অদ্রি-অৰ্পি দুজনেই কাঁদছিল। অদ্রি ডায়েরিটা অর্পির হাত থেকে নিয়ে বলল,
“আর পরব না,”
অৰ্পি কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
“কেন? শেষটা না জানলে মরেই যাব।”
“শেষই তো। কীভাবে মানসী আন্টির বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তা তো জানলামই। যার বিয়ে হয়ে গিয়েছে তার জন্য তো আর বসে থেকে লাভ নেই। তাছাড়া সে তো বলল, ‘দিতিয়াকে ছেড়ো না’ তাই চাচ্চুর সাথে চাচির ডিভোর্সটা আর হয়নি।”
“হ্যাঁ, কিন্তু চাচির সাথে ভালোবাসা কী করে হলো, সেটা জানব না? তাছাড়া ডায়েরিটাতে তো আরো কত কী লেখা আছে। আমি সবটা না পড়লে শান্তি পাব না।”
“তাহলে তুই একাই পড়। আমি আর পারছি না। আমার নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে।”
“সত্যি আপ্পি, আমারও বুকের মধ্যে কেমন জানি করছে! কী অদ্ভুত ভালোবাসা ছিল ওদের। ভালোবাসা যে এমন হয় আমি জানতাম না, অথচ ভাবতাম ভালোবাসার সবই বুঝি আমি।”
“এটা না পড়লে জানতামই না ভালোবাসা কী! কী করে ভালোবাসতে হয়! কিন্তু আমার আর ক্ষমতা নেই এসব নেয়ার মতো। পাগলের মতো ভালোবাসত দুজন দুজনকে অথচ শুধুমাত্র ফ্যামিলির কথা চিন্তা করে স্যাক্রিফাইস করে গিয়েছে।”
অৰ্পি চোখ মুছে বলল,
“ওরা পালিয়ে গেলেই ভালো হতো রে আপ্পি।”
“তা হয়তো হতো, কিন্তু ১০% হয়তো ভালোবেসে পালায় তাদের কথা
শুনে আমরা কেউ কেউ বলি খুব ভালো কাজ করেছে, কেউ কেউ বলি খুব খারাপ কাজ করেছে। কিন্তু বাকি ৯০% যারা নিজের ফ্যামিলির কথা ভেবে পালিয়ে যায় না তাদের কষ্টের কথা আমরা জানতেও পারি না।”
“আসলেই।”
হঠাৎ দরজার বাইরে টোকা পড়ল। তারপর অনন্যার গলা পাওয়া গেল,
“অৰ্পি? অৰ্পি?”
অর্পি চমকে বলল,
“মা কেন?”
তারপর বাইরের দিকে চোখ পড়তেই দেখল ভোর হয়ে গিয়েছে! কখন যে রাত পার হয়ে গেল টেরই পায়নি ওরা।
আবার অনন্যার ডাক,
“অর্পি ওঠ, তাড়াতাড়ি। আজকেও স্কুলে যেতে দেরি হলে তোর স্কুল বন্ধ করে একটা রিক্সাওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দেব।”
অর্পি ডায়েরিটাকে নিজের ড্রয়ারে চালান করে দিল। অদ্রি বিছানায় শুয়ে পড়ল। তারপর অর্পি গিয়ে দরজা খুলে ঘুমের ভান করল। অনন্যা বলল,
“দশ মিনিটে রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট করতে আসবি। লেট লতিফ কোথাকার!”
একথা বলেই অনন্যা রান্নাঘরে চলে গেল।
অর্পি স্কুলে যাওয়ার সময় ড্রয়ারের চাবি নিয়ে চলে গেল। বলল,
“চাবি আমি নিয়ে যাচ্ছি যাতে তুই একা না পড়তে পারিস! আমি ফিরি তারপর দুজনে একসাথে পরব।”
—————
সকাল ১০টা নাগাদ অদ্রি উঠল ঘুম থেকে উঠল। ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট নিয়ে ড্রইং রুমে গিয়ে টিভি ছাড়ল। দিতিয়া কাজ করতে করতে বলল,
“কী ব্যাপার! আমার আম্মুর চোখমুখ ফোলা লাগছে কেন?”
অদ্রি ভেবে পেল না কী বলবে! রাত জেগে কান্নাকাটি করায় চোখমুখ ফুলে গেছে বোধহয় কিন্তু সেটা তো বলা যাবে না। বলল,
“আর বলো না, ঘুম হয়নি ঠিকমতো। অর্পি বারবার গায়ে পা তুলে দিচ্ছিল।”
দিতিয়া হেসে বলল,
“ভালোই তো।”
“ধুর কিসের ভালো? খুব বাজে অভ্যাস!”
দিতিয়া কিছু বলল না। অদ্রিই একটু পরে বলল,
“বাই দা ওয়ে, আম্মু কোথায়? দেখছি না যে?”
“বাইরে গেল তো।”
“কোথায়?”
“জানি না।”
দিতিয়া ভেতরে চলে গেল। অদ্রির খাওয়া প্রায় শেষ। এমন সময় দিতিয়া ঝুড়ি নিয়ে বেরোচ্ছে। তার মানে বাগানে যাচ্ছে। বাগানে অনেক সবজি গাছ আছে। দিতিয়া ওখান থেকে কিছু আনবে বোধহয়। দিতিয়া একা, সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে। পিছু পিছু গেল অদ্রি।
দিতিয়া বলল,
“ওরে বাবা! আম্মু দেখি বাগানে।”
“হুম! উইদাউট অর্পি বাসাটা খুবই বোরিং, তোমরা তো সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকো। তুমি বাগানে আসছ দেখে এলাম।”
“খুব ভালো করেছিস।”
চাচি করল্লা গাছ থেকে করল্লা ছিঁড়ছিল। অদ্রি হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
“আচ্ছা চাচি, তোমার আর চাচ্চুর লাভস্টোরিটা একটু শোনাও না।”
“আমাদের আবার লাভস্টোরি কী? আমাদের তো অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ হয়েছিল।”
“তো? অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে বুঝি কোনো ডে অফ লাভ থাকে না? বিয়ের দিন থেকেই দুজন দুজনকে ভালোবাসো?”
“নাহ, তা নয়।”
“তাহলে? তোমাদের সেই ডে অফ লাভের কাহিনী শুনতে চাই।”
চাচি লজ্জা পেয়ে বলল,
“ধুর! কী যে বলিস না। আমাদের সেরকম কাহিনী নেই।”
অদ্রি দিতিয়ার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“বলো না, এত লজ্জা পাওয়ার কী আছে? আমরা তো বন্ধুর মতো। মা কত্ত বলে তাদের লাভস্টোরির কথা। বাট ওটা শুনতে শুনতে বোর হয়ে গিয়েছি।”
“আচ্ছা তা হঠাৎ আমাদের লাভস্টোরি শুনতে মন চাইল কেন?”
“সত্যি কথা বলব? রাগ করবে না তো?”
“আমি কখনো রাগ করেছি কোনো কিছু নিয়ে?”
“না তা করোনি, কিন্তু এটা তো পারসোনাল ব্যাপার!”
“কী!”
“আগে বলো মাকে বলবে না।”
“আচ্ছা বাবা আচ্ছা বলব না।”
“গতকাল বিকেলে আমি অনিচ্ছাকৃতভাবে একটা দৃশ্য দেখে ফেলেছি। তাই খুব আগ্রহ হচ্ছে তোমাদের লাভস্টোরিটা শোনার জন্য।”
“কী দৃশ্য?”
“চাচ্চু তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। বারান্দায় গিয়েছিলাম কাপড় আনতে। বাতাসে পর্দাটা সরে যাওয়ায় আমার চোখ পড়েছিল।”
দিতিয়ার চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল। তা দেখে অদ্রি বলল,
“বিশ্বাস করো আগে জানলে তাকাতামও না ওদিকে। আমি অবশ্য সাথে সাথে চলে এসেছিলাম। তারপর চাচ্চু প্যারিস চলে যাওয়ার পর থেকেই তোমার কী মন খারাপ!”
মুহূর্তের মধ্যে দিতিয়া লজ্জায় লাল হয়ে গেল। অদ্রি বলল,
“আসলে এটা কমন দৃশ্য, বাবা-মাকে অসংখ্যবার দেখেছি কিন্তু কখনো এরকম ফিল হয়নি।”
“কারণ, তোমার চাচ্চু একটু অন্যরকম। অনেকের কাছে বোরিং। তাকে বাইরে থেকে দেখে অনুভূতিহীন মনে হয়, কিন্তু সেও একটা মানুষ, তারও অনুভূতি আছে। তবে সবার মতো তা প্রকাশ করতে পারে না এখন আর।”
“তার মানে আগে পারত?”
“হুম, শুনেছি আগে ও খুব চঞ্চল আর মজার মানুষ ছিল।”
“তাহলে এখন এরকম হয়ে গেল কেন?”
“বয়সের সাথে সাথে মানুষের মধ্যে অনেক চেঞ্জ আসে।”
অদ্রি মনে মনে ভাবল, ইশ চাচি কত ভালোবাসে চাচ্চুকে। চাচ্চুর দোষটা ঢেকে রাখল। ওর সামনে চাচ্চুকে ছোট করল না। কিন্তু মানুষ তো সুযোগ পেলে ভালোবাসার মানুষের দোষ বলতে ছাড়ে না। ওর বেস্ট ফ্রেন্ডই তো পাগলের মতো ভালোবাসে বয়ফ্রেন্ডকে। অথচ সারাটা দিন খালি তার দোষগুলো বলতে থাকে। এত দূরেই বা যাচ্ছে কেন! ওর মাও তো বাবাকে অনেক ভালোবাসে। তারপরেও বাবার কাছ থেকে কোনো কষ্ট পেলে ভুলে যায় না, ঠিকই সুযোগমতো বলে বসে, তোর বাবা এই করেছে সেই করেছে। অমুক জিনিসটা চেয়েছিলাম আজও দেয়নি অথচ এত অবহেলা, আর খারাপ ব্যবহারের পরেও চাচির মুখে কোনো অভিযোগ নেই! অদ্রি বলল,
“চাচি চাচ্চু কি রোমান্টিক?”
চাচি হেসে ফেলল। অদ্রি বলল,
“আহা বলোই না।”
“সদ্য প্রেমে পড়েছিস বলে এসব জানতে চাচ্ছিস তাই না? খুব বুঝতে পারছি।”
অদ্রির মনে হলো সেদিন ডায়েরি হাতে ধরা খেয়ে অর্পি যে মিথ্যাটা বলেছিল তা ভালোই কাজে দিচ্ছে। অদ্রি হেসে বলল,
“বলো না। যেভাবে তোমাকে দূর থেকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল তাতে তো আমার মনে হয়েছিল খুব রোমান্টিক।”
“ওটাকে যদি রোমান্টিসিজম বলিস তাহলে বলব ও রোম্যান্টিক। কিন্তু সত্যি বলতে রোমান্টিসিজম কী তাই আমার কাছে ঝাপসা। ওই আমার জীবনে প্রথম পুরুষ। ও যেমন, তেমনভাবেই ওর প্রতি আমার ভালোবাসা হয়েছে। তেমনভাবেই ওকে চেয়েছি। তেমনভাবেই পেয়ে আমি অনেক সুখী।”
ও। আচ্ছা, প্রায়ই তো শুনি চাচ্চু তোমার বার্থডে এনিভার্সারি ভুলে যায়। তুমি রাগ করো না কেন?”
“আমি তো জানি তোদের চাচ্চু একটু ভুলোমনা। তাছাড়া কত ব্যস্ত থাকে!”
“হুম। কিন্তু ভুলে গেলে তো গিফটও দেয় না, তখন মন খারাপ হয় না তোমার?”
“ও আমাকে কী দিতে কম রেখেছে বলো? আর যখনই কোথাও যায় আমার জন্য তো কত গিফট নিয়ে আসে।”
“সে তো সবার জন্যই আনে। তোমার জন্য স্পেশালি তো না।”
“স্পেশাল গিফট! সারাজীবনের জন্য কত বড় একটা স্পেশাল গিফট তো দিয়েই রেখেছে। এর চেয়ে বেশি স্পেশাল আর কী হতে পারে?”
“কী?”
“দিহান।”
অদ্রি হেসে আবার চাচিকে জড়িয়ে ধরল,
“ওহ! সো সুইট অফ ইউ চাচি!”
চাচি হেসে বলল,
“পাগলি। ছাড়! কাজ করছি না?”
অদ্রি চাচির গলা ছেড়ে দিল। তারপর চাচি আবার কাজ করতে শুরু করে দিল। অদ্রি বলল,
“ইশ কত্তো ভালোবাসো তুমি চাচ্চুকে।”
“সব মেয়েরাই তাদের স্বামীকে ভালবাসে।”
“কক্ষনো না। সবাই হয়তো তাদের স্বামীকে ভালোবাসে কিন্তু এভাবে না। আচ্ছা চাচি বলোই না একটা মানুষের সাথে তোমার বিয়ে হলো যাকে তুমি চেনো না জানো না, তারপর তার প্রতি এতটা ভালোবাসা হলো কী করে? নিশ্চয়ই কোনো একটা দিন কোনো একটা ঘটনা ঘটার পরেই ভালোবাসাটা হয়েছিল। সেই ডে অফ লাভের কথাই জানতে চাচ্ছি। বলো না চাচি প্লিজ প্লিজ প্লিজ!”
“সেই হিসেব করলে আমাদের ডে অফ লাভ তিনটা।”
“তিনটা? হাও ইজ ইট পসিবল?”
“একটা হচ্ছে তোমার চাচ্চুকে যেদিন থেকে আমি ভালোবেসেছি। আরেকটা তোমার চাচ্চু আমাকে যেদিন থেকে ভালোবেসেছে! আরেকটা হলো যেদিন থেকে দুজনেই দুজনার ভালোবাসার কথা জেনেছি।”
“পুরো গুলিয়ে গেল। একটু বুঝিয়ে বলো না সুইটহার্ট। তিনদিনের ঘটনাই বলো।”
চাচি হেসে বলল,
“ঘটনা বিশেষ কিছু না। তবে ওকে আমি আগে ভালোবেসেছি। আমাদের বিয়ের দু’তিন মাস পরেই হুট করে একদিন মনে হয়েছিল আমার কপালের গুণে ওর সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। ওর সাথে সারাজীবন না থাকতে পারলে আমার জীবনটাই বৃথা হয়ে যাবে।”
“সারাজীবন না থাকতে পারার কথা বলছ কেন? তোমাদের তো বিয়েই হয়ে গিয়েছিল।”
অদ্রি ইচ্ছে করেই খোঁচাটা মারল। চাচি কী বলে সেটা দেখার জন্য। দিতিয়া বলল,
“কথার কথা বললাম।”
অদ্রি মনে মনে ভাবল, ‘চাচি এবারও চাচ্চুকে ছোট করল না। কীভাবে মানুষ এতটা ভালোবাসতে পারে?’ তারপর বলল,
“আচ্ছা তারপর বলো কী কারণে এরকম মনে হয়েছিল?”
“কী জানি! ভালোবাসা কি আর বলেকয়ে হয়? হঠাৎ করেই হয়ে যায়।”
“আর চাচ্চুর হয়েছিল কবে?”
“তা তো আমি জানি না তোমার চাচ্চুই বলতে পারবে।”
“আচ্ছা আর দুজনে জানলে কবে? কী করে জানলে?”
“আমাদের বিয়ের প্রায় ৮ বছর পর।”
“সেকি! ৮ বছর!”
“হুম!”
“কে আগে বলল? তুমি না চাচ্চু?”
“ডিরেক্টলি কেউই কিছু বলিনি।”
“না বললে বুঝলে কী করে?”
চাচি হেসে বলল,
“ভালোবাসলে ঠিকই বোঝা যায়।”
“ও, আচ্ছা তারপর কবে প্রথম আই লাভ ইউ বললে?”
চাচি আবার হাসল,
“ডিরেক্টলি কখনোই বলিনি। আমাদের সময়টা তোমাদের সময়ের মতো ছিল না। আজকাল দেখি কথায় কথায় মানুষ আই লাভ ইউ বলে। কথাটা অনেক সস্তা হয়ে গিয়েছে। যাকে তাকে যখন তখন বলে দিচ্ছে। অথচ একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম এটা না বলে।”
“সেটা অবশ্য ঠিক কিন্তু আজকাল এটা না বললে ঝগড়াও হয় জানো?”
“তাই?”
“হ্যাঁ।”
দিতিয়ার সবজি তোলা শেষ। এবার বাসার ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে দিতিয়া বলল,
“পারেও আজকালকার ছেলেমেয়েরা!”
দাদু সামনে পড়ায় অদ্রি আর কোনো কথা বের করতে পারল না!
·
·
·
চলবে.........................................................................