মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ০৬ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


          সন্ধ্যার নরম আলো ধীরে ধীরে মাঠটাকে ঢেকে নিয়েছে। অনন্যা মাঠের এক কোণায় নিরবে নির্বিঘ্নে বসে আছে। কোলের ওপর রাখা বিকেলের খাবারের প্যাকেটটা এখনো খোলা হয়নি। চোখে একরাশ অপেক্ষা। আর মনটা ছুটে চলেছে কৌশিক স্যারের খোঁজে। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, স্যার আসছেন না। বিল্ডিংয়ের দরজার দিকে বারবার তাকিয়ে থেকেও তার দেখা মেলে না। অনন্যার কিছুই ভালো লাগছে না। ক্ষুধা পেটের ভেতর ছটফট করছে। তবু এখনই খেতে ইচ্ছে করছে না। এই একাকী সন্ধ্যায় বসে থাকা ধৈর্যের এক কঠিন পরীক্ষার সমান।

মশারা একটু আগ পর্যন্ত উৎপাত করছিল। তবে দূর আকাশের ঘনঘটা কালো মেঘগুলো কয়েক বার ঘন আওয়াজে গর্জে উঠতেই মশাগুলো হঠাৎ যেন উধাও হয়ে গেল। যাক ভালোই হলো। এই বজ্রপাতের জন্য অনন্যা মশার আঘাত থেকে বেঁচে গেল। কিন্তু যার জন্য বসে থাকা তিনি তো আর আসছেন না। এখন বৃষ্টি পড়লে আবার এক এলাহি কাণ্ড হয়ে যাবে অনন্যার জন্য।‌

মাঠের চারপাশে আলো কমে আসছে, ঠান্ডা হাওয়া বইছে। অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলো বের হওয়ার পথের দিকে। অতঃপর আবারো পেছনে ফিরে তাকালো সে। কিন্তু কিছুই মনে না হওয়াই ঘুরে আবারও হাঁটতে শুরু করলো। কিছুদূর হাঁটতে হাঁটতে মেইন রোডের সামনে এসে দাঁড়ালো অনন্যা। এখন একটা রিকশা নিয়ে বাসায় চলে যাবে।

অনন্যা টিউশনি ছেড়ে দিয়েছে অনেক দিন হয়ে যাবে। এমনিতেও স্টুডেন্টের অভিভাবক অনন্যার কয়েক দিন পর পর অসুস্থ হয়ে যাওয়া পছন্দ করছিলেন না। তাছাড়া কৌশিক স্যার চলে যাওয়ার পর অনন্যার মানসিক অবস্থা ও করুণ হয়ে পড়েছিল যার কারণে বাধ্য হয়েই ছেড়ে দিয়েছে এই টিউশনি। এখন সবকিছু করতে কেমন যেন আলসেমি লাগে এখন অনন্যার। টাকা পয়সার চিন্তা নেই। সামনে কি করবে তা নিয়েও ভাবনা নেই। মানুষের ফিউচারের চিন্তা থাকে অনন্যার মন থেকে এখন তাও উধাও হয়ে গেছে। সামনের দিন কি করে চলবে তা নিয়েও ভাবনা নেই। বাবা কিছু টাকা পাঠিয়েছে তা দিয়েই চলছে। যদিও কতদিন চলবে তা নিয়েও ভাবেনি অনন্যা।

চোখের সামনে দিয়ে ভরা ভরা রিকশা চলে যাচ্ছে। বৃষ্টি পড়বে এই ভেবে সবাই তাড়াতাড়ি তাড়াতাড়ি করছে। অনেকক্ষণ পর একটা খালি মিশুক আসতে দেখে দ্রুত ডেকে বসলো অনন্যা। কিন্তু পেছন থেকে আরেকজন ও ডাকলো সেই মিশুককে। পরিচিত সেই কণ্ঠস্বর! অনন্যার বুক ধ্বক করে উঠলো। সত্যিই কী সে? তা নিশ্চিত করতেই পিছনে ফিরে তাকালো অনন্যা। বুকে বাতাস ফিরে এলো যখন দেখলো হ্যাঁ কৌশিক স্যার। আহ! মনের ভিতর এক গুচ্ছ প্রজাপতি উড়ে গেল।

কৌশিক স্যার অনন্যার পাশে এসে দাঁড়ালেন। চোখ ঘুরিয়ে ঠিকমতো দেখলেন ওকে। অতঃপর বললেন,
"আপনি আমার স্টুডেন্ট না? এতো সন্ধ্যায় কেনো বাড়ি ফিরছেন?"

অনন্যা হাসার চেষ্টা করে বললো,
"আমার হাসবেন্ডের অপেক্ষা করছিলাম।"

কৌশিক আশেপাশে খুঁজে দেখে বললো,
"তো কোথায় সে?"

"আসেনি।"
অনন্যা মাথা নিচু করলো।

"ঠিক আছে। বাসায় যান তাড়াতাড়ি। বৃষ্টি পড়বে মনে হচ্ছে। ‌"

অনন্যা হাত নাড়িয়ে বললো,
"না না। আপনি যান। আমি দেখি অন্য কিছু পাই কিনা।"

"না আপনি যান। আমি পরেরটার জন্য অপেক্ষা করবো।"
কৌশিক সামনে তাকিয়ে উঠে যাওয়ার জন্য ইশারা করলো। 

"না, স্যার। আমার জন্য আপনাকে কষ্ট পোহাতে হবে না। আপনি চলে যান আমি পরেরটা নিয়ে বাসায় যাব।"

কৌশিক কিছুক্ষণ চুপ ছিল। আচমকা হাত ভাঁজ করে অনন্যার দিকে ঘুরে বললো,
"মিস অনন্যা শিকদার!"

অনন্যা দ্রুত বলে উঠলো,
"মিসেস!"

"ইয়াহ, অনন্যা শিকদার। আপনাকে বলছি তো উঠুন তারপরও এতো কথা কেনো বলছেন আপনি?"

মিশুকটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের কথার তর্কে পড়ে গিয়ে মিশুক চালক বেশ বিরক্ত হলো। বিরক্ত গলায় বলে উঠলো,
"আপনারা উঠতাছেন, না আমি অন্য কাস্টমার খুঁজমু?"

অনন্যা দ্রুত স্যারের দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলে উঠলো,
"স্যার , উঠুন বলছি।"

থতমত খেয়ে গেল কৌশিক। কয়েক বার পলক ফেলে তাকালো অনন্যার দিকে। তারপর মুখে কিছু না বলে উঠে গেলো মিশুকে। অনন্যা সামনে দুই পা এগিয়ে বললো,
"সরুন। "

কৌশিক চমকে উঠলো। চোখে ধরা পড়লো বিস্ময়। মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে গেলো,
"হ্যাঁ! কেন?"

অনন্যা কোনো উত্তর না দিয়ে মিশুকে উঠে গিয়ে বসে পড়লো। কৌশিক বাধ্য হয়ে সরে গেলো তার পাশ থেকে।
অনন্যা বসেই একটুখানি শান্তির শ্বাস ফেললো। তাকে দেখে মনে হলো জয় করেছে সে। হ্যাঁ, না শুরু করা কোনো যুদ্ধ জয় করে ফেলেছে আজ একদম। ঠিকমতো বসে স্যারের দিকে তাকিয়ে হালকা এক মিষ্টি হাসি ছুঁড়ে দিলো সে। কৌশিকের মুখটা তখন দেখার মতো হয়ে উঠেছিল। সে কিছু বলতেও পারছে না, সইতেও পারছে না। চোখেমুখে ধরা দিলো বিস্ময়, বিরক্তি আর কোথায় যেন এক বিনা শব্দে হেরে যাওয়ার স্বাদ।

মিশুক চালক জিজ্ঞেস করলো,
"কোই যাইবেন আপনেরা?"

কৌশিক সোজা হয়ে বসে ছিল। অনন্যাই কৌশিকের দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করল,
"আপনার বাসা কাছে ?"

"না। অনন্যা শিকদার, আপনার লোকেশন বলুন।"

"সমস্যা নেই। আপনি বলুন। পরে আমি মিশুক ঘুরিয়ে বাসায় যাবো।"

কৌশিকের এবার তো প্রচন্ড রাগ হলো। সেও ধমকে উঠলো,
"তাড়াতাড়ি তোমার লোকেশন জানাও।"

অনন্যা দ্রুত কৌশিকের দিকে তাকালো। স্যারের ক্রোধিত দৃষ্টি দেখে ঢোক গিলে নিজের বাসার লোকেশন জানালো সে। মিশুক চালক সেই স্থানেই গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো।

বাইরের আবহাওয়া ধীরে ধীরে খারাপ হচ্ছে। ঘন ঘন মেঘ ডাকছে। কৌশিক মিশুকের একদম ডান পাশে চেপে বসে আছে। অনন্যা ইচ্ছে করেই বেশি জায়গা নিয়ে বসেছে। ওর বেশ মজা লাগছে স্যারকে জ্বালাতে। কৌশিক অনন্যার হাতে খাবারের প্যাকেটটা দেখে চমকে বললো,
"এখনো এটা খাননি আপনি?"

অনন্যা প্রথমে বুঝতে পারেনি। পরক্ষণেই প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে বললো,
"ওহ এটা! হ্যাঁ, তখন খিদে ছিল না। তাছাড়া বললাম না হাসবেন্ডের অপেক্ষায় ছিলাম তাই!"

"আপনার হাসবেন্ড কি করে?"

অনন্যা ঘুরে কৌশিকের চোখের দিকে তাকালো। কৌশিক ও সেই সময় ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ চোখ পড়ায় দুজনে ই খেই হারিয়ে ফেললো। একে অপরের দিকে স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুটা সময় । চোখের পলক পর্যন্ত পড়ছিল। কেনো যেনো কৌশিক ও চোখ সরাতে পারছিলো না। মনে হচ্ছিল এই চোখে সে বারবার তাকাতো! বারবার হারাতো! খুবই চেনা দুটি চোখ! কিন্তু তাও কেনো অচেনা? দুজনের চক্ষুদ্বয় যখন দুজনাতে স্থির ঠিক তখনই ঝপ ঝপ করে বৃষ্টি নামলো‌ এই ভুবনে। ভিজিয়ে দিলো চারপাশ‌। বৃষ্টির ছিটে এসে ভিতরে এসে লাগলো। বৃষ্টির ফোঁটা গুলো ছেচড়ার মতো লেগে বসলো দুজনের শরীরে এবং মুখমন্ডলে। কৌশিক দ্রুত চোখ সরিয়ে ফেললো। হঠাৎ বুঝতে পারলো কি বড় ভুল করতে যাচ্ছিলো সে। মাথাটা আচমকাই খুব গরম হয়ে গেলো। মন চাইছিল এখনি মিশুক থেকে নেমে গিয়ে নিজের পথে হাঁটা দিতে। কিন্তু যা বৃষ্টি নেমেছে এই বৃষ্টিতেও তো তাও অসম্ভব। 

মিশুকচালক বললো পাশ থেকে পর্দা নামিয়ে নিতে। অনন্যা আগ বাড়িয়ে নিজের পর্দা নামিয়ে নিলো। কিন্তু কৌশিক স্যারের এই দিকে কোনো খেয়াল নেই। তিনি আছেন নিজের খেয়ালে। তাই অনন্যাই সামনে ঝুঁকে উনার সাইডের পর্দা নামিয়ে দিলো। আবারো কাছাকাছি পড়ে গেলো দুজনে। কৌশিক বুঝতে পেরে দ্রুত পাশে সিটিয়ে গেলো। কড়া গলায় বলে উঠলো,
"আমাকে বললেই হতো। নামিয়ে দিতাম। কাছে ঘেঁষাঘেঁষি করছেন কেনো?"

অনন্যা দ্রুত সরে এলো। মাথা নিচু করে বললো,
"পাশে ঘেঁষাঘেঁষি নয়! আপনার শরীরে বৃষ্টি যাতে না লাগে তাই নামিয়ে দিচ্ছিলাম অথচ আপনি!"

কৌশিক আর কিছু বললো না। এই মেয়েটির সাথে সে আর কথা বাড়াতে চাইছে না। একটু আগের ঘটনার পর নিজের উপর মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার। কি করে একটা বিবাহিত মেয়ের দিকে এমন করে তাকিয়ে থাকতে পারলো সে? নিজের বিবেকের উপর নিজেরই সন্দেহ হচ্ছে এখন।

অনন্যা ব্যাগটা সামনে নিয়ে ঠিক হয়ে বসলো। ফোন বের করতে করতে বললো,
"আমার হাসবেন্ড একজন প্রফেসর!"

পরমূহুর্তেই কৌশিক প্রশ্ন করলো,
"সেদিন রাস্তায় আপনিই ছিলেন তাই না? আপনিই তো বলছিলেন আমি আপনার হাসবেন্ড। এতো বড় ভুল কি করে করলেন আপনি? "

অনন্যা ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
"আমার হাসবেন্ডের নাম ইশতেহার কৌশিক!"

থমকে গেলো কৌশিক। কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। একসময় বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলো সে। কঠোর গলায় বলে উঠলো,
"আই ডোন্ট নো আপনার সমস্যা কি! সেদিন থেকেই আপনি আমার পেছনে লেগে আছেন তাই না? আচ্ছা কি চাই আপনার? কি লাগবে?"

অনন্যা মুচকি হেসে ফোনের গ্যালারিতে থাকা একটা ছবি বের করলো। তারপর কৌশিকের চোখের সামনে ধরে বললো,
"বিশ্বাস হচ্ছে না, স্যার?"

কৌশিকের চোখ মুহূর্তে বড় হয়ে গেলো। ছবির দিকে তাকিয়ে সে হঠাৎ থমকে গেলো। ছবিটায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একটি ভরা অনুষ্ঠান চলছে। চারপাশে অনেক মানুষ। ঠিক তার মাঝেই অনন্যার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে কৌশিক। আর কৌশিকের হাত আলতো করে জড়িয়ে আছে অনন্যার গলায়। নিখাদ ভালোবাসায় ভরপুর ছিল ছবিটি। কিন্তু কৌশিকের চোখে এই ছবিটি এক প্রকার আতঙ্কের প্রতিচ্ছবি। তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল ছবির উপর। আর ঠিক তখনই মিশুক আচমকা ব্রেক কষে থামলো। সম্বিৎ ফিরে পেলো সে।

মিশুক চালক বলে উঠলো,
"আইসা পড়ছি। নামেন এহন!"

অনন্যার মুখে এখনো হাসি লেগে আছে। কৌশিক কাঁপা হাতে ফোনটা হাতে নিলো। সে নিঃসন্দেহে বলতে পারবে ছবিটিতে থাকা লোকটি অন্য কেউ! কিন্তু তার মতো দেখতে এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বিস্ময়ের কারণ! কৌশিক কয়েকটি ফটো আরো দেখতে পেলো। এটা সত্যিই সে! কিন্তু তাও সে নয়! 

অনন্যা মৃদু হেসে বললো,
"এটাকে কি বলবেন, স্যার? কীভাবে অস্বীকার করবেন এই ছবিকে? আচ্ছা এখন যদি আমি বলে দেই আপনি ইশতেহার কৌশিক স্যার নন! তখন?

কৌশিক কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকলো। তারপর মিশুক থেকে বেরিয়ে এলো ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে অনন্যার দিকে তাকিয়ে বললো,
"নামুন।"

অনন্যার ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে গেলো। সে বুঝতে পারছিল না এই লোকটা কি করতে চাইছে। তাও নামলো সে। বৃষ্টির ফোঁটা দুজনের শরীরে পড়ে ভিজিয়ে দিলো তাদেরকে। কৌশিক আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে দ্রুত বলে উঠলো,
"আপনার বাড়ি কোথায়?"

অনন্যা সামনে ইশারা করে নিজের বিল্ডিংটা দেখিয়ে দিলো। কৌশিক সেদিকে হাঁটা ধরলো দ্রুত। ওদের সামনে দিয়েই মিশুকটা ছুটে চলে গেলো। অনন্যাও চিন্তিত হয়ে কৌশিকের পিছু পিছু হাঁটতে লাগলো। নিজের বিল্ডিংয়ের নিচে এসে ভিতরে ঢুকে গেলো তারা। কয়েক কদম এগিয়ে কৌশিক পিছনে ঘুরে দাঁড়ালো। অনন্যা তখনও চিন্তিত হয়ে এগিয়ে আসছে। কৌশিক স্যারের কাছে এসে দাঁড়ালো শেষমেশ। বিল্ডিংয়ের ভিতরে নিচ তলায় অন্ধকার স্থানে দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। 

অনন্যা বলে উঠলো,
"এখানে আমরা ভাড়া থাকি। এই বিল্ডিংকে হোটেলের মতো বলা যায় কিছুটা।"

"আপনার কাছে কি প্রমাণ আছে আমি ইশতেহার কৌশিক না?"

অনন্যা হাসলো। কৌশিক স্যারের সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে খুব ভালো লাগছিল তার। সে কিছুটা কাছে এগিয়ে কৌশিক স্যারের বরাবর দাঁড়িয়ে বললো,
"অবশ্যই প্রমাণ আছে। কারণ আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না। এর থেকে বড় প্রমাণ কি লাগবে? আর সবথেকে বড় অমিল কি জানেন? আপনার চোখ দুটো! কৌশিক স্যারের চোখের মণির কাছে আপনি প্রথমেই হেরে যাবেন। কারণ এই জীবনে প্রথমবার আমি সে চোখ দুটোয় নিজেকে হারিয়েছি। "

"কেউ বিশ্বাস করবে না আপনাকে! বাসায় যান। খাবার খান। ঘুমিয়ে পড়ুন। আর দুঃস্বপ্ন মনে করে ভুলে যান।"

কৌশিক পিছন ফিরে হেঁটে বেরিয়ে যেতে লাগলো। অনন্যা বলে উঠলো,
"দুঃস্বপ্ন নয়। আমি যাকে ভালোবেসেছি সে দুঃস্বপ্ন হতে পারে না। সে আমার জীবনের সাথে জুড়ে গেছে। আর ভুলে যাওয়া তা তো কখনোই সম্ভব না। স্যার! আপনি যদি কৌশিক স্যার হয়ে থাকেন প্রমাণ দিতে পারেন। যদি সঠিক প্রমাণ দেন তাহলে তাহলে!"

অনন্যা মাথা নিচু করে চিন্তা করতে লাগলো। অতঃপর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলে ফেললো,
"আমি আপনাকে বিরক্ত করবো না। কারণ আমার বিশ্বাস নিজের ওয়াইফকে পেয়ে আমার প্রিন্স এরকম আচরণ করতে পারে না। সে আমাকে এতো দ্রুত ভুলে যেতে পারে না। তাই তাই!"

কৌশিক হেসে ফেললো। অনন্যার কাছে এগিয়ে এসে মেয়েটার কাঁধে হাত রেখে মাথা হেলিয়ে তাকালো। স্যারের চোখের সামনে থাকা চুলগুলো থেকে টিপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। কেমন অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল তাকে। থমকে গেলো অনন্যার শরীর। কথাগুলো গলায় আটকে গেলো। বেরিয়ে আসতে চাইলো না। এই হাসি, এই চেহারা, এই সৌন্দর্য এসব কিছু কেনো এই লোকটার মধ্যে থাকবে। এই সবকিছু শুধু একজনের মধ্যে থাকতে বাধ্য। কিন্তু কেনো আরেকজনের মধ্যেও একি বিষয় সে লক্ষ্য করে যাবে?

কৌশিক বললো,
" ইউ আর কনফিউজড। রাইট?"

অনন্যার চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় হলো। এই লোকটা কি করে জানালো?

কৌশিক আবারো বললো,
"ওকে, টেক ইউর টাইম। আমি আপনাকে প্রমাণ করবো আমিই সেই পুরোনো কৌশিক। কিন্তু সরি ফর ইউ! আমি আপনার হাসবেন্ড হতে পারবো না। কারণ আমার বিশ্বাস আমার এখনো কারো সাথে মনের মিল হয়নি।"

"আপনি কি বলছেন আমি বুঝতে পারছি না। যদি আপনি পুরোনো কৌশিক স্যার হয়ে থাকেন আপনাকে আমার হাসবেন্ড ও হতে হবে।"

"হ্যাঁ। জানি। আমি আপনার ট্রিকস বুঝতে পেরেছি। কিন্তু সেটা সম্ভব না। কারণ আমি পুরোনো কৌশিক স্যার টিচার হিসেবে! কিন্তু আপনার হাসবেন্ড হিসেবে নই। "

"তাহলে প্রমাণ দেখিয়ে লাভ নেই। আমি আপনাকে কোনোমতে বিশ্বাস করবো না।"

"তাহলে আমার জন্য সহজ হলো। আমার ইন্টারেস্ট ও নেই আপনার উপর আর না আপনার কথার উপর। এই দুনিয়া আপনার কথায় বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস করবে তারা যা দেখছে তার উপর। এই দুনিয়া হয়তো ভুলেও গেছে পুরোনো কৌশিকের চোখের মণি অন্যরকম ছিল। এই দুনিয়া নিশ্চয়ই জানে না আপনি উনার হাসবেন্ড! রাইট? কীভাবে বুঝলাম? বোঝাই যায়, অনন্যা শিকদার! তাই ডোন্ট ডিস্টার্ব মি। নিজের পথে চলুন। ভালো থাকুন। আমার পথে এসে আমাকে পথভ্রষ্ট করবেন না। "

কৌশিক বেরিয়ে গেলো। অনন্যা নড়তে পারছিল না। সত্যি বলতে সে ভীষণ কনফিউজড। একবার মনে হচ্ছে ইনিই সেই কৌশিক স্যার পরমূহুর্তেই মনে হচ্ছে না, ইনি হতে পারে না। কৌশিক স্যার ওর সাথে এমন ব্যবহার তো কখনোই করতে পারে না ‌। কিন্তু যদি সত্যিই ওনার স্মৃতি চলে গিয়ে থাকে এটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু উনি সেই মানুষটি নন। ওনার রূপ পরিবর্তন হয়েছে। অনন্যা নিজের চুল টেনে ধরলো। কি হচ্ছে টা কী? কোনটা বিশ্বাস করবে অনন্যা?

******

কৌশিক বৃষ্টিতে ভিজে চুপচাপ বাড়ি ফিরেছে। ওর কালো শার্ট, প্যান্ট ভিজে চুপচুপে অবস্থা। চুল থেকে পানি টপটপ করে পড়ছে। তবুও ছেলেটার চেহারায় কোনো অস্থিরতা নেই। চোখে শুধু গভীর চিন্তা আর চিন্তা যা থামার কোন নাম নেই।  

অনন্যা মেয়েটা হঠাৎ করেই ওর জীবনের গতি অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। সে কি সত্যিই তার হাসবেন্ড?
এই প্রশ্নটা মাথার ভেতর শিলার মতো ভারী হয়ে পড়ে আছে। যদি সত্যিই হয় তাহলে? তাহলে কি তাকে এই সম্পর্কের দায় স্বীকার করেই নিতে হবে? কিন্তু কীভাবে সম্ভব? যদি কৌশিক এই চাকরিকে স্বীকার করে নেয় তাহলে তো অনন্যার দেখানো প্রমাণ অনুযায়ী ওকেও স্বীকার করতে হয়। এসব আজগুবি চিন্তার ভারে মাথাটা ফেটে যাচ্ছে কৌশিকের। বৃষ্টির জলে ভেজা শরীরটা যতটা ঠান্ডা হয়ে কেঁপে উঠছে তার ভেতরের অস্থিরতা ঠিক ততটাই দগদগে।

বাসায় ঢুকতেই হঠাৎ চারদিক থেকে চেঁচামেচি আর উচ্ছ্বাসে ভরে উঠলো ঘরটা। মা, ভাই সবাই খুশির জোয়ারে ভাসছে। ছেলে চাকরি পেয়েছে। এই আনন্দে সারা বাড়ি আজ সাজানো হয়েছে। আলো ঝলমলে ঘরের উষ্ণতা আর পরিবারের উল্লাস সবই ছিল স্বস্তির জন্য উপযোগী। তবুও কৌশিকের বুকের ভার এক বিন্দুও হালকা হলো না। সে হাসার চেষ্টা করলো পুরোটা সময়।

সোফার সামনে টেবিলের উপর বড় একটা চকলেট কেক রাখা হয়েছে। কেকের উপরে সাদা ক্রিমে যত্ন করে লেখা "Happy First Day in Job"। কৌশিক হেসে ফেললো নিঃশব্দে। পরিবার কৌশিকের কাছে অপরিচিত হয়েও যেন কতটা আপন ওর কাছে। 

মোমবাতিতে আগুন জ্বলছে। মেহজাবিন বেগম আর নুহাশ দুজনেই বলছে মাঝে থাকা মোমবাতিতে ফুঁ দিয়ে কেক কাটা সম্পন্ন করতে। কৌশিক মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। নিচু হয়ে মোমবাতিতে ধীরে ধীরে ফুঁ দিলো।
আলোর ক্ষীণ নাচন থেমে গেল। নিভে গেল শিখা। তারপর ছুরি হাতে কেক কাটলো সে। প্রথম টুকরো মেহজাবিন বেগমের মুখে তুলে দিলো, তারপরের টুকরো নুহাশকে। মুখে কেক নিয়ে হঠাৎ করতালিতে মেতে উঠলো দুজনে‌। 

কৌশিক দুহাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। কপালে এক চুমু এঁকে দিলো।
নরম কণ্ঠে বললো,
“থ্যাংকস মা!”

আজ সন্ধ্যেটা ছিল একেবারে উৎসবের মতো। ঘরের প্রতিটা কোণ ভরে উঠেছিল মনকাড়া সুগন্ধে। মেহজাবিন বেগম কাজের মেয়েটার সঙ্গে মিলে কৌশিকের পছন্দের সব খাবার রান্না করেছিলেন। টেবিলে সাজানো ছিল পোলাও, রেজালা, চিংড়ি মালাইকারি আর মিষ্টি দই। এসব খাবার চোখে দেখে যে কারো জিভে জল আসবে।

কিন্তু কৌশিকের মুখে তেমন কিছুই তোলার ইচ্ছা হলো না। খাবারের ঝালটা বাড়িয়ে দিয়েছিল কৌশিকের অস্বস্তি আর খাবারের প্রতি অনীহা। প্রতিটা খাবার মুখে তোলার পর ওর মন বলছিল এই খাবার তার পছন্দের নয়। মনে হতে লাগলো অন্য কারো পছন্দকে জোর করে তার মুখে গুঁজে দেওয়া হয়েছে। বলে দেওয়া হয়েছে তার পরিচয় এটা, তার পছন্দ এটা, তার ফ্যামিলি এটা। কিন্তু মাঝেমধ্যে কোনোকিছুই কৌশিকের আপন মনে হয় না। সে শুধু সবকিছু নিজের মধ্যে আপনানোর চেষ্টা করে। এছাড়া এসবকে আর কিছুই বলা যায় না।

খাওয়াদাওয়া শেষে নুহাশের সাথে হালকা আড্ডা দিয়ে উঠে এলো কৌশিক। নিজের ঘরে এসে বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। শরীর বিশ্রাম চাইলেও মন উল্টোদিকে হাঁটছে। কিন্তু অনেক কাজ বাকি আজ। লেকচার রেডি করতে হবে শিক্ষার্থীদের জন্য। আজ একটা মিটিং হয়েছে। সেই মিটিংয়ে বলা হয়েছে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে ক্লাসে মনোযোগী হতে সাহায্য করতে হবে। এজন্য লেকচার শীট, পিডিএফ সবকিছু সুন্দরমতো সাজানো গোছানো চাই। 

কৌশিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুই ঘণ্টার জন্য এলার্ম দিয়ে চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করলো। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পূর্বে চোখের সামনে বসে থাকা অনন্যা শিকদারের প্রতিটা কথা মাথায় কাঁটার মতো বিঁধছে। আর তখনকার অনুভূতিটাও অদ্ভুত ছিল। মনে হচ্ছিল কৌশিকের শরীরের আত্মা একদিকে হাঁটছে আর দেহ! দেহ অন্যকিছু করতে চাইছে। কৌশিকের হৃৎপিণ্ড অনন্যার জন্য কাজ করছে না, অনন্যার জন্য অনুভব করছে না। কিন্তু ওর অন্তর সেই কবেই অনন্যার নামে বিলীন হয়ে গেছে।

সর্বশেষ, কৌশিকের মস্তিষ্কে কয়েকটি প্রশ্ন এসে বারি খাচ্ছে,
"কে আমি? কি আমার পরিচয়? আমার স্মৃতি কেনো পুরাতন দিনের? আমার সত্যি কে জানে? কে পারবে আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে সঠিক উত্তর দিতে?"
·
·
·
চলবে.................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp