ঘর জুড়ে বউ ঝিয়ের চাঁপা গুঞ্জন। গ্রামের অধিকাংশ ঝি বউ বর্তমানে সুরেলাদের দোচালা ঘরে অবস্থান করছে। সকলের মধ্যমণিতে শীতল পাটিতে বসে থাকা নব বধুয়া। মলিন মুখে মাথা নত করে বসে আছে সে। লাজুক হাসি মুখে লেপ্টে নব বধুয়ার পাশে বসে আরিফা। পিটপিট চোখে সুরেলাকে দেখে যায়। মেয়েটার চোখ মুখ শুকনো কেন? সে যতগুলো বিয়ের কণে দেখেছে সবার মুখটাই শুকনো আর মলিন ছিলো। অথচ নিজ বিয়ের কথা শুনলে তাঁর লজ্জা লাগে। সে ফিসফিসিয়ে বলে,
" রূপসা ঠিক বলে তোমার চোখ অনেক সুন্দর; আর হাসলে নাকি চোখ জ্বল জ্বল করে। বড় ভাবী একটু তো হাসো?"
সুরেলা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসার চেষ্টা করে অল্প। তবে হাসিটাও বেঈমানি করে বসে। প্রাণহীন হাসিতে কান্তিমান নয়ন যুগল জ্বল জ্বল করলো তবে তা নোনাজলের বদৌলতে। আরিফার মুখটা চুপসে যায়। শাপলা সুরেলার অপর পাশেই বসে ছিলো।সে হেসে আরিফার উদ্দেশ্য বলে,
"কি কন বিয়ানসাব? কই আমি তো কুনোদিন দেহি ন্যাই! ও সুর আপা এতজাল্লা হাসো দেহি?"
সুরেলা শান্ত চোখে চাইলে শাপলা মুখ বাঁকায়। দুই ভাই-বোন সমান সমান। কিছু কইলে এমন কইরা চাইয়্যা থাহে বুকটা ছ্যাত করে ওঠে। সে লাগেজ হাতিয়ে দেখে। দু'টো লাগেজ এসেছে তত্ত্ব হিসেবে। এক লাগেজ বধুয়ার সখি, ভাবী, দাদী, যারা বধুয়াকে সাজিয়ে দিবে তাদের সবার উপহার। অপর লাগেজে সব বউয়ের জিনিসপত্র। যা এখনো তালাবদ্ধ। চাবি বধুয়ার ননশ্বাসের কাছে। অথচ তাঁর ধরা পাত্তাই নেই। এই নিয়ে কানাঘুষা চলছে। আইয়ালী বেওয়া সবাইকে ধমকে থামিয়ে দেয়। ইশারায় আরিফা কে দেখিয়ে বোঝায় বরযাত্রীর একজন এখানেই উপস্থিত। সবাইকে চুপ করতে বলে আইয়ালী বেওয়া ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে সুরেলার ডাকে এগিয়ে আসে।
" ভাইকে একটু ডাক দে না বু!"
কন্ঠ জড়িয়ে আসে সুরেলার। আইয়ালী বেওয়া সুক্ষ্ম চোখে চায়। এই ভাইবোনের মাঝে কি হলো? দুজনে তো একে অপরকে চোখে হারায়। কিন্তু আসার পর থেকেই দেখছে দু'জনের মাঝে কেমন নীরব ভাব বিদ্যমান।
"ওলে আমার ভাইয়ের পুতুল! ভ্যা ভ্যা হরা বাদ দে। ওহন জামাইয়ের নাম জপবার বয়স বুঝলি?"
উপস্থিত জনরা হেসে ওঠে। বউয়েরা মুখে আঁচল গুঁজে লুকিয়ে লুকিয়ে হাসে। সুরেলার মুখে হাসি ফুটে না। করুণ চোখে চায়। আইয়ালী বেওয়া হয়তোবা নাতনীর না বলা কথা বুঝতে পারলো। মাথায় হাত রেখে বলে,
"বুবু মাইয়াগোরে ঘরদোর নাই। তয় বাপের ঘর, শশুর ঘর ছলপলের বাড়িঘর আছে । বাপ ভাইয়ের ঘরে আমরা মেহমান, শ্বশুরের ঘরে হইলাম কাজের ঝি আর ছলপলের ঘরে বোঝা। বুঝছোস?"
সুরেলার মুখ নত হয়ে আসে। তবুও মেনি গলায় ভাইকে ডাকতে অনুরোধ করে। আইয়ালী বেওয়া হতাশ। এদিকে বোন ভাই ভাই বলে ঘ্যান ঘ্যান করছে ওদিকে ভাইয়ের কাছেই যাওয়া যাচ্ছে না।
"তোর ভাইয়ের কাছে যাওয়া যায়? যাওয়ার আগেই 'সর বুড়ি সর দূর হ' বলে খেঁকিয়ে ওঠে। শাপলা পাগুলনিরে পাঠা?এই পাগুলনি যা পাগলারে ডাইক্যা আন? যা?"
শাপলা দাঁতে নখ খুঁটে বোকা বোকা হাসে। বুড়ি তাকে পাগুলনি আর সিন ভাইরে পাগল ডাইক্যা কি বুঝাইলো? আইয়ালী বেওয়া আবারও ধমকাতেই শাপলা ছুটে বেরিয়ে যায় সিনান সালেহকে ডাকতে। তবে ক্ষণপল পরেই ভোঁতা মুখে ফিরে আসে। মুখ দেখে বোঝা যায় ঝাড়ির সাথে চাটা মুফতে খেয়ে এসেছে।
"তোমার তার-ছেড়া ভাই মানুষ না গিরগিটি বুজছো সুর আপা? সেকেন্ডে সেকেন্ডে রং পাল্টায়। গাল তো দিলই ঠাস করে মাথায় মারলো। বদ দোয়া দিলাম বউয়ের ঠ্যাঙানি জুটবো কপালে হুঁ!"
শাপলা ভর্ৎসনার সুরে বলে উঠে সুরেলার পাশে গালে হাত দিয়ে বসে পড়ে। আইয়ালী বেওয়া তাঁর গাল টিপে বলে,
"যাঁগোর মেজাজ সবসময় আসমানে চইড়্যা থাহে তাঁরা বউরে বড়ো ভালা পায় বুজছু হতিন?"
শাপলা মুখ খোলে কিছু বলার জন্য। চাচিকে মলিন মুখে এগিয়ে আসতে দেখে আর বলা হয় না। শান্তি বেগম এগিয়ে এসে মেয়ের সামনে বসে। আঁখি পল্লব ভিজে আছে তাঁর। মেয়ের বিদায় নিশ্চয়ই সুখপাঠ্য না! তবুও অনেক কষ্টে মুখে হাসি ফুটিয়ে মেয়ের গাল আঁজলায় ভরে। স্নেহ ঢেলে চুম্বন করেন মেয়ের ললাটে। একটু জড়তা কাজ করে মাঝে। শেষ কবে মেয়েকে চুমু এঁকেছিলেন মনে নেই। ছোট বেলায় ছেলে মেয়ে বাবা মায়ের আহ্লাদী থাকলেও বড় হওয়ার সাথে সাথে অদৃশ্য জালে জড়তা এসে যায় না চাইতেও।
সুরেলার ভেজা চোখ ভরে উঠতে সময় নেয় না। মায়ের দুই হাত গালে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে বলে,
"মা তোর ছনের ঘর আমার ভাল লাগতো না। বাদলা দিনে পানি পড়ে, কেঁদো কেঁদো হইয়া যায়, ঝড়ে উইড়া যায়। শীতের দিনে ঠান্ডা বাতাস আইসে। দেখ সেই ঘর ছাইড়্যা যাইতে আমার কষ্ট হইতাছে। আমারে তোর ছনের ঘরেই রাইখ্যা দে মা? আর কোনো আবদার করমু না।"
শান্তি বেগম মেয়েকে টেনে বুকে জড়িয়ে কেঁদে ওঠে গুনগুন সুরে। সুরেলা 'ও মা মা রে' জপে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। মুহুর্তেই পুরো ঘর জুড়ে মা মেয়ের কান্নায় স্তব্ধ হয়ে ওঠে। শাপলার নাকের জল চোখের জল একাকার। উপস্থিত বউদের চোখজোড়াও ভিজে ওঠে। হয়তোবা স্মৃতির পাতায় এরকম একটা মুহূর্ত উঁকি দিয়ে বেড়ায়। সুরেলার কান্নার সুরে ভারী হয়ে আসে পরিবেশ। আইয়ালী বেওয়া মেয়ে নাতীন দু'জনকেই বোঝায়। মন কি আর সেই বুঝ মানে? তাদের কান্নার আওয়াজ বাইরে ভেসে যায়। সালেহউদ্দিন ঘরে এসে চুপ করতে বলে তাদের। শোনে না কেউই, বিরক্ত হয়ে চলে যান তিনি। সিনান সালেহের কাছে কান্নার খবর পৌঁছাতেই পড়নের লুঙ্গি হাঁটুর উপর ভাঁজ করে গিঁট মেরে দোর গোরে দাঁড়ায়। চাপা স্বরে ধমকে বলে,
"মানষের আর বিয়া হয় না, না? মরা বাড়ি বানাইছোস মায়ে বিটি মিইল্যা। ময় মুরুব্বি বুঝোষ না? কান্দবি কান্দেক; পাশের মানষে টের পাইবো না! তোরা পুরা মহল্লায় মাইকিং দেস। চুপ কর নইলে গলায় পাড়া দিয়া ধরমু?"
গ্রামের ঝি বউরা মুখে আঁচল টেনে আড়াল হয়। সিনান সালেহের মেজাজ গায়ের অলিতে গলিতে রপ্ত। শান্তি বেগম আঁচলে চোখ মুখ মুছেন। সুরেলার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত হতে বলে। সুরেলা কান্নার শব্দ বন্ধ হয়। মা'কে ছেড়ে টলমল চোখে ভাইয়ের দিকে তাকায়। সিনানের মুখ চোপায় বিরক্তি ঠিকরে পড়ছে। সে কিছু বলবে দোর গোড়ায় আরো কয়েকজনের উপস্থিত বুঝতে পারে। তারপর সেই চিরচেনা গমগমে আওয়াজ ভেসে আসে।
"কোনো সমস্যা সিন?"
সুরেলা ফোঁপানি থেমে যায়। শান্ত জল ভরা চোখে ভাইয়ের দিকে চায়। সিনান তাকায় না। ঘুরে নওরিজের উদ্দেশ্যে বলে,
"না ভাই। মেছল মানুষ বুঝেনই তো।"
"মওলানা সাহেব এসেছেন। সময় বেশি নেবেন না। তারাবীহ নামাজ আছে আবার। ঈশার ওয়াক্তের আগেই সব সমাধান করতে হবে। রিন? যা ওকে রেডি করা?"
নওরিজের ভারী গলার পৃষ্ঠে নওরিন সায় জানিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। হঠাৎ থেমে ঘার ঘুরিয়ে সিনানের দিকে তাকিয়ে বলে,
"মেয়ে হলে বুঝতি বিয়োগ বেদনা কতটুক। নিজ ভিটে মাটি, খেলার সাথী, আপনজন, সব ছেড়ে অচেনা জায়গায় নিজেকে মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়া কতটা যন্ত্রণার।"
কেউ জ্ঞান দিবে আর সিনান সালেহ হজম করবে এমনটা হতেই পারে না। নওরিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই সিনান ফটুয়া। নওরিন একটু অপমানিত বোধ করে। কি দরকার ছিলো যেচে জ্ঞান দিতে যাওয়ার? এই অসভ্য বেয়াদব সিনানকে তার কোনোকালেই পছন্দ ছিলো না। সে থমথমে মুখে ভেতরে গিয়ে পাটিতে বসে লাগেজ খোলে।
দরজার ওপাশে নওরিজ মাহবুব সুক্ষ্ম চোখে চায়। মানুষের ভিড়ে কাঙ্ক্ষিত রমনীর দেখা মিলে না তাই প্রস্থান নেয়।
"গয়না ছিলো লাগেজে তাই তালা দিয়ে রাখা হয়েছে।চাবি আমার কাছে না রিজের কাছে ছিলো তাই কানাঘুষো বন্ধ করুন। কান আমাদেরও আছে।"
বলতে বলতে নওরিন লাগেজ হতে শাড়ির প্যাকেট খুলে বের করে সুরেলার কোলে রাখে। আইয়ালী বেওয়া প্যাকেট খোলে; লাল বেনারসী সাথে ব্লাউজ পেটিকোট।
"তরা বুবুরে মেন্দি লাগাইতে চাইলি ভাগ্যিস আমি জোর কইরা আলতা পড়াইছি! ওহন লাল বেনারসীর লগে আলতা কুমকুম লাগাইলে চোখ ফিরান পারবো না নাতজামাই। বুবু ব্লাউজ পেটিকোট পিন্দেক নে ধর?'
শান্তি বেগম জল ভরা চোখে হাসে। উঠে যাবে নওরিন তাঁর হাতে গয়নার বাক্স ধরিয়ে বলে,
"ওর গয়নাগাটি। ভাই গড়িয়েছে, আপনিই পড়িয়ে দিন!"
শান্তি বেগম ইতস্তত বোধ করেন। নওরিনের জোড়াজুড়িতে বাক্স খুলতেই বিস্ময়ে মুখ হাঁ হয়ে যায়। সিতাহার, দুই জোড়া বালা, দুই জোড়া ঝুমকা, নাকশলা, নথটানা আর কোমড়ের বিছা, মাথার টিকলিও আছে। শান্তি বেগমের চোখ জ্বল জ্বল করে। এতো গয়না একসাথে প্রথমবার দেখলো। সব নতুন গয়না যেন জ্বল জ্বল করছে। তিনি মেয়ের দিকে তাকান। মেয়ের যে সোনায় সোহাগা ভাগ্য। সুরেলা কান্নাভেজা মুখশ্রীও অবাক। এতো গয়না?
নওরিন নিজ হাতে সাজায় ভাই বউ কে। আটপৌরে শাড়ি পড়িয়ে কোমড়ে স্বর্ণের বিছা আঁটকে দেয়। দু জোড়া বালার মধ্যে মোটা কারুকাজে আঁকা বালা জোড়া সুরেলার হাতে পড়িয়ে দিলো। বড় চুল খোঁপায় বেঁধে গোলাপ গুঁজে দেয়। কানে ঝুমকো, মাঝ সিঁথিতে টিকলি সাজিয়ে, কপাল হতে গাল অবদি লাল সাদা কুমকুম আঁকিয়ে দেয় নিপুণ হাতে। কাজল কালো কান্তিমান আঁখি যুগলে কাজলের বক্ররেখা। শুকনো অধরে লাল টকটকে লিপস্টিক লাগিয়ে নওরিন হাঁফ ছাড়ল।
"এখন বুঝলাম রিজ কেন পাগল হলো। মন্দ লাগছে না সুর। আমার দেখা সুন্দর বউ।"
নওরিন অতি স্বাভাবিক ভাবেই বলে সুরেলার মাথায় বউ ওড়না দিয়ে ঘোমটা টেনে দেয়। সুরেলা শান্ত চোখে চায় নওরিনের দিকে । রিন আপু তাঁর ভাইয়ের মতোই গম্ভীর আর রাগী স্বভাবের। সে তো দূরে দূরেই থাকতো।
উপস্থিত সকলেও প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আইয়ালী বেওয়া সুরেলার আঁচলে আগুন দিয়ে সামান্য সুতো পুড়িয়ে দেয়। আঁচলে রসুন গিঁট দেয়। নতুন বউয়ের উপর ভুত প্রেত বা কোনো মানুষের নজর না লাগে যেন। নওরিন বিরোধীতা করে; এসব কুসংস্কার। রিজ ভাই জানলে রেগে যাবে। আইয়ালী বেওয়া মুখ মুচড়িয়ে বলে,
" সব জায়গায় ভাব দেহাইতে আসবি না বুঝলি? চুল এমনে এমনেই পাকে নাই। মুখ চোপা ঠিক কর তাকান যাইতেছে না। আমরা গরিব তয় দিল ছুডো না। তোগোর মতোই রক্ত মাংসে গড়া মানুষ।নাক ছিটকনোর কি আছে? নাকি গরিব গরিব গন্ধ লাগতেছে?"
অপমানে নওরিনের মুখ থমথমে। চুপ না থেকে খানিকটা ঠেস দিয়েই বলে,
"পরিস্থিতি বুঝেন না আপনারা। গতরাতের ডাকাত আক্রমণের কথা নিশ্চয়ই জানেন? হাসপাতালের কামড়ায় পিচ্চি বাঁচার জন্য লড়াই করছে। ভাইকে বাইরে থেকে দেখছেন ফিটফাট। হাতে পিঠে স্টিচ লেগেছে বারোটার মতো। ডাক্তার পুরো বেড রেস্টে থাকতে বলেছে। ভাই আপনাদের মেয়ের উপর কেউ কথা না বলুক তাই অসুস্থ শরীর নিয়েই ছুটে এসেছে। জ্বরে গায়ে হাত দেওয়া যাচ্ছে না। আর আমি ফ্যাক ফ্যাক করে হাসবো তাই না? আমার ওতো হাসি আসে না দাদি। জলদি করুন আপনারা। হাতে সময় নেই।"
সুরেলা অবাক চোখে চায়। তারা তো জানে শুধু রূপসা আহত হয়েছে। সুরেলার হাত পা জমে আসে ঠান্ডায়। লোকটার খুব বেশি লেগেছে? বৃদ্ধা আইয়ালী বেওয়া মুখ মুচড়ায়। মেয়েটা ভারী বেয়াদব। অহংকারে পা মাটিতে পড়ে না। এর মাঝেই সিনান এসে জানায় মওলানা সাহেব বিয়ে পড়াবেন। যতটুকু সাজানো হয়েছে ততটুকুই থাক শুধু ঘোমটা টেনে দিক মওলানা সাহেব, মুরুব্বি-সাক্ষী সমেত আসছে।
—————
মওলানা সাহেব সহ মুরুব্বি গুরুজন বসে বধুয়ার সামনের শীতল পাটিতে। বিদ্যুতের অবর্তমানে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে বধুয়ার সম্মুখে পাটিতে রাখা হয়েছে। আঁধার ভিড়ে দাঁড়িয়ে সবাই। মওলানা সাহেব নতুন বউয়ের সম্মুখে দোয়া দরুদ পাঠ করার পর নিকাহনামায় বউয়ের অনুমতি নিজ কানে শুনবে। মওলানা সাহেব বধুয়া সহ সকলকে তিনবার করে সুরা ফাতিহা, সুরা ইখলাস আর দরুদ শরীফ পাঠ করতে বলে। দোয়া দরুদ পাঠ শেষ হলে মওলানা সাহেব বলেন,
" জনাবা সুরেলা সালেহ,
নোমান মাহবুবের একমাত্র পুত্র নওরিজ মাহবুব খানের..."
থেমে যায় মওলানা সাহেব। দরজা দিয়ে প্রবেশ করে খোদ নওরিজ মাহবুব। সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে নওরিজ অল্প হেসে এগিয়ে আসে। নওরিনের স্বামী ইকরাম উল্লাহর পাশে বসে বলে,
"তাঁর কবুল বলা আমিও শুনি। তাছাড়াও সময় নেই হাতে; হুজুর সাব?একসাথেই বিয়ে পড়ানো যায় শুনেছি! ভুল শুনেছি নাকি?"
মওলানা আবদুল হামিদ পাকা দাঁড়িতে চিরুনি চালিয়ে হাসে । ইকরাম উল্লাহ নওরিজের পেটে কনুই মেরে বলে,
"এতো অধৈর্য হলে চলে শালাবাবু? তোমারই বউ। আর কেউ না তুমিই নিয়ে যাবে। আসার পর থেকেই বাচ্চাদের মতো জলদি করেন সময় নেই হ্যান ত্যান লাগিয়ে দিয়েছো। বলি তুমি বর রুমাল দিয়ে নাক মুখ ঢেকে চুপ করে বসে থাকবে। একটু আকটু লজ্জা পাবে। আর সময় হলে কবুল বলবে ব্যস। তা না! তোমার থেকে এটা আশা করি নি রিজ!"
নওরিজ মাহবুব মৃদুস্বরে কেশে বলে, "নিজের বিয়ের কথা ভুলে যাচ্ছেন কেন দুলাভাই?"
"বর মশাই বেশি কথা বলো না। কনের দিকে একনজর তাকাও দেখি?"
ইকরাম উল্লাহ বলে সম্মুখে তাকাতে ইশারা করে। সে খেয়াল করেছে নওরিজ সামনে তাকাচ্ছে না। অথচ দুই তিন গজ পরেই তাঁর নববধূ ঘোমটা টেনে বসে আছে নত মুখে। নওরিজ তাকায় না। ইকরাম উল্লাহর দিকে খানিকটা বেঁকে এসে ধীমান ভরাট গলায় বলে,
"সর্বনাশা কালবৈশাখী সে। সব তছনছ করে দিবে দুলাভাই!"
ইকরাম উল্লাহ দুষ্টু হাসে। নওরিজ ধরাছোঁয়া দেয় না।
—————
ঘরে গুমগুমে নিস্তব্ধতা। বাহিরে বহমান শীতল বাতাস পর্যন্ত থমকে গেছে যেন। সিনান দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে বুকে হাত গুটিয়ে। মুখাবয়ব অতি শান্ত। তাঁর পাশেই সজল চোখে শফি ক্ষণে ক্ষণে ফোপাচ্ছে। এ যাত্রায় সিনান সালেহ আর ধমকায় নি। শুধু একবার ভর্ৎসনা করেছে পুরুষ মানুষ কাঁদে নাকি? কান্নাকাটি মেয়েদের ন্যাকামি ছাড়া আর কি? সালেহউদ্দিন এখানে নেই বাইরে মেহমানদের সাথে বিড়ি টানছেন। শান্তি বেগম দুবার ডাকতে গিয়েছিল। ধমক খেয়ে মুখ কালো করে ফিরে আসেন । বর্তমানে অন্য ঘরের এক কোনায় বসে অশ্রু বিসর্জন করছেন। ঘরের মাঝ বরাবর হ্যরিকেন জ্বলছে টিমটিমে আলো ছড়িয়ে। এক পাশে বধুয়া অপর পাশে বর। বধুয়ার চোখে অশ্রু তো বরের চোখে এক নতুন সূচনার উদিত রাঙা অরুণ। এমন মুহূর্তে মওলানা আব্দুল হামিদ গলা খাঁকারি দিয়ে নিচু গলায় মুখ খুললেন,
"বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।
আলহামদুলিল্লাহি ওয়াহদাহু, আস-সালাতু ওয়াস সালামু আলা রাসূলিহি মুহাম্মদ ওয়া আলা আ-আ-লিহি ওয়া আসহাবিহি আজমায়ীন।
এই মজলিশে আমি আব্দুল হামিদ, শরিয়ত মোতাবেক বিয়ে সম্পাদনের উদ্দেশ্যে পাত্র-পাত্রীর পক্ষ, অভিভাবকবৃন্দ ও সাক্ষীগণের উপস্থিতিতে বিবাহের ঘোষণা প্রদান করিতেছি।
পাত্র নওরিজ মাহবুব খান, পিতা নোমান মাহবুব খান_ যিনি তাহার পিতা-মাতার একমাত্র এবং জ্যেষ্ঠ পুত্র।
কনে সুরেলা সালেহ, পিতা সালেহউদ্দিন আহমেদ— এক নিম্নবিত্ত পরিবারের সুশিক্ষিতা কন্যা।
মোহরানা ধার্য করা হইয়াছে— নগদ ষাট হাজার টাকা ও আট ভরি স্বর্ণালঙ্কার।
প্রথমে আমি বরের পক্ষ হইতে ওয়াকিলের মাধ্যমে পাত্রী সুরেলা সালেহের নিকট বিবাহের প্রস্তাব পেশ করিতেছি।"
মওলানা সাহেব থেমে পাঞ্জাবির পকেট থেকে ওয়াকিলনামা বের করে চোখ বুলিয়ে বলেন,
"সুরেলা বিনতে সালেহউদ্দিন আহমেদ, আপনি কি পিতা-মাতার পরামর্শক্রমে, স্বজ্ঞানে, স্বইচ্ছায় ও সম্পূর্ণ সন্তুষ্টির সাথে মোহরানা ষাট হাজার টাকা ও আট ভরি স্বর্ণালঙ্কার ধার্য করিয়া, নওরিজ মাহবুবকে আপনার জীবনসঙ্গী হিসাবে কবুল করিতেছেন?"
নওরিজ এযাত্রায় মুখ তুলে। বধুয়ার মুখপানে দৃষ্টি স্থির হয়। সোনা রাঙা আলোয় সোনা বরণ মুখ ঘোমটার আড়ালে লুকিয়ে। সুরেলার ভেতরটা থমকে যায়। অশ্রুরা আবারও ভিড় জমায়। এমন একটা মুহূর্ত কিছুদিন আগেও তাঁর জানালায় উঁকি দিয়েছিল। সেবার যে স্নেহময় মুখশ্রী ভাসছিল মানসপটে সে আজ সম্মুখে দন্ডায়মান। সুরেলা ঘোমটা তুলে সরাসরি ভাইয়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। সিনান সালেহ বোনের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। চোখাচোখি হতেই নজর সরিয়ে এদিকে ওদিকে তাকায় তবে সুরেলার দৃষ্টি স্থির। লাল টকটকে অধর কাঁপছে। নওরিজ মাহবুবের শান্ত চাহনি তাঁর বধুয়াতেই নিবদ্ধ। এহেন কনে ঘোমটা তোলায় সবাই অবাক হয়। আইয়ালী বেওয়া ঘোমটা নামিয়ে দিয়ে হে হে সুরে হেসে বলে,
"ভাইয়ের এক্কেরে দুলালি! ও সিন আয় না? বুইনের পাশে বয়।"
"মেছলের ভিড়ে আমি কি করমু। তোরা আছিস উক্কামে?"
শান্ত খিটখিটে গলা সিনানের।সিনানের জবাবে নওরিজ যেন ধীরে ধীরে বুঝতে পারে সবটাই।না চাইতেও ভাই বোনের এই নীরব দ্বন্দের বীজ সেই বুনেছে। সুরেলার বুকটা হাহাকারে ভরে যায়। আইয়ালী বেওয়া মুখ ভেঙ্গিয়ে সুরেলারে তাগাদা দেয় কবুল বলার জন্যে। সুরেলা থম মেরে বসে থেকে শান্ত গলাতেই বলে,
"আলহামদুলিল্লাহ, আমি কবুল করিলাম।"
মওলানা একই প্রশ্ন দ্বিতীয়বার এবং তৃতীয়বার করেন। প্রতিবারই কনের পক্ষ থেকে একই জবাব আসে। মওলানা এবার বরপক্ষের দিকে তাকান। নওরিজ স্বাভাবিক ভাবেই বসে আছেন, দুই হাঁটুর মাঝে হাত জোড় করে রাখা। তার মুখাবয়ব একটু গম্ভীর।
"এবার আমি পাত্র নওরিজ মাহবুবের প্রতি জিজ্ঞাসা করিতেছি_
জনাব নওরিজ মাহবুব খান, আপনি কি নিজ ইচ্ছায়, সুস্থ বুদ্ধি ও পরিপূর্ণ সম্মতির সাথে, মোহরানা ষাট হাজার টাকা ও আট ভরি গহনা শর্ত পূরণ করিয়া, সুরেলা বিনতে সালেহউদ্দিন আহমেদকে আপনার স্ত্রী হিসাবে কবুল করিতেছেন?"
নওরিজ সময় না নিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
"আলহামদুলিল্লাহ আমি কবুল করিলাম।"
আবারও একই প্রশ্ন দুইবার পুনরাবৃত্ত হয়। সাথে জবাবের ।শেষে মওলানা আলতো হাসেন এবং ঘোষণা দেন,
"তাহা হইলে, শরিয়ত মোতাবেক, উপস্থিত সাক্ষী ও অভিভাবকদের সম্মতিক্রমে আমি ঘোষণা করিতেছি, নওরিজ মাহবুব ও সুরেলা সালেহ-এর বিবাহ সম্পন্ন হইয়াছে।
আল্লাহ এই নবদম্পতির মাঝে ভালোবাসা, রহমত ও বরকত দান করুন। আমিন।"
ঘরে ছড়িয়ে পড়ে নিঃশব্দ বিস্ময় আর নিঃশ্বাস গমগমানো আবেগ। কারো ঠোঁটে নীরব প্রার্থনা, কারো চোখে অশ্রুর চিকচিক। সকলের মুখে আলহামদুলিল্লাহ ধ্বনি পরিস্ফুটিত হয়। বর বধুয়া কাবিন নামায় স্বাক্ষর করে। মোনাজাতের মাধ্যমে বিয়ের কার্য সম্পাদন হতেই উপস্থিত সকলের মিষ্টি মুখ করানো হয়। দায়িত্বে নিয়োজিত সিনান সালেহ। বড় গামলায় খুরমা আর খেজুর বিতরণ করে। মওলানা সাহেব বর বধুয়াকেও দিতে বলে। নওরিজের হাতে দু'টো ধরিয়ে বোনের দিকে বাড়ায়। সুরেলা ঘোমটার আড়ালেও ভাইয়ের মুখটা স্পষ্ট দেখতে পায়। বাড়িয়ে রাখা হাত থেকে খুরমা ও খেজুর তুলে নেয়। খানিকটা হেসে বলে,
"এইভাবে পর করে দিলা ভাই?"
—————
বিয়ের পরবর্তী নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নওরিজ মাহবুব বাড়ি যাওয়ার তাড়া দেয়। এখন বিয়ে পড়ানো শেষ বউটাও তাঁর হাতের নাগালে এসে গেছে তাই কারো গাইগুই চলছে না। শাপলা অবশ্য কোমড় বেঁধে ঝগড়া করতে নেমেছিল। মায়ের চোখ রাঙানিতে না থামলেও সিনানের ধমকে লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। শফি কেঁদে কেঁদে গঙ্গা যমুনা বইয়ে দিচ্ছে, কথা বলবে কি। কবুল বলার পর থেকেই তাঁর আর শান্তি বেগমের কান্না বাঁধ ভেঙ্গেছে। তবে সুরেলা যেন নওরিজের হাতের মুঠোয় বাঁধা পুতুল। যেদিকে টানছে সেদিকেই যাচ্ছে।
"দুলাভাই আপনে এইডা করবার পারেন না! ওহনো কত্তো নিয়ম বাকি আছে। আয়না মুখ দেখোন আছে। পান, মিষ্টি, দুধ খাওন বাকি। চাচা চাচীরে আব্বা আম্মা ডাইক্যা সুর আপার দায়িত্ব পালনের ওয়াদা করতে হইবো। আমরা আপনের জুতা চুরি করুম।"
শাপলার দুঃখের শেষ নেই। এটা কোনো বিয়ে হলো? নওরিজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জখমিত শরীর আর চলছে না। নাই বা মন মস্তিষ্ক এসবের জন্য প্রস্তুত। ওদিকে পিচ্চিটার জ্ঞান ফিরেছে ওকে না দেখা অবদি স্বস্তি মিলবে না। নওরিন অতি সুক্ষ্মভাবে ব্যাপারটা সামলিয়ে নেয়। অবশেষে ঘনিয়ে আসে বিদায়ের মুহূর্ত। শান্তি বেগম মেয়েকে নওরিজের হাতে তুলে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সুরেলাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। ঘোমটা তুলে দিয়ে মেয়ের গালে হাত রেখে মেয়ের গালে মুখে আদর করে আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ে। তবে সুরেলা নীরবে অশ্রু বিসর্জন দেয়। অভিমানী চোখে চায় ভাইয়ের দিকে। সিনান সালেহ একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। বুকটা ভারী হয়ে আসলেও নিজেকে সামলে নেয়। সারাটা জীবন আয়না সাফ করে গেছে সে। অথচ ধুলো মুখে লেপ্টে ছিলো। বোকার স্বর্গে বাস করে সবটা উজার করে দিয়েছিল বিনিময়ে কি পেলো? থাক সেসব কথা। তবে দায়িত্ব পালনে হেরফের করে না। এগিয়ে আসে বোনের দিকে। অভিমানী চোখে চোখ রাখে। শাপলার মা এসে শান্তি বেগমকে নিয়ে যান। সিনান মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। নওরিজ মাহবুব সিনানের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে বলে,
"সিন এমন তো কথা ছিলো না।"
"সত্যিই এমনটা হওয়ার কথা ছিলো না। ওর যত্নে কমতি না থাকে রিজ ভাই।"
সিনান সুরেলার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে জবাব দিল। সুরেলা বোকা বোকা চোখে চায়। টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ে বিদায়ী অশ্রু। সিনান বুক পকেটে হতে এক জোড়া চুড়ি বের করে। নওরিজ ছেড়ে দেয় সুরেলার হাত। সিনান যত্নসহকারে চিকন ঠান্ডা হাত দুটোয় চুড়ি পড়িয়ে দেয়।
"সাধ্যের মধ্যে সেঁকরার দোকানে সবচেয়ে কম দামী চুড়ি। দামী দামী গয়নার বাক্সের এক কোণায় না হয় ফেলে রাখিস।"
সুরেলা ক্ষণিকের মান অভিমান ভুলে ঝাপিয়ে পড়ে সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বুকটায়। যে বুক তাকে জন্মের পর থেকেই আগলে রেখেছে। সিনান হাসে অল্প; শান্ত চোখে নোনাজল জমার আগেই শুকিয়ে যায় পালকির আগমনে। তাজা ফুলে সজ্জিত পালকি! তাজা ফুলের ঘ্রাণে চারপাশ মো মো করছে। সে এগিয়ে নিয়ে যায় সুরেলাকে। শাপলা কান্না গিলে হা করে তাকিয়ে দেখে পালকি। সে শুনেছে আগের দিনে বউ পালকিতে চড়ে শশুর বাড়ি যেতো। কিন্তু কখনো কোনো বিয়েতে দেখে নি পালকি। সবাই নছিমন নিয়েই আসে। তাঁর শখ জাগে সেও পালকি চড়ে শ্বশুড় বাড়ি যাবে। তখনি স্মরণে আসে সুর আপা প্রায়শই বলতো, 'আমি সুর পালকি চড়েই যাবো শ্বশুরবাড়িতে। নইলে বিয়েই করবো না।' শাপলার কান্না ভুলে হেসে ওঠে। রিজ ভাই সুর আপার জন্য পালকি এনেছে মানে আপাকে অনেক ভালো রাখবে।
সিনান সুরেলা কে বুঝিয়ে পালকিতে বসিয়ে দেয়। কাঁধে পালকি চেপে বেহারা ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করে।
পালকির কাপড়ের ফাঁক দিয়ে সুরেলার মুখ দেখা যায় না, কিন্তু ভেতরের কান্না, হাসি আর স্বপ্নের মিশ্র আবেগ যেন বাইরের শীতল পবনেও ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামের ছেলেমেয়ে, বউ ঝি ছুটে আসে পালকি দেখতে। মুরুব্বিরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। কেউ কেউ বলে ওঠে, "এই যুগেও কেউ এমন করে মেয়েকে বিদায় দেয়!"
নওরিজ সহ বাকিরা হাঁটা দেয়। চেয়ারম্যান বাড়ি খুব দূরে নয়। বিশ পনেরো মিনিট হাঁটলেই পাওয়া যাবে। সিনানও পায়ে পায়ে হাঁটে নওরিজের পাশে। হুট করেই বলে ওঠে,
"রিজ ভাই, আমার পুতুল টা আপনাকে দিলাম আগলে রাখবেন।"
থেমে যায় সিনান। নওরিজের প্রত্যুত্তর না শুনেই ধীরে ধীরে পেছন ফিরে হাঁটা দেয়। চোখে জল নেই, কিন্তু মনে ঢেউ। সেই ছোট্ট সুরেলা, যে একদিন তার আঙুল ধরে হাঁটা শিখেছিল, ভাই ভাই জপে আগে পিছে ঘুরঘুর করতো। ধমক ঝাড়ি খেয়ে মুখ কালো করলেও একটু পরেই ভাই ভলে গলা জড়িয়ে ধরতো আবদার করতো। সে আজ পালকিতে চড়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছে।
পিছনে ফেলে যাওয়া পথটা যেন আজ কিছুটা ফাঁকা লাগে। তবুও সিনান জানে, ভালোবাসা মানেই তো আগলে রাখা আর সময় হলে ছেড়ে দেওয়া।
—————
চেয়ারম্যান বাড়ির গেইট খুলে যায় ক্যাচ ক্যাচে শব্দে। চার জোড়া পা প্রবেশ করে পালকি কাঁধে ফেলে। পালকিতে উদাস চিত্তে বসা নববধূর বুকের ভেতরটা কেমন কেঁপে কেঁপে ওঠে। মেরুদন্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। এই বাড়িতে আনাগোনা সেই ছোট্ট বেলা থেকেই। মায়ের আঁচল ধরে কতো এসেছে।তবে তখন সম্পর্ক ভিন্ন ছিলো। সে কাজের লোকের মেয়ে ছিলো। এখন সে খান বাড়ির বড় পুত্রবধূ রূপে পা ফেলবে। অজানা সুর গেয়ে যায় কানের কাছ ঘেঁষে। সুরেলা পর্দা ফাঁক করে উঁকি দিয়ে বাইরের নাজারা দেখে। বাড়ির কর্মচারী আর মেহমানদের আসতে দেখে সুরেলা পর্দা টেনে ভেতরে যায়। কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। একটু পানি পেলে ভালো হতো। হঠাৎ পালকির ঝাঁকুনীতে সুরেলা ভয়ে চাঁপা স্বরে চেঁচায়। মাথাও ঠুকে যায় কাঠের তক্তার সাথে। বুঝতে পারে পালকি নামানো হয়েছে। তখনই পর্দা সরে যায়। কোমল গলায় কেউ শুধায়,
"ঠিকাছো তুমি?"
না চাইতেও অধর কোন বেঁকে আসে। কোনোমতে মাথা নাড়িয়ে ছোট্ট করে সম্মতি জানালো। নওরিজ বেহারাকে ধমকায় নামানোর আগে সতর্ক করা উচিত ছিলো। সে ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে সুরেলার উদ্দেশ্য বলে,
"বেরিয়ে এসো সুরেলা?"
ভদ্রলোকের শান্ত কোমল সুর সুরেলার বুকে লাগে; সাথে তুমি সম্বোধন পুরোই রসে ডোবা রসগোল্লা। সে লাজে হাঁসফাঁস করে বাড়িয়ে রাখা হাতে নিজেকে সঁপে দেয়। নিমিষেই রুক্ষ খসখসে শক্ত হাতের মুঠোয় বন্দিনী হয় সে। আস্তেধীরে পালকি থেকে নামে। নওরিজ খেয়াল করে আলতা রাঙা পা জোড়া খালি। জুতো নেই। সে জুতোর জন্য হাঁক ছাড়বে ইকরাম উল্লাহ কাঁধে হাত রেখে বলে,
"জুতো দিয়ে কি করবে? বাড়ির বড় বউকে হেঁটে নিয়ে যাবে রিজ?"
নওরিন এগিয়ে এসে চোখ রাঙায়। ইকরাম উল্লাহর উদ্দেশ্যে বলে, "মাথা খারাপ আপনার? রিজের অসুস্থ শরীর। মুখ চোপা দেখুন? রিজ একদম উল্টাপাল্টা কিছু করবি না। রাতেই স্টিচ করা হয়েছে। কাঁচা ঘা। ব্লিডিং হবে।"
কে শোনে কার কথা। সুরেলার পিঠে হাত গলিয়ে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। পেশিতে পিঠে টান লাগায় জখমিত স্থান ব্যাথায় টনটন করে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে পা বাড়ায়। নওরিন ধমকায়, নামাতে বললেও নামায় না নওরিজ। শক্ত চোয়ালে এগিয়ে যায়। সুরেলা শুকনো ঢোক গিলে। কথা গুলো যেন গলায় আঁটকে রয়েছে। তবুও মিনমিনে গলায় বলে,
" রিজ ভাই আল্লাহর দোহাই লাগে নামাইদেন। আপনার শরীর ঠিক নেই.."
"ডার্লিং, আমি ঠিক আছি কি না পরে বুঝিয়ে দিবো। পরিশ্রমের পর পারিশ্রমিক চাইই চাই।"
সুরেলা বোকা বোকা চোখে চায়। নওরিজ খানিকটা ঝুঁকে শব্দহীন অধর নাড়িয়ে কিছু বলে চোখ টিপে। এক চোখ টিপলে বাচ্চাদের মতো দুই চোখই বুজে যায়। ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগে সুরেলার। তবে শব্দহীন অধর নাড়িয়ে বলা বাক্য গুলোয় লাজে মুখ লুকায়। নওরিজ মাহবুব দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে যায়। সম্মুখে দন্ডায়মান মানবীকে দেখে বলে,
"খান বাড়ির বড় বউ সসম্মানে তার গৃহে প্রবেশ করবে। তাকে পায়ে হেঁটে যেতে দিই কিভাবে? খালাম্মা, আম্মার অনুপস্থিতিতে আপনিই বরণ করুন আপনাদের বউমাকে।"
রাহেলা বানু মুচকি হাসলো। রিজ ছেলেটা সব দিক দিয়েই ভার বুদ্ধি সম্পন্ন। বড়দের সম্মান করতে জানে খুব। সে বরণ করে নেয় নববধু কে। মিষ্টি মুখ করায়। চামচে পায়েস ভরে নওরিজের মুখ সম্মুখে ধরে। নওরিজ বাটির দিকে তাকায় তো খালার দিকে। তাঁর খুঁতখুঁতে স্বভাব বেরিয়ে আসে। সন্তপর্নে এড়িয়ে ভেতরে ঢুকে। পেছন থেকে ইকরাম উল্লাহ খোঁচা দিয়ে বলে,
"খালাম্মা, এই মিষ্টি এখন মুখে রুঁচবে না শালা বাবুর। তাঁর কাছে এখন মধুর খনি আছে। তাতেই মুখ..."
আর শোনা যায় না। কান ভারী হয়ে আসে সুরেলার। চোখে অগাধ লাজ লুকাতে মুখ লুকায় ব্যাক্তিগত পুরুষের বুকে। পুরুষালী গন্ধ যেন নাসা গহ্বর ভেদ করে বুক বরাবর বিঁধে যায়। কপোল জোড়া গরম হয়ে আসে অশালীন চিন্তা ভাবনায়। সব দোষ ওই বুড়ি'র! নওরিজ সিঁড়ির পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
" আই লাভ টু টেইক আ বাইট অফ আ রেড অ্যাপল!"
বোধগম্য হয় না ইংরেজি ভাষার মানে। নওরিজ ক্রিয়ায় বুঝিয়ে দেয়। মুখ নামিয়ে রক্তিম গালে দাঁত বসিয়ে বলে,
"দিস ওয়ান।"
সুরেলার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। ভেজা গালে ঘনঘন হাত ডলে লাল বানিয়ে ফেলে। নওরিজ মাহবুব ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে গম্ভীর মুখে হাঁটছে। দৃষ্টি সম্মুখে রাস্তায় নিবদ্ধ। সুরেলা চোখ খিঁচে বিড়বিড় করে,
"লুইচ্চা লোক।"
"তোমার ঘরের লোক সুরেলা। লুচ্চামি করার সনদ পেয়েছি তাও দুইবার। তাই কোনো বাহানা চলবে না।"
নিরেট রাশভারী স্বরে সুরেলার ভেতর স্বত্তা কেঁপে কেঁপে উঠলো। দাদীর সব কথা মস্তিষ্ক জুড়ে ঘুরপাক খায়। বাসর রাতে বিড়াল মারার পরিকল্পনা জগাখিচুড়ী পাকায় মন মস্তিষ্কে। বুড়িটা সাথে এলে ভালো হতো।
" আমার ঘরের ঘরনী তাঁর ঘরে পা ফেলবে হুঁশিয়ার!"
সুরেলার একটু হাসি পায়। আশ্চর্য মনটা ভালো হয়ে গেলো কখন? লোকটা কি জাদু করলো? সে তো অসম্ভব রেগে ছিলো লোকটার উপর। লোকটার জন্য ভাইয়ের চোখে আজ সে এতোটা ছোট হয়েছে যে ভাই কথা বলে না তাঁর সাথে। লোকটার মোহমায়ায় আঁটকে সে তাঁর ভাইয়ের ভালোবাসাকে ছোট করেছে। ভাবতেই মনটা আবারও বিষিয়ে ওঠে। নওরিজ পা দিয়ে কাঠের দরজা ঠেলে দেয়। ঘরের চৌকাঠে নামিয়ে দেয় সুরেলা কে।
"ডার্লিং, তোর রাজত্ব তোর কাছে সঁপে দিলাম।"
" কাল পরশু কথাকাটাকাটি হলেই ধমকাবেন বের হ আমার কাম..."
থেমে যায় সুরেলা। সাদা ধবধবে শার্টের হাতা রক্তে রক্তিম। আঙুল গড়িয়ে পড়ে রক্তের ছটা। দুই হাতে মুখ চেপে আতংকে চাপা স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে সুরেলা। নওরিজ হাত ঝাড়া দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে দাঁড়ায়। আড়চোখে সুরেলাকে কাঁপতে দেখে খানিকটা শক্ত গলায় বলে,
"মৃগী রোগীর মতো কাঁপা কাঁপি বাদ দিয়ে আলমারি খোলো আর শার্ট প্যান্ট বের করো। ডার্লিং বউয়ের দায়িত্ব পালন করো, যাও?"
সুরেলার কাঁপা থামার বদৌলতে বেড়ে যায়। স্মরণে আসে শফির কথা।
"সুর আপা গো! তোমার কপাল পুড়লো বলে। আমার তো ডর লাগতেছে। রিজ ভাই নাকি তিনডা মানুষ কোপাই মারছে। আর দুইডা হাসপাতালে ভর্তি আছে।"
বিয়ে নামক ভয়াবহ উত্তেজনা, সাথে ভাইয়ের মান অভিমান সব মিলিয়ে বলতে গেলে এসব কথা মাথায় আসে নি। হুট করেই অস্থি মজ্জায় ভয় সুরসুরি দিচ্ছে। সুরেলা শুকনো ঢোক গিলে ভিতু চোখে চায়। লোকটাকে সে চেনে টুকটাক । তাঁর উপর গলা চড়িয়ে কথা বলতেও দ্বিধা করে না। তবে লোকটার এই ভয়ানক রূপের সাথে পরিচিত হয় নি সে। মানুষ মারা নিশ্চয়ই ছোট খাট বিষয় না? তাও আবার তিন তিনটা মানুষ। সুরেলা আবারও শুকনো ঢোঁক গিলে।
"এই ডার্লিং ভয় পাচ্ছিস নাকি? ভয় ডর সাইডে রাখো জলদি আনো। আর ওয়াশ রুমে তোয়ালে আছে ভিজিয়ে আনো। যাও?"
তুই তুমি মিশ্রনে কথায় নওরিজ অল্প হাসে। মানুষ আসলেই অভ্যাসের দাস। সুরেলা দোনামোনা মনে আলমারি খুলে। পরিপাটি আলমারিতে ভাঁজে ভাঁজে কাপড় রাখা। সুরেলা অবাক হয় শাড়ি সহ মেয়েলী সালোয়ার কামিজ। এগুলো তাঁর জন্য?
"হাত পা চালা? আমি আবার ঢাকার পথে রওনা হবো। পিচ্চির সাথে কথা না বলা অবদি শান্তি পাবো না।"
নওরিজের কথায় সুরেলার হাত থমকায়। ঢাকার পথে রওনা হবে মানে? সে শার্ট প্যান্ট বের করে এনে দেয় চটজলদি।
"এখন ঢাকায় যাবেন? এই রাত বিরেতে?"
নওরিজ শার্ট প্যান্ট হাতে নিয়ে সুরেলার কাঁধে ফেলে। কোমড়ে স্বর্ণের বিছা ছুঁয়ে হুট করে কাছে টানে। রক্তাক্ত হাতসহ দুইহাত সুরেলার কাঁধে ভর দিয়ে রেখে ঝুঁকে আসে।
"ডার্লিং, মন খারাপ করিস না বুঝলি? রূপের এই হাল আমার জন্য। মরতে মরতে বেঁচেছে।"
"মন খারাপ করবো কেন? যান। তবে সাবধানে যাবেন।"
সুরেলা স্বাভাবিক ভাবেই বলে। নওরিজ মাহবুব মুচকি হাসে। নব বধূয়ার মুখ পানে দৃষ্টি আনে। কান্তিমান আঁখির কাজল লেপ্টে আছে। শ্যামল মুখটা জ্বল জ্বল করছে হালকা কৃত্রিম প্রলেপে। কুমকুম গুলো চিকচিক করছে। লাল টকটকে অধর দেখে ভ্রু কুঁচকে যায়। লিপস্টিকটা পছন্দ হয় না। নাকের নথটা খুলে দেয় নওরিজ। সিঁথির টিকলি সরিয়ে চুম্বন এঁকে বলে,
"তোমার সিঁথির টুকরোতেই আমার পৃথিবী শুরু হোক আর এখানেই শেষ হোক সুরেলা সালেহ। সোভাগ্য বতী হও স্বামী সোহাগী হও।"
সুরেলা মাথা নত করে নেয়। শুকনো মুখটা দেখে নওরিজ হাসে। কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে কোমল পেসব হাত দুখানা ধরে শার্টের বোতামের রাখে।
"দায়িত্ব পালন করো সুরেলা সালেহ। তোমার রোজকার দায়িত্বের মাঝে এটিও একটি।"
ভরাট গলায় বলে নওরিজ। শার্টের বোতামে থাকা সুরেলার হাত কাঁপে মৃদু মন্দ। ভয়, অস্বস্তি, লজ্জা সব যেন জাপ্টে ধরে। সময় নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে একে একে শার্টের বোতাম খোলে সে। বলিষ্ঠ ফর্সা বুকটার দর্শন মিলতেই মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। নানীর কথাগুলো যেন জোরে জোরে শ্রবণ ইন্দ্রিযের কাছটায়। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে গতর হতে শার্ট আলাদা করে যত্নসহকারে। নওরিজ মাহবুব টিস্যু তুলে নেয়। হাতের রক্ত পরিষ্কার করতে করতে বলে,
" তোয়ালেটা ভিজিয়ে আনো সুরেলা।"
সুরেলা চলে যাবে নওরিজ গম্ভীর গলায় আবারও হুকুম তামিল করলো,
"সাথে ব্রাশটাও করে এসো। লিপস্টিকের প্রলেপ যেন গায়েব হয়ে যায়। গ্রিন কালারের ব্রাশ তোমার। ব্লু'টা আমার। পেস্টও সেখানেই রাখা আছে!"
সুরেলা কপাল কুঁচকালো। অবুঝ স্বরে শুধালো,
"ব্রাশ কেন করবো?"
নওরিজ বাহুতে টিস্যু ঘষতে ঘষতে স্বাভাবিক জবাব দিলো,
"চুমু খাবো আমি!"
সুরেলা ফ্যাল ফ্যাল করে চায়। কি ভয়ানক কথাবার্তা!
.
.
.
চলবে..........................................................................