বাসায় গিয়ে লগ্ন পাগলের মতো কাঁদলো। নাদভির দ্বারা প্রতারিত হবার পরেও সে এতটা কাঁদেনি, যতটা আজ কাঁদল। এতদিনের সব জমানো কষ্টের যেন বাঁধ ভেঙে গেছে আজ। কেন একটা প্রতারককে এতটা ভালোবেসে ফেলল যে ওর সব কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে! যখন প্রতারিত হলো সেই মুহূর্তেই তো সব ভালোবাসা উধাও হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। অথচ গেল না! এমনভাবেই রয়ে গেল যে, মন বলে ও আজ সব সত্যি বলছে। কিন্তু মস্তিষ্ক বলে ও মিথ্যা বলছে। নিজের ওপর এত রাগ আগে কখনো লাগেনি তার।
পরদিন সকালে লগ্ন ইফতেখার মাহমুদকে ফোন করল। ইফতেখার বললেন, ‘অনেকদিন পর আপনার ফোন। তা কেমন চলছে?’
‘চলছে ভালোই। আপনার কী খবর?’
‘ভালো।’
‘ইফতেখার আমার একটি ব্যাপারে আপনার সাহায্য দরকার।’
‘জি বলুন।’
‘নাদভির বাবা-মা কীভাবে মারা গেল সেটা আমার জানা দরকার। আপনি কি একটু খোঁজ লাগিয়ে দেখবেন?’
‘নিশ্চয়ই। ও এখন কোথায় সেটা জানা না গেলেও আশা করি এটা জানা যাবে। তবে কথা দিতে পারছি না যে আসলেই কোনো তথ্য দিতে পারব কি না। চেষ্টা করব।’
‘ওতেই হবে।’
ইফতেখার কলব্যাক করল দুদিন পর। জানাল, সে এক বন্ধুর মাধ্যমে জেনেছে নাদভির বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন আর মা দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগে মারা গেছেন।
—————
এই অফিসে সবচেয়ে অসহ্যকর বিষয় হচ্ছে লগ্নকে নাদভির সাথে একই টিমে কাজ করতে হচ্ছে। কাজের কারণেই প্রতিদিন তাদের কথা হচ্ছে। এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। একদিন লগ্ন পায়ে ব্যথা পেল। তাদের টিম লিডার বলল, নাদভি যেন লগ্নকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে। লগ্ন প্ৰথমে মানা করলেও পরে রাজি হলো।
লগ্ন গাড়ি থেকে নেমে একাই পা টেনে টেনে হাঁটছিল। নাদভি বলল, ‘আমি ধরব?’
লগ্ন চোখ পাকিয়ে বলল, ‘খবরদার। আমাকে ধরতে এলে হাত ভেঙে গলায় ঝুলিয়ে দেব।’
‘আচ্ছা তোমার ব্যাগগুলো আমাকে দাও।’
আজ অফিসে লগ্নর পার্সেল এসেছিল তাই বাড়তি ব্যাগ রয়েছে। সেগুলো নাদভির হাতে দিয়ে সে নিজেই হেঁটে গিয়ে লিফটে উঠল। বাসায় ঢুকে চেয়ার টেনে বসে জুতো খুলতে খুলতে বলল, ‘এবার বিদেয় হও।’
নাদভি ব্যাগগুলো রেখে হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করে বসল, ‘কিছু মনে না করলে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি, বাসা দেখে মনে হচ্ছে তুমি এখানে একা থাকো। তোমার হাজবেন্ড কোথায় থাকেন?’
লগ্ন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী বলতে চাও তুমি?’
‘স্পষ্টই তো বললাম।’
লগ্ন বিরক্তমুখে বলল, ‘বিয়ে করিনি। একবার করে সাধ মিটে গেছে।’
নাদভি এবার চমকে উঠে বলল, ‘তাহলে দরজার নেমপ্লেটে মিসেস লেখা দেখলাম যে! তুমি কি এখনো নিজেকে আমার স্ত্রী ভাবো?’
আসলে এখানে যেন ভুলেও তাহসিনের মতো কেউ জুটে না যায় তাই লগ্ন নেমপ্লেটে নামের আগে মিসেস যুক্ত করেছে। মেজাজ ধরে রাখতে না পেরে লগ্ন এবার চিৎকার করে বলল, ‘এক্ষুনি বেরিয়ে যাও তুমি আমার বাসা থেকে।’
নাদভি লগ্নর সামনে মেঝেতে বসে পড়ল। তারপর অনুনয় করে বলল, ‘যাচ্ছি। তুমি শুধু এই একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।’
লগ্ন এবার রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল, ‘আমার ভাবা না ভাবাতে কিছু যায় আসে না। বিয়ের পর তিন বছর পর্যন্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলে কেউ আর স্বামী-স্ত্রী থাকে না।’
‘ঠিক। কিন্তু অনুভূতিরা রয়ে যায়।’
নাদভি সঙ্গে সঙ্গে নিজের ওয়ালেট বের করে দেখাল সেখানে তাদের বিয়ের একটি ছবি রাখা। তারপর বলল, ‘আমারও রয়ে গেছে, তোমারই মতন।’
লগ্ন হেসে বলল, ‘এটা তুমি আমাকে দেখানোর জন্য রিসেন্টলি প্রিন্ট করে রেখেছ।’
নাদভি এবার ছবিটা বের করে উল্টোপাশে প্রিন্ট করা তারিখটা দেখাল। তাদের বিয়ের ঠিক একবছর পরের তারিখ। নাদভি বলল, ‘ফার্স্ট অ্যানিভার্সারিতে এটা প্রিন্ট করেছিলাম ওয়ালেটে রাখার জন্য। সেই থেকে আছে।’
লগ্ন এবার উঠে গিয়ে দরজা খুলল। তারপর নাদভির হাত ধরে টেনে দরজার সামনে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে বের করে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিল।
—————
সামনে উইকেন্ড আছে। তার আগে দুদিন অফিস। এই দুদিন লগ্নকে হোম অফিস দেয়া হয়েছে। লগ্ন অভিভূত হয়ে গেল এই ঘটনায়। এইটুকু পা ব্যথার কারণে কোনো অফিস সেধে হোম অফিস দেয়? বাংলাদেশিদের জন্য এটা স্বপ্ন।
সপ্তাহের শেষ দিন অল্প অল্প বরফ পড়তে শুরু করেছে। বরফ দেখেই লগ্নর মনটা বিরিয়ানি বিরিয়ানি করতে লাগল। কিন্তু শরীরের যে অবস্থা রান্না করার কোনো এনার্জি নেই। তার পছন্দের বিরিয়ানি আছে পাশের শহর টরোন্টোতে। কে যায় পা ব্যথা নিয়ে এখন অতদূরে! কানাডায় এসেই টরোন্টো গিয়ে বিরিয়ানি খেয়েছিল। সেই ছবিটা ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করে লিখল, স্নোফল দেখে সবার আগে এই বিরিয়ানিটার কথা মনে পড়ল।
রাতে নাদভি এলো।
লগ্ন ইন্টারকমে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী চাই? এখানে কেন এসেছ?’
‘তোমার বিরিয়ানি ক্রেভিংয়ের পোস্ট দেখে আমারও বিরিয়ানি ক্রেভিং হচ্ছিল। তাই নিয়ে এলাম। ভাবলাম ডিনারটা একসাথে করি।’
লগ্নর মেজাজ খারাপ হলো।
বলল, ‘তুমি আমাকে ইন্সটায় ফলো করো?’
‘সবকিছুতেই করি।’
‘তোমার যে কত ফেইক পরিচয় আছে আল্লাহ জানে! তোমার বিরিয়ানি তুমি নিয়ে বিদেয় হও।’
নাদভি অনুরোধ করে বলল, ‘আচ্ছা ঠিকাছে আমার সাথে খেতে হবে না। কিন্তু প্লিজ বিরিয়ানিটা তো রাখো। এই স্লোফলের মধ্যে টরোন্টো গিয়ে এনেছি।’
‘কেন এনেছ? তোমাকে তো আনতে বলিনি।’
‘আচ্ছা ভুল হয়ে গেছে। আজকে তো রাখো।
এরপর লগ্ন কী মনে করে যেন নাদভিকে আসতে দিলো। লগ্ন খাবার গরম করতে গেলে নাদভি বলল, ‘আমি করে দিই।’
লগ্ন চোখ পাকিয়ে বলল, ‘এটা তোমার বাসা না। আমার বাসা। চুপচাপ লিভিংরুমে গিয়ে বসো।’
নাদভি লিভিংরুমে বসে মুগ্ধ চোখে দেখছিল লগ্ন খাবারগুলো গরম দিয়ে শসা, টমেটো কুচি কুচি করে একটা সালাদ তৈরি করছে। আটপৌরে একটা ট্রাউজার আর সোয়েটারেও কি সুন্দর লাগছে ওকে!
খাবার টেবিলে দিয়ে লগ্ন নাদভিকে ডাকলো।
খেতে খেতে নাদভি বলল, ‘তোমার বাবা শেষ অবধি তোমাকে বিদেশে পড়তে পাঠাল?’
লগ্ন ব্যঙ্গ করে বলল, ‘অবশ্য সেক্ষেত্রে তোমার সামান্য অবদান আছে। তুমি আমার জীবনটা জাহান্নাম না বানালে বাবা কখনোই আসতে দিত না।’
‘ভেবনা তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমি সুখে ছিলাম। মা মারা যাবার পর আমার জীবনটাও জাহান্নামই হয়ে গিয়েছিল।’
লগ্ন প্রসঙ্গ পালটে বলল, ‘তুমি কিন্তু ভালো রকমের বেহায়া। সেদিন ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার পরেও আজ আবার এসেছ! আমাকে কেউ এভাবে বের করে দিলে আর কোনোদিন তার ত্রিসীমানায় যেতাম না।’
নাদভি হেসে বলল, ‘আমি যা করেছি তাতে ওইটুকু কিছুই না। তুমি জুতো খুলে পেটালেও আবার আসব।’
এবার লগ্ন হাসল।
জিজ্ঞেস করল, ‘কেন? এবার কেন পটাতে চাইছ? এবার তোমার উদ্দেশ্য কী?’
নাদভি গম্ভীর গলায় বলল, ‘কোনো উদ্দেশ্য নেই। যে নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিজের দোষে হারায়, কোনোদিন আর সামনে পাওয়ার সুযোগ নেই জেনেও ভালোবাসতে থাকে। সে যদি হঠাৎ করে তার ভালোবাসার মানুষটাকে সামনে পায়, কী করবে সে? আবার পাওয়ার চেষ্টা কী করবে না? আমিও সেই চেষ্টাই করছি।’
লগ্ন বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলল, ‘তোমার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি।’ নাদভি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ওটা তো আজন্মকাল বেশিই ছিল। নাহলে অত ভয়ংকর সব কাজ কীভাবে করতাম?’
লগ্নর নিজের ওপর ভয়ংকর রাগ হচ্ছিল। একবার মনে হয় মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদুক, আরেকবার মনে হয় মানুষটাকে খুন করে ফেলুক। কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে না।
·
·
·
চলবে..........................................................................