অপরাহ্নের নিষিদ্ধ অনুভূতি - পর্ব ০৬ - ইসরাত তন্বী - ধারাবাহিক গল্প


          রাতের শহর সেজেছে রং বেরঙের কৃত্রিম আলোয়। দিনের সমাপ্তি ঘটেছে ঘণ্টা দুয়েক হতে চলল। শেখ সাদমান কিছুক্ষণ আগেই বাসায় ফিরেছেন। মাত্রই ফ্রেশ হয়ে ওয়াশ রুম থেকে বের হলেন। আজ তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার কথা থাকলেও কাজে আটকিয়ে গিয়েছিলেন। যার দরুন সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে উনি মেয়ের আবদার ভুলে যাননি। শত ঝামেলার মাঝেও ঠিক মনে রেখেছেন। আরাধ্যা শেখ বিছানায় বসে তন্ময়কে পড়াচ্ছেন। শেখ সাদমান ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। চুলে চিরুনি চালিয়েই পিছু ঘুরলেন। একটু কাশলেন। আরাধ্যা শেখ ওনার দিকে তাকাতেই প্রশ্ন করলেন, "আমার আম্মা কোথায়?"

অমনিই আরাধ্যা শেখের চোখে জল জমল। মনটা ভার করে বললেন, "ওর যে আজ কী হয়েছে কে জানে? ভার্সিটিতে যেয়েও ফিরে এসেছে। ক্লাস করেনি। বাসায় এসে থেকেই চুপচাপ নিজের রুমে পড়ে আছে। কারোর কথা বলছে না ঠিকমতো। ইভেন খাচ্ছেও না। আমি জিজ্ঞাসা করলেও এড়িয়ে যাচ্ছে সবটা।"

আরাধ্যা শেখের ব্যবহারে একটু অবাক হলেন শেখ সাদমান। ভেবেছিলেন প্রিয়তমা স্ত্রী হয়তো ওনার করা প্রশ্নের জবাব'ই দিবে না। অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে নিবে। কিন্তু ঘটনা তো উল্টো‌। রেখে যাওয়া জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড এখন সায়রের ন্যায় উত্তাল অথচ আগুন ঠিক নিভিয়েছে। পরক্ষণেই তন্ময়ীর বিষয়টা চট করে মস্তিষ্কে হানা দিতেই দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আরাধ্যা শেখ ও পিছু পিছু ছুটলেন। চঞ্চল মেয়েটার এই শান্ত রুপ উনি মেনে নিতে পারছেন না। ভালো মেয়ে ভার্সিটিতে যেয়ে হঠাৎ কী হয়ে গেল? মায়ের মন তো কত কিছুই ভাবছে। একদণ্ড শান্তি পাচ্ছেন না।

শেখ সাদমান আলতো হাতে দরজায় টোকা দিতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো ঠাণ্ডা গলার নির্লিপ্ত আওয়াজ, "ভেতরে এসো বাবা।"

মেয়ের কথায় মনটা ভালো লাগায় ছেয়ে গেল শেখ সাদমানের। ওনাকে চিনতে কখনো একটুও ভুল করেনা তন্ময়ী। উনি ভেতরে যেতে নিয়েও পাশ ফিরে চাইলেন। আরাধ্যা শেখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন "তুমি রুমে যেয়ে রেডি হও। সাথে তন্ময়কেও রেডি করিয়ে দাও। সময় আধাঘণ্টা। আমরা সবাই বেরোব। আম্মার সাথে কথা বলে রাজি করিয়ে নেই কেমন?" আরাধ্যা শেখ স্বামীর কথায় বাধ্যের মতো মাথা নেড়ে প্রস্থান করলেন। একটু ঘোরাঘুরি করলে মেয়ের মন হয়তো ভালো হয়ে যাবে। 

শেখ সাদমান ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই কিঞ্চিত চমকালেন। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে কিচ্ছুটি দেখার উপায় নেই। নিগূঢ় নিস্তব্ধতায় মোড়ানো ঘরের পরিবেশ। যেদিকে চোখ যাচ্ছে সেদিকেই যেন অশরীরীদের মেলা বসেছে। ডান দিকে হাত বাড়িয়ে লাইট অন করতে নিয়েও কী যেন ভেবে থামলেন। ডাক ছাড়লেন, "আম্মা কোথায় আপনি?"

সকালের মতো এবারও জবাব এলো ব্যালকনি থেকেই। উনি সময় নষ্ট না করে সেদিকে এগিয়ে গেলেন। শশীর ভরা পূর্ণিমার আলোতে মেয়ের উদাস আনন চক্ষুগোচর হতেই বাবা নামক মানুষটা একটু থমকালেন। বুকটা যন্ত্রণায় পিষ্ট হলো। তন্ময়ীর পাশে বসতেই ও জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত কাজটাই করে বসল। বাবার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিলো মেয়েটা। শেখ সাদমান কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কী হয়েছে তার আম্মার? খুব কী কষ্টে আছে? নিজের অজান্তেই কি অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছে? কষ্টের পাহাড় এতোটাই বেড়েছে যে তার আম্মা নিজের শক্ত খোলস থেকে বেরিয়ে এসেছে? অবশ্য আমরা মানুষেরা একজনের কাছে সবসময় আদুরে বিড়ালছানা থাকি। যার কাছে অনায়াসে খুব সহজেই নিজের সবটা উগলিয়ে দেওয়া যায়। এমন একটা মানুষ জীবনে না থাকলে তার জীবন জাহান্নামের থেকে কোনো অংশে কম নয়। প্রতিনিয়ত নিজের মন, মস্তিষ্কের সাথে লড়তে হয় তাকে। শেখ সাদমান নিজের ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসলেন। মেয়েকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলেন। চুলের ভাঁজে বার কয়েক ঠোঁট ছুঁইয়ে শুধালেন,

"কী হয়েছে আম্মা? কষ্ট কী খুব বেশি? বলা যাবে না বাবাকে?" 

বাবার আদর মেশানো প্রতিটা বাক্যে তন্ময়ীর কান্না আরও বাড়ল। সময় পেরোল। শেখ সাদমান মেয়েকে বুকে জড়িয়ে সেভাবেই বসে রইলেন। কথা বললেন না। মেয়েকে হয়তো সময় দিলেন। উনি জানেন তন্ময়ী ওনাকে সবটা ঠিক বলবেন। আর হলোও তাই। কিছুক্ষণ পেরোতেই তন্ময়ী নিজেকে সামলিয়ে নিলো। বাবার বুকে মাথা রেখেই ভাঙা গলায় আওড়াল,

"আমার মাঝে একটা অদ্ভুত রকমের সত্তা আছে বাবা। যেই সত্তাটা অনেক বেশি সাহসী। ওইটা আমি তন্ময়ী না বাবা। ওইটা অন্য কোনো তন্ময়ী। যেই তন্ময়ী শান্ত, ভীতু তন্ময়ীকে মেরে দিয়ে নিজের আধিপত্য বিস্তার করেছে। আমাকে ভালো থাকতে দিচ্ছে না। আমার ভালো থাকা কেড়ে নিয়েছে। আমি ভালো নেই বাবা। আজকাল আমি আমার মধ্যে থাকি না বাবা।" 

মেয়ের বলা প্রতিটা শব্দে শেখ সাদমানের বুকব্যথা ক্রমশ বাড়ল। বুক চিরে পাঁজর কাঁপানো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মানসপটে এক টুকরো অতীত ভাসল। পরক্ষণেই দু'দিকে মাথা নাড়লেন। ওইসব একদমই ভাবতে চান না। অতীত ভুলে সব যখন শুরু করেছেন তখন সেই অতীত মূল্যহীন। কিন্তু আসলেই কি তাই? চাইলেই কি এতো সহজে সবকিছু জীবনের মূল্যহীন খাতায় ফেলে দেওয়া যায়? উঁহু, একদমই না।

"ভুল বললেন আম্মা। আপনার ওই রুপটাই আপনার ভালো থাকার কারণ। আমার আম্মা আপনি। আপনাকে সবটুকু চিনি তো এই আমি। আমাদের সবার ভেতরেই সুপ্ত একটা রুপ থাকে আম্মা। সেটা কেবল হিংস্র রুপ। আমার ভেতরেও আছে আম্মা। কিছু ঘটনা সাপেক্ষে সেই রুপটা প্রকাশ পায়।" 

একটু থামলেন। ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিলেন, "একজন মেয়ের নিজেকে রক্ষা করার মতো এতটুকু ক্ষমতা থাকা উচিত আম্মা। এই ছোট্ট জীবনের কোনো এক পর্যায়ে মানুষকে একা থাকতে হয়। সেই সময়টাতে হয়তো কারোর সঙ্গ পাওয়া যায় না। একাকীত্বের ভারে ভেতরে ভেতরে গুমরে ম রে মানুষ। এই মহাবিশ্ব বড়োই অদ্ভুত আম্মা। আমাদের দেখার, জানার আড়ালেও অনেক কিছু রয়ে যায়। আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিটা ঘটনা আমাদের নতুন নতুন অভিজ্ঞতা এনে দেয়‌। নতুন কিছু শিক্ষা দেয়।" 

তন্ময়ী চুপ করেই রইল। বাবার কথাগুলো শুনল কিন্তু কোনো প্রত্যুত্তর করল না। একটু অন্যরকম অনুভূতির সাথে পরিচিত হলো। কীভাবে যেন মনের ভার অনেকটাই কমে গেল। ততক্ষণে কান্না থেমেছে ওর। শেখ সাদমান নরম সুরে আবারও ডাকলেন,

"আম্মা?"

"হুঁ।"

"ঘুরতে যাবেন না?"

"ভালো লাগছে না।"

"গেলে ভালো লাগবে। আপনার মা রেডি হচ্ছে।"

"যেতেই হবে?"

"উঁহু, কোনো জোর নেই আম্মা। কেবল আপনাকে একটাবার বাঙালি নারীর রুপে দেখার ইচ্ছাটা পূরণ হবে না আমার। ব্যস এতটুকুই।" বাবার চালাকি বুঝতে পেরেই তন্ময়ী ফিক্ করে হেসে দিলো। সেভাবেই বলল, "তুমি ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করা শিখে গেছ বাবা। আমার বোকা ছেলেটা চালাক হয়ে যাচ্ছে।"

"আপনার থেকেই শিখেছি আম্মা। মাম্মাস বয় বলে কথা!" কথাটা বলে উনি নিজেও হেসে ফেললেন। তন্ময়ীও বাবার সঙ্গ দিলো। কিছুক্ষণ আগের বিষাদে ছেয়ে থাকা ঘরটাতে আনন্দ হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করল। সবটুকু বিষাদ ঢাকা পড়ল খুশির ছোঁয়ায়। বাবা, মেয়ের এই চোখজুড়ানো মুহূর্তে হাসল আরও একজোড়া নেত্র। অমানিশার চাদরে আবৃত থাকা ঘরের সর্বকোণ ঈষৎ কম্পিত করে শোনা গেল একটা পুরুষালী নিরেট মৃদু কণ্ঠস্বর,

"বাবা, মেয়ের এই স্নিগ্ধ, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আজীবন বেঁচে থাক।" 

—————

ঘড়ির কাঁটা টিকটিক শব্দ তুলে অবস্থান করছে নয়টার ঘরে। শেখ পরিবার একটা লেকের পাড়ে বসে আছে। চারজন হালকা, পাতলা নাস্তা করছে আর আড্ডা দিচ্ছে। তন্ময়ীর কোলে ওর পোষা কিটেন। মেয়েটা ভালোবেসে ওর নাম রেখেছে স্নোবল। স্নোবল চোখজোড়া গোল গোল পরিবারের সবার আড্ডা দেখতে ব্যস্ত। প্রাণীটার নিষ্পাপ লোচন দুটো জ্বলজ্বল করছে। যেন ঘুরতে এসে ও নিজেও খুব খুশি। মেয়েকে আবারও আগের মতো পেতেই আরাধ্যা শেখের খুশি আরও দ্বিগুন বেড়েছে। মনখুলে হাসছেন মানুষটা। তন্ময়ী মায়ের হাসিখুশি মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। জীবনের সবটুকু সুখ, শান্তি যেন ওই মুখটাতেই নিবিষ্ট আছে। তন্ময়ী মুচকি হাসল। এইজন্যই হয়তোবা আল্লাহ তায়ালা মায়ের অবস্থান সবকিছুর উপরে রেখেছেন। মায়ের পদতলে জান্নাত রেখেছেন। তন্ময়ী মনে মনে ভাবল ও নিজেও খুব ভালো একজন মা হবে ঠিক সামনে উপস্থিত মধ্যবয়সী নারীর মতোই। যার ভালোবাসা অদৃশ্য, অপ্রকাশিত কিন্তু জলধির মতো সুগভীর। যেই ভালোবাসা লুকিয়ে আছে এক ঘণ্টার বকাবকির মাঝে, সকালের যত্ন করে তৈরি করা নাস্তার প্লেটে, মধ্যরাতে তন্ময়ীর কপালে হাত রেখে শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা স্নেহের স্পর্শে, তন্ময়ীর একটু জ্বর হলেই কেঁদে ফুলিয়ে ফেলা আঁখি জোড়ায়, এছাড়া আরও কত্ত কী! মায়ের ভালোবাসা আবার পরিমাপ করা যায় নাকি? উঁহু! মায়েদের ভালোবাসা নিখাদ, নিঃস্বার্থ। নিজের ভাবনায় নিজেই হাসল মেয়েটা। কিন্তু আফসোস আমরা চাইলেই যে সবটা হয় না! আমাদের সব শখ, ইচ্ছা পূরণ হয় না।

আড্ডার মাঝেই অকস্মাৎ তন্ময়ীর ফোনটা সশব্দে বেজে উঠল। ব্যাঘাত ঘটাল সুন্দর একটা মুহূর্তে। ফোনের স্ক্রিনে একটা আননন নাম্বার উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। রিসিভ করবে না করবে না করেও করল। পরক্ষণেই যা শুনল তাতেই নয়ন যুগল বড়ো বড়ো হয়ে গেল। মুখটা হা হয়েই রইল। সবটা শুনতেই আঁতকে উঠল তন্ময়ী। উপস্থিত তিনজন শুধু তন্ময়ীর বলা একটা কথাই শুনতে পেলো, "আমি আসছি।" ব্যস আর কিচ্ছু না। তন্ময়ী তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়াল। স্নোবলকে তন্ময়ের কোলে দিয়ে বাবা, মায়ের দিকে তাকিয়ে কোনোরকমে বলল, "তোমরা বাসায় চলে যেও। আমাকে যেতে হবে। কোনো প্রশ্ন করো না। বাসায় ফিরে সবটা বলব।" মুখের কথা শেষ করেই ছুটে চলে গেল মেয়েটা। সবাই ফ্যালফ্যাল করে ওর প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে রইল। শাড়ি পড়েই বাইক নিয়ে ছুটল। অবশ্য শাড়ি সেভাবেই পড়া আছে। সমস্যা হচ্ছে না। আরাধ্যা শেখ আজ নিজ হাতে মেয়েকে শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছেন।

—————

তন্ময়ী হসপিটালের সামনে বাইক থামিয়েই কোনোদিকে না তাকিয়ে ত্বরান্বিত পদযুগলে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল। ফোর্থ ফ্লোরের বাটন টিপেই অপেক্ষায় রইল। কিছু সময়ের ব্যবধানে কাঙ্ক্ষিত ফ্লোরে পৌঁছাতেই ছুটে গেল চারশ তিন নম্বর কেবিনে। কেবিনের সামনে পৌঁছাতেই দেখল কিছু মানুষের জটলা। মিরার পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতি চক্ষুগোচর হলো। তন্ময়ীকে দেখতেই মিরার মা এগিয়ে আসলেন। ওকে জড়িয়ে ধরেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। ক্রন্দনরত অবস্থায় অস্ফুট স্বরে বললেন, "আমার মিরারে অনেক কষ্ট দিয়েছে তনুমা। মেয়েটার শরীরে অনেক জায়গায় আঘাত করেছে।"

তন্ময়ীর মনে হলো কেউ ছুরিকাঘাতে ওর বুকটা এফোঁড়ওফোঁড় করে দিলো। দাঁতে দাঁত চেপে কান্না দমাল। হস্তজোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে সামলানোর সবটুকু প্রয়াস চালাল, "আন্টি আমার মিরা এখন কেমন আছে?"

"ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। ঘুমাচ্ছে এখন।"

"কোথায় থেকে এমনটা হয়েছে?"

"আমার বাসার পাশে ওই যে একটা বাগান আছে না ওখানে?" ব্যস তন্ময়ীর ধারাল মস্তিষ্ক সবটুকু খুব সহজেই বুঝে ফেলল। ভালো মন্দ দুটো কথা বলে আর দাঁড়াল না। উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরল। পিছন থেকে শুনতে পেলো ক্লারার নিস্তেজ কণ্ঠস্বর, "মাত্রই তো আসলি। আবার কোথায় যাচ্ছিস?"

"আমার কাজ আছে। আগামীকাল সকালে আসব এখানে।" কয়েক সেকেণ্ডেই তন্ময়ীর সাথে কথাগুলোর অস্তিত্ব ও মুছে গেল হসপিটালের করিডোর থেকে। বেনামি হাওয়ায় ভেসে গেল দূরে, বহুদূরে।

—————

মিরার বাসা থেকে কিছুটা দূরে সেই বাগানের সামনে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তন্ময়ী। হাতে হকিস্টিক এবং নাইফ। ও খুব ভালো করেই জানে কারা করতে পারে এমনটা। একটা নারীকে আঘাত করার মতো দুঃসাহস ওই পশু গুলো কীভাবে পেলো? ওরাও তো কোনো না কোনো নারীর গর্ভ থেকেই জন্ম নেওয়া সন্তান। তাহলে? তন্ময়ীর ভাবনার মাঝেই বাগানের ভেতর থেকে কিছু যুবকের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। মেয়েটা হাসল আলগোছে। হকিস্টিক, নাইফ হাতে এগিয়ে গেল সেদিকে। একটু ভেতরে প্রবেশ করতেই পাঁচটা মাতাল জানোয়ারের সন্ধান পেল। সবগুলো মিনিটে বোধহয় পাঁচ/ ছয় পেগ করে গিলছে। তন্ময়ীর কাজটা নিজেরাই আরও অধিকতর সহজ করে দিচ্ছে। 

পায়ে পায়ে সামনে অগ্রসর হলো তন্ময়ী। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোনো কথা ছাড়াই এক জনের মাথায় হকিস্টিক দিয়ে সজোরে আঘাত করল। মাথায় হাত দিয়ে ওখানেই লুটিয়ে পড়ল সেই যুবক। রক্তে ভাসল মৃত্তিকা। জ্ঞান হারিয়েছে বোধহয়! বাকিগুলো চোখে চারজন করে নারী দেখছে। এতো গুলো নারী হকিস্টিক, নাইফ হাতে কী প্রয়োজনে এসেছে? কোনোভাবে কি মেরে দিতে? কিন্তু কেন? ওদের অপরাধ কী? আর কিছু ভাবার ফুরসৎ মিলল না। বেধড়ক ক্যালানি খেয়ে মাটিতেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইল সবগুলো। তন্ময়ী হাঁফাতে হাঁফাতে হাত উঠিয়ে কপালের একাংশের ঘাম মুছল। পিছন থেকে কারোর হাঁটার শব্দ ভাসমান। বিটপীর ঝরা শুকনো পাতাগুলো মড়মড় শব্দ তুলে কারোর আগমনের আগাম বার্তা দিব্যি জানিয়ে চলেছে। তন্ময়ী একটু সাবধান হলো। বুঝল জানোয়ার গুলোর আধো আধো আর্তনাদ শুনে ওদের দলের'ই কেউ হয়তোবা আশপাশ থেকে ছুটে এসেছে। শব্দটা মিলিয়ে যেতেই আস্তে ধীরে পিছু ফিরল। অমনিই বিশালদেহী একজন যুবক চোখের সামনে ভেসে উঠল। ওই মানুষ নামক পশুর সাথে পেরে ওঠা তন্ময়ীর পক্ষে সম্ভব নয় তবুও ও ভয় পেলো না। উল্টো অধর প্রসারিত করে হাসল। এতেই যেন অপরপক্ষ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। হনহনিয়ে সামনে এগিয়ে তন্ময়ীকে আঘাত করতে নিলেই ও এক পলকেই নিচে বসে একমুঠো মাটি নিয়ে যুবকের দিকে ছুঁড়ে মারল। ওর নিশানা কখনো ভুল হয় না। যুবক চোখ ধরতেই তড়িৎ গতিতে পা উঠিয়ে অন্ডকোষ বরাবর নিজের সর্বশক্তি দিয়ে লাথি মারল। করুণ আর্তনাদে মুখরিত হলো বাগানের সর্বদিক। যেই জায়গাটা কিছুক্ষণ আগেই একজন নারীর আর্তনাদে কেপেছিল এখন সেই জায়গাটা কাপ ধরেছে আঘাতকারী সেই জানোয়ারগুলোর কাতর চিৎকারে। এটাকেই বলে রিভেঞ্জ অব ন্যাচার। আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে হাত রেখেই মাটিতে বসে পড়ল যুবক। তন্ময়ী হকিস্টিক তুলে মাথা বরাবর পুনরায় আঘাত করতে নিলেই অপরহাতে সেটা ধরে ফেলল ছেলেটা। তন্ময়ী বাঁকা হাসল। ডান পা উঠিয়ে ডিরেক্ট গলা বরাবর লাথি মেরে কনুই দিয়ে মুখমণ্ডল বরাবর আঘাত করতেই নাক, মুখ ফেটে গলগল করে রক্ত উঠে আসলো। হকিস্টিকে মুষ্টিবদ্ধ থাকা হাতটা একটু ঢিলা হতেই তন্ময়ী সুযোগ বুঝে মাথার মাঝবরাবর পরপর তিনটা বাড়ি মেরে বসল। নাইফ দিয়ে একটানে বুকের মাঝ বরাবর ক্রস এঁকে দিলো। ব্যস অপরপক্ষ সহজেই কুপোকাত। এক নিমিষেই যেন সবটা ঘটে গেল। কিছুক্ষণ গুঙ্গিয়েই যুবকের শান্ত, স্থির দেহখানা বাগানের মাটিতে পড়ে রইল। তন্ময়ী সবগুলোর নাসারন্ধ্রের নিকট আঙ্গুল এগিয়ে দেখল। প্রাণে বেঁচে আছে তবে মেইন পয়েন্টের কাজ শেষ। জীবনে আর কোনো মেয়ের সম্মান নষ্ট করা তো দূর গায়ে হাত তোলার মতো দুঃসাহস করবে না। 

ওখানে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না তন্ময়ী। দ্রুত বাগানের বাইরে বেরিয়ে আসলো। মুখে থাকা মাস্কটা তাজা র ক্তে স্নানিত হয়ে ভ্যাপসা দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। আলগোছে ওটা খুলে হাতেই রাখল। কোথাও ফেলল না। ফেসে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। যদিও ওর মনে হচ্ছে ও ফাঁসবে না। বিগত কিছুদিন থেকে কেউ একজন হয়তো ওকে আড়াল থেকে প্রটেক্ট করে চলেছে। কিন্তু কে সেই মানুষটা সেটাই জানার বাকি রয়ে গেছে। মনের জল্পনা-কল্পনার ইতি টেনে সামনে তাকাতেই তন্ময়ীর সবটুকু হিংস্রতা বিলীন হয়ে মুখটা চুপসে একটুখানি হয়ে গেল। ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। তৎক্ষণাৎ দরদরিয়ে ঘেমে উঠল মেয়েটা। চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসলো। অথচ অপর পাশে অবস্থান করা ব্যাক্তির হ্যাজেল রঙের মণি জোড়ায় ছড়িয়েছে একরাশ মুগ্ধতা। হৃৎস্পন্দন কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। খেই হারিয়ে বসেছে নিজের। দু'জন কপোত কপোতীর একে অপরের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলতেই প্রকৃতিতে এক অদ্ভুত শক্তিশালী কালো অশুভ ছায়া বিরাজ করল। চারপাশ জুড়ে দমকা পবন বয়ে গেল। কেঁপে উঠল তন্ময়ীর শীর্ণ কায়া। পরক্ষণেই ভীষণ শ্বাসকষ্ট অনুভব করল মেয়েটা। আশেপাশের পরিবেশ গুমোট রুপ ধারণ করেছে ততক্ষণে। যেন হঠাৎ করেই জায়গাটায় অক্সিজেনের সংকট দেখা দিয়েছে। 

সম্মুখে সদ্য ফোটা স্নিগ্ধ, কোমল পুষ্পের ন্যায় প্রস্ফুটিত শুভ্র রঙা শাড়ি পরিহিত এক রমনী। অনেক আগেই হাত খোঁপাটা খুলে সুদীর্ঘ কৃশলা পিঠজুড়ে ছড়িয়েছে। খোঁপায় বাঁধা বেলি ফুলের মালাটা চুলের একপাশে ঝুলছে। হাঁটু ছাড়িয়ে যাওয়া কেশগুলো রাতের প্রকৃতির মৃদুমন্দ গতিতে বয়ে চলা বাতাসের সহিত উড়ছে। স্কন্ধে অবলীলায় পড়ে থাকা আঁচলটা কোমর পেঁচিয়ে শাড়ির কুচির সাথে স্থান পেয়েছে। কালো কুচকুচে মণি জোড়ার চারপাশে লাল র ক্তে র রেখা ফুটে উঠেছে। চিকন পাতলা র ক্তে রাঙা ওষ্ঠজোড়া তিরতির করে কাঁপছে। হস্তজোড়া র ক্তা ক্ত নাইফ ও হকিস্টিকের দখলে। সফেদ রঙের শাড়ি জুড়ে তাজা লাল র ক্তে র ছোপ ছোপ দাগ স্পষ্ট। দুধে আলতা গায়ের রঙের উপর লাল রঙের র ক্তে র ফোঁটা গুলো ভীষণ নজর কাড়ছে। 

বহ্নির ন্যায় চোখ ধাঁধানো নারীর এমন রুপে অপরপক্ষ কথাটা বলতেও ভুলে গেছে। নিজের অজান্তেই মন মস্তিষ্ক খুইয়ে বসেছে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমনী যেন সাক্ষাৎ এক হুর পরী। একটা মানুষ কখনো এতোটা সুন্দর হতে পারে না। ও আগে কখনো এতো সুন্দর মানুষ দেখেনি ইভেন নিজের ভ্লাডিমির ইম্পায়ার সহ অন্যান্য ইম্পায়ারেও এমন আগুন সুন্দরী কোনো নারী নজরে আসেনি। একভাবে তাকিয়ে থাকার দরুন যুবকের আঁখি যুগল কেমন যেন ধাঁধিয়ে আসে। দ্রুত তা নামিয়ে নেয়। দুই মেরুর, সম্পূর্ণ আলাদা দুই সত্তার অধিকারী দুটো মানুষের অপ্রত্যাশিত, অনাকাঙ্ক্ষিত প্রথম সাক্ষাৎ যেন নতুন কিছুর সূচনার ঘ্রাণ ছড়াল প্রকৃতির মাঝে!
·
·
·
চলবে......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp