লগ্নজিতা - পর্ব ১৫ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          লগ্ন কানাডা শিফট হবার পর অফিসে জয়েন করতে আর তিন দিন বাকি রইল। এবার আর ফার্নিচার কেনার ভুল করেনি সে। ফার্নিশড অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়েছে। সে যখন মিসিসাগা শহরে নামল তখন রাত। তাই শহরটাকে বিশেষ কিছুই মনে হয়নি। কিন্তু সকালবেলা প্রথমবার যখন বাসার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল, তখন মিসিসাগা শহরের অনেকটাই তার চোখের সামনে। একদিকে উঁচু উঁচু দালান, আরেকদিকে আবাসিক এলাকা, এখানে দোতলার ওপরে কোনো বাসা নেই। আর সামনে নীল জলরাশির প্রশস্ত অন্টারিও লেক। এক পলকেই শহরটার প্রেমে পড়ে গেল।

লগ্ন নাস্তা সেড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে একটা কফি নিল। কফি হাতে হাঁটতে হাঁটতে সোজা চলে গেল লেকের দিকে। লেকটা তার বাসা থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। এই লেকের পাড় টা একদম সী বিচের মতো। কী অপূর্ব! পুরোটা সকাল সে লেকের পাড়ে হেঁটে বেড়াল। লেকসংলগ্ন পার্কে ঘুরল। দুপুরবেলা প্রচণ্ড ক্ষুধা লাগায় বাইরেই খেয়ে নিল, এখন আর বাসায় ফিরে রান্না করার মতো সময় নেই। খেয়ে আবার ঘুরতে লাগল। এবার অন্যদিকে। সারাদিন ঘুরে রাতেও বাইরেই খেয়ে নিল। তারপর বাসায় ফিরে এক ঘুমে সকাল করে দিলো।

আজ লগ্নর মিসিসাগা অফিসের প্রথম দিন। একটু আগেভাগেই বের হলো, প্রথমদিন যেন দেরি না হয়ে যায়। অফিসে তাকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হলো। তারপর যখন তার টিমমেটদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো তখন লগ্ন অবাক হয়ে চেয়ে রইল নাদভির দিকে। অথচ সেই প্রতারক খুব স্বাভাবিক রইল। যাকে এতদিন আমেরিকায় নানাভাবে খুঁজেছে তাকে পেয়ে গেল কানাডায় তারই অফিসে তারই টিমমেট হিসেবে। দুনিয়াটা কী অদ্ভুত!

নাদভি যেমন স্বাভাবিক, লগ্নও নিজেকে ততটাই স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছে সারাদিন। নাদভিকে পেলে সে কী কী বলবে কী কী করবে-সব ঠিক করে রেখেছিল। এখন ওকে এখানে দেখে সব গুলিয়ে গেছে। ভাবতে হবে আরও অনেক ভাবতে হবে। অফিস শেষ করে লগ্ন যখন বের হলো তখনই পেছন পেছন নাদভি বের হলো। দূর থেকেই ডাক দিলো। লগ্ন দাঁড়াল। নাদভি কাছাকাছি এসে বলল, ‘আমরা কি কোথাও বসে কথা বলতে পারি?’

‘না।’

লগ্ন এ কথা বলে আবার হাঁটা শুরু করল।

নাদভি পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘প্লিজ লগ্ন। প্লিজ তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।’

লগ্ন ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কথা থাকলে নিজেই যোগাযোগ করতে। আমার সাথে যোগাযোগ করার সব রাস্তা তোমার খোলাই ছিল।’

‘মানছি। কিন্তু তোমার সাথে যোগাযোগ করার মতো সাহস আমার ছিল না। এখন যখন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন, এই সুযোগটা হারাতে চাই না।’

নাদভি ও লগ্ন একটা কফিশপে বসল। মুখোমুখি দুজন, যে লগ্ন ভেবেছিল নাদভিকে পেলে লঙ্কাকাণ্ড বাঁধাবে সে নাদভির দিকে তাকাতেও পারছে না এখন। শরীর ভেঙে কান্না পাচ্ছে। কিন্তু এখন তো কাঁদা যাবে না। যে কোনো কিছুর বিনিময়ে এখন তার কান্না আটকে রাখতে হবে।

নাদভি বলল, ‘লগ্ন, আমি তোমার সাথে এমনটা করতে চাইনি। লগ্ন বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, ‘তাহলে কি আমি বাধ্য করেছি তোমাকে?’

নাদভি মাথা নিচু করে বলল, ‘না। কেউই বাধ্য করেনি। কিন্তু ওই সময়টা…’

লগ্ন চুপ। নাদভি আবার বলতে শুরু করল, ‘লগ্ন, তুমি যাদের আমার বাবা-মা বলে চিনেছ তারা আমার কেউ না। জাস্ট টিমমেট ছিল। আমার বাবা ডাক্তার ছিল। আমি যখন ভার্সিটিতে অ্যাডমিশনের জন্য কোচিং করি তখন তিনি মারা যান। বাবার রেখে যাওয়া জমানো টাকাপয়সা দিয়ে মা কোনোভাবে আমার পড়াশোনা চালিয়ে নেয়। পাবলিকে চান্স পেয়ে যাই তাই খুব একটা অসুবিধা হয়নি। অসুবিধা হলো মা অসুস্থ হবার পর। তখন সবে আমার গ্রাজুয়েশন শেষ হয়েছে। মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ল।

ক্যান্সারের কথা শুনেই লগ্নর মনে হলো আরেকটা ঢপ মারছে নাদভি আর সে গিলছে। তবে কিছু বলল না। চুপচাপ শুনতে লাগলো। নাদভি বলল, ‘মায়ের ট্রিটমেন্টের জন্য প্রচুর টাকা দরকার। তাই মাস্টার্স না করেই চাকরির চেষ্টা করতে থাকি। কিন্তু আমাদের দেশের চাকরির বাজার তো জানো। এদিকে মায়ের ট্রিটমেন্ট তো থামিয়ে রাখা যায় না। বাবার রেখে যাওয়া টাকা শেষ হবার পর জমি-জমা, বাড়ি-ঘর যা কিছু ছিল সব একে একে বিক্রি করে দিয়েছি। তখন আসলে মাকে বাঁচিয়ে রাখা ছাড়া আমার জীবনে আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। টাকা-পয়সা, সম্পত্তি সব যখন শেষ হয়ে যায় তখনো চাকরি পাইনি। এরপর টাকার জন্য এমন কোনো খারাপ কাজ নেই যা আমি করিনি। ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত ভাবার মতো বোধ ছিল না। একটাই বোধ ছিল মাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।’

এবার লগ্ন জিজ্ঞেস করল, ‘সবই বুঝলাম। তোমার টাকার দরকার ছিল। কিন্তু নাদভি, তুমি আমাকে প্রেমের জালে কেন ফেলেছিলে? বিয়ে তো ঠিক হয়েই গিয়েছিল। ওটা হতোই। তোমার পরিকল্পনাও সফল হতো। তাহলে ওই প্রেম প্রেম খেলার কী দরকার ছিল?

নাদভি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘জানি তুমি আমার কোনো কথা বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস করার মতো কাজ আমি করিনি। কিন্তু আজ আমি একটি বর্ণও মিথ্যে বলছি না। আমি তোমাকে প্রেমের জালে ফেলিনি লগ্ন। উলটো নিজেই প্রেমের জালে জড়িয়ে পড়েছিলাম। বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর তোমার সাথে যত সময় কাটাতাম ততই ভালো লাগত। তোমার সাথে থাকাকালে আমি নিজের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকতে পারতাম না। এই কাজ আমরা আগেও কয়েকবার করেছি। কিন্তু কখনো কারো প্রেমে পড়িনি। যেহেতু আমি জানিই আমি ধোঁকা দিতে যাচ্ছি সেখানে প্রেমে পড়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু কীভাবে যেন তোমার প্রেমে পড়ে গেলাম। অন্যসময় হলে আমি ওই মুহূর্তে সরে যেতাম। কিন্তু আমার মা তখন হাসপাতালে। টাকা লাগবে আমার। মেহেদির দিন আমি যখন তোমাকে দেখতে দিনাজপুর গিয়েছিলাম সেদিন এতটা ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম যে ভেবেছিলাম, যা হওয়ার হবে সব বলে দিই তোমাকে। কিন্তু আমার তখনকার পরিস্থিতি আমাকে বলতে দেয়নি।’

‘তোমার মা হাসপাতালে থাকলে তুমি তখন দেশ ছাড়লে কীভাবে?’

‘দেশ ছাড়িনি তো। গা ঢাকা দিয়ে ছিলাম। কয়েক মাস পর মা মারা যান। ততদিনে সব টাকাপয়সাও শেষ। টিমমেটরা নতুন কাজের কথা বললে ওদের ফিরিয়ে দিই। যে মানুষটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এসব করতাম সেই তো নেই। ডিপ্রেশনে পড়ে যাই। একটা সময় ভাবলাম পড়াশোনাটা আবার শুরু করা দরকার। স্কলারশিপের জন্য চেষ্টা করতে লাগলাম। আমেরিকায় একটা ইউনিভার্সিটিতে হয়ে গেল। তখন দেশ ছাড়লাম।’

‘কোন ইউনিভার্সিটি?’

‘মিসৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটি।’

‘তারপর?’

‘তারপর আর কী! চাকরিবাকরি শুরু করলাম। ওয়ালমার্টই আমাকে কানাডায় ট্রান্সফার করল।’

‘আশা করি তোমার সব কথা শেষ হয়েছে। এখন আমি উঠি।’

‘আমাকে কি ক্ষমা করা যায় লগ্ন? আমি জানি আমি যা করেছি তা ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য না। কিন্তু তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমিও শান্তি পাইনি। যতটা কষ্ট তোমাকে দিয়েছি তার অনেকগুণ বেশি কষ্ট আমি পেয়েছি।’

লগ্ন এবার হেসে বলল, ‘সারারাত একসাথে কাটিয়ে বিয়ের পরদিন যখন স্বামী গয়নাগাটি নিয়ে পালিয়ে যায় তখন বাংলাদেশের একটা মেয়ে আশেপাশের মানুষদের থেকে কী পরিমাণ গঞ্জনা সহ্য করে তার বিন্দুমাত্র ধারণা যদি তোমার থাকত তাহলে আমার চেয়ে বেশি কষ্ট তুমি পেয়েছ এ কথা ভুলেও বলতে না।’

নাদভি মাথা নিচু করে ফেলল। লগ্ন এবার উঠে দাঁড়াল। চলে যাচ্ছিল। আবার ফিরে এসে বলল, ‘আর হ্যাঁ, তোমাকে আমি কখনোই ক্ষমা করব না নাদভি আহমেদ।

তারপর চলে গেল লগ্ন। নাদভি দুহাতে মুখ ঢেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল!
·
·
·
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp