অর্পি স্কুল থেকে ফেরার পরেও অদ্রি অর্পি কোনো চান্স পেল না ডায়েরিটা নিয়ে বসার। মোনা ফুপ্পি আর ফুপা এসেছে। এর মধ্যে দরজা বন্ধ করে রাখা সম্ভব না। আর দরজা খুলে ডায়েরিটাও পড়া যাবে না। অনেক কষ্টে ওরা রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর দরজা লাগিয়ে ডায়েরিটা নিয়ে বসল। যতটুকু পড়েছিল তার পর থেকে পড়া শুরু করল…
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ছুটিতে আছি। ছুটিটা প্রথমত নিয়েছি অসুস্থতার কারণে। দ্বিতীয়ত, এই লেখাটা শেষ করা দরকার। যা অবসরে লিখতে গেলে বছর বছর পার হয়ে যাবে। একটা কাজ অনেকদিন ধরে অসম্পূর্ণ থাকলে ভালো লাগে না। তাছাড়া ছুটিটা আরো একটা কারণে জরুরি ছিল, লেখাটা শেষ করে আমি কদিন আর কোনো স্বাভাবিক কাজ করতে পারব না।
আমি বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে ডায়েরি লিখছি। আর দিতিয়া আমার গা ঘেঁষে ঘুমাচ্ছে। মেয়েটা খুব অদ্ভুত! গত কয়েকদিন ধরে দেখছে আমি ডায়েরিতে কিছু লিখছি। তবু জিজ্ঞেস করেনি কী লিখছি। এটা তো তেমন কিছুই না। আরো হাজারটা ঘটনা আছে এরকম। সেসব লিখে শেষ করা যাবে না। তার চেয়ে বরং বলি সেদিন মানসী আমার ঘর থেকে বের হওয়ার পর কী হয়েছিল। দরজা খুলে বেরিয়ে মানসী বলল,
“মা চলো।”
খালামণি মানসীকে একটা চড় মেরে বলল,
“নির্লজ্জ, অসভ্য, বেয়াদব মেয়ে কোথাকার!”
মানসী হেসে দিল। খালামণি ওর হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল। আর মানসী যেতে যেতে পেছনে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। বুকটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল ওর ওই হাসি দেখে!
আজ ওর বিয়ে, ও অন্য কারো হয়ে যাবে! ভাবতেই পারছিলাম না। বাসায় যাকেই দেখছিলাম তাকেই অসহ্য লাগছিল। শেষে থাকতে না পেরে সেদিনই আমি বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম। তারপর মনে হলো ঢাকায়ই থাকব না। রাতের ট্রেনেই চট্টগ্রাম চলে গেলাম। ওখানেও ভালো লাগল না, চলে গেলাম কক্সবাজার। সারা দিনরাত সমুদ্রের পাড়ে বসে থাকতাম। সমুদ্রের ঢেউগুলো দেখলে ভালো লাগত। মনে হতো একেকটা ঢেউ এসে আমার বুকটার ওপর ভেঙে পড়ছে। তারপর আমার সব কষ্ট ধুয়ে আবার গভীরে চলে যাচ্ছে। একা থাকতেই ভালো লাগছিল। একাই তো আমি, কেউ তো নেই আমার। দুইতিন সপ্তাহ বাইরে বাইরে ঘুরে মনে হলো মা তো চিন্তা করবে! হয়তো ভাববে আমি তার নিজের ছেলে না, এটা জানার পর আগের মতো ভাবি না তাকে নিয়ে। কিন্তু ব্যাপারটা তো তা না। বাসায় ফিরে সোজা আমার ঘরে ঢুকে শুয়ে রইলাম। সবাই আমাকে দেখল কিন্তু কেউ আমার কাছে এল না। কিছু জিজ্ঞেস করল না। দুপুরে খেতে বসে মাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“মানসী শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে না? কোথায় ওর শ্বশুরবাড়ি? নাকি কানাডা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ওদের বাড়িতেই থাকবে?”
সবাই চুপ। শুধু অনন্যা আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদছে। আমার বুকের মধ্যে কেমন যেন করে উঠল। সবাই চুপ কেন? এটা কি কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস? এবার সত্যি একটা ভয় আমাকে পেয়ে বসল। অনন্যাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“কী হয়েছে তুই কাঁদছিস কেন? তুই তো কথায় কথায় এত কাঁদিস না! মানসী কোথায়? মানসীর কিছু হয়েছে?”
এবার মাও কাঁদতে শুরু করল। আমার অবচেতন মন বোধহয় বুঝে গিয়েছিল কী হয়েছে। তাই আমি এবার চেঁচিয়ে বললাম,
“কেউ আমাকে বলবে কী হয়েছে?”
সৌরভ এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“মানসী…”
এটুকু বলে থেমে গেল। আমি বললাম,
“কী? মানসী কী?”
“মানসী বিয়ের আগেই সুইসাইড করেছে।”
এই লাইনটা পড়ে অদ্রি মুখ চেপে ধরে কান্না করে দিল। ওদিকে অৰ্পি ও কাঁদছে। দুই বোন এত বড় একটা ধাক্কা ঠিক মেনে নিতে পারল না। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করার পর অর্পি বলল,
“আপি চল বাকিটা পড়ি।”
“আর পড়ে কী হবে?”
“দেখি না কী হয়। ডায়েরিতে আরো অনেকটা লেখা আছে।”
অদ্রি অর্পি আবার ডায়েরিটা পড়া শুরু করল…
সৌরভের কথাটা শোনামাত্র আমার হাত-পা পুরো শরীর কাঁপতে শুরু করে দিল। দাঁড়ানো থেকে বসে পড়লাম। আমি কী শুনলাম! সৌরভ আমার পাশে বসে বলল,
“তুই তো সন্ধ্যার পর চলে গিয়েছিলি। আমরা খবর পাই রাতে। তারপর যে তোকে কত যায়গায় খুঁজেছি! তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি।”
অনন্যা আমার পাশে এসে বসল। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
“কেন চলে গিয়েছিলে দাদা! কেন? একবার শেষ দেখাটাও তো দেখতে পারলে না।”
আমি ওদের কথার কোনো জবাব না দিয়ে উঠে পড়লাম। পুরো বাসার দেয়ালে মানসীর অনেক ছবি ছিল। মায়ের ঘরে মায়ের সাথে, আমার ঘরে আমার সাথে। অনন্যার ঘরে সৌরভ, অদ্রি, অনন্যার সাথে। মোনার ঘরে মোনার সাথে। সবগুলো ছবি খুলে নিয়ে আসলাম ড্রইং রুমে
তারপর এলবাম বের করে ওর ছবিগুলো বেছে বেছে বের করলাম। অনন্যা বলল,
“দাদা, কী করছ?”
আমি ওর কথার উত্তর দিলাম না। ওর সব ছবি আলাদা করে সব নিয়ে বাগানে চলে গেলাম। সবাই দৌড়ে এল আমার পিছু পিছু। তারপর লাইটার দিয়ে যখন ছবিগুলো পোড়াতে শুরু করে দিয়েছি তখন মা বলল,
“নীরব, ছবিগুলো পোড়াচ্ছিস কেন? প্লিজ এসব করিস না।”
আমি পাত্তা দিলাম না সেসব কথায়। সবগুলো ছবি পোড়ানো শেষ হলে উঠে গিয়ে বললাম,
“আজ থেকে মানসী নামটা কেউ উচ্চারণও করবে না এই বাড়িতে। কী বলেছে আর কী করেছে। বেঈমান বিশ্বাসঘাতক কোথাকার!”
রাগে আমার গা কাঁপছিল। ঘরে ঢুকে বিছানার ওপর বসলাম। মানসীর সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো একটার পর একটা চলমান ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমি ভেবেই পাচ্ছি না ও কীভাবে পারল এই কাজটা করতে! আমি যেভাবে রিয়্যাক্ট করলাম, যেভাবে ওর ছবিগুলো পুড়িয়ে দিলাম তাতে কেউ আমার কাছে আসার বা কিছু বলার সাহস পেল না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দিতিয়া এল। আমার পাশে এসে বসে আমার মুখটা ধরে ওর দিকে ঘোরাল। দেখি ও কাঁদছে। ওর চোখ কিছু বলতে চাচ্ছিল আমি বুঝলাম কিনা জানি না কিন্তু আমি ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম। জ্ঞান হবার পর আমার জীবনের প্রথম ও শেষ কান্না। তারপর আর কখনো কাঁদতে পারিনি। অনেক কষ্ট হলেও না। সেদিন কতক্ষণ কেঁদেছিলাম জানি না। দিতিয়া শুধু আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। কোনো কথা বলেনি। কেউ কাঁদলে আমরা সান্ত্বনা দিই। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে সান্ত্বনা কোনো কাজে দেয় না। উল্টো বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর দিতিয়া সেটা খুব ভালো করে বুঝেছিল।
পরে জানতে পেরেছিলাম খালু আমার নামে কেস করেছিল। তার অভিযোগ ছিল আমার জন্যই মানসী সুইসাইড করেছে। কিন্তু পুলিশ মানসীর ঘর সার্চ করে একটা চিরকুট পেয়েছিল। তাতে লেখা ছিল,
“বাবা,
তুমি জোর করে আমার বিয়ে দিতে না চাইলে আমি মরতাম না। মরা খুব কঠিন, আর এই কঠিন কাজটা তুমি আমাকে দিয়ে করালে।”
খালুর জেদের কথা বলতে গিয়ে আরেকটা কথা না বললেই নয়। সে নিজের মেয়ের মৃতদেহ ফেলে নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্য তার ছোট মেয়ে মাধবীকে ওইদিন ওই ছেলেটার সাথে বিয়ে দিয়েছিল। ১৫ বছর বয়সী ফুটফুটে ফুলের মতো মেয়েটাকে ৩২ বছর বয়সী লোকটার সাথে বিয়ে দিতে একটুও দ্বিধাবোধ করেনি।
আমার সব অনুভূতি অকেজো হয়ে গিয়েছিল। ঠিক-বেঠিক জ্ঞান ছিল না। ঠিক তখনই আমাদের মেডিক্যাল কলেজের একজন প্রফেসর আমাকে একটা স্কলারশিপের পরীক্ষায় বসতে বলল। কী মনে করে তার কথা শুনেছিলাম জানি না। পরীক্ষাটা দিয়েছিলাম আর স্কলারশিপটাও পেয়েছিলাম। তারপর হায়ার স্টাডিজের জন্য ইউএসএতে চলে গিয়েছিলাম, বলা ভালো পালিয়ে গিয়েছিলাম। কাউকে কিছু বলে যাইনি। বলতে ইচ্ছে করেনি। এমনকি মাকেও না।
জানতাম মা খুব চিন্তা করবে, তবুও বলে যাইনি। আসলে আমি কিছু কিছু ব্যাপারে এমন অমানুষ। যখন কারো কাছ থেকে খুব বেশি কষ্ট পাই তখন খুব রাগ হয় তার ওপর। তাকে আরো বেশি কষ্ট দিতে ইচ্ছে করে। এবং দিয়েও ফেলি, পরে অনুশোচনা হয়!
·
·
·
চলবে..........................................................................