অপরাহ্নের নিষিদ্ধ অনুভূতি - পর্ব ০৮ - ইসরাত তন্বী - ধারাবাহিক গল্প


          নব দিনের সূচনা। ঘড়ির কাঁটার দখলদারিত্ব আটটার ঘরে। বিষাক্ততায় মোড়ানো রাতের সমাপ্তি ঘটেছে অবশেষে। হসপিটালের কেবিনে মিরার পাশে বসে আছে তন্ময়ী। এখানে আসবে বলে আজ একটু তাড়াতাড়িই বাসা থেকে বের হয়েছে।আপাতত পাশে আর কেউ নেই। মিরার বাবা নেই, মারা গেছে বছর চারেক আগে। মা, ছাড়া এই জগতে নিজের বলতে আর কেউ নেই মেয়েটার। তন্ময়ী আসতেই ওর মা ছুটে গেছে নার্সের সাথে কথা বলতে। মেয়েটার চোখমুখ শুকনো ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। দৃষ্টি নিবিষ্ট বেডে বিছানো সফেদ রঙা চাদরে। রাত থেকে হঠাৎ করেই কথা কম বলছে। দেখেই মনে হচ্ছে হাসিখুশি চঞ্চল মেয়েটা এখনো নিজের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার ট্রমা থেকে বের হতে পারেনি। তন্ময়ী এসে যে পাশে বসেছে সেটাও সম্ভবত খেয়াল করেনি। মিরার বাম হাতে ক্যানোলা পড়ানো। স্যালাইন শেষ হয়েছে ভোর রাতে। তন্ময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিরার ডান হাতের উপর নিজের ডান হাতটা আলতো করে রাখল। মেয়েটা এতক্ষণে ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জাপটে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। হাতে ব্যথা পেলেও গুরুত্ব দিলো না। বুকের ভেতরের যন্ত্রণার কাছে এই ব্যথাটুকু খুবই তুচ্ছ।তন্ময়ীর বুকটা যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে উঠল। চোখের কোণে জল জমল। নিজেকে সামলিয়ে নিলো। মিরাকে বুকে জায়গা দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

"ওই জানোয়ার গুলো আমাকে মে রে দিয়েছে তনু। আমি ভালো নেই। বিশ্বাস কর আমার সব স্বপ্ন ওরা ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। আ.. আমাকে ওরা বাজেভাবে ছুঁয়েছে তনু।" 

কাঁপা কাঁপা গলায় কথাগুলো আওড়াল। তন্ময়ীর বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে হাত দিয়ে সবটা দেখাতে লাগল আর পাগলের মতো বিলাপ করতে শুরু করল মেয়েটা, "মাথার চুল ধরে টেনে হিচড়ে নিয়ে গেছে আমায় জঙ্গলর ভেতরে, এই হাতটা বাজেভাবে স্পর্শ করেছে, এই যে গলা ছুঁয়েছে, পা দুটোতে খুব ব্যথা দিয়েছে, পেটে চাকু দিয়ে আঘাত করেছে, আ.. আমার বুকের উপর কুকুরের মতো ঝাঁপিয়ে নিজেদের ক্ষুধা নিবারণ করেছে। কিন্তু, কিন্তু! শেষ‌ মুহুর্তে কী যে হলো জানি না। একটা ভয়ংকর গর্জনে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। তারপর মধ্যরাতে নিজেকে এই রুমে পেয়েছি। আমার অজান্তেই কি আরও খারাপ কিছু ঘটে গেছে এই আমিটার সাথে?" 

কথাগুলো বলতে বলতেই আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ল মিরা। তন্ময়ী এই পর্যায়ে নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হলো। আঁখি জোড়া দিয়ে বারিধারা নামল। নীরবে চোখের জল ঝরাল। মিরাকে পুনরায় বুকে আগলিয়ে নিলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নরম কণ্ঠ শুধাল, "তুই রাতে বাইরে কেন গেছিলি সোনা? তোদের বাসাটা এমনিতেই অফসাইডে।"

"মমের অসুস্থতার জন্য মেডিসিন আনতে বেরিয়েছিলাম। ওরা আমার সব শেষ করে দিয়েছে তনু। আমি অপবিত্র।"

"হুশশ! চুপ সোনা। তোর কিছুই শেষ হয়নি। পশু কোনো নারীর শরীর স্পর্শ করলেই কি সে অপবিত্র হয়ে যায়? ধরে নে একদল শু য়ো রে র দল তোকে তাড়া করেছিল, তোকে তাদের খাদ্য বানাতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি। এখানে তো তোর কোনো দোষ নেই। পশুরা তো কতকিছুই চায়। তাই বলে যারা তাদের হাত থেকে বেঁচে ফিরে তারা কি অপবিত্র হয়ে যায়? উঁহু, কখনোই না। পবিত্রতা আসে মন থেকে। শরীর ছুঁয়ে কখনো কাউকে অপবিত্র করা যায় না। এই যে দেখ আমাদের পিরিয়ডস এর সময় আমরা কিন্তু নামাজ পড়তে না পারলেও মুখ দিয়ে ঠিকই সব রকমের সূরা সহ আমল করতে পারি। মানুষের পবিত্রতা থাকে অন্তরে।"

মিরা তন্ময়ীর বক্ষস্থলে সেভাবেই পড়ে রইল। কথাগুলো নিগূঢ় মনোযোগের সহিত শুনল তবে মাথা তুলল না। কান্নার দরুন থেকে থেকে শীর্ণ কায়া কেঁপে উঠছে। তন্ময়ীর নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে। কাছের মানুষদের কষ্ট ও একদমই সহ্য করতে পারে না। কিয়ৎসময় পেরোল। মিরা বুকে মাথা রেখেই ছোট্ট করে বলল,

"ওরা নিজেদের প্রাপ্য শা স্তি পাবে তো তনু?"

"তুই কী চাস? ওদের কতটুকু শা স্তি পাওয়া উচিত?"

কিছুক্ষণ চুপ থেকে দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে উঠল মিরা, "মৃত্যু।" চোখে মুখে এক অন্যরকম অগ্নি প্রস্ফুটিত হলো। পরপরই তা নিভে গেল। দু'দিকে মাথা নাড়ল, "কিন্তু না, এমন কিছুই হবে না। ওদের বাবাদের অনেক ক্ষমতা। ওই এরিয়ায় কোনো সিসিটিভি ও নেই। প্রমাণ ছাড়া এইসব মূল্যহীন।"

"আচ্ছা চাপ নিস না। বাপের ও বাপ থাকে। ওদের মৃত্যু যদি তোর অন্তরাত্মার জ্বলন্ত আগুন নেভাতে পারে তাহলে আমি কথা দিচ্ছি তোর ইচ্ছা পূরণ হবে। শিঘ্রই তোর হৃদয়ে শীতলতা বিরাজ করবে।"

তন্ময়ীর মুখনিঃসৃত কথাগুলো মিরা প্রথমে ঠিক বুঝল না। কিছু সময়ের ব্যবধানে মস্তিষ্ক সবটা উপলব্ধি করতেই তবদা খেয়ে একদৃষ্টে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কান্না থেমেছে ততক্ষণে।তন্ময়ী নির্লিপ্ত, কেবল ঠোঁটে খেলা করছে কুটিল হাসি। ইশারায় আবারও বোঝাল 'চিইইইল বেইবি'।
এর অর্থ মিরা খুব করে বুঝল। তন্ময়ীকে অনেকগুলো বছর ধরে চেনে কি-না! ক্রন্দনরত আননেই মুচকি হাসল। পাঞ্চ করার উদ্দেশ্যে ডান হাতটা এগিয়ে দিলো। তন্ময়ীও হাত এগিয়ে পাঞ্চ করল। দু'জন সমস্বরে বলল, "ডান।"
এটা ওদের বন্ধুত্বের একটা অংশ। ওরা যখন কোনোকিছুতেই সহমত প্রকাশ করে তখন এমনটাই করে থাকে। কেবিনে মিরার মায়ের আগমনে ওদের আলোচনার ইতি ঘটল। তন্ময়ী ক্লাসের আগ অবধি হসপিটালে মিরার সাথেই কাটাল।

—————

ড্রুসিলা প্যালেসের সামনের বাগানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে তিনজন। রৌহিশ, তিয়াশ এবং রায়ান। সকালের মিষ্টি রোদের দেখা পাওয়া না গেলেও অল্পস্বল্প বোঝা যাচ্ছে যে রাতের অমানিশা কেটে দিনের আগমন ঘটেছে। তিনজনের মুখমণ্ডল'ই গম্ভীর দেখাচ্ছে। হয়তো আবারও কোনো ঝামেলা বেঁধেছে। স্যারের নীরবতার মাঝে কথা বলার মতো দুঃসাহস রায়ানের নেই। কিন্তু তিয়াশ? সে তার জানে জিগার বন্ধুর রাগ ব্যতীত অন্যকিছুই তোয়াক্কা করলে তো। ঠিক যেমন এখনো করল না। ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে রৌহিশের দিকে দৃষ্টিপাত করল অতঃপর বলতে শুরু করল, "আমার যতদূর মনে হচ্ছে কেউ আড়াল থেকে তোর সাথে খেলছে রৌহিশ। কিন্তু এটা কে? রোজ কি কোনোভাবে কিছু জানতে পেরেছে? নাকি নতুন কোনো আপদ উদয় হলো আবার?"

রৌহিশ ওর কথা শুনল কী শুনল না কে জানে? হয়তো! হয়তো না! দৃষ্টি তরুর শাখাপ্রশাখায় স্থির অবস্থায় আছে। তিয়াশ হতাশ চোখে রায়ানের দিকে তাকাল। ওর দিকে একটু এগিয়ে যেয়ে ফিসফিস করে বলল, "তুমি এই আস্ত রোবটের সাথে কীভাবে থাকো গো? কথা বলে না কিছু বলে না। সবসময় হনুমানের মতো করে রাখে মুখটা।"

রায়ান পড়ল বিপাকে। স্যারের বিরুদ্ধে সে কোনো কিছুই বলতে পারবে না। স্যারকে বড্ড ভালোবাসে কি-না? এদিকে তিয়াশ স্যারের প্রশ্নের জবাব না দেওয়া অভদ্রতা। সেটাও সে করতে পারবে না। ভদ্রতা রক্ষার্থে বলল, " স্যার এমন'ই তবে স্যারের ব্যাক্তিত্ব আমার ভীষণ ভালো লাগে। চাইলে আপনিও ওমন হতে পারেন স্যার।"

মিটিমিটি হাসছে রায়ান। আবারও কোনোভাবে কি তিয়াশকে কথা শোনাল ছেলেটা? সবসময়ের মতো এইবার ও পাত্তা দিলো না তিয়াশ। উল্টো রায়ানের কথায় চোখদুটো গোল গোল করে ফেলল, "ওরেম্মা! তুমিও দেখি তোমার স্যারের দলেই। শোনো রায়ান মশাই শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। তুমি মানো না মানো ও একটা রোবট।"

রৌহিশের শান্ত, শীতল দৃষ্টি ওদের দিকে নিক্ষেপ হতেই দু'জন থেমে গেল। দু'জনের শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠল। রায়ানের বুকটা এতো জোরে লাফাচ্ছে যে এক্ষুনি বোধহয় ওটা বের হয়ে আসবে। স্যারের এই দৃষ্টি সে ভীষণ ভয় পায়। অপরদিকে মুখে ফটরফটর করা তিয়াশ ও মিইয়ে গেছে। বন্ধুর দিকে তাকিয়ে একটা ভ্যাটকানি হাসি দিয়েই চুপ করে রইল। রৌহিশ নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো পুনরায়। বিটপীর শাখা প্রশাখায় দৃষ্টি ভাসমান হলো। শোনা গেল ঠাণ্ডা গলার আওয়াজ,

"স্মাইল, দে উইল নেভার সাসপেক্ট আ থিং।"

"কিন্তু রোহিশ তবুও...." তিয়াশ নিজের নিজের মনোভাব শব্দের বুননে প্রকাশ করতে পারল না। রৌহিশের কণ্ঠ শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছাতেই থেমে গেল।রৌহিশ সেভাবেই কপট হেসে আওড়াল,

"বর্ন টু বি আ ভিলেন।" নমনীয় ঘাড়টা শব্দ তুলে বাঁকিয়ে তিয়াশ, রায়ানের দিকে ঘুরল, "বি দ্য ভিলেন, বাট বি আনফরগেটেবল। অ্যাণ্ড দ্য মোস্ট পাওয়ারফুল ভিলেন ইজ দ্য ওয়ান হু নোজ হোয়াট দে ওয়ান্ট। লেটস দ্য ভিলেনাস সাইড সাইন। ইমব্রেসিং মাই ইনার ডার্কনেস।"

রৌহিশের অদ্ভুত ব্যবহার সহ কথাতে অপর দু'জন বেশখানিকটা ভড়কাল। কথার অর্থ বুঝল কিন্তু মর্মার্থ বুঝতে অপারগ। তৎক্ষণাৎ চারপাশের প্রকৃতি জুড়ে কালো ছায়ার রেশ ছড়াল। 'ব্ল্যাক' শব্দটাই রৌহিশের নিজস্ব স্বত্ত্বা বহন করে যেন। তিয়াশ, রায়ান উপলব্ধি করল ওরা আবারও কোনো বিপদের সম্মুখীন হতে চলেছে। তবে রৌহিশ যতক্ষণ সাথে আছে ওরা নিরাপদ।অপরপক্ষকে সজ্ঞানে হার বরণ নিতে হবে। এতগুলো বছরে রৌহিশের হিংস্রতা দেখার সুযোগ কেবল একবারই হয়েছিল। বেচারা রায়ান তো জ্ঞান হারিয়ে বসেছিল। আর তিয়াশ? সেই বা রৌহিশের থেকে কম কিসে? গোত্র আলাদা, প্রজাতি আলাদা। কিন্তু সাহসীকতায় পরিপূর্ণ এক মানব। উঁহু, মানব নয় হিংস্র এক প্রাণী।

সকালের একটা কথা মস্তিষ্কে হানা দিতেই একবুক ভয় মনে পুষে অধর নাড়াল রায়ান, "স্যার, বড়ো স্যার আপনাকে আজ বাসায় যেতে বলেছে।" দুশ্চিন্তার চাপে পড়ে কথাটা ভুলতেই বসেছিল ও। বড়ো স্যার ভোর রাতের দিকেই কল দিয়ে কথাটা জানিয়েছিলেন। রায়ান কথা শেষ করেই রৌহিশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

"ওকে।" 
নিজস্ব স্টাইলে পকেটে দুই হাত রেখে গটগট পায়ে হেঁটে প্যালেসের ভেতরে চলে গেল রৌহিশ। প্রতিটা কদম অদমনীয়। ও যেতেই হাফ ছেড়ে বাঁচল তিয়াশ। ভ্রু কুঁচকে রায়ানের উদ্দেশ্য প্রশ্ন ছুঁড়ল, "আংকেল হঠাৎ তলব করার কারণ কী?"

"জানি না তবে সম্ভবত ড্রুসিলা ইম্পায়ারের কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন। ইম্পর্ট্যান্ট ইস্যু।"

তিয়াশ বুঝদারের মতো বার কয়েক মাথা নাড়ল। পরক্ষণেই দু'জন প্যালেসের দিকে হাঁটা ধরল।
·
·
·
চলবে.....................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp