোল হলো না রানির। তিনি এক চিত্তে ভাবতে লাগলেন কত কী।
যামিনী আবার ডাকলো, “সখী, আহার করবে আসো।”
রানির ধ্যান ভাঙলো। ছোটো স্বরে বললেন, “পরে খাবো, সখী। বাঁচতে যেহেতু হবে, খাবো। কিন্তু এখন না।”
যামিনী এসে রানির কাছটায় বসলো। ফ্রেয়া দাঁড়িয়ে রইলো দূরে দাঁড়িয়ে। রানির এই মূর্ছা যাওয়া ফ্রেয়াকে ব্যথিত করেছে বাকি সবার চেয়েও বেশি। সে আসার পর তো রানির এমন রূপ কখনো দেখেনি। এই নতুন রূপ অবশ্য রাজ প্রাসাদের সকলের কাছে অভাবনীয়। যে নারী গর্দান নিয়ে নেন হাসতে হাসতে, তিনি এতটা শোকেও ডুবতে জানেন কেউ ভাবতে যেন পারেনি।
“সখী, আমি জানি শিশুটির প্রাণ হারায় তুমি বড়ো যন্ত্রণা পেয়েছো। কিন্তু জন্ম, মৃত্যু সবই তো বিধাতার হাতে। আমি খাবার নিয়ে আসি কেমন?”
রানি কথা বললেন না। চুপ করে রইলেন। তার বোধহয় কথা বলতে ভালো লাগছে না।
তখনই হ্যাব্রো এলো অনুমতি নিয়ে। হ্যাব্রো আসতেই বেরিয়ে গেলো যামিনী। তাকে বলারও প্রয়োজন হয়নি বের হওয়ার কথা। যামিনী যেতেই হ্যাব্রো মাথা নত অবস্থায় বলল,
“রানি, বিশেষ জায়গায় যেতে হবে। সেখানে কিছু সমস্যা হয়েছে।”
রানি কিছুটা কপাল কুঁচকালেন। দাঁড়িয়ে গেলেন তৎক্ষণাৎ। দায়িত্বের কাছে তার শোক চাপা পড়ে গিয়েছে। বললেন, “কী হয়েছে?”
“গেলেই বুঝবেন।”
“এখুনি চলো।” কথা সমাপ্ত করে রানি আর অপেক্ষা করলেন না। মাথার সাদা ওড়নাটি ভালো করে জড়িয়েই ছুটে গেলেন বাহিরে। হেমলক তখন রানিকে দেখার জন্যই কক্ষে আসছিলো কিন্তু হন্তদন্ত হয়ে রানিকে বেরিয়ে যেতে দেখে আর এলো না। বরং ভ্রু কুঁচকিয়ে অবস্থা বুঝার চেষ্টা করল।
••••••••••
গাঢ় গুমোট অন্ধকারে ধিক্ ধিক্ জ্বলছে মশাল। মশালের আগুন একদম স্থির৷ কারণ এখানে আলো, বাতাস প্রবেশ করার কোনো পথই নেই। কোনো সাধারণ মানুষ এলে চমকে যাবে। ভাববে নরকের দরজা হয়তো এদিকটা থেকেই শুরু।
রানির পায়ের নূপুরের রুনুঝুনু শব্দ কেবল প্রাচীরের চারপাশটায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। আর থেকে থেকে একটি কর্কশ কণ্ঠের হাসি ভেসে আসছে।
রানি হ্যাব্রোর দিকে তাকালেন। বিস্ময় নিয়ে বললেন,
“কী ব্যাপার? এর মাথা কি নষ্ট হয়ে গিয়েছে?”
“জানি না। কিন্তু কাল থেকেই এমন করছেন।”
রানি ধপধপ করে এগিয়ে গেলেন। লোহার শিক লাগানো দরজাটা খুলে দিলো হ্যাব্রো। রানি সেখানটায় প্রবেশ করতেই দেখলেন মধ্য বয়স্ক লোকটি পাগলের মতন হাসছে। লোহার শিকলে তার হাত-পা বাঁধা থাকলেও ঠোঁটে হাসি।
রানি গিয়েই গরম লোহার রডটা নিয়ে লাগিয়ে দিলেন পুরুষটির শরীরে। তীব্র আর্তনাদে বন্ধ হয়ে গেলো লোকটির হাসি।
এবার হাসলেন রানি। ক্রুর স্বরে বললেন, “হাসুন। আরও জোরে হাসুন। আমিও শুনি কতটুকু হাসতে পারেন।”
ভদ্রলোক তীব্র আর্তনাদ বন্ধ করে সত্যি সত্যি রানিকে অবাক করে হেসে উঠলেন। এরপর এক দলা থুতু ফেললেন। বিজয়ী স্বরে বললেন,
“অহংকারী রানি, তোর রাজ্য ধ্বংস হবে। গণনা শুরু কর৷ তোর রাজ্যে প্রলয় ঘনিয়ে এসেছে৷ তুই কেবল দেখে যাবি কিন্তু কিচ্ছু করতে পারবি না। তোর রাজ্য শেষ। শেষ তুই।”
রানি থমকে গেলেন। এর আগে এই কর্কশ কণ্ঠ কখনো রানির সামনে ধ্বনি করেনি আকুতিময় কান্না ছাড়া। অথচ সেই কণ্ঠ আজ এত বুক উঁচিয়ে কথা বলছে? এত জোর কোথা থেকে এলো তার?
·
·
·
চলবে…...............................................................................