কামিনী - পর্ব ২৪ - মম সাহা - ধারাবাহিক গল্প


          রাজ প্রাসাদে আসতে যতটুকু পথ, ততটুকু জুড়েই মানুষের ভিড় হতে শুরু করল। পথে যে-ই রানির ঘোড়াটিকে আসতে দেখলো সে-ই কুর্নিশ করতে গিয়েও থমকে গেলো। হত-বিহবল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রানির বুকের কাছটায়। চোখ জুড়ে নেমে আসা অসীম বিস্ময় নিয়ে তারা নির্বাক হয়ে রইল। রানির বুকের কাছটাতে একটি নবজাতক কী পরম মমতায় লেপ্টে আছে। নবজাতকের খোলা, সুন্দর পিঠটি উন্মুক্ত আছে শ্বেতপদ্মের মতন। রানির হাতটি রক্তে মাখামাখি। নবজাতকটির কোনো নড়চড় নেই। সবাই জানতো রানি পাষণ্ড। তবে একটি নবজাতককে মেরে ফেলার মতন পাষাণী কি তিনি আদৌ কখনো ছিলেন?

 বিরাট রাজকীয় প্রাসাদের দুয়ারটি খোলা। রানির ঘোড়াটি সশব্দেই ঢুকলো সেই দুয়ার দিয়ে। প্রহরীদের যেন চক্ষু চড়কগাছ। পেছন পেছন কত পথচারী এসে দাঁড়িয়েছে দরজাটির বাহিরে। হয়তো মনের উদ্বেগ কিংবা কৌতূহল থেকেই। 
রানি আজ নামলেন না ঘোড়া থেকে জৌলুশ বেশে। কেবল একটি প্রহরীকে ম্লান কণ্ঠে বললেন সেনাপতিকে ডেকে দেওয়ার কথা। 

সেকেন্ড ব্যয়েই সেনাপতি এসে উপস্থিত হলো বিরাট খোলা জায়গাটিতে। যার একদিকে রানির সুন্দর ফুলের বাগান। যেখান থেকে ম-ম করে ভেসে আসছে কত ফুলের ঘ্রাণ। সতেজ সেই ঘ্রাণে প্রফুল্ল চারদিকটায় রানির নিষ্প্রভ মুখটিই বেশি দৃষ্টিগোচর হলো হ্যাব্রোর। সে ছুটে এলে তৎক্ষণাৎ। পেছন - পেছন এসে উপস্থিত হলো হেমলক, মন্ত্রীসহ বহু দাসদাসী। রানির বুকে লেপ্টে থাকা অজ্ঞাত শিশুটির কথা ততক্ষণে ছড়িয়ে গিয়েছে প্রাসাদ জুড়ে। 

 রানির চোখে-মুখে অকথিত বিষণ্ণতা। মলিনতায় ছেয়ে গেছে কণ্ঠ। কোনোরকমে বুকের শিশুটির শরীরে প্যাঁচালেন তার রাজকীয় উত্তরীয়টি যা তার কেশে আটকে ছিলো পরম যত্নে। নরম তুলতুলে ছোটো দেহটিতে যে প্রাণ নেই তা বেশ ভালো করেই বুঝেছে সকলে। কিন্তু কোথা থেকে এই শিশুটি এলো, রানিই বা কোথাও গিয়েছিলেন কেউ বুঝল না। 
ব্যাকুল কণ্ঠে কেমন বললেন, 'ওকে একটু নিবে, হ্যাব্রো?'

হ্যাব্রো কালবিলম্ব না করে দু'হাত ছড়িয়ে দিলো। রানি যতটা মায়ায় বাচ্চাটিকে এগিয়ে দিলেন, তার চেয়ে অধিক মমতায় হ্যাব্রো জড়িয়ে নিলো বাচ্চাটিকে। কী ফুটফুটে মুখটি! মনে হচ্ছে সদ্য ভোরে ফোটা কোনো ফুল। 
বাচ্চাটিকে হ্যাব্রোর কোলে দিয়েই রানি নেমে দাঁড়ালেন। রাজ্যবাসীর ভাষ্যমতে তাদের কঠিন, পাষাণ, নির্দয় রানির আজ বুকে কম্পন। কণ্ঠে বসে গিয়েছে অবেলার দুঃখ। মলিন স্বরে বললেন,
 "সাবধানে ধরো, হ্যাব্রো। ব্যথা যেন না পায়। ওর বুকটায় ভীষণ ক্ষত।"

রানির কথায় কিছুটা ধাক্কা খেলো হ্যাব্রো। বাচ্চাটি যে জীবিত নয় তা তো সবাই ই বুঝতে পারছে। 
রানির হাতে, পোশাকেও রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। বাচ্চাটির শরীরেও দাগ। যদিও ওরা তখনো ভালো করে বুকের ক্ষতটি দেখেনি। তবুও বাচ্চাটির প্রাণপাখি যে নেই তা বুঝতে তো আর সেই ক্ষত দেখার প্রয়োজন নেই। তবে রানি কেন এমন অদ্ভুত কথাটি বললেন? মৃত মানুষ আবার ব্যথা পায় কীভাবে? 

ছুটে এলেন মন্ত্রীমশাই। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে শুধালেন, "ও কে, রানি কামিনী? কার শিশু এ? আপনিই বা কোথায় ছিলেন সেই ভোর থেকে? কী হয়েছে?"

 এই সব প্রশ্নের উত্তর রানির কাছে থাকলেও এই মুহূর্তে বলার কোনো জোর পাচ্ছেন না তিনি। কথা যেন জড়িয়ে আসছে গলার কাছটায়। তার জীবনে এত এত কঠিন দৃশ্য দেখেছেন তিনি, তবুও আজকের দৃশ্য যেন হার মানিয়েছে সকল কাঠিন্যতা। 
রানির কথা জড়িয়ে আসে, কোনো রকমে উচ্চারণ করেন, "আমাকে একটু ধরুন, মন্ত্রীমশাই। আমি বোধহয় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। আমাকে ধরুন।"
 বাকি আর কিছুই বলতে পারলেন না। এতটুকুই বললেন অস্পষ্ট ভাবে। মন্ত্রীমশাই ছুটে এসে ধরার আগেই রানি ছিটকে পড়ে গেলেন। এত জোরে মাটিতে পড়লেন যে কপাল অব্দি ফেটে গেলো। সবার কাছে তখনও সবটা এলোমেলো। কেবল এতটুকু বুঝল সকলে যে, রানি ভীষণ বিক্ষিপ্ত। অস্বাভাবিক কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়। 

হ্যাব্রোর কোলে তখন মৃত শিশুটি নির্জীব হয়ে লেপ্টে আছে। তাই রানিকে ধরার মতন সুবিধা করতে পারল না। হেমলক ছুটে এলো। দ্রুত মাথাটা উঁচিয়ে ধরল রানির। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে রানির কপাল থেকে। সে তার ডান হাত দিয়ে চেপে ধরল কপালটি। মুহূর্তেই কী হয়ে গেলো তা কেউ বুঝতে পারল না।

 ৩৯......

বাহিরে অঝোর ধারায় ঝরছে বৃষ্টি। আকাশের কোথাও নেই এক ছটাক শুদ্ধ আলো। চারপাশটা মেঘলা, ঘোলাটে। রানির যখন জ্ঞান ফিরল তখন বিকেল হবে হবে ভাব। কিন্তু আকাশে মেঘের হঠাৎ আনাগোনায় সেই বিকেলের ভাবটি রূপ নিয়েছে সন্ধ্যায়। রানি চোখ মেলে সবার প্রথমে যা দেখলেন তা হলো তার মাথার কাছটায় বসে আছে যামিনী। ঝলমলে সুন্দর মুখটি তার। অঙ্গ বেয়ে যেন পড়ছে রূপের আভা। তবে চোখে বিমর্ষ ভাব। হয়তো রানির চিন্তায় নয়তো এতদিন বহুদূরে ছিলো সেই শোকেই সখীর এই হাল। কিন্তু সখীর দেহ অত্যাধিক উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। রূপসী হৃদের ঝলমলে জলের মতন দেহে শোভা পাচ্ছে সৌন্দর্যতা। 
 রানি খানিক অবাক হলেন। মনে মনে ভাবলেন ভ্রম নয়তো? সখী তো এখানে আসার কথা নয়। অত বড়ো জঙ্গলে তো সখীকে খুঁজে পায়নি রানির দূতেরা। তবে, এখন আবার সখী এলোও বা কোথা থেকে? তাছাড়া এতটা পথ এলেও বা কী করে? নিশ্চয় তিনি কল্পনায় আছেন। 

মাথায় মৃদু ব্যথা অনুভব করলেন। ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে বসে হেলান দিলেন পালঙ্কের সাথে। কণ্ঠে তার তখনো অবিশ্বাস্যতার ছোঁয়া,
 "সখী, তুমি? তুমি সত্যিই এসেছো কি?"

যামিনীর ঠোঁটে টানা হাসি। রানির জ্ঞান ফিরতে দেখে ঝলমল করে উঠল চক্ষু যুগল। দু-হাত মেলে রানিকে জড়িয়ে ধরল বেশ অকপটে। বলল,
"না এসে যাবো কোথায়, সখী? তুমি ছাড়া আদৌ কেউ আছে আমার?"

রানির মনে হলো আজকের দিনটি তার কাছে অপ্রত্যাশিত কল্পনার মতনই। সকাল থেকে যা যা হলো তার সাথে সেই সবটাই তো ধারণার বাহিরে ছিলো তার। আকস্মিক ভাবে আজকেই পর পর তার সাথে ভাবনাতীত ঘটনা ঘটছে। 

 "কী হলো, সখী? আমাকে কি আজও জড়িয়ে ধরা যায় না?" 

যামিনীর কথায় ভাবনা চূর্ণ হয় রানির। তিনি হাত উঠিয়ে জড়িয়ে ধরেন। যামিনীর চেয়েও আন্তরিক ভাবে। যেন বুকের ভেতর আটকে ফেলবেন একমাত্র, প্রিয় সখীকে। 
 হ্যাব্রো তখন অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করল। রানির জ্ঞান ফিরতে দেখে দুশ্চিন্তা কাটলো তার। 

হ্যাব্রোকে দেখে রানির মনে পড়লো জ্ঞান হারানোর আগের সময়টার কথা। বাচ্চাটাকে না হ্যাব্রোর কাছে দেওয়া হয়েছিলো? এক কোথায় সে বাচ্চাটি? 
রানি উতলা হলেন। জিনিস করলেন, "সেনাপতি, শিশুটি কোথায়? তোমার কাছে না দিয়ে ছিলাম?"

শিশুটির প্রতি রানির এই অতি টান হ্যাব্রোকে দ্বিধান্বিত করল। সে মৃদু স্বরে জবাব দিলো, "শিশুটিকে রাখা আছে বরফের খণ্ডে। আর বেশিক্ষণ রাখা সম্ভবপর হবে না বোধহয়।"

রানি তপ্ত শ্বাস ফেললেন। ভঙ্গুর স্বরে বললেন, "রাজ্যে খোঁজ নাও, কার বাচ্চা ও খুঁজে বের করতে হবে তো না-কি?"

 "খোঁজ লাগিয়েছি। যদিও এখনো তেমন কোনো খবর আসেনি।"

"রাজ বৈদ্যকে দেখিয়েছিলে? শিশুটির প্রকৃতপক্ষে হয়েছিলো কী?"

হ্যাব্রো উত্তর দেওয়ার আগেই বাহিরে শোনা গেলো হেমলকের কণ্ঠে। সে-ও প্রবেশের অনুমতি চাচ্ছে। রানি অনুমতি দিলেন অকপটে। 

হেমলক ভেতরে প্রবেশ করল। তার হাঁটা-চলায় রাজকীয় দম্ভ নেই। বেশ স্বাভাবিক ভাবেই ভেতরে এসে রানির বরাবর দাঁড়ালো। দায়িত্ববোধ থেকে শুধালো,
"শরীর কেমন এখন, সম্রাজ্ঞী?"

রানির যদিও মাথা ভার হয়ে আছে তবুও তিনি উত্তরে বললেন, "ভালো আছি।" 

হেমলক আর অন্য কোনো প্রসঙ্গে না গিয়ে আসল কথায় ফিরে এলো৷ ভারিক্কি স্বরে বলল, 
"আমাদের রাজ বৈদ্য আপনার নিয়ে আসা শিশুটিকে পরীক্ষা করেছেন।"

রানির এবার কৌতূহল জাগলো,"তারপর? কী বললেন তিনি?"

 "শিশুটির বুকে বেশ বৃহৎ একটি ছিদ্র আছে নিশ্চয় দেখেছেনই?"

"হ্যাঁ।"

 "সেটি কোনো জন্তুজানোয়ারের নয়। মানুষ আক্রমণ। কোনো মানুষ করেছে এটি। জন্তু জানোয়ারের কোনো ছাপ পাওয়া যায়নি।"

রানি চমকালেন। তার রাজ্যে এত নিষ্ঠুর মানুষও প্রবেশ করেছে? এতটুকু একটা নবজাতক যেখানে ছাড় পেলো না!

 ৪০....

প্রবল বৃষ্টিতে চারপাশ ভিজে একাকার। রাজপ্রাসাদ জুড়ে তীব্র স্তব্ধতা। বৈঠকখানায় বসে আছে মন্ত্রী, বৈদ্য, হেমলক পিয়ার্স, সেনাপতি। রানি বেরিয়ে এলেন ঘড় ছেড়ে। শুভ্র রঙের বসন তার গায়ে। কোনো কারুকার্য, কোনো রাজকীয়তা নেই সেই বস্ত্রে। চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে আছে। মুখে, গলায়, শরীরে নেই কোনো অলঙ্কার। যেন মহা প্রলয়ের পর বিধ্বস্ত পাহাড়টি। 
সকলে চমকে গেলো। যামিনী তো কিছুটা উৎকণ্ঠা নিয়েই এগিয়ে গেলো সখীর কাছে। রানি কামিনীকাঞ্চনের চোখে-মুখে ব্যথার তীব্র শোক। তবে, কণ্ঠের তেজ আগের মতনই। মন্ত্রীমশাইকে বললেন,
"শিশুটির পরিবারের যেহেতু খোঁজ মেলেনি তাই তার শেষ কার্য আমিই সমাপ্ত করব। রাজ শিশুদের যেমন করে অন্তেষ্টিক্রিয়াটা হয় তেমন করেই। সেনাপতিকে বলেছি ছোটো একটি নৌকার ব্যবস্থা করতে। ছোটো, মৃত শিশুকে তো জলাঞ্জলি দেওয়া হয়। এবং তার জন্য তার মাতা শোক পালনে শুভ্র বস্ত্র পরিধান করে। ওর মাতার যেহেতু খোঁজ নেই তাই আমি শুভ্র বস্ত্র পরিধান করলাম। আপনারা ব্যবস্থা করুন ওকে এখন নিয়ে যাওয়ার। ওর শেষ বিদায়ের আয়োজন করুন।"

রানির আদেশ পেতেই মন্ত্রী ব্যতিব্যস্ত হলো। রাজ পুরোহিতকে ডাকতে গেলো হ্যাব্রো। যে, যার মতন ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো নিজস্ব ব্যস্ততায়। যামিনীও গেলো বস্ত্র বদলাতে। কিন্তু সেখানে উপস্থিত রইল হেমলক। এক ধারে কেদারায় বসেই বলল,
 "যে রানির কঠোরতায় মানুষ কাঁপে, সে রানি একটি অপরিচিত শিশুর জন্য এমন শোকাবহ হচ্ছেন, বিষয়টা আশ্চর্যের না?"

"কঠিন হয়তো আমি। তাই বলে যে মানুষ নই, তেমনটা তো নয়!"

হেমলক হাসলো। মৃদু ভাবে মাথা নাড়িয়ে বলল, "যে নিজের পিতাকে হত্যা করে, সে অন্যের পুত্রের জন্য শোক করলে বিস্ময় তো জাগবেই। তাই না?"
·
·
·
চলবে..................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp