মাই মিস্টিরিয়াস প্রিন্স - পর্ব ০৪ - মৌমিতা মৌ - ধারাবাহিক গল্প


          দেখতে দেখতে অনন্যার মা আর ভাইয়ের ফেরার দিন এসে পড়লো। ঘরে তখন ব্যস্ততা চলছে। মামাবাড়ি থেকেও ঈরা এসে রয়েছে এই বাড়িতে। সবার মাঝে একধরনের তাড়াতাড়ি তাড়াতাড়ি চলছে। অনন্যাও সাহায্য করেছে যতটা পেরেছে। তবে তার মন পড়ে ছিল অন্য কোথাও। মাঝে মাঝে সে বাইরে বেরিয়ে পড়েছে একটু হেঁটে আসার নামে। আসলে আশায় ছিল যদি কৌশিক স্যারের সাথে আরেকবার দেখা হয়ে যায়।

কিন্তু না, হয়নি। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সেই জায়গায়, ঠিক সেই সময়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে অনন্যা। অপেক্ষায় নিশ্চুপ হয়ে ঘাম ঝড়ানো অবস্থায় চোখ ঘুরিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে খুঁজেছে কৌশিক স্যারকে। কয়েক দিন ধরে রুটিনে পরিণত হয়েছে এই জিনিসটা। যদি তিনি আবার আসেন? যদি আচমকাই দেখা হয়ে যায়? এই আশায় ই দিন কেটেছে অনন্যার।

কিন্তু তিনি আসেননি। দেখা হয়নি আর অনন্যার সাথে। তবু অনন্যা ভেঙে পড়েনি। তার বিশ্বাস, যেহেতু একবার দেখা হয়েছে, তবে আবারো ও হবে। তবু প্রতিদিন প্রতীক্ষার শেষে যখন কিছুই হাতে আসে নি। সেই অপ্রাপ্তির হালকা কান্না নিঃশব্দে জমে থাকে চোখের কোণে। মন তো মানুষের। প্রতীক্ষা যতই মধুর হোক, না পাওয়ার বেদনা কি আর চাপা থাকে?

সেদিন অনন্যার মা বলেছিল ওর জন্য পাত্র খুঁজবে। অনন্যা সোজা কথায় না করে দেয়। সে এসব ঝামেলা চায় না। অনন্যা এটাও বুঝিয়ে বলে ওর বিশ্বাস স্যার আসবে। আর যদি নাও আসে অনন্যা একাই এই বাচ্চা পালবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অনন্যার মা বুঝতে চায় না। মায়ের সাথে ছোটখাটো তর্ক ও লেগে যায় তার। একসময় চুপ করে যান তিনি। কিন্তু মনে মনে ওনার কথাই ঠিক থাকে।

সন্ধ্যার দিকেই অনন্যার মা আর ভাই বেরিয়ে গেছে। ফ্লাইট রাত এগারোটায় হলেও, সময়মতো তো আগেই যেতে হয়। যাওয়ার আগে অনন্যাকে বারবার বুঝিয়ে দিয়ে গেছে যেন নিজের খেয়াল রাখে। অনন্যা শুধু মাথা নেড়ে চুপচাপ সম্মতি জানিয়েছে। ঈরাকে বলেছে আজ রাতটা থেকে যেতে। ঈরা কিছু বলেনি, থেকে গেছে। তারপর থেকে দুজনে পাশাপাশি বসে টিভি দেখছে। কিন্তু অনন্যার মন ছুটে বেড়াচ্ছে দূরে কোথাও। টিভির পর্দায় আর মনোযোগ নেই তার।

কাল থেকে আবার ক্লাস শুরু।কিন্তু কী লাভ তাতে? যার উপস্থিতি ছাড়া ক্লাসে মনই বসে না, সে তো নেই। পড়াশোনাও কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ভবিষ্যতটা কুয়াশার মতো অদৃশ্য আর অনিশ্চিত মনে হয়। মাঝেমধ্যে নিজেকেই খুব অসহায় লাগে। সবকিছু এতো ফাঁপা, এতো অচেনা লাগে মনে হয় নিজের মধ্যেই কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে অনন্যা। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। সাথে সাথেই কলিং বেল বেজে উঠলো। অনন্যা, ঈরা দু'জন দু'জনের দিকে তাকালো। কেউই বুঝতে পারলো না এই সময়ে কে আসতে পারে।

অনন্যা উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
"আমি দেখে আসছি।"

ঈরা ওর হাত চেপে ধরে জোরে বললো,
"তুই বস। আমি খুলে দেখি কে।"

ঈরা দরজার ছিটকিনি খুলে দরজা একটু ফাঁক করতেই এক অচেনা মুখের সঙ্গে চোখাচোখি হলো। একজন অচেনা ডাক্তার দাঁড়িয়ে, পরিপাটি জামা, কাঁধে স্টেথোস্কোপ, চোখে মৃদু গাম্ভীর্য।

ঈরা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
"কে আপনি?"

ভদ্র ভঙ্গিতে লোকটা বললো,
"আমি প্রাঞ্জল। অনন্যাকে দেখতে এসেছি।"

ঈরা আর এক মুহূর্তও দেরি করলো না। ঠান্ডা গলায় বললো,
"এখন বাসায় কেউ নেই। পরে আসবেন।"

তারপর আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঈরা ধীরে ধীরে দরজাটা বন্ধ করতে উদ্যত হতেই ভেতর থেকে অনন্যা উঠে দাঁড়ালো। নামটা তার কানে এসেছে! মায়ের মুখে শোনা সেই নাম। যে ডাক্তার একদিন এসে ওকে দেখে গিয়েছিল। অনন্যা এগিয়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়াতেই প্রাঞ্জল এক ধাপ এগিয়ে দরজার বন্ধ হওয়া থামিয়ে দিলো।
চেহারায় সদাচারিতার হাসি টেনে জিজ্ঞেস করলো,
"কেমন আছেন আপনি?"

অনন্যা ভদ্রভাবে মাথা নেড়ে বললো,
"ভালো আছি। কিন্তু হঠাৎ আপনি এখানে কেন?"

"আপনার মাকে তো বলেছিলাম, মাঝেমধ্যে দেখতে আসবো আপনাকে। তাই ভাবলাম একবার দেখা করে যাই।"

প্রাঞ্জলের স্বরে নরম ভাব থাকলেও অনন্যার মন একরকম অস্বস্তি বোধ করলো। লোকটার ভঙ্গিমায় মনে হলো সাধারণ ভাবটা ঠিক নেই।

অনন্যা চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট গলায় বললো,
"ধন্যবাদ, কিন্তু আমাদের না জানিয়ে দয়া করে হুটহাট চলে আসবেন না।"

প্রাঞ্জল তখনও জোরের সাথে দরজাটা খোলা রাখার চেষ্টা করে বললো,
"ঠিক আছে, কিন্তু এখন তো একবার ভেতরে ঢুকতে দিন।"

ঈরা আর সহ্য করলো না। পেছন থেকে গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
"আমরা আপনাকে ভেতরে আসতে বলিনি। এখন দয়া করে চলে যান।"

অনন্যা ঈরাকে থামতে ইশারা করলো। বোঝালো সে যা করছে তা অভদ্রতা। ঈরা ভেতরে চলে গেলো। লোকটা ও ভেতরে প্রবেশ করলো। হাঁটতে হাঁটতে বললো,
"আপনার মা কোথায় গেছে?"

অনন্যা সত্যিটা বললো না।
"বাইরে কিছু কাজে বেরিয়েছে।"

"আর ভাই ও নেই?"

অনন্যা হাসার ভান করে বললো,
"কেনো জানতে চাইছেন? আগে ফোন করে বলে দিতেন তাহলেই হতো। "

"না না আমি তো এমনিই জানতে চাইছিলাম।"

ডাক্তারকে টেবিলের সামনে চেয়ারে বসালো অনন্যা। ঈরা রান্নাঘর থেকে পানি এনে দিলো‌। টিভি আপাতত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রাঞ্জল পানি পান করে অনন্যার দিকে তাকিয়ে বললো,
"আচ্ছা এখন আসুন। আপনাকে চেক করে দেখি।"

প্রাঞ্জল তার ব্যাগ খুলে কিছু সরঞ্জাম বের করতে লাগল। অনন্যা বুঝতেই পারলো না কি চেক করবে অনন্যার তো সবকিছুই ঠিকঠাক আছে। প্রাঞ্জল ব্যাগ থেকে স্টেথোস্কোপ, ছোট একটি টর্চ, ব্লাড প্রেসার মেশিন ও থার্মোমিটার বের করলো।
তারপর গম্ভীর গলায় বললো,
"একটু রিল্যাক্স করুন। সাধারণ চেকআপ করছি মাত্র।"

অনন্যা সন্দিহান ভঙ্গিতে বসে থাকলেও কিছু না বলে মাথা নাড়লো। প্রাঞ্জল প্রথমেই অনন্যার রিস্ট ধরে পালস চেক করলো। অনন্যাকে কিছু না বলেই প্রাঞ্জল তার হাত ধরে ফেলেছিল বলে অনন্যা কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলো। কিন্তু ডাক্তার বলে আর কিছু বললো না। তারপর স্টেথোস্কোপ কান ও বুকে স্পর্শ করিয়ে শুনতে লাগলো হৃদস্পন্দন ও শ্বাসের গতি। ছোট টর্চ জ্বালিয়ে চোখের রিফ্লেক্স পরীক্ষা করলো।
তারপর বললো,
"একটু জিভ দেখান, গলা ব্যথা আছে কি না?"

অনন্যা দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বললো,
"নেই!"

"তারপর ও বের করুন দেখি।"

বাধ্য হয়ে জিভ বের করলো অনন্যা।
গলা পরীক্ষা করে সে বললো,
"ঠান্ডা বা ইনফেকশনের কোনো লক্ষণ নেই।"

শেষে ব্লাড প্রেসার মেশিনটা হাতে জড়িয়ে রিডিং নিলো।
"প্রেশারও ঠিক আছে।"

সব মিলিয়ে প্রাঞ্জল একটু বেশিই সতর্ক হয়ে চেকআপ করছিলো। শেষে বললো,
"সবকিছুই তো ঠিক আছে। কিন্তু বেবীর জন্য বেশি খাওয়া দাওয়া করবেন। আর হ্যাঁ আপনার জন্য ভিটামিন একটা ট্যাবলেট এনেছি।"

প্রাঞ্জল ব্যাগ থেকে একটা ছোট ট্যাবলেটের কৌটা বের করে অনন্যার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
"তিন বেলা খাওয়ার আধা ঘন্টা পূর্বে মনে করে খাবেন এটা। আপনার শরীর বেশ দুর্বল। এজন্যই হঠাৎ হঠাৎ শরীর খারাপ লাগে। তবে এই অবস্থায় এটি স্বাভাবিক। তাও শরীর সুস্থ রাখতে হলে এটা নিয়মিত খাবেন আর খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করবেন।"

অনন্যা মাথা নাড়িয়ে বললো,
"ঠিক আছে। আপনি চা খাবেন। বসুন।"

ডাক্তার কয়েক বার না করলো। কিন্তু শেষমেশ চা খেয়েই বের হলো। সে চলে যাওয়ার পর ঈরা সন্দেহের সহিত সোফায় বসে বললো,
"এই লোকটাকে আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে। আর মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছিলাম।"

অনন্যা হাত নাড়িয়ে বললো,
"বাদ দে। বস,টিভি দেখি।"

ঈরা ও সব গুছিয়ে সোফায় আবার টিভি দেখতে মনোযোগ দিলো।

*******

অনন্যা বেশ দেরি করেই ঘুম থেকে উঠেছে। ঘুম ভাঙতেই ফোনের রিংটোনের শব্দে বিরক্তি বাড়তে থাকে ওর। নোহারা বারবার কল করে যাচ্ছে। আগেই বলেছিল, আজ ওর কোথাও যাওয়ার মন নেই। কিন্তু সেই কথা শুনে নোহারা আরও চটে গেছে। অগত্যা অনন্যা উঠে বসে। মন খারাপ, শরীরে ক্লান্তি, তবুও রেডি হয়ে নিলো ধীরে ধীরে। আজ তো শুধু পরিচয়পর্ব, বিশেষ কিছু নয়। তারপর ও কেন যে মেয়েটির যাওয়ার এতো তাড়া! এই নোহারার জেদের কাছে হার মেনেই বের হওয়া আজ। প্রতিদিন বাস স্ট্যান্ডের দিকে নির্দিষ্ট সময়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেটাও হয়তো ক্লাসের চক্করে সম্ভব হবে না আজ। নিচে নামতেই চোখে পড়লো নোহারাকে। কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে একগাল অভিমান জমে আছে। নোহারার রাগ দেখে অনন্যা ফিক করে হেসে ফেললো। ঈরাও সেই ভোরে বেরিয়ে গেছে। বাসা থেকে ওর মা ফোন করছিল। অনন্যাও কিছু বলেনি। কি আর বলবে?

অনন্যা চুপচাপ হেঁটে গেলো নোহারার দিকে। নোহারা চোখ দুটো থেকে ঠিকরে আগুন বের হচ্ছে।

"এই যে ম্যাডাম, মনে আছে তো আজ তোমার ইউনিভার্সিটি যাওয়ার কথা?"
নোহারার কণ্ঠে রাগ ঝরে পড়লো।

অনন্যা মাথা নিচু করে বললো,
"জানি রে। কিন্তু তুই এত গলা ঝাড়িস কেন? আমি তো আর না বলিনি শেষমেশ।"

নোহারা মুখটা বাঁকিয়ে বললো,
"না বলিসনি ঠিক, কিন্তু ওই ‘ইচ্ছা নেই’ শুনেই আমার মেজাজটাই বিগড়ে গেছে। তোর জন্যই না সকাল থেকে টেনশনে আছি!"

অনন্যা নোহারার কাঁধে হাত রেখে এগিয়ে যেতে লাগলো,
"হয়েছে আর রাগ করতে হবে না। চল যাই। আর হ্যাঁ অনেক ধন্যবাদ বাসার নিচে এসে নিয়ে যাওয়ার জন্য।"

"হ্যাঁ! তুমি তো ছোট খুকি। তুলে নিয়ে না গেলে আবার যাবে না।"

নোহারার কথায় হেসে উঠলো অনন্যা। অল্প একটু হলেও মনটা হালকা লাগলো। দুজনে মিলে একটা রিকশা ধরে রওনা দিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইট পেরোতেই চোখে পড়লো সাজানো চারপাশ। রঙিন কাপড়, কাগজের তৈরি ঝালর, আর ফুলের মালায় সাজানো প্রবেশদ্বার স্বাগত জানাচ্ছে সবাইকে।

চত্বরজুড়ে ছড়িয়ে আছে উৎসবের আবহ। কোথাও টুকটাক পোস্টার, কোথাও সাজানো চেয়ার-টেবিল, গাছগুলোর গায়ে রঙিন ফিতা বাঁধা। হালকা বাতাসে সেগুলো উড়ছে। ছুটির পর নাকি ছোটখাটো আয়োজন আছে। অনেক দিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎসব করার সুযোগ পেয়েছে। তাই পড়াশোনা আজ হবে না বললেই চলে। অনন্যার ঠোঁটে অল্প হাসি দেখা গেলো। ওর মনে হলো এই সাজানো পরিবেশের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। হাসিমুখে তাকালো চারপাশে। দিনটা বুঝি ভালোই কাটবে আজ।

দুজনে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছিল। হঠাৎ পাশের গ্রুপটির কথা অনন্যার কানে ভেসে এলো চেনা এক শব্দ কৌশিক স্যার। সে থমকে দাঁড়িয়ে নোহারার হাত চেপে ধরলো।

"কৌশিক স্যার সম্পর্কে কিছু বলছে ওরা।" শ্বাস কাঁপা কাঁপা অনন্যার কণ্ঠে।

নোহারা অনন্যার কথার এতো গুরুত্ব দিলো না। কারণ মেয়েটা কিছু হলেই কৌশিক স্যারকে দেখতে পায়, শুনতে পায়। সেদিন ও নাকি কৌশিক স্যারকে দেখেছে। কিন্তু এরপর তো তাকে খুঁজেই পাওয়া গেলো না। নিককেও বলেছিল নিক ও পাত্তা দেয়নি। বলেছে অনন্যার ভ্রম ই হবে এসব। 

নোহারা সময় নিয়ে বললো,
"হতেই পারে। কারণ স্যার তো আগে এখানেই ক্লাস করাতো। তাই উনাকে নিয়ে কথা হওয়া এটা স্বাভাবিক নয়?"

অনন্যা হতাশ হলো। মাথা নাড়িয়ে উপরে উঠতে লাগল আবারো। আরেকজনের মুখ থেকে আবারো শোনা গেলো স্যারের নাম। অনন্যার পা হঠাৎই জমে গেলো। নড়তে পারছিল না সে। এক অচেনা রকমের শিহরণ বয়ে গেলো তার বুকজুড়ে। কিছুটা নিচু হয়ে কান পেতে শুনতে লাগলো সে।

মেয়েটা বলছিল,
"এই শুনেছিস? আজ কৌশিক স্যার আসছেন। উনার ক্লাস হবে আজ। ইশ! কতদিন দেখি না ওনাকে!"

আরেকজন সঙ্গে সঙ্গে সায় দিয়ে বললো,
"আমিও রে, খুব মিস করছিলাম স্যারকে। প্রতিদিন ই খুঁজতাম। আজ তাহলে আমাদের অপেক্ষার অবসান হলো!"

এই কথাগুলো অনন্যার হৃদয়ে ঝড় তুললো। সে নোহারার দিকে তাকালো। নোহারাও বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে অনন্যার দিকে। নোহারাকে রেখেই অনন্যা দ্রুত হাঁটা ধরলো। মূহুর্তখানেক পর সে দৌড়াতে লাগল টিচার্স রুমের দিকে। টিচার্স রুমে এসে সম্পূর্ণ রুমে কয়েক বার চোখ বুলিয়ে ফেললো। কৌশিক স্যার যেখানে বসতেন সেই স্থানটা খুব দূরে। কিন্তু দূর থেকেও স্যারের মাথা দেখা যেত। আজ ও কী তাকে দেখা যাবে?

অনন্যা ঢোক গিলে ভেতরে প্রবেশ করলো। স্যারের নামটা যেখানে আছে সেখানেই এসে থামলো অনন্যা। কিন্তু সিটটা খালি। তবুও সন্দেহ উড়ে যায় নি মন থেকে। কারণ ডেস্কের উপর কয়েকটা শীট পড়ে আছে। নতুন নতুন শীট ই মনে হলো। অনন্যা দ্রুত শীটগুলো হাতে তুলে নিলো। হ্যাঁ, ডেট তো বর্তমানের ই দেওয়া। অনন্যার মুখে হাসি ফুটলো। সে শীটগুলো দেখতে লাগলো। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন এসে অনন্যার হাত থেকে শীটগুলো ছো মেরে কেড়ে নিলো। 

কঠোর গলায় বললো,
"না জিজ্ঞেস করে আমার জিনিসপত্রে হাত দিয়েছেন কোন সাহসে?"

অনন্যা দ্রুত পিছনে ফিরলো। একদম চোখের সামনে কৌশিক স্যার দাঁড়িয়ে আছে। অনন্যার শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেলো। সেই চেনা মুখ! চেনা লোকটা! শুধু চোখ দুটো! চোখ দুটোই মিললো না পুরাতন মানুষটার সাথে।‌ আচ্ছা এই মানুষটি কি সেই পুরোনো মানুষটি নয় যাকে অনন্যা মন প্রাণ সব দিয়ে ভালোবেসেছিলো? যার জন্য নিজের মায়ের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত না নিয়ে এই মানুষটির সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, অনন্যা! এ কি সে নয়? যদি না হয়ে থাকে তাহলে তো অনন্যা আরো একবার শেষ হয়ে যাবে।

অনন্যা বিস্ময়ে অভিভূত চক্ষু যুগল নিয়ে তাকিয়ে রইল প্রিয় মানুষটির দিকে। চুলের গঠন ভিন্ন কৌশিকের। আজ তাও লক্ষ্য করলো অনন্যা। কালো এবং ডার্ক ব্রাউন মেশানো চুল। অনন্যা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল। লোকটার চোখের সামনে খুচরো চুল এসে পড়ছে। কি দারুন লাগছে তাকে দেখতে। অনন্যা ধীরে ধীরে নিজের হাত উঁচিয়ে স্যারের মুখে হাত স্পর্শ করার চেষ্টা করলো। কৌশিক ফটাস করে অনন্যার হাতে থাপ্পড় মেরে বসলো। অনন্যা ও হাত থামিয়ে দিলো।
কৌশিক গম্ভীর স্বরে বললো,
"ওয়াট ননসেন্স!"

টিচার্স রুমে থাকা কয়েকজন প্রফেসর মুখ তুলে ওদের দিকে তাকালো। কৌশিক অনন্যা কে এড়িয়ে নিজের চেয়ারে বসলো। অনন্যা ও কঠোর কণ্ঠে কিন্তু নিচু গলায় প্রশ্ন করলো,
"আপনি এখানে! কীভাবে?"

কৌশিক শীটগুলো টেবিলে রেখে অনন্যার দিকে তাকালো। নরম গলায় বললো,
"হু আর ইউ?"

অনন্যা আরো একদফা চমকে উঠলো। কৌশিক স্যার তাকে একদমই চিনতে পারছে না? অথচ এখানে কৌশিক স্যারের সিটে আসন গ্রহণ করে বসে আছে। এটা কীভাবে সম্ভব? অনন্যার মাথা সম্পুর্ন গুলিয়ে যাচ্ছে। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। 

কৌশিক আবারো বললো,
"আমি কী আপনাকে চিনি? "

অনন্যা সময় নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। মাথা নাড়িয়ে বললো,
"আমি আপনার স্টুডেন্ট।"

মনে মনে বললো,
"বাকি কথা নাহয় বাদই দিলাম। অন্তত এইটুকু তো মনে আছে আমি আপনার স্টুডেন্ট। আর....আর আমাদের বিয়ে হয়েছে?"

কৌশিক মাথা হেলিয়ে বুঝতে পারার ভঙ্গিতে বললো,
"আসলে, এই ইউনিভার্সিটিতে হাজার হাজার স্টুডেন্ট আছে। এতো স্টুডেন্টকে মনে রাখা, তাদের চেহারা, নাম মনে রাখা আমি একা একজনের পক্ষে তো সম্ভব না। তাই ভুল হতেই পারে। হবেন আপনি আমার স্টুডেন্ট। তাই বলে হঠাৎ এসে আমার জিনিসপত্রে হাত দেওয়া কোন ধরনের ভদ্রতার মধ্যে পড়ে? যাই হোক, ক্লাসে যান। এভাবে হুটহাট বিনা প্রয়োজনে এখানে আসতে পারেন না। রুলস জানেন ই তো?"

অনন্যা হাসার চেষ্টা করলো। কিন্তু ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গেলো তার। খুব কান্না পাচ্ছে অনন্যার। অনন্যা দৌড়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। কৌশিক মুখ তুলে একবার পিছনে ফিরলো। কাঁধ ঝাঁকিয়ে আবারো তার কাজে মনোযোগ দিলো সে।

কয়েক দিন আগের ঘটনার কথা হঠাৎই মনে পড়ে গেল কৌশিকের। আরণ্যক নামের এক অচেনা ছেলে তাকে দেখে হঠাৎ করেই আবোল-তাবোল বলতে শুরু করেছিল। শুরুতে কৌশিক গুরুত্ব দিতে চায়নি, ভেবেছিল পাগলের প্রলাপ মাত্র। কিন্তু এক বাক্যে ছেলেটি বলেছিল,
"আপনি তো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ছিলেন!"

এই কথাটাই কৌশিকের ভেতরে একটা প্রশ্নের ঝড় তোলে। কী বললো সে? প্রফেসর? তাও বিশ্ববিদ্যালয়ের?
মনটা অস্থির হয়ে উঠলো ওর। ভুলেও যেটা কখনো ভাবতে পারেনি এখন সেটাই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা। সে আর দেরি করলো না। ছেলেটাকে বললো বিশ্ববিদ্যালয়টা দেখিয়ে নিয়ে আসতে। 

কৌশিকের কথামতো আরণ্যক নিয়ে গেলো ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ে। কৌশিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তো পৌঁছে গেলো। কিন্তু চিনতে পারলো না সেখানকার কোনো কিছু। কোনো দিন এসেছিল কিনা তাই মনে পড়লো না কৌশিকের। সে ধীরে ধীরে ভিতরে প্রবেশ করলো। এখানকার সিকিউরিটি গার্ড ঠিক ই কৌশিককে চিনে ফেললো। স্যার বলে সম্বোধন করলো এবং সম্মান ও জানালো। সবকিছুই অবাক করলো কৌশিককে।

আরণ্যক কৌশিককে ডিপার্টমেন্টের হেড অফিসের দিকে নিয়ে গেলো। এই ছুটিতেও ভেতরে কাজ চলছে।‌ কৌশিক হেড অফিসে পৌঁছতেই কয়েক জন ওকে দেখেই অবাক হয়ে গেলো। বলে উঠলো,
"স্যার! আপনি ফিরেছেন? আপনার সাথে কোনো কন্টেক্ট হচ্ছিল না। আপনাকে খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছিল না বেশ অনেক দিন। আপনি ফোন তুলছিলেন না। আমরা ভেবেছিলাম আর আসবেন না আপনি।"

কৌশিক কোনো উত্তর করলো না। একজন বললো,
"আমি আপনার কাগজপত্র রেডি করছি। আপনি আবার আগের মতো নিজের স্থানে কাজ করে যেতে পারবেন। প্রফেসর হিসেবে এখানে আবার পড়িয়ে যেতে পারবেন।"

কৌশিক বুঝতে পারছে না কিছুই। তাও কাগজে নিশ্চুপ হয়ে সাইন করে বেরিয়ে গেল। আরণ্যক যদিও বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। সে চিন্তিত ছিল। ভাবছিল কৌশিক স্যারের মধ্যে এরকম পরিবর্তন কি করে হতে পারে? আর কেনোই বা এরকম? তিনি সব ভুলে গেছেন। এর অর্থ অনন্যাকেও তার মনে নেই। অনন্যার জন্য ভালোবাসা, কেয়ার সব অদৃশ্য। দেখতে দেখতে কৌশিক যখন বেরিয়ে এলো, ওনার মুখের অভিব্যক্তি বোঝা যাচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল কোনো শকে আছে সে। আরণ্যক ও বোঝেনি কিছু।

সেদিন বাড়িতে পৌঁছেও স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকে কৌশিক। মেহজাবিন বেগম অবাক হয়ে যান ছেলের এইরকম কাণ্ডে। কৌশিক না পেরে মাকে জিজ্ঞেস করে,
"আমি আগে কি ধরনের চাকরি করতাম?"

মেহজাবিন বেগম উত্তর দেন,
"কোনো চাকরি তো করতিস না তুই!"

"কিন্তু রাস্তায় একজন আমাকে দেখে বললো সে নাকি আমার স্টুডেন্ট আর আমি নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর।"

"কী?"
মেহজাবিন বেগম অবাকই হলেন।

কৌশিক বললো,
"আমি বোধহয় চাকরি পেয়ে গেছি।"

"মানে?"
মেহজাবিন বেগম ছেলের পাশে বসে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

"আমি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম ওরাও বলছে আমি নাকি সেখানে চাকরি করতাম। আমি সেখানকার প্রফেসর ছিলাম। আমি যদি না থাকতাম ওরা কী আমাকে বলতো মা? এর অর্থ আমি আসলেই সেখানে প্রফেসর হিসেবে ছিলাম।"

"কিন্তু কৌশিক এটা কীভাবে সম্ভব? আমি তো কখনোই তোর এসব ব্যাপারে জানতাম না। আচ্ছা তোর কি কিছুই মনে নেই।"

কৌশিকের মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন গোলক ধাঁধায় ঘুরছে সে। কৌশিকের চোখে ভেসে উঠছে ঝাপসা এক অন্ধকার। মনে হচ্ছে কেউ যেন ঠেলে দিচ্ছে তাকে এক গভীর অতলে, যেখানে স্মৃতিরা নেই, নেই কোনো পরিচয়। চারপাশে মুখ, শব্দ, দাবি! কিন্তু কোনটা নিজের আর কোনটা আরোপিত, তার আর হুঁশ নেই।

সে কান চেপে ধরে কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলো,
"না। আমার কিছু মনে নেই। কিচ্ছু না। দয়া করে... আমাকে বাঁচতে দাও। আমার মাথাটা খেয়ো না।"

মেহজাবিন বেগম এরপর ছেলেকে আর কিছু বলেনি। ছেলেটা যা করতে চাইছে যেখানে যেতে চাইছে যাক। তাইতো কৌশিক আজ এখানে। সে জানে না কবে সে এতো ডিগ্রি অর্জন করলো, সে জানে না কবে থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেছে আর সে এটাও জানে না তার পড়ানোর যোগ্যতা কতটুকু। সে শুধু জানে, আজ এই মূহূর্তটাই তার সত্যি। এখন থেকে যা করবে, যা শিখবে, যা দেবে সবকিছুর শুরু হবে এই মুহূর্ত থেকে।

কৌশিক কাগজপত্র গুছিয়ে ক্লাসের দিকে হাঁটা ধরলো। আজ প্রথমবারের মতো ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস নিতে যাচ্ছে সে। জানে না কতটুকু সবার সাথে মিশতে পারবে। কিন্তু নিজের সবটুকু দেওয়ার চেষ্টা করবে কৌশিক। ক্লাস ছিল পাঁচ তলায়। সিঁড়ি দিয়ে চতুর্থ তলায় উঠছিল কৌশিক। সিঁড়ি পেরোতেই পাশের একটা কমন রুমে একজন মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলো সে। আশেপাশে উৎসবের আমেজ। কিন্তু এই মেয়েটি হঠাৎ কাঁদছে কেনো তাই চিন্তিত করে তুললো কৌশিককে‌। কিন্তু বুঝতে পারলো না এখন এদিকে যাওয়া ঠিক হবে কিনা। অপরদিকে ক্লাসেও তো দেরি হয়ে যাবে খুব।
·
·
·
চলবে.................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp