বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হতে চলল। ভয়ংকরভাবে ঝড়ো হাওয়া বইছে। জানালার কপাটগুলো বারি খাচ্ছে বারবার। এবছর বৈশাখ আসার আগেই কালবৈশাখী শুরু হয়ে গিয়েছে। অনন্যা চিৎকার করে বলল,
“অদ্রি, অর্পি দৌড় দিয়ে সব ঘরের জানালাগুলো বন্ধ কর।”
“যাচ্ছি মা।”
তারপর অনন্যা ছাদে চলে গেল কাপড় আনতে। অদ্রি দাদা-দাদুর ঘরে আর অর্পি লাইব্রেরি ঘরে জানালা বন্ধ করতে গেল। এই লাইব্রেরিটা বানিয়েছে বড় চাচ্চু। সব ধরনের বই আছে এখানে। তিন দিকের দেয়ালে তিনটি বইয়ের আলমারি, আর একটি দেয়ালে ঘরে ঢোকার দরজা আর একটি বড় টেবিল আর দুটি চেয়ার। অর্পি ছাড়া আর কারোরই বই পড়ার নেশা নেই, অদ্রি মাঝে মাঝে পড়ে কিন্তু নেশা নয়। তবে এই ঘরে অর্পির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো তালা দেয়া আলমারিটি। এখানকার ঐ একটি আলমারিই তালা দেয়া। ১৮ বছর হওয়ার আগে অর্পি ঐ বইগুলো পড়ার অনুমতি পাবে না।
লাইব্রেরিতে ঢুকতে গিয়েই দেখল বড় চাচ্চু টেবিলে বসে কিছু লিখছে। চাচ্চু একটু অন্য ধাঁচের মানুষ। বয়স ৪১/৪২-এর মতো হবে। কম কথা বলে, গম্ভীর আর প্রচণ্ড রাগী। নামটাও তেমন, নীরব! কেন যেন সবাই একটু ভয় পায় তাকে। দাদুর মুখে শুনেছে বড় চাচ্চু যেমন চুপচাপ তেমনি রাগলে নাকি মারাত্মক। কিন্তু ব্যাপারটা আজও বোঝাই হয়নি, কারণ ওরা কখনো সেরকম কিছু দেখেনি। চাচ্চু খুব বড় ডাক্তার, বাসায় থাকেই না বলতে গেলে। সকালে বেরিয়ে যায় আর রাতে ফেরে। তো বাসায় থাকলে না রাগারাগি করবে আর ওরা দেখবে।
আজ ছুটির দিন তাই চাচ্চু বাসায়, মাঝে মাঝে অবশ্য ছুটির দিনেও থাকে না। অর্পির বাবা সৌরভও ডাক্তার, তবে এমন রসকষহীন না, বাবা খুব মজার। ভাগ্যিস চাচ্চু ওর বাবা না। তাহলে যে কী হতো! আহারে দিহানটা ওর বাবাকে একটুও কাছে পায় না। অর্পিকে দেখেই চাচ্চু বলল,
“অৰ্পি কিছু বলবে?”
“না মানে চাচ্চু…আসলে আম্মু পাঠিয়েছে জানালা বন্ধ করার জন্য।”
“তাহলে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ভেতরে এসো।”
ভেতরে ঢুকে অর্পি জিজ্ঞেস করল,
“চাচ্চু, জানালাগুলো বন্ধ করব?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, বন্ধ করে দাও।”
জানালা বন্ধ করতে লাগল অর্পি। দিহান ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,
“বাবা, দাদা তোমাকে ডাকছে।”
“কেন?”
“ঠিক জানি না।”
“আচ্ছা চলো, যাচ্ছি।”
নীরব আর দিহান বেরিয়ে গেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল অর্পি। ও প্রতিবারই ভাবে, ধুর এত ভয় পাওয়ার কী আছে? চাচ্চু মোটেই ভয়ংকর না, তবু কেন যেন সামনে এলেই ভয় লাগে। জানালা বন্ধ করে ফেরার সময় টেবিলে একটা ডায়েরির ওপর চোখ পড়ল অর্পির। বাহ ডায়েরিটা কী সুন্দর! নীল রঙের মলাট! নীল খুব প্রিয় অর্পির। কাছে গিয়ে দেখল ডায়েরিতে বাবার হসপিটালের লোগো! তার মানে এটা ওর বাবার হসপিটালের ডায়েরি! এত সুন্দর ডায়েরিটা বাবা ওকে দেয়নি কেন? ভেতরটা দেখার জন্য ডায়েরিটা খুললো অর্পি। এরপর উদ্দেশ্যহীনভাবেই প্রথম পাতার লেখাটায় চোখ চলে গেল…
—————
ছোটবেলা থেকে এক ছাদের নিচে থাকতে থাকতে কবে থেকে যে দুজন দুজনকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম তা বলতে পারব না। প্রথমে কেউই ভালোবাসি কথাটি বলিনি কিন্তু তবু এই না বলা কথাটি আমরা দুজনেই হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম।
কী দিন ছিল! সবসময় একজন আরেকজনের পেছনে লেগে থাকতাম। মারামারি করতাম, দুষ্টুমি করতাম, আরো কত কী! তবে ভালোবাসতাম প্রচণ্ড, দুজনেই। ওর গায়ের রঙ কালো ছিল, সেজন্য খুব দুঃখও ছিল তার। কিন্তু ওর মুখে ছিল একটা অদ্ভুত মায়া। সেই মায়া মায়া চেহারাটাই আমাকে শেষ করে চলে গেছে।
আচ্ছা ও কি ভালো আছে আমাকে ছাড়া? ও কি ভুলতে পেরেছে আমাকে? সত্যিই কি আমার কোনো খোঁজখবর কি রাখে না ও? কই আমি তো এত বছরেও ভুলতে পারিনি। ওর স্মৃতিগুলো আমাকে এখনো পোড়ায়। টুকরো টুকরো এই স্মৃতিগুলো তো কোনো শাসন মানে না। মানে না কোনো নিয়ম
নীরব ইশতিয়াক
৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
দাদা-দাদুর ঘরের জানালা বন্ধ করে অদ্রি নিজেদের ঘরের জানালা বন্ধ করল। তারপর বাবা-মার ঘরে গিয়ে দেখল সেখানকার জানালাগুলোও খোলা, বন্ধ করতে করতে ভাবলো, অর্পি সেই যে লাইব্রেরিতে জানালা লাগাতে গেল, ও কি এখনো ওখানে এতক্ষণ ধরে? তারপর চাচ্চুর ঘরের জানালা বন্ধ করে দিহানের রুমের জানালা বন্ধ করল। তারপর রান্নাঘরের জানাল বন্ধ করতে গেল। দিতিয়া চাচি কী যেন রান্না করছে। ওকে দেখেই হেসে বলল,
“রান্নাঘরের জানালা আমি বন্ধ করে দিয়েছি।”
“ও, তুমি কী বানাচ্ছ চাচি?”
“উমম, আজকে আমি তোর পছন্দের নাস্তা বানাচ্ছি।”
“কী?”
আগ্রহ নিয়ে বলল অদ্রি। দিতিয়া বলল,
“নাগেট।”
“ওহ গ্রেট! হতে কতক্ষণ লাগবে?”
“এই তো হয়ে যাবে। আর একটু অপেক্ষা কর?”
“আচ্ছা।”
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে অর্পির খোঁজে লাইব্রেরিতে ঢুকল অদ্রি। দেখল অর্পি একটা ডায়েরি হাতে নিয়ে পড়ছিল, কেউ আসছে ভেবে লুকিয়ে ফেলেছিল। ওকে দেখেই আবার বের করল। বলল,
“আপ্পি তুই? আমি আরো ভাবলাম কে না কে!”
“ভয় পেয়ে লুকিয়ে ফেলেছিলি কেন? এটা কার ডায়েরি? কী লেখা?”
অর্পি ফিসফিসিয়ে বলল,
“আপ্পি, এটা বড় চাচ্চুর ডায়েরি।”
আঁৎকে উঠল অদ্রি,
“তোর তো সাহস কম না, বড় চাচ্চুর জিনিস ধরেছিস!”
“এটা শুধু জিনিস না, গোপন জিনিস।”
দুষ্ট হাসি দিল অৰ্পি। অদ্রি বলল,
“গোপন জিনিস মানে?”
“চাচ্চুর লাভ স্টোরি।”
“কী বলছিস?”
“ঠিক বলছি।”
“লাভ স্টোরি হলে তো লুকিয়ে রাখত। কোথায় পেয়েছিস এটা?”
“একটু আগে চাচ্চু এখানে ছিল না? তখন বোধহয় লিখছিল, কিংবা আগের লেখা পড়ছিল। দাদা ডাকতেই টেবিলের ওপর রেখে চলে গেছে।”
“তার মানে আবার আসবে, এক্ষুনি রেখে দে বলছি।”
“না আপ্পি, প্লিজ। বাকিটা না পড়লে আমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে। কী ইন্টারেস্টিং স্টোরি না পড়লে বুঝবি না। আর চাচ্চু কী সুন্দর করে যে লিখেছে!”
“এক থাপ্পড় দিয়ে তোর দাঁতগুলো সব ফেলে দেব, অসভ্য মেয়ে কোথাকার! লুকিয়ে লুকিয়ে বড়দের ডায়েরি পড়া হচ্ছে?”
“উফ তুই না বড্ড ভিতু রে আপ্পি। তোকে না জানিয়ে লুকিয়ে পড়া উচিত ছিল।”
“তাই তো করছিলি।”
“নারে আপ্পি, পরে তো তোকে বলতামই। তোকে কিছু না বলে কি আমি থাকতে পারি? পেট ফেটে মারা যাব না?”
এমন সময় দিতিয়ার গলা পাওয়া গেল,
“অদ্রি, অৰ্পি, দিহান নাস্তা রেডি। তোরা কোথায়?”
অর্পি সাথে সাথে ডায়েরিটা যেভাবে রাখা ছিল সেভাবে রেখে বলল,
“আচ্ছা চল আপ্পি।”
—————
সন্ধ্যার পর অর্পি পড়তে বসেছে, ও ক্লাস টেনে পড়ে। আর অদ্রি এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। অদ্রির পড়া না থাকলেও অর্পির পাশে বসে থাকতে হয় তা না হলে ও পড়ে না। তাই একটা গল্পের বই নিয়ে বসেছে অদ্রি। অৰ্পি পড়তে পড়তেই হঠাৎ বলে উঠল,
“আপ্পি, চাচ্চু মেয়েটাকে অনেক ভালোবাসত।”
“তুই ভালোবাসার কী বুঝিস?”
“না বোঝার কী আছে? আমার এখন ১৫ বছর। আমার ক্লাসের সব মেয়েরা প্রেম করে, তুই জানিস?”
“প্রেম আরো ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও করে যারা ভালোবাসা বোঝে না।”
করতে পারে, কিন্তু আমি বুঝি।”
“ঘোড়ার ডিম বুঝিস তুই, বউ আছে বাচ্চা আছে সে নাকি অন্য কাউকে ভালোবাসবে, তাও আবার সে কে? সে বড় চাচ্চু।”
“হ্যাঁ আমি মানছি বড় চাচ্চু একটু অন্যরকম। কিন্তু তাই বলে তার মনে প্রেম থাকতে পারবে না তা তো নয়।”
“হয়তো দিতিয়া চাচির কথাই লিখেছে।”
“না আপ্পি, চাচির কথা না। কারণ যার কথা লিখেছে সে কালো, চাচি তো ফরসা। এত ফরসা যে লাল দেখায়। তাছাড়া যার কথা লিখেছে সে চাচ্চুকে ছেড়ে চলে গেছে।”
“এসব লিখেছে?”
“হ্যাঁ।”
“আর সেটা পড়ার জন্য তুই মরে যাচ্ছিস?”
“আপ্পি তুই পড়লে বুঝবি। আর সবচেয়ে বেশি পড়তে ইচ্ছে করছে মেয়েটা কে ছিল তা জানার জন্য। কারণ ঐ মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই এই বাসায় থাকত।”
“কী বলছিস? এই বাসায় এমন কে ছিল?”
“জানি না, আচ্ছা আপ্পি আমরা যদি দাদুকে জিজ্ঞেস করি?”
“নাহ, খবরদার। এই ভুল করা যাবে না। মা জানতে পারলে মেরে ফেলবে।”
“কিন্তু আপ্পি আমি মাত্র এক পাতা পড়ছি, পুরোটা না পড়লে তো শান্তি নেই। পুরোটা কোথায় পাব? চাচ্চু ওটা কোথায় রাখবে তা তো জানি না। আর মেয়েটা কে ছিল জানতে না পাড়লে আমার পেটের মধ্যে গুড়গুড় করবে।”
“আচ্ছা কী করা যায় আমি চিন্তা করে দেখছি। তুই ততক্ষণে হোমওয়ার্কগুলো করে ফেল, নাহলে কাল স্কুলে মার খাবি।”
“আচ্ছা করছি, কিন্তু…”
“আর কোনো কথা না, এখন হোমওয়ার্ক কর।”
অর্পি আবার হোমওয়ার্ক করতে শুরু করল, কিন্তু মন পড়ে রইল নীল মলাটের ডায়েরিটায়।
·
·
·
চলবে..........................................................................