হৃৎপিণ্ডে তীব্র ধুকধুকনি হচ্ছে। একটা ভীত ভাব ক্রমশ কাবু করে ফেলছে। এভাবে তো ব্যাপারটা ভাবতে চায়নি ও। চিন্তা করেনি এমন কিছু। তবে কেন সেলিম কাজটা করেছে? সে কী পুরোনো কোনো ঘটনার প্রতিশোধ স্পৃহায় ভুগছে? সে কী এখন চাইছে এই নির্জন পাহাড়ি পথে, ফাঁকা গাড়িতে, সম্পূর্ণ থমথমে পরিবেশে বাজে একটা দূর্গতি ঘটাতে? শাওলিন চুপচাপ, শান্ত; বাইরে থেকে স্থিরবিদ্ধ। ভেতরের কলুষিত ভয় এতটুকুও প্রকাশ পেতে দিচ্ছে না। ও জানে, যেই ভেতরের ভয়টা বহিঃপ্রকাশ পাবে, ঠিক তখনই ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে শকুনটা! তাই আপামর শান্ত থেকে ব্যাকসিটের দরজাটা খুলে দিল শাওলিন। একটা নিঃশব্দ দম ছেড়ে ব্যাকসিটের কাছ থেকে টোটব্যাগ তুলে নিল। সামনে থেকে সেলিম শক্ত স্টিয়ারিংয়ের উপর তবলার মতো আঙুল বাজিয়ে বলল,
- কী হলো? আরো দেরি করবে নাকি? সময় কিন্তু বেশি বাকি নেই!
শাওলিন টোটব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে তাকাল। গাড়ির ডানদিকে থাকা সাইড মিররে তাকিয়ে প্রচণ্ড ক্রোধে দাঁত কিড়মিড় করছিল। কিন্তু এমন কিছু বলল না, যাতে সেলিমের ফাঁদ সফল হয়ে উঠুক। শাওলিন ধাতস্থ ভঙ্গিতে শান্ত কায়দায় প্রশ্নটা ছুঁড়ল,
- পানিটা ফেলেছেন কেন? ব্যাকসিটে যেন না বসি এজন্য?
সরাসরি কথাটা মুখের উপর বলে দেওয়াতে কিঞ্চিত রূঢ় হল সেলিম। তার জীবনে দেখা সবচাইতে কঠোর ধাতুর মেয়ে ও। মুখের উপর এভাবে কথাটা বলে দিবে এটা আশা করেনি সে। ভেবেছিল, একটা গোবেচারা, বোকাটে ভঙ্গি করবে শেহজানা। কিন্তু তা না, বরং ভালোমতোই বুঝেছে সেলিমের নিগূঢ় উদ্দেশ্য। স্টিয়ারিংয়ের উপর তবলা বাজানো থমকে গেছে। এখন সোজাসুজি তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে গাড়ির সাইড মিররে। আর মাত্র দুটো মিনিট উপহার দিবে ওকে। এরপরই শুরু করবে তার আসল কর্ম। এবার বুঝিয়ে ছাড়বে, কতটুকু ধানে কতটুকু চাল উৎপন্ন হয়। আর তাকে এরকম অহংকার দেখালে কতটুকু ক্ষতিপূরণ পেতে হয়। দাপুটে একটা ভঙ্গি নিজের অবয়বে ফুটিয়ে তুলল সেলিম। মনে মনে ঘড়ির দুই মিনিট হিসেব করে চলল সে। এদিকে শাওলিন ওই দৃষ্টি, ওই ভঙ্গি, ওই বাহ্যিক অবয়বের ধারাভাষ্য বুঝতে হেরফের করল না। ওর মনে এমনিতেই অশনি ঘণ্টার ঢং ঢং বেজে চলেছে। বুঝতে পেরেছে জিদানের ওই নামাটাই ওর জন্য মহা বিপদসংকেত ছিল। বতর্মানে একটুও অস্থির হল না ও। হঠাৎ ওর চোখ পড়ল নিজের হাতের ওপর! ফোন! এই মুহুর্তে কাকে ফোন করলে একটা উদ্ধার পাওয়া যাবে? কে এই মুহুর্তে বাজি পালটে পরিস্থিতি ঘুরিয়ে দিবে? সেকেণ্ডের ভগ্নাংশে ভাবতে লাগল শাওলিন। চটজলদি নামটা মাথায় আসাতে ওমনেই আঙুল চালিয়ে কলটা ডায়ালে ফেলল। ফোনটা ডান কানে চেপে দূর পাহাড়ের দিকে তাকাল শাওলিন। এদিকে সিটে বসা সেলিম কপালে কৌতুহলের ভাঁজ ফেলল। গাড়ির ডানদিকের সাইড মিররে পেছনের পুরো ঘটনাটা দেখতে পাচ্ছিল। ও কাকে কল দিচ্ছে? শ্রেষ্ঠাকে? ওকে কল দিলে লাভ নেই। ওর ফোন আজন্ম সাইলেন্ট। নাযীফের ফোন সোহানার কাছে। সোহানার ব্যাগ থেকে নিশ্চয়ই হই-হল্লার মাঝে রিংটোন শোনা যাবে না। সেলিম তেরছা হাসিতে বাঁহাত স্টিয়ারিংয়ের উপর রেখে, তবলা বাজানোর মতো আঙুল নাচাচ্ছে। হঠাৎ ওর মনে অন্য চিন্তাটা ভর করতেই আঙুলগুলো থমকে গেল। জানা কী ওই লোকটাকে . . . ব্যাপারটা চটজলদি ভাবতেই মুখের অবস্থা বদলে গেল সেলিমের! সে তৎক্ষণাৎ অস্থিরকণ্ঠে বলে উঠল ওকে,
- কাকে কল দিচ্ছ তুমি? শ্রেষ্ঠাকে?
শাওলিন প্রশ্নটা শুনে চোখ সরিয়ে নিয়েছে। ওর সম্পূর্ণ মনোযোগ কলের ওপ্রান্তে! প্লিজ কলটা ধরুক। অনুষ্ঠানের ব্যস্ততা সত্ত্বেও একবার চেক করুক ফোনটা। কিন্তু না, কলটা ধরল না। বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে গেলে সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল ওর। এখন কী হবে? কান থেকে ফোন নামালেই সেলিম সত্যটা বুঝে যাবে। এও বুঝে যাবে, ও প্রান্তের ভদ্রলোক ব্যস্ত। শাওলিন আবারও কানে হালকা প্রশ্নটা শুনতে পেল,
- কাকে কল দিচ্ছ জানা? তুমি কী কথা কানে শুনতে পাও না?
- এক মিনিট। কথা বলছি আমি।
সপাটে সেলিমের কথায় দাড়ি কষালো ও। অদৃশ্যভাবে বুঝিয়ে দিল চটপট উত্তর দিতে বাধ্য নয় কারো। শাওলিন মুখটা বাঁদিকে ঘুরিয়ে বারবার ঢোক গিলছে। ও কোনোভাবেই বুঝতে দিতে চাচ্ছে না ও এখন ভীত। অনুভব করতে পারছে ওর বুকের পাঁজরাটা ভয়ংকর ভাবে টলছে! গলার কাছে নিঃশ্বাসের কুণ্ডলী পাকিয়ে আসছে। একটা অস্থির আতঙ্ক ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরতে প্রচুর। এমন সময় সমস্ত হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। কলটা বাজতে বাজতে এবারও কেটে গেল! ভদ্রলোকটা এ দফায়ও রিসিভ করেনি। খুব সাবধানে আড়দৃষ্টিতে গাড়ির সাইড মিররে তাকাল ও। সেলিম একদৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখদুটোতে যেন দূর্গম সংকেত। স্টিয়ারিং ছেড়ে দরজার হ্যাণ্ডেলে হাত দিচ্ছে, বাইরে বোধহয় বেরোবে, তার আগেই শাওলিন চটজলদি একটা উপায় ঠাওরে নিল। চোখদুটো মিররে এঁটে ভীষণ স্থিরকণ্ঠে বলল,
- আসসালামুয়ালাইকুম!
আচমকা সেলিমের হাত থমকে গেল। দরজার হ্যাণ্ডেল সেভাবেই বন্ধ রইল। আর খুলল না সে। বরং তীব্র উদগ্রীব চোখে তাকিয়ে আছে সেলিম। কাকে কল দিয়েছে? এদিকে শাওলিন বুকভর্তি দমটা ছেড়ে চোখদুটো বুজে নিল। মনে মনে কল্পনা করতে লাগল, ওর সামনে এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষটাই দাঁড়িয়ে আছে। এখন ও একা নয় এখানে। কণ্ঠে নির্ভার ভাবটুকু শান্তভাবে বুঝিয়ে বলল,
- আমি . . আমি কী পার্বত্য চট্টগ্রাম, ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার, মহাশয় শোয়েব ফারশাদের সঙ্গে কথা বলছি?
কথাটা বলতেই একটা শিরশিরে শিহরণ ওর সমস্ত শরীরে খেলে গেল! এই আচানক অনুভূতির অর্থ বুঝতে পারল না ও। শুধু অনুভব করতে পারল, তিরতিরে নরম পাতার মতো ওর হৃৎপিণ্ডটা কাঁপছে। একটা অদ্ভুত মোচড়ে ওর হৃদয়-কোষ নিংড়ে যাচ্ছে! বহু কষ্টে শুকনো খটখটে কণ্ঠনালী ঢোকে সিক্ত করল। এরপর পরবর্তী কথাগুলো আরো নিখুঁত, আরো বাস্তব কায়দায় বলতে লাগল শাওলিন,
- আমরা . . আমরা ঠিক আছি। এই মুহুর্তে আনসার ক্যাম্প ছাড়িয়ে আধঘণ্টার দূরত্বে আছি। না, গাড়িতে সদস্য দুইজন। তিনজন ছিল। জিদান ভাই একটু আগে গাড়ি থেকে নেমে গেছেন। পরিচিত এক ছোট ভাইয়ের সঙ্গে উনার দেখা হয়েছে। কিছুক্ষণ পর আসছেন উনি। জ্বী, দুইজন।
খুব সাবধানে কথাগুলো বসাচ্ছিল শাওলিন। যেন সেলিম এটা ভাবুক, বন কর্মীকে ওদের ব্যাপারে সবই জানিয়ে ফেলছে। শাওলিনকে যে গাড়িতে একা, আর ওর কিছু হলে যে দোষটা কার, এসবই আকারে-ইঙ্গিতে সেলিমকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। যেন সেলিম এটা বিশ্বাস করুক, ওর কোনো ক্ষতি হলে একজন সাক্ষী অন্তত থাকছে। এবার আসল কথাটা বলার জন্য চোখ খুলল শাওলিন। মাথাটা ঘুরিয়ে গাড়ির ডানদিকের সাইড মিররে চোখ বিদ্ধ করে বলল,
- সেলিম? ড্রাইভে আছেন। এখানে সবকিছু ঠিক আছে। আমরা রাস্তায়. . আসছি। কল দিয়েছিলাম সবাই ঠিকমতো পৌঁছুল কিনা, এটা জানতে। না, কোনো সমস্যা নেই। জ্বী নিশ্চয়ই। আমি সেলিমকে বলে দিব, আপনি দ্রুত বৈসাবি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে বলেছেন। রাস্তায় কোনোপ্রকার দেরি করা যাবে না। আপনি লোক না পাঠালে ঠিক হবে। আমরা বোধহয় কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। পথ চিনতে ভুল হচ্ছে না। ঠিকআছে বলে দিব দ্রুত ড্রাইভ করতে। আমরা কাছাকাছি পৌঁছে জানাব। আল্লাহ হাফেজ।
কল কাটার মতো ভঙ্গি করে গাড়ির ব্যাকসিটের দরজাটা বন্ধ করল ও। নিজের টোটব্যাগটা নিয়ে গাড়ির ডানপাশ কাটিয়ে সামনে আধপাক ঘুরে এবার বাঁপাশে এসে পৌঁছল। ড্রাইভিং সিটের পাশের দরজাটা খুলে নির্ভার মুখে বসে পড়ল শাওলিন। ডানদিকে সেলিমের উদ্দেশ্যে ভীষণ নিশ্চিন্ত সুরটা ফুটিয়ে বলল,
- উনি দ্রুত অনুষ্ঠানে পৌঁছাতে বলেছেন। রাস্তায় দেরি করা যাবে না। সবাই ওখানে পৌঁছে গেছে। বারবার আমাদের কথা জিজ্ঞেস করছে। আরো দেরি হলে সবাই চিন্তা করতে বসে যাবে। গাড়ি স্টার্ট দিন সেলিম।
কোনো এক অদ্ভুত কারণে সেলিম একটা কথাও কাটলো না। সামান্য টু আওয়াজ পর্যন্ত না। ভীষণ আশ্চর্যজনক ভাবে একেবারে খামোশ হয়ে রইল। সে তখনো বুঝতে পারেনি, শাওলিন ঠাণ্ডা মাথায় পুরো পরিস্থিতিই ঘুরিয়ে দিয়েছে। তার কল্পনার বাইরে থেকে সেই ঘাতক নামটাই উচ্চারণ করেছে, যেটা তার জন্য অবশ্যই প্রাণঘাতী। সেলিম চাইলেও ভয়াবহ কিছু করতে পারবে না। করলেও খাগড়াছড়ি ছেড়ে যাবার পথগুলো রেড সিগন্যালে বাঁধা পড়বে। সম্পূর্ণ বাধ্যগত প্রজার মতো গাড়িটা স্টার্ট দিয়েছে সেলিম। ছুটন্ত পথে আর একটাও শব্দ, উচুঁ-নিচু কর্ম, হেঁয়ালি তৎপরতা ঘটাতে গেল না। যেন সবকিছুতে পানি ঢেলে দিয়েছে কেউ। ভেস্তে দিয়েছে কু ইচ্ছেটা।
—————
খাগড়াছড়ির বুকে আনন্দের পসরা বসেছে। বিভিন্ন গোষ্ঠীর আগমন আজ বৈসাবি উৎসবে। নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে ছোট ছোট শিশুরাও সমবেত আজ। ভীড় করেছে পাহাড়ের নির্জন-প্রিয় মানুষরা। তাদের পোশাকে, ভাষাতে, কাজে ও কর্মে পাহাড়ের পুরোনো ঐতিহ্য প্রতিফলিত হয়ে ফুটছে। আধুনিকতার সীমারেখা ছেড়ে শান্তি কামনা করা পাহাড়ি মানুষগুলো আজ তাদের বর্ষবরণে মত্ত। চারিদিকে সরস প্রাণের ছড়াছড়ি, হৃদয়ে সম্প্রীতির ছোঁয়া, মানুষে মানুষে মেলবন্ধনী সুর, অন্যদিকে গান, নৃত্য, পাহাড়ি ঐতিহ্যের পরিবেশনা। বিশাল পরিসরে একখণ্ড জায়গা জুড়ে বৈসাবি মেলা বসেছে। বাঁশ দিয়ে মজবুত করে বানানো স্টলে ছোট-বড় সকল মানুষের ভীড়। খাবার, কাপড়, বাঁশ, কাঠ ও নিজস্ব কারিগরিতে কত বাহারি জিনিস, কত রঙ-বেরঙের তৈজসপত্র! সমস্তই বাঁশের স্টলগুলোতে থরে থরে সাজানো। শ্রেষ্ঠা একটা দোকানে ঢুকে বাঁশ দিয়ে বানানো খুব সুন্দর একটা মগ কিনল। মগের গায়ে চমৎকার করে খোদাই করালো নিজের নামটা। আরেকটা মগ নিজের ছোটবোনের নামে খোদাই করিয়ে নিতেই পাশ থেকে মিথিলা একমুখ মিষ্টি হাসিতে বলল,
- বাঁশের জিনিস পছন্দ করো? ভালো লাগে?
- আমার তো এসব দেশী জিনিসই বেশি পছন্দ। আফসোস এই, ঢাকায় এসব সচরাচর চোখে পড়ে না। পড়লেও দ্বিগুণ তিনগুণ দাম চুকাতে হয়। আমার ছোটটা দুদিন পরপর আড়ংয়ে ঢুঁ দিয়ে কী কী সব কিনে আনে! ওর ঘরে এসব জিনিসে ভর্তি। এজন্য ভাবলাম, এবার একটা মগ নিয়ে যাই। খাগড়াছড়ির চিহ্নস্বরূপ ছোট বোনের কাছে কিছু একটা থাকুক।
- চমৎকার। মগটা তোমার ছোটজনের পছন্দ হবে। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তুমি এক কাজ করো তো, আমার জন্যও একটা মগ পছন্দ করে নাম লেখাতে বলো। আমি শাওলিনের জামার ব্যাগগুলো আমাদের গাড়িতে তুলে দিচ্ছি, কেমন?
- জ্বী আপু। ভালো হয়। আপনাকে থ্যাংকিউ।
মিথিলার তত্ত্বাবধায়নে দু সেট জামাকাপড় কেনা হয়েছে শ্রেষ্ঠার। বতর্মানে ওর টিউশনির খরচ সম্পূর্ণই শেষ। রেসোর্টের ওই হামলাটা না হলে এখন ওই টাকাটা থাকতো বাড়তি কেনাকাটার জন্যে। তবে, ভালোই হয়েছে। মেয়েটার জন্য এটা একটা ছোট্ট উপহার হিসেবেই থাকুক! পাহাড়ি মেয়েদের হাতে বোনা কাপড়ে শিল্প-নিপূণ জামাকাপড়! এমন সময় পেছন থেকে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এল সোহানা। কোমরে দুহাত রেখে হাপাতে হাপাতে বলল,
- শ্রেষ্ঠা, ঝটপট দোস্ত। গাড়িতে উঠা লাগবে।
শ্রেষ্ঠা সদ্য একটা মগ বেছে খোদাই করতে দিয়েছে। সোহানার ওমন ভাবভঙ্গি দেখে কিঞ্চিত অবাক সুরে বলল,
- ঝটপট? মানে এখনই কীসের গাড়িতে ওঠা? বাকিরা তো এখনো আসেনি! ওদের রেখে যাব নাকি আশ্চর্য?
সোহানা শুকনো ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে ঢোক গিলল। কিছুটা সুস্থির গলায় বলল,
- সময় নেই দোস্ত। ভ্যালির রুটে এক্ষুণি পৌঁছুতে হবে। স্যার আমাদের সবাইকে জীপে উঠে যেতে বলেছেন। তিন গাড়ির মাত্র দুই গাড়ি এখানে পৌঁছেছে। বাকি একটা এখনো আসেনি। এদিকে যদি আমরা রওনা না দিই, তাহলে আর্মি এসকোর্ট টাইম ওভার হয়ে যাবে। লাইট স্টেজে আমরা কেউই ভ্যালি পৌঁছাতে পারব না।
- কিন্তু আরেক গাড়ির লোকেরা? সেলিম, জিদান, জানা বাকি! ওদের পেছনে রেখে ভ্যালিতে চলে যাব? এটা কেমন স্বার্থপরতা?
এবার পেছন থেকে পাথর-শীতল কণ্ঠে কথা কাটলো কেউ। দুজনই হতভম্ব মুখে পেছনে ঘুরে তাকিয়েছে। এক মুখ ধারালো স্থৈর্যভাব শোয়েব ওদের পেছনে দাঁড়ানো। হাতে কয়েকটা ব্যাগ, যেগুলো এখন সোহানার দিকে বাড়িয়ে ধীরস্থির কণ্ঠে জানাল,
- তোমরা রওনা দাও। দেরির কোনো মানে দেখছি না। ওই গাড়ির লোকজন পৌঁছালে ওটা দেখার দায়িত্ব আমার রইল। তোমরা ভ্যালির উদ্দেশ্যে এগিয়ে যাও। আর্মি এসকোর্ট পেরিয়ে গেলে সমস্যা হবে একটা, টাইম ওভার হয়ে গেলে ওরা কাউকেই নিবে না।
- ঠিকআছে, স্যার। এদিকটা আমি দেখছি। কিন্তু ওরা যদি পেছন থেকে আসতে আরো দেরি করে তখন? পরে তো আমরা ভ্যালিতে পৌঁছে যাব, আর ওরা পেছনে আঁটকা পড়ে যাবে।
শোয়েব আবারও ওর চিন্তার কারণগুলো স্থির করিয়ে বলল,
- আমি চেষ্টা করব এসকোর্টের লাস্ট কল পর্যন্ত ওই গাড়ি পৌঁছে দিতে। তোমাদের প্রত্যেককেই এসকোর্ট লাইনে পৌঁছে দিয়ে আমি সবার শেষে পৌঁছব। ভয় পেয়ো না। ভাবীদের জীপে পর্যাপ্ত জায়গা, একজন গাইডের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। গাইড ছেলেটার নাম শামীম। শামীম তোমাদের রুম পর্যন্ত পৌঁছে দিবে। এখন আর দেরি করো না, সামনে আগাও।
- আচ্ছা, আমরা তবে বেরোচ্ছি। ওরা তিনজন এসে পরলে বাকিটা আপনি একটু দেখে দিয়েন। আর জানাকে কাইণ্ডলি বলবেন, আমরা ওকে ছেড়ে যাইনি। বরং, আপনি আমাদের দ্রুত আগাতে বলেছেন। ও যেন আবার ভুল ---
- ভুল বুঝবে না। ওটা বোঝানোর দায়িত্ব আমার ব্যক্তিগত মালিকানায় রইল। তোমরা এখন বেরোতে পারো। ভ্যালিতে পৌঁছে দেখা হবে আশা করছি। ট্রায় টু হেভ অ্যা প্লেশান্ট জার্নি।
কথাগুলো শোনার পর শ্রেষ্ঠা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। কেন যে রইল কে জানে। ও শুধু চশমা পরা লোকটার চোখদুটো পড়তে চাইল। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি, এক ইঞ্চিও মর্মোদ্ধার করতে পারল না। অথচ, ওর জীবনে এটা ওর গুণই ছিল, ও মানুষের চোখে তাকিয়ে সব বুঝে ফেলতে পারে। গোপন অনেক গল্প আন্দাজ করতে পারে। কিন্তু এই নীল সুন্দর চোখদুটোর ভাষা হায়ারোগ্লিফিক্সের মতো দূর্বোধ্য। আচ্ছা লোকটা মালিকানাধীন বলতে কী বোঝাচ্ছে? সাদামাটা দায়িত্ববোধ? নাকি গভীরস্পর্শী কিছু?
—————
সেলিম নির্দিষ্ট ঠিকানাটা খুঁজে পেতে ভালোই জক্কি পোহিয়েছে। ভেবেছিল জায়গাটা খুঁজেই পাবে না। কিন্তু শেষপর্যন্ত স্থানীয় লোকদের সহায়তায় গাড়িটা পার্ক করতে পারল। সামনেই "বৈসাবি উৎসব" লেখা বিরাট বড় গেট। নিজস্ব ভঙ্গিতে সাজানো জায়গাটা খুবই চমৎকার লাগছে। গাড়ি থেকে নামতেই অন্যরকম আনন্দে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। চারিদিকে কী সুন্দর মিলনমেলার আয়োজন! জায়গাটা তো ভারি সুন্দর! সেলিম যখন গাড়িটা ঘুরিয়ে জিদানকে আনতে ছুটল, শাওলিন তখন পা চালিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছে। চারিদিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো প্রতিটি সৌন্দর্য আবিষ্কার করতেই বুঝতে পারল, এরা গুলশান-বনানীর মতো কৃত্রিম সৌন্দর্যে বিশ্বাসী না। বরং, নিজেরা নিখুঁত শিল্পগুণে পারদর্শী। একটা বাঁশের স্টলে কাঠ দিয়ে বানানো হরেক জিনিসপত্র দেখছিল ও। হাতে তুলে নিয়েছিল ছোট্ট একটা কাঠের বাক্স। বাদামি কালচে কাঠের রঙ, কাঠের বুকে নিখুঁত নকশা, সোনালি ছোট্ট লকটা খুলে বাক্সটা পুরোপুরি উন্মুক্ত করল শাওলিন। ভেতরে ফাঁপা স্থান। কিছু যত্নে গড়া জিনিস সেখানে লুকিয়ে রাখা যাবে। ঠিক যেন বুকের মধ্যে আবদ্ধ সিন্দুক। যে সিন্দুকে কত কথা, কত স্মৃতি, কত গল্প, কত আকাঙ্ক্ষাই যে লুকোনো! সেই সিন্দুক খোলার চাবিটা কে কবে পেল? বাক্সটা বন্ধ করে আগের জায়গায় রেখে দিল। দোকানি মেয়েটা টানা সুরে বোঝাতে চাইল,
- আপনি এটা নিতে পারেন। এটা আমাদের নিজস্ব হাতে বানানো জিনিস।
শাওলিন বাক্সটা না নিয়ে বরং একটা কলম নিল। কাঠেরই কলম। দাম মিটিয়ে ব্যাগের চেইন আঁটকে যেই পিছু ঘুরতে যাবে, ঠিক তখনই দু পা পিছিয়ে যেতে হল। আশ্চর্য-বিমূঢ় চাহনি ছুঁড়ে কপালে কটা কুঞ্চন ফেলে বলল,
- আপনি . .?
শোয়েব ওর কুঞ্চিত কপালে চোখ বুলিয়ে ওর চোখে চাইল,
- আমিই।
উত্তরের ধরণ শুনে চোখ নিচে নামাল ও। বোকার মতো প্রশ্নটা হয়েছে না? আপনি বলতে আবার কী বোঝাচ্ছে? শাওলিন নিজেই নিজেকে দুদণ্ড বকে মাথা উপরে তুলে বলল,
- দুঃখিত, ওভাবে বলার ইচ্ছে ছিল না। আপনি হঠাৎ আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাই রিয়েক্টটা ওরকম হয়ে গেছে। স্যরি।
- সমস্যা নেই। মনে হচ্ছে তুমি কিছু কিনেছ?
শাওলিন মাথা উঁচু করে উঁচু লোকটার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। পরক্ষণে চোখ নামিয়ে হাতের মুঠোটা সামনে বাড়িয়ে ধরল। শোয়েব দেখল, ওই ছোট মুঠোটার ভেতর একটা কলম। বার্নিশ করা মসৃণ কাঠের তৈরি। ওটা দেখে মৃদু হেসে পুনরায় ওর দিকে তাকাল সে,
- মানুষ এখানে এলে বড়সড় জিনিস কিনে, তোমাকে দেখছি সবচেয়ে অ্যাভেইএবেল জিনিসটা কিনে নিলে। কলম নিশ্চয়ই দেশের সর্বত্র অ্যাভেইএবেল।
- আমার দূর্লভ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ নেই। যেটাকে হাতের কাছে পাব না, পেয়ে গেলেও যন্ত্রণা, হারানোর ভয়ে সবসময় চিন্তা হবে; তা নিয়ে আকাঙ্ক্ষা রাখার মানে হয় না। সহজলভ্যই ভালো। যখন-তখন প্রয়োজনে কিনে রাখতে পারব। হারানোর ভয়ে দুশ্চিন্তা হবে না।
কথার চমৎকার ভঙ্গি শুনে কিঞ্চিত হাসলো শোয়েব। চোখদুটো শাওলিনের পেছনে থাকা দোকানি মেয়েটার দিকে পড়ল। সেই মেয়েটাও ওর কথা বুঝতে পেরে হাসছে মিটিমিটি। শোয়েব চোখ ফিরিয়ে পুনরায় ওর কাজল-কালো গভীর চোখদুটোতে দৃষ্টি মিলিয়ে বলল,
- সহজলভ্য জিনিস সাময়িক প্রয়োজন মেটানোর পন্থা। কিন্তু দূর্লভ জিনিস জীবন গোছানোর কারিগর। যতদিন মানুষ দূর্লভকে নিজের কাছে আঁকড়ে রাখে, ততদিন পর্যন্ত সেই মানুষ মূল্যবান। যেদিন থেকে দূর্লভকে ছেড়ে দিল, সে নিজের কার্যকারিতা হারাল। তুমি যথেষ্ট ছোট ইয়াং লেডি। জীবনকে যে দৃষ্টিতে ভাবছ, ওটা ততটা কঠিন নয়। একটু সহজ হও। নিজেকে নরম করো। আজ এ প্রসঙ্গে কথা বাড়াতে চাই না। তোমাকে এখন বেরোতে হবে।
শেষ দুটো বাক্য ছুঁড়ে কথা এখানেই স্থগিত করল শোয়েব। চাপা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল তার পিছু চলে আসতে। গমন অভিমুখে হাঁটা দিতেই নিঃশব্দে তার পিছু পিছু অনুসরণ করল শাওলিন। সামনে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছিল, গাঢ় সবুজ রঙের শার্টটা, যার কাঁধের কাছে শার্টটা ঘামে ভিজে গেছে। বাঁ কাঁধের পেশিপুষ্ট জায়গাটা স্ফীত এখনো। ফোলা ভাবটা কমেনি একচুলও। দৃষ্টিটা সরিয়ে চুপচাপ হাঁটা দিল শাওলিন। গেট ডিঙিয়ে বাইরে বেরুতেই ঘুমন্ত কালচে সবুজ জীপটাকে দেখতে পেল। একবার ভাবল, সরাসরি বলবে হুড খোলা জীপে ওর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ নেই। পরক্ষণে লোকটাকে ড্রাইভিং সিটে চড়তে দেখলে নিজের মতটাকে রদবদল করল। ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটটাতেই উঠে বসলো শাওলিন। বন কর্মকর্তার নিজস্ব জীপে, তার পাশের আসনটাতে। শোয়েব জীপের স্টিয়ারিং খামচে ইঞ্চিন স্টার্ট দিতেই একবার বাঁয়ে চাইল।
- ঠিকভাবে বসতে পেরেছ?
শাওলিন পুরোপুরি শক্ত হয়ে বসেছিল। কথাটা শুনে ডানদিকে চাইল। ও নিজেও জানে না এই ভয়ংকর বাহনে কীভাবে ব্যালেন্স হবে। কীভাবে হাতের গ্রিপ অটুট রাখবে। তবু মাথাটা 'হ্যাঁ' ইঙ্গিতে নাড়িয়ে নীরব উত্তরটুকু বুঝিয়ে দিল,
- ঠিক আছে।
শোয়েব দেরি করল না আর। স্টিয়ারিং ঘুরাতেই সশব্দে গর্জন ছেড়ে জীপটা ছুটতে আরম্ভ করল। ওরা তখনো জানতো না, কী ধেয়ে আসছে পেছন থেকে। কী সমস্যাটা ছুটে আসছে পেছন পেছন। শোয়েব শুধু একবার জীপের সাইড মিররে চোখ ফেলল। কিন্তু শান্ত মুখে কোনো চিন্তার খাঁজ পড়ল না। তার বাঁহাত স্পিড বাড়ানোর থ্রটলে স্থির, ডানহাত স্টিয়ারিংয়ে ব্যস্ত। যে করেই হোক, আর্মি এসকোর্ট পর্যন্ত পৌঁছুতেই হবে! সেটা যে করেই হোক!
.
.
.
চলবে.......................................................................