কামিনী - পর্ব ২৩ - মম সাহা - ধারাবাহিক গল্প


         বন্য পশু ডাকছে এক ধারে। রাতটি নিস্তব্ধ, থমথমে। রানি চিঠি লিখলেন ক্যামিলাস রাজ্যের উদ্দেশ্যে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে রইল সেনাপতি হ্যাব্রো। এত রাতেও আজ সকলে জাগ্রত। কথোপকথন চলছে নতুন ব্যাধির বিষয়ে। 
সেনাপতি হ্যাব্রো খেয়াল করে দেখলো, চিঠিটি লিখতে রানি একটিবারও দ্বিধাগ্রস্ত হননি। কিংবা তার ভেতর সংশয় নেই এক বিন্দুও। অথচ রানির জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো এই পত্রটি লিখতে পারতেন না। ক্যামিলাস রাজ্যের সাথে তাদের বর্তমান সম্পর্কের যেই অবনতি তার পরেও এতটা আত্মবিশ্বাসের সাথে পত্র লেখার গুণ রানি কামিনীকাঞ্চনের ছাড়া আর কারো হবেও না। 

 ৩৬.....

 বৈরী বাতাস গা ছুঁয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। উষ্ণ মধ্যাহ্নের বৈরাগী ভাব বিদ্যমান পরিবেশে। রানি কামিনী তখন আরামকেদারায় বসে ঝিমুনি কাটছিলেন। ফ্রেয়া রানির পায়ের কাছটাতেই বসা। মৃদু চাপে পায়ে মালিশ করে দিচ্ছে সে। 

রানিকে তখনো নিদ্রাহীন দেখে ফ্রেয়া বহু সাহস সঞ্চয় করে বলল,
 "মার্জনা করবেন, রানি। একটি প্রশ্ন করবো?"

রানির চক্ষুদ্বয় তখনও বন্ধ। আরামকেদারায় দুলতে দুলতে বললেন, "করো।"

ফ্রেয়া এই ক'দিন রানির সাথে থাকার সুবাদে এতটুকু বুঝে গিয়েছে যে, রানি সবক্ষেত্রে কঠিন আচরণ করে না মোটেও। 
 "আপনি ক্যামিলাস রাজ্যে পত্র পাঠিয়ে ছিলেন ক'-একদিন আগে। সে নিয়ে গুঞ্জন চলছে। সকলে বলছে, আমাদের রাজ্যের সাথে ক্যামিলাস রাজ্যের সম্পর্ক ভালো নয়। এরপরেও রানি পত্র পাঠালেন কীভাবে? রানি কি বুঝতে পারছেন না যে, উনারা আমাদের পত্রের উত্তর দিবেন না!"

"কোন সকলে এই কথাটি বলেছে? নাম কী তাদের?"

রানির প্রশ্নে খানিক ভড়কে গেলো ফ্রেয়া। আমতা-আমতা করলো সে। কারো নাম রানির সামনে উচ্চারণ করে ঝামেলা বাড়ানোর মনোভাব যে তার নেই! 
 ফ্রেয়াকে চুপ করে থাকতে দেখে রানি চোখ মেলে তাকালেন। চোখগুলো তার রক্তজবার মতন লাল টুকটুকে হয়ে আছে। বিগত কিছু রাত তিনি নিদ্রাবিহীন কাটাচ্ছেন। রাজ্যের অশান্তি তার মনেও খচখচানি তৈরি করে দিয়েছে। কীভাবে রাজ্যের মানুষকে সুস্থ করে তুলবেন তা ভেবে ভেবে ক্লান্ত হচ্ছেন। 

"নাম বললে না যে?"

ফ্রেয়া চোখ নামিয়ে রাখলো। মৌন থাকার ব্রত করেছে যেন!
 "ফ্রেয়া, তুমি হয় প্রচণ্ড চতুর নয়তো একেবারেই নির্বোধ।"

রানির শ্লেষাত্মক মন্তব্যটিতে চমকালো ফ্রেয়া। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি নিয়ে তাকালো রানির দিকে। 

 "কেন এটা বলছি তা-ই ভাবছো তো? এই যে তুমি আমার কাছ থেকে কথা জানতে চাচ্ছো সেটাও অন্য কারো নাম দিয়ে। যেন কথাটি তোমার নয়, অন্যকারো জানার আকাঙ্ক্ষা। আবার আমি যখন অন্যকারো নাম জানতে চাচ্ছি তখন বলতে দ্বিধা! কারণ তুমি কারো নাম বলে, কারো শত্রুও হতে চাচ্ছো না। এখন তোমার এই গুণটিকে কী নাম দিই বলোতো? সরলতা না-কি চতুরতা?"

"মার্জনা করুন, রানি। আমি চাইনি আপনি এই বেলায় কারো উপর রুষ্ট হোন। তাই নাম প্রকাশ করিনি।" নতজানু হয়ে উত্তর দিলো ফ্রেয়া।

 রানি চাপা হাসলেন। চোখ দু'টি আবার বন্ধ করলেন। বললেন,
"সকলকে বলে দিও, আমি রানি কামিনীকাঞ্চন। আমার ভাবনা আর সকলের ভাবনা যে এক নয়! আমি কেন পত্র পাঠিয়েছি তা আমি বুঝেই পাঠিয়েছি। সকলকে বলো, রানির কাজ নিয়ে এত ভাবতে না। তাহলে কয়েক দিনের ভেতরই উন্মাদ হয়ে যাবে।"

যদিও রানি তাকিয়ে নেই তবুও ফ্রেয়া মাথা নাড়ালো। যার অর্থ, সে বলবে।

এর মাঝেই বাহিরে কণ্ঠ পাওয়া গেলো সেনাপতির। ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি চাচ্ছে সে। রানি অনুমতি দিতেই হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করলো। 
রানি ফ্রেয়াকে বেরিয়ে যেতে বলল।

সেনাপতির চোখে-মুখে চাপা অস্থিরতা যা চোখ এড়ায় না রানির। তিনি তীর্যক চেয়ে থেকেই প্রশ্ন করেন, 
"এমন কী ঘটলো ধরণীতে? যে আমার রাজ্যের সেনাপতির মুখে এমন উৎকণ্ঠা? একবার বলেই দেখো, ধরণী ভাগ করে ফেলবো।"

শেষের কথাটি কিঞ্চিৎ ঠাট্টা করেই বললেন রানি। 
সেনাপতি নিজেকে ধাতস্থ করল। বাম হাতের উল্টো পিঠে মুখ মুছলে নিজের। বলল,
"রানি আপনাকে একটু বসার কক্ষে যেতে হবে।"

 "সে না-হয় গেলাম। তা এসেছে কে?"

"গেলেই দেখবেন। যে এসেছে, সে বলেছে আপনাকে নাম না বলতে।"

"এমন কে এলো, যার কথা আমার সেনাপতি এমন অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে! গিয়ে দেখতে হচ্ছে তো!" কথাটি বলেই কেদারা থেকে উঠে দাঁড়ালেন রানি। 

 বাহু টান টান করে বসার কক্ষে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। তবে কিছু একটা ভেবে আবার ফিরে তাকালেন। সেনাপতিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
"হ্যাব্রো, ফ্রেয়া সম্পর্কে আবারও একটু খোঁজখবর নিও তো!"

হ্যাব্রো কিছুটা অবাক হলো। ফ্রেয়াকে নিয়ে হুট করে রানির এহেন আগ্রহের কারণ বুঝল না। শুধাল,
"কিছু হয়েছে কি?"

 "কিছু যেন না হয় সেজন্যই তো খোঁজ নিতে বললাম।"

"খোঁজ তো নিয়েছিলাম। তেমন কোনো সন্দেহের কিছু খুঁজে পাইনি।"

 "খুঁজে পাওনি কারণ হয়তো তা প্রকাশ্যে নেই। আবার খুঁজবে।"

সেনাপতি মাথা নাড়ালেন। কিন্তু মনে মনে সে ভেবেই পেলো না হঠাৎ রানির এমন আদেশের কারণটিই বা কী!

 ৩৭....

বৈঠকখানার বাহিরে দাস-দাসীদের ভীড় জমেছে। চাপা আকর্ষণ বয়ে যাচ্ছে স্রোতের বেগে। রানি বৈঠক খানার ভেতরে। সাথে সেনাপতি, মন্ত্রী, রাজবৈদ্য সকলই আছে। 

বিশাল বৈঠকখানা জুড়ে পিনপতন নীরবতা। রানির সামনে দাঁড়িয়ে আছে হেমলক পিয়ার্স। নীলাভ চোখের মণিগুলো পুরুষটির। সেই অদ্ভুত সুন্দর চোখগুলো নিয়ে তাকিয়ে আছেন রানির দিকে। ঠোঁটে হাসি নেই অথচ মনে হচ্ছে তার মুখে চাপা হাসি বয়ে যাচ্ছে। চেহারাটাই যেন অদ্ভুত মায়া দিয়ে তৈরি। 

 "রাজা হ্যাভেনের ভ্রাতাও এসেছেন আমার রাজ্যে! বাহ্!" 
রানির কথায় হেমলক পিয়ার্স হাসলেন। খানিক মাথা কুর্নিশ করে বেশ মোলায়েম কণ্ঠে বললেন, "তবুও তো রানি অবাক হলেন না।"

 "এত সহজে অবাক হলে হবে? পৃথিবীতে এরচেয়েও কত আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে।"

"তা ঠিক। সে যাই হোক, তুমি আমাদের রাজবৈদ্যকে চেয়ে ছিলে তাই নিয়ে এলাম।"

 "সে তো রাজবৈদ্যকে চেয়ে ছিলাম। আপনাকে তো নয়!"
ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে বেশ হেলাতেই কথাটি বললেন রানি।

"যতই হোক, তোমরা আমাদের মিত্র রাজ্য তো নও। যদি আমাদের রাজবৈদ্যকে দিয়ে কোনো ছলাকলা করো তবে তো আমাদের উপর তা ভারী হবে। তাই নিজেদের রাজ্যের সুরক্ষা রক্ষার্থে না ডাকলেও যে আসতে হয়!"

রানি এবার বেশ অপমানিত অনুভব করলেন। তীর্যক চোখে তাকিয়ে ভারিক্কি স্বরে বললেন,
 "যদি ক্ষতিই করার চিন্তা থাকতো তবে কি প্রকাশ্যে পত্র দিয়ে আমন্ত্রণ জানাতাম? রাজা হ্যাভেনের ভ্রাতা হয়ে এত সামান্য চিন্তাভাবনা ধারণ করলে হয় না-কি?"

"সম্রাজ্ঞী, আমার নিজস্ব একটি নাম রয়েছে। আমার পরিচয় কেবল মাত্রই আমার ভ্রাতা নয়।"

রানি হেমলক পিয়ার্সের গতিবিধি খেয়াল করলেন কথাটি বলার সময়। তার ভেতর ভেতর খটকাও লাগছে কিছুটা। বেশ কিছুদিন আগে যেই রাজ্যের রাজকন্যার এমন ক্ষতি করে এলেন তিনি, সেই রাজ্যেরই রাজা এত সহজভাবে সকল কথা বলছেন, একবার নিমন্ত্রণেই চলে এসেছেন কেমন যেন দ্বিধা সৃষ্টি করে এই ঘটনা মনে।

রানি আর কিছু বলেন না। উনাদের থাকার ব্যবস্থা করেই বেরিয়ে যায় কক্ষ ছেড়ে। 
 হ্যাব্রো এবং মন্ত্রীকে বারংবার বলেন খোঁজ নিতে। ক্যামিলাস রাজ্যের রাজাদের ছলের অভাব নেই। তাই কোন উদ্দেশ্যে লোকটি এখানে এসেছেন সেটি অনুধাবন করা প্রয়োজনীয়। কেবল মাত্র শত্রু রাজ্যকে সাহায্যের উদ্দেশ্যে তো মোটেও আসেননি। মানুষের মনে এত উদারতা থাকলে তো হতোই!

 ৩৮......

শুভ্র মেঘে গগণ ছেয়ে আছে। আজকাল গরম পড়েছে বেশ। রাজ্যজুড়ে উত্তপ্ততা ফুলকির ন্যায় ছুটছে। তাই তো এই সদ্য সকালেই এতটা রৌদ্রে ভরে গেছে প্রকৃতি। 
 রানি গরম এলেই শুভ্র বস্ত্র পরিধান করেন। আজও ব্যতিক্রম নয়। তিনি শুভ্র রঙের রাজকীয়, মোলায়েম একটি বস্ত্র পরেছেন। মৃদু সোনালি ও কালো মিশেলের কোমরের নিচ সমান চুল গুলো ঢেউ খেলছে পিঠ জুড়ে। একা বেরিয়েছেন আজ সেই গ্রামে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। মন্ত্রীমশাই তো প্রচণ্ড ভীত হন গ্রামে যাওয়ার নাম শুনলেই। হ্যাব্রোকে কিংবা অন্য কোনো প্রহরীকে সাথে নিতে চান না। এই মানুষগুলোর তো নিজস্ব পরিবার রয়েছে। এই মরণব্যাধি রোগ যদি এই মানুষগুলোকে ধরে তবে পরিবারগুলোর কী হবে? তিনি রানি হয়ে তো আর ইচ্ছেকৃত প্রজাদের ক্ষতি করতে পারেন না! 

 এই উদ্দীপ্ত সূর্যের রশ্মি ভেদ করে রানির ঘোড়াটি ছুটছে। রাজপ্রাসাদ থেকে তখনো তিনি বেশিদূর যাননি। সবে একটি ছোটো জঙ্গলে প্রবেশ করেছেন। তখনই তিনি অনুভব করলেন তার ঘাড়ে কিছু একটা পড়েছে। হালকা উষ্ণ পানীয় জাতীয় কিছু। 
এই গরমে শিশির নিশ্চয় পড়ছে না! কিছুটা অবাক হয়ে রানি ঘাড়ে হাত দিলেন। এবং হাতটি সামনে আনতেই চমকে উঠলেন। লাল টুকটকে, তাজা রক্তে তার চারটি আঙুল ভিজে গিয়েছে। রানি থমকালেন তা দেখে। শিরশির করে একটি স্রোত বয়ে গিয়েছে তার পিঠ দিয়ে। 

রানির শক্ত মন হলেও এই তাজা রক্তে কিছুটা ভীত হলেন। পরক্ষণেই ভাবলেন হয়তো কোনো পশুপাখির রক্ত হবে। সে-ই ভেবেই তিনি মাথার উপরে তাকালেন। উপরে তাকাতেই তার গায়ের রক্ত হীম হয়ে গেলো।  
একটি ছোটো নবজাতকের নিথর দেহ ঝুলে আছে গাছের ডালটায়। বুকের একপাশে কিচ্ছুটি নেই। বড়ো একটি ছিদ্র হয়ে আছে বুকটায়। সেখান থেকেই চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে রক্ত। 

রানির সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগলো। এরচেয়েও কঠিন মৃত্যুদণ্ড তিনি বহু লোককে দিয়েছেন কিন্তু আজ এই ছোটো প্রাণটির এমন দশা দেখে শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। কীভাবে এমনটা হলো? কোনো বন্যপ্রাণী কি ছিঁড়ে খেলো বাচ্চাটাকে? 
·
·
·
চলবে...................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp