রোকসানা আদেশ পালন করলো। শরবত নিয়ে এলো। সেই সাথে তার মধ্যে মিশিয়ে দিলো একটা সাদা দ্রব্য। হুসনাতের বুঝতে বাকি রইলো না এই দ্রব্যটা কি! তাকে বিষ দেওয়া হচ্ছে। এটাই তার আনুগত্যের পরীক্ষা। সে অসহায় দৃষ্টিতে চাইলো তাবিয়ার দিকে। তাবিয়ার নির্লিপ্ত দৃষ্টি। সে তার সামনের অলংকারের কৌটোতে অলংকার বাছাইএ ব্যস্ত। শবরতের গেলাস রাখা হলো হুসনাতের সামনে। এই শরবত না খেলে সে আনুগত্যের পরীক্ষায় পরাজিত হবে। আর খেলে তার প্রাণ চলে যাবে। হুসনাতের দ্বিধান্বিত চাহনী দেখে তাবিয়া শীতল স্বরে বললো,
“ওটা চিনি ছিলো। আনুগত্যের পরীক্ষায় দ্বিধা মানেই সে বিপত্তি। কেমন দাসী তুমি যে মালিকের প্রতি বিশ্বাস আনতে পারছো না?”
“না মালেকা বেগম। আমি বিশ্বাস করি আমার মালিক আমার ক্ষতি করবেন না”
“শুধু তাই নয়, দাসী কর্তব্য মালিকের সকল হুকুম মানা। আমি হুকুম করছি, শরবতটা খেয়ে নাও”
“জি”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো হুসনাত। একনিঃশ্বাসে শরবতটা খেয়ে নিলো সে। খাওয়ার কিছুক্ষণ বাদেই তার গলা জ্বলতে শুরু করলো। বিশ্রী সেই জ্বালাবোধ। হৃদস্পন্দন অসম্ভব বেড়ে গেলো। এতটাই বেড়ে গেলো যে সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। চোখে পানি জমে এলো। তাকালো তাবিয়ার দিকে। তার ঠোঁটে নিষ্ঠুর হাসি। শরবতে সত্যি বিষ ছিলো। হুসনাত হাঁসফাঁস করতে লাগলো নিঃশ্বাস নেবার জন্য। কাঁটা মাছের মত কাতরালো সে। কিন্তু তাবিয়া, রোকসানা বা উসমা তাকে সাহায্য করলো না। একটা সময় ছটফটানি থেমে গেলো। চোখ উলটে গেলো। জ্ঞান হারালো হুসনাত। উসমা ভীত গলায় বললো,
“বেগমজান, ও কি মরে গেলো?”
“নাড়ি পরীক্ষা কর”
উসমা নাড়ি পরীক্ষা করলো। খুবই ক্ষীণ। ভয়ে তার মুখরক্তশূন্য হয়ে গেলো। তাকালো তাবিয়ার দিকে। তাবিয়া নিরুদ্বেগ গলায় বলল,
“রোকসানা, শেহজাদা ইরহানকে খবর দাও যে তার দাসীকে কেউ বিষ খাইয়েছে”
—————
মীর বখসি সকাল সকাল উপস্থিত হল ইরহানের কক্ষে। ইরহান তখন নাস্তা সেরে মাত্রই কাফতান পড়ছিলো। মীর বখসি আসার খবর শুনতেই হুদ ঘর ফাঁকা করে দিলো। প্রহরীকেও বাহির থেকে সরিয়ে দিলো। ইরহান যখন ছয় বছর তখন থেকে মীর বখসি সে তার ওস্তাদ। তার যুদ্ধ, রাজনীতি, তলোয়ার চালানোর হাতে খড়ি মীর বখসিই দিয়েছেন। ইরহান অন্য শেহজাদাদের মত মক্তবে পড়ার সুযোগ পায় নি। নেহায়েত মীর বখসি তার প্রতি দয়াবান হয়েছিলেন। তাই তো আজ মেহমুদ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে দক্ষ যোদ্ধা ইরহান। তার নিষ্ঠুরতা, নির্দয়তা একমাত্র এই গুণের জন্য ঢাকা পড়ে যায়। সুলতান মালেক শাহ নিজেও তাকে ভয় পায়। ইরহানের নেতৃত্বে এখন তার সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি পারস্য ছাড়িয়ে মিশর, দামেস্ক, মেসোডোমিয়া অবধি হয়েছে। তাই ইরহানকে চাইলেও তিনি সরিয়ে দিতে পারেন না। মীর বখসি বসলো ঠিক ইরহানের সামনে। ইরহান নির্বিকার স্বরে বললো,
“সকাল সকাল দরবারে না যেয়ে আমার কামরায় কেন ওস্তাদ? আমি তো আপনার সুলতান নই”
“এসফাইন বিদ্রোহ করার ফন্দি আটছে। ওখানের প্রাদেশিক প্রধান আলাউদ্দিনের উপর সৈন্যরা ক্ষেপে গেছে। তারা এখনো তাদের সুলতান হিসেবে খোরতাইন শেহজাদা নাসিরকেই মানে। তাদের ধারণা আলাউদ্দিন তাদের সাথে বেইমানি করেছে। তাদের শেহজাদাকে মেরে ফেলেছে। আলাউদ্দিন এসফাইনের কর বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ আমাদের কোষাগারে অর্থ জমা পড়ছে না। এসব কারণে সেখানের সৈন্যরা বিপ্লব শুরু করেছে। যেকোনো সময় ওরা আলাউদ্দিনকে মে-রে এসফাইন নিজেদের দখলে নিতে পারে। এসফাইন আমাদের সাম্রাজ্যের অনেক বড় অংশ। সুলতানের কানে গিয়েছে ব্যাপারটা। উনি তোমাকে এসফাইনে পাঠাতে চান"
ইরহান একেবারেই নির্লিপ্ত স্বরে বললো,
"আমি এখন বিশ্রামে আছি। অন্তত মাস দুই আমি কোনো যুদ্ধে যাব না"
"তোমাকে এসফাইনে পাঠানো যে উনার একটা নিঁখুত পরিকল্পনা আমি সেটা বুঝতে পেরেছি। আফগান থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। সুলতান আফগান শেহজাদীর জন্য শেহজাদা উমারকে বাছাই করেছেন। তুমি এই সময়ে এখানে না থাকলে অযুহাত দেবার সুযোগ পাবেন উনি"
"আমি থাকলেও বিয়ে করছি না"
"ইরহান! তুমি কিন্তু তোমার উদ্দেশ্য ভুলে যাচ্ছো"
"আপনি আমার উদ্দেশ্য ভুলে যাচ্ছেন। আর এসফাইন সুলতানের মুঠো থেকে বের হওয়া তো ভালো লক্ষণ। ধীরে ধীরে মেহমুদ সাম্রাজ্য টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। সুলতান সিংহাসনে বসে মাথা চুলকাবে। একটা কাজ করুন, কেননা এখানেও বিদ্রোহ শুরু হোক, দামেস্ক, কারবালা—সব জায়গায় বিপ্লব হোক"
মীর বখসি চুপ করে গেলেন। তার মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। শিষ্য হিসেবে ইরহান অনেক যোগ্য হলেও, সুলতান হিসেবে তার যোগ্যতা নেই। সে প্রজা বৎসল নয়। কিন্তু তাকে যে সুলতান হতেই হবে। মীর বখসি ফোস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। হতাশ গলায় বললেন,
"এখনো সময় আসে নি ইরহান। তুমি এই মুহূর্তে সুলতানের হুকুম অমান্য কর না। তাবিয়া সুলতানা আরোও একটি সুযোগ পাবেন। তোমাকে বিদ্রোহী ঘোষণা করতে উনার এক মুহূর্ত লাগবে না। তুমি এখন কারবালার প্রাদেশিক প্রধান। সেই সাথে এসফাইন তোমার দখলে থাকলে লাভটা তোমার। শুধু তলোয়ার চালালেই সুলতান হওয়া যায় না"
ইরহান শব্দ করে হাসলো। তারপর চতুর গলায় বললো,
"এখন কি আপনি আমাকে সুলতান বানানোর স্বপ্ন দেখছেন?"
"তোমার উদ্দেশ্য কখনোই সফল হবে না যদি না তুমি সুলতান হও"
এই বুড়ো লোকটা বড্ড বকে। ইরহানের বিরক্ত ধরে গেলো। মীর বখসি একচেটিয়া স্বভাবের মানুষ। সে যতক্ষণ না নিজের কথা মত কাজ করাবে ততক্ষণ সে ক্ষান্ত হবে না৷ তাই ইরহান বিরক্ত গলায় বললো,
"আমি ইতোমধ্যেই বায়োজিদকে সৈন্যবল নিয়ে এসফাইনে পাঠিয়ে দিয়েছি। ও সব সামলে নিবে। ও আমার প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে কাজ করবে। খুশি আপনি?"
মীর বখসির কপাল কুচকে গেলো। থমথমে গলায় বললেন,
"তুমি বায়োজিদকে বেশি বিশ্বাস করছো না? ভুলে যেও না সে কিন্তু এসফাইনের মানুষ"
ইরহান এগিয়ে এলো মীর বখসির সামনে। কিছুটা ঝুকলো সে। খিনখিনে স্বরে বললো,
"জানি। কিন্তু সে আমার একান্ত সহোচর। আর বিষে বিষে বিষক্ষয়। ও এসফাইনের বলেই ওকে সৈন্যরা ওকে মেনে নিবে। বিপ্লব থামিয়ে দিবে। আমি গেলে খামোখা অনেকটা গ-র্দা-ন কাঁ-টা যাবে। কি দরকার! বায়োজিদ শান্ত ছেলে। ও সামলে দিবে"
"আর যদি ও নিজেই এসফাইনে রাজত্ব করে?"
"সে অন্যের অধিনস্ত সে রাজত্ব করতে পারে না মীর বখসি। এটা আপনার থেকে ভালো কে জানে!"
ঠিক সময়েই হুদ কক্ষে প্রবেশ করলো। চিন্তায় তাকে উদ্ভ্রান্ত দেখালো। মীর বখসি উঠে বললেন,
“আমি সুলতানকে জানিয়ে দিচ্ছি আর মনে করে তুমি সুলতানের সাথে একবার দেখা করবে”
মীর বখসি বেরিয়ে যেতেই ইরহান হুদের উদ্দেশ্যে বললো,
“কি হয়েছে হুদ? দিনদুপুরে ভূত দেখেছো নাকি?”
“সর্বনাশ হয়ে গেছে শেহজাদা। হুসনাত বিষ দেওয়া হয়েছে”
হুদ ভেবেছিলো ইরহান হয়তো চিন্তিত হবে। তার চোখে মুখে ক্লেশ দেখা যাবে। অথচ এমন কিছুই হল না যেন। বরং তাকে দেখালো উৎসাহিত, প্রসন্ন। নিজের আসনে গা এলিয়ে দিলো সে। সহাস্যে বললো,
“এখনই যাও। হুসনাতকে আমার ঘরে নিয়ে আসো। সেই সাথে হাকেমকে খবর দাও। ওর চিকিৎসা আমার ঘরে হবে”
“কিন্তু হুজুর, তাহলে তো সুলতানা বুঝে যাবেন আপনি হুসনাতকে প্রাধান্য দিচ্ছেন”
“হুদ, হুদ, হুদ। তোমার মাথায় কি জং ধরেছে? নাকি যুদ্ধে যেতে পারছো না বলে তুমি সব বুদ্ধি গুলে খেয়েছো”
হুদ বিভ্রান্ত নয়নে তাকিয়ে রইলো ইরহানের দিকে। বিমূঢ় দেখাচ্ছে তাকে। ইরহান গাল ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো,
“যা ঘটেছে তা আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী-ই ঘটেছে। তাবিয়া দেখতে চায় হুসনাতের মূল্য আমার কাছে কেমন! তাই আমিও দেখাতে চাই হুসনাত আমার জন্য অমূল্য। অবশেষে তাবিয়া আমার চালে পা দিয়েছে। এবার দাঁড়িয়ে না থেকে মেয়েটিকে চিকিৎসার ব্যবস্থা কর।”
হুদের কাছে বিষয়টি এখনো ধোঁয়াশা। কিন্তু মালিকের আদেশ তার কাছে শিরোধার্য। তাই সত্যি সত্যি সে হুসনাতকে ইরহানের ঘরে নিয়ে এলো। সেই সাথে ইরহানের হাকেমকেও খবর দেওয়া হল। হারেমে কথাটা ছড়িয়ে পড়লো আগুণের মত। হুসনাত শেহজাদার প্রিয়। তার মানে খুব শীঘ্রই সে তার উপপত্নী হয়ে যাবে। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হারেমের সাথে সাথে খবরটা তাবিয়ার কানেও গেলো। তাবিয়া রোকসানাকে বললো,
“এই হুসনাত মেয়েটির উপর খাস নজর রাখো। ওকে রুমেলিয়ার দাসী হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে দাও”
!!৯!!
মালেক শাহর সাথে বাগানে হাঁটছে শেহজাদা উমার। বিকেলের দিকে মালেক শাহ নিজের গোলাপ বাগানে হাঁটেন। শরীরচর্চার উপায় হিসেবে এই হাঁটাহাঁটি। বয়স তো কম হচ্ছে না তার। তাই এই সময়টাতেই তিনি শেহজাদা উমারকে ডেকে পাঠালেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই উমার উপস্থিত হল। মালেক শাহকে সালাম দিয়ে বলল,
“আব্বা হুজুর কেমন আছেন?”
“ভালো। আমার গোলাপ বাগানে নতুন গোলাপ ফুটেছে। তাই তোমাকে ডাকা। দেখো কি সুন্দর”
“জি, অনেক সুন্দর”
মালেক শাহ বসলেন বাগানের মধ্যিখানের বসার জায়গায়। দাস খাবারের থালা নিয়ে এসেছে। মালেক শাহ বললেন,
“নাও খাও। এই মিষ্টিটা আজ খাস আমার জন্য বানানো হয়েছে। তোমার তো মিষ্টি পছন্দ”
উমার বুঝতে পারছে না মালেক শাহ শুধু এদিক সেদিকের কথা কেন বলছে। তবুও হাসি মুখে মিষ্টিটা খেলো। সত্যি প্রশংসনীয় তাদের রান্নাশালার প্রধানের হাত। মালেক শাহ উদাসীন স্বরে বললেন,
“জীবনটাও একটা বাগানের মত উমার। এই বাগানে যতক্ষণ প্রজাপতি, মৌমাছির আগমণ ততক্ষণ জীবন উজ্জ্বল। যেদিন সেই আগমণ বন্ধ হয়ে যাবে বাগান যেমন মলিন হয়ে যায়, জীবনও মলিন হয়ে যায়”
“আমি ঠিক বুঝলাম না আব্বা”
“তোমার জীবনে প্রজাপতি আসার সময় হয়েছে। এবার তোমার বিবাহ করা উচিত। আফগান শেহজাদী নূরের বিবাহ প্রস্তাব এসেছে তোমার জন্য। আফগানরা আমাদের সাথে মৈত্রতা গড়ে তুলতে চায়। বিবাহর থেকে ভালো উপায় নেই এই সম্পর্ক স্থাপনের। ওরা আমাদের সাথে বাণিজ্য করবে। শুধু শত্রু বানালেই তো হবে না, মিত্রও থাকা উচিত”
উমার চুপ করে রইলো। কিছু বললো না। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো সে বিদীর্ণ চোখে। তার মনে যে অন্যনারীর বাস। সে কি করে একটি মেয়েকে বিয়ে করবে যাকে সে ভালোবাসে না। মালেক শাহ আবার বললো,
“তুমি আমার যোগ্য শেহজাদা, তোমার বিয়ের প্রস্তাব পেলে আফগানরা খুশিতে লাফাবে। আর ভাববে তাদের শেহজাদীর ভাগ্য খুলে গেছে। আর অন্যদিকে ওদের গলার দড়ি হবে এই শেহজাদী। তোমার মাও আরবকন্যা ছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ উনার বদৌলতে আরব খলিফাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক সুমধুর। তাহলে আমি সম্বন্ধটা পাঠিয়ে দেই? মনে রেখো আফগান তোমার পক্ষে থাকলে তোমারই সুবিধা”
“আব্বা, আমি তো তাকে চিনিও না”
“বিয়ে করতে চেনার প্রয়োজন হয় না। বিয়ের পর চিনে নিবে”
“কিন্তু……”
উমারের ইতস্তত স্বর শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন মালেক শাহ। থমথমে স্বরে বললেন,
“ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নাও উমার। আমি তোমাকে ভালোবাসি তাই তোমাকে এত বড় সুযোগ দিচ্ছি। এই সুযোগের পেছনের ভাবনা বুঝতে চেষ্টা কর”
উমার আর আপত্তি করতে পারলো না। মালেক শাহ তাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে এই বিবাহের সুযোগের পেছনের উদ্দেশ্য। উমার ব্যথিত চোখে তাকিয়ে রইলো। বুক চিরে আসা দীর্ঘশ্বাসটা গোপন করে মলিন হাসি ঠোঁটে রাঙ্গিয়ে বললো,
“যেমন আপনি ভালো মনে করে আব্বা”
—————
গভীর রাত। তারাবিহীন আকাশে তখন অর্ধচন্দ্র লাজে রাঙ্গা নববধুর মত উঁকি দিয়েছে। তার রুপালী আলো প্রবেশ করছে ইরহানের আলোহীন ঘরে। ইরহান বসে আছে ঠিক জানালার পাশে। হুসনাত ধীরে ধীরে চোখ মেললো। প্রচন্ড দূর্বল লাগছে শরীর। কিন্তু গায়ে জ্বলুনি নেই। ভার হয়ে আসা চোখ মেলে অচেনা ঘরে নিজেকে আবিষ্কার করে বুক ধক করে উঠলো হুসনাতের। এটা তো হারেম না। ঠিক সেই সময়েই মশালে আলো জ্বালালো হুদ। হুসনাত দূর্বল শরীরটা নিয়ে উঠে বসলো। তার নজর প্রথমে গেলো সাদা থান জড়ানো পুরুষের দিকে। সাদা থান তার কৃষ্ণ দেহকে আবৃত করে নি সম্পূর্ন। সুঠাম মাংসপেশী উদাম। তার হাতে একটা তামা গেলাস। চোখ বাহিরের দিকে। হুদ জিজ্ঞেস করলো,
“হুসনাত খাতুন এখন কেমন লাগছে?”
হুদের প্রশ্নে ঘোর কাটলো হুসনাতের। ম্রিয়মান স্বরে শুধালো,
“আমি কোথায়?”
“বেঁচে আছেন। এটা শেহজাদার ঘর। আপনার ভাগ্য খুব ভালো। তাই তো এই ঘরে আসার সুযোগ পেয়েছেন। সবার সেই ভাগ্য হয় না”
হুসনাত মাথা নত করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। বিনয়ী স্বরে বললো,
“অত্যন্ত ধন্যবাদ, দ্বিতীয়বার আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্য। এই দাসী এই উপকার কখনো ভুলবে না”
“তুমি জানতে আমি তোমাকে বাঁচাবো?”
ইরহানের ভারী স্বরে ঘরের পরিবেশ থমথমে হয়ে গেলো মুহূর্তেই। হুসনাত সাথে সাথে পালঙ্ক থেকে নেমে গেলো। ইরহানের সামনে মাথানত করে বললো,
“বিশ্বাস ছিলো”
“কেন বাঁচাবো আমি এই দাসীকে?”
ইরহান হাতের গেলাস রেখে এগিয়ে গেলো হুসনাতের দিকে। তাদের মধ্যকার দূরত্ব স্বল্প। তার তীক্ষ্ণ চোখে শীতলতা। হুসনাত উত্তর দিল না। ইরহান আচমকা তার গলা চে-পে ধরলো নিজের সুঠাম হাত দিয়ে। শক্ত হাতের বলে হুসনাতের শ্বাসরোধ হবার যোগাড়। শুভ্র মুখখানা নীল হয়ে গেলো। গলা থেকে স্বর বের হচ্ছে না। হা করে শ্বাস নেবার ব্য-র্থ চেষ্টা করলো। মনে হচ্ছে এখনই গলা ভেঙ্গে যাবে। কপালের শিরা দপদপ করছে। তারপর তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
“নাকি সুলতানার প্রিয় হবার সুযোগ হারাতে চাও নি, তাই তো আগ থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে গিয়েছিলে? যে বিষে এক প্রহরে মানুষের প্রাণ চলে যায়, সেই বিষ সেবন করার পরও তুমি আমার সামনে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছো? কে তুমি? বল কি তোমার উদ্দেশ্য? যার গায়ে বিষের প্রভাব পড়ে না, সে সাধারণ দাসী হতে পারে না”
হুসনাত নিজের দূর্বল হাত দিয়ে ইরহানের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু মারলো না, একসময় নিঃশ্বাস আটকে আসায় চোখ উল্টে যেতে লাগলো। মুখখানা নীল হয়ে গেছে। সে ছটফট করতে লাগলো বাঁচার জন্য। খুব কষ্টে বললো,
“আ—আ—মি কে—ব—ল আ---প, আপ---না—র দা---সী”
হুদ পাশ থেকে বললো,
“হুজুর ম-রে যাবে”
ইরহাম হুসনাতের গলা ধরে ছিটকে ফেললো মাটিতে। ছাড়া পেতেই খুকখুক করে কাশতে লাগলো হুসনাত। তার বুক ধরফর করছে। গলায় পাঁচ আঙ্গুলের দাগ বসে গেছে। দুহাতে গলা ধরে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো সে। ঠিক তখনই অনুভব করলো তার গলার কাছে ধারালো তরবারি। এতটাই ধার সে তার চুলও কিছু কেটে নিচে পরে গেছে। হুসনাত অশ্রুচোখে অসহায় দৃষ্টিতে চাইলো। ইরহামের কৃষ্ণ মুখখানা পাথর হয়ে আছে। হুসনাতের মনে হলো সে মানুষ নয় কোনো দানবের সামনে বসে আছে। মাটিতে আছড়ে পড়ায় পায়ে ব্যথা পেয়েছে। কিন্তু সেই ব্যথা অনুভব হচ্ছে না। তার মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেছে। কিভাবে এই মৃত্যু থেকে বাঁচবে বুঝতে পারছে না। ইরহান হিনহিনে স্বরে বলল,
“শেষ সুযোগ দিচ্ছি বল তুমি কে? তাবিয়ার বিষ কেন তোমার শরীরে কোনো প্রভাব ফেলে নি?”
“আমার কাছে প্রতিকারক ছিল”
ইরহানের তরবারি একেবারে গলার চামড়া চিরে ফেলেছে। গড়িয়ে পড়ছে র-ক্ত। ইরহানের চোখ এখনো আগের মতোই, সে যেন ব্যখ্যা চাইছে। হুসনাত চোখ বন্ধ করে হরবর করে বললো,
“আমি হারেম থেকে শুনেছি, সুলতানা আপনাকে পছন্দ করেন না। তাই আমার সন্দেহ হয়েছিলো উনি আমাকে মারতে চাইতে পারে। তাই আমি প্রতিকারক সেবন করেই তার ঘরে গিয়েছিলাম। উনার কথা না মান্য করলে উনার কাছাকাছি যাওয়া যেত না। আর চরের প্রথম কাজ তার মালিকের শত্রুর কাছে যাওয়া। আর জীবন না বাঁচলে আমি আপনার চর হব কি করে?”
“আর এই প্রতিকারক পেলে কিভাবে?”
“বণিকের আগে আমি যার দাস ছিলাম উনি হেকেম ছিলেন। উনার কাছ থেকে আমি অনেককিছু শিখেছি। বিষের প্রতিকারক, আঘাতের প্রতিকারক। কি করে জখমকে মুহূর্তেই মিশিয়ে ফেলা যায় ইত্যাদি। আমি জানি আপনি আমাকে বিশ্বাস করছেন না। কিন্তু আমি আল্লাহ কসম খেয়ে বলছি, আমি আমার প্রাণরক্ষককে ঠকাবো না। আমার প্রাণ যে বাঁচিয়েছে তার প্রতিদান আমি দিবোই”
ইরহানের তরবারি নড়লো না। হুসনাত দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছে। চোখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এখনই তার ধর থেকে মাথা বুঝি খসে যাবে। ঠিক তখনই ইরহান বললো,
“তুমি আমার দাসী?”
“জি হুজুর, আমার মালিক কেবল আপনি। আমি সম্পূর্ণ আপনার দাসী”
“বেশ অনুগত্যের একটা প্রমাণ না হয় আমাকেও দেও। যেহেতু পুরোপুরি তুমি আমার, তাই আজ থেকে প্রতিরাত তুমি আমার সাথে কাটাবে। হুদ”
হুদকে চোখ দিয়ে ইশারা করলো ইরহান। ফলে সে ঘর ছেড়ে দিলো। স্বল্প হলদে আলোর ঘরে কেবল ইরহান, হুসনাত এবং নিস্তব্ধতা। হুসনাত বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে রইলো ইরহানের কঠিন, ক্রুর মুখের দিকে। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা। বিমর্ষ কণ্ঠে বললো,
“এটাই আমার পরীক্ষা?”
“অন্তত বিষ দিচ্ছি না আমি”
বলেই তরবারিটা আরো শক্ত করে ধরলো। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। জ্বলছে কাঁটা অংশ। হুসনাত তখন ম্লান স্বরে বললো,
“আমি আপনার সাথে প্রতি রাত কাটাবো হুজুর, কিন্তু আমি যিনাকারী হতে পারবো না। আমাকে উপপত্নী হিসেবে গ্রহণ করতে হবে আপনার”
·
·
·
চলবে.........................................................................