মিটিং রুম। আপাতত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কনফারেন্স চলছে বদ্ধ এই ঘরে। যার দায়িত্ব পালন করছে শেরাজ। শেরাজ দেশের বাইরে থেকে আগত বিজনেস পার্টনারদের প্রজেক্টের সমস্ত বিষয় বস্তু তুলে ধরছে। কোনটা করলে উভয়পক্ষের কোম্পানির লাভ হবে কোনটা করলে উভয়পক্ষের কোম্পানি লস হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
মিটিং রুমে সবার ফোন সাইলেন্ট। শেরাজের ফোনও সাইলেন্ট কিন্তু কেউ বার বার কল করে যাচ্ছে তাকে। ফোন সাইলেন্ট হওয়ার কারণে শেরাজের ফোনের দিকে নজর নেই। শেরাজ পুরো মনোযোগ দিয়ে কথা বলছে, হঠাৎই তার চোখ গিয়ে পড়ে টেবিলের ওপর রাখা ফোনটার দিকে। স্ক্রিনে বারবার আলো জ্বলে উঠছে। ভেসে উঠেছে একটা নাম—“বিকাশ”।
নামটা দেখা মাত্রই শেরাজের মুখ থমকে গেল। একটুও সময় নষ্ট না করে ফোনটা হাতে তুলে কল রিসিভ করল। কানে নিতেই ভেসে এলো বিকাশের উত্তপ্ত কণ্ঠ, "স্যার... ম্যাডাম কিডন্যাপ হয়েছে!"
শেরাজের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, "আসছি আমি।"
তারপর এক ঝটকায় ফোন পকেটে ঢুকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়তে নিলে ইহসান মির্জা চেয়ারে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলেন, "রাজ! কোথায় যাচ্ছো তুমি এইভাবে?"
কিন্তু শেরাজ থামল না। দরজা খুলে সে কনফারেন্স রুম থেকে বেরিয়ে গেল একটুও পিছন ফিরে তাকায় নি। রুমের সবাই নির্বাক। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে একে একে চোখের ভাষায় বিস্ময় প্রকাশ করতে শুরু করল। ইহসান মির্জা নিজেকে সামলে নিয়ে সবার দিকে ক্ষমাসরূপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, "সরি আমার ছেলের হয়ে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। নিশ্চয়ই কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে গেছে তাই এভাবে চলে যেতে হয়েছে।"
—————
মেহুল পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। অচেনা ঘর, অজানা জায়গা। মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে—মনে হচ্ছে রগগুলো যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। দু'হাতে চেপে ধরে মাথা, উঠতে গিয়েও পারছে না মাথা ভার হয়ে আছে। তবুও নিজেকে সামলে ধীরে ধীরে উঠে বসে। ঝাপসা চোখে চারপাশটা ভালো করে দেখে।
ঘরটা বেশ বড়—কিন্তু তেমন কিছু নেই একটা বিছানা, একটা টেবিল, চেয়ার আর একটা আলমারি শুধু। দেয়াল থেকে বালু, সিমেন্ট খসে পড়েছে। কোথায় আছে সে, কিছুই বুঝতে পারছে না। চোখে চশমা নেই, যদিও এখন চশমা ছাড়া ভালোই দেখতে পারে, কিন্তু চোখে প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। চশমাটা দরকার।
মেহুল বিছানার চারপাশ হাতড়ে খুঁজতে থাকে চশমাটা, কিন্তু চশমার অস্তিত্ব নেই। ঠিক তখনই একটা কণ্ঠ ভেসে আসে, "এটা খুঁজছো মেহু পাখি?"
মেহুল চমকে উঠে সামনে ফিরে তাকায়। মুঈন দাঁড়িয়ে আছে ঠোঁটে বাঁকা হাসি নিয়ে। তার হাতে মেহুলের চশমা। মেহুল শুকনো ঢোক গিলে কম্পিত কণ্ঠে বলল, "কি চান আপনি? আমাকে এখানে এনেছেন কেন?"
মুঈন ঠোঁট বাঁকিয়ে মেহুলের দিকে এগোতে থাকে, "শান্ত থাকো মেহু পাখি, এত উত্তেজিত হয়ো না। তোমার কিছু হলে আমার কি হবে বলো তো?"
মেহুল বিছানার ওপর হাত ভর দিয়ে ধীরে ধীরে পেছাতে থাকে, "কাছে আসবেন না একদম আমার।"
মুঈনের চোখ জ্বলে ওঠে, "আমি আসবো না তো কে আসবে? ওই শেরাজ মির্জা আসবে? নাকি তোমার ওই হবু স্বামী আসবে তোমার কাছে?"
মেহুল পেছাতে পেছাতে গিয়ে পিঠ ঠেকে বিছানার মাথার সাথে। মুঈন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। মেহুল ভয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে মুখ ফিরিয়ে নেয় অন্য দিকে। ভয়ে তার হৃদস্পন্দন দ্রুত চলছে। এর কিছু মুহূর্ত পরেই টের পায়, মুঈন তার চোখে চশমা পরিয়ে দিচ্ছে। চোখ মেলে তাকায় মেহুল। মুঈন তার মুখোমুখি বসে আছে, ঠোঁটে তার সেই পরিচিত হাসি।
মেহুল কাঁপা কাঁপা গলায় ঢোক গিলল। মুঈন মেহুলের চুলে হাত ছুঁয়ে বলল, "চশমাটা পড়িয়ে দিলাম। জানো মেহুপাখি, তোমায় চশমা পরলে এত সুন্দর লাগে—যা কল্পনারও বাহিরে আমার। তুমি এত সুন্দর কেন বলো তো? তোমার এই রেশমি ঘন চুল, লালচে ঠোঁট, উঁচু নাক, গোল গোল চোখ, ফোলা ফোলা লাল গাল দুটো—আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না। তোমার এই রূপে আমি বারবার হারিয়ে যাই অতল সাগরে।"
মেহুল মুহূর্তেই চিৎকার করে উঠল, "চুপ করুন আপনি!"
মুঈন হেসে বলল, "তুমি যদি বলো, আমি সারা জীবনের জন্য বোবা হয়ে যেতে পারি—যদি তুমি আমার সাথে থাকো সারাটা জীবন তাহলে।"
মেহুল মুঈনের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে কড়া কণ্ঠে বলল, "কি চান আপনি?"
মুঈন ঠোঁটে হাসি রেখে, "তোমায় চাই, সারা জীবনের জন্য।"
মেহুল থমকে বলল, "মানে?"
মুঈন কণ্ঠে আবেগ মিশিয়ে বলল, "ভালোবাসি তোমায়—সেই দু’বছর ধরে। তোমায় প্রথম দেখেছিলাম এক বৃষ্টিস্নাত বিকেলে। তখনই ভালোবেসে ফেলি। তারপর থেকে সবার অজান্তে, তোমার অগোচরে কাছাকাছি ছিলাম সবসময়।"
মেহুল বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে মুঈনের দিকে। মুঈন নড়েচড়ে বসল, "আচ্ছা মেহুল, তোমার মনে আছে সেই ছেলেটার কথা যেই ছেলেটা তোমার গালে পহেলা বৈশাখের দিন রং লাগিয়েছিল?"
মেহুল কোনো জবাব দিল না, চুপচাপ বসে রইল। মুঈন হেসে লজ্জা পাওয়ার ভান ধরে বলল, "ওইটা আমি ছিলাম।"
মেহুল বার কয়েক চোখের পলক ফেলে তাকাল মুঈনের দিকে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল, "ওইটা আপনি ছিলেন?"
"হুম, আমি। এবার এটা বলো তো, তোমায় আমি কিডন্যাপ কিসের জন্য করেছি?" মুঈনের কণ্ঠ নরম অথচ ভয় ধরানো।
মেহুল নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল, "প্লিজ, আমায় যেতে দিন... সবাই আমার খোঁজ করবে।"
মুঈন হেসে বলল, "যাবে তো... তবে একা নয়, জোড়া হয়ে যাবে।"
মেহুল বিস্ময়ে বলল, "মানে?"
মুঈন কণ্ঠ শক্ত করে বলল, "মানে, আজ আমাদের বিয়ে হবে।"
মেহুল চমকে উঠে, "কি বলছেন আপনি এসব?"
"হুম, কাজী হয়তো একটু পরেই চলে আসবে।"
"আমি আপনাকে কিছুতেই বিয়ে করব না!" —চেঁচিয়ে উঠল মেহুল।
মুঈন শান্তভাবে বলল, "সেটা তো সময় বলবে—তোমার বিয়ে কার সঙ্গে হবে! তবে মনে হচ্ছে বিয়েটা আমার সঙ্গেই হবে তোমার কারণ তুমি এখন আমার আস্তানায়। আচ্ছা তুমি কিছু খাবে? খিদে লাগে নি তোমার?"
মেহুল অনুনয় ভরা গলায় বলল, "আমি কিছু খাব না। প্লিজ, আমায় শুধু যেতে দিন।"
এই বার মুঈনের ধৈর্য ভেঙে গেল। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল, "একটা কথা কতবার বলব তোমায়! তুমি এখান থেকে যাবে, তবে আমার স্ত্রী হয়ে যাবে। তাই চুপচাপ ভালো মেয়ের মতো বসে থাকো।"
মেহুল মুঈনের চিৎকার শুনে ভয়ে কুঁকড়ে যায়। মুঈন নিজেকে সামলে ঠোঁটের কোণে হাসি এনে মেহুলের দিকে ঝুঁকে আসে। মেহুল চোখ মুখ খিঁচে নেয়। মুঈন মেহুলের এলোমেলো চুল গুলো যত্নসহকারে তর্জনী দিয়ে কানে গুঁজে দিয়ে ফিসফিস করে বলল।
"আমায় রাগিও না মেহুপাখি। তোমার উপর রাগ দেখাতে আমার একটুও ভালো লাগবে না। তবে এটা খুব ভালো লাগবে তোমায় আদর-সোহাগ করতে।"
মেহুল চমকে তাকায় মুঈনের দিকে। মুঈন মুচকি হেসে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, "এই কাজী পাজিকে নিয়ে আসতে এত লেইট করছে কেন রবিটা? এতক্ষণে তো চলে আসার কথা!"
এই কথা বলে সে দরজা খুলে অন্য এক রুমে চলে গেল। মেহুল দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। কি হচ্ছে এসব তার সাথে? কে কোথা থেকে তার জীবনে হুট করে চলে আসে তা সে বুঝতেই পারে না। তার জীবন যেন তার নিয়ন্ত্রণে নয় বরং অন্য কারো নিয়ন্ত্রণে চলচ্ছে। আজ তার বাবা-মা যদি বেঁচে থাকলে তাহলে হয়তো তার জীবনটা অন্য রকম হতো অন্য এক দুনিয়া হতো তার। বাবা-মা না থাকার কষ্টটা মেহুল প্রতিনিয়ত ভুগে যাচ্ছে। বাবা-মা মানেই পৃথিবীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয়ের স্থান। অথচ সেই স্থানটুকু মেহুলের নেই সেই পাঁচ বছর বয়সের পর থেকে। মেহুলের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে কয়েক ফোঁটা নোনাজল। এখন সে কী করবে? কে বাঁচাবে তাকে এখান থেকে? শেরাজ ভাই কি জানে, সে এখানে আছে যে? যদি জানত—তাহলে তো এতক্ষণে চলে আসতো তাকে বাঁচাতে।
—————
শেরাজ যতটা সম্ভব হাই স্পিডে গাড়ি চালিয়ে গন্তব্যে এসে পৌঁছাল। চারপাশ ঘন জঙ্গলে ঘেরা, বড় বড় গাছগুলো তার শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে রেখেছে চারদিকে। সূর্যের আলো ভেতরে আসা যেন দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সচরাচর এখানে কেউ আসে না আর যারা আসে তারা মূলত সন্ত্রাসী বা অপরাধীচক্রের লোকজন। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে সরু একটা রাস্তা বয়ে গেছে।
শেরাজ গাড়ি থেকে নেমে এল একদম ঠান্ডা আর স্থির মেজাজে। চোখে মুখে কোনো উত্তেজনা নেই, যেন কিছুই হয় নি। বিকাশ শেরাজের গাড়ি দেখা মাত্রই দৌড়ে শেরাজের কাছে এসে দাঁড়াল বলল, "স্যার, ম্যাডামকে একটু দূরের একটা বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছে।"
শেরাজ শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, "বাড়িটার ভেতরে কয়জন আছে?"
"স্যার, একজনই আছে" — জবাব দিল বিকাশ।
শেরাজ কৌতূহলী ভঙ্গিতে বলল, "অনলি একজন! জা নো য়ারের বাচ্চার কলিজা আছে বলতে হবে! একাই একটা মেয়েকে কিডন্যাপ করে এনেছে? কলিজাটা মেপে দেখতে হয় তো কতো কেজি ওজন! কিন্তু মেহুলকে ওই পোলা কিডন্যাপ করল কেন?"
বিকাশ নিচু গলায় বলল, "স্যার, যে কিডন্যাপ করেছে সে ম্যাডামকে বিয়ে করতে চায়।"
শেরাজ কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। বরং কণ্ঠ আরও ঠান্ডা হয়ে উঠল, "বিয়ে করতে চায়! এত শখ বিয়ে করার!"
বিকাশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। শেরাজের এমন শান্ত রূপ শেরাজের চেনা অশান্ত রূপের থেকেও ভয়ংকর লাগছে তার কাছে। কি চলছে শেরাজের মাথায়? কি করতে চাইছে কি?
শেরাজ হুকুমের সুরে বলল, "চল, ওর বিয়ে পড়িয়ে দিয়ে আসি। আজ এক দিনের জন্য আমি কাজী।"
বিকাশ একটু ভয়ে ভয়ে বলল, "স্যার, আসলে… কাজী আছে।"
শেরাজ দুই ভ্রু উঁচু করে তাকিয়ে বলল, "কাজী আছে? কোথায়?"
বিকাশ জবাব দিল, "গাড়িতে। আসলে যে কিডন্যাপ করেছে, তার সঙ্গে একজন সঙ্গী ছিল, সে-ই কাজীকে এনেছে এখানে আর তখনই ওদেরকে ধরে সবকিছু জানতে পারি।"
শেরাজ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, "কাজী আর ওই জা নো য়ারের বাচ্চার সঙ্গীটাকে নিয়ে আয়।"
বিকাশ সঙ্গে সঙ্গে সিএনজি চালক আর কাজী সাহেবকে নিয়ে এল গাড়ি থেকে। এদিকে শেরাজ ইতিমধ্যে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছে। কালচে ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট রেখে তার নিকোটিন টেনে নিয়ে উঁড়িয়ে দিচ্ছে তার ধোঁয়া বাতাসের সাথে।
কাজী সাহেব ভীত কণ্ঠে হাত জোড় করে বলল, "বাবা, আমায় ছেড়ে দাও। আমার কোনো দোষ নাই। জোর করে ধরে এনেছে আমাকে এই ভয়ানক জায়গায়। আমি তো আসতেই চাই নি।"
শেরাজ জলন্ত সিগারেটটা তর্জনী আর বুড়ো আঙুলে ঘুরাতে ঘুরাতে ঠান্ডা গলায় বলল, "চাচা আপনি এতো হাইপার হইয়েন না। এই বুড়ো বয়সে বেশি উত্তেজনা ভালো না বিপি বাড়তে পারে। তাই শান্ত থাকুন।"
তারপর বিকাশকে উদ্দেশ্য করে বলল, "চাচাকে গাড়িতে তুলে, সসম্মানে ওনার বাসায় নামিয়ে দিয়ে আয়। ভবিষ্যতে চাচাকে আমার কাজে লাগতে পারেন।"
বিকাশ ইশারা করতেই পাশের একটা ছেলে এগিয়ে এসে কাজী সাহেবকে ধরে নিয়ে গেল। শেরাজ এগিয়ে এল সিএনজি চালকের কাছে। সিএনজি চালক মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। শেরাজ সিগারেট টেনে ধোঁয়াটা সিএনজি চালকের মুখের ওপর ছুড়ে দেয়। সিএনজি চালক চোখ-মুখ কুঁচকে নেয় ভয় আর অস্বস্তিতে।
শেরাজ বাম হাত দিয়ে সিএনজি চালকের মুখটা চেপে ধরে উপরে তুলে, দাঁত চেপে বলল, "প্রাণ হারানোর ভয় নিশ্চয়ই আছে তোর মনের ভেতরে তাই না?"
সিএনজি চালক মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। শেরাজ বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, "ঠিক আছে, তাহলে যা বলব তাই করবি। তবে অপরাধ করেছিস তার শাস্তি তো পেতেই হবে তোকে সোনা।"
বলেই কোনো সময় না নিয়ে জলন্ত সিগারেটটা সিএনজি চালকের বাম চোখের পাশে চেপে ধরে। সিএনজি চালক ব্যথায় ছটফট করে চিৎকার করে ওঠে, কিন্তু শেরাজ শক্ত করে পেছন দিক থেকে মাথাটা চেপে ধরে সিগারেটটা কিছুক্ষণ চোখের পাশেই চেপে ধরে রাখে চোখ মুখ শক্ত করে। শেরাজ শান্ত হয়ে এলে সিএনজি চালককে ছেড়ে দেয়। সিএনজি চালক যন্ত্রণায় কাতর হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
শেরাজ হুকুমের সুরে বলল, "বিকাশ, তোল ওকে।"
বিকাশ টেনে তুলে দাঁড় করায় সিএনজি চালককে। শেরাজ এবার ঠাণ্ডা গলায় বলল,"চল, এবার ওই কু ত্তার বাচ্চার বিয়ের স্বাদ মিটাই গিয়া। ওর বিয়ের স্বাদ আমি ওর কোথা দিয়ে বের করব তা আমি নিজেও জানি না।"
—————
মুঈন বারবার একটা নম্বরে কল করে যাচ্ছে, কিন্তু ফোন বন্ধ। একসময় রাগে মুখে অশ্রাব্য গালি ছুঁড়ে দিয়ে চেয়ারে লাথি মারে। চেয়ারটা শব্দ করে নিচে পড়ে যায়। তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়। মুঈন থমকে যায়, নিজেকে সামলে জিজ্ঞেস করে, "কে?"
বাহির থেকে ভেসে আসে, "ভাই, আমি বিলাল। কাজী নিয়া আসছি।"
মুঈনের মুখে হাসি খেলে যায়, তার সাথে ফুটে উঠে চোখমুখে উজ্জ্বলতা। মুঈন দরজার দিকে এগিয়ে এসে বলে, "এত দেরি করলি কেন?"
দরজা খুলতেই থমকে যায় মুঈন বিলালের চোখের কোণা এমন আগুণে ঝলসানো দেখে। মুঈন চিন্তিত কণ্ঠে বল, "চোখে কি হইছে? আর কাজী কই?"
ঠিক তখনই দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে শেরাজ বলে ওঠে, "আই এম হিয়ার।"
মুঈনের চোখ ছানাবড়া—শেরাজ এখানে দেখে? মুঈন বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, "এ এখানে কি করছে?"
শেরাজ হাসিমুখে বলে, "ওমা! আমিই তো কাজী। তোর বিয়েটা আমি পড়াবো আজকে।"
বলতে বলতেই ঘরে ঢুকে পড়ে, চারপাশটা একবার দেখে একটা চেয়ারে বসে পা তুলে বলে, "নববধূকে নিয়ে আয়। বউ ছাড়া কি বিয়ে হয়?"
মুঈনের মাথা গরম হয়ে যায়। রেগে মেগে গিয়ে শেরাজের শার্টের কলার চেপে ধরে দাঁড় করিয়ে বলে, "বেরিয়ে যা এখান থেকে। না হলে তোর কপালে খারাপি আছে বলে দিলাম।"
শেরাজ ঘাড় কাত করে ঠোঁট বাঁকিয়ে মুঈনকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখে চুপচাপ হাসে। তারপর বলে, "তোর সাইজ দেখছিস? তুই আমার কই পড়িস?"
মুঈন বাঁকা হাসি দিয়ে বলে, "সাইজে কি আসে যায়! কথায় আছে ছোট মরিচের ঝাল বেশি।"
শেরাজ হেসে ওঠে, "তুই কি নিজেকে মরিচ ভাবিস নাকি? কিন্তু কি বলতো এই ছোট মরিচেই যদি পায়ের নিচে পড়ে তাহলে পা দিয়ে পিষে ফেলতে বেশি সময় লাগে না।"
বলেই, এক ঝটকায় মুঈনের হাত দুটো নিজের কলার থেকে ছাড়িয়ে নেয়। মুঈন নিজের টাল সামলাতে না পেরে দুই কদম পেছনে হেঁটে যায়। মুঈন চেঁচিয়ে উঠল, "কে ওকে খবর দিয়েছে? বিলাল তুই দিয়েছিস?"
শেরাজ ঘাড় কাত করে শব্দ করে হেসে বলল, "বোকা ছেলে! তোর লোক কেন আমায় খবর দেবে? আমার বহুত লোক আছে, আমায় খবর দেওয়ার জন্য।"
তারপর গলা নামিয়ে বলল, "এবার বল, মেহুল কোথায়? বিশ্বাস কর, মেহুলকে আমার হাতে তুলে দিলে তোকে কিচ্ছু করব না আমি। কিন্তু যদি না তুলে দিস… তাহলে তোর মরণ আমার হাত ধরেই সূচনা ঘটবে।"
শেষ কথাটা শক্ত কণ্ঠে বলল শেরাজ। মুঈন উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে বলে, "আমি মেহুলকে তোর হাতে তুলে দেবো না! দেখি কী করতে পারিস তুই?"
শেরাজের চোখে আগুন জ্বলে ওঠে। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছিল এতক্ষণ, কিন্তু এই দেড় আঙুলের ছেলেটার দম্ভ তার ধৈর্যকে পুড়িয়ে দিয়েছে। হঠাৎই শেরাজ ঝাঁপিয়ে পড়ে মুঈনের গলা তার পেশিবহুল শক্ত হাত দ্বারা চেপে ধরে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, "তোর গলাটা বহুত লম্বা রে… খা ন কি র পোলা! তোর গলার এই নরম নলিটা ছিঁড়তে আমার এক মুহূর্তের জন্য একটুও হাত কাঁপবে না।"
মুঈন শ্বাস নিতে না পারায় যন্ত্রণায় ছটফট করছে। চোখ দুটি কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। শেরাজ মুঈনের দুর্দশা দেখে ছেড়ে দেয়। মুঈন কাশতে কাশতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। শেরাজ হাঁটু গেড়ে বসে মুঈনের চুল ধরে জোরে টান দিয়ে জিজ্ঞেস করে, "মেহুল কোথায়? ভালোই ভালোই বলছি মেহুল কোথায় বলে দে?"
মুঈনের চোখ রক্ত লাল হয়ে আছে। সে হিংস্র গলায় বলে, "পাবি না তুই মেহুলকে! ওকে এমন জায়গায় রেখেছি যেখানে কেউ খুঁজে পাবে না! তুই যদি আমায় মেরে ফেলিস, তাহলে জীবনেও তুই মেহুলকে খুঁজে পাবি না। মেহুল শুধু আমার হবে শুধুই আমার!"
বলেই বিকৃতভাবে হাসতে শুরু করে। শেরাজ দাঁতে দাঁত চেপে উঠে দাঁড়ায়। চোখে মুখে তার হিংস্রতা। হিংস্র চোখে পুরো ঘরটায় চোখ বোলায়। ঘরটায় ঢোকার একটা মাত্রই দরজা—আর কোনো জানালা বা দরজা নেই। তাহলে মেহুল কোথায় আছে, কোথায় রেখেছে এই হারামির বাচ্চা?
শেরাজ আকস্মিক “মেহুল” বলে গর্জে ওঠে। শেরাজের তীব্র চিৎকারে বন জুড়ে থাকা গাছের মগ ডালে থাকা পাখিগুলো উড়ে যায় আতঙ্কে। প্রকৃতিও যেন কেঁপে ওঠেছে শেরাজের ভয়ংকর চিৎকারে।
·
·
·
চলবে..................................................................................