অন্তর্নিহিত কালকূট - পর্ব ১১৪ - অনিমা কোতয়াল - ধারাবাহিক গল্প


          রাত তখন আড়াইটা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শীতকালে আড়াইটা অনেক রাত। তাজওয়ারদের সেই অফিসরূপে ঝিম ধরা নীরবতা। পলাশ মীর্জার নিয়ে আসা ভয়ংকর সেই খবর শোনার পর মারাত্মক প্যানিক করে বসে ওরা সবাই। উত্তেজিত অবস্থাতেই পরপর কল করে কয়েক জায়গায়। তবে বিশেষ কোন লাভ হয়না। সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে ততক্ষণে। প্রত্যেকটা ক্লাইন্টের রোষের মুখে পড়ে গেছে ওরা এখন। বিস্ময়, হতাশা, ঘোরের মধ্যে থম মেরে বসে আছে ওরা এই রাত আড়াইটা অবধি। দুশ্চিন্তায় ঝিম ধরে যাচ্ছে মাথায়। হঠাৎ নড়েচড়ে বসল শওকত মীর্জা। চোয়াল শক্ত করে পুনরায় তুলে নিল নিজের ফোনটা। দুচোখে মারাত্মক রাগ, ক্ষোভ নিয়ে কল করল হুসাইন আলীকে। প্রথমবার রিং হতে হতে কেটে গেল। কেউ ধরল না। দাঁত খিঁচে দ্বিতীয়বার কল করল শওকত। এবার রিসিভ হল কলটা। বিশাল বড় একটা হাই তুল হুসাইন আলী। ঘুম জড়ানো, অস্ফুট আওয়াজে বলল, 'হ্যালো?'

শওকত মীর্জা শক্ত কন্ঠে বলল, ' বড্ড আয়েশের ঘুম দিচ্ছেন মনে হয়?'

' আয়েশ আর হলো কই? কানে বিষ ঢেলেতো ফোন বেজে উঠল।'

চোখ বুজে ক্রোধ সংবরণ করল শওকত। ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠে বলল, 'আমার সঙ্গে ডাবল ক্রস করার পরিণতি জানেন?'

' ডাবল ক্রস!' যেন ভীষণই অবাক হয়েছে হুসাইন।

' করেননি?'

থেমে একটু চিন্তা করার ভঙ্গি ধরল হুসাইন। তারপর বলল, 'তেমন কিছু মনেতো পড়ছে না। তবে স্মৃতি-ফৃতি হারিয়ে ফেললে সেটা ভিন্নবিষয়।'

হুসাইনের এমন গা ছাড়া ব্যবহারে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছে শওকত, 'মশকরা করছো আমার সাথে?'

মৃদু হেসে হুসাইন আলী বলল, ' এই হাড়কাঁপা শীতে, মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে আপনার সঙ্গে মশকরা করার ইচ্ছা নেই আমার। কী হয়েছে সেটা বলুন।'

শওকত হুংকার দিয়ে টেবিলে চাপড় মেরে বলল, 'যতগুলো মাল দিয়েছো সব ডিফেক্টেড ছিল। ক্লাইন্টরা সব একযোগে কমপ্লেইন করেছে। প্রায় সবগুলো মাল খারাপ।'

' নেওয়ার সময় চেইক করে নেননি?'

' আমরা স্যাম্বল টেস্ট করেই রিসিভ করি। সেদিন অলরেডি রিসিভ করেছিলাম। তারপরে গেছে তোমার হাতে। আর ডেলিভারির তাড়া ছিল। দ্বিতীয়বার চেইক করার বিন্দুমাত্র সময় ছিলোনা হাতে।'

কিছুক্ষণ চুপ থাকল হুসাইন আলী। অতঃপর গম্ভীর গলায় বলল, 'দেখুন, মালগুলো আমার কাছে বিক্রি করেছিল রুদ্র আমের। শত শত ইউনিট মাল। আমি বিশটা চেইক করে নিশ্চিত হয়েছিলাম বাকিগুলো ঠিক আছে। বাইশ মিনিটের চেকিং টাইম নিয়েছিলাম। সে অনুযায়ী সব ঠিকঠাকই ছিল। আর আমি সেই মালগুলোই দিয়েছি আপনাদের। আপনার মেয়ের কথায়। বলতে গেছে ব্লাকমেইলে। এখন তারপরে ঠিক কী ঘটেছে তাতো আমার জানার কথা নয় তাইনা?'

' কথার মারপ্যাচে ফেলছো আমায়? তোমার এসব ঢপের চপ আমি গিলব?'

আরো একবার হাই তুলল হুসাইন। নিরস গলায় বলল, 'গেলা না গেলা আপনার ব্যপার শওকত সাহেব। আমি আমার দিকটা পরিষ্কার করে দিয়েছি। আপনি বিশ্বাস না করলে আমার কিছুই করার নেই। জোর করেতো কাউকে আর বিশ্বাস করানো যায়না।'

শওকত শীতল গলায় বলল, 'আমার লেজে পা দিয়ে কেউ আজ পর্যন্ত বাঁচতে পারেনি হুসাইন। রাশেদ আমেরের মতো মানুষই পারেনি, তুমিতো চুনোপুটি। ভুল করলে।'

হো হো করে হেসে ফেলল হুসাইন, ' কারো লেজে পা দেওয়ার সময় আমার কই শওকত সাহেব? আমি কিছুই করিনি। ব্যপারটা যত তাড়াতাড়ি বিশ্বাস করবেন ততই আপনার লাভ। বরং চুক্তি অনুযায়ী আমার টাকাটা কবে ফেরত দিচ্ছেন সেটা জানান। নয়তো ঐ কাগজ ব্যবহার করে আপনাদের ফাঁসিয়ে দিতে সময় লাগবেনা আমার। আগেই বলেছি, আমার ভাইয়ের জীবন আমার এতোটাও বেশি প্রিয় না যে আমি এতোবড় ক্ষতি এফোর্ড করতে পারব। রাখছি।'

কল কেটে দিল হুসাইন। ফোনটা স্পিকারে দেওয়া ছিল বিধায় সবকিছুই শুনতে পেল ঘরের বাকি তিনজন। বিচ্ছিরি এক গালি ছাড়ল সম্রাট, ' ওর শরীরের প্রত্তেকটা রগ কাইট্টা ছিড়মু আমি। শালা শুয়োর!'

শান ভ্রুকুটি করে বলল, 'তাতে কী উদ্ধার হবে? এখন আমাদের অবস্থা নাজেহাল। নিজেরা কীভাবে বাঁচব সেইটা খুঁজে পাচ্ছি না, এ এখন অন্যের রগ কাটতে আসছে।'

সম্রাট দাঁত খিঁচে কিছু বলতেই যাচ্ছিল কিন্তু থামিয়ে দিল শওকত, ' আহ্ থামবে! এখন এসব করার সময়? কীভাবে এই বিপদ থেকে বাঁচব সেটা ভাবো।'

একে অপরের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখেই এক নীরব যুদ্ধ সাড়ল সম্রাট আর শান। অতঃপর সম্রাট রাগে হাঁসফাঁস করতে করতে বলল, 'তারমধ্যে রাণীর কোন খবর নেই। রুদ্র মেরেটেরে ফেলেনিতো ওকে? তেমন হলে কিন্তু ঐ মাদারচোদটাকে ছাড়ব না আমি মীর্জা সাহেব। আমি সব ক্ষতি মেনে নিতে পারি, এই ক্ষতিটা না।'

হতাশ হয়ে কপালে হাত দিয়ে বসল করিম। এই ছেলের ঐ মেয়ের প্রতি গদগদ প্রেমটাই একদিন ওর কাল হবে, সেটা স্পষ্ট টের পাচ্ছে সে। কিন্তু সবটা বুঝেও কিচ্ছু করতে পারছেনা। কোন দুঃক্ষণে আড়াইবছর আগে ডার্ক নাইটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ভেবে পায় না করিম। না হয়েও উপায় আছে? এমন একটি সুপুত্র থাকলে ধ্বংস হতে আর কী লাগে?

এদিকে শওকত মীর্জা স্থির, গম্ভীর বহুদিন পর তাল, ছন্দ সব হারিয়ে ফেলেছে সে। চারদিকটাই যেন হঠাৎ, আচমকা এসে গ্রাস করেছে তাকে। কোন দিক থেকে ভাববে, কী দিয়ে শুরু করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না।

—————

সন্ধ্যা থেকে টানা কাজ করে কিছুটা ক্লান্ত রুদ্র। এবারের তুলে আনা মালগুলো সব চেক করতে হয়েছে আজকের মধ্যেই। সময় নেই ওর হাতে। মালও প্রচুর। হেভি গান, হ্যান্ড গান, রাইফেল কমতো ছিলো না। মালের বক্সগুলো খুলে দেখার পর বেশ হাসি পেয়েছিল রুদ্রর। সেই পরিচিত ডিল অনুযায়ী-ই অস্ত্র এসেছে। এটা সেকেন্ড ব্যাচ। যে ডিলটা রুদ্র নিজে করেছিল বার্মা নাইনের সঙ্গে। কিন্তু রাশেদ আমেরের একটা সইয়ের কারণে হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল ডিলটা। ঠিক সেই পরিমাণ মালই এসেছে। রাইফেল তিনশ; AK-103 চাইনিজ ক্লোন, বারোশ 9mm পিস্তল, পনেরোটি RPG-7 গ্রেনেড, LGM ত্রিশটি, গোলা-বারুদ ষাট হাজার রাউন্ড, সাইলেন্সার দেড়শ। সবগুলো মাল টেস্ট করে নিতে সময় লেগেছে প্রায় সাত ঘন্টা। চেক ফায়ারের জন্যে সিকিউর জায়গা বাছাই করা। হ্যান্ডগানগুলোর ট্রিগার, ম্যাগাজিন ফিট, ব্যারেল চেইক করা; হ্যাভিগানের ওয়েট, ব্যালেন্স পরীক্ষা। রাইফেলের স্কোপমাউন্ট, সেফটি, রেঞ্জ ফায়ার টেস্ট। এইসব একদিনে করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে রুদ্র আমেরকে। তবে সুষ্ঠুভাবে সবটা হয়েছে এটাই স্বস্তির। কাল থেকে আসল কাজ! লম্বা এক শ্বাস ফেলে চারপাশে তাকাল রুদ্র। প্রায় তিনটে বাজতে চলল।
এই মুহুর্তে কুড়িল বিশ্বরোড দিয়ে যাচ্ছে রুদ্রর জীপ। পাশে বসে আছে রঞ্জু। আশপাশটা শীতল, নির্জন। অনেকটা ভুতুড়ে থমথমে ভাব। চারপাশের ঘন কুয়াশা স্ট্রিটল্যাম্পের হলদে আলোয় যেন স্থির হয়ে ভেসে আছে। রাস্তার পাশের বিলবোর্ডগুলোও দাঁড়িয়ে আছে নির্বাক হয়ে। রঞ্জু নিজের হাত ঘষতে ঘষতে বলল, ' ভাই? বনানীর ফ্ল্যাটে যামু আমরা এখন?'

রুদ্র ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল। বলল, 'কেন?'

রঞ্জু সরলভাবে জানাল, 'বাড়ির কাছাকাছি নাইমা যাইতাম তাইলে।'

' কানের নিচে একটা দিয়ে বাড়ি যাওয়ার সখ মিটিয়ে দেব। রাতে খেয়েছিস?'

রঞ্জু সামান্য ইতস্তত করল। জবাব দেওয়ার কিছু নেই। উত্তরটা জানে রুদ্র। এতক্ষণ রুদ্রর সঙ্গেই ছিল ও। দুজনের একজনেরও খাওয়া হয়নি। রুদ্র বলল, 'চুপচাপ আমার সঙ্গে ফ্ল্যাটে যাবি। রান্না হয়েছে। একসঙ্গে খাব।'

অগত্যা। চুপচাপ বসে থাকতে হলো রঞ্জুকে। কারণ এটা শুধু বাক্য না, আদেশ ছিল। ঠিক সেসময়ই ভাইব্রেট করে উঠল রুদ্রর ফোন। রুদ্র ব্লুটুথ কানেক্ট করল। বরাবরের মতোই থমথমে গলায় বলল, 'হ্যালো?'

ওপাশ থেকে ভেসে এলো, 'হুসাইন আলী বলছি। কোথায়?'

' কুড়িল। কাজ সেড়ে বাড়ি ফিরছি।'

' ভালো! কিন্তু ওদিকেতো আগুন লেগে গেছে ইতিমধ্যে।'

ঠোঁটে বক্রহাসি ফুটল রুদ্রর, 'সবেতো আগুন লেগেছে। এখনো আরও অনেককিছু লাগা বাকি আছে। আমার চালতো এখনো প্রায় সবই বাকি।'

মৃদু হাসল হুসাইন, 'তোমার কথামতোই কাজ করেছি আমি। কতবড় রিস্ক ছিল সেটা তুমিও ভালোভাবে জানো। তোমার যে ডেঞ্জারাস বউ! তাকে ঘোল খাওয়ানো সহজ ছিলোনা। দ্বিতীয়বার যখন ও এলো, কী অভিনয়টাই না করতে হল আমাকে। অথচ আমি জানতাম আমাকে মাল দিতে হবে। তোমার কথামতো সেই ডিফেক্টেড মাল।'

রিটার্ন গিফ্ট কবে পাচ্ছি? শুনলাম এবারেও বেশ চকচকা মালপত্র ছিনিয়েছো। তোমার দিকে গেছি কারণ ওদিকে লাভটা আমার বেশি ছিল। তাই..'

হেসে ফেলল রুদ্র, 'পাবেন। আমি বেইমানি করি না। আর কেউ বেইমানি করলে সেটা সহ্যও করি না।'

শেষের লাইনটা যেন হুসাইনকে সতর্ক করে দিতেই বলল রুদ্র। হুসাইন আলী মৃদু হেসে বলল, 'সেটা আমি জানি। জানতাম আসলে। মানে..তোমার স্ত্রীকে এখনো জীবিত দেখে সংশয় তৈরী হয়েছে বৈকি।'

সঙ্গেসঙ্গে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল রুদ্রর। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শীতল, থমথমে গলায় বলল, 'ক'টাদিন পর আর থাকবেনা।'

বলতে বলতেই কলটা কেটে দিল রুদ্র। বনানীর আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করল রুদ্রর গাড়ি। ছিমছাম, নিরিবিলি চারপাশ। কুয়াশা আর অন্ধকারের মিশ্রনে ভুতুড়ে পরিবেশ বলা যায়। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল আরও খানিকটা। এইমুহূর্তে শওকত, সম্রাট, শান, করিম, পলাশ সকলেই প্যানিকড, হতাশ, অসহায় মুখভঙ্গি মনে পড়তেই পুনরায় ঠোঁটে হাসি ফুটল রুদ্রর। আনমনেই মৃদুস্বরে শিস বাজাতে শুরু করল। বড় ধাক্কাতো এখনো অপেক্ষা করছে ওদের জন্যে। ওদের কফিনে প্রথম পেরেকতো ব্যবসায়ীদের ভুয়ো লিস্ট দিয়ে মেরেছিল রুদ্র। সেটা এখনো বোঝেনি ওরা। ওরা এটাও জানেনা দুবাইতে গিয়ে সেই কফিনের দ্বিতীয় পেরেগটাও রুদ্র মেরে এসেছে অনেক আগেই। রুদ্রর মনে পড়ল কদিন আগের দুবাইর সেই মিটিংটার কথা। 

সোলার সিস্টেম তখন চারপাশ দিয়ে অন্ধকার দেখছে। ফেইক বিজনেসম্যানদের লিস্টকে সামনে রেখে আর মিল বিক্রি করে সবে কিছুটা টাকার ব্যবস্থা করতে শুরু করেছিল রুদ্র। ঠিক সেইসময় সেই অন্ধকারকে আরও বিভৎস আর যন্ত্রণাময় করে তুলতে রুদ্রর সামনে আসতে শুরু করে তার প্রিয়তমা অর্ধাঙ্গিনীর ভয়ংকর সত্যি। প্রকাশ পেতে শুরু করে রাণী মীর্জার অস্তিত্ব! ভেতরে থেকে ভেঙে গুড়িয়ে যেতে থাকা রুদ্র যেন চারপাশ দিয়ে শক্ত করে ধরে নিজেকে। ওর চারপাশের জগতটা যখন ধ্বসে পরে ওকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্যে উদ্ধত হয়। সেসময় রুদ্র যেন প্রচণ্ড আক্রোশে সবটা আকড়ে ধরে বলে, "এতো সহজে না!" এরপরই এক ভয়ংকর জীবনমরণের খেলায় পা দেয় রুদ্র আমের। মারাত্মক জেদ, ক্ষোভ আর হিংস্রতা যেন উন্মাদ করে তোলে ওকে। জাফর আর উচ্ছ্বাসকে ছাড়াই দলে সাধারণ সদস্যদের মধ্যে যারা ওর খুবই বিশ্বস্ত। বেশ কয়েকবার যারা নিজেদের সমর্পনের পরিচয় দিয়েছে কঠিন ত্যাগের মাধ্যমে; তাদের নিয়ে ছোট্ট একটা আলাদা টিম রেডি করে রুদ্র। যার মধ্যে রঞ্জুও ছিল। যদিও সেই দলটার কাছেও পুরোপুরি কোনকিছু রিভিল করেনি ও। শুধু কাজ করিয়ে গেছে যতটুকু প্রয়োজন। সেসময়টাতেও রুদ্রর হাতে রাণীর দেওয়া সেই ব্রেসলেট ছিল। যাতে থাকতো মাইক্রোফোন। কিন্তু রুদ্র তখন তা জানে। তাইতো গোপনীয় যেকোন পদক্ষেপ নেওয়ার আগে কোথাও একটা খুলে ফেলে রাখতো ওর লোহার ড্রয়ারটার মধ্যে। ততক্ষণে কোনকিছুই রেকর্ড হতো না। আর প্রিয়তা ভেবে নিয়েছিল, মাইক্রোফোন ঠিকঠাক কাজ করছে না।

সব গুছিয়ে দুবাইতে একটা মিটিং এরেঞ্জ করে রুদ্র। বিশেষ অনুরোধ এবং জরুরি বিষয় উল্লেখ করে যোগাযোগ করে তিনটি দলের সঙ্গে। ব্লাক ডিউন লিমিটেড: দুবাইয়ের গ্রুপ- যেটার মাধ্যমে মানি লন্ড্রিং এবং পোর্ট ট্রান্সফার কাভার করতো সোলার সিস্টেম, ভল্ক আর্মিক্স: রাশিয়ান গ্রুপ এবং গোল্ডেন কস্ট আর্মস: আফ্রিকান গ্রুপ। পাঁচটা দলের মধ্যে এই তিনটেকে খুব ভেবেচিন্তেই বেছেছিল রুদ্র আমের। কারণ সবচেয়ে ক্ষমতাশীল, উগ্র এবং ভয়ংকর এরাই ছিল। সুতরাং এদেরকে হাতে রাখাটা সবার আগে প্রয়োজন ছিল।

যদিও দলের যা অবস্থা ছিল তাতে এই তিনটে দলকে একসঙ্গে এনে মিটিংয়ে বসাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল রুদ্রকে। কিন্তু নিজের অসাধারণ ম্যানিউপুলেটিভ ওয়ার্ডস আর বিজনেস মাইন্ড দিয়ে তা করতে সক্ষম হয় রুদ্র। কিন্তু যাওয়ার আগের দিনটাতেই রাণী-মীর্জা খুন করে ইকবালকে। রুদ্রর সামনে প্রকাশ পায় রাণীর সম্পূর্ণ সত্যি। ভেতরে পুষে রাখা ক্ষোভ আর রাগ আরও বাড়ে রুদ্রর। ঠিক যেমন আহত বাঘের থাবা ভয়ংকর হয়, সেই ক্ষোভ থেকেই দুবাইয়ের মিটিংটা যেন হল রুদ্রর সবচেয়ে ভয়ংকর চাল। 

রুদ্র দুবাই যাওয়ার পরের দিনকার কথা-

—————

দুবাই, দ্য এম্পটি টাওয়ার। একটি পুরোনো, বন্ধ হয়ে যাওয়া হ্যালিপ্যাড বিল্ডিংয়ের পয়ত্রিশতম ফ্লোর। চারপাশে কাঁচের দেয়াল। বাইরে একপাশে তাকালে ধূ ধূ মরুভূমি আর নীল সাগরের রেখা চোখে পড়ে। দুবাইর মতো 'জিরো ক্রাইম সিটি' বস্তুত তথাকথিত 'জিরো ক্রাইম সিটিতে' এধরণের মিটিং সাধারণ জায়গায় করা সম্ভব হয়না। ঐ জায়গাটা মূল শহর থেকে বেশ দূরে হলেও একটা ভূয়া কম্পানির ব্যানারে হচ্ছে মিটিংটা। লোকাল স্পন্সরকে ঘুষ দিয়ে চারপাশে তৈরী করা হয়েছে একটা সিকিউরিটি ব্লাইন্ড স্পট। রুদ্র জানতো বড্ড বেশি রিস্ক নিয়ে ফেলছে ও। যাদের সঙ্গে ওর মিটিং তারা যতটা না ভয়ংকর, তারচেয়েও বেশি উগ্র। উনিশ থেকে বিশ হলে এখান থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবেনা ও। হয়তো আর কোনদিন ফেরা হবেনা বাংলাদেশে। কিন্তু শেষ চেষ্টা ওকে করতেই হবে।
দ‍ৃঢ়, লম্বা কদমে সেখানে প্রবেশ করল রুদ্র আমের। হাতে কালো একটা ব্যাগ। বাকিরা চলে এসেছে ইতিমধ্যে। সবকিছু গুছিয়ে আসতে দেরী হয়েছে রুদ্রর। কারণ এখানে ওর নকল পরিচয় এবং ব্লাক মানির মাধ্যমেই আসতে হয়েছে। নিজের জন্যে বরাদ্দ রাখা চেয়ারটাতে বসল রুদ্র। 
রুমটাতে আবছা অন্ধকার। কৃত্রিম আলোয় খানিকটা আলোকিত হয়ে আছে কেবল। সেই আলোয় চলনসইভাবে দেখা যাচ্ছে তিনটি দলের তিন প্রধান প্রতিনিধির মুখ। রুদ্র একে একে তাকাল তিন প্রতিনিধির দিকে।

ব্লাক ডিউন লিমিটেডের প্রতিনিধি হিসেবে এসেছে রায়ান খলিফা। তরুণ, লম্বা, সুদর্শন। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। দেখেই বোঝা যায় বেশ শীতল ব্যক্তিত্বের অধিকারী সে। ভ্লক আর্মেক্স এর প্রতিনিধি হিসেবে এসেছে আর্কাদি সোলভ। রুশ, গম্ভীর, ভারী চেহারার অধিকারী। বেশ লম্বা এবং সুস্বাস্থ্য। আরও আছে ডোমিনিক ওসেই। গোল্ডেন কস্ট আর্মসের প্রতিনিধি সে। আফ্রিকান, বিকট লম্বা দেহ, চোখ দুটোতে লালচে হিংস্রতা। সব মিলিয়ে রুদ্রর দ্বিগুণ বলা যায় একে। পরিস্থিতি বুঝতে আশেপাশেও একবার চোখ বুলিয়ে নিল রুদ্র। প্রত্যেক প্রতিনিধির খানিকটা পেছনেই একজন করে অস্ত্রধারী গার্ড দাঁড়িয়ে আছে, এবং পাশের চেয়ারে বসে আছে আরও একজন করে। রুদ্র জানে এরা টেকনিক্যাল প্রতিনিধি। ডেলিভারি, ট্রাকিং, রিসোর্স প্রসেসিং খুব ভালোভাবে বোঝে এরা। আশেপাশেও শক্ত সিকিউরিটি ব্যবস্থা আছে তা জানে রুদ্র। হতে পারে স্নাইপার বা আরও কিছু। এসব নিয়ে আর ভাবল না রুদ্র। টেবিলে প্রত্যেকের জন্যে ড্রিংক এবং স্মোকের ব্যবস্থা আছে। রুদ্র তিনজনের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে ইংরেজিতে বলল, ' আলোচনা শুরু করতে পারি আমরা।' তিনটি আলাদাভাষি মানুষের সঙ্গে আলোচনার জন্যে আপাতত ইংরেজি-ই আদর্শ ভাষা।

রায়ান খলিফা বলল, ' বলো! কী বলার আছে তোমার।'

রুদ্র কিছু বলার আগেই আর্কাদি সোলভ বলল, 'তোমার তিনটা বড় ডিল ওরা কেড়ে নিয়েছে। একটাও বাঁচাতে পারোনি তুমি। এখন খালি হাতে এসেছো ঋণ শোধের গল্প শোনাতে?

রুদ্র বলল, ' আপনাদের তিনটা গ্রুপ এমুহূর্তে আমার কাছে প্রায় বিশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার টাকা পাওনা। যা আমি এখনো শোধ করতে পারিনি। ডেডলাইনও কাছে। এবং যদি অনেস্টলি বলি তাহলে, ডেডলাইনের মধ্যে আমি আপনাদের টাকা দিতে পারব না। তারপরেও পারব কি-না সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান আমি।'

সঙ্গে সঙ্গে নিজের সঙ্গে থাকা পিস্তলটা বের করে ফেলল ডোমিনিক ওসেই। তেলতেলে কালো মুখে লালচে চোখজোড়া ভীষণ ভয়ংকর। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে সে বলল, 'যদি এটা বলতেই এখানে এসে থাকো তাহলে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবেনা। এখানে একটা কবর তৈরী করে যাব আমি। তোমার কবর।'

রুদ্রর মধ্যে বিন্দুমাত্র বিচলিত হওয়ার লক্ষণ নেই। বেশ অনেকটা আয়েশ করেই চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, 'আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। আমি শুধুমাত্র আমার বর্তমান অবস্থানটা জানালাম। তবে ভবিষ্যৎ ভিন্ন হতে পারে যদি আপনারা চান।'

' কীরকম?' ড্রিংকে চুমুক দিয়ে প্রশ্ন করল আর্কাইভ।

' শুধুমাত্র পাওনা টাকা নয়, তারচেয়েও বেশি কিছু দিতে পারি আমি আপনাদের। কিন্তু তারজন্যে আমার আপনাদের সাহায্য লাগবে।'

রায়ান হাতের সিগারটা তুলে অনেকটা ব্যঙ্গ করে বলল, ' এ মুহূর্তে যে গোটাটাই শূন্য, সে আমাদের পাওনা দিয়ে আবার বার্তিও দেবে। কীভাবে সেটা?'

রুদ্র সোজা হয়ে বসল। নিজের নিয়ে আসা কালো ব্যাগটা থেকে তিনটা খাম বের করল। টেবিলের ওপর দিয়ে তিনজনের দিকে তিনটা ছুড়ে দিল ও। তিনজন প্রতিনিধিই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। অতঃপর তিনজনই খুলে পড়ে দেখে নিজ নিজ খামের কাগজগুলো। শেষে পড়ল ডোমিনিক। ভ্রু কুঁচকে বলল, 'এগুলোতো আমাদের চালানেরই কাগজ। ডার্ক নাইট আর ব্লাক হোলের সঙ্গে করা চুক্তির ইনফরমেশন। তোমার কাছে এই তথ্য কীকরে?'

রুদ্র মৃদু হাসল, ' ঠিক তাই। এবং খুব শীঘ্রই অস্ত্রগুলোও আমার কাছে থাকবে। ওদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেব আমি।'

রায়ান গম্ভীর গলায় বলল, ' সে তুমি নিতেই পারো। তোমার দেশ, তোমার শহর। তোমার পদ্ধতি। এসবে আমরা নাক গলাই না। আমরা শুধু ওদের কাছ থেকে পেমেন্ট পেলেই হল। কিন্তু তুমি এসব করবে তা এখানে এসে বলছো কেন? আমরা কী সাহায্য করব?'

' রিসোর্স।'

' রিসোর্স?'

মাথা ঝাঁকাল রুদ্র, ' এমুহূর্তে সোলার সিস্টেমে না লোক আছে আর পর্যাপ্ত অস্ত্র। কিন্তু ওদের কাছ থেকে মাল ছিনিয়ে নিতে গেলে আমার অনেক লোক লাগবে, সঙ্গে শক্তিশালী অস্ত্র।'

' তারপর?' প্রশ্ন করল ডোমিনিক।

' ব্লাক ডিউন থেকে যে মাল কদিন পর যাচ্ছে সেটা ছিনিয়ে নেব আমি। সে মাল বিক্রি এবং আমার ব্যক্তিগত অর্থ দিয়ে আমি ব্লাক ডিউনসহ অন্য দুজন ক্লাইন্ট বার্মা-নাইন এবং ইন্ড্রিরার টাকা শোধ করব।'

ডোমিনিক ভ্রু তুলে বলল, 'আর আমাদের পেমেন্ট?'

' ঐটা দ্বিতীয় ব্যাচে যখন বার্মা-নাইন থেকে মাল আসবে এবং ফাইনালি তৃতীয় ব্যাচে আপনাদের মাল যখন যাবে সেসব হাতিয়ে নেওয়ার পর তার বিক্রির সব টাকা আপনাদের। টাকা শোধ হয়ে যাওয়ায় এবং ডার্কনাইট-ব্লাকহোল ব্যর্থ হওয়াই বার্মা, ইন্ড্রিরা নতুন ডিল দেবে আমাকে। আই হোপ ব্লাক ডিউনও দেবে।' কথাটা রায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল রুদ্র। তারপর বলে চলল, 'সেখান থেকে আমার দেশীয় ক্লাইন্টের কাছ থেকে নেওয়া এডভান্স মিলিয়ে আপনাদের দুদলের টাকাও শোধ হয়ে যাবে। এইসবটাই সম্ভব হবে, যদি আপনারা আমাকে রিসোর্স দেন।'

ঠান্ডা হাসে আর্কাদি, ' এতোগুলো লোক, ভারী অস্ত্র আর ড্রোন সাপোর্ট চাইছো তুমি আমাদের কাছ থেকে, নিজের ব্যক্তিগত হিসেবে মেটানোর জন্যে। কিন্তু সেই সাহায্য কেন করব আমরা? দিচ্ছোতো শুধু পাওনাটাই। লাভ কী?'

রুদ্র বলল, 'লাভ আছে তাতো বলে__'

রুদ্র কথাটা শেষ করার আগেই নিজের পাশের জনের মাথাটা টেবিলের ওপর চেপে ধরল ডোমিনিক। পকেট থেকে বের করে ছোট্ট একটা ধারালো না-ইফ। কেউ কিছু বলার আগেই ডোমানিক ছোরার পরপর তিনটা টান দিল লোকটার গলায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। গোঁত গোঁত শব্দ করতে করতে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ল লোকটা। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে, চোখ উল্টে গেছে। তবে বেশিক্ষণ টিকল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিঃশব্দ হয়ে গেল লোকটা। রুদ্র তাকিয়ে দেখল বাকিদের মধ্যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া নেই। যেন খুবই স্বাভাবিক বিষয় ঘটল এখানে। যদিও রুদ্রর কাছেও ব্যপারটা আহামরি অস্বাভাবিক না। ডোমিনিককে এক টুকরো কাপড় দিল তার দেহরক্ষী। সেটা দিয়ে রক্তাক্ত নাইফটা মুছতে মুছতে খুব নির্বিকারভাবে জানাল, 'রেকর্ড করছিল হারামজাদা! তুমি থামলে কেন? বলো কী লাভ?'

রুদ্র জানে, কীভাবে বুঝল সেটা বলবেনা ডোমিনিক। এগুলো সিক্রেট। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে সিগারেট ধরাল রুদ্র। সময় নিয়ে প্রথম টানটা দিয়ে বলল, 'আপনাদের অস্ত্র মধ্যপ্রাচ্যে ঢোকার আগে বেশ কয়েক জায়গায় আটকে থাকে সেটা আমি জানি। আমাকে করা এই সাহায্যের কারণে আপনাদের এই সমস্যার সমাধান করতে পারি আমি।'

আর্কাদি উৎসাহি হয়ে টেবিলের ওপর হাত রেখে বলল, 'কীভাবে?'

পুনরায় চেয়ারে হেলান দিল রুদ্র। ঠোঁটে ঝুলে আছে রহস্যময় এক হাসি। পুনরায় নিজের কালো ব্যাগটা থেকে মোড়ানো একটা লম্বা পেপার বের করে রুদ্র। সঙ্গে একটা মার্কার পেইন। পেপারটা বিছিয়ে নিল টেবিলের ওপর। তারপর বলতে শুরু করল, 'মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা বা ইউক্রেনের মতো জায়গায় যেসব অস্ত্র রুটে আটকে থাকে সেগুলো সাধারণত হয় কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সে সমস্যা, মধ্যবর্তী দেশের ভাড়া ট্রান্সপোর্ট ব্লক, অথবা দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসারদের 'পার্সোনাল রেট' না মেটানোর কারণে। আমার টিম আগে থেকেই এসব পয়েন্ট ম্যাপ করে রাখবে। দুবাই, ওমান, ইরান, পাকিস্তান এসব দেশে আমার কিছু মিডলমেন বা কনট্যাক্ট বহুবছর যাবত আছে সেটা আপনাদের জানা। যা আমার বাবা রাশেদ আমের সেট করে দিয়ে গিয়েছিলেন। ওনার নামটুকু শুনলেও অনেকে বিনাস্বার্থেও অনেক কাজ করে দেয়।'

' লিগ্যাল কাভার?' প্রশ্ন করে আর্কাদি।

' একটা জাল কোম্পানি তৈরী হবে। Middle-East Heavy Equipments. এর ব্যানারে অস্ত্রগুলোকে মেশিন পার্টস, কনস্ট্রাকশন গিয়ার, হিসাবে কাগজপত্র তৈরি করানো হবে। সেই কাগজেই নতুন কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স নেওয়া হবে, কখনো জাল অফিসার দিয়ে ম্যানুয়ালি সিলও নেওয়া হবে দরকার অনুযায়ী।'

তিনজন প্রতিনিধি একে অপরের দিকে তাকাল। পার্শ্ব প্রতিনিধিরাও নিজ নিজ লিডারকে বোঝাল কী চমৎকার প্রস্তাব রুদ্রর। রায়ান বলল, 'ফাইনাল রিচ কীভাবে হবে?'

রুদ্র একটু থেমে টান দিল সিগারেটে। আবার বলল, 'অস্ত্র যেখানে আটকে আছে, সেখানকার মালিকানা ট্রাক বা কন্টেইনার কাউকে টাকা দিয়ে কিনে নেবে কিংবা তাদের চালকদের ম্যানেজ করে নিতে হবে। মুভ করতে হবে কালো রুট ব্যবহার করে যেমন_' ম্যাপে মার্কার এঁকে দেখাল রুদ্র, 'ওমান-ইউএই বর্ডার, পাকিস্তান-ইরান সীমান্ত। এসব রুটে সাধারণত বেদুইন মাদক ব্যবসায়ীরা বা ট্রাইবাল লর্ডরা নিয়ন্ত্রণ রাখে। তাদের সঙ্গে আগে থেকেই একটা চুক্তি করে রাখবে আমার সেই টিম। বাকিটা একটু কষ্ট করে আপনাদের ম্যানেজ করতে হবে।'

ডোমিনিক এক গাল হেসে বলল, 'যা দেখালে! সেইটুকুও যদি করতে পারো তাহলে তা মোর দ্যান ইনাফ। এরচেয়ে বড় লাভ হয় না।'

রুদ্র একটু হাসল। ম্যাপটা গোটাতে গোটাতে বলল, 'কী ধরে নেব তাহলে? আমি রিসোর্স পাচ্ছি?'

আর্কাদি বলল, 'তোমার কী কী লাগবে সেটা বলো?'

রুদ্র ধীরেসুস্থে সিগারেটে দুটো টান দিয়ে বলল, ' বেশি না। এক্স-মারসেন্যারি, সিকিউরিটি ট্রেইনড, হাই ক্লাস হিটম্যান- চল্লিশ জন। ৮টি AK-103, ২ টি RPG-7। ব্লাক ডিউনের কাছ থেকে চাই থার্মাল স্কোপ এবং ড্রোন সার্ভিলেন্স কিট। ভুয়া কন্টেইনার রেজিস্ট্রেশন আর একবারের জন্য কাস্টম ক্লিয়ারেন্স কভার। দ্যাটস্ ইট।'

তিনজন প্রায় একসঙ্গে জানাল, 'ডান!'

রুদ্র সব গুছিয়ে উঠে দাঁড়াল। তাকাল ফ্লোরে পড়ে থাকা মৃত লোকটার দিকে। ডোমিনিক বলল, ' এটাকে নিয়ে ভাবার কিছু নেই। ব্যবস্থা করে ফেলব আমরা।'

চোখে হাসল রুদ্র। টেবিলের ওপর রাখল একটা রিং। তিনজন তাকিয়ে দেখল, তাকে ইংরেজিতে খোদাই করা আছে Blood Seal. যার অর্থ এটা কোন লিখিত চুক্তি নয়। কোড অফ ব্লাড ডেব্ট। অর্থাৎ গোপন ব্রাদারহুড শর্ত। সেটা দেখে হাসর রায়ান। বলল, 'অনেক শুনেছিলাম জগৎসুন্দর, কিন্তু ক্রিমিনাল রুদ্র আমেরের কথা। আজ শুধু তার ভয়ংকর সৌন্দর্য নয়, ভয়ংকর ক্রিমিনাল মাইন্ডও দেখলাম।'

কিছু বলল না। নিজের ব্যাগ নিয়ে উল্টো ঘুরে হাটা দিল রুদ্র। অসম্ভব সুদর্শন মুখটায় অপ্রাঢ় এবং ভয়ংকর রহস্যময় মৃদু একটুখানি হাসি!

—————

এটাই ছিল ব্লাকহোল আর ডার্কনাইটের কবরে মারা রুদ্রর দ্বিতীয় পেরেক। প্রথমবারের মাল আর বাকিসব জোগাড় করা টাকা দিয়ে একারণেই ভ্লক আর্মিক্স বা গোল্ডেন কষ্টের টাকা শোধ করেনি রুদ্র। কারণ ইতিমধ্যে তাদের ম্যানেজ করে ফেলেছিল ও। ওদের কফিনে তৃতীয় এবং চতুর্থ পেরেকটাতো পর দু'বার অস্ত্র ছিনিয়ে মেরেছে ও। এবার পঞ্চম পেরেকটা বসানোর অপেক্ষা।

—————

ফ্ল্যাটে চাবি দিয়েই লক খুলল রুদ্র। রঞ্জুকে নিয়ে ঢোকার সঙ্গেসঙ্গেই দেখতে পেল উচ্ছ্বাস আর জয়কে। দুজনেই সোফায় বসে ঝিমছে। কপাল কুঁচকে আরেকবার ঘড়ি দেখল রুদ্র। এগিয়ে দিয়ে মাঝারি গোছের একটা টোকা মারল উচ্ছ্বাসের মাথায়। চমকে উঠল উচ্ছ্বাস। উদ্ভ্রান্তের মতো চারপাশে তাকিয়ে বলল, 'কে? কই? বউমণি আমি কিছু করিনাই।'

বলতে বলতেই রুদ্র আর রঞ্জুকে ঠিকঠাক দেখতে পেল। সম্বিত ফিরে পেতেও সময় লাগল না ওর। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করতে করতে বলল, ' শা--লা!'

উচ্ছ্বাসের লাইনটায় অন্তর্নিহিত ব্যপারটা প্যাথেটিক হলেও, এমুহূর্তে এভাবে শুনে ভেতরে ভেতরে বেশ হাসি পেল রুদ্রর। এদিকে উচ্ছ্বাসের কথায় ঝিমুনি কেটে গেছে জয়েরও। আশেপাশে তাকিয়ে ছোট্ট একটা হাই তুলল। রুদ্র সোফায় বসতে বসতে বলল, 'চিন্তা নেই। শয়তান এতো তাড়াতাড়ি মরেনা। তুইও দ্রুত মরছিস না?'

চোখ ডলতে ডলতে হাসল উচ্ছ্বাস, ' ইউ নেভার নো ব্রো!'

' ঘুমোসনি কেন এখনো?'

' সেইযে সন্ধ্যায় বের হয়েছো। রাত এখন তিনটে বাজে। শহরেজুড়ে হাওয়াবাতাস খেতে বের হওনি সেটা আমি জানি। এমন মুহূর্তে কল করেও তোমায় পাবনা। তাই আদোও বেঁচে আছো, নাকি পটল তুলেছো তা জানার জন্যেই বসে ছিলাম আরকি। তা কাজ হয়েছে ঠিকঠাক? কোন ঝামেলা হয়নিতো?'

সোফায় গা এলিয়ে দিলো রুদ্র, 'এখনো অবধি সব ঠিকঠাকই আছে।'

'যাক! খাবিতো এখন নাকি?'

' হুঁ! তাসলিমা এসেছিল?'

' হ্যাঁ রান্নাবান্না সব করে দিয়ে গেছে। কাল সকালে আবার আসবে।' বলতে বলতে রঞ্জুর দিকে তাকাল উচ্ছ্বাস। ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, ' তুই দাঁড়িয়ে আছিস কোন দুঃখে? বসে একটু রেস্ট কর। খাবার দিচ্ছি।'

মৃদু একটুখানি হেসে বসল রঞ্জু। রুদ্র একবার তাকাল প্রিয়তা যে ঘরে আছে সেঘরের দরজার দিকে। রুদ্রর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো রুদ্র। হালকা গলা ঝেড়ে বলল, 'খেয়েছে! তাসলিমা খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে গেছে। জ্বরটা যদিও আছে এখনো। তবে রতন কাকা বলেছে সমস্যা হবেনা তেমন। কল করেছিলাম আমি।'

রুদ্র সেবিষয়ে কিছুই বলল না। গম্ভীর গলায় বলল, 'খিদে পেয়েছে। পারলে খাবারটা আন।'

উচ্ছ্বাস উঠতে যাচ্ছিল। তার আগেই জয় উঠে দাঁড়িয়ে বলল, 'আপনি বসেন ভাই। আমি নিয়ে আসতেছি।'

—————

খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে সবাই ঘুমোতে গেছে। সবশেষে ধীরেধীরে প্রিয়তা যে রুমে আছে সে রুমে এলো রুদ্র। ঘরটা অন্ধকার। তবে কমলাটে ড্রিম লাইটের আলোতে সবটাই দেখা যাচ্ছে। একপাশে কাত হয়ে ঘুমোচ্ছে প্রিয়তা। গায়ে ভারী কম্ফোর্টার জড়ানো। রুদ্র এগিয়ে প্রিয়তার পাশে এসে থমকে দাঁড়াল হঠাৎ। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে। এরপর কী যেন ভেবে ঝুঁকলো বিছানার ওপর এক হাত রেখে। আরেক হাত আলতো করে রাখল কপালে। বেশ ভালোই জ্বর আছে। ফোঁস করে শ্বাস ফেলল রুদ্র। উঠে ঘুরে চলে যাচ্ছিল, কিন্তু খপ করে হাতটা ধরে ফেলল কেউ। রুদ্র ঘাড় ফিরিয়ে দেখল প্রিয়তা তাকিয়ে আছে ওর দিকে। শক্ত করে ধরে রেখেছে হাতটা। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে থেকেই ধীরে ধীরে উঠে বসল প্রিয়তা। রুদ্র দেখল একদিনেই মুখটা শুকিয়ে গেছে প্রিয়তার। কিন্তু ক্লান্তি ঘিরে ধরলেও অপূর্ব ঐ চোখজোড়ার সৌন্দর্য কমেনি একবিন্দুও। গম্ভীর গলায় রুদ্র বলল, 'কী চাই?'

প্রিয়তা দুর্বল হাসল, ' আমার চাওয়াগুলো কখনও স্থির থাকেনা। তাই আমার চাওয়াই আমার সবচেয়ে বড় শত্রু।'

' মানে?' রুদ্রর কন্ঠে স্পষ্ট বিষ্ময়।

প্রিয়তা রুদ্রর চোখে চোখ রেখে একই গলায় বলল, 
      ' সে এক মরিচিকা, পুরিয়ে দেওয়া অনল,
         তাকেই পেতে তবুও পান করেছি এই হলাহল।
        বিষাক্ত এ কৃষ্ণগহ্বর গ্রাস করেছে আমায়;
        তলিয়ে যেতে যেতেও আমি, চেয়েছি শুধুই তোমায়।'

রুদ্র ভ্রুকুটি গভীর হল। তা দেখে হেসে ফেলল প্রিয়তা, 'বোঝেননি তাইনা? জেন-জি টার্মে বলব?' কথাটা বলে আলতো করে রুদ্রর দুগালে নিজের উষ্ণ হাত রাখল প্রিয়তা। দুর্বল স্বরেই অনেকটা সুরতাল ছাড়া, ফিসফিসে গলায় গাইল,  
       'তুযসে হ্যাঁ মুঝকো পানে, ইয়াদোকে ও নাজরানে
               ইক জিনপে হাক হো ব্যস মেরা।
            তেরে ইয়াদো মে রাহু, তেরে খাবো মে জাগু
              মুঝে ঢুনডে যাব কোয়ি তেরে আখোমে মিলু।'

রুদ্র লালচে আলোয় তাকাল প্রিয়তা সম্মোহনী চোখদুটোর দিকে। পানি চিকচিক করছে। মনে হল যেন সেই চোখে সম্মোহিত করতে চাইছে প্রিয়তা রুদ্রকে। আচমকাই চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল রুদ্রর। প্রিয়তা দুই বাহু ধরে প্রায় ঝাঁকি দিয়ে সরিয়ে দিল নিজের কাছ থেকে। চাপা ক্রোধ নিয়ে বলল, 'এক বিষে মানুষ একবারই মরে প্রিয়তা।'

কথাটা বলে আর দাঁড়াল না রুদ্র। দৃঢ় কদমে বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে। বোধ হয় খেয়ালও করেনি, ওর দেওয়া ধাক্কায় আহত স্থানে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে প্রিয়তা। শরীর খিঁচে দাঁড়িয়ে আছে যন্ত্রণায়।

—————

পরেরদিন দুপুরের আগ দিয়েই আমের ভিলা থেকে ওদের আনতে গিয়েছিল। গোটা আমের ভিলাই যেন এসে হাজির হল বনানীর ফ্যাল্টটাতে। জ্যোতি, কুহু, নীরব, জাফর, এমনকি নাজিফাও এ অবস্থায় এসে হাজির হয়েছে। উচ্ছ্বাসের কোন বারণ শোনেনি সে। ফ্ল্যাটে ঢুকেই কুহু দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল প্রিয়তাকে। নিঃশব্দ কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠল মেয়েটার শরীর। হঠাৎ জড়িয়ে ধরায় ক্ষ*তস্থানে ব্যথা পাচ্ছে প্রিয়তা। কিন্তু তাও সরালোনা কুহুকে। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ' কাঁদছো কেন পাগল মেয়ে! ঠিক আছিতো আমি। এই দেখো? কিচ্ছু হয়নি।'

নীরব এগিয়ে এসে বলল, ' কুহু, ভাবির লাগছেতো। একটু ছাড়ো।'

প্রিয়তা নীরবের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় বলল ও ঠিক আছে। কুহু প্রিয়তাকে ছেড়ে নিজে একবার তাকাল প্রিয়তার ক্ষতর দিকে। প্রিয়তা সযত্নে মেয়েটার চোখ মুছে দিয়ে বলল, ' কাঁদে না।'

নীরব জিজ্ঞেস করল, 'এখন কেমন আছেন ভাবি?'

প্রিয়তা মুখে হাসি রেখেই বলল, ' ভালো। বসো!'

পেছনে জ্যোতি আর নাজিফাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, 'তোমরা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি আমার কাছে আসবে?'

জ্যোতি নাজিফাকে নিয়ে এগিয়ে এলো। কম্ফোর্টেবল একটা চেয়ার এনে দিল উচ্ছ্বাস। জ্যোতি নাজিফাকে সেখানেই বসাল। প্রিয়তা নাজিফাকে বলল, 'এই অবস্থায় তোমার আসার কী খুব দরকার ছিল? তোমার এখন রেস্ট দরকার নাজিফা।'

নাজিফা একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, 'তোমাকে না দেখে শান্তি পাচ্ছিলাম না।'

' ঠিক আছি আমি।'

' তাতো দেখতেই পাচ্ছি।' কথাটা বেশ অসন্তোষ নিয়ে বলল জ্যোতি, ' তোমাকে কতবার বলেছি রুদ্র যা বলে, যা করে তোমার ভালোর জন্যে করে। কেন শোননা ওর কথা? কী ঘটশ দেখলে? প্রিয়তা তুমি কেন বোঝো না আমরা সবাই তোমাকে ভালোবাসি। রুদ্রর ওপর রাগটা আমাদের ওপর কেন দেখাও?'

কথাটা বলতে বলতে চোখে প্রায় জল চলে এলো জ্যোতির। এগিয়ে গিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরল বিছানায় বসে থাকা প্রিয়তাকে। মৃদু গলায় বলল, 'ভাগ্যিস অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। আরও বড় কিছু হলে কী করতাম আমরা?'

এতক্ষণে মুখ খুলল জাফর, 'কথাটা কিন্তু সত্যি প্রিয়তা মা। এমন করা তোমার উচিত নয়। বর্তমান অবস্থাটা তোমার বোঝা উচিত। এই নিয়ে দুবার অ‍্যাটাক হল তোমার ওপর। তুমিতো অবুঝ নও মা।'

প্রিয়তা নরম গলায় বলল, 'স্যরি।'

দরজার পাশে দেয়ালে হেলান দেওয়া অবস্থায় সবটাই দেখছিল রুদ্র আমের। দেখছিল, একটা মেয়ে এতোটা নাটক, এতোটা ছলনা কীভাবে করতে পারে! কী দুর্দান্ত অভিনয়! যা প্রিয়তা ওর সঙ্গেও করে গেছে। ভেতরটা অদ্ভুত রোষে জ্বলে উঠল রুদ্র। উচ্ছ্বাসও খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে সেটাই দেখল। দেখল, রুদ্রর প্রতিক্রিয়াও।

—————

তানজিলা এসে রান্না করল সকলের জন্যে। প্রিয়তার সেই রুমে বসেই একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেল ওরা সবাই। খাওয়াদাওয়ার পর সব গোছগাছ আর টুকটাক কথাবার্তা চলতে চলতে বিকেল হল। সময় হল আমের ভিলায় ফেরার। জ্যোতি বলল, 'রেডি হয়ে নাও তাহলে প্রিয়তা। এখনতো অনেকটা সুস্থ তুমি। তোমাকে নিয়ে যাব আমরা।'

ঠিক তখনই রুদ্র বলে উঠল, ' ও যাবেনা এখন।'

রুদ্রর এমন ঘোষণায় চরম অবাক হল সকলে। এমনকি প্রিয়তা নিজেও। জ্যোতি বিষ্ময় নিয়ে বলল, 'যাবেনা মানে? এ অবস্থায় ওকে এখানে রেখে যাব আমরা?'

রুদ্র বলল, ' ওকে নিরাপদে রাখা সবচেয়ে জরুরি এখন।'

জ্যোতি আরও বেশি অবাক হল, 'প্রিয়তা আমের ভিলার চেয়ে এখানে বেশি নিরাপদে থাকবে? এটা কেমন মজা রুদ্র?'

ধমকে উঠল রুদ্র, ' হ্যাঁ মজাই এটা। আমের ভিলায় বাবাও ছিলেন, ইকবাল ভাইও ছিল। আমি যা বলছি ভেবেচিন্তে বলছি। এখানে পর্যাপ্ত গার্ড থাকবে, বেশিরভাগ সময় আমিও থাকব।'

' কিন্তু...'

' নাউ জাস্ট শাট আপ এন্ড সবাইকে নিয়ে বাড়ি যা।'

জ্যোতি হতাশ হয়ে তাকাল সবার দিকে। নাজিফা আর নীরবের রুদ্রর মুখের ওপর কথা বলার সাহস নেই। জাফর জানে রুদ্র অকারণে কিছু করেনা। তাই সে চুপ। কুহুর বায়নাও এক্ষেত্রে খাটবেনা তা কুহু নিজেও বুঝেছে। তাই অগত্যা প্রিয়তাকে রেখেই ওদের ফিরতে হলো আমের ভিলাতে। প্রিয়তার কাছ থেকে ঠিকঠাক বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল ওরা সবাই। উচ্ছ্বাস পৌঁছে দেবে ওদের। রুদ্র গেল ওদের এগিয়ে দিতে। প্রিয়তা তখনও বিস্ময় নিয়ে ভেবে চলেছে রুদ্রর এমন সিদ্ধান্তের কারণ।

—————

প্রিয়তা বিছানার হেডরেস্টে হেলান দিয়ে বসে আছে। আবার কালো রঙের একটা টেন-টপ পড়ে নিয়েছে ও। ক্ষতস্থানে আরাম লাগে। গভীর চিন্তায় মগ্ন প্রিয়তা। ফোন নেই ওর কাছে। কারো সঙ্গে যোগাযোগের উপায়ও নেই। সত্যি বলতে আপাতত সেই ইচ্ছেটাও নেই ওর। কিন্তু অনেককিছু মিলছে না যা ওর মেলানোর চেষ্টা করছে। 
দরজা খোলার শব্দে ধ্যান ভাঙে ওর। রুদ্র এসেছে। রুদ্রকে দেখে সোজা হয়ে বসে প্রিয়তা। কাঁধে একটু টান লাগলে নিজেকে সামলে নেয়। কিন্তু রুদ্র আসলেও তাকিয়ে দেখল না প্রিয়তার দিকে। কাবার্ড থেকে নিজের টিশার্ট আর জিন্স নিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে। প্রিয়তা হতাশ হয়ে আবার হেডরেস্টে হেলান দিল। আস্তে করে বন্ধ করল চোখজোড়া। ক্লান্ত লাগছে ভীষণ। আপাতত আর কোনকিছু ভাবার শক্তি অবশিষ্ট নেই। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও টের পায়নি। 

প্রিয়তার যখন ঘুম ভাঙল তখন সন্ধ্যা হয়েছে। চোখ খুলে কিছুটা ধাতস্থ হতেই চারপাশে উদ্ভ্রান্তের মতো তাকায় ও। ঘরটাতে কেবল একটা টেবিলল্যাম্প জ্বলছে। যার ফলে হলদেটে আলো ছড়িয়ে আছে রুমে। রুদ্র কী চলে গেছে? প্রশ্নটা মনে আসতেই আরও একবার আশেপাশে তাকাল প্রিয়তা। কিন্তু বারান্দা থেকে নিকোটিনের গন্ধ আসতেই বুঝল রুদ্র বারান্দায় আছে। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল ও। আস্তেধীরে বিছানা থেকে নামল। ধীরপায়ে এগিয়ে গেল বারান্দার দিকে। প্রিয়তা দেখল ওর ধারণাই সত্যি। রেলিং ওপর একহাত রেখে অপর হাতে সিগারেট টানছে রুদ্র আমের। পরনে মেরুন একটা ফুলহাতা গেঞ্জি আর জিন্স। দৃষ্টি অদূর শূণ্যে। প্রিয়তা মৃদু স্বরে ডাকল, 'রুদ্র?'

রুদ্র মুখে সিগারেট নিতে যাচ্ছিল। থেমে গেল প্রিয়তার ডাকে। গম্ভীর গলায় বলল, 'কিছু লাগবে?'

' আমায় আমের ভিলায় যেতে দিলেন না কেন?'

রুদ্র কোন জবাব দিলোনা। পুনরায় সিগারেট পুড়ে নিল পাতলা পুরুষালি ঠোঁটের মাঝে। প্রিয়তা ভ্রুকুটি করে বলল, 'কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি।' 

কিন্তু রুদ্র এবারও নিরুত্তর। প্রিয়তা আরও জোরে ডাকল, 'রুদ্র!' 

রুদ্র আচমকাই আধপোড়া সিগারেটটা চেয়ারে রাখা অ‍্যাশট্রেতে ফেলে দিল। অতঃপর প্রিয়তাকে পাশ কাটিয়ে ফিরে এলো রুমে। কোনদিকে সোজা পা বাড়াল কাবার্ডের দিকে। রুদ্র কাবার্ড খুলতেই যাচ্ছিল। প্রিয়তা এসে হাত ধরে ফেলল, 'আমার প্রশ্নের উত্তর দিন আগে। আমের ভিলায় কেন যেতে দিলেন না আমাকে?'

রুদ্র তাকাল প্রিয়তার দিকে। সাবলীলভাবে বলল, 'পরপর দুটো ডেলিভারী বানচাল করেছি তোমাদের। এই মুহূর্তে পাগল কুকুরের চেয়েও হিংস্র হয়ে আছো তুমি। যাকে সামনে পাবে কামড়ে দেবে। আমার পরিবারের আর একটা সদস্যকে নিয়েও রিস্ক নেবনা আমি।'

প্রিয়তা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল রুদ্রর মুখটার দিকে, 'এটাই কারণ?'

রুদ্র ভ্রু উঁচু করে বলল, ' যথেষ্ট নয়?'

প্রিয়তা কিছু না বলে চোখ নামিয়ে ফেলল। রুদ্র আবার ঘুরলো কাবার্ড খুলতে। রুদ্র কাবার্ড খুলতে খুলতেই হঠাৎ বেজে উঠল ওর ফোনটা। রুদ্র ভ্রু কুঁচকে পকেট থেকে নিজের ফোন বের করল। ফোনের স্ক্রিনটা একবার দেখে রেখে দিল আবার নিজের পকেটে। কিন্তু প্রিয়তা স্পষ্ট দেখতে পেল, স্ক্রিনে থাকা হুসাইন আলী নামটা। থমকে গেল প্রিয়তা। কিছুক্ষণের জন্যে যেন ঝিম ধরে গেল মাথায়। কিছু একটা ভাবল ও। চতুর মস্তিষ্কের কিছুক্ষণের ভাবনাতেই যেন মিলে গেল একটা হিসেব। রুদ্রর কাজের মাঝেখানেই প্রিয়তা আবার হাত ধরে ঘোরালো নিজের দিকে। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, 'পরপর দুবার সফল হয়েছেন আপনি। কীভাবে? প্রথম ডেলিভারীর সময় অতো স্কিলড লোক আর ভারী অ*স্ত্র! হুট করে আসেনি। দুবাই! হ্যাঁ দুবাই গিয়ে কিছু একটা করেছিলেন আপনি সেটা আমি বুঝেছি। কিন্তু কিছু করতে হলেওতো এদিকের কোন না কোন ইনফরমেশন প্রয়োজন। সেটা কীভাবে পেলেন? প্রথমবার ডেলিভারির মাল কোথায় আসবে সেটাইবা কীকরে জানলেন? আর দ্বিতীয় বার? ঐবার ঐ মিটিংয়ের ছ'জন ছাড়া কেউ জানতোনা পাসকোড কী, কোথায়, কীভাবে মাল আসবে। আর এই ছ'জনের কেউই কোন তথ্য ফাঁস করবেনা। নিজের স্বার্থেই করবেনা। তাহলে আপনার পক্ষে জানা সম্ভব হল কীকরে? কীকরে খুললেন কন্টেইনার? আর হুসাইন আলীর সঙ্গে আমার মিটিংটা সম্পর্কেও আপনি জানেন তাই না?'

রুদ্র জবাব দিলোনা। হাত ছাড়িয়ে আবার ঘুরতে গেল। কিন্তু জোরপূর্বক আবার নিজের দিকে আবার ঘুরিয়ে নিল প্রিয়তা। কাধের ব্যথা ভুলে চেপে ধরল রুদ্রর কলার। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, 'আনসার মি রুদ্র।'

রুদ্র নিজের দুহাত দিয়ে কলারে রাখা প্রিয়তার হাত দুটো থেকে ছাড়াতে বলল, 'ওয়েল! আ'ল আন্সার। বাট তুমি সহ্য করতে পারবেতো?'

প্রিয়তা সেই একই গলায় বলল, 'আমি যা অনুমান করেছি আমার বিশ্বাস তা সত্যি না। হতে পারেনা। আনসার মি!'

রুদ্র ধীরগতিতে নিজের তীক্ষ্ম চোখজোড়া নামিয়ে নিল প্রিয়তার গলায়। যেখানে জ্বলজ্বল করছে ওর দেওয়া সেই লকেটটা। ওদের বাসররাতে কত ভালোবেসে, যত্ন নিয়ে রুদ্র পরিয়ে দিয়েছিল প্রিয়তার গলায়। রুদ্র একহাত বাড়িয়ে আলতো করে ধরল সেই লকেটটা। সেটাতে মৃদু টান দিয়ে প্রিয়তাকে নিয়ে এলো নিজের একদম কাছে। নিজের কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল, 'কেনো? অনুভূতি নিয়ে খেলার অধিকার শুধু তোমারই আছে, রাণী মীর্জা?' 

প্রিয়তা বিস্ময়সমেত চোখ নামিয়ে তাকাল লকেটটার দিকে। রুদ্র খাদে নামানো কন্ঠেই বলল, 'Atto Digital এর TileRec মাইক্রোফোন। পরিচিত লাগছে নামটা?'

বিস্ফোরিত হয়ে উঠল প্রিয়তার অমায়িক চোখজোড়া। বিস্ময়ে কেঁপে উঠল অধোরষ্ঠ। চরম অবিশ্বাসে হালকা করে মাথা নেড়ে বলল, 'ন্ না! মিথ্যে বলছেন আ-আপনি।'

নিষ্ঠুরভাবে হাসল রুদ্র। নির্বিকারভাবে বলল, ' সত্যি বলছি। আর খেলাটা কবে থেকে শুরু হয়েছে জানো? শেষবার যখন আমি তোমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম, তখন থেকে।'

প্রিয়তা চকিতে চাইল। রুদ্র বলে চলল, ' আসলে আমি ঘুমোনোর সময় ব্রেসলেট খুলে রাখলেও তুমি ঘুমোনোর আগে ওটা খুলতেনা। খোলার জন্যে কোন একটা বাহানাতো চাই তাই না? প্রথমবার দিয়ে শুধু এইটুকুই নিশ্চিত হয়েছিলাম যে আমার দুবাই মিশন সম্পর্কে তুমি কতটা জানো। আর দুবাই থেকে ফিরে এসে তোমাকে হাতেনাতে ধরার পরেও আমের ভিলায় থাকতে দেওয়ার পেছনেও এটাই কারণ।'

প্রিয়তা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। চোখজোড়া টলমল করছে ওর। রুদ্র লকেটটা ছেড়ে দিয়ে বলল, 'বোঝনি? আরে ব্যাটরি চেঞ্জ করতে হতোতো। তারজন্যে অন্তত দিনশেষে আমার ঘরেত দরকার ছিল তোমাকে। তবে সেক্ষেত্রে তোমার ট্রিকটাই ফলো করতাম আমি।' প্রিয়তার চোখে তখনও প্রশ্ন। তা দেখে রুদ্র বলল, 'এটাও বোঝনি? ঘুমের ঔষধ!'

প্রিয়তা তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে। বাঁ চোখের জলটুকু গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। রুদ্র যেন দেখলোই না সেটা। লকেটটা খুলতে উদ্ধত হয়ে বলল, 'এখন আর এটার কোন দরকার নেই। না তোমার, না আমার।'

সঙ্গেসঙ্গে লকেটটা ধরে ফেলল প্রিয়তা। ভীষণ শক্ত করে। কিন্তু দৃষ্টি তখনও রুদ্রর দিকে স্থির। একই ভঙ্গিতে। তা দেখে হাত সরিয়ে নিল রুদ্র। কাধ ঝাঁকিয়ে বলল, 'এজ ইওর উইশ।'

বলে আর দাঁড়াল না রুদ্র আমের। কাবার্ড থেকে নিজের জ্যাকেট নিয়ে সাবলীলভাবে বেরিয়ে গেল। কিন্তু প্রিয়তা! প্রিয়তা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ওখানেই। একা! নড়ল অবধি না। দাঁড়িয়ে রইল স্থির পাথরের মতো। ওভাবেই কেটে গেল অনেকটা সময়। হঠাৎ প্রবল ধাক্কায় টেবিল ল্যাম্পটা নিচে ফেলে দিল প্রিয়তা। ভেঙে কয়েক টুকরো হল ওটা। নিভে গেল ঘরের অবশিষ্ট আলো। প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে ফ্লোরে বসে পড়ল প্রিয়তা। হাঁটুর ওপর দুহাত রেখে চিৎকার করে কাঁদল। অন্ধকার ঘরটাতে প্রিয়তার হৃদয়বিদারক চিৎকার দেয়ালগুলোকেও যেন কাঁপিয়ে তুলল। ভাগ্যিস ফ্ল্যাটে এখন আর কেউ নেই। যদি কেউ থাকতো, প্রিয়তার এই আর্তনাদে অন্তরাত্মাও কেঁপে উঠতো তার।
.
.
.
চলবে....…................................................................

—————

সংক্ষেপ কথাঃ—

          প্রশ্ন হল, রুদ্র আমের প্রিয়তার লকেটে মাইক্রোফোনটা কী বাসররাতেই দিয়েছিল? উত্তর হচ্ছে না, রুদ্র যখন লকেটটা প্রিয়তাকে পরিয়ে দেয়, সেটা ভালোবেসে উপহার হিসেবেই পরিয়ে দিয়েছিল। কোনকিছু ভেবেচিন্তে দেয়নি। এবং পরবর্তী দু'বছরও সেখানে কোন মাইক্রোফোন ছিলো না। তাহলে এবার প্রশ্ন থাকে, তাহলে রুদ্র কখন লকেটে মাইক্রোফোন সেট করল? এর উত্তরও গতপর্বটাতেই দেওয়া আছে, রুদ্রর একটা লাইন আছে যেখানে ও প্রিয়তাকে বলছে, খেলাটা সেদিনই শুরু হয়েছে যেদিন ওরা শেষবার ঘনিষ্ঠ হয়েছিল। শেষবার ঘনিষ্ঠ হয়েছিল কখন? ৯৯ তম পর্বে। রুদ্রর দুবাই যাওয়ার আগ দিয়ে। রুদ্র এটাও বলেছে, প্রথমবার মাইক্রোফোন লাগিয়েছিল প্রিয়তা দুবাই মিশনটা সম্পর্কে কিছু জানে কিনা তা জানার জন্যে। আর ফিরে আসার পর রাণী মীর্জা রূপে প্রিয়তার মুখোমুখি হওয়ার পরেও আমের ভিলায় কেন ওকে থাকতে দিয়েছিল সেটাও কিন্তু বলেছে রুদ্র। রুদ্রর ব্রেসলেটের মতোই একমাত্র লকেটটাই পড়ে থাকতো প্রিয়তা। তাই ঐ লকেটটাই ছিল রুদ্র আমেরের জন্যে সেরা অপশন। লাইনগুলো আরেকবার পড়লেই ঠিকভাবে বুঝে ফেলবেন সবটা। গতপর্বে বিষয়গুলি এতো ভেঙ্গে ভেঙ্গে বলা হয়নি, কারণ প্রিয়তার রুদ্রর দেওয়া ছোট্ট ইঙ্গিতেই বিষয়গুলি বুঝে ফেলার ব্যপারটা দেখানো হয়েছে।

আশা করি বিষয়টা এখন মোটামুটি সবার কাছেই ক্লিয়ার। তারপর কোন প্রশ্ন থাকলে জিজ্ঞেস করবেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp