অভিমানিনী - পর্ব ১৪ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          আমার ও মানসীর সম্পর্কের কথা বাবা হয়তো কিছুটা জেনেছিল মায়ের কাছ থেকে, কিন্তু আমাদের বিয়ের কথা জানত না। বাবার সাথে আমি খুব একটা ফ্রি ছিলাম না। তবু সাহস করে গেলাম তার কাছে। জানি বাসায় বাবার সাথে এ বিষয়ে কথা বলা যাবে না। মা খুব চোখে চোখে রাখছে। তাই কথা বলার জন্য বাবার অফিসে গেলাম। আমি ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছিলাম। বাবা রুমে ঢুকে আমাকে দেখে চমকে উঠেছিল,

“তুই এখানে? কোনো সমস্যা?”

“হ্যাঁ বাবা, মানে…একটু কথা ছিল যা বাসায় বলা সম্ভব না।”

“এমন কী কথা, বল তো।”

“বাবা আমি বিয়েটা করতে পারব না।

“সেকি! কেন? আর তোর মা যে বলল আমরা কাল মেয়ে দেখতে যাব? আর দেখাদেখিও তো না। তোর মা তো সব ঠিকই করে ফেলেছে, কাল নাকি আংটি পরিয়ে আসবে, আর তোরও তো মত আছে শুনেছি। এখন এই কথা কেন বাবা?”

“আমার মত আছে তোমাকে কে বলল?”

“তোর মা বলেছে। আরে মেয়েটার ছবি যেদিন দেখাল, আমার তো খুব পছন্দ হয়েছে। আমি মত দিয়েছিলাম আর বলেছিলাম ছেলের মত আছে কিনা জেনে নাও। তখন তো তোর মা বলল মেয়েকে নাকি তোর পছন্দ হয়েছে।”

“আমার মুখ থেকে তো শোনোনি!”

“আমার বাসায় যেতে যেতে এত রাত হয়ে যায়, সংসারের কোনো খোঁজই তো রাখতে পারি না কখনো। তোর মায়ের উপরেই তো সব ছেড়ে দিয়ে রেখেছি। আচ্ছা যাই হোক, তোর মত নেই কেন? মেয়ে তো খুবই সুন্দরী, ইংলিশে অনার্স করেছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে, নম্র ভদ্র। অপছন্দ হওয়ার মতো তো কিছু দেখছি না।”

“বাবা আমি মানসীকে ভালোবাসি।”

বাবা খুব অবাক হয়ে বলল,

“আমিও তো তাই জানতাম। কিন্তু তোর মা তো বলল তোদের সম্পর্ক ভেঙে গেছে।”

“সম্পর্ক ভাঙা তো দূরের কথা, ওর সাথে আমার কোনো ঝগড়া কিংবা কথা কাটাকাটিও হয়নি।”

“তাহলে?”

মা আমাকে আর মানসীকে যা যা বলেছে পুরো ব্যাপারটা বাবাকে খুলে বললাম। সব শুনে বাবা বলল,

“কোনো একটা ভুল হচ্ছে, তোর মা তো এরকম না। তোদের সম্পর্কের কথা সে প্রথম থেকেই জানত। তোদের বিয়ে নিয়ে কত প্ল্যান করত। তাছাড়া মানসী তো ওর আদরের ছিল। আমি সব গুলিয়ে ফেলছি।”

আমি বাবাকে বললাম,

“বাবা প্লিজ তুমি কিছু একটা করো। মানসীর সাথে এই অন্যায়টা তুমি হতে দিয়ো না। মেয়েটা বুঝতে শেখার আগে থেকে আমাকে ভালোবাসে। আর আমিও ওকে ছাড়া অন্য কারো সাথে ভালো থাকতে পারব না। এখন তুমি ছাড়া আর কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না। একমাত্র তুমিই পারবে মাকে বোঝাতে।”

“আচ্ছা আচ্ছা আমি দেখছি, তুই চিন্তা করিস না।”

পরদিন শুক্রবার আমাদের মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথা। সকাল থেকেই টেনশন করছিলাম বাবা কি আদৌ মাকে কিছু বোঝাতে পেরেছে? বিকালবেলা মা এসে বলল,

“তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। আমরা আধা ঘণ্টার মধ্যে বের হব।”

আমি কিছু বলার আগেই মা আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি ঘর থেকে বের হব এমন সময় বাবা এসে ঢুকল। বলল,

“আমি তোর মাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। আমাকে বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করছে। ছিঃ ছিঃ, ওর মতো মানুষকে এরকম করতে দেখে আমি খুব অবাক হয়েছি। আমার মনে হচ্ছে তোর মা কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এত জিজ্ঞেস করলাম কিছু বলছেই না। উল্টো কিসব যা তা বলছে। এত বছর একসাথে থেকে তারপর ওর এই নতুন রূপ আমি নিতে পারছি না।”

“মাকে তো বলতে হবে কী সমস্যা হয়েছে! তাছাড়া আমরা সমস্যা সমাধান করব কীভাবে?”

“জানি না। সারারাত এক ফোঁটা ঘুমায়নি সে, আর কি কান্না! তুই প্লিজ এখন চল। গিয়ে মেয়েটাকে আলাদা নিয়ে কথা বলবি। বলবি তুই রাজি না এ বিয়েতে। শিক্ষিত মেয়ে, বুঝিয়ে বললে অবশ্যই বুঝবে।”

“কিন্তু বাবা…

“রেডি হয়ে আয়। আর ঝামেলা বাড়াস না। তোর মায়ের এখন মাথা ঠিক নেই।”

বাবাই তুলেছিল কথাটা,

“ওদেরকে একটু আলাদা কথা বলতে দেয়া উচিত। একটু বুঝে নিক দুজন দুজনকে।”

মা সাথে সাথে বলে উঠল,

“না না, কী দরকার? দুদিন পর তো বিয়েই। তখন তো দুজন দুজনকে বোঝার জন্য সারাটা জীবন পাবে।”

তখন ওই বাড়ির কেউ একজন বলল,

“সমস্যা কি? বলুক না।”

আমাদের দুজনকে যখন আলাদা ঘরে কথা বলতে দেয়া হলো তখন মেয়েটা মাথা নিচু করে বসে ছিল। আমি বললাম,

“আপনার কি এই বিয়েতে মত আছে?”

মেয়েটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। নরম স্বরে বলল,

“মানে?”

“মানে আমি জানতে চাচ্ছি আপনার সম্মতিতে কি হচ্ছে এই বিয়েটা?”

মেয়েটা বোধহয় আস্তেই কথা বলে। সেভাবেই বলল,

“আমার পরিবার আমার জন্য যা ঠিক করবে আমি তাতেই রাজি।”

আমি একটু থেমে বললাম,

“ভালো, কিন্তু আমার এই বিয়েতে মত নেই।”

মেয়েটা চমকে তাকাল আমার দিকে। আর এই প্রথম মেয়েটার মুখ দেখলাম। সত্যি বলছি এত সুন্দর মেয়ে আমি আগে কখনো দেখিনি। বিধাতা বোধহয় কোনো ছুটির দিনে অফুরন্ত সময় নিয়ে নিজ হাতে ওকে বানিয়েছে। একটা সুন্দর ফুল দেখলে যেমন বলা যায় ফুলটা সুন্দর, একটা সুন্দর পাখি দেখলে যেমন বলা যায় পাখিটা সুন্দর, তেমনভাবেই বলছি সে সুন্দর। কিন্তু তাকে বিয়ে কী করে করব? আমি তো মাদকাসক্ত ছিলাম। আমার মানসী হোক সে কালো, হোক সে সাধারণ! সেই ছিল আমার মাদক!

মেয়েটাকে আমি বললাম,

“আমি আসলে একজনকে ভালোবাসি। একদম ছোটবেলা থেকে আমাদের সম্পর্ক। তাকে ছাড়া আমি অন্য কারো সাথে ভালো থাকতে পারব না। তাই বলছি আমি এ বিয়েটা করতে পারব না।

মেয়েটা আবার মাথা নোয়ালো। বলল,

“কথাটা আমাকে না বলে আপনার বাবা-মাকে বললে বোধহয় ভালো হতো।”

“হুম, বলেছি। কোনো কাজ হয়নি। তাই আপনাকে বলছি। আপনি যদি আমাকে একটু সাহায্য করেন।”

“আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি?”

“বলবেন যে আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি।

“দেখুন, আমার বাবা-মা নেই। চাচা-চাচির কাছেই বড় হয়েছি। ওনারা না থাকলে আমি ভেসে যেতাম। ওনাদের পছন্দের ওপরে আমার আর কিছু বলার সাহস নেই। আর যদি বলিও তারা সেটা শুনবে না। আমার চাচাতো বোনরা আমার ছোট। আমার বিয়ে না হলে ওদের বিয়ে দিতে পারছে না।”

মেয়েটা কিছু বলল না। আমি আকাশ পাতাল অনেক কিছু ভেবে শেষে বললাম,

“তাহলে বলবেন আমি আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি।”

মেয়েটা রীতিমতো চমকে গেল। বলল,

“মানে?”

অসহায় লাগল আমার। কী বোঝাব আমি এই মেয়েকে? তারপর উপায় না দেখে বললাম,

“আমি বিবাহিত।”

“সে কথা চাচা আমাকে জানিয়েছে। এটাও জানিয়েছে যে আপনার এখনো ডিভোর্স হয়নি। কিছুদিনের মধ্যে হয়ে যাবে। এজন্যই তো চাচা আপনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। নয়তো আপনার মতো ছেলের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে ঠিক না করে আমার বিয়ে ঠিক করত না।” মেয়েটার এই কথার পর কিছুই বলার ছিল না আর আমার!

এ পর্যন্ত পড়ে অর্পি জিজ্ঞেস করল,

“আপ্পি চাচ্চু কয়টা বিয়ে করেছে?”

“করেছে একটাই। অন্যটা করেনি, জোর করে করানো হয়েছে।”

“অন্যটা বলছিস কেন? বল অন্যগুলো।”

“উঁহু, আমার তো মনে হচ্ছে এই মেয়েটাই দিতিয়া চাচি।”

“ওম্মা, এটা দিতিয়া চাচি হলে মেয়েটা মেয়েটা লিখতো? দিতিয়া লিখত না?”

“দিতিয়া চাচি কিন্তু ইংলিশে স্টাডি করেছিল, ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে। চাচির বাবা মা ছোটবেলায় মারা গেছে সেটাও মিলে গেছে।”

“তাই তো, আমি তো খেয়ালই করিনি।”

“আর চাচ্চু সৌন্দর্যের কথা কী লিখেছে খেয়াল করিসনি?”

“হ্যাঁ, তাইতো। চাচি এখনো যেই ভয়ানক সুন্দরী, এক ছেলের মা হয়ে গেছে, এখনো কী চেহারা! কী গায়ের রং! কী ফিগার… শাড়ি পড়লে হাঁ করে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে! ১৬ বছর আগে কী ছিল জাস্ট থিংক আপ্পি! চাচ্চুর জায়গায় আমি হলে প্রথম দেখায় বিয়েতে রাজি হয়ে যেতাম। এমন একটা সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করার লোভ সামলানো যায় নাকি?”

“ভাগ্যিস তুই ছেলে হোসনি।”

অর্পি অবাক হয়ে বলল,

“কেন?”

“কারণ তুই ভালোবাসা বুঝিস না, সৌন্দর্য বুঝিস শুধু।”

অর্পি দাঁত কেলিয়ে হাসল। কিন্তু সেকেন্ডেই মধ্যেই হাসিটা মিলিয়ে গেল। বলল,

“আপ্পি, তার মানে বিয়েটা আটকানো যায়নি? তাহলে মানসী আন্টির কী হয়েছিল? আর দাদুই বা কেন এমনটা করেছিল তা কি চাচ্চুরা আর জানতে পারেনি?”

“তোর সমস্যা কী অর্পি জানিস? সবকিছু নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করছিস। যেন সব উত্তর আমার জানা আছে।”

“সরি।”

“কিন্তু অৰ্পি…চাচ্চু, দাদা সবাই সন্দেহ করছিল দাদুর কোনো মানসিক সমস্যা হচ্ছে যার কারণে চাচ্চুকে বাধ্য করছে এই বিয়েটাতে। আর সবাইকে যখন ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করছিল তখন কারণ তো নিশ্চয়ই একটা কিছু ছিল। এখন আমার সেই কারণটা জানার জন্য বড্ড অস্থির লাগছে। কী এমন হতে পারে!”

“আমার তো মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে নারে আপ্পি।”

“আচ্ছা বাদ দে, এসব কথা বলে সময় নষ্ট করছি, সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগেই আমাদের এই রুম থেকে বের হতে হবে। আরো লেখা আছে চল পড়ি।”
·
·
·
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp