রমজান মাসের প্রথম সেহরি খেতে উঠেছে মুসুল্লিরা। মুয়াজ্জিন দূরপাল্লার মসজিদ হতে সবাইকে সতর্ক করছে। উনুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে অগ্নিশিখা। তাঁর লাল আভায় উজ্জ্বল শান্তি বেগমের মুখাবয়ব। হাসি মুখে গল্প করে যাচ্ছেন আত্বীয় স্বজনের সাথে। হাসি যেন সরছেই না তার মুখে। সুরেলার বড় ফুফু টিপ্পনী কেটে বলে,
" ভাবী তোর মুখ থেকে হাসি সরছেই না। যেন তোর মাইয়ার না বিয়াই সাবের লগে তোর বিয়ার বন্দোবস্ত চলতেছে!"
সবাই মুখ টিপে হাসে। শান্তি বেগম দু গালে আড়াআড়িভাবে চাপড় মেরে বলে,
"আস্তাগফিরুল্লাহ বু! কি কস এল্লা? আমার সুর এতো বড় ঘরে যাইবো। সুখে থাকবো বাকিটা জনম। অভাবের টানাপোড়নে জীবন কাটাইতে হইবো না। তাই খুশি খুশি লাগতেছে। অভাব মানুষের স্বভাব নষ্ট করে বুঝলি বু?"
মধ্যবয়সী মহিলা সায় জানালো। সুরেলার এক মামী বলেন,
"মাইয়ার গতি তো হইলোই। আমাগোরে সিনের একটা ব্যবস্থা করেন আপা। পোলার বয়স তো কম হয় নাই। পঁচিশ ছাব্বিশ তো হইছেই।"
"দিমু তো। সুরের বিয়ার অনুষ্ঠান শেষ হইলেই গ্যাদার লগে কথা কইতাম।"
"মাইয়া খোঁজা শুরু কইরা দিই তাইলে? নাকি সিনের কোনো পছন্দ আছে?"
শান্তি বেগম হাসেন। একটু নিচু গলায় ফিসফিসিয়ে বলেন,
"সিনরে চিনোস না? বিয়ার কথা কইলেই চেইত্যা ওঠে। কয় যহন সময় হইবো তিন চারডা একসাথে ঘরে তুলুম তোগোর চিন্তা করোন লাগতো না।"
উপস্থিত সকলে সমস্বরে হেসে ওঠেন। শান্তি বেগমের মা আইয়ালী বেওয়া উঠোনে থুতু ফেলে এগিয়ে আসেন।
"শান্তি, তোর পোলার যা মেজাজ! বউ দুই দিনও টিকতো না।নানি হই দুই একটা রসিকতা করার হক আছে আমার। কাল কইছিলাম, 'কি লা পরাণ? সুর বুবুরে আজ বাদে কাল বিদায় দিবা আমারে ঘরে তুলবা কবে? ছেড়ায় জ্বইলা উঠলো।আগলা পিরিতি তেনার পছন্দ না। আমি বদ দোয়া দিলাম এমন ঢঙ্গি মাইয়া জুটবো নাকে দড়ি দিয়া ঘুরাইবো।"
বৃদ্ধার কথা শেষ হতে না হতেই সিনান সালেহের আগমন ঘটে। কল পাড়ে যেতে যেতে জবাব দেয়,
"তোর বদ দোয়ায় সিনান ভাইস্যা গেলো বুড়ি! এমন বউ আনমু উঠতে কইলে উঠবো বসতে কইলে বসবো। আমি যা কবো তাই সই। না হইলে কপালে তিন চার লাথি দিয়া খেদাই দিমু!
বৃদ্ধা মুখ মুচড়িয়ে বলে, "আ'লোও শখ কি ছেঁড়ার! যেইনা কাইলা কুচকুচা গতর তাঁর আবার ভাব! যে খ্যাটখ্যাইটা স্বভাব তোর কপালে বউ নাই! উঠবার কইলে উঠবো বইবার কইলে বইবো! না কইয়া হাগতেও যাইতো না বুঝি?"
সিনান অল্প হেসে মাথা নাড়ে শুধু। কল চেপে হাত মুখ ধোঁয়ায় ব্যস্ত হয়। বৃদ্ধা আরো দুয়েক কথা শুনায়। সুরেলার মামী ভাতের কাঁসা উল্টে দিয়ে বলে,
"আপা তোমার পোলার তো নরম শান্ত শিষ্ঠ বউ চাই দেখতাছি। আমার এক ভাতিজি আছে। কও তো একবার দেখাবো নে!"
শান্তি বেগম ফিসফিসিয়ে বলে, "ওর কথা বাদ দে তো! বউ আমি দেখে শুনে আনমু। পাশের উঠানে পাড়া পড়শী ছোট জায়ের মাইয়া শাপলা আছে না? ওরে আনতে চাইছি। আমার ভারী পছন্দ বুঝলা!"
"কি কস ভাবী? মাইয়া সুন্দর তো কি হইছে ওই মাইয়ার তো বাপ নাই। কবেই মরছে! দেনাপাওনা পরিশোধ করবো কেমনে? একটাই পোলা তোর! থাক ওদিক আর মুখ দিস না। মুরুব্বি নাই বাইত্তে সেইহানে সম্বন্ধ গড়া ঠিক না।"
সুরেলার ফুফু চাপা স্বরে বলে ওঠে। শান্তি বেগম ভাতের পাতিল নামিয়ে বলেন,
"কি কন না বুবু! আমাগোরে টাকা কড়ি চাই না। নেক দিল মাইয়া হইলেই হইবো। শাপলা এই হাতের নিচেই মানুষ হইলো। একটু বোকাসোকা বাঁচাল হইলেও মনটা বড্ড সাফ। ওর মায়ের মনটাও খারাপ না। মাঝে মধ্যে দুই এক কথা হয়! ওর মায়েই আইগা আইসা কথা কয়। সিন অমত না করলে ওরেই আনমু!"
আরো চাপা স্বরে আলাপ আলোচনা চলে। উনুন পাড়ের পাশেই দোচালা ঘরের মেঝেতে শুকনো খড়ের উপর পাতানো বিছানায় শুয়ে শাপলা লাজুক হেসে কাঁথা মুড়ি দেয়। ইশ্ কি লজ্জা! সে কি সিন ভাইয়ের বউ হইবো নাকি?
"জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা বাদ দে বইন। মায়ের কথায় আসমানে উড়িস না। সিন ভাই মনে হয় না মত দিবো। তোর প্যাক প্যাকানি স্বভাবের জন্য ভাই তোরে ধারের কাছেও ঘেঁষতে দেয় না।"
সুরেলার কথায় শাপলা ছ্যাত করে উঠলো যেন। পাশ ফিরে সুরেলার দিকে ফিরে বড়সড় ভেংচি কেটে বলে,
"তোমার ওই তার ছেঁড়া ভাইয়ের জন্যে মনে হয় আমি কানতেছি? আমার মেজ মামা আছে না? তার একখান পোলা আছে। গার্মেন্টসে কাজ করে। মেলা ট্যাহা বেতন পায়। মেলা সুন্দর দেখতে। গায়ের রংটাও উজ্জ্বল। সিন ভাইয়ের মতো কালা না। খিটখিট্যা তো আরো না। মিষ্টি মিষ্টি কথা কয়! আমারে লিপিস্টিক কাজল চুলের ফিতা কিইনা দিছিলো সেবার।"
সুরেলা সন্দিহান চোখে চায়। শাপলা পাত্তা না দিয়ে উঠে যায়।
—————
বারান্দায় সবাই শীতল পাটি বিছিয়ে খেতে বসেছে। সবার পাতে খাবার দিচ্ছে শান্তি বেগম। সিনান পাতে হাত দিয়ে খাবার মুখে দেয়। মেহমান সহ বাড়ির সকলের দিকে একপল তাকিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,
"সুর কই?"
শান্তি বেগমকে কিছু বলতে হয় না। সুরেলা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সিনান মাথা তুলে তাকায়। গায়ে বেগুনি রঙের তাতের শাড়ি। গতবছর হাট থেকে মায়ের জন্য এনেছিল। সুর মা'কে পড়তে দেয়নি শাড়িটা। লুকিয়ে রেখেছিল কোথাও। শাড়িতে তাঁর ছোট বোন সুর নয় যেন কোনো বড় বাড়ির বউ লাগছে। সুরেলা ভাইয়ের পাশে বসে মাথা নত করে। সিনান আরেকটু সেঁটে ভালোভাবে বসার সুযোগ করে দেয়। শান্তি বেগম স্টিলের থালায় ভাত মাংস দেন। সুরেলা খেয়াল করে আজকে সবার পাত থেকে তাঁর পাত ভারী ভারী। ভাতের অংশের সাথে তাঁর পছন্দের খাসির গোশত। তাও প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত।
"পেট ভইরা খাইয়া নে বুবু! হয়তো বাপের বাড়ির এই শ্যাষ থাল। বিয়ার পর বাপের বাড়ি আইলে মাইয়া অতিথি হিসেবেই আইসে। তহন ভাই, ভাইয়ের বউয়ে দু এক বেলা দিলে খাবি নইলে না। বাপ মায়ে তো কবরেই গেলো বলে!"
নানীর কথায় মনটা খারাপ হয়ে আসে তাঁর। কান্নারা যেন গলা ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়। সিনান আড়চোখে খেয়াল করে বোনের টইটম্বুর চোখ। নানীর উদ্দেশ্যে বলে,
"চোয়াল ঝুইল্যা গেছে আদ্দব শিখোস নাই বুড়ি? খাওনের সময় তোমার কিসের গপ্প আসে তোর? জলদি খাইয়া কামে লাইগ্যা পর। উক্কামে আনি নাই তোরে!"
আইয়ালী বেওয়া নড়বড়ে দাঁতে গোশত চিবিয়ে বলে, "বিয়া খাইতে আইছি। খামু দামু ঘুরমু ফিরমু আয়েশ করমু। বিয়াই বিয়ানগোর লগে টিটকারী মারমু। নাতজামাইয়ের কোলে উইঠা বইসা থাকমু। তোর কামে আমার বুড়ো আঙুল!"
"আসছে মহারানী ভিক্টোরিয়া! নানারে খাইয়া হাউশ মিটে নাই তোর? আমারে খাইতে চাস? সক্কাল হইতেই টোপলা টাপলি নিয়া ফটুয়া হইবি বুড়ি।"
"কইলেই হইলো? আইছি একবছরের মতো থাকুম। তোর বউ আইলে কানপড়া দিমু।"
বৃদ্ধা দন্তহীন চোয়ালে মুখ ভেঙায়। সবার মুখেই চাপা হাসি। নানী নাতিনের মধ্যে এই হলো সম্পর্ক। দু'জন দু'জনকে ভর্ৎসনা করেই যেন আনন্দ পায়। সুরেলার মনটাও ভালো হয়ে আসে। সে ভাইয়ের পাতে তাকায়। ডালভাত ডলে পেঁয়াজ কাঁচামরিচ দিয়ে গোগ্রাসে গিলছে। নিত্যদিনের স্বভাব। পাতে গোশত খুবই কমই নেয়। তাঁর নাকি হজম হয় না। সুরেলা জানে সব মিথ্যাচার। এ ব্যাপারে কথা বললে ঝাড়ি খেয়ে কান পচিয়ে ফেলতে হয়। সুরেলা পাঁচ টুকরো গোশতের তিন টুকরো ভাইয়ের পাতে। সিনান কিছু বলে না। একটু টুকরো রেখে বাকি দু'টুকরো সুরেলার পাতে তুলে দেয়। সুরেলা আবারও একই কাজ করবে শক্ত চাহনি দেখে দমে যায়। সবার মাঝেই ধমকে না ওঠে। তবে সাহস করে এক টুকরো আবারও চালান করে বলে,
"আমি এতো খাইতে পারমু না ভাই। তুমি খাও না!"
সিনান সালেহ আর কিছু বলে না। আনন্দে সুরেলার মুখে হাসি সরে না যেন। খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই সবাই কাজে লেগে পড়ে। বাড়ির বউ ঝিয়েরা শিল পাটা নিয়ে বসে। সুরেলা একটু বাচ্চামো করে বসবে। সেই ছোটবেলার মতো ভাইয়ের আগে পিছে ঘুরঘুর করে বেড়ায়। সিনান খেয়াল করলেও কিছু বলে না। পাশে চেয়ার টেনে দেয়। সুরেলা বসতে সময় নেয় না। গাঁইগুই করে কিছু বলার জন্যে। ভয়ে জড়তায় বুঁদ হয়ে বসে রয়। সিনান ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত। বাবুর্চিসহ আত্মীয় স্বজনদের ফোন করে সব পাকাপোক্ত করে নিচ্ছে। সুরেলাকে থম মেরে বসে থাকতে দেখে ফোনের বাটনে আঙুল চালাতে চালাতে শুধায়,
"কিছু কইবি?"
সুরেলা মাথা নাড়ে। বলার তো অনেক কিছুই আছে। বলার শব্দটুকুর অভাব। ভাইয়ের কাঁধে মাথা রেখে মলিন সুরে বলে,
"বাপ তো শুধু নামে ছিলো লোকটা। সুর তো তার ভাইয়ের ছায়াতেই বড় হইলো। আমার ভুল ত্রুটি হইলে বকছো মারছো। আমার জীবনে সবচাইতে বড় ভুল করছি ভাই। তুমি মারো কাটো শুধু মুখ ফিরাইয়া নিও না। সুর বাঁইচা থাইকাও মইরা যাইবো! তোমার পায়ে পড়ি ভাই?"
সুরেলার চোখের নোনাজল টপ টপ করে পতিত হয় কাঁধ বরাবর। সিনান মলিন সুরে হেসে বলে,
"আমার মুখ ফিরাই নেওয়া, না নেওয়াতে কিছু যায় আসেনা কারো। দোয়া করি ভালো থাক সুখে থাক। আগলা ঢং দেখাইতে আসবি না আমার সামনে। যা সর?"
সুরেলা চোখ মুখ শান্ত হয়ে আসে। সিনান কাঁধ থেকে ঠেলে সরিয়ে দেয় মাথা। সুরেলা কথা বলার সুযোগ পায় না সিনান উঠে চলে যায়। সুরেলার দম আটকে আসে। সেদিন অপরাহ্ন বেলায় রিজ ভাইয়ের কাছে ফিরে যাওয়া তাঁর জীবনের সবচেয়ে ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তাঁর ক্ষণিকের আবেগ তাকে মুখ থুবড়ে দিলো।
সকালের আলো ফুটতে শুরু করেছে। সিনান সালেহের বাড়িতে যেন উৎসব মুখর পরিবেশ। বাচ্চাদের হৈচৈ, সিনানে্য ভয়ে কিশোরীদের চাপা স্বরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ, মা খালা, মামীদের কাজের ফাঁকে গল্প গুজব সব মিলিয়ে যেন আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। সুরেলা অন্ধকার ঘরের এক কোণায় চুপটি মেরে বসে আছে। কান্তিমান নেত্রযুগল শুকিয়ে উঠতে পারে না জোয়ারে ভেসে যায়। এমনও মুহুর্তে সালেহউদ্দিন বাড়িতে প্রবেশ করে। চোখ মুখ আতংকে বিবর্ণ দেখায়। তাঁর মুখনিঃসৃত বাক্যে মুহূর্তেই অমানিশা ছেয়ে যায়। কানে কানে রটে যায় গুঞ্জন। এ যে মুখ পোড়া হতভাগিনী মেয়ে!
—————
আঘাতপ্রাপ্ত শরীরে সাদা শার্ট জড়ায় নওরিজ মাহবুব। সদ্য সেলাইকৃত বাহুতে টান পড়ায় নাক মুখ কুঁচকে যায়। কোনো মতে তিনটে বোতাম আটকে হাঁফ ছাড়ল নওরিজ। কামরার বিছানা থেকে নেমে চপ্পল পায়ে দিতেই দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে এক মানব। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে স্বীয় গাম্ভীর্য ঠাঠ বজায় রেখে বলে,
"বিয়ের ঘোরে পাগল হলে চলে রিজ? চোখ কান খোলা রেখে চলা উচিত ছিলো। গ্রামের পাতি মাস্তান ভেবে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরলে এমনই হবে। তুমি ভাবছো ওদের ক্ষমতা নগন্য; অপরাধের পরিসর ছোট। আদৌতে তা নয়। ওরা নিজেদেরকে খুবই স্মুথলি ডিভাইন করেছে যা ধরা খুব একটা সহজ হবে না।"
"সাদমান ভাই আপনার সিনিয়রগিরি আপনার পকেটে রাখুন। রূপটা না থাকলে বুঝিয়ে দিতাম পাঙ্গাটা কার সাথে পড়েছে। সেবার সুরুজ মিয়া হারে হারে টের পেয়েছে।"
নওরিজের হেঁয়ালিপূর্ণ জবাবে সাদমান কপাল কুচকালো।
"দু'জন মারা গেছে। আর তিনজন হসপিটালাইজড আছে পুলিশের হেফাজতে। ভাববে না আমি এবার তোমার সেক্টরে গিয়ে হেল্প করবো। স্যার তোমার সাথে কথা বলতে চাইছে সরাসরি।"
নওরিজ উঠে দাঁড়ালো। এলোমেলো চুলে হাত চালিয়ে বলে,
"আমি কথা বলে নেবো স্যারের সাথে। আর প্রথমে পাঁচজন থাকলেও পরবর্তীতে আরেকটা শুয়োরের উদয় হয়েছিল। যেটার গলায় দা বসিয়েছিলাম। আরেকটা পালিয়েছে। একচুয়ালি যেতে দিলাম। মাঝে মাঝে চোরকে ছেড়ে দেওয়াও বুদ্ধিমানের কাজ।"
সাদমানের মুখাবয়বে অবাকতা। কিছু বলবে নওরিজ তাকে সুযোগ না দিয়ে পাল্ট প্রশ্ন করে,
"রূপের কি হাল? ডাক্তার কি বললো? রওশন পৌঁছেছে কি?"
প্রসঙ্গ বদলানোতে সাদমান বিরক্ত হয়। মুখে বলে, "ডাক্তার বলেছে চব্বিশ ঘন্টা না যাওয়া অবদি কিছুই বলা যাচ্ছে না।প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। আঘাতটা মাথায় লেগেছে কেসটা ক্রিটিক্যাল। তবে আশা রাখতেই হবে। রওশন পৌঁছেছে একটু আগেই। রূপের কেবিনের সামনেই দাঁড়িয়ে। যেকোনো মুহূর্তে এসে হামলা চালাতে পারে! তোমার ভাগ্য ভালো ছবি এখনো কিছুই জানে না।"
নওরিজ মুখটা মলিন দেখায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
"সাদমান ভাই আমার জীবনের সবচেয়ে জঘন্যতম মুহূর্ত ছিলো! যদি ডিলিট করতে পারতাম। রূপের কিছু হলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।"
কামরায় তৃতীয় ব্যক্তির আগমনে নওরিজ সাদমান দু'জনেই তাকায়। রওশন এগিয়ে আসে। সাদমানের দিকে একপল তাকিয়ে নওরিজের আপাদমস্তক দেখে নেয়। স্বাভাবিকভাবেই শুধায়,
"তুমি ঠিক আছো? হাতে কোপ লেগেছে শুনলাম!"
নওরিজ রওশনের কাঁধে হাত রেখে বলে, "আমার ছোট বোনটাকে আগলে রাখতে পারি নি। ভালো থাকি কি করে? যতক্ষণ ও ঠিক না হচ্ছে রিজ ভাই ডেকে শান্তি দিচ্ছে আমি ঠিক থাকবো না রওশন!"
রওশন নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। আহ্লাদী বোনটা তাদের নয়নের মণি। আর সেই কি না হাসপাতালের কামড়ায় বাঁচার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে।
হাসপাতালের কড়িডরে বসে সবাই। ছামিনা বেগম কেঁদে কেঁদে মূর্ছা গেছেন। আপাদত স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। নোমান মাহবুব বসে আছেন চিন্তিত মুখে। রমজান মিয়া তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে থমথমে মুখে। মুখচোপা ভয়ে বিবর্ণ তাঁর। রেবেকা বানু এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। চোখমুখ রক্তিমতার রেশ। রূপসা সবারই যে আহ্লাদী! নওরিজের আগমনে রেবেকা বানু ছেলের কাছে এগিয়ে আসেন। উদ্বেগ ভরা কন্ঠে বলেন,
"আব্বা আপনি এখানে কেন? কামরায় চলেন। ডাক্তার রেস্ট নিতে বললো না? গায়ে জ্বরও দেখছি!"
কপালে গলায় হাত দিয়ে তাপমাত্রা পরখ করেন ভদ্রমহিলা। ছেলেটা একটু উনিশ বিশ হলেই অসুখে পড়বে আর এখানে তো এতোবড় ঝড় বয়ে গেলো। নওরিজ মায়েকে আশ্বাস দেয়।
"আম্মা ঠিক আছি আমি। চিন্তা করবেন না। চাচি আম্মার কি অবস্থা? জ্ঞান ফিরেছে?"
"হুঁশে ফিরলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। নার্স ইনজেকশন দিয়ে গেলো এখন ঘুমুচ্ছে।"
নওরিজ উষ্ণ শ্বাস ফেলে বাবার পাশে বসে। নোমান মাহবুব ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
"আমার বাচ্চাদের উপর যার চোখ পড়েছে তাদের চোখ উপড়ে শকুনকে খাওয়াবো। কার এতো বড় কলিজা আমিও ছিঁড়ে বের করে দেখবো।"
"আব্বা আপনি শান্ত হন। ওসব পড়েও দেখা যাবে। আপাদত রূপের জন্য দোয়া করি সবাই! আমাদের তোতা পাখি আমাদের মাঝে ফিরুক জলদি করে।"
নোমান মাহবুবের চোখ চিকচিক করছে। নওরিজ চাচার দিকে তাকায়। রমজান মিয়া থমথমে গলায় বলে,
"কেউই রেহাই পাবে না। কচু কাচা কাটবো সবকটা কে।"
সাদমান এগিয়ে এসে বলে, "এতোক্ষণে পুরো গ্রামে এসব নিয়ে চর্চা হচ্ছে। সুরেলার ভাই কি যেন নাম সিন মনে হয়। ওকে ফোন করে কথা বলে নাও। বিয়েটা তো হচ্ছে না আর আজ! ওদের ক্লিয়ার বলে দাও। আশায় না থাকে।"
রেবেকা বানু তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো যেন। এগিয়ে এসে শক্ত গলায় বলেন,
"এখানে জান নিয়ে টানাটানি! বিয়ের কথা উঠছে কেন? ও মেয়েটাই কুফা। আমার আব্বার জীবনে আসতে না আসতেই যে খেল দেখালো বাকিটা জনম তো পড়েই আছে.."
"আম্মা? অনুগ্রহ করুন। এখন তর্ক করার শক্তি, ইচ্ছে কোনটাই নেই। সাদমান ভাই? আমার ফোনটা বোধহয় গাড়িতেই পড়ে আছে। আপনার ফোন.. না থাক চাচা আপনার টা দিন! সালেহ চাচার নাম্বার আছে তো নাকি?"
রমজান মিয়া ওতশত না ভেবে ফোনটা বের করে দেয়। নওরিজ মাহবুব আড়চোখে সাদমানের দিকে তাকিয়ে উঠে চলে যায় নির্জনে। সালেহ নামে সংরক্ষণকৃত নম্বরে ডায়েল করতেই রিসিভ হয়। যেন ফোনের অপেক্ষায় ছিলো। সে কানে ফোন চেপে চুপ থাকে।
"মিয়া ভাই? এসব কি শুনলাম? রিজ বাবা, রূপসা মা ঠিক আছে তো?"
নওরিজ মাহবুব গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, "চাচা আমি রিজ বলছি!"
ফোনের ওপাশের ব্যাক্তি অবাক হয়। অবাকতাকে পিছু ফেলে সালেহ উদ্দিন বলে,
"রিজ বাবা তুমি ঠিক আছো তো! রূপসা মায়ের কি খবর?"
উঠোন ভর্তি মানুষের চোখে মুখে উদগ্রীবতা। ঘরের দরজায় উদাসীন চোখে তাকিয়ে আছে সুরেলা। সিনান বাবার পাশেই দাঁড়িয়ে কথা শোনার অভিপ্রায়ে।রিজ ভাই বিয়ের জন্য মানা করবে নিশ্চয়ই! এমন পরিস্থিতিতে বিয়ের প্রসঙ্গ বেমানান। তবে তাঁর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এতো এতো খরচের কথা নাই বা ধরলো গ্রামবাসীর কটু কথা কিভাবে থামাবে? সে সুক্ষ্ম চোখে বোনের দিকে তাকায়। কি মনে করে বাবার কান থেকে ফোনটা কেড়ে নেয়। কানে ফেলে বলে,
"রিজ ভাই? সিনান বলছি। সুর কথা বলবে আপনার সাথে।"
উপস্থিত সকলের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। সিনান সব উপেক্ষা করে ফোনটা সুরেলার দিকে বাড়িয়ে বলে,
"কথা বল?"
সুরেলা থতমত খেয়ে যায়। ফোনে কথা বলবে মানে? সে মেনি সুরে কিছু বলবে সিনানের ধমকে কাঁপা হাতে ফোনটা নেয়। চোখ বাঁধন ছিন্ন করে। ভাইয়ের উদ্দেশ্যটা কি?
"হুতুম পেঁচার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে ভেতরে গিয়ে কথা বল যা?"
খেঁকিয়ে ওঠে সিনান। সুরেলা ভেজা চোখে ভাইয়ের দিকে তাকায়। নাক টেনে ফোন হাতে ভেতরে চলে যায়। কান্নায় গলায় জট পাকিয়ে আসে।কানে ফোন চেপে ভঙ্গুর গলায় বলে,
"রিজ ভাই?"
নওরিজ মাহবুব আটকে রাখা শ্বাস ছাড়ে। এ কোন দোটানায় পড়লো সে? এই ক্রন্দনরত সুর বড্ড পিঁড়াদায়ক।
"কাঁদছো কেন?"
"সুখে কাঁদছি বুঝছেন?"
সুরেলার খিটখিটে গলায় নওরিজ ঠোঁট বাঁকায়। পুরো ভাইয়ের কার্বন কপি। রসকষ নেই এক্কেবারে। কোথায় উদ্বেগ প্রকাশ করে হালচাল শুধাবে! তা না ত্যাড়ামো করছে। নওরিজ নরম গলায় বলে,
"আমি ঠিক আছি। চিন্তা করো না। রূপকে নিয়েই যা চিন্তা। দোয়া করো পিচ্চিটার জন্য, হুম?"
সুরেলা কিছু বলে না। আঁচলে ঘন ঘন নাক মুখ মুছার দরুণ মুখশ্রী রক্তিম হয়ে উঠেছে। নওরিজ মাহবুব ঠাহর করতে পারে ওপাশে ব্যাক্তিগত রমনীর কান্নার বেগ। সে স্নেহের সুরে ডাকে,
"এই ডার্লিং? কাদছিস কেন? তোকে নিতে পালকি আসবে না সেজন্য? স্বামীর বাড়ি আসার জন্য এতো উদ্বেগ?"
"আপনার মাথা!"
"আচ্ছা?"
সুরেলা নাক ঝেড়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
"আপনি নামক লোভ আমাকে পুরোপুরি নিঃশেষ করে দিলো রিজ ভাই।
নওরিজের কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়ে। সুরেলার কথায় কেমন একটা ভঙ্গুরতার আভাস! মনে হচ্ছে মেয়েটা ভেঙে পড়েছে। কিন্তু কেন? সে গম্ভীর গলায় শুধায়,
"হয়েছে টা কি বলবি নাকি ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদবি?"
সুরেলা কিছু পল থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। নীরবতার জাল বিচ্ছিন্ন করে বলে,
"কিছুই হয় নি। বললাম তো অতি সুখে কাঁদছি। ফোন রাখলাম। সবাইকে জানাই আসবেন না আপনারা।"
নওরিজ মাহবুব ভরাট গলায় বলে ওঠে,
"সেজে গুজে অপেক্ষায় থাক আমার! নওরিজ মাহবুব আসছে তাঁর ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে নিতে।"
.
.
.
চলবে..........................................................................