রুশা রুমে ঢুকে ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখলো। মিনমিনে গলায় বললো,
"আবার নিশ্চয়ই কিছু না কিছু করে বসেছিস।"
তারপর হঠাৎ করেই গলার জোর বাড়িয়ে বললো,
"যা, বাবা ডাকছে! বাবা ডাকলে মানে বকা খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যা।"
আরণ্যক টেবিলে মাথা রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রতিদিন এই এক ঝামেলা! কবে যে নিজের মতো করে একটু শান্তিতে বাঁচতে পারবে সেই আশায় বুক বাঁধে সে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। মুখ গোমড়া করে এগিয়ে গেল বসার রুমের দিকে। সেখানে, সোফায় বসে সকালবেলার খবর দেখছিলেন শামীম সাহেব। চশমার কাচে টিভির আলো ঝিলমিল করছে। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি আরও গভীরে কিছু খুঁজছে।
আরণ্যক দাঁড়িয়ে থেকেই বললো,
"কী জন্য ডাকছিলে?"
শামীম সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন,
"বসো।"
বাধ্য ছেলের মতোই পাশে এসে বসে পড়ে আরণ্যক। দুজনেই চোখ রাখে টিভির দিকে। কিন্তু মন যে ঠিক সেখানেই নেই তা তো বুঝে নেওয়াই যায় নিঃশব্দ দমবন্ধ পরিবেশে।
হঠাৎই শামীম সাহেবের কণ্ঠে তীক্ষ্ণতা বাড়ে,
"কি চিন্তা করেছো? বাসা কবে ছাড়ছো?"
এক ঝটকায় আরণ্যকের শরীর কেঁপে ওঠে। সে টিভির দিকে চেয়ে থাকলেও তার মাথার ভিতর বজ্রপাত হচ্ছে।
আরণ্যক চমকে চোখ ঘুরিয়ে নিজের বাবার দিকে তাকালো। শামীম সাহেব পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে টেবিলে রাখলেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
"আমার পরিচিত একজনের নাম্বার। যোগাযোগ করো। ইন্টার্নশিপের জন্য প্রস্তুতি নাও। এই কোম্পানিতে চাকরি করা অনেক গর্বের ব্যাপার। কথাবার্তা বলে দেখো কীভাবে কি করতে হবে। আশা করি সমস্যা হবে না ইন্টার্নশিপ পেতে। তোমাদের ভার্সিটি তো এখন থেকেই বাচ্চাদের বলে ইন্টার্নশিপে ঢুকতে, তাই না?"
আরণ্যক মুখ না তুলেই মাথা নাড়লো।
"তাহলে প্রস্তুতি নাও। উল্টাপাল্টা সময় নষ্ট থেকে বিরত থাকো। এই সময়ে ছেলেরা ভার্সিটিতে কম যায় দরকার ছাড়া। তুমি ও তাই করবে। লাইফে বড় হতে হলে, ভালো চাকরি পেতে হলে যেটা করা উচিত, সেটাই করবে। ঠিক আছে?"
আবারও মাথা নাড়লো আরণ্যক। কিন্তু ভেতরে শব্দ করে ভেঙে পড়লো কিছু একটা। আরণ্যকের বাবা আবারো বললো,
"বড় হচ্ছো। বয়স বাড়ছে আর কত বোনের দেওয়া টাকায় চলবে? বোনের ও বিয়ে হবে। তখন কি তোমায় সে এতো দিতে পারবে? এতো খেয়াল রাখতে পারবে? আমার ও শরীরের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। কয়েক দিন আমি অসুস্থ। জানোই তো? নাকি জানো না? হ্যাঁ, নিজের বাবার উপর তো আবার কোনো খেয়াল নেই তোমার। বাইরে ঘুরোঘুরি ছাড়া আর কিইবা পারো!"
আরণ্যক কার্ডটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। হাঁটতে হাঁটতে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো সে। আসলেই অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলেছে মানুষের চক্করে। কিন্তু এসব কাজে তো তার মন সায় দেয় না যেসব তার বাবা করতে বলে। কি করা উচিত আসলে? চিন্তায় চিন্তায় জীবনটা অতীষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
******
কৌশিক ব্রেকফাস্টের জন্য নিচে এসেছে। সকালের নরম আলোয় টেবিলে বসে রুটির টুকরো কামড়ে খেতে খেতে হঠাৎ বলে উঠলো,
"ফিজিক্স রিলেটেড আরো বই থাকলে ভালো হতো।"
নুহাশ হাত থামিয়ে তাকালো। বলে উঠলো,
"ফিজিক্স নিয়ে কি করবে?"
"ভাবছি পড়াশোনা করে চাকরি বাকরি করবো ।"
নুহাশের কপাল কুঁচকে গেল।
"তোমার তো পড়াশোনা আছেই। তুমি ইংরেজিতে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছো।"
"ইংরেজি?"
কৌশিক চমকে উঠলো। মুখটা একদম ফ্যাকাশে হয়ে গেল তার।
মেহজাবিন বেগম খাবার খেতে খেতে একটু আনমনেই বলে উঠলেন,
"বই লাগলে কিনে নিয়ে আসো। ওইটা কোনো ঝামেলা না। কিন্তু তোমার তো আমার বাবার বিজনেসে বসার সুযোগ আছে। তাই শুধু শুধু এতো কষ্ট করে পড়াশোনা করার কি দরকার? আমি আগেও তোমাকে বলেছিলাম এতো না পড়তে। এখনো বলছি তোমরা দুই ভাই আমাদের পারিবারিক বিজনেসে ঢুকবে। সেটা বড় করবে, নাম কামাবে। সেটাই আমাদের স্বপ্ন।"
কৌশিক থেমে গেল। চামচটা প্লেটে নামিয়ে ধীরে ধীরে বললো,
"কিন্তু মা, ওটা তো তোমার স্বপ্ন। আমার নয়।"
মেহজাবিন চমকে তাকালেন ছেলের দিকে।
"তুই কি বলতে চাইছিস? এই বিজনেস তোকে কোথায় কোথায় নিয়ে যেতে পারবে জানিস?"
"জানি না কিন্তু আন্দাজ করতে পারছি। তবে আমি কোথায় যেতে চাই সেটা তুমি জানো না, মা। আমার যেটাতে মন আছে, যেটাতে আমি আনন্দ পাই আমি সেটাই করতে চাই। আর সেটা বিজনেস নয়।"
"কি করতে চাইছিস তুই?"
"আমার যে সাবজেক্ট ভালো লাগে সেই সাবজেক্টে আমি মাস্টার্স শেষ করে টিচিং প্রফেশনে যেতে চাই।"
মেহজাবিন বেগম খাবার খাওয়া থামিয়ে বললো,
"আবারো পড়াশোনা?"
"হুম! কিছু তো করতে হবে তাই না? আচ্ছা যাই হোক আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। আমার খাওয়া শেষ।"
"গাড়ি নিয়ে বের হ, ইশু। নুহাশকেও নিয়ে যা। একা একা রাস্তায় বের হলে আবারও কোনো দুর্ঘটনা হবে।"
কৌশিক উঠে টিস্যু দিয়ে হাতটা মুছে বললো,
"ডোন্ট ওরি! আমার কিচ্ছু হবে না, মা।"
মেহজাবিন বেগম চামচ আওয়াজ করে রেখে বললেন,
"আমি অফিসে যাচ্ছি। তুই আমার সাথে চল। কোথায় নামবি আমিই নামিয়ে দেবো।"
কৌশিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের কাছে এসে নিচু হয়ে বসল। মেহজাবিন বেগমের কোলের ওপর হাত রেখে নরম কণ্ঠে বলল,
"মা… আমি এখন অনেক বড় হয়েছি। কিন্তু তোমার চোখে এখনো আমি সেই ছোট্ট ছেলেটা। তুমি এমন করে আগলে রাখতে চাও যে আমার এখনো পৃথিবীর কিছু জানা নেই। বাইরের কেউ দেখলে ভাববে এই ছেলেটা বুঝি জীবন বুঝতেই শেখেনি। কিন্তু মা, আমি একটু নিজে পথ খুঁজে নিতে চাই।"
মেহজাবিন বেগমের চোখ কেঁপে উঠল। ঠোঁটটাও কেঁপে উঠল। তিনি গলা শক্ত রেখে বললেন,
"তুই বুঝবি না, কৌশিক। তোকে আর তোর বাবাকে একসাথে শেষ করে দিতে চেয়েছিল কেউ। তোর বাবার আর বাঁচার উপায় ছিল না। আমি… আমি তো আমার ভালোবাসাকে হারিয়েছি। এখন যদি তোদের কাউকে আবার হারাই, আমি আর বাঁচবো না। শুধু নিঃশ্বাস নেব, কিন্তু বাঁচবো না।"
কথা শেষ হতেই তাঁর চোখ দুটো ভিজে উঠল। কৌশিক মায়ের হাত চেপে ধরল, গলা কাঁপছে তার।
এই সময় নুহাশ উঠে এসে মায়ের অন্য পাশে বসে পড়ল। শাড়ির ভাঁজে আলতো করে হাত রেখে মাথা নিচু করে বলল,
"মা, আমরা দুজনেই কথা দিচ্ছি নিজেদের যত্ন নেব। তুমি শুধু আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখো। তুমি এত চিন্তা করলে শরীর খারাপ হবে। আমরা চাই না তোমার চোখে একটুও পানি আসুক।"
মেহজাবিন বেগম কান্নাভেজা চোখ নিয়ে নুহাশের দিকে তাকালো। কৌশিক মাথা নেড়ে বলল,
"নুহাশ একদম ঠিক বলেছে, মা। আমরা নিজেদেরকে সুরক্ষিত রাখব। আর জানোই তো বাঁচা-মরার হিসেব তো কারও হাতে নেই। সবটাই ওনার লেখা। তাই তুমি অযথা চিন্তা করো না। তোমার তো স্ট্রেসের সমস্যা। এইভাবে চিন্তা করলে আবার ডাক্তার দেখাতে হবে।"
মেহজাবিন বেগম হেসে উঠলেন,
"তোর মুখে এসব শুনতে ভালো লাগছে, কৌশিক। ভাবতেই পারিনি তুই আমার চিকিৎসার কথাও মনে রাখিস।"
কৌশিক মায়ের দিকে স্নেহভরে তাকিয়ে বলল,
"মনে রাখার চেষ্টা করছি, মা। এখন থেকে সব মনে রাখব। তোমার দুঃখ, তোমার স্বপ্ন, তোমার ভয় কিছুই ভুলে যাব না। আর আমি তো আছি, আর নুহাশও তো আছে। ও পারিবারিক বিজনেসে বসবে। ওর পড়াশোনাও তো সেদিকেই। ও খুব ভালোভাবে সব সামলে নেবে। ও অনেক বেশি শক্ত, অনেক বেশি বাস্তববাদী।"
নুহাশ পাশে বসেই হালকা হেসে বলল,
"আমি আছি মা। সব ঠিকভাবে করব। কিন্তু তুমিও আমাদের একটু বিশ্বাস করতে শিখো। আমরা ছোট নেই আর।"
মেহজাবিন বেগম চোখের কোনে জমে থাকা অশ্রু লুকাতে চেষ্টা করলেন। আর মুখে ধরা দিলো মিষ্টি হাসি। দুজনেই জড়িয়ে ধরলো মাকে। মেহজাবিন বেগম ও দুই হাত দিয়ে ছেলেদের জড়িয়ে ধরলেন।
সকালে বের হওয়ার পরিবর্তে বিকেলের দিকে বেরিয়েছে কৌশিক। ঠিক সেদিনের মতো আবারো হাঁটতে বেরিয়েছে। গন্তব্য ঠিক নেই। লক্ষ্য আশেপাশের রাস্তা ঘাট চেনা। আর বিশেষত আশেপাশে কোনো লাইব্রেরী বা বইয়ের দোকান আছে কিনা তাই দেখা। রাস্তাগুলো আজ একটু বেশি আপন মনে হচ্ছে। গলির মোড়ে চা-ওয়ালার হাঁড়ির ধোঁয়া ধীরে ধীরে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। পাশের দোকানে টিভিতে গানের হালকা সুর বেজে চলেছে। পুরনো দিনের কোনো গান মন ভালো লাগায় ভরিয়ে দিচ্ছে। চারপাশটা চুপচাপ নয়, আবার ঠিক ব্যস্তও নয়। মাঝামাঝি এক শান্ত আবহে ঘেরা সবকিছু।
পাখিরা ঘরে ফিরছে, রোদের আভা ধীরে ধীরে হালকা কমলা রঙে বদলাচ্ছে। গলির পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ করেই কৌশিকের চোখ পড়লো এক পুরনো বইয়ের দোকানে। তেমন বড় না। কিন্তু জানালার কাঁচের ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে সারি সারি বইয়ের স্তূপ। দোকানের নামটা কাঠের একফালি ফলকে আঁকা। কৌশিক মাথা হেলিয়ে নামটা পড়লো, বইয়ের সুপার মার্কেট।
কাছে দূরেই একটা বইয়ের দোকান পেয়ে একটা অদ্ভুত ভালো লাগা ভর করলো কৌশিকের মনে। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো দোকানটির দিকে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই কেমন একটা ঘ্রাণ পুরনো কাগজের। মনে হলো শত শত গল্প আর ইতিহাস মিশে এক গভীর সুবাস তৈরি করেছে। ভেতরে ছোট্ট এক ঘর। সে ঘরের পাশেও আরেকটা ঘর ছিল। ছিল দেয়ালজুড়ে তাকভর্তি বই আর দুই থেকে তিনটা কাঠের আলমারি। সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন সবই একে অপরের পাশে ঠেসে বসে আছে। কিছু বইয়ের পাতা ভাঁজ হয়ে গেছে। কিছু আবার এতটাই নতুন যে ছাপার কালি এখনো তাজা।
কৌশিক একটুখানি থেমে চারপাশটা দেখতে লাগলো। ঝুলন্ত এক বাতির নিচে বসে আছেন দোকানদার। বয়সে প্রবীণ, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, ঠোঁটে অল্পসল্প হাসি।
কৌশিক ধীরে ধীরে পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করলো। তাতে কিছু বইয়ের নাম লেখা ছিল যেগুলো সে আগে থেকেই ফোন ঘেঁটে বের করে রেখেছিল।
সে দোকানদারের দিকে কাগজটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
"এই বইগুলো খুঁজছিলাম। যদি থাকে, একটু দেখে দিন?"
দোকানদার উঠে আসলো। চশমা নামিয়ে লেখাগুলো পড়লো। অতঃপর জোর গলায় বললো,
"বিট্টু। এই বিট্টু! ওই বন্ধ আলোমারিটা খুল তো।"
কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
"আপনি বসুন।"
কৌশিক ধন্যবাদ জানিয়ে পাশে রাখা কাঠের বেঞ্চে বসে পড়লো। বেঞ্চের এক কোণে কিছু পুরনো দেশ পত্রিকা, কিছু সাহিত্য সাময়িকী রাখা। বাতাসে ধুলো মেশানো বইয়ের ঘ্রাণ, পেছনের জানালা দিয়ে আসা হালকা বাতাসে পর্দা একটু দুলে উঠলো। এই পর্দাগুলোর কারণেই বাইরের রাস্তার কোলাহল এ দোকানের ভেতরে পৌঁছাতেই পারে না। ভেতর থেকে একটা ছোট ছেলে ছুটে আসলো। কৌশিক চোখ ঘুরিয়ে আবার তার দিকে নজর দিল। বয়স হবে বারোর মতো। আন্তাজ করলো কৌশিক ই। ছেলে আলমারি খুলতেই দোকানদার এগিয়ে কিছু বই নামাতে লাগলো। কয়েকটা বই বের করে উল্টে পাল্টে দেখে কৌশিকের দিকে এগিয়ে আসলো। কৌশিকের দিকে আগ বাড়িয়ে বই গুলো দিলো। কৌশিক ও পছন্দমত বইগুলো পেয়ে বেশ খুশিই হলো। সে জিজ্ঞেস করলো," কত হয়েছে?"
দোকানদার কিছু না বলে প্যাকেট নিয়ে আসলো। কৌশিক ভ্রু কুঞ্চিত করে ফেললো। প্যাকেটে বইগুলো ভরে টাকার পরিমাণ জানালো। টাকাটা বের করে দোকানদারের দিকে বাড়িয়ে দিলো কৌশিক । ঠিক তখনই পাশের দিক থেকে এক অচেনা কণ্ঠ হঠাৎ ছেদ ফেললো এই মুহূর্তকে।
“কৌশিক স্যার?”
কৌশিক থমকে গেলো। ধীরে ধীরে সে পেছন ফিরলো। চোখে পড়লো একটা অপরিচিত মুখ উস্কো-খুসকো চুল, ধূসর টিশার্ট, কালো প্যান্টের এক যুবক। চিনতে পারলো না ছেলেটিকে। ছেলেটা এগিয়ে এসে বললো,
"স্যার আপনি তো দেখছি একদম সুস্থ স্বাভাবিক আছেন। তাহলে অনন্যাকে কেনো রেখে চলে গেলেন?"
কৌশিক উচ্চারণ করলো,
"কে অনন্যা?"
"কি বলছেন? অনন্যা আপনার মানে..... আপনার স্ত্রী হয় ও।"
কৌশিক অবিশ্বাসের সাথে বললো,
"আপনি কে?"
"কী? আমি তো আরণ্যক! আপনার স্টুডেন্ট!"
"স্টুডেন্ট? আমি কি কাউকে পড়াতাম নাকি?"
আরণ্যকের মাথা ঘুরে যাচ্ছে কৌশিক স্যারের সাথে কথা বলতে বলতে। সে স্যারের দিকে এক পা এগিয়ে বললো,"আপনি কি সব ভুলে গেলেন? আপনি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। আপনি অনেক অনেক ছাত্রছাত্রীকে পড়াতেন।তার মধ্যে আমিও ছিলাম আর অনন্যাও।"
কৌশিক নিজের কপালে হাত চেপে ধরলো। একটা অস্থিরতা, এক ধরনের দহন ভিতর থেকে তাকে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। নিঃশ্বাসগুলো ভারী হয়ে উঠছে তার। বুকের ভিতর বাতাস ঢোকার আগেই কোথাও আটকে যাচ্ছে। চোখ দুটো নামিয়ে নিল সে। মাটির দিকে নিজের পড়ে থাকা ছায়ার দিকে তাকালো কৌশিক যেটা এখন আর চেনা মনে হচ্ছে না। হাত থেকে ধীরে ধীরে পড়ে গেলো বইগুলো, একটা একটা করে শব্দ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। প্রতিটা শব্দ তার মনে পড়া ভুলে যাওয়া ইতিহাসের পাতার মতো ধাক্কা দিচ্ছিল।
চারপাশে একটা নিঃস্তব্ধতা নেমে এলো। দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কেউ কিছু বলছে না। কৌশিক আচমকাই বলে উঠলো,
"নিয়ে যেতে পারবে আমাকে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে?"
আরণ্যক কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল। বুঝতে পারলো কিছু একটা তো নিশ্চিত হয়েছে কৌশিক স্যারের।
******
অনন্যা বারান্দায় বসে নরম বাতাস খাচ্ছে। গরমের মধ্যে এই একটু বাতাস ও যেন স্বর্গের মতো মনে হয়। মন ফুরফুরে করে দেয়। কিন্তু সবসময় ভালো লাগে না। ওই যে মন যখন খারাপ থাকে তখন কিছু ভালো লাগে না। এই বাতাস ও তখন আগুন মনে হয়। কৌশিক স্যারকে দেখার পর থেকেই মনটা ভালো হয়ে গেছে অনন্যার। সে জানে কোনো না কোনো উপায়ে আবারো তাদের দেখা হবে। সেই সুযোগ একদম অনন্যা হারাতে দেবে না। কৌশিক স্যারকে তার কাছে ফিরতেই হবে।
অনন্যার মা বারান্দায় এসে বললেন,
"শোন, অনন্যা।"
অনন্যা মাথা ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
"হ্যাঁ বলো।"
"আমাদের পনের দিনের জন্য ফিরে যেতে হবে। আমাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। সব ঠিকঠাক করে আবার আসতে হবে।"
অনন্যা বুঝতে পেরে বললো,
"তাহলে কবে যাচ্ছো? কোনো সাহায্য লাগলে বলো।"
"আমরা তোকে বলতাম এই বিষয়ে। কিন্তু তোর অবস্থা দেখে কীভাবে বলতাম বুঝতে পারছিলাম না। এজন্য আর বলা হয়নি। নোহারাকে বলবো তোর সাথে থাকতে।"
অনন্যা উঠে দাঁড়ালো। হেসে বললো,
"আমি কী কিছু বলেছি? তোমরাও না কি সব অদ্ভুত আচরণ করো। তোমাদের ভিসার মেয়াদ শেষ। এখন কি জোর করে ধরে রাখতে পারবো? নোহারাকেও বলার দরকার নেই। ওর কাজ থাকে, সবসময় এসে তো আর থাকতে পারবে না। আমি আর ওকে বিরক্ত করতে চাই না।"
অনন্যার মা এগিয়ে এসে বললো,
"আরে বিরক্ত করার কী আছে? মেয়েটা তোর সাথে এসে থাকবে। দুজনে মিলে রান্না করবি। খাবি এই তো!"
"আহা, মা! বাদ দাও তো। তোমরা কবে যাচ্ছো এটা বলো!"
"পরশু দিন। এরপর থেকে তো তোর ক্লাস ও শুরু হয়ে যাবে। যাক ভালোই হলো। কাজে কামে থাকবি। সময় এমনিতেই কেটে যাবে।"
অনন্যা হাসার চেষ্টা করে বললো,
"হুম। আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করো না।"
"তোকে নিয়ে এতো চিন্তা নেই। চিন্তা তো তোর পেটে বাড়ন্ত শিশুকে নিয়ে।"
"মা!"
অনন্যা মুখ ফুলিয়ে ফেললো।
পল্লবী হেসে ফেললেন। অনন্যাকে নিয়ে রুমে আসলেন। মেয়েকে বিছানায় বসিয়ে বললেন,
"সামনে তোর বাবাও আসছে। পরে সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।"
অনন্যা ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
"কীসের সিদ্ধান্ত?"
পল্লবী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
"পাত্র খোঁজার।"
·
·
·
চলবে......................................................................................