প্রশ্ন, বিভ্রম, চিন্তা তিনটি ওকে ছাড়ছে না। প্রশ্ন বলছে, কেন? বিভ্রম বলছে, তোমাকে কেন? চিন্তা বলছে, এর পেছনে কারণ কী? কোনোটাই ওর কাছে জানা নেই। মনে মনে ভাবছে, আর ব্যাপারগুলো নাড়াচাড়া করছে শাওলিন। বতর্মানে বন-বাংলোর আনাচে কানাচে দেখতে ব্যস্ত। একতলা, কাঠ নির্মিত, মজবুত কাঠামোর উপর ভিত্তিসম্পণ্ণ বাংলো, সুনিখুঁত এর প্রতিটি কোণা। একদিকে একটা সিঁড়ি আছে, সেটিও কাঠের তৈরি এবং সিঁড়িটা ছাদে উঠার। চর্তুদিকে নজর বুলাতে বুলাতে কাঠের মেঝেতে নরম পা মাড়িয়ে সিঁড়িতে উঠল শাওলিন। বাঁহাতে কাঠের রেলিংটা ছুঁয়ে ছুঁয়ে একধাপ একধাপ করে উপরে উঠছিল ও। যতই নিকটবর্তী হচ্ছে দোতলার ছাদের দিকে, ততই অজানা আশঙ্কায় মনপ্রাণ কেমন জড়িয়ে আসছিল। ও জানে না খাগড়াছড়ির প্রাবল্য ওকে কেন টানছে। ও জানে না এই বাংলোর শোভিত সৌন্দর্য কেন তীব্ররূপী আকৃষ্ট করছে। শুধু জানে, ওর অবচেতন মন এক অমোঘ টানে চারপাশটা নিরীক্ষণ চালাচ্ছে। চোখে অদম্য কৌতুহলের দ্যুতি নিয়ে ছাদের লোহার দরজায় থামল। ডানহাতে দরজাটা ঠেলতেই বুঝল প্রচণ্ড ভারী ও শক্ত। আরো জোর খাটাতে দুহাতে দরজাটা ঠেলতে নিবে, ঠিক তখনই কে যেন কান ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল,
- ওইখানে গেছ কেন! কী সর্বনাশ!
অমন চ্যাঁচানো কণ্ঠে ভড়কে গিয়ে ওর থামল হাত। বুঝে উঠতে পারল না অমন গলা চড়ানো চিৎকারটা কেন হল। মাথা পিছু ঘুরিয়ে দেখল সিঁড়ির অর্ধভাগে বৃদ্ধ গফুর মিয়া। উনার চোখেমুখে ভয়, ঠোঁটদুটো হাঁ, জোরে জোরে নিশ্বাস টানছেন তিনি। যেন আকস্মিক উত্তেজনায় দম কুলোতে পারছেন না। কিন্তু কেন ব্যাপারটা ঘটল তা বুঝতে পারল না ও। গফুর আবারও উনার আঞ্চলিক টানে অস্থিরতা ফুটিয়ে উঠল,
- তাড়াতাড়ি নামো!
কণ্ঠের ওমন ব্যগ্রতা ওর নজর এড়াল না। কেমন এক দূর্বিপাকে বৃদ্ধর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে। তিনি যে ওর এখানে আসাটা একটুও পছন্দ করেননি তা বুঝতে কসরত হল না একটুও। শাওলিন প্রচণ্ড সীমায়া অবাক ছিল । কণ্ঠে সেরকমই একটা ভাব ফুটিয়ে প্রশ্নকণ্ঠে বলল,
- আপনি এরকম চিৎকার করলেন কেন চাচা?কোনো সমস্যা?
গফুর কোনোভাবেই উত্তরটা দিতে পারলেন না। ভয় জড়িত চোখদুটো ডানে বামে একপলক ঘুরিয়ে দেখলেন তিনি। কাকে যেন আশেপাশে দেখতে না পেয়ে স্বস্তির দুদফা দম ত্যাগ করলেন। আবারও মুখটা উর্ধ্বমুখো করে শাওলিনের দিকে উদ্বিগ্ন চাহনিতে বললেন,
- কিছু না মা, তুমি নিচে নামো। অতো সন্ধ্যায় উপরে যাওয়া ভালা না। বন জঙ্গল এলাকা। জায়গাটাও খুব বিচ্ছিরি। কখন কী ঘইটা যায় বলা তো যায় না। খারাপ বাতাস গায়ে লাগলে অসুখে পরবা মা। আসো, নাইমা আসো।
একমুখ প্রশ্ন নিয়ে থমকে রইল শাওলিন। সহসা কী উত্তর দিবে বুঝতে পারল না ও। এটা ঠিক, বন-জঙ্গল এলাকায় অশুভ কিছুর উপস্থিতি বেশি। সন্ধ্যার পর কুমারী মেয়েদের ছাদে যাওয়াটাও নিরাপদ নয়। কিন্তু তবু এরকম চিৎকার করে উঠল কেন? পেছন থেকে ডাকলেও তো হতো? ব্যাপারটা স্বাভাবিক ঠেকল না ওর। পায়ে পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নামতেই বৃদ্ধর মুখোমুখি হয়ে বলল,
- আপনি ওরকম জোরে ডাকলেন যে চাচা? এখানে ওরকম গলা ফাটানোর তো কিছু নেই। এইটুকু দূরত্বই তো, আস্তে ডাকলেও হতো।
গফুরের চোখ একবার শাওলিনের দিকে পড়ল, আরেকবার দৃষ্টিটা ওর পেছনে থাকা দরজার দিকে পড়ল। তিনি ঘন করে দুটো ঢোক গিলে ঠোঁটে অনিচ্ছুক একটা হাসি টেনে বললেন,
- দিনের বেলায় যাইয়ো মা। এই সন্ধ্যারাইতে উপরে উইঠো না। বড় বাবা একটু বাইরে গেছে। গাড়িটা মেরামত নিছে। আমারে বইলা রাইখা গেছে তুমি যেন সহি সলামত থাকো। তোমার এইটা সেইটার কিছু দরকার লাগলে আমারে কইয়ো। আমি আইনে দিব।
শাওলিন তখনো অমন উদ্ভট আচরণের হেতু ধরতে পারছিল না। এমন বেখাপ ব্যবহারটাও ওর বোধগম্য না। ও তো টো টো করার মানুষ নয়, ছটফটে ভঙ্গিতেও কিছু করেনি, বরং সামান্য কৌতুহল থেকে চারপাশটা দেখছিল। তবু দোষটা যেহেতু ওরই হয়েছে, পরিস্থিতির কল্যাণে ও আর দ্বিরুক্তি করল না। মাথা উপর-নিচ নাড়িয়ে হ্যাঁ বোধকে বলে উঠল,
- ঠিকআছে, আমি এটা খেয়াল রাখব। আর বিশেষভাবে দুঃখিত, কারণ জানতাম না এখানে ঘুরাফেরা করাটা সমস্যা হতে পারে।
কথাটা শান্ত ভঙ্গিতে বললেও যথেষ্ট জোর ছিল গলায়। গফুর ব্যাপারটা লক্ষ করলেও চুপ করে থাকলেন। নিজের ডানপাশ দিয়ে শান্ত, নির্বিকার শাড়ি পরিহিতা মেয়েটাকে যেতে দেখে নিবিড় চক্ষুতে পরোখ করলেন। আগে কখনো দেখেছেন বলে মনে হয় না। তবু কী তেজ, কী অটল ভাব! কথা বলার ভঙ্গিতে উদ্ধত আচরণ না ফুটলেও ঠুনকো ব্যাপারটা একটুও ছিল না। বড় বাবা কী এই মেয়েটাকেই উদ্ধার করেছিলেন? এই একরত্নি ছোট মেয়েটাকে? মোখলেসের কাছে শুনেছেন সম্প্রতি সাতজনের একটা দলকে নিরাপত্তা দিচ্ছেন তিনি। কিন্তু কেন এবং কী জন্য এই উত্তর এখনো মেলেনি।
গফুরকে চিন্তা ভাবাপণ্ণ রেখে নিজ ঘরে ঢুকে পড়ছিল শাওলিন। দরজাটা চাপিয়ে বিছানায় উঠে বালিশে মাথা রাখল। ঘরের এককোণে হারিকেন জ্বলছে, টিমটিম করে উজ্জ্বল দীপশিখার মতো হলদেটে আলো ছড়াচ্ছে ছোট্ট কাঠের ঘরে। হাতে মোবাইলটা নিয়ে শ্রেষ্ঠাকে একটা কল করল শাওলিন। ভাবল, দুপুরের সেই অর্ধসম্পণ্ণ কথা এখন নাহয় শোনা যাক। ফোনের স্ক্রিনে সন্ধ্যা ছয়টা একুশ মিনিট হচ্ছে দেখে কলটা কানে বসাল শাওলিন। দুটো টোন যেতেই ওপাশ থেকে খট করে করে আওয়াজ,
- ব্যস্ত তুমি?
ওপাশ থেকে শ্রেষ্ঠা কিছু চিবোতে চিবোতে বলল,
- না জানা। খাবার নিয়ে এইমাত্র রুমে এলাম। একা একা খাচ্ছি। সাজেকের সন্ধ্যাটা উপভোগ করছি। বিশ্বাস কর, আমি জায়গাটার প্রেমে পড়ে গিয়েছি। চারপাশটা এতো মায়া মায়া, এতো আরাম আর নির্মল। চুপচাপ বারান্দায় বসে ওই আকাশটা দেখছি রে। মুহুর্তটা অন্যরকম ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে, খোদা তা'য়ালার এই প্রকৃতিকে আমি নতুনভাবে অনুভব করলাম। এতো সুন্দর!
শ্রেষ্ঠার ভাবুক মনের কথা শুনে ফিক করে হাসলো শাওলিন। ফোনটা ডান কান থেকে বাঁ কানে নিয়ে বলল,
- তুমি দেখছি আমার মতো কথা বলছ। আমার পাল্লায় পড়ে তোমার চরম সর্বনাশটা হয়ে গেছে। যদি ঢাকায় ফেরো, তখন কী হবে ভাবো। আমরা কিন্তু ঢাকার মানুষ পাহাড়ের সৌন্দর্য বিলাস করতে পারি না। এভাবে স্বাচ্ছন্দ্যে কটা দিন থাকারও সুযোগ পাই না। কী এক বদ্ধচাপা জীবনে অভ্যস্ত আছি। কেমন রোবটের মতো জীবন। মাঝে মাঝে মনে হয়, সবকিছু ছেড়েছুড়ে যদি এমন একটা মুহুর্ত খুঁজে পেতাম? যদি এমন শান্ত, স্নিগ্ধ জায়গায় ছুটে আসতে পারতাম? সম্ভব নয়।
কথাগুলো শুনতে শুনতে নরম হাসিতে টের পেল শ্রেষ্ঠা। বারান্দায় বসে বসে সূদূর আকাশে মেঘের খেলা চুপটি করে দেখল। সন্ধ্যার আকাশও এতো সুন্দর হয়? পাহাড়ের চূড়ো থেকে এতো মোহনীয়? এজন্যই কী এই মেয়েটা এমন প্রকৃতিপাগল, আকাশলোভী? শ্রেষ্ঠা বুঝতে পারল, তার অসম বয়সি বোনতুল্য বান্ধবিটা আকাশ ছাড়া কিছুই দেখেনি। সে তার জীবনে মা পায়নি, বড় বোন পায়নি, ছোট ভাই পায়নি, বাবার ছায়াটুকুও দেখেনি। আজও সেই দিনটার কথা স্পষ্ট মনে আছে।
সেবার ছিল ঘনঘোর বর্ষা। সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় বর্ষার আমেজে চঞ্চল হয়ে সৌন্দর্যের দুয়ার খুলে দিয়েছে। নতুন বর্ষের শিক্ষার্থীরা যুক্ত হয়েছে সবে দুমাস হল। বোটানিক্যাল এরিয়া পেরিয়ে ডানে মোড় নিচ্ছিল শ্রেষ্ঠা। এমন সময় লক্ষ করল শাপলা ভর্তি পুকুরটার ওদিকে কে যেন বসে আছে। সিমেন্টে বাঁধানো পাকা শানটার উপর পা ঝুলিয়ে বসেছে। মুখটা পুকুরের দিকে ঘুরোনো। শ্রেষ্ঠা দূরদৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিল নির্ঘাত নতুন বর্ষের একজন। দূর থেকে এক হঙ্কার দিয়ে উঠল,
- অ্যাই মেয়ে!
মেয়েটা ওর গর্জন শুনে ধীরে ধীরে মাথা ঘুরাল। বৃষ্টিতে চোখদুটো ছোট ছোট করে আছে। পাপড়িগুলো ভীষণ বড়ো। দুটো পাতলা ঠোঁট সামান্য ফাঁক। পড়নে কালো রঙের জামা। শ্রেষ্ঠা ওই মুখটা দেখে কেন জানি আর হুঙ্কার দিতে পারল না। ডানহাত চোখের সামনে আড়াল বানিয়ে ওর দিকে দ্রুত কদমে এগিয়ে গেল। পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই এদিক-ওদিক কাউকে দেখতে না পেয়ে গরম গলায় বলে উঠল,
- এদিকে একা একা ভিজো কেন? জ্বর আসবে না? যাও বাসায় যাও! ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসে কী?
গভীর চোখের পাপড়িগুলো নিচু হল একবার। কী যেন ভেবে আবার ওর দিকে দৃষ্টি তুলে বলল,
- আপনি যান আপু। আমি এখানে কিছুক্ষণ বসব। জ্বর নিয়ে টেনশন করবেন না। ঔষুধ আমার সঙ্গে রাখি।
এবার মেয়েটার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল শ্রেষ্ঠা। খুব মিষ্টি, ঝরঝর মোলায়েম সুর। একবার কানে শুনলে বারবার শোনার আকাঙ্ক্ষা হয়। কী যেন ভেবে শ্রেষ্ঠা আর ধমক দিল না। পাকা শানটায় বসে দুপা এপাশ থেকে চট করে ওপাশের পুকুরমুখো করে ঝুলিয়ে নিল। ডানপাশে ওই নতুন বর্ষের মেয়েটা। কিছুক্ষণ নীরব থেকে অবশেষে প্রশ্নের খাতা খুলল শ্রেষ্ঠা, নিজের রাগী গম্ভীর কণ্ঠস্বর কিছুটা সহজ বানিয়ে বলল,
- থাকো কোথায়? হলে?
পাশ থেকে মেয়েটা ডানে বামে মাথা নাড়াল। অর্থাৎ, হলে থাকে না। তার মানে আশেপাশেই বাসা বোধহয়। শ্রেষ্ঠা আবার প্রশ্ন করে উঠল,
- নাম কী তোমার? কোন ডেপ্ট?
এবার মেয়েটা ওর দিকে তাকাল। পাপড়ি-ঘন ওই চোখদুটো দিয়ে আপাদমস্তক শ্রেষ্ঠাকে একবার দেখল, কিছু একটা বুঝতে পেরে প্রত্যুত্তরটা করল,
- শাওলিন। বি এম বি ডেপ্ট।
- ওমা! তুমি দেখি নাযীফদের জুনিয়র ব্যাচ।
মেয়েটা ওর কথার হেতু বুঝতে না পেরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। নাযীফ কে, আর ইনিই বা কত ব্যাচ সিনিয়র সেটা বুঝতে পারছিল না তখনো। শ্রেষ্ঠা ওর চাহনিতে দ্বিধাপূর্ণ আঁচটা দেখে একমুঠো হাসি উপহার দিল। সদা মিশুক শ্রেষ্ঠা ডানহাত বাড়িয়ে জুনিয়র মেয়েটার কাঁধ জড়িয়ে বলল,
- আমি নূপুর ইসলাম শ্রেষ্ঠা। অনার্স কমপ্লিট। কাজেই বুঝতে পারছ তুমি আমার কত পিচ্চি। নাযীফ হচ্ছে তোমাদের সিনিয়র ভাই-ব্রাদার। বি এম বি ডেপ্টেরই কততম ব্যাচ যেন। আচ্ছা তোমার বাসা কোথায়? যেতে অসুবিধা হলে চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
সেই প্রথম শ্রেষ্ঠার খোলামেলা আচরণে জড়তা ছাড়ে শেহজানা আলম শাওলিন। সিনিয়র ব্যাচের নূপুর ইসলাম শ্রেষ্ঠা সেই থেকে এককভাবে সঙ্গী। বয়সে বড়, পড়াশোনায় বড়, দক্ষতায় আরো শাণিত। অথচ, শ্রেষ্ঠাই কিনা জুনিয়র বয়সি এই মেয়েটার ব্যক্তিত্বে ধীরে ধীরে বদলে যায়। ওড়নাহীন ঘুরাফেরা করা শ্রেষ্ঠা একদিন নিজেই গলায় ওড়না জড়ায়, সুন্দর করে চুল বাঁধে, পশ এরিয়ার জাঁকজমক কাণ্ড এড়িয়ে সাদামাটা সৌন্দর্যে আনন্দ খোঁজে। ধীরে ধীরে বন্ধুত্বটা গভীর হয়ে একপর্যায়ে বোনতুল্য সম্পর্কে এসে যায়। এরপর দলে ভিড়ল রোজা, আরো ভিড়ল সোহানা, সঙ্গে জুড়ল সেলিম ও নাযীফ। শেষেরজন জিদান। সূদূর ভাবনার থেকে বাস্তবে ফিরে ভারী শ্বাস ছাড়ল শ্রেষ্ঠা। কীভাবে যে সময়টা পেরুল নিজেও জানে না। খাওয়াটা ততক্ষণে শেষ হয়ে যাওয়াতে হাত ধুয়ে নিচু কণ্ঠে বলল,
- জানা, একটা কথা বলি?
- বলো।
- আমার কী মনে হচ্ছে জানিস?
- কী মনে হচ্ছে?
- তুই এমন একটা মানুষ, যেখানেই থাকিস, সেখানেই মানুষকে কঠিন মায়ায় জড়িয়ে ফেলিস। তুই ভ্যালি আসিসনি, আমার খারাপ লাগছে। তুই ওই বাংলোয় নেই, দাদী মানুষটার ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তুই অধরা ভাবীদের সামনে নেই, তারপরও উনারা তোকে নিয়ে কথা বলছে। তুই মণির কাছেও নেই, অথচ ওই মহিলা দিনে চৌদ্দবার তোর খোঁজ নেয়। এসবের মানে বুঝিস?
কলের এপ্রান্তে চুপ হয়ে গেল শাওলিন। এরকম কথাবার্তায় কিছুই বলার নেই। তবু মন চাইছে শ্রেষ্ঠা আসলে কী কারণে টপিকটা উঠিয়েছে, সেটা অন্তত শুনে নিতে। নয়ত তীব্র প্রবল ব্যাপারটা ওকে স্বস্তি দিবে না। শ্রেষ্ঠা একটু থেমে শব্দগুলো গুছিয়ে আবার বলে উঠল,
- তুই এখন কোথায় আছিস? আর কার কাছে আছিস?
সরল কপালে ধীরে ধীরে কুঞ্চল পড়ল কটা। শাওলিন এবার সত্যিই কথাটা ধরতে পারল না। বালিশ থেকে মাথা তুলে সবে উঠে বসেছে ও, এমন সময় শ্রেষ্ঠা নিজের সুক্ষ্ম অনুমান ব্যক্ত করে উঠল,
- শোয়েব ফারশাদ ইচ্ছে করে তোকে আঁটকে রেখেছে। উনি চাইলে আর্মি এসকোর্টে স্পেশাল কল দিতে পারতো। উনি একজন ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার, জানা। এই খাগড়াছড়ি জেলার বিভাগীয় হেড।
ঠক্ ঠক্ করে শব্দ হল কাঠের দ্বারে। শাওলিন আচমকা চমকে উঠে শব্দ উৎসের দিকে তাকিয়েছে। দ্বারের ওপাশে কে আছে, তা অনুমান করতে চাইছিল ও। কানে শুনতে পেল শ্রেষ্ঠার অনুমিত কণ্ঠ,
- উনি শান্ত, ঠাণ্ডা। অথচ কাজকর্ম চিতার মতো। চাইলে তো পরদিনই ঢাকায় পাঠিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু কাউকেই একতিল পরিমাণ আন্দাজ করতে দেয়নি। আমি এরকম ভয়ংকর ঠাণ্ডা লোক জীবনেও দেখিনি জানা। কক্ষণো কোনোদিন না!
কথা শেষ হতেই স্তব্ধ-বিমূঢ় চাহনি বন্ধ দরজায় বিদ্ধ হল। ওমনেই শুনতে পাচ্ছিল বরফ-শীতল কণ্ঠস্বর,
- তোমার জন্য অপেক্ষা করছি শাওলিন। চা এবং কফি দুটোই বন্দোবস্ত করা হল। বারান্দার ডাইরেকশন, হাতের বাঁদিকে। করিডোরের শেষমাথায় ডানদিকের গেট। মেইক ইট স্যূন।
এরপর একজোড়া ভারী পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে গেল। বিছানা থেকে ধীরেসুস্থে দাঁড়িয়ে পড়ল শাওলিন। দরজা থেকে চোখ সরিয়ে জানালার কাছে গেল ও। বাঁহাতে লক খুলে কাঁচের থাইগ্লাসটা ঠেলে দিতেই বৃষ্টির ছাঁট মাখানো ঠাণ্ডা বাতাস লাগল মুখে। গভীর শ্বাস টানল শেহজানা আলম। প্রশ্নটা এবার ধীরভাবে শুধাল,
- তুমি আজ কোনো ব্যাগ ফেলে গেছ? কাপড়ের ব্যাগ?
—————
বারান্দায় কিছুক্ষণ পায়চারি শেষে নিজ ঘরে ফিরল শোয়েব ফারশাদ। ব্যথায় দেহের ডানপাশটা অবশ হতে চাইছে। চোখের উপর ডান ভ্রুঁটা প্রচণ্ড ভোগাচ্ছে তাকে। ব্যথানাশক কোনো ক্যাপসুল তার কাছে নেই। মেয়েটা তাকে একপাতা যে ক্যাপসুল দিয়ে গেছে, এটা তার জন্য শিশু সমতুল্য। এর চেয়ে দ্বিগুণ ডোজের ঔষুধ তার ব্যথা সারাতে অভ্যস্ত। এই রক্ত মাংসে গড়া পেশিসর্বস্ব দেহ অল্প আঘাতে, অল্প ঔষুধে কোনোক্রমেই ধরা দেয় না। অথচ, এই মুহুর্তে প্রতিটি শিরায় শিরায় যেন অসহনীয় তাণ্ডব বইছে। চোখ বুজে বিছানায় বসল শোয়েব। মাথা কিঞ্চিৎ ফ্লোরমুখো ঝুঁকিয়ে দুহাতের আঙুল একে অপরের মাঝে আবদ্ধ করে নিল। বাঁ কানে ছোট্ট ইলেকট্রনিক বস্তু, নীল উজ্জ্বল আলো থেকে থেকে জ্বলছে-নিভছে। ফোনটা পাওয়ার ব্যাংকের মাধ্যমে ড্রেসিং টেবিলের কাছে চার্জপূর্ণ হচ্ছে। ফোনের ব্লুটুথ সেকশন থেকে কানে শুনতে পাচ্ছে জরুরি কথা। ওপাশ থেকে চিন্তিত কণ্ঠে কথা বলছে সেজো ভাবী তাহিয়া।
- তুমি এরকম অবস্থায় পরবে জানলে আমি আর অধরা যেতামই না। মিথিলা ভাবী পর্যন্ত বারবার তোমার কথা শুধাচ্ছে। এভাবে কী হয় শোয়েব?
- আপনারা ওখানে আনন্দ করুন। আমি এখানে ঠিক আছি। আমার সঙ্গে সেই মেয়েটাও ঠিক আছে। দূর্ভাগ্যবশত এসকোর্টটা মিস হলো, কিন্তু এটা নিয়ে আফসোস করে লাভ নেই তাহিয়া ভাবী।
- তুমি কী নাম জানো না?
- কী জানি না?
শোয়েব আসলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল না। কী নাম? আর কীসের কী? ওপাশ থেকে তাহিয়া বিজ্ঞ ভঙ্গিতে জবাব দিয়ে বলল,
- যাকে কোলে করে এনে সেবা দিচ্ছ, তার শুদ্ধ নাম কী মশাই? মেয়েটার কী ভদ্র নাম নেই? নাম ধরে ডাকা যায় না? বয়সে তো তোমার চেয়ে ছোটই। নাম ধরে ডাকলে তো ক্ষতি নেই। তাহলে অপমান করে 'সেই মেয়ে' ডাকা কেন?
ঘটনা বুঝতে পেরে শোয়েব চুপ রইল। বাড়তি আলাপের দিকে অগ্রসর হল না। কথার পিঠে কথা না পেয়ে তাহিয়াও বিপরীত দিকে ঠাণ্ডা। অখণ্ড নীরবতার মাঝে প্রহর না বাড়িয়ে তাহিয়া নিজেই কথাটা ছোট্ট করে বলল,
- আগলে রাখতে জানলে আঁটকে রাখতে ক্ষতি কী? মানুষ চিনতে এক জীবন লাগে না, এক মুহুর্তই দামী। তুমি জানো এই কথাগুলোর অর্থ কী। তুমি এটাও জানো, তুমি রাখঢাকে যোগ্য পারদর্শী। কিন্তু অতো মুন্সিয়ানা দেখাতে গিয়ে হাতদুটো ঢিল দিয়ো না শোয়েব। হাতের জোর এবার একটু বাড়িয়ে দাও। তোমার একহাতে ওই দুইহাত আঁটবে। সেখানে তোমার দুহাতের জোর কতটা প্রবল!
—————
বাংলোয় সর্বোচ্চ তিনটে হারিকেন জ্বলছে। তন্মধ্যে দুটো দুঘরে। একটা মাত্র হারিকেন ডাইনিং টেবিলের ঘরটাতে রাখা। আশেপাশে কেউই নেই। ভূতুড়ে আচ্ছন্নতা ছেয়ে আছে চর্তুদিকে। হঠাৎ জানালার দিকে তাকালে গা ছমছম করে উঠে। বাইরে এখন বৃষ্টি নেই। থেমেছে আধঘণ্টা হলো। ঠাণ্ডা বাতাসে মন মাতানো সুবাস জড়ানো, নাকে লাগছে শ্যাওলা ভেজা সুগন্ধি সুবাস। সামনের হাঁট করে খোলা দরজাটা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল শাওলিন। ওমনেই দেখতে পেল বিশাল বড়, লম্বা প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দার চর্তুদিকটা খোলামেলা, ওপাশে গভীর সুন্দর বন, চারপাশে দুরন্ত হাওয়ায় ছড়াছড়ি চলছে। বুকে আছড়ে পরছে ঢিপঢিপে কাঁপন! মুগ্ধ, বিহ্বল, নেশালু নয়নে চারদিকটা দেখছিল শাওলিন। আর অনুভব করছিল, এমন এক পরিবেশ, এমন এক জগত, এমন এক নীরবতা, এমন এক অলীক ভুবন ও মনেপ্রাণে চাইতো। অথচ বাস্তবতার কঠোর আঁচে তা সম্ভব হতো না কখনো। বাঁদিকে চাইতেই দেখল কাঠের মেঝেতে তোশক পাতা। তাতে টানটান করে সাদা চাদর বিছানো। কাঠের দেয়াল ঘেঁষে একটা নরম কোলবালিশ, তার পাশে একটা ছোট কুশন। বৃদ্ধ গফুর নাশতা সমেত ট্রেটা সেখানেই রেখেছেন। সঙ্গে একটা হারিকেন উনি কখন এনেছিলেন, কে জানে! দুটো ইটের উপর সুন্দর করে হারিকেনটা ঠাঁই দিয়েছেন। সামান্য উঁচু থেকে ছোট্ট বসার জায়গাটা যেন স্বল্পলোকিত হোক। শাওলিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করতেই হঠাৎ একজোড়া ভারী পায়ের শব্দে পেল। বুকটা তৎক্ষণাৎ ধ্বক করে উঠল! মুখ তুলে তাকাতেই দেখল দরজার চৌকাঠে উপস্থিত হয়েছে শোয়েব ফারশাদ। হাতমুখ ধুয়ে বাড়তি পোশাক পড়ে এসেছে। কালো শার্ট, কালো ট্রাউজার, চোখে বাড়তি একসেট চশমা। ডান পকেটে মোবাইল ফোনটা ঢুকাতে ঢুকাতে ওর দিকে হিম কণ্ঠে বলে উঠল,
- আমি ভেবেছি তুমি আসবে না। তাই তোমাকে বিরক্ত করতে যাইনি।
কথাটুকু বলে ছোট্ট জায়গাটায় বসে পড়ল সে। শাওলিন দেখল তার হাতে একটা বই। মলাটের নামটা Pride and Prejudice. লেখক Jane Austin. উনি বই পড়েন? এজন্যই উনার বাচনভঙ্গি এতো সুন্দর? এ কারণেই অল্প কথায় গভীর অর্থ মিশিয়ে থাকে? ঠিক যেভাবে মণির হাতে একটা বইয়ের ভেতর পড়েছিল —
“অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।
এবার হৃদয় মাঝে লুকিয়ে বোসো,
কেউ জানবে না, কেউ বলবে না।”
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ব্যাপারটা ভাবতেই নিজের মনে পুলক অনুভব করল ও। পায়ে পায়ে বসার সেই ছোট্ট জায়গায় সেও একপাশে চুপিসারে বসলো। বইটা নিজের ডানদিকে রেখে ট্রে সমেত খাবারটা বাঁদিকে রাখল শোয়েব। হাফ লিটারের ছোট একটি ফ্ল্যাক্স থেকে কাপে কাপে কফি ঢালতে লাগল। আড়চোখে বাসন্তি বরণ ঝড়টার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল সে,
- বাড়তি চিনি খাবে?
পাশ থেকে নরম কণ্ঠটা বলল,
- দু চামচ।
- বেশি।
- জ্বী?
- মিষ্টি বেশি।
- তো?
- কিছু না।
শাওলিন আসলেই কিছু বুঝতে পারল না। ওর সবসময়ের অভ্যাস দু চামচ বেশি চিনি খাওয়া। চায়ে বা কফিতে এরকমই মৌখিক একটা নিয়ম পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু সেখানে বেশি বলে ঘোষণা দেবার কারণটা কী? ওর দিকে এক কাপ কফি বাড়িয়ে দিল বনকর্মী। বনের বৃষ্টি মাতানো দিনে গরম উষ্ণ পানীয়টা অন্যরকম সুখদ। দুহাতের মুঠোয় ছোট্ট কাপটা ধরে ঠোঁট ছোঁয়াল ও। পাশ থেকে ওই ঠোঁটদুটোর দিকে কেউ তাকিয়ে ছিল, তা খেয়াল রইল না ওর। দীর্ঘ এক চুমুক দিয়ে কথার তেরপল খুলল শাওলিন,
- আপনি আমার ব্যাপারে কী জানতে চান? কেন জানতে চান?
এক ধাক্কায় দুটো প্রশ্ন ছুঁড়ে ফ্যালফ্যাল চাহনিতে তাকাল শাওলিন। ওর সেই প্রশ্নদুটো যত্ন করে উত্তরে মুড়িয়ে পাশের মানুষটা বলল,
- মা ছাড়া জীবন কেমন, এটাই জানতে চাই। এছাড়া কোনো শক্ত কারণ নেই।
কথাটা কানের কাছে কেমন বিঁধে বিঁধে গেল। মুখ ফুটে বলা গেল না ব্যাপারটা। শাওলিন চোখ সরিয়ে নিজের কোলে তাকিয়ে রইল। কাপটা চুমুক দেয়া ঠোঁটদুটোর অপেক্ষায় ছিল, কিন্তু মিষ্টি ঠোঁটদুটো আর ছোট্ট চুমুকও দিল না। নিস্তব্ধ মুহুর্তে ঝিরিঝিরি বাতাস ছাড়লে একবুক দম টানল ও। শান্ত, ধাতস্থ, নির্জীব কণ্ঠে বলতে শুরু করল,
- মানুষের দুটো জীবন থাকে। একটা পৃথিবী; অন্যটা পরকাল। পৃথিবীর মানুষও দুটো জীবন ইহজন্মে যাপন করে। একটা সরল; অন্যটা গরল। সরলটা এতো সুন্দর, এতো নির্মল, এতো পরিচ্ছন্ন ছবি যে কেউ আপনার কাছে ধূলো ছড়াতে চাইলেও মলিন হবে না। একদিনের জন্য রঙ বিবর্ণ হবে না। কিন্তু গরলটা এতো বিশ্রী, এতো নোংরা, এতো কুৎসিত যে হাজারটা সুশ্রী ফুল আনলেও দূর্গন্ধ দূর হবে না। নোংরামি একটুও কমবে না। আমার মা ছিলেন প্রথমটা। সরল জীবন। সরলের সঙ্গে গরলের সম্পর্ক ছিল ভুলের মাশুল। আমার মা যতটুকু আয়ুষ্কালে বেঁচেছিলেন, সবটাই ছিল পদে পদে হেনস্তা। এমন নয়, আমার মা বোকা ছিলেন, অবুঝ ছিলেন, বুদ্ধি কম নারী ছিলেন। বরং আমি উনারই ঔরসের দ্বিতীয় সন্তান। আমাকে যদি আপনি নির্ভুল দেখেন, সঠিক পান, আমার মাও তাই। উনি বুঝতে পারতেন উনার সাথে অন্যায় হচ্ছে। উনি টের পেতেন মানুষ উনাকে মিষ্টি কথায় ছুরি দিচ্ছে। তবু উনি মানুষের সামনে কড়া আচরণ করতেন না। আল্লাহ পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ পাঠান, যাদের ধৈর্য এতোটাই বেশি, এই ধৈর্য শুধু হাজারটা অন্যায় সয়ে যাওয়ার পেছনে নিঃশেষ হয়ে যায়। শেষকালে ধৈর্যের জোগান এতোটাই ফুরিয়ে যায়, তখন আয়ুটাই একদিন ঠুনকো হয়ে যায়। কেউ কোনোদিন বুঝতেও পারে না ওই মানুষটার জীবনে কত কী ক্ষত লুকিয়ে ছিল। জীবনে একটাই ভুল করেছিলেন, আর সেটা ছিল একজন মানুষকে বিশ্বাস করার ভুল। ফলশ্রুতিতে আজ ফলাফল এতদূর যে, দ্বিতীয় সন্তান হিসেবে আমি উনার আঙুল ধরে রাখতে পারিনি। আমার মা ছাড়া জীবন না বলা গল্পের মতো। যে গল্প অন্যপ্রান্তের মানুষরাও বুঝতে অক্ষম। তার যা আছে, আমার তা শূন্য। তারা যা পাচ্ছে, তা আমার কাছে আরাধ্য।
এটুকু বলে নত মাথাটা বাঁদিকে ঘুরাল শাওলিন। গাল বেয়ে নেমে আসা অঝোর বর্ষা এই আলো-আঁধারির হলদে আলোয় চিকচিক করে ঝরছিল। হাতের কাপটা অনেকক্ষণ হল নামিয়ে রেখেছে শাওলিন। ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া কফি অবশিষ্ট অবস্থায় পড়ে আছে কাপে। পাশে চুপচাপ বসে থাকা শান্ত, নীরব মানুষটা নিজের মতো কফি উপভোগ করছে। তার লালচে-মেরুন ঠোঁটের কাছে কাপের কিনারা। অল্প করে চুমুক দিচ্ছে তাতে। চোখদুটো চশমায় ঢাকা, দূরের আকাশ ফেটে নীলচে বিদ্যুৎ তার চশমার কাঁচে প্রতিবিম্ব ফেলছে। একটু থেমে শেষ বাক্যটুকু আরেকবার গুছিয়ে নিল শাওলিন। মনের উত্থাল-পাত্থাল ঝড় বড্ড যন্ত্রণায় লাগাম ধরে অবশিষ্ট কথাটুকু বলল,
- এমনই এক সন্ধ্যায় মা ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছিলেন। ছোট্ট একটা ব্যাগ। ছোট্ট ছোট্ট মলাটবন্দি নতুন খাতা। এক বক্স নতুন পেনসিল। দুটো র্যাপার মোড়া রাবার। পরদিন সকালে আমার প্রথম স্কুল। চকচকে নতুন ইউনিফর্ম পড়ে স্কুলে যাব। অ্যাসেম্বলির লাইনে দাঁড়াব। সেই উত্তেজনায় রাতে আমার ঘুম হচ্ছিল না। আমার জীবনের প্রথম স্কুল! প্রথম আনন্দ! পরদিন খুব সকালে উঠে তৈরি হয়ে গেলাম। মা সেই শেষবারের মতো চুলে দুটো ঝুটি করে দিলেন। গলায় ওয়াটার বটল ঝুলিয়ে স্কুলের গেটে ঢুকতে গিয়ে কেন জানি পিছু ফিরে তাকালাম। মাকে টা টা দিয়ে ঢুকেও গেলাম। মা সদা প্রফুল্ল মুখে। উনি হাত নাড়িয়ে হাসছিলেন। যখন স্কুল শেষে বাড়ি ফিরলাম, দেখলাম সিলিং থেকে লাশ ঝুলছে। মায়ের মুখটা মৃত। সমস্ত শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে আছে।
সমস্ত কথা দুকানে শোনার পর শান্ত, অবিচল রইল শোয়েব। তার ভেতরে তেমন কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ব্যক্ত করছে, এমনি করে অটল শ্রোতার মতো শুনে গেল। শূন্য কাপটা পাশের ট্রেতে রেখে ট্রেটা মৃদু ধাক্কা দিয়ে ছোট্ট জায়গাটা থেকে দূরে সরাল। যেন অকস্মাৎ হাত লেগে ট্রের জিনিস উলটে না পড়ুক। আড়চোখে বাঁয়ে তাকিয়ে বুঝল, ছোট্ট মুখটা আবারও বাঁদিকে ঘুরিয়ে রেখেছে। গালের একটা পাশ অল্প খানিকটা স্পষ্ট। সেখানে চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে নামছে শান্তশিশির। নীল চোখের মালিক দেখতে পেল, তার পাশে বসে থাকা মেয়েটির হাত থরথর করে কাঁপছে। ডানহাতটাই শুধু লাগামহীন বেগে কেঁপে যাচ্ছে। ভেতরের যুদ্ধ, চোখের জল, নিঃশব্দ দহন সব যেন ওই হাতটুকুতে পরিস্ফুট। আস্তে করে নিজের ডানহাত ওই হাতের ওপর রাখল শোয়েব। চট করে বাঁ'পাশে ফেরানো মুখটা ডানে ফিরে আসে। শাওলিন অনুভব করে তার হাত কারো বজ্রমুষ্ঠিতে ডুবে যাচ্ছে। নরম আঙুলের উপর শক্ত আঙুলের আক্রোশ ঘিরে উঠছে। তীরবিদ্ধ নীল চোখদুটো ওর ভেজা চোখে মালিকত্ব ছুঁয়ে বলল,
- তুমি তোমার আম্মির মতোই। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে এসেছ। ক'বার হামলার শিকার হয়েছ। আজ দুপুরেও একটা দূর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেছ। কিন্তু কাউকেই কিছু বলোনি তুমি। বিপদসীমার অত্যন্ত কাছে আছ, অথচ আসল বিপদের ছোবল পাওনি।
·
·
·
চলবে........................................................................