অভিমানিনী - পর্ব ১৩ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          সেই ঘটনার ২ দিন পর রাতে হসপিটাল থেকে ফেরার পর অনন্যা এল আমার ঘরে,

“দাদা আসব?”

“আয় আয়, কিছু বলবি?”

অনন্যা একবার দরজার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বলল,

“মানসী তোমার জন্য একটা চিঠি দিয়েছে আমার কাছে।”

“ও বাসায় এসেছিল? নাকি ইউনিভার্সিটিতে?”

“নাহ, কদিন ধরে বাসায় আসছে না, ইউনিভার্সিটিও তো বন্ধ। ফোন করেছিলাম, কেউ ধরল না তাই মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। মা বলল জানে না তাই কোনো খোঁজ না পেয়ে আজ গিয়েছিলাম ওদের বাসায়। তখনই ইন্সট্যান্ট লিখে দিল।”

“ওহ। কোথায় চিঠিটা?”

অনন্যা আঁচলের তলায় লুকিয়ে রাখা চিঠিটা বের করে দিল আমাকে। তারপর বলল,

“দাদা আমি গেলাম।”

বুঝলাম অনন্যা মাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছে। একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, “ভাগ্যিস তুই ছিলি।”

অনন্যাও আমার মতো একটু হাসার চেষ্টা করল। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলাম। চিঠিটা ছিল এরকম,

“নীরবদা,

কেমন আছ? এমনি ফর্মালিটি করে জিজ্ঞেস করলাম। আমাদের বাসার ফোন লক করা থাকে, ফোন করতে পারি না। খালামণি তোমাদের বাসায় যেতে নিষেধ করেছে। এখন ইউনিভার্সিটি বন্ধ, বাইরে যেতে পারি না। তাই দুপুরে তোমার হসপিটালে যেতে পারি না, একদিন সুযোগ করে সকালে গিয়েছিলাম কিন্তু তোমাকে পাইনি। তুমি কি কাল দুপুরের পর আমাদের বাসায় আসতে পারবে? ওই সময় বাসায় কেউ থাকে না। জানি তোমার তুলতুলের মা হওয়ার সৌভাগ্য আমার আর হবে না। তবু আমি আর একটা বার তোমার সাথে দেখা করতে চাই। যদি আসো বাকি কথা কাল হবে।

—মানসী”

পরদিন দুপুরের পরপর হসপিটাল থেকে ছুটি নিয়ে মানসীদের বাসায় গেলাম। দরজা খুলতেই আমি ওর বিধ্বস্ত মুখটা দেখতে পেলাম। ভেতরে ঢুকতেই ও দরজাটা লাগিয়ে দিল। তারপর আলতো পায়ে হেঁটে আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। ওর খুব লজ্জা ছিল, বিয়ের পরেও নিজ থেকে এসে আমাকে কোনোদিন জড়িয়ে ধরেনি। আজ কিন্তু লজ্জা পায়নি। হারানোর সময়টা বোধহয় এমনই। ইচ্ছে করে শরীরের সবটা শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরে রাখি। আমি ওকে আরো শক্ত করে ধরে বললাম,

“আমি তোকে ছাড়তে পারব না।”

আমার এ কথায় ওর যে কী হলো! কোনো শব্দ হলো না কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে ওর চোখের পানিতে আমার শার্ট ভিজে গেল। আজ আর ওকে কাঁদতে নিষেধ করতে পারলাম না। চুপ করে রইলাম। কিছুক্ষণ পর ও ভেজা গলায় বলল,

“কী করবে তাহলে? খালামণি তো তোমাকে বিয়ে দেবে, মেয়ে ঠিক করেছে।”

“বিয়ে ঠিক করলেই তো হলো না। আমি বিবাহিত, আমি কেন বিয়ে করতে যাব আবার?”

“দেখো আমরা তো আগে থেকেই জানি আমার বাবা আমাদের সম্পর্কটা মানবে না তাই খালামণির উপরেই ভরসা করে ছিলাম এতদিন। কিন্তু খালামণিই এখন আমাদের সাথে নেই। এখন আর আমরা কী করব বলো?”

“পালিয়ে যাব।”

মানসী আমাকে ছেড়ে পাশের সোফায় বসল। তারপর বলল,

“নাহ, আমি কখনোই পারব না এ কাজ করতে।”

আমি ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসলাম। বললাম,

“কেন?”

“বাবা-মা খুব কষ্ট পাবে। তাছাড়া খালামণি আমার কাছে এসেছিল। বলেছিল তোমাকে ডিভোর্স দিতে। আমি কারণ জানতে চাইলে সে কিছুই বলল না। যখন বললাম আমি এটা করতে পারব না তখন সে যা করল তাতে লজ্জায় আমি মরে গিয়েছি।”

“কী করেছে?”

“আমাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে হঠাৎ করেই আমার পা জড়িয়ে ধরল।”

“কি বলছিস!”

“হ্যাঁ, আমি তো তাড়াতাড়ি বসে পড়ে খালামণির হাত ধরে ফেললাম। তুমি কল্পনা করতে পারবে না খালামণি কি কান্নাটাই না কাঁদল। কোনো কারণে খালামণি খুব কষ্ট পাচ্ছে না হলে ওইভাবে কাঁদতো না।”

“আমারও মনে হচ্ছে ঘটনা কিছু আছে। কিন্তু কী তা তো বুঝতে পারছি না, মাকে এত করে জিজ্ঞেস করলাম কিছুই বলল না।”

“আরেকটা কথা শুনলে তুমি আরো অবাক হয়ে যাবে।”

“কী?”

“বলে তোমাকে ডিভোর্স দেয়ার বিনিময়ে আমি যা বলব তাই নাকি করবে। ইভেন আমি যদি বলি তাহলে নাকি খালুকে ডিভোর্স দিতে তাতেও উনি রাজি। কিন্তু যে করেই হোক তোমার বিয়েটা দিতেই হবে। আর বারবার বলছিল যা করছে তোমার ভালোর জন্য করছে।”

“মা পাগল হলো নাকি! তারপর তুই মাকে কী বললি?”

“বলেছি খালামণি যা চাইবে তাই হবে।”

“এ কথা কেন বলেছিস?”

ও বলল,

“যে মানুষটার কাছ থেকে ছোটবেলা থেকে মায়ের আদর পেয়েছি, যে মানুষটা নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে, গোসল করিয়েছে, জ্বরে কাতর হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলে সেই ছোট্ট তপ্ত দেহটাকে নিজের ঠাণ্ডা বুকে রেখে যে আমাকে শান্তি দিয়েছে সেই মানুষটাকে ফিরিয়ে দিতে পারিনি আমি। আমি তাকে কথা দিয়েছি তার ছেলেকে তার কাছ থেকে আমি আলাদা করব না।”

“আলাদা করার কথা আসছে কোত্থেকে?”

“আমরা পালিয়ে গেলে তো আলাদাই হবে, তাই না?”

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। মা এতটা ভেবেছে! মনে মনে ভাবলাম বাবার সাথে কথা বলা ছাড়া কোনো উপায় নেই। এর মধ্যেই মানসী আবার বলল,

“আমি ভেবেছিলাম তোমার সাথে আর যোগাযোগ করবই না কিংবা খুব খারাপ ব্যবহার করব তারপর আবার ভেবেছি তাতে লাভ কী? তাই সব কথা তোমাকে সরাসরি বললাম।”

“খুব ভালো করেছিস।”

তারপর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। হঠাৎ মানসী বলল,

“খালামণি বলেছে পরশু দিন ডিভোর্স পেপার নিয়ে আসবে।”

“তুই সাইন করবি না।”

“তাহলে আমি কী করব? সব তো শুনলে!”

মানসীর কান্নার বেগ বাড়ল। আমি উঠে ওকে কাছে টেনে নিলাম। ওর মাথাটা আমার বুকে জড়িয়ে বললাম,

“তুই চিন্তা করিস না। আমি তোকে ডিভোর্স দিচ্ছি না। তুই বোকা তাই মা তোকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করতে পেরেছে, আমাকে পারবে না। একটা বিবাহিত ছেলেকে জোর করে বিয়ে দেয়া অত সোজা না, আর বাবার সাথে কথা বলছি আমি। সব ঠিক করে দেব।”

ওর কান্না আরো বেড়ে গেল। এবার বলল, “আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি খুব।”

আমি ওর কপালে চুমু খেয়ে বলেছিলাম,

“জানি তো আমি। পাগলি! কাঁদিস না সব ঠিক করে দেব…আমি আছি তো।”
·
·
·
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp