হসপিটাল থেকে ফিরে শুয়ে আছি, কিছুই ভালো লাগছে না। সেই যে মানসীর বাসায় গিয়ে দেখা করে এসেছিলাম তারপর ৬টা দিন পার হয়ে গেছে। ওর সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি। একবার কথাও হয়নি। কী যে কষ্ট হচ্ছিল কাউকে বোঝানো সম্ভব না। কখনো কল্পনায়ও ভাবিনি এরকম কোনোদিন আসতে পারে। অনেকবার শুনেছি একটা কথা…জীবনের একটা সময়ে খুব কষ্ট করলে বাকিটা জীবন সুখের হয়। আমার হয়েছে উল্টো। সুখের কি কোনো সীমা ছিল? এত এত সুখ করে ফেলেছিলাম যে বাকিটা জীবন পাহাড়সমান কষ্ট সইতে হবে!
পায়ের আওয়াজ শুনতে পেয়ে ফিরে তাকাতেই মাকে দেখতে পেলাম। মা একটা কাগজ এগিয়ে দিল। কাগজটা খোলার পর মনে হলো বুকের ভেতর ছুরি বসিয়ে দিয়েছে কেউ। ডিভোর্স পেপার, মানসী সাইন করে দিয়েছে। কেন করল? কেন আবার? মা নিশ্চয়ই ওর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সাইনটা আদায় করেছে। আমি মাকে বললাম,
“মা প্লিজ আমাকে খুলে বলো না কেন এমন করছ? কী হয়েছে?”
“কিছু হয়নি তো। এই নে এখানে সাইনটা কর।”
“মা আমি মানসীকে ডিভোর্স দেব না।”
“তা বললে তো হবে না বাবা, মানসী তোকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে, এবার তুইও দে।”
“মানসী একটা ভিন্ন মানুষ, আমি একটা ভিন্ন মানুষ। ওর যা ইচ্ছে হয়েছে ও করেছে, আর আমার যা ইচ্ছে হবে আমি তাই করব।”
মা কিছু না বলে ডিভোর্স পেপার আর কলম এগিয়ে দিল আমার দিকে। আমি মায়ের হাত থেকে ওগুলো নিলাম। কাগজটা ছিঁড়ে ফেলে বললাম,
“আমি মানসীকে ডিভোর্স দেব না আর অন্য কাউকে বিয়েও করব না। ডিসিশান ফিক্সড এন্ড ফাইনাল।”
“আর একবার জিজ্ঞেস করছি, ভেবে বল।”
“একবার কেন আর একশ বার জিজ্ঞেস করলেও আমি এই একই কথা বলব মা।”
মা কথা না বাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আমি চুপচাপ বসে ভাবছিলাম এত কষ্ট হচ্ছে, বুকের মধ্যে পাথর জমে আছে তবুও কাঁদতে পারছি না কেন? কাঁদলে নিশ্চয়ই একটু হালকা হতে পারতাম। মেয়েদেরই ভালো। কিছু থেকে কিছু হলেই কান্না আর সবকিছুতে জয়! হঠাৎ খুব হৈচৈ-এর আওয়াজ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। এর মধ্যেই অনন্যা ছুটতে ছুটতে এল। কাঁদতে কাঁদতে কি যে বলল কিছুই বুঝলাম না। মায়ের ব্যাপারে কিছু বলছে বুঝে দৌড়ে গেলাম মায়ের ঘরে। গিয়ে দেখি মা ফ্লোরে পড়ে আছে। রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
মাকে হসপিটালে নেয়া হলো। মা তখন ছিল বাঁচামরার মাঝখানে। অনেক রক্ত লেগেছিল। মায়ের রক্তের গ্রুপ ছিল সৌরভ, মানসী আর খালামণির। ওরা রক্ত দিল। কিন্তু তাতেও হলো না। তারপর আমার আর সৌরভের কিছু বন্ধুদের সাহায্যে রক্ত জোগাড় করা হয়েছিল। উফ সে কী দুর্বিষহ পরিস্থিতি। কারণ আমি জানি এবং সবাই জানে যা ঘটল তা শুধু আমার জন্যই ঘটলো।
আমি হসপিটালের লবিতে বসে ছিলাম। মানসী কোত্থেকে এসে আমার পাশে বসল। তারপর বলল,
“কেন আর এমন করছ বলো? আমরা দুজন দুজনের জন্য না। মেনে নাও না এটা।”
“আমি মানতে পারছিলাম না।”
“আশা করি এখন মানতে পারবে।”
“মা যে এমনটা করবে আমি ভাবতেও পারিনি। আর তুই… তুই আমাকে ডিভোর্স দিলি কোন সাহসে?”
“এছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না তখন।”
আমি কিছু বলার আগেই মানসী আমার হাত ধরে বলল,
“তুমি বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যাও। তোমার পায়ে পড়ি।”
“কী বলছিস তুই?”
“তুমি একদিন আমাকে বলেছিলে না তুমি তোমার মাকে আমার থেকেও বেশি ভালোবাস? আমার তো সেদিন খুব গর্ব হয়েছিল। আজ কেন অন্যথা করছ? আজ খালামণির কিছু একটা হয়ে গেলে সব দোষটা তো তোমার উপরেই এসে পড়বে। তোমার ওপর কেউ আঙুল তুললে আমি সহ্য করতে পারব না। আর খালু কতটা ভেঙে পড়েছে দেখেছ? জীবনের জন্যই তো ভালোবাসা। ভালোবাসার জন্য তো জীবন না।”
“আমি বুঝতে পারছি না আমি কী করব!”
“অনেক মিরাকল তো ঘটে। সবটা ছেড়ে দাও না আল্লাহর হাতে। হয়তো আমার কপালে তুমি নেই। আর যদি আমার কপালে তুমি থাকো শেষ মুহূর্তে হলেও আমি তোমাকে পাব।”
সেবারের মতো আর মানসীর আমাকে পাওয়া হলো না। মা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে এল। তারপর চুপচাপ ঘরোয়াভাবে কজন আত্মীয়স্বজন নিয়ে আমি মায়ের পছন্দ করা মেয়ে দিতিয়াকে বিয়ে করলাম।
বিয়ের রাতে দিতিয়াকে বললাম,
“আমি তো আপনাকে বিয়ের আগেই বলেছিলাম সব। আমি শুধু মায়ের জন্য বিয়েটা করেছি। হ্যাঁ, মানসীর সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু আমি ওকে ভালোবাসতাম, আজীবন ভালোবাসব। আমার কাছ থেকে আপনি প্লিজ কিছু আশা করবেন না।”
দিতিয়া মাথা নিচু করে আমার সব কথা শুনল। কথাগুলো বলে আমি বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। ও ডাকল,
“শুনুন।”
আমি ঘুরে তাকালাম। ও বলল,
“আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি নিরুপায় ছিলাম। আমার যদি ক্ষমতা থাকত তাহলে আমি এই বিয়েটা করতাম না।
ওর কথা শেষ হতেই আমি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। বাইরে গিয়ে মেইন গেটের সামনে গিয়ে মনে হলো পেছন থেকে কেউ আমায় ডাকছে। আমি উপরের দিকে তাকাতেই যে দৃশ্য দেখতে পেয়েছিলাম তা মনে পড়লে আজও বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। মানসী বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওড়নায় মুখ চেপে কাঁদছে। ও এত দিন যত তুচ্ছ কারণেই কাঁদুক না কেন যখনই কাঁদত আমি বুকে জড়িয়ে ধরতাম, চোখ মুছে দিতাম। কত আদরই না করতাম। আর আজ সত্যি অনেক বড় কারণে কাঁদছে। কিন্তু আমি দূর থেকে দেখছি শুধু। আমি কি অমানুষ! সেই মুহূর্তেও একটু কাঁদতে পারিনি।
·
·
·
চলবে........................................................................