অভিমানিনী - পর্ব ০৬ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          তখন আমার ফাইনাল ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। রাত জেগে পড়তাম বলে মানসী আমার ঘরে আসত না। ও আর মোনালিসা একসাথে থাকত। আমার ঘরের পাশের ঘরটাই ওদের ছিল। দুই ঘরের একটা কমন বারান্দা ছিল। সেই নতুন বারান্দা দিয়েই আমার আর ওর সম্পর্কের যত চোরাকারবারি চলত। মোনালিসা টের পেলেও কাউকে কখনো বলেনি।

সেদিন খুব মিস করছিলাম ওকে। তাই বারান্দায় গেলাম ডাকতে। গিয়ে দেখি ও বারান্দায় অদ্রিকে বুকে শুইয়ে হাঁটাহাঁটি করছে। রাত তখন প্রায় পৌনে তিনটা বাজে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

“এত রাতে হাঁটছিস! ঘুমাসনি কেন?”

ও ফিসফিসিয়ে বলল,

“ইশ, আস্তে কথা বলো। অদ্রি উঠে যাবে, কত কষ্টে ঘুম পাড়িয়েছি জানো?”

“ভালো করেছিস। এখন ওকে রেখে আয়। পড়তে পড়তে বোর হয়ে গেছি। এখন আমার তোকে দরকার।”

“পাগল হয়েছ? ওকে বুকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে ঘুম না পাড়ালে ও ঘুমায় না। আর ঘুমানোর পর কোল থেকে নামিয়ে বিছানায় শোয়ালে চিৎকার করে সারা বাড়ি মাথা তুলবে। ও যতক্ষণ ঘুমায় কোলেই ঘুমায়। খুব কোল চিনেছে পুঁচকুটা!”

একথা বলেই অদ্রির মাথায় একটা চুমু খেলো মানসী। আমি ওকে বললাম,

“এত কোল চিনলে ওর মায়ের কাছে দিয়ে আয়। তোর এত দায় কিসের?”

কী বলছ তুমি? তুমি জানো না? অনন্যা ওকে ঘুম পাড়াতে পারে না। এই

কাজটা খালামণি না হয় আমাকেই করতে হয়।”

“মা যখন হয়েছে সব পারবে। না পারলে মা হয়েছে কেন?”

“ছিঃ কি কথার ছিরি! এসব বলছ কী করে?”

“কেন বলব না? দিন নেই রাত নেই সবসময় দেখি তুই এইটাকে কোলে নিয়ে টিক টিক করে ঘুরঘুর করিস! মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি। এইসব ন্যাকামি আমার একদম পছন্দ না।”

“ছিঃ কী পচা হয়ে গেছ তুমি! কী ভীষণ স্বার্থপর! একটা রাত বউকে কাছে পাবে না বলে এরকম কথা বলছ?”

“দ্যাখ মানসী, আমি তোকে ডাকতে এসেছিলাম ঠিকই কিন্তু তার মানে এই নয় যে অদ্রির জন্য তুই যেতে পারবি না, তাই আমি এসব বলছি।”

“তাহলে কেন বলছ?”

“পরের বাচ্চা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করাটা ঠিক না। পরে ওর মা কিছু বললে প্রচণ্ড কষ্ট পাবি, সেজন্যই বলেছি।”

“তুমি যে কী বলো না! অনু কী বলবে আবার?”

“অনেক কিছুই বলতে পারে। যেমন ধর হয়তো বলবে, অদ্রি তোর বাচ্চা না আমার বাচ্চা। কিংবা ধর, একটা বাচ্চার জন্ম দিয়ে দেখেছিস কেমন লাগে? মা তো হোসনি, বুঝবি কী করে এইসব।”

“যাহ, তুমি একটা পাগল। অনু বুঝি সেরকম মেয়ে? তাছাড়া ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ওর বাচ্চা আমার বাচ্চা এবং আমার বাচ্চা ওর বাচ্চা সব একই কথা।”

আমি মানসীর পেছনে দাঁড়িয়ে ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে কানের কাছটায় একটা চুমু খেয়ে বললাম,

“এসব কথা বলতে সেরকম মেয়ে হওয়া লাগে না। পরিস্থিতি সেরকম হলে এসব কথা তুমিও বলতে পারো। মেয়েরা বড্ড পজেসিভ হয়।”

“আমাকে তুমি করে বললে কেন?”

“মাঝে মাঝে বললে কী হয়?”

“তোমাকে কতবার বলেছি, তুমি করে বললে আমার ভালো লাগে না। মনে হয় যেন দূরে সরে যাচ্ছ।”

“দূরেই তো সরিয়ে দিচ্ছিস। তাও আবার পরের বাচ্চার জন্য। নিজের বাচ্চা হলে না জানি তুই কী করতিস।”

ও রেগে গিয়ে বলল,

“নীরবদা, তুমি কি বলো তো? একটা বাচ্চাকে হিংসে করছ?”

“আচ্ছা বাবা, সরি। আপনি কি এখনো হাঁটবেন? নাকি একটু শোবেন?”

“শোব, কিন্তু ওকে বুকে জড়িয়ে রাখতে হবে। শরীরের ওম না পেলে ও ঘুমাতে পারে না।”

“সে তো আমিও পারতাম না। তোর এই পুঁচকু এসে আমার সম্পত্তিতে ভাগ বসাল।”

“মোটেও না, তোমার পরীক্ষা বলেই আমি তোমার ঘরে খুব একটা আসি না। “যাতে আমার ডিস্টার্ব না হয়?”

“হ্যাঁ।”

“আর তুই আমার কাছে না থাকলে তোর কথা ভেবে ভেবে যে আমার পড়ার ডিস্টার্ব হয় তখন?”

“আমার কথা এত ভাবতে হবে কেন? আমি কি ভেগে যাচ্ছি নাকি?”

“আচ্ছা বাদ দে তো। এখন চল, আজকে আমার ঘরে ঘুমাবি। সমস্যা নাই তোর বাচ্চা তোর বুকেই থাকবে।”

“অদ্রিকে নিয়ে তোমার ঘরে ঘুমালে তোমার তো কোনো লাভ নেই। এক সেকেন্ডের জন্য ওকে কোল থেকে নামাতে পারব না।”

“আপাতত দীর্ঘমেয়াদি লাভ না হলেও চলবে। তোর চুলের আর শরীরের ঘ্রাণ পেলেই আমার ঘুমটা আরামের হবে। লাভ এই একটাই। এত রাত পর্যন্ত পড়ার পর একটু আরামে ঘুমানো দরকার।”

তারপর লাইট অফ করে সেদিন ও আমার পাশে শুয়ে পড়েছিল। আমিও একটু একটু করে ওর কাছে গিয়ে ওকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলাম যাতে অদ্রির ঘুমটা না ভেঙে যায়। অন্ধকারেও আবছা আলোয় টের পেলাম ও মিটমিট করে হাসছিল। কিন্তু কেন হাসছিল? ও কি তবে এরকম কিছুই চাচ্ছিল!

তার বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা। ড্রইং রুমে বসে টিভি দেখছিলাম। পাশেই মানসী অদ্রিকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। আর অনন্যা পাশে বসেই মায়ের কাছে সোয়েটার বোনা শিখছে।

অদ্রি এত দুষ্টুমি করছিল, খেতে তো চাইছিলই না উল্টো মানসীকে হাঁপিয়ে তুলেছিল। হঠাৎ মানসী রেগে গিয়ে অদ্রিকে একটা চর মেরে বলল,

“আমাকে আর কত জ্বালাবি তুই?”

অদ্রি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। কিছু বোঝার আগেই অনন্যা লাফিয়ে পড়ে অদ্রিকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,

“আমার বাচ্চাকে মারার সাহস তুই কোত্থেকে পেলি? ওর খেতে ইচ্ছে করলে খাবে, ইচ্ছে না করলে খাবে না। এখানে তুই বলার কে? তোর হাতে দিয়েছি বলে তুই যা ইচ্ছা তাই করবি? কোনো জানোয়ারও তো এইটুকু বাচ্চার গায়ে হাত তুলতে পারবে না। খবরদার বলছি এরপর থেকে আমার মেয়ের কোনো ব্যাপারে নাক গলাতে আসবি না।”

এক দমে কথাগুলো বলে অনন্যা অদ্রিকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। মানসী এতক্ষণ হাঁ করে চেয়ে কথাগুলো শুনছিল। অনন্যা চলে যেতেই হাঁটুতে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলল। মা আর আমি ওর কাছে গিয়ে বসলাম। মা ওর মাথায় হাত রেখে বলল,

“কাঁদছিস কেন মা? সংসারে এরকম কত কী হয়! কাছের মানুষরাই আমাদের বুঝে না বুঝে কষ্ট দেয়। এসব নিয়ে মন খারাপ করলে চলে না।”

মানসী ওর স্বভাবসুলভ চুপচাপ কেঁদে গেল। কোনো কথা বলল না। মা আবার বোঝালো,

“লক্ষ্মী মা আমার, কাঁদিস না। ও ছোট মানুষ বুঝতে পারেনি। হ্যাঁ বয়সে তো তোরা সমান তবে তোর মতো ম্যাচিউরিটি তো ওর আসেনি। তাছাড়া ওর মেয়েকে মেরেছিস ওর তো একটু খারাপ লাগবেই।”

মানসী কাঁদতে কাঁদতেই বলল,

“আমি কি অত জোরে মেরেছি নাকি? অদ্রি তো দুপুরে কিছু খায়নি, এখনো না খেয়ে থাকলে আমি তো খেতে পারতাম না। আর বাচ্চাদের কি শুধু আদর করলেই হয়? প্রয়োজনে শাসনও তো করা লাগে।”

আমি এতক্ষণ চুপ করেই ছিলাম। এবার বললাম,

“তোর এই কান্নাটা দেখতে চাইনি বলেই সেদিন ওই কথাগুলো বলেছিলাম।”

নীরব ইশতিয়াক
২১ মার্চ, ২০১৬

এতক্ষণ পড়ছিল বলে কেউ কারো দিকে তাকায়নি। পড়া শেষ করে অদ্রির দিকে তাকিয়েই অৰ্পি চমকে উঠল। অদ্রি কাঁদছে!
·
·
·
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp