মানসীর কথা লিখতে গিয়ে সবসময় খেই হারিয়ে ফেলি। কোথা থেকে শুরু করব, কোথায় গিয়ে শেষ করব কিছুই বুঝতে পারি না। আজও একই অবস্থা। খুব লিখতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখব! যাই হোক, আমার জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনাগুলোর মধ্যে একটা ঘটেছে কয়েক মাস আগে।
সেদিন আমি একটা ইমার্জেন্সি অপারেশনের জন্য হসপিটালে আটকে গিয়েছিলাম। দিতিয়া, অনন্যা আর সৌরভ বাচ্চাদের নিয়ে অনন্যার বাবার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। বাসায় মা-বাবা একা ছিল। অগত্যা মাকেই ফোন করে জানালাম বাসায় ফিরতে দেরি হবে, আমি রাতে খেয়ে ফিরব, যাতে মা জেগে না থাকে। অনেক রাতে বাসায় ফিরে নিজের চাবি দিয়ে দরজা খুললাম। দরজার পাশের সোফায় বসে জুতা খুলছি, এমন সময় খেয়াল করলাম আমার ঘরে মৃদু ভলিয়্যুমে বাজছে…
“চোক্ষে আমার তৃষ্ণা..
আমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন..
সন্তাপে প্রাণ যায়… যায় যে পুড়ে…
চোক্ষে আমার তৃষ্ণা…”
বুকের ভেতর ছ্যাত করে উঠল। দিতিয়ার তো রবীন্দ্রসংগীত শোনার কথা না, তাছাড়া দিতিয়া তো বাসায়ই নেই। কে বাজাচ্ছে আমার ঘরে এই গান? আগে প্রতি রাতে মানসী ঘুমানোর সময় রবীন্দ্রসংগীত শুনত। এখন তো কেউই শোনে না। তার ওপর এখন কেউ বাসায়ও নেই। রাত বাজে ২টা। এত শীতে মা জেগে থাকলে বকা খাবে তা তো ভালো করেই জানে। তবে? আমার উৎকণ্ঠা বাড়তেই লাগল। যত ঘরের কাছে যাচ্ছি আওয়াজটা স্পষ্ট হচ্ছে। আমার হাত-পা কাঁপছিল। মনে হলো ঘরের দরজা খুললেই আমি দেখতে পাবো মানসীকে। যেমনি দেখতে পেতাম ১৬-১৭ বছর আগে। কিন্তু এখন তা কী করে সম্ভব। দরজাটা খুলতেই জানালা দিয়ে আসা পূর্ণিমার আলোয় যা দেখলাম তাতে আমার মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা। তরতর করে ঘামছিলাম আমি। কে শুয়ে আছে আমার বিছানায় কম্বলমুড়ি দিয়ে? কে?
বেশি নার্ভাস লাগছে কারণ মানসী যখন ওদের বাসায় থাকতে শুরু করেছিল তখন একদিন ঠিক এরকমই একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেদিনও আমি হসপিটাল থেকে অনেক রাতে ফিরেছিলাম। ঠিক আজকেরই মতো জুতা খুলতে খুলতে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে পেয়েছিলাম। গান অবশ্য এটা ছিল না। যাই হোক, সেদিনও ঘরে ঢুকে দেখেছিলাম আমার বিছানায় কেউ ঠিক এভাবেই কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়েছিল। সেদিন আমি লাইট জ্বালাতেই মানসী উঠে বসেছিল,
“এই যে তুলতুলের বাবা, সেই কখন এসেছি আমি। আর এই তোমার আসার সময় হলো?”
“একটা পেশেন্টের কন্ডিশন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমরা তো শুধু চাকরি করি না। অনেক দায়দায়িত্ব থাকে। কিন্তু তুই যে আসবি তা তো বলিসনি আগে?”
“আমি তো ডেইলি আসি।”
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
“হুম বাবা, আসিস তো কিন্তু থাকিস তো না। আমি ফেরার আগেই চলে যাস। রাতে তো থাকিস না।”
“সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম তোমাকে, তাই জানাইনি। ধেৎ, রাতের অর্ধেকটাই চলে গেল।”
“কেন, পুরো রাতের প্ল্যান নিয়ে এসেছিলি নাকি? প্রব্লেম নাই, এখনো যে রাত আছে তাতে ওডিআই না হোক টি-টুয়েন্টি খেলা যাবে।”
এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মানসী আমাকে ছেড়ে দূরে গিয়ে বলল, “ছিঃ তুমি যে কী অসভ্য! এমন নোংরা কথা আমাকে আর কক্ষনো বলবে না। ছিঃ…”
“আরে বাপরে! তুই বলেই পাত্তা দিলি না বুঝলি! কেট উইন্সলেট হলে ঠিকই মর্ম বুঝত, এই দামি কথাটার জন্য ইন্সট্যান্ট পুরস্কারও হয়তো দিয়ে ফেলত।”
“উফ তোমার আউলা কথা বন্ধ করো। খুব জরুরি কথা বলতে এসেছি আজকে আমি। খুব বোঝাপড়া হবে আজ তোমার সাথে।”
“কী বোঝাপড়া আবার? এই আমি কিন্তু সুন্দরী মেয়েদের দিকে তাকাই না এখন আর।”
“উফ, তুমি একটু চুপ করবে। আমাকে বলতে দাও। আর প্লিজ ফাজলামো বন্ধ করো।”
আমি এবার সিরিয়াস হলাম,
“আচ্ছা বল।”
“এখন না। আগে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও। আমারও বড্ড খিদে পেয়েছে।”
“আজও আমার জন্য না খেয়ে বসে আছিস? পারিস কী করে তুই?”
“এত কথা বলো কেন তুমি? ফ্রেশ হয়ে এসো প্লিজ।”
“না, এখনই বল কী বলবি। খাওয়া-দাওয়ার পর আমার আর সময় হবে না।”
“কেন?”
“আবার জিজ্ঞেস করছিস কেন? বাচ্চা হয়ে গেছিস নাকি? যা মায়ের পেটের মধ্যে ঢুকে যা।”
মানসী বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,
“ধুর!”
আমি পাত্তা না দিয়ে ওকে আবার কাছে টেনে আনলাম। বললাম, “এতদিন পর আমার সোনাবউটাকে কাছে পেয়েছি। ছেড়ে দেব ভেবেছিস? সারারাত জ্বালিয়ে মারব।”
“শোনো, আমি খুব সিরিয়াস কথা বলতে এসেছি। এসব মিষ্টি কথায় চিড়ে ভিজবে না।”
“না ভিজলে পানি দিয়ে ভেজাব।”
“উফ, প্লিজ একটু সিরিয়াস হবে তুমি? একটা প্রশ্ন ছিল আমার। উত্তর চাই।” আমিও এবার সত্যি সিরিয়স হলাম। আমার বউ লজ্জা না পেয়ে উল্টো ধমকাচ্ছে, তার মানে পুরো ডালই কালা। আমি বললাম,
“ওকে সরি। বল কী বলবি।
“তুমি ভিয়েনার স্কলারশিপটা নিলে না কেন? আর তোমার এত বড় অ্যাচিভমেন্টের কথাটা কাউকে জানাওনি কেন তুমি? আমার কাছে কী করে গোপন করলে?”
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার জোগাড়! এসব কথা ও কী করে জানলো। মানসী আবার জিজ্ঞেস করল,
“কী হলো উত্তর দাও। চুপ করে থাকতে তো পারবে না আজ।”
“কে বলেছে তোকে এসব কথা?”
“কে বলেছে সেটা বড় কথা না। আর পাল্টা প্রশ্ন করার আগে উত্তর দাও তুমি।”
“মা জানে? আই মিন মাকে বলে দিসনি তো?”
“না।”
“সৌরভ জানে?”
“না।”
“হুম সেটা বুঝতেই পারছি। ও জানলে আমার সাথে কথা না বলে তোকে বলত না।”
“হ্যাঁ তা তো হবেই, ভাইকে তো ওরকমই বানিয়েছ।”
“আমি বানাইনি। ও নিজে থেকেই ওরকম। ইটস আ ট্র ব্রাদারশিপ। তুই বুঝবি না। বাই দ্য ওয়ে, তুই না বললে কোনো প্রব্লেম নেই, এটা বুঝতে পারছি আমার বন্ধুদের কেউ বলেছে। আমার সব ফ্রেন্ড জানেও না। সো কে বলেছে তা বের করতে আমার দুদিন লাগবে জাস্ট। ওকে বলে দিস আমার সামনে যেন না আসে। গুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়ব।”
“ছিঃ কী মুখের ভাষা।”
“আমার মাথা গরম হলে অনেক খারাপ কথা আমি বলতে পারি, ইউ নো দ্যাট ভেরি ওয়েল।”
“আচ্ছা ঠিক আছে, এবার বলো তো স্কলারশিপটা ক্যান্সেল করেছ কেন?”
“আমার পক্ষে এখন দেশের বাইরে যাওয়ায় অসুবিধা আছে। ওসব পরেও করা যাবে। যার যোগ্যতা আছে সে যেকোনো সময় স্কলারশিপ পেতে পারে।”
“কেন, এখন বাইরে যাওয়া সম্ভব না কেন?”
“এই কেনর উত্তর আগে দিয়েছি আমি তোকে। এক কথা বারবার বলতে আমার ভালো লাগে না। দয়া করে খেতে দে এখন। খিদেয় মরে যাচ্ছি।”
তখন মানসী আমার ছিল তাই হঠাৎ হঠাৎ আমার ঘরে পেতাম ওকে, ঠিক স্বপ্নের মতো। কিন্তু আজ? এখন তো আর মানসী আসে না আমার কাছে। তবে কে?
লাইট জ্বালালাম। নাহ সেদিনের মতো উঠে বসল না কম্বলমুড়ি দেয়া মানুষটা। খুব আতঙ্ক নিয়ে কম্বল সরাতেই দেখতে পেলাম আমার ছোট বোন মোনালিসা ঘুমিয়ে আছে। ওর মাথায় হাত রাখতেই ওর ঘুম ভেঙে গেল। সাথে সাথে উঠে বসে বলল,
“ওহ, দাদা তুই। এত দেরি হলো যে!”
“হ্যাঁ, মাকে ফোন করে বলেছিলাম তো।”
“মা আমাকে বলেছে, বাট এত রাত হবে বুঝিনি।”
“কখন এলি?”
“সন্ধ্যার পর এসেছি।”
“বাসার সবাই ভালো আছে?”
“হ্যাঁ ভালোই আছে। ওরা সব বেড়াতে গেছে, মা-বাবা একা আছে শুনে এলাম।”
“অফিস কেমন চলছে?”
“চলছে আর কি!”
“তুই খেয়েছিস?”
“সন্ধ্যায় খেয়েছি দাদা। এখন আর খাবো না। দেখো না কেমন মুটিয়ে যাচ্ছি।”
আমি হেসে বললাম,
“এটা কিন্তু ঠিক না। রাতে না খেলে কেউ শুকায় না…”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে মোনা বলল,
“থাক, তুই ডাক্তার আমরা সবাই জানি। এখানেও ডাক্তারি করিস না প্লিজ।”
আমরা দুজনেই হেসে দিলাম। তারপর আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“তুই রবীন্দ্রসংগীতও শুনিস নাকি?”
“না, কিন্তু অ্যালবামগুলো লাইব্রেরিতে পেয়ে শুনতে মন চাইল। হঠাৎ মানসী আপুর কথা মনে পড়ে গেল। ও প্রতিরাতে ঘুমানোর সময় শুনত। ওর সাথে ঘুমাতাম বলে আমারও শোনা হতো।”
আমি কিছু বললাম না। চুপ করে রইলাম। ও জিজ্ঞেস করল,
“তুই এগুলো শুনিস দাদা?”
“নাহ শুনি না, মানসীর স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি।”
“জানিস দাদা, আজ যখন বিছানায় শুয়ে গানগুলো শুনছিলাম মনে হচ্ছিল মানসী আপু আমার পাশেই শুয়ে আছে। যদি ভয় পাই তাহলেই ছোটবেলার মতো করে জড়িয়ে ধরে বলবে, “ভয় কিসের বনু? আমি আছি তো!”
কথাগুলো বলতে বলতেই মোনা কেঁদে ফেলল। আমি বললাম, “মোনা, কী হচ্ছে এসব?”
“জানিস দাদা আজ আমি আরো বেশি করে টের পেলাম তোর কষ্টটা।”
“ধুর পাগলী, কাঁদিস না তো। আমার আবার কিসের কষ্ট? ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারলে আমি পারব না? আর দিতিয়া, ওর মতো বউ থাকলে কি কেউ খারাপ থাকতে পারে?”
“জানি তুই এখনো যতটা আছিস দিতিয়া ভাবির জন্যই আছিস। কিন্তু মানসী আপু তো আমার বোন ছিল। ছোটবেলা থেকে বেড শেয়ার করেছি। শুধু বেড কেন? কত কি শেয়ার করেছি। ওর কথা মনে পড়লে আমি নিজেকে সামলাতে পারি না দাদা।”
“মনে করিস কেন তাহলে? কাঁদিস না আর। কাঁদলেই তো আর ও চলে আসবে না। যে আমাদের কথা ভাবেনি তার কথা আমরা কেন ভাবব?”
—————
এই পাতা শেষ হতেই ডায়েরিটা রেখে অর্পি অদ্রির গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “আপ্পি, কেন এমন হলো?”
অদ্রি কোনো কথা বলতে পারল না। ও তো আগে থেকেই কাঁদছিল। কান্না যে বড্ড ছোঁয়াচে।
·
·
·
চলবে.........................................................................