স্টে উইথ মি - পর্ব ২৩ - নুসরাত জাহান বৃষ্টি - ধারাবাহিক গল্প


          মেহুল খাটের মাথায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। হঠাৎ বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। অজান্তেই চমকে উঠে তড়াক্ করে সোজা হয়ে বসল, অস্থির কণ্ঠে বলে উঠল, “শেরাজ ভাই…”

মেহুল চারপাশে তাকায়। না, কেউ নেই। শুধু নিঃশব্দ আর নিঃসঙ্গ এক বদ্ধ ঘর ছাড়া কিছুই নেই। মেহুল বেড থেকে নেমে দরজার দিকে ছুটে যায়। দরজায় করাঘাত করতে করতে চিৎকার করে ওঠে, “মুঈন! দরজা খুলুন প্লিজ… আমাকে যেতে দিন! আমি এখানে থাকতে চাই না! আমার দম বন্ধ লাগছে। প্লিজ দরজা খুলুন!”

কিন্তু কারো কোনো সাড়া নেই। কেউ তার বুক ফাটা আর্তনাদ শুনতে পেলো না শুধু সে ছাড়া। মেহুল ক্লান্ত হয়ে পেছন দিকে হাঁটতে হাঁটতে বিছানার সাথে ধাক্কায় খায় ধীরে ধীরে মেঝেতে বসে মাথাটা বিছানার উপর হেলিয়ে দেয়। কেন জানি তার অবুঝ মন বলছে, খুব কাছ থেকে কেউ তাকে ডাকলো। ভীষণ চেনা সেই ডাক। তার শেরাজ ভাইয়ের এই কণ্ঠ। কিন্তু পরক্ষণেই নিজ মনেই বলে ওঠে।

“শেরাজ ভাই তো জানেই না আমি এখানে…। আচ্ছা আমায় কি শেরাজ ভাই খুঁজে বেড়াচ্ছে ঠিক পাঁচ আগের সময়কার মতো নাকি এখনও জানেই না আমায় কিডন্যাপ করা হয়েছে।”

এসব ভেবে মেহুলের চোখ দুটো টলমল করে ওঠে। দু-এক ফোঁটা নোনা জল নিরবে গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে।

—————

শেরাজ চোখ বন্ধ করে বুকের বা পাশে হাত চেপে ধরে রেখেছে। মেহুল…এখানেই আছে। খুব কাছেই আছে তার। সে মেহুলের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছে যেটা সবসময় করে থাকে মেহুল তার আশেপাশে থাকলে। কিন্তু মেহুলকে এখন খালি চোখে দেখতে পাচ্ছে না। কোথায় আছে মেয়েটা? 

শেরাজ চোখ মেলে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বিকাশকে নির্দেশ দেয়, “বিকাশ চারপাশ ভালো করে খুঁজে দেখ। মেহুল এখানেই আছে… আমাদের খুব কাছেই। এই ঘরে কোথাও একটা অদৃশ্য রুম তো আছেই আমি সিউর, যা আমাদের চোখে ধরা দিচ্ছে না। পুরো ঘরটা চিরুনি তল্লাশি কর।”
 
তারপর মুঈনের দিকে ফিরে দৃঢ় গলায় বলে, “ঠিক বলেছি না আমি? এই ঘরের ভেতরেই কোথাও লুকানো এক গোপন কক্ষে মেহুলকে লুকিয়ে রেখেছিস তাই না?”
 
মুঈন উঠে দাঁড়ায়। চোখ দুটো লাল, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। দু’ভ্রু উপরে তোলে বিদ্রূপভরা কণ্ঠে বলে, “তুই মেহুলকে কিছুতেই খুঁজে পাবি না, কিছুতেই না!”
 
শেরাজ ঠোঁটের কোণে এক ভয়ানক হাসি টেনে বলল, “বিশ্বাস কর, মেহুলকে পাওয়ার পর তোর গলাটা আমি নিজ হাতে আগে কাটব। তারপর তোর এই পাঁচ ফুট, পাঁচ ইঞ্চির শরীরটাকে টুকরো টুকরো করে চিল শকুনদেরকে উৎসর্গ করব।”

মুঈন হো হো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে, “তোর এই সব ডায়লগ বাজি অন্য কাউকে গিয়ে শুনা, আমাকে না।”
 
শেরাজের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। হাত মুঠো করে সরাসরি ঘুষি তোলে মুঈনের নাক বরাবর, কিন্তু মুঈন আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো আর তৎক্ষণাৎ শেরাজের হাত চেপে ধরে মুহূর্তের মাঝে ঘুষি বসায় শেরাজের মুখে। শেরাজ খানিকটা পেছনে সরে যায়। ঠোঁট কেটে গেছে, রক্ত ঝরছে। শেরাজ বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে রক্ত মুছে মুঈনের দিকে তেড়ে আসতে নিবে ঠিক তখনই বিকাশের তড়িঘড়ি করা ডাক থামিয়ে দেয় তাকে।

“স্যার!”

শেরাজ চোখ ঘুরিয়ে তাকায় বিকাশের দিকে। চোখে আগুন, ঠোঁটের কোণায় তাজা রক্ত—আর ভিতরে মেহুলকে ফিরে পাওয়ার আশা। 

শেরাজ এগিয়ে আসে বিকাশের কাছে। বিকাশ একটা নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। পুরো ঘরটাই সাদা কার্পেটে ঢাকা, কিন্তু যেই জায়গাটায় বিকাশ দাঁড়িয়ে আছে সেই জায়গাটা একটু অন্যরকম—দেখতে কার্পেট দেওয়া মনে হলেও আসলে মেঝেটা একধরনের ফেক মার্বেল শিট দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। পা দ্বারা চাপ দিতেই বোঝা যাচ্ছে ওই জায়গাটা ফাঁপা। বিকাশ জায়গাটাতে পা ঠুকতে ঠুকতে বলল।

“স্যার, এই জায়গাটার নিচে মাটি নেই। শুনছেন? নিচটা ফাঁকা। মনে হচ্ছে মাটির নিচে কোনো ঘর আছে। কিন্তু খোলার কোনো সিস্টেম খুজে পাচ্ছি না হয়তো অন্য কোনো সিস্টেম করে রেখেছে এটা খোলার।”

শেরাজ একটুও সময় নষ্ট না করে ঠাণ্ডা গলায় বলল, “খোলাখুলি না করে সোজা ভেঙে দে এটাকে?”

তখনই মুঈন চিৎকার করে উঠে, “না! না! এটা ভাঙবি না! নিচে কিছু নেই!”

শেরাজ তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। নিজের লোকদের দিকে ইশারা করে বলল, “এই টিকটিকির বাচ্চার হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখ। খুব বেশি লাফালাফি করছে আগে মেহুলকে উদ্ধার করি, তারপর এর ব্যবস্থা করছি আমি।”

শেরাজের লোকেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে মুঈনের ওপর। কিছুটা ধস্তাধস্তির পর মুঈনের হাত-পা আর মুখ শক্ত করে বেঁধে ফেলে রাখে এক পাশে। কিন্তু মুঈনের গোঙানি কমে নি।

ওদিকে বিকাশ হ্যামার নিয়ে আসে। নিজের সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করে সেই জায়গাটায়। বিকট এক শব্দে কেঁপে ওঠে ঘর। আরও একবার আঘাত করে।

এদিকে আকস্মিক বিকট শব্দে মেহুল আঁতকে উঠে। বুক ধকধক করে ওঠে ভয়ে। কোথা থেকে আসছে এই শব্দ। আতঙ্কে দু’হাত দিয়ে কান চেপে ধরে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। গলা শুকিয়ে গেছে ভয়ে। 

বিকাশ আরেকবার হ্যামার চালাতেই হঠাৎ করে মেঝেটা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভেঙে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে নিচ থেকে ধুলোর ঝাঁপটা উঠে আসে। বিকাশ আর শেরাজ এক ধাক্কায় পিছিয়ে যায় দু কদম। ধুলো একটু থিতু হতেই শেরাজ দু’কদম এগিয়ে নিচের দিকে তাকায়। দেখে—একটা সিঁড়ি, যেটা সরাসরি নিচে নেমে গেছে। আশেপাশে ক্ষীণ কৃত্রিম আলো জ্বলছে। শেরাজ মুঈনের দিকে তাকায় এ তো তার থেকেও সাংঘাতিক। শেরাজ এক মুহূর্ত দেরি না করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করে। পেছনে বিকাশ। নিচে নামতেই দেখে পাথরের দেয়ালে ঘেরা একটা সরু করিডোর। বাতাস ভারী, ভেতরে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। করিডোরের একদম শেষে একটা লোহার দরজা।

শেরাজ এক মুহূর্ত দেরি না করে দরজা খুলতেই দেখে মেহুল জড়োসড়ো অবস্থায় বসে আছে। মেহুল দরজা খোলার শব্দ শুনে সামনের দিকে তাকায়। শেরাজকে দেখে মেহুল থমকে যায়। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকে শেরাজের দিকে। যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না শেরাজ ভাই এখানে এসেছে। 

শেরাজ আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। মেহুলকে দেখে যেন প্রাণ ফিরে পেলো দেহে। কয়েকটা ঘন্টা যেন প্রাণ পাখিটা তার দেহ থেকে বহু দূরে ছিলো। মেহুলকে দেখার পর প্রাণ পাখিটা যেন ফিরে এলো। শেরাজ এক দৌড়ে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে মেহুলের সামনে। এক ঝাপটায় মেহুলকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে। কণ্ঠটা ভার হয়ে আসে, ঠোঁট কাঁপে...

“তুই ঠিক আছিস, মেহুল…”
 
মেহুলের শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে। চোখের পাতা ভারী, ভিড় জমায় চোখের পাতায় অন্ধকার। কিন্তু তারপরও মেহুল নিজেকে শক্ত করে রাখে। শেরাজ ভাই এসেছে গেছে তার এবার সে নিরাপদ। কেউ এখন আর‌ তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

শেরাজ মেহুলকে বুক থেকে সরিয়ে মুখটা দুই হাতের তালুতে আবদ্ধ করে কাঁপা কণ্ঠে বলল, “তুই জানিস আমি কতটা ভয় পেয়েছি… এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল তোকে হারিয়ে ফেললাম বুঝি।”

মেহুল নিস্তেজ গলায় বলল, “বাড়ি যাবো, শেরাজ ভাই… এখানে দম বন্ধ হয়ে আসছে।”

শেরাজ মেহুলের চোখে চোখ রাখল, “যাবি তো… এখানে আর এক মুহূর্তও থাকার কোনো দরকার নেই।”

বলেই এক ঝটকায় মেহুলকে কোলে তুলে নেয় শেরাজ। মেহুল কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে মাথাটা শেরাজের বুকে হেলিয়ে দেয়। শেরাজ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসে।

মুঈনের চোখ পড়ে মেহুলের ওপর। শেরাজের কোলে মেহুলকে দেখে তার চোখ বড় হয়ে যায়। গোঁ গোঁ করে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করে, কিন্তু হাত-পা, মুখ বাঁধা থাকার কারণে কিছু করে উঠতে পারে না। মেহুলেরও চোখ পড়ে মুঈনের দিকে। কিন্তু কোনো কথা বলে না, শুধু চুপচাপ তাকিয়ে থাকে।

শেরাজ এক মুহূর্ত না থেমে সোজা বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়ির দিকে যায়। গাড়ির দরজা খুলে মেহুলকে আস্তে করে বসিয়ে দেয়। তারপর মেহুলের কপালের চুল সরিয়ে কানে গুঁজে দিয়ে বলল, “তুই একটু বস, আমি আসছি।”
 
মেহুল শেরাজের কব্জি টেনে ধরে। কণ্ঠটা কেঁপে উঠে, “যেও না শেরাজ ভাই… খুব ভয় লাগছে আমার।”

শেরাজ মুচকি হেসে বলে, “একটু বস। একটা কথা রেখে আসি কথাটা না রাখলে, কথার বরখেলাপ হয়ে যাবে। আর এই শেরাজ মির্জা তার কথার বরখেলাপ করে না। ভয় পাবি না, তুই এখন নিরাপদ।”
 
শেরাজ কথাটা বলে চলে যায়। মেহুলের চোখে এক ধরনের শূন্যতা, বিষন্নতা ফুটে ওঠে। সে চুপচাপ শেরাজের চলে যাওয়ার পানে চেয়ে রইল। কানে বাজছে মুঈনের বলা কিছু কথা যা মাথার ভেতর গুঞ্জন তুলছে বারবার । মেহুল তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মাথাটা সিটে হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয় ভেসে উঠে মুঈনের সাথে থাকা একটা মুহূর্ত যেই মুহূর্তটা ছিলো শেরাজকে ঘিরে। 

মুঈন "চ" সূচক শব্দ উচ্চারণ করে ঠোঁটে বক্র হাসি টেনে বলল, “তোমার ওই শেরাজ ভাই, শালা একটা গভীর জলের মাছ। শালার চোখ মুখ দেখলেই বোঝা যায় ও তোমারে ভালোবাসে যাকে বলে খাঁটি ভালোবাসা।” 

মেহুল চমকে তাকাল মুঈনের দিকে। মুঈন মেহুলকে চমকে উঠতে দেখে হালকা হেসে বলল, “এতে এতো চমকানোর কী আছে, হ্যাঁ? কইসি না—শালায় একেবারে গভীর জলের মাছ তাই তো ধরতে পারো না তুমি। কিন্তু কথা হইল, ওয় তোমারে অন্য পোলার লগে বিয়ে দিতে রাজি হইলো ক্যামনে? আমি হলে তো বাড়িতে ঝড় তুলে দিতাম। সব তছনছ করে দিতাম।”

একটু থেমে চোখ সরু করে বলল, ”কিন্তু ও‌ একদম ঠাণ্ডা! ও কিভাবে এতটা শান্ত আছে? ওর পেটে পেটে নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে। কিন্তু এখন থাকলেও কোনো লাভ নেই কারণ কিছুক্ষণ পরেই তুমি আমার বউ‌ হতে চলেছো এই মুঈনের অর্ধাঙ্গিনী।” 

বলেই হাসতে শুরু করল। মেহুল কোনো কথা বলে না। নিঃশব্দে বসে থাকে আর ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকে মুঈনের দিকে। 

—————

শেরাজ ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মুঈনের সামনে দাঁড়াল। মুঈন মাটিতে লুটিয়ে আছে। মুঈন আগুন ঝরা চোখে তাকায় শেরাজের দিকে। শেরাজ বিকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোল ওকে। আর মুখের বাঁধন খুলে দে।”

বিকাশ মুঈনের কলার ধরে টেনে তুলে বসায়। মুঈন হাঁটু গেড়ে বসে। শেরাজ মুঈনের সামনে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে এসে মুঈনের মুখোমুখি বসল। বিকাশ মুঈনের মুখের বাঁধন খুলে দিতেই মুঈন গর্জে উঠল, “তুই কাজটা ঠিক করিস নি শেরাজ মির্জা। একদম ঠিক করিস নি।”

শেরাজ ভ্রু কুঁচকে বলল, “কোন কাজটা ঠিক করে নি শুনি? তুই উড়ে এসে জুড়ে বসবি, আর আমি চুপচাপ বসে দেখবো—এটা ভাবলি কি করে তুই?”

মুঈন তীব্র কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, “তুই নিজেই তো মেহুলকে অন্য কারো সাথে বিয়ে দিচ্ছিস!”

শেরাজ শান্ত গলায় বলল, “হ্যাঁ, দিচ্ছি। তাতে তোর সমস্যা কোথায়?”

মুঈন এক রকম ঝাঁঝিয়ে উঠল, “তাহলে সেই বিয়েটা আমার সঙ্গে হলে কী সমস্যা তোর?”

শেরাজ হেসে ফেলল—তাচ্ছিল্যের হাসি। চোখ ছোট ছোট করে মুঈনের দিকে একটু ঝুঁকে এসে বলল, “অনেক সমস্যা হতো রে মুঈন… অনেক।”

মুঈন উত্তেজিত গলায় বলল, “তাহলে আমার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দে আমি তোর সমস্যার সমাধান করে দেই!”

শেরাজ সোজা হয়ে গা ছমছমে স্বরে হেসে উঠল, “ও মা, তুই কি আমায় আহাম্মক ভেবেছিস নাকি যে তোর হাত-পায়ের বাঁধন খুলে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারব?”

মুঈন ঝাঁজালো চোখে তাকিয়ে বলল, “তোর সাহস থাকলে খুলে দে।”

শেরাজ ঘাড় কাঁত করে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “সত্যি কথা বলতে… আমার সাহস নাই রে মুঈন। আমি খুব ভীতু টাইপের একটা মানুষ। আমার মাঝে সাহসের "স" টাও নাই।”

শেরাজ একটু থেমে গলার স্বর আরও নিচু করল, “এসব সাহসের কথা বাদ দিয়ে এবার আসল কথায় আসি— কথা ছিল, মেহুলকে পাওয়ার পর… তোর এই সুন্দর, মসৃণ গলাটা কাটব?”

বলতে বলতেই শেরাজ মুঈনের গলায় হাত ছুঁইয়ে দিল। মুঈন শুকনো ঢোক গিলে বলল, “কি করতে চাইছিস তুই?”

শেরাজ ঠোঁটের কোণে নির্মম এক হাসি নিয়ে চু-সূচক শব্দ করে বলল, “বলতে ইচ্ছা করছে না…তবে হাতে-কলমে দেখাতে ইচ্ছা করছে।”

শেরাজ কথাটা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল। পকেট থেকে ধাতব ঝকঝকে একটা ছুরি বের করল। মুহূর্তের মধ্যে সেটা মুঈনের গলায় বসিয়ে দিল।

মুঈনের আর্তচিৎকার বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে। চোখ বড় বড় করে তাকায় শেরাজের দিকে। চোখে পানি টলটল করছে। শেরাজের এই‌ ভয়ানক কাজটা তার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। শেরাজ ঠোঁট বাঁকা করে হাসল। নাকের পাটা ফুলে উঠল। এরপর কোনো কথা না বলে এক পোঁচে ছুরিটা চালিয়ে দিল মুঈনের গলায়।

বিকাশ চোখ কুঁচকে মুখ ফিরিয়ে নিল অন্য দিকে। তাজা রক্ত ছিটকে এসে লাগল শেরাজের ধূসর শার্টে। মুঈনের শ্বাসনালি কেটে গেছে। মুঈন লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। গলা কাটা মুরগির মতো ধড়ফড় করতে শুরু করল। কিন্তু হাত-পা বাঁধা থাকার কারণে ছটফটানিটাও যেন কষ্টদায়ক হয়ে উঠল মুঈনের কাছে।

শেরাজ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সবটা দেখছে। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে অদ্ভুত এক তৃপ্তি। সাদা কার্পেট রক্তে ভিজে লাল হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে এল মুঈনের শরীর। প্রাণ পাখিটা একসময় উড়ে গেলো… কোনো এক অজানার দেশে।

শেরাজ হাঁটু ভেঙে বসল মুঈনের নিথর শরীরটার সামনে। মুঈনের দু চোখ খোলা—তাকিয়ে আছে ঠিক শেরাজের দিকেই। মুঈনের দেহে প্রাণ নেই, কিন্তু দু চোখে রয়ে গেছে শেষ মুহূর্তের ভয়। শেরাজ আপন মনে বলে উঠল। 

“বিয়ে করার খুব শখ ছিল না তোর, নে এবার মন প্রাণ ভরে বিয়ে-শাদী, হাঙ্গা-সাঙ্গা যা খুশি তাই কর কেউ বাঁধা দিবে না। তোর নতুন পথ চলার জন্য শুভকামনা রইল।”

শেরাজ র ক্তাক্ত ছুরিটা মুঈনের র ক্ত বিহীন শার্টের এক কোণায় মুছতে মুছতে বলল, “আমি আমার কথা রেখেছি। তোর গলার নলি কেটে, তোর জীবন এখানেই সমাপ্ত। উপরে গিয়ে নতুন জীবন উপভোগ কর।”

এই বলে উঠে দাঁড়াল। বিকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওর লা শটা কোনো হিং স্র জানো য়ারের মুখে ফেলে দিয়ে আয়। যাতে কোনো অস্তিত্ব না থাকে ওর‌ শরীরের কোনো অংশের।”

বলেই ছুরিটা বাড়িয়ে দিল বিকাশের হাতে। তারপর ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বিকাশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কিছু বলল না। শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মুঈনের র ক্তা ক্ত, নিস্তেজ শরীরটার দিকে।
 
—————

মেহুল চোখ বন্ধ করেই বসে ছিল। হঠাৎ গাড়ির দরজা খোলার শব্দে চোখ মেলে তাকাল। শেরাজ এসে ড্রাইভিং সিটে বসেছে। মেহুল তখনই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল শেরাজের দিকে, “মুঈনের সাথে কী করেছ তুমি?”

শেরাজ ভ্রু কুঁচকে তাকাল মেহুলের দিকে। মেহুল আবার বলল, “ওকে কি মে রে ফেলেছ তুমি?”

শেরাজ চোখ সরিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,
“হ্যাঁ। গলা কেটে দিয়েছি।”
 
মেহুল চমকে উঠল, “কিহ?”

শেরাজ নির্বিকারভাবে বলে, “হুম কথানুযায়ী এমনটাই হওয়ার কথা ছিলো।”

মেহুলের কণ্ঠ কাঁপছে, “তুমি সত্যি বলছো?”

শেরাজ নির্লিপ্ত স্বরে উত্তর দিল, “হুম এক অংশও মিথ্যা কথা নয়।”

মেহুল ধীরে বলে, “আমি... আমি দেখতে চাই।”

শেরাজ অবাক হয়ে বলল, “কাকে দেখবি?”

মেহুল এবার জোর গলায় বলল, “মুঈনকে।”

শেরাজ তীক্ষ্ণভাবে বলে, “আমার কথা বিশ্বাস হয় না তোর?”
 
মেহুল কিছু না বলে গাড়ির দরজা খুলে নামতে নিলে। শেরাজ মেহুলের কব্জি শক্ত করে চেপে ধরে, “কোথায় যাচ্ছিস?” 

মেহুল ঘুরে তাকিয়ে বলে, “আমি মুঈনকে দেখতে চাই ঠিক কেমন অবস্থায় আছে ও।”
 
শেরাজ গম্ভীর গলায় বলে, “তুই সহ্য করতে পারবি না, মেহুল।”
 
মেহুল কিছু একটা বলতে যাবে, তখনই তার চোখ পড়ে শেরাজের শার্টের উপর। রক্তের দাগ। শুকিয়ে গেছে। চোখ বিস্ফোরিত হয়ে যায় মেহুলের। অবিশ্বাসে চোখে চেয়ে বলে, “তুমি সত্যি... মুঈনের গলা কেটে দিয়েছো?” 

শেরাজ জবাব দেয় একদম ভাবলেশহীন কণ্ঠে, “হ্যাঁ।”

“কেন?” মেহুল প্রশ্ন করে কাঁপা কাঁপা গলায়।

শেরাজ নিরুত্তাপভাবে বলে, “এটাই কথা ছিল আমাদের মাঝে আর কত বার বলব তোকে এই কথাটা।”

মেহুল ধরা গলায় বলল, “তুমি একজন খুনি, শেরাজ ভাই।”
 
শেরাজ চোখ তুলে তাকায় মেহুলের দিকে, গলায় হিমশীতল ধ্বনি, “হ্যাঁ, আমি খুনি। আর যদি খুনির পরে কোনো নিকৃষ্ট পরিচয় থেকে থাকে, তাহলে সেই পরিচয়টাও আমার।” 

মেহুল দম বন্ধকর গলায় বলল, “তুমি এভাবে নিজের হাত‌ দিয়ে মানুষের রক্ত ঝরাচ্ছো কেন?”

শেরাজ গম্ভীর স্বরে বলে, “ভালোবাসায় যদি রক্ত নাই ঝরাই, তাহলে সেই ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে কী করে?”

মেহুল থমকে যায়, “মানে?”

শেরাজ কঠিন কণ্ঠে বলে, “কিছু না। দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত যা যা হয়েছে সব ভুলে যা। বাড়ি গিয়ে এমন ভাব করবি যেন কিছুই ঘটে নি। বাড়ির কেউ যেন কিছু জানতে না পারে। বাড়ি গিয়ে বিয়ের জন্য নিজেকে তৈরি কর।” 

মেহুল নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, “আমি যদি বাড়ি না গিয়ে থানায় যাই।”

শেরাজ চমকে উঠে, “মানে।”

“তোমার নামে যদি আমি থানায় গিয়ে অভিযোগ করি তাহলে তুমি কি করবে শেরাজ ভাই.... পালিয়ে যাবে?”

শেরাজ এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, “যদি তুই অভিযোগ করিস তাহলে আমি হাসতে হাসতে পুলিশের কাছে নিজে থেকে গিয়ে আত্মসমর্পণ করব কথা দিলাম।”

কিন্তু শেরাজ মন প্রাণে জানে আর যাই হোক মেহুল পুলিশের কাছে যাবে না। মেহুল এবার গলা একটু কোমল করে জিজ্ঞেস করে, “তুমি ঠিক কী চাও, শেরাজ ভাই? আমায় স্পষ্ট করে একটু বলবে?”
 
শেরাজ সামনের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি কী চাই, সেটা বোঝার মতো ক্ষমতা হয়তো এখনও তোর হয় নি।”

মেহুল কিছু বলতে নিলে শেরাজ কড়া গলায় থামিয়ে দেয়, “আর একটাও শব্দ নয়।” 

বলেই গাড়ি স্টার্ট দেয়। গাড়ি চলতে শুরু করে তার আপন গতিতে।
·
·
·
চলবে..................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp