নীলাম্বরে রৌদ্দুরের হাতছানি - পর্ব ২০ - বেলা শেখ - ধারাবাহিক গল্প


"আমি না কথা বলতে ভালোবাসি। তবে সবার সাথে না। যাকে ভালোলাগে ঘুরে ফিরে তার কাছেই যাই। কিন্তু সে যদি উপেক্ষা করে আমার প্রচুর রাগ হয়। রাগের চোটে কান্না পায়। মনে হয় মাথার সব চুল টেনে ছিঁড়ে দিই।"

কোণা চোখে নিষ্ঠুর খিটখিটে মানবের পানে তাকিয়ে শফির উদ্দেশ্যে বলে রূপসা। খিটখিটে লোকটা ভুল ক্রমেও তাকায় না। যছন রূপসা মাহবুব খান বলতে কেউ এই গ্যারেজে কেন দুনিয়াতেও নেই। রাগে অভিমানে নয়নাভিরাম ভরে ওঠে। তর্জনী আঙ্গুল তুলে নাকের নিচে ডলা দেয়।

"তুমি খুব ভালো শফি। কত মিষ্টি একটা ছেলে। দেখলেই মন চাইবে গাল টিপে দিই। দিই?"

মিহি স্বরে অনুমতি চায় রূপসা। শফি পারেন না খুশির ঠেলায় দৌড়ে গিয়ে সিন ভাইয়ের গালে চটাস করে চুমু খেতে। লাজুক হেসে তেলে মাথায় হাত রেখে পরিপাটি করে। গালটা দুই হাতে ঘষে বাড়িয়ে দেয়। রূপসা মুচকি হেসে আলতোভাবে গাল টিপে দেয়। শফির বুকটা যেন ধড়ফড়িয়ে ওঠে। বুকের ডান পাশে হাত রেখে বলে,

"আপা আমার বুকটা ধরফড় করে ক্যান? মনে হইতেছে কলজ্যা লাফাইতেছে। আমার কি হইলো কও তো আফা?"

রূপসা খিলখিল করে হেসে দেয়। শফির মাথায় আলতোভাবে চাটা মেরে বলে,

"বুদ্ধু ওটা কলিজা না, হৃদপিন্ড। আর হৃদপিন্ড বুকের বা পাশে থাকে।"

শফি ঘার চুলকে মিটমিট হাসে। রূপসার হাসি দীর্ঘ হয়। শফিটা তাঁর মতোই সহজ-সরল আর বোকা বোকা। 

"রূপসা আপা আপনে মেলা সুন্দর। আপনের মতো সুন্দর মাইয়া পাঁচ গেরামে নাই।

শফির কথায় রূপসা হাসির গতি কমিয়ে আনে। চোরা চোখে শ্যামল থমথমে মুখ পানে চেয়ে লাজুক স্বরে বলে,

" ধ্যাত, কি যে বলো না শফি! তোমার মন সুন্দর তাই সবাইকেই সুন্দর লাগে। যাদের মন কালো তাদের কাছে পুরো দুনিয়া কালো। তারাই মুখ কালো করে ঘুরে বেড়ায়।'

শফি কি বুঝলো কেন জানে। দাঁত কেলিয়ে ফিসফিস করে বলে, "তার ছেঁড়ার কথা কইলা?"

"তার ছেঁড়া কে?"

রূপসার অবুঝ গলা। শফি দম নেয় বলার জন্য। কোত্থেকে সিনান এসে চাটি মারে মাথায়। খ্যাঁক করে বলে ওঠে,

"কাজ কাম বাদ দিয়া রসের আলাপ জুইড়্যা দিছোস? ফ্যাক ফ্যাক করে দাঁত কেলাও বলি লজ্জা শরমের মাথা খাইছোস? পর-মাইয়া মানুষের সাথে কিসের হাসাহাসি?"

শফি মাথা ডলে বিরক্ত চোখে চায়। ধচং বচং করে সিনানের হাত হতে বালতি নিয়ে পানি আনতে যায়। রূপসা জড়সড় হয়ে বসে। সে পরপুরুষ শুনেছে পর-মাইয়াও হয়? হাসি হাসি মুখ বানিয়ে বলে,

"সিন ভাই তোমার মুখে কালি লেগে আছে। ওই যে বা গালে?"

সিনান শুনেও না শোনার ভান করে লাল টুলে বসে। হিসেবের খাতা খুলে তাতে মনোযোগী হয়। রূপসার হাসি নিভে যায় দপ করে। লোকটা এমন কেন? তাঁর সামনে কেমন গা ছাড়া ভাব নিয়ে চলে। রূপসা উঠে আসে। সিনানের পিছনে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখে কি লেখছে। কি লিখছে বোধগম্য হয় না। তবে অবাক স্বরে বলে,

"সিন ভাই তোমার হাতের লেখা কি সুন্দর! অথচ আমি জানি তুমি পড়াশোনা জানো না।"

সিনান নিজ লেখা দেখে ভ্রু কুচকালো। সুন্দর লেখা? লিখছেই গোটাকয়েক সংখ্যা তাঁর আবার প্রশংসার ঝুলি! রূপসা হতাশ হয়। প্রশংসায়ও কাজ দিলো না। তবে সে হাল ছাড়ে না। আবারও উচ্ছ্বসিত গলায় বলে,

" জানো সুর আপা আর রিজ ভাইয়ের বিয়েতে আমারও হাত আছে। আমি অনেক আগে থেকেই জানতাম। রিজ ভাইকে কত সাহায্য করেছি। তাই বিয়ের ফিফটি পার্সেন্ট ক্রেডিট গোস টু মি। তালিয়াআ?"

হাত তালি দেয় রূপসা। সিনান মুখ বাঁকায়। আপন ভাইয়ের পশ্চাতে বাঁশ দিয়ে চাচাতো ভাইয়ের সংসার গড়ে দিয়ে তালি বাজাচ্ছে। মাথামোটা গর্দভ বেকুব মহিলা! রূপসা হঠাৎ মন খারাপির সুরে বলে,

"তবে রওশন ভাইয়ের জন্য না খারাপ লাগছে। আমি জানতাম নাকি ভাইও সুর আপাকে পছন্দ করে? জানলেও বা কি! রিজ ভাই তো রিজ ভাই। জানো? রিজ ভাই তো চাচি আম্মার মুখের উপর কতো কথা বলে দিলো। চাচি আম্মার মুখটা দেখার মতো হয়েছিলো। আমি তো হেসেই দিয়েছিলাম। আমার আবার সিরিয়াস মুহুর্তে হাসি পায় বেশি।"

রূপসা থেমে নেই। অপরপক্ষ প্রতিক্রিয়া না দেখাক সে তো গল্প করে বেশ মজা পাচ্ছে। যাকে বলে হাওয়ায় উড়ছে। সিনানের ধৈর্য বরাবরই কম। এতো ফাও পেঁচালে মেজাজ চটে যায় দপ করে। কিন্তু মেজাজটা উগড়ে দেওয়ার মানুষ পায় না। যার তাঁর উপর তো মেজাজ দেখানো যায় না। মানুষ ঘুরে ফিরে অতি কাছের মানুষের কাছেই মেজাজ দেখায়। শফিকে বালতি হাতে আসতে দেখে খিটখিটে মেজাজ বেরিয়ে আসে।

" কহন থাইক্যা ছাগলের মতো ভ্যাঁ ভ্যাঁ করেই যাচ্ছিস। একটা চর খাইলে কাইন্দ্যা কুল কিনারা পাবি না। তহন বাপ ভাইয়ে আমার গর্দানে ছুরি ধরবো। আর আমি তোর সোহাগি লাগি আগলা পিরিতি দেহাইস? বলি লজ্জা শরম নাই?"

শফি বালতি হাতে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঝাড়ির আগামাথা বোধগম্য হলো না তার। তবে যার বোঝার সে বুঝে গেছে। মনটা কাচের চুড়ির মতো মুচড়ে চুর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছে নিষ্ঠুর নির্দয় পাষন্ড। অপমানে দগ্ধ কিশোরীর চোখের পানি বাঁধ মানে না। নেকাবটা নামিয়ে গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে যায় ধুপধাপ পায়ে। শফি এবার বুঝতে পারে সব। রাগ হয় প্রচুর। এই সিন ভাই এমন ক্যান? ভালো কইরা কথা না কইতে পারলে চুপ থাক; খ্যাক খ্যাক করবি ক্যান? শফি বালতি ভর্তি পানি ফেলে দেয় রাগে। 

"অনেক হইছে সিন ভাই। তুমি আমারে গাল দাও! মারো আমি মুখ বুইজ্যা সহ্য করি। রাগ হইলেও কিছু কই না‌। কিন্তু রূপসা আপারে কেন গাল দিলা? আপা কানতে কানতে চইল্যা গেলো কেমন কইরা তোমার মনে কি একটুও মায়া দয়া নাই?"

শফির রাগি আওয়াজে শুরু করলেও সিনান সালেহের শাণিত চাহনিতে শেষের দিকে মিইয়ে যায়। সিনান এগিয়ে আসে ক্ষিপ্ত মেজাজে। শফি ভয়ে দৌড় দেয় তবে সুবিধা করতে পারে না। পেছন থেকে সিনান শফির হাফ প্যান্ট টেনে ধরেছে। শফির মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে আসে। সিনান বদমেজাজি গলায় বলে,

"পানি নষ্ট করলি ক্যান? পরের মাইয়ার জন্যে দরদ উতলাই পড়তাছে শফি সাহেবের? পরের মাইয়ার আক্কেল নাই পরপুরুষের গ্যারেজে বইসা হি হি হা হা করে। গায়ে পইড়্যা কথা কইতে আহে। পাশে রহিম চাচার দোকানে হাজার মানুষ আসে‌। তিলেক তাল বানাইতে সময় লাগবো? পরের মাইয়ার কিছুই হইতো না। তয় ওর বাপ ভাইয়ে গাড়ি নিয়া আইস্যা এলাচ ছাড়া বিরিয়ানি খাওয়াই যাইবো। আমার শখ নাই খাওয়ার।"

শফি ভোঁতা মুখে বাম দিকের মোড়ে তাকিয়ে আছে। সিনান তাঁর দৃষ্টি খেয়ালে রেখে কপাল কুঁচকে ঘার ঘুরিয়ে তাকায়। আলালের ঘরের দুলালি টইটম্বুর চোখে এগিয়ে আসে। স্যাঁতস্যাঁতে মাটির মেঝের গ্যারেজ। একপাশে আধভাঙা টেবিল আর লাল টুল। রূপসা টুলে বসে টেবিলের মাথা রেখে চোখ বুজে নেয়। সিনান শান্তি চোখে তাকায়। এই মেয়ের লজ্জাবোধ নেই? সুরকে রাতে একটু কথা শুনিয়েছে বোনটা লজ্জায় সামনে আসে নি। আর এ মেয়ে কি দিয়ে তৈরি? 
শফির কনুইয়ের গুঁতোয় বিরক্ত মুখে তাকায়। শফি গোমরাহ মুখে রাস্তায় কতকগুলো বখাটে ছেলেদের দেখায়। দুলালি যে রাস্তা থেকে ফিরে এলো সে রাস্তা দিয়েই আসছে। 

°°°°°°°°°°°°°

ধাগায় সুতো জড়ায় আরিফা। হাতের আঙুলে কাপড় পেঁচিয়ে লাগিয়ে নকশা আঁকা কাঁথায় সুই ফুটোয়। অধর কোণে লেপ্টে লাজুক হাসি। ছামিনা বেগম পাশে বসে আরিফাকে পরখ করে যায়। মেয়েটার লাজুক মিষ্টি মিষ্টি ভাবভঙ্গি পছন্দ হয়েছে তাঁর। শান্ত শিষ্টাচারে ভরপুর মেয়ে। পড়াশোনাতেও নাকি বেশ ভালো। এই ব্যাপারটা বেশি মুগ্ধ করেছে তাকে। পড়াশোনার প্রতি তাঁর আলাদা দূর্বলতা কাজ করে। একজন সুশিক্ষিত মানুষ বরাবরই বুদ্ধিমান আর ঝুটঝামেলা থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে। অহেতুক তর্ক বিতর্কে জড়াবে না। 

"রিফা? তোমার পুরো নাম কি?"

হঠাৎ প্রশ্নে খানিকটা চমকপ্রদ হয় আরিফা। ভদ্রসুলভ হেসে জবাবে বলে, "আরিফা তাবাসসুম রিফা।"

"এসএসসি দিয়েছো তাই না? রেজাল্ট কি এসেছে?"

আরিফা জড়সড় হয়ে বসে। এভাবে জিজ্ঞাসা করছে কেন?আম্মা কি তাহলে খালাকে জোড়া জুরি করেছে? লজ্জায় মুখটা লাল হয়ে আসে তাঁর। কোনোমতে জবাব দেয়,

"৪.৫৫"

ছামিনা বেগম অবাক হয়। চর এলাকার এক বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয় হতে ৪.৫৫ পেয়েছে মানে মেয়েটা মেধাবী সন্দেহের অবকাশ নেই। ছামিনা বেগম এ যাত্রায় মুচকি হেসে বলে,

"মাশাআল্লাহ অনেক ভালো রেজাল্ট করেছো। আমার রওশন সে-ই চার সনে দিয়েছিল। কোন মতে ফোর পয়েন্ট তুলেছিল। ওর বাবা তো পুরো এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করেছে। রিজ তার অনেক আগে দিয়েছিল। মনে হয় দুই হাজার না হয় এক সনে। থ্রি পয়েন্ট নাইন এইট পেয়েছিল।"

সে নিজেও দিয়েছিলো রওশনকে পেটে নিয়েই। টু পয়েন্ট পেয়ে পাশ করেছিলো। শশুর শাশুড়ি আর স্বামীর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না। বড় জায়ের তো মুখই নেই। ভাবতেই হাসি পায় তার। আরিফা সুঁই কাঁথায় ফুটায়। ছামিনা বেগম বলেন,

"কলেজে ভর্তি হও নি শুনলাম! হওয়ার ইচ্ছে নেই নাকি?"

আরিফার হাত থেমে যায়। ইচ্ছে তো আছে অনেক। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতেই হবে। আরিফাকে চুপ থাকতে দেখে ছামিনা বেগম ভ্রু উঁচিয়ে বলে,

"তোমার মা ভর্তি করিয়ে দিবে না?"

"তেমন না। গ্রামে এসএসসি পাশ মানে অনেক পড়াশোনা। তাছাড়া বাবা নেই। মেয়ে বড় হয়েছে বিয়ে দিতে হবেই। ভাইয়া দু'দিন পরপরই একে ওকে ধরে আনেন। আম্মা প্রথম প্রথম গাইগুই করলেও এখন তিনিও চাইছেন।"

বলতে বলতে চোখ ভিজে ওঠে আরিফার । লুকানোর প্রয়াসে হাঁটুর ভাঁজে মুখ লুকিয়ে কাঁথা সেলাই করে। ছামিনা বেগমের মায়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে এক সময় তিনিও পড়েছিলেন। নাইনে উঠতেই মা বিয়ে দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর বাবা একজন শিক্ষক ছিলেন। গৃহিণীকে বুঝ দিতে পারে নি। পাঠিয়ে দেয় শ্বশুর বাড়ি। কথা ছিলো উচ্চ মাধ্যমিক অবদি পড়াবেন। ম্যাট্টিক দেওয়া নিয়েই কত নাটক হলো। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

"তোমার ভাই তো আলাদা হয়ে গেছে। তোমাদের দেখভাল করে না। দায়িত্ব যখন নেয় নি কথা বলবে কেন?"

লজ্জায় পড়ে আরিফা।

"কি যে বলেন না খালা। দেখবে না কেন? ভাই যথাসাধ্য চেষ্টা করে আমাদের জন্য!"

ছামিনা বেগম হাসেন। রাহেলা বানু মুখরোচক মানুষ। গল্প করার সময় দিন দুনিয়া ভুলে যান। শুধু ছেলের কেন পুরো আত্নীয় স্বজনের নারী নক্ষত্রের গাঁথা শেষ করেছেন। বিয়ের পর ছেলের উপর মায়ের হক ফুরিয়ে যায়। বউ বউয়ের শশুর বাড়ির লোকজন ছাড়া ছেলে কিছুই চোখে দেখে না। তিনি আর কিছু বলেন না আরিফা কে। মেয়েটার এই গুনটাও ভালো লাগে তাঁর। মনোমালিন্য আছে আমাদের ভেতর আছে অন্যদের বলে বেড়ানোর মানেই হয় না।

°°°°°°°°°°°

কাল বাদে পরশু পবিত্র রমজান মাস শুরু হবে। প্রথম রমজানে বিয়ের দিন তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। নোমান মাহবুব ঈদের পরে দিন ফালাতে চেয়েছিলেন। নওরিজ ছোট্ট করে বলেছিল ঈদের আগেই বাড়ির বউ ঘরে তোলার ব্যবস্থা করুন আব্বা। নোমান মাহবুব চটে গিয়ে দু'দিন পরেই দিন ঠিক করে এসেছে। নওরিজ মাহবুব এ কথা শুনে একটু বিব্রত বোধ করলেও আমলে নেয় না। বিয়ের বন্দোবস্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দিন যে হাতে নেই। ওদিকে আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। কতবার কথা বলতে গিয়েছে। হতাশ হয়ে ফিরে এসেছে। আজ সকালেও গিয়েছিল গয়নাগাটির ব্যাপারে কথা বলতে। তাঁর আম্মা আলমারি হতে সব গয়নার বাক্স বের করে দিয়েছিল থমথমে মুখে। একটা কথাও বলে নি। নওরিজ ছুঁয়েও দেখে নি। ছোট করে বলেছে,

"আম্মা আপনার পুত্রবধূ সে। ভালোবেসে মন থেকে দিলেই গ্রহণ করবে তাছাড়া না।"

তারপর এখন সে সেঁকরার কাছে বসে গয়না দেখছে। বৃদ্ধা সেঁকরা নওরিজের থেকে গয়নার মাপজোক আর নকশা বুঝে খাতায় টুকে নিচ্ছেন। 

"দাদা আমার কিন্তু কালকের মধ্যেই সব কমপ্লিট চাই। বুঝতেই পারছেন হুট করে বিয়ের দিন পড়লো। নতুন বউকে গয়না ছাড়া ঘরে তুলি কি করে?"

নওরিজের কথায় ভদ্রলোক হাসেন। পানের পিক ফেলে বলে,

"তা ঠিক বাছা। তবে কথা হলো তুমি যেমন নকশা দেখাইলা সব পুরনো আমলের। ওহন আধুনিক যুগ। বউ পছন্দ করবে তো? এতো বড় নাকশলা আর কেউ পড়বার চায় না।"

নওরিজ উঠে দাঁড়ালো। অগ্রিম টাকা পরিশোধ করে রাশভারী স্বরে প্রত্যুত্তরে বলে, "সে পড়বে দাদা। আপনার নাত বউয়ের পছন্দ আমার নখদর্পণে। আপনাকে সেসব ভাবতে হবে না। গয়না গুলো যত্নসহকারে বানাবেন। আসছি!"

সেঁকরার দোকান থেকে বেরিয়ে নওরিজ ফোন বের করে। সংরক্ষনে থাকা রওশনের নম্বরে ফোন করে। দু'বার রিং হলেও পরের বার বন্ধ দেখায়। নওরিজের কপালে ভাঁজ পড়ে। বিয়ের খবর ওর অবদি পৌঁছে গেছে? তার জন্যই কি ধরছে না? সে যাইহোক তাঁর বিয়েতে একমাত্র ভাই উপস্থিত থাকবে না এটা কেমন দেখায়! এমনিতেই বাড়ির কাজের মেয়ে গুসুর ফুসুর করছে। হয়তোবা গাঁয়ের ঘরে ঘরেও পৌঁছে যাবে অতিশীঘ্রই!সে সাদমানের নম্বরে ফোন করে সবটা জানিয়ে রাখে। যদিও আব্বা কথা বলবেন সে একটু গুছিয়ে নিলো। বাঙালির বিয়েতে সবচেয়ে সাধারণ বিষয় ঝি জামাইয়ের মনোমালিন্য! বিয়ে বাবদে তাদের ভাব একটু না বেশিই বেড়ে যায়।

" ভাই ঘটনা তো একটা ঘটে গেছে। পুরো গাঁও থমথমে অবস্থায়।"

হারুণ ছুটে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে ওঠে। নওরিজ ফোনটা পকেটে পুরে জিপে উঠে বসে। স্টেয়ারিং হাত রেখে কৌতুহল গলায় বলে,

" সাসপেন্স কম রাখ। কি হয়েছে?"

"মতিনের এক দের বছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে ছিলো। মেয়েটা মারা গেছে। ওর বউয়ের আহাজারিতে পুরো গাঁও কাঁদছে। প্রথম বাচ্চা ছিলো। কিভাবে কি হয়েছে জানতে চাইলে মতিন জানায় নিউমোনিয়া হয়েছিলো। ডাক্তারের কাছে নিয়েছিলো। শ্বাস নিতে না পেরে মারা গেছে।"

হারুণের কন্ঠস্বর কাঁপছে। মতিনের ঘর তাদের ঘরের সাথেই। বাচ্চাটা কতবার ছুটে আসতো তাদের বাড়িতে। সেই বাচ্চাটা নাকি নেই। বিশ্বাস হচ্ছে না এখনো। নওরিজ সুক্ষ্ম চোখে চায়। গাড়িতে উঠতে ইশারা করে বলে,

"সদরে নিয়েছিল? নাকি নর্থ বেঙ্গলে? অক্সিজেন মাস্ক পড়ায় নি?"

হারুণের মুখচোপা বিবর্ণ দেখায়। থমথমে গলায় বলে,

 "ভাই পুরা কথা শুনেন তো। মতিন এই কথা গায়ে ফিরলে ওর বউ তেড়েফুঁড়ে যায়। লাথি গুঁতো যা পারে মারে। সবার কাছে গলা ফাটিয়ে জানায় মতিনই নাকি বাচ্চাডারে মারছে। কাল রাতে কিসব আনছিলো। সাদা সাদা পাউডার। অনেক গুলো গোলাপি বড়ির মতো। সকালে মতিনের বউ রান্না করতে বইছিলো। ছোট বাচ্চা চুপ থাকে কন? চৌকির তলায় গিয়া ওসব খাইছে ইচ্ছে মতো। খাইয়া অজ্ঞান হইছে। মতিনের বউ তো তহন থাইকা কান্নাকাটি শুরু করে দিছে। পরে ডাক্তারের কাছে নিয়া গেল। ফিরলো লাশ নিয়া। ফেরার পথে মতিন নাকি কানতে কানতে কইছে এসব কাউরে না কইতে। বলতৈ নিউমোনিয়ায় মারা গেছে। মায়ের মন তাই মানবো কন?"

স্টেয়ারিং-এ থাকা হাত কেঁপে উঠলো। বুকটা কেঁদে ওঠে নওরিজের। একটা দুধের বাচ্চা বলি হলো বাবার ভয়ানক কাজে। আর বাপ? কুত্তার বাচ্চারে হাতের কাছে পেলে কি করবে নওরিজ জানে না। মুখটা ক্রমশই রক্তিম হয় রাগে। আবারও ফোন করে সাদমান ভাইয়ের নম্বরে।

°°°°°°°°°°

"এই বিয়ের কণে? একা একা দোলনায় দোল খাচ্ছিস! নিশ্চয়ই বর'রে নিয়ে পঁচা পঁচা স্বপ্ন দেখছিস?"

সুরেলা দোল থামিয়ে ঘার ঘুরিয়ে তাকায়। প্রাণপ্রিয় সখিকে দেখে মলিন মুখে হাসি ফুটে ওঠে। মারিয়া দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে সখিকে। উচ্ছ্বসিত গলায় বলে,

"সইরে আমি কত্তো খুশি বোঝাতে পারবো না।"

"এতো খুশির কারণ? তোর ভাঙ্গা চোরা জামাই আইছিলো নাকি? আদর সোহাগ কইরা মন ফুরফুরে কইরা দিছে বুঝি?"

সুরেলার রসকষহীন বেখাপ্পা গলায় লাজে রঙিন হয় মারিয়া। সখির পিঠে কিল বসিয়ে বলে, 

"কি সব অশ্লীল কথাবার্তা! সে আসে না। বলে তোমার বাড়িতে গেলে সবাই লজ্জা দেয় যে, বউয়ের জন্য তর সয় না। তাই আর আসবে না।"

সুরেলার মন খারাপি ধুলোয় মিশে যায় সখির হাসিখুশি মুখটা দেখে। রশি বাঁধা দোলনায় বসিয়ে দু'জনে দোল খায় অল্প গতিতে। সুরেলা হেসে বলে,

"বিয়ে করতে লজ্জা করে নাই এখন আসছে লাজুকলতা। পুরুষ মানুষ ক্যান লজ্জা পাইবো? সে তো বুক ফুলিয়ে বলবো আমার বউকে যতদিন তুলে না দিচ্ছেন আসা যাওয়া লেগেই থাকবে সে যতই টিপ্পনী কাটুন।"

শেষের কথাটা ভারী স্বরে অভিনয় করে বলে। মারিয়া হেসে উঠলো খিলখিল করে। হাসতে হাসতে চোখে পানি জমে যায় তাঁর।

"উনি খুব লজ্জা পায় জানিস? ফোন দিয়ে একমিনিট চুপ থাকবে। তবে তোর বয়স্ক ভা/তার মনে হয় না লাজ শরম রাখে। তোর তো সোনায় সোহাগা কপাল সুরেলা সালেহ!"

মারিয়ার কথায় সুরেলার চোখের আকার বড় হয়। কান্তিমান আঁখি যুগ্ম নজর লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মারিয়া আবারও হেসে বলে,

"ওলে লে লে। ডার্লিং লজ্জা পাচ্ছে বুঝি? কাল বাদে পরশু সব লজ্জাকে বুড়ো আঙুল দেখে নিস!"

"ছিঃ! মারু বেশি বেশি বলছিস কিন্তু! আমি বললে লজ্জায় পুকুরে ঝাপ দিবি।"

সুরেলার হুমকিতে দমে যায় মারিয়া। সিনান সালেহের বোনের সাথে পাঙ্গা না নেওয়াই উত্তম। মহিলা ভাইয়ের কোনো অংশে কম না। বেশ সময় নীরাবতায় কেটে যায়। দুই বান্ধবী পুকুর ঘাটে বাঁধা দোলনায় মৃদু গতিতে দোল খায়। নীরাবতার জাল ভেঙে মারিয়া বলে,

"তো হবু বধুয়া অনুভূতি কেমন? কাল পরশু বাদেই বিয়ের পিঁড়িতে বসবে বলে কথা!"

সুরেলা শান্ত চোখে চায় সখির দিকে। কাজলে টানা ডাগর ডাগর চোখ জলে চিকচিক করে। উদাসী গলায় বলে,

"আমার খুব ভয় হচ্ছে সই। একমন খুশিতে আপ্লুত হয় তো আরেকমনে শঙ্কা জাগায়। আরেকদিকে ভাইয়ের চোখে চোখ রাখতে পারছি না।"

মারিয়ার কপালে ভাঁজ পড়ে। সখির কাঁধে গুঁতো মেরে বলে, "হইছে কি খুইল্যা ক বইন!"

সুরেলা কাতর গলায় বলতে শুরু করে, 

"রিজ ভাইকে ছোট থেকেই তো দেখে আসছি। লোভী ভাবলে ভাব। তবে এটা সত্যি ওনাদের বিশাশ বড় বাড়ি গাড়ি দেখে আমার মন চাইতো আমারও যদি এমন বাড়ি হতো! গাড়িতে চড়তে পারতাম।!ভাইকে বললে মারতো। মায়ের সাথে চেয়ারম্যান বাড়ি যেতে দিতো না। আমি তবুও যেতাম। ভালো লাগতো অনেক। তারপর বড় হলাম। সাথে বুঝতে শিখলাম যে বড় বড় বাড়ি গাড়ি না মনটা বড় হওয়া বড্ড জরুরি। ও বাড়িতে সবাই অহংকারী বুঝলি? এক রওশন ভাই বাদে। সে স্নেহ করতো খুব। নওরিন আপু, ছবি আপু খেলার সাথী না কাজের লোকের মেয়ের মতোই ব্যবহার করতো। গিন্নী মায়ের কথা নাই বলি। রূপসা তো ছোট ছিলো। ওকে কোলে নিয়ে ঘুরতাম বাকিরা খেলতো। তখন সিক্সে পড়ি মনে হয়। একদিন কোণায় একটা ঘরে গিন্নী মা পাঠিয়ে দিলো ঘর ঝাড়ু দিতে। ঘরটা রিজ ভাইয়ের। তাকে চিনতাম তবে কখনো কথা হয় নি। অহংকারী ভাব আর খুঁতখুঁতে স্বভাবের কারণে দূরে দূরেই থেকেছি। তিনিও বাড়িতে থাকতেন না। পড়াশোনার জন্য অন্যত্র থাকতো। সেদিন ঘর ঝাড়ু দিতে গিয়ে দেখি ভদ্রলোক সিডি চালিয়ে সিনেমা দেখছিলেন। পাশেই চায়ের কাপ। আমি সিনেমা চলছে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে যাই। ভুলবশত ঝাড়ুর মাথার সাথে লেগে ওনার চায়ের কাপ পড়ে যায়। আমি তো ভয়ে জান যায় যায় অবস্থা। কাপ তো ভেঙেছেই সাথে গরম চা লোকটার হাতে পায়ে পড়েছে। গিন্নী মা জানলে তো সুনামি উঠে আসবে। আর এই খুঁতখুঁইত্যা লাট সাহেব কি করবে আল্লাহ মালুম! তবে আমাকে আশ্চর্য করে উনি কিছুই বলেন নি। ওনার মা'কেও বলেনি চায়ের কাপ আমার জন্য ভেঙেছে। ভুলবশত তাঁর সাথে লেগেই পড়ে গেছে। আমার কেন জানি খুব ভালো লেগেছিল ব্যাপারটা। তারপর থেকেই শয়তান আমিটার হাবভাব পাল্টে যায়। রিজ ভাইয়ের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। ওনার কাছে আবদার করতাম উনি কখনো ফেরান নি। ছোটখাটো সব বিষয়ই জানাতাম। গল্প করতাম। একটু একটু করে ভালো লাগতে শুরু করে। তারপর একদিন জানতে পারি ছবি আপু ওনাকে পছন্দ করে। উনিও নাকি ছবি আপুকে পছন্দ করে। বিয়েও করবে। ছবি আপুই বলেছিলো আমাকে। আমার না খুব কষ্ট হচ্ছিল জানিস? ছবি আপু হঠাৎ আমার সাথে ভাব জমাতে শুরু করে। আমার ভালো লাগতো না ওনাকে। কিছু বলতেও পারতাম না। একদিন ছবি আপু একটা চিঠি পড়তে দেয়। বলে রিজ ভাই দিয়েছে ওনাকে। তাই তিনিও চিঠি লিখবেন। আমাকে বলে লিখে দিতে। আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও লিখেছি। ছবি আপু পড়ে খুশি হয়। আমাকেই বলে দিয়ে আসতে। আমি চিঠি তো দিয়েছিলাম তবে সেটা বদলে দিয়েছিলাম। হাবিজাবি কিসব লিখেছি যা বলার মতো না। পরদিন এসে দেখি মামলা গরম। রিজ ভাই খুব ধমকে ছিলো আমাকে। ছবি আপুর মুখটাও থমথমে ছিলো। আমাকে ধমকে ছিলো বলে কষ্ট পেলেও ছবি আপুর থমথমে মুখ দেখে কি যে খুশি হয়েছিলাম! তারপর থেকে ছবি আপু খুব খারাপ ব্যবহার করতো। আমিও যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। তারপর দূরত্ব সৃষ্টি হয় আপনে আপ। আমিও বুঝতে শিখেছি ওটা আবেগ ছিলো। ওনার সৌন্দর্য আভিজাত্য টানতো আমাকে। তবে ভালোলাগার রেশ কোথাও একটু থেকেই যায়। সেটা বাড়তে শুরু করে যখন লোকটাকে সামনে থেকে দেখি বা সে আশেপাশে থাকে। আমার ভয় হয় খুব। আমি চাই না তাঁর সাথে জুড়তে। ততক্ষণে কিছুটা হলেও বুঝতে পারি তাঁর মনের খবর। আমার বিশ্বাস হতো না বুঝলি? ওনার মতো লোক আমার মতো কাইল্যার পেছনে কেন পড়ে থাকবে? তুই ই বল?"

বিশাল বড় রচনায় মারিয়া হামি তুলে। এসব তাঁর জানা তাই ঘুম চলে এসেছে। সখির মাথায় চাটা মেরে বলে,

"তুই না সখি ফাও পেচাল কম করো। আয়নায় দেখছোস নিজেরে? গায়ের রং একটু চাপা তাও অযত্নের ফল। দু'দিন রানির হালে থাকলেই দেখবি ঝকঝক করছিস। আর চেহারার কথা কি বলি? তোর যা টানা ডাগর ডাগর চোখ। ও চোখে তো আমিই ডুবে যাচ্ছি সই!"

সুরেলা গায়ে মাখে না। দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।

"তুই তো ওনারে দেখছোস। রাজপুত্তুর একদম। ওনার মা নিশ্চয়ই রাগে বোম হয়ে আছে।ওই পরিবারের সাথে আমি কিভাবে মানিয়ে নিবো বল সই?"

"তাইলে এক কাজ কর বিয়া ভাইঙ্গা দে!"

মারিয়ার ভাবলেশহীন গলা। সুরেলা মলিন হাসে। গলায় পেঁচিয়ে থাকা ওড়নাটা সরিয়ে একটা স্বর্ণের চেইন দেখিয়ে বলে,

"ওই খুঁতখুঁইত্যা লাট সাহেব গভীর জলের মাছ বুঝলি। নিকাহনামা পড়া হয়ে গেছে।"

মারিয়া ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকে। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে,

"দেখতে এসেই বিয়ে পড়িয়ে দিলো? আমাকে জানালি না অবদি?"

সুরেলা স্বাভাবিক ভাবেই বলে, "তাঁর আগেই হয়ে গেছে। হাত ধরে টেনে কাজি অফিসে নিয়ে গিয়েছিল। পথে ওনার বাবা আর আমার বাপরে ফোন দিয়া আনছিলো।"

মারিয়া তড়িঘড়ি এগিয়ে আসে। সখির দুই কাঁধ ধরে বিস্ময়ের সাথে বলে, "কস কি সুর? সিন ভাই জানে? তোরে জোরজবরদস্তি অরে বিয়ে পড়াইছে? নাকি খুশির ঠেলায় চ্যাল চেলাইয়া কবুল কইছোস?"
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp