উদাস চিত্তে বেলকনির বেতের চেয়ারে বসে আছে সুরেলা। লম্বা আঁচল অবহেলায় মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে নাক টানে সুরেলা। আঁখি পল্লব ক্ষণে ক্ষণে আবেগে ভিজে যায়। শ্বশুর বাড়িতে আজ তাঁর প্রথম দিন। তবে শ্বশুরবাড়ি ফাঁকা। কিছু কাজের লোক আর খালা শাশুড়ি ও তাঁর মেয়ে আরিফা আপু। আরো কিছু কিছু মেহমান ছিলো। সাহরির সময় আলাপ হয়েছিলো সবার সাথে। বেলা গড়াতেই তারা বিদায় নিয়েছে। সুরেলার বাড়ির কথা মনে পড়ে। তাঁর ক্ষণিকের নিজ বাড়ি যেখানে তাঁর বড় হওয়া। আচ্ছা সিন ভাই কি করছে এখন? তাঁর কথা কি মনে পড়ছে? একটুও কি শূন্যতা অনুভব করছে না? শাপলা, শফি, মা ওরা কি তাঁর কথা মনে করে এখনও কাঁদছে? কি জানি! সুরেলা আঁচলে চোখ মুছে নাক ঝাড়ে। ভাবে খুঁতখুঁইত্যা লোকটা থাকলে নিশ্চিত নাক সিঁকায় তুলে এক কেজি জ্ঞান বিলাতো! লোকটার কথা ভাবনায় আসতেই অভিমান জন্মায় মনের কোণে। এভাবে নতুন বউকে কেউ ফেলে যায়? সাথে নিলে কি খুব ক্ষতি হতো? আশেপাশে সকলের কত গুঞ্জন। বউ তো আছে তবে বর উধাও; শ্বশুর বাড়ির কেউই নেই। বাসর রাতেও বরকে আঁটকে রাখতে পারলো না? তিল কে বানিয়ে মুফতে বিক্রি করছে ঘরে ঘরে।খালা শাশুড়িও খোঁচা দিতে ভুলে নি। তাই তো ঘরে খিল এঁটে বসে আছে। ইশ্ ভুল হলো! তারই পোড়া কপাল; সিটকিনি উঁচুতে হওয়ায় নাগাল পায় নি। কোনোমতে চাপিয়ে এসেছে। দরজার কথা মনে আসতেই দরজা খটখটানোর আওয়াজ শোনা যায়। সুরেলা চটজলদি উঠে আসে। মাথায় আঁচল টেনে দরজা খুলে দেয়। রাহেলা বানু কপাল কুঁচকে বলে,
"বউ তোর তো দেখতাছি খুব নাখরা! কি কইছি তরে? 'খালি কইছিলাম একটা রাত জামাইরে আটকা রাখবার পারোস নাই! কিসের মাইয়া মানুষ তুই?' এনে খারাপ কি কইছি, বুঝা আমারে? এমন দেমাগ নিয়া চললে শাশুড়ির লগে এক সেকেন্ডও পড়বো না। রেবু রে তো চিনোস না! আর রিজ বাবা মনে হয় না মায়ের বিরুদ্ধে কথা কইবো।"
সুরেলা বিরক্ত হয় বটে। তবে মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলে,
"তেমন না খালাম্মা! কিছুই মনে করি নাই আমি। মাথা টা ধরছিলো খুব তাই এল্লা শুইছিলাম!"
রাহেলা বানু মুচকি হাসলো। মুখ মুচড়ে বলে, "বুঝি লো বউ বুঝি। বরের লাইগা মন আনচান করে! বিকেলে ফোন দিমু নে। কথা কইস রিজের লগে। ওহন নিচে চল তোর মায়ে আইছে!"
সুরেলার উদাসী চোখ উজ্বিবিত হয়। তবে খালার পরবর্তী কথায় অপমানে মুখ থমথমে হয়ে আসে।
"কিছু মনে নিস না বউ। বিয়ার পরদিনই মাইয়ার শ্বশুর বাড়ি কোন মায়ে আইসে? মানছি বাড়ির কাছে তাই বইলা মায়ের আসা লাগবো? আর কি মানুষ নাই। আচ্ছা চল তো?"
বলে রাহেলা বানু সুরেলার বাহু চেপে নিয়ে যায়। অপমানে চোখ বাঁধ মানে সুরেলার।
"খালাম্মা, মাইয়ার শ্বশুর বাড়িতে মায়েদের আসতে নাই? রিফা আপুর বিয়া হইলে আপনে যাইবেন না দেখতে?"
সুরেলার কথায় থেমে যায় রাহেলা বানু। বিস্ময়ের সাথে বলে,
"বউরে তুই দেখতাছি সাংঘাতিক। যামু না কেন? তাই দেইখ্যা ড্যাং ড্যাঁং করইরা পরদিনই যামু নাকি? ওনারা দাওয়াত দিয়া সসম্মানে নিলে তবেই যামু।"
থেমে সুরেলার হাত ছেড়ে আগে হাঁটতে হাঁটতে বলে, "তোর বউজীবনরে সালাম। বউ শাশুড়ি খুব জমবো বুঝলি? বেচারা রিজ বাবার জন্য কষ্ট আইতেছে!"
সুরেলা বাঁকা চোখে চায় খালা শাশুড়ির দিকে। নিচে নেমে অন্দর মহলের উঠোনে এসে দেখে তাঁর মা, নানী, শাপলা আর দু'টো মামাতো বোন আর এক চাচাতো ভাই এসেছে। ভাই আসে নি তবে? মনটা খারাপ হয় তাঁর। এগিয়ে গিয়ে মায়ের সাথে কথা বলে। বোনদের সাথে দুদন্ড গালগপ্পো করে। শান্তি বেগম শাপলা কে চিমটি কেটে ইশারা করে কিছু। শাপলা আমতা আমতা করে সুরেলাকে শুধায়,
"ও সুর আপা? দুলাভাইরে দেখতাছি না? বাড়ির কাউরেই তো চোখে পড়ে না!"
সুরেলা ক্ষণপল থম মেরে থাকে। দূরে পিঁড়িতে বসা রাহেলা বানুর দিকে তাকায় একবার। ভদ্রমহিলার সম্পূর্ণ মনোযোগ এখানেই। সে মা নানীর দিকে তাকিয়ে বলে,
"সবাই ঢাকায়। উনি সকালে উঠেই ঢাকা পথে রওনা হইছে। রূপসা অসুস্থ না? আর উনারও হাতে পিঠে সেলাই আছে।"
"সকালে কই? রাত্রেই গেছে। মিছা কথা কস ক্যান বউ?"
রাহেলা বানু হাতের তসবি টিপে টিপে হেসে বলে। সুরেলা দাঁতে দাঁত চাপে। এই খালা শাশুড়ির হাবভাব বোঝা দায়! আইয়ালী বেওয়া যেন খ্যাক করে ওঠে,
"কিহ্! নাত জামাই কাজটা কি ঠিক করলো? বিয়ার রাইতে বউরে থুইয়া গেলো! লোকে জানলে তো মাইয়াডার মুখে থু দিবো। আর তুই মা/গী জামাইরে আটকাই রাখবার পারোস নাই? যাইতে দিলি ক্যান?"
সুরেলা বিরক্ত বোধ করে। শান্ত বুঝদার গলায় বলে,
"নানিবু চুপ কর। ওনার ছোট বোন অসুস্থ। আর উনি নিজেও অসুস্থ। ডাক্তার দেহান লাগতো তাই গেছে।"
আইয়ালী বেওয়া আরো কিছু বলবে শান্তি বেগম থামিয়ে দেয়। মেয়ের শ্বশুর বাড়ি এটা তার মা কি ভুলে গেছেন নাকি? তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে সাংসারিক আলাপচারিতায় মেতে ওঠেন। বাকপটু রাহেলা বানুও মিলে মিশে একাকার।
সুরেলা মা বোনদের তাঁর ঘরে নিয়ে আসে। সাদা দেয়ালে ঘেরা অতি মাত্রায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এক কামরা। ঘরের প্রতিটি আসবাবপত্র পুরনো কিন্তু বড্ড শৌখিন আর পরিচ্ছন্ন। ধুলোবালির আস্তরণ তো দূরের জিনিস। সাদা চাদর বিছানো টান টান বিছানায় দুই একবার গড়াগড়ি খায় শাপলা। তার দেখাদেখি সুরেলার বাদবাকি পিচ্চি তো তো ভাই বোনেরা একেবারে গরু খচা খচে দিলো। সুরেলা কিছু বলে না। তবে তাঁর ভদ্রলোক থাকলে নিশ্চয়ই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা যেতো না। সুরেলা মা নানীকে টেনে বেলকনিতে নিয়ে যায়।
"ভাই আইলো না কিহামে?"
মেয়ের প্রশ্নে শান্তি বেগম নজর লুকায়। তবে আইয়ালী বেওয়া চুপ থাকেন না। বলেন,
"তোর ভাইয়ের যা ভাব বুবু কি আর কমু? কয় বড়লোক বাড়িতে সিনের পাও পড়তো না। তোর বাপে তো কাল রাতেই ভাগছে। ভাইরে কত কইলাম বুইনডারে নিয়া আয়। তুই না গেলে আর কেডা যাইবো? তার ছিঁড়া চাইতা চাইতা ওঠে। আইলোই না। তোর মা আর আমিই আইলাম ওই ক্যাসেটগোরে নিয়া।"
সুরেলার শান্ত চোখে চায়। প্রতিবারের মতো চোখ ভিজে না। আফসোস হয় শুধু; সাথে ভাইয়ের উপর সামান্য অভিমান। সে তো স্বীকার করলোই, ভুল হইছে তাঁর। পায়েও পড়লো তবুও এতোটা রাগ? সে চুপ করে যায়। মা নানীর সাংসারিক উপদেশ বিরক্ত লাগে। উঠে গিয়ে আলমারি খুলে তাঁর গয়নার বাক্স থেকে একজোড়া দুল যা মা দিয়েছিলো তাকে; দুল জোড়া নিয়ে মায়ের হাতে ধরিয়ে বলে,
"শিগগির সিন ভাইরে বিয়া করাবি তাই না মা? এইডা তুই ভাইয়ের বউরে দিস। আমি ভাইয়ের দেওয়া চুড়ি জোড়া রাখলাম সাথে।"
শান্তি বেগম মেয়ের হাতের দিকে তাকায়। সিনের দেওয়া চিকন স্বর্ণের চুড়ি শুধু। অথচ শ্বশুর বাড়ি থেকে দু জোড়া মোটা বালা দেওয়া হয়েছিলো। গাধা মেয়েটা পড়ে নি।
"এই চুড়ি পড়ছু ক্যান? ওই মোটা বালা পড়বি! বড়লোক বাড়ির বড় বউ তুই। রানীর বেশে থাকবি বুজছু?"
সুরেলা জবাব দেয় না। শান্তি বেগম দুল জোড়া আঁচলের গিঁটে বাঁধেন। মেয়ের তো আল্লাহর রহমতে অভাব হবে না। সে না হয় দুলজোড়া ছেলের বউরে দিবে। তিনি মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলেন,
"অনেক অনেক সুখী হ সুর।ব্যাগ পত্তর গুছায় নিয়া তৈয়ার হ জলদি। আমি তোর খালা হাউরির লগে কথা কইয়া আসি।"
"তোরা ইফতার কইরা যাইস নে মা। আমি যামু না!"
শান্তি বেগম অবাক গলায় শুধায়,
"ক্যান যাবি না?"
"এমনিই যামু না। তোরা যা!"
সুরেলার বিরস গলা। শান্তি বেগম মেয়ের অভিমান বুঝতে পারে। নরম গলায় মেয়েকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করে যান। সুরেলা নিরেট হয়ে বসে থাকে শুধু।
—————
"ও পেয়ারি দামু? ভগবানের দোহাই লাগে এসব থেকে দূরে থাকো। কি পুশ করলা?"
"সুকুন পুশ করলাম মণি। আহা কি শান্তি মাসিমণি! মনে হচ্ছে সব দুঃখ ছুঁ মন্তর!"
সোফায় গা ছেড়ে সতেজ গলায় বলে দামিনী। শুপ্রাকে চিন্তিত দেখায়। দামিনী হেসে বলে,
"ভালোবাসা নামক বিষক্রিয়ায় নিঃশেষ মিনী। এই নীরব বিষ আর কতটুকুই বা ঘায়েল করবে বলোতো মাসিমণি?"
"তুমি ধীরে ধীরে নেশা পানিতে ডুবে যাবে। তারপর মরবে নিশ্চিত। কিন্তু ছোট্ট সুভার কি হবে?"
দামিনী খিলখিল সুরে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতেই বলে,
"কিছুই হবে না তাঁর। সে জেনে গেছে মাসি। শিঘ্রই সুভাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিবে। আর আমি বাঁধা দিতে পারবো না।"
দামিনীর হাসি যেভাবে হুট করেই উদয় হয়েছিল সেভাবেই অস্ত যায়। শুপ্রা বিস্ময়ে বলে ওঠে,
"কেন? সুভা তোমার মেয়ে। দশমাস তুমি গর্ভে ধারণ করেছো। আর উনি হুট করে এসে নিয়ে যাবে আর তুমি দিবে?"
"আমার ভবিষ্যৎ নেই মাসি। তবে আমি চাই আমার মেয়েটা সুস্থ একটা জীবন পাক। তাই তো এই গাঁয়ে ফিরে আসা।"
শুপ্রা হতবাক। বলে কি দামু? দামিনী শুপ্রার বিস্ময়ের পেন্সিলে আঁকা মুখটা দেখে আবারও খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। তাঁর হাসির ঝংকার যেন নিশীথের হাতছানি। বহিরাগত লোকের আগমনে দামিনী হাসি থামিয়ে দেয়। দেহরক্ষী দের সাথে কিছু চেনা আর অচেনা মুখ। দামিনী প্যাথেডিন লেখা কাঁচের শিশি ও সিরিঞ্চ আলগোছে লুকিয়ে মুচকি হাসলো। উঠে শুপ্রাকে ইশারা করে বলে,
" শুপ্রা জল পানির ব্যবস্থা কর গিয়ে! আর আপনারা বসুন?"
গ্রামের সাধারণ যুবক সাগর, ফাহাদ, সৌরভ সহ স্যুট ব্যুট পড়া শহুরে গোছের যুবক বসে পড়ে সোফায়। সৌরভ ঘার ফিরিয়ে পেছনে দন্ডায়মান বন্ধুর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,
"তোরে নতুন করে ইনভাইটেশন দিতে হবে নাকি সিন? আয় বস?"
"দাঁড়িয়েই ঠিকাছি। জলদি কাজ শেষ কর আমার তাড়া আছে।"
সিনান সালেহ তাড়া দেখিয়ে বলে। সে তো আসতেই চাইছিলো না এই নাচনে ওয়ালীর দোর গড়ায়। বন্ধুরা জোর করে টেনে আনলো। দামিনী স্মিত হেসে সিনানের দিকে তাকায়। কম বেশি চেনে চ্যাংড়া ছেলেটাকে। সে কিছু না বলে শুপ্রাকে জল পানি আনার জন্য তাড়া দেয়। সিনান দাঁতে দাঁত চেপে সৌরভের উদ্দেশ্যে বলে,
"ঘটে ঘিলু নাই? রমজান মাস চলে।"
"ইশ্ রে একদম ভুলে গেছি। রাগ করছো কেন? এই মাসি জলখাবার এনো না তো।"
দামিনী হাঁক ছেড়ে বলে মিষ্টি করে হাসলো। সিনানের মেজাজ বিগড়ে যায়। জিভ লক লক করে কিছু শুনিয়ে দেওয়ার জন্য। তুমি তুমি মা/রা/চ্ছে.. নেহায়েৎ মেয়ে মানুষ নইলে দু ঘা লাগিয়ে তবেই ক্ষান্ত হতো। সৌরভ গলা খাঁকারি দিয়ে দামিনীর উদ্দেশ্য বলে,
"আসলে দামু দি একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। দু মিনিট কথা বলতে চাই। সময় হবে তোমার?"
দামিনীর কপালে ভাঁজ পড়ে। কিসের প্রস্তাব নিয়ে এলো ছেলেপেলেরা? উল্টোপাল্টা কিছু বললে চটি খুলে পিটিয়ে খেদিয়ে দিবে।
"আচ্ছা বলো?"
সৌরভ হাসে অল্প। পাশে বসা স্যুট ব্যুটে বনেদি যুবককে দেখিয়ে বলে,
"ওনার নাম আঙুর হক। সরকারি কর্মকর্তাদের একজন। তুমি হয়তো জানো বর্তমানে মাদকের বিস্তার ঘরে ঘরে এসে পৌঁছেছে। ক'দিন আগেই এক দুধের শিশু কুরবান হলো বাবার আনা মাদক হিরোইন আর ফেনসিডিল খেয়ে। ভাবতে পারো আমাদের এই ছোট্ট সরোজপুরে ভবিষ্যতে কি ঘটবে? স্কুলের ছেলেরা শখের বশে, বাজে বন্ধুর পাল্লায় পড়ে এসবে জড়িয়ে পড়ছে। তাই উনি মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব গুলো জনসাধারণের মাঝে তুলে ধরতে চাইছেন!"
দামিনী শুকনো গলায় কেশে ওঠে। মায়ের কাছে নানা বাড়ির গল্প শোনানো হচ্ছে। সে বিনুনী নেড়েচেড়ে বলে,
"খুউব পূণ্যের কাজ। কিন্তু এখানে আমি কি করতে পারি?"
সৌরভ আঙুর হক নামক লোকটার দিকে তাকায়। ভদ্রলোক চোখের রোদ চশমা খুলে রাখে। ভদ্রসুলভ হেসে ভদ্রগলায় বলে,
"বলছি মিস দামিনী। আমি সরকারের পক্ষ থেকে এসেছি গ্রামের মানুষকে মাদকের ব্যাপারে সচেতন করার জন্য। গ্রামের সহজ-সরল মানুষ টাকার লোভে, না বুঝেই কারো প্ররোচনায় এসবে জড়িয়ে পড়ছে কিন্তু এসবের ভয়াবহতা সম্পর্কে তাঁরা অবগত নন। এসব মাদক শুধু শরীরের না মন, মস্তিষ্ক, পরিবার এমনকি পুরো সমাজকে অচল করে দিতে সক্ষম। তাই সরোজপুর সহ আশেপাশের কয়েক গ্রামের মুরুব্বি শিক্ষিত বর্গদের আলোচনা সাপেক্ষে একটা যাত্রাপালার আয়োজন করা হবে। যার মূল লক্ষ্য একটা ছোট্ট ম্যাসেজ গ্রামের প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। আপনি নাচ গান করেন বিভিন্ন যাত্রাপালায়। সুনামও শুনেছি বেশ। পেয়ারি দামুকে এক নামে চিনে সকলে। আপনি যদি আমাদের যাত্রাপালায় অভিনেত্রী হিসেবে যোগ দেন দর্শক জমবে খুব।দেখুন পজিটিভলি ভাববেন আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। আপনি পর্যাপ্ত পরিমাণে পারিশ্রমিক পাবেন।"
দামিনী হাসে। চোর ঢোল পিটিয়ে গ্রামবাসীকে এহলান শোনাবে যে, চুরি করা মহাপাপ।
"খুবই ভালো উদ্যোগ। তবে আমি অপরাগ বাপু। ওসবে মেলা রিস্ক আছে। আমি বাপু ঝামেলায় নাই। আপনারা আসতে পারেন।"
" আপনার সেফটি আমাদের দায়িত্ব। আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন মিস।"
আঙুর হক শান্ত সুরে বলে ওঠে। দামিনী খেয়াল করে লোকটাকে। ভদ্রলোক দেখতে বেশ! সুঠাম দেহে কোথাও মেদের ছিটেফোঁটা নেই। কথা বলার ভঙ্গিও বেশ গোছানো। সে রাজি হতো তবে শফিল ভাই জানলে খবর করে দিবে। তাই আবারও মিষ্টি হেসে বাহানা দেখিয়ে নাকচ করে দেয়। সিনান সালেহ গম্ভীর মুখে সবটাই অবলোকন করছিলো। দামিনীর নাকচে মুখ মুচড়ায়। এমনটা হবে জানা তাঁর। তাই রসকষহীন গলায় শেষ চাল চালে,
"যাত্রাপালা চেয়ারম্যান বাড়িতে হবে।"
দামিনী চকিত দৃষ্টিতে তাকায় সিনান সালেহের দিকে। চেয়ারম্যান বাড়িতে হবে?
—————
হাসপাতালের বিছানায় নিথর পড়ে রূপসা। চঞ্চলা মনটা আজ শান্ত। কিছুই ভালো লাগছে না তাঁর। মন চাইছে এই বদ্ধ কামরা হতে ছুটে বেরিয়ে যেতে। তার চিরচেনা সে-ই গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে হাঁটতে। ভাঁড়ে বিক্রি করা মিষ্টি মিষ্টি নই-মটকা, শম-পাপড়ি খাওয়ার ইচ্ছে জাগে। বদরুল দাদার দোকানের বার্মিস আচার খেতে মন চাইছে। ময়নার মায়ের বানানো জলপাইয়ের আচার ইশ্। মহি কাকার ঠেলাগাড়িতে উঠে দরিয়ার শান্ত চেহারা দেখার শখ জাগে প্রচুর। আচ্ছা সঙ্গে কে থাকবে? তাঁর সখীর দল? নাহ্ ওরা না। অন্য কেউ!
"কি রে পিচ্চি? কি খবর?"
রূপসা দরজার দিকে তাকায়। রিজ ভাইকে দেখে অভিমানে মুখ সরিয়ে বলে,
"তোমার সাথে কথা নেই রিজ ভাই। আমি তোমাকে কত হেল্প করেছি আর তুমি আমাকে ছাড়াই বিয়ে করে আনলে?"
নওরিজ দরজা চাপিয়ে এগিয়ে আসে। চেয়ার টেনে রূপসার শিয়রে বসে ফিসফিসিয়ে বলে,
"আমার বউয়ের একটা বড় ভাই আছে। শালা গভীর জলের হাঙর বুঝলি? তাই সেখানে তোর যাওয়া বারণ।"
রূপসার গাল ভারী হয়ে আসে।
" কি সব বলছো রিজ ভাই? আমি বলেছি তো দুষ্টুমি করে শার্টটা নিয়ে ছিলাম। তেমন কিছুই না!"
"আমি কি বলেছি তেমন কিছু?"
নওরিজের পাল্টা প্রশ্নে রূপসা থতমত খেয়ে গেল। করুণ চোখে চায়। নওরিজ মুচকি হেসে বলে,
" জানি তেমন কিছুই না; তবে হতে কতক্ষণ? এখন আবেগের বয়স তোর; ওসব ভুলে যা। এটা নাটক সিনেমা নয়; নিষ্ঠুর বাস্তবতা। বড় ভাই হিসেবে নিশ্চয়ই তোর খারাপ চাইবো না। ভালোবাসা কি তা তোর বোঝার বয়স হয় নি পিচ্চি। এখন পাত্তা পাচ্ছিস না তাই আগ্রহ কাজ করে। বড় হলে নিজেই লজ্জা পাবি। কোথাকার কোন কালাচাঁদের জন্য পাগলামো করেছিস!"
রূপসা মুচকি হাসে তবে তাঁর মন-ই-মন 'ভালোবাসা' নামক শব্দটা ঘুরপাক খায়। রিজ ভাই ভালোবাসার কথা বললো কেন? ভালোবাসা কি? ওই যে সিনেমার পর্দায় যে দেখায় সেরকম মিষ্টি মিষ্টি অনুভূতি? নায়কের মিষ্টি মিষ্টি কথার পৃষ্ঠে নায়িকার লাজুক হাসি! হাতের মুঠোয় হাত রেখে দিলে লজ্জাবতী গাছের ন্যায় কুঁকড়ে যাওয়া! নয়নে নয়নে শত শত মধুর আলাপ। খোঁপায় গোলাপ গুঁজে দেওয়ার পর মুখে লেপ্টে থাকা রাঙা হাসি। পরিজনের থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে হলুদ খামে চিঠির আদান প্রদান! চোরা চোখে আশেপাশে তাকিয়ে টেলিফোনে প্রেমালাপ। শাড়ির আঁচলে টান লাগার পর বড় বড় করে তাকানো! তাঁর হাত ঘড়িতে ওড়না আটকানো। কই তাঁর সাথে তো এমন কিছু হয় নি? এমন মিষ্টি কিছুই অনুভূত করে নি এখনো। তবে?
"এই পিচ্চি, সব বাজে চিন্তা ফেলে পড়াশোনায় মন দে। নয়তো ছবি'র মতো একটা নিম পাতার গাছের সাথে বেঁধে শ্বশুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিবো। ছবি'র বিয়ের ঘটক কিন্তু আমিই। রিনের বিয়েও আমার হাত দিয়েই গড়িয়েছে। ভার্সিটিতে কত বিয়ের ঘটকালি করলাম। ফুফু আম্মার বিয়েতেও আমার অবদান আছে। তখন আমি চার কি পাঁচের হবো। বলতে পারিস ঘটকালি আরেকটা আমার শখ।"
রূপসা মিটমিট করে হাসে নওরিজের কথায়। নওরিজও প্রত্যুত্তরে অল্প হাসে। হাত বাড়িয়ে রূপসার মাথার ব্যান্ডেজ আলতোভাবে ছুঁয়ে দেয়। পিচ্চিটার কিছু হলে সে সারাটা জীবন অনুতাপের রেশে দগ্ধ হতো। এমনিতেই আফসোসের অন্ত নেই। বলেছিলো কেউ ছুঁতে অবদি পারবে না অথচ শারীরিক মানসিক উভয় ভাবেই ঘায়েল করে দিলো কিশোরী মেয়েটাকে।
"আ'ম স্যরি পিচ্চি! আমার জন্যই সবটা হলো। তোর বড় ভাই তোকে পুরোপুরিভাবে রক্ষা করতে পারলো না। আর কে বলেছিলো আমাকে বাঁচাতে?খুব সাহস হয়েছে না? ভয় লাগে নি?"
রূপসা পিটপিট করে চায়। মিনমিনে সুরে বলে, "তোমাকে বাঁচাই নি তো! আসলে ওই হাত কাটা লোকটা ওভাবে দা ছুঁড়ে মারে আমি তো ভয়ে তোমাকে জাপ্টে ধরে ছিলাম! জানতাম নাকি আমাকে লাগবে। লাগলে তো ধরতামই না তোমাকে।"
নওরিজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। রূপসার নাক টিপে বলে,
"আমি তো ভেবেছিলাম পিচ্চি আমাকে বাঁচাতে সিনেমার মতো এগিয়ে এসেছে।"
রূপসা নিজ শারীরিক হাল ভুলে শব্দ করে হেসে ওঠে তবে ক্ষণপলের ব্যবধানে কুঁকড়ে ওঠে ব্যাথায়। নওরিজ খানিকটা উতলা হয়। শান্ত গলায় বলে,
"এই পিচ্চি, ডাক্তার তোকে বেশি জোরে কথা বলতে বারণ করেছে আর তুই শাকচুন্নীর মতো হাসছিস! ডাক্তার ডাকবো? কোথায় টান লেগেছে?"
রূপসা মলিন চোখে চায়। নোনাজলে ভরে ওঠা আঁখি যুগ্ম বাঁধন ভাঙে। নওরিজ টিস্যু পেপার এনে মুছে দেয় সেই নোনাজল। রূপসা ফ্যাচফ্যাচে ভঙ্গুর স্বরে আওড়ায়,
"রিজ ভাই জানো? ডাক্তার আমার সব চুল কেটে ফেলেছে। আমাকে ন্যাড়া বানিয়েছে। আমি এখন বাইরে যাবো কিভাবে? সবাই কি বলবে বলো? আমার কত সুন্দর চুল! আর যদি কখনো না গজায়?"
—————
মাঝে কেটে যায় আরো দু'দিন। সুরেলার অপেক্ষার প্রহর কাটে না। আর কত দীর্ঘ হবে এ প্রহর? কর্তা বিহীন ফাঁকা ঘরে ভালো লাগে না। অভিমানের পাল্লা ধীরে ধীরে বাড়ে। নতুন পরিবেশ, নতুন বাড়ি, নতুন ঘর; এতো এতো নতুনত্বের ভিড়ে নিজেকে বড্ড একা একা লাগে। বিবাহিত বান্ধবী , বুবু আর ভাবীদের মুখে বিয়ের পরবর্তী রোমাঞ্চকর মুহূর্ত গুলো শুনে সুরেলার রূহ অবদি কেঁপে উঠেছিল। লাজে রাঙা হয়েছিলো তনুমন। কিশোরী মন নানান স্বপ্নে বিভোর হয়েছিলো অথচ আজ বিরহে তাঁর দিন কাটে না। লোকটা আসুক কথা বলবে না সে।
"ভাবী? কি ভাবছেন?"
আরিফার ধাক্কায় সুরেলা ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে। মলিন মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
"কিছু না রিফা আপু!"
আরিফা মুচকি হাসে। লুডুর গুটি দিতে দিতে বলে,
"বুঝেছি। নিশ্চয়ই রিজ ভাইয়ের করা মনে পড়ছে। কথা বলবেন? আম্মার থেকে ফোন আনবো?"
সুরেলা একটু ইতস্তত বোধ করে। খানিকটা লজ্জাও পায়। তবে লজ্জাকে ঠেলে মাথা কাত করে স্বীকৃতি জানায়। আরিফা ঠোঁট চেপে হেসে উঠে চলে যায় ফোন আনতে। সুরেলা ফোঁস করে শ্বাস ফেলে। হায় বিবাহিত জীবন! নানীবু তো বললো বিবাহিত জীবনটা খাট্টা, মিঠা আর তিখা হবে কিন্তু এ যে পানসে লাগে!
কাজের মেয়ের ডাকে সুরেলা ছাদ থেকে নেমে আসে। দক্ষিণা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই চেনা কন্ঠস্বর ভেসে আসে। সুরেলার চোখে মুখে বিস্ময় ফুঁটে ওঠে। মাথায় ঘোমটা টেনে চটজলদি নেমে আসে। অন্দরমহলের ভেতরের বারান্দায় নেমে আসতেই প্রথমবারের মতো শাশুড়ির মুখোমুখি হয় সুরেলা। একটু ভীত হয় মন। জড়তা ঘিরে ধরে। কি বলবে কি শুধাবে ভেবে পায় না মন মস্তিষ্ক।
"আসসালামুয়ালাইকুম আম্মাজান।"
সালাম মিনমিনে গলায় দিলেও আম্মাজান বলতে আলাদা জোশ পায় সুরেলা। অতীতে ফেলে আসা কতশত অপমানে এ যেন নুনের ছিটা! রেবেকা বানু থম মেরে অবলকন করে সম্মুখে দন্ডায়মান কিশোরীকে। গায়ে টিয়া রঙের শাড়ি আটপৌরে শাড়ি আর হালকা স্বর্ণালঙ্কারে সুরেলা কে চেনা দায়। মেয়েটা তাঁর পুত্রবধূ ভাবতেই রাগে দুঃখে কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করে। থমথমে গলায় বলে,
"ফকিন্নী হুট করে রাজার ভান্ডার পেলে হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। পেছনে কিছুই তাদের নজর আসে না বুঝলি? আরেকবার ওই সম্বোধন করলে জিভ টেনে ছিঁড়ে নিবো।"
"আমার ভাই বলে নজর সবসময় সামনে রাখবি। পেছনে তাকালে পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। আশেপাশে কে কি বললো তাতে কান দিলে কষ্ট পাবি আর হেলায় উড়িয়ে দিলে মজা পাবি। আম্মাজান ডাক পছন্দ না হইলে শাশুড়ি জান ডাকি?"
সুরেলার ত্যাড়া জবাবে রেবেকা বানু ফুঁসে ওঠে।
"এতো জলদি তো গিরগিটিও রং পাল্টায় না। ফকিন্নীর ঝিয়ের অভিজাতের হাওয়া গায়ে লাগতেই বুলি ফুটলো নাকি?"
সুরেলা আঁচলে মুখ ঢাকে; শাশুড়ির দিকে এগিয়ে ফিসফিস সুরে বলে, "হয় শাশুড়ি জান। বাপের জন্মেও ভাবি নাই খান বাড়ির বড় বউ হমু। ভাগ্য দেখেন আমার, আপনার একমাত্র ছাওয়ালের বউ আমি। ফিলিং ভেরি প্রাউড।"
বলেই লাজুক হাসে সুরেলা। রেবেকা বানুর দাঁত কিড়মিড় করে। ইচ্ছে তো করছে চাপকে গাল লাল করে দিতে। তবে তিনি কাঁচা কাজ করতে অভ্যস্ত নন। তিনি যথা সময়ে যথযথ চাল দেবেন। রাহেলা বানু দূর থেকে লক্ষ্য করছিলেন বউ শাশুড়িকে। শাশুড়ি বুনো ওল তো বউ বাঘা তেঁতুল। তিনি এগিয়ে এসে বলেন,
"রেবু? কদ্দুর থাইকা আইলি যা হাত মুখ ধুইয়া নে ঠান্ডা পানিতে। ভাল্লাগবে নে। রোজা রাইখ্যা এতোটা পথ জার্নি কইরা আইলি। যা যা?"
রেবেকা বানু সুরেলার দিকে কটমট চাহনি নিক্ষেপ করে প্রস্থান করেন। সুরেলা মৃদু কেশে খালা শাশুড়ির দিকে তাকান। রাহেলা বানু চোখ পাকিয়ে শাসনের সুরে বলে,
"বউ তুই দেখতেছি বড্ডো ভেজাইল্ল্যা অথচ সুরত খানি আলাভোলা! তোর হাউরির নয়তো তার ছাওয়ালের কপাল পুড়লো বলে।"
সুরেলা ঠোঁট চেপে হাসে। এসব সাংসারিক কুচকাঁচাল সম্পর্কে কম-বেশি ধারনা নিয়েই এসেছে এ বাড়িতে। সেও সিনান সালেহের বোন। তাঁকে দমানো ওতই সোজা নাকি? সে এগিয়ে গিয়ে শ্বশুর মশাইকে সালাম দেয়। নোমান মাহবুব সুরেলার দিকে তাকায়। প্রথমে চমকালেও পরে স্মরণে আসে ছেলের পাগলামো। দ্বিতীয়বার উপস্থিত না থাকতে পারলেও প্রথমবার সজমিনে উপস্থিত ছিলো সে। সালামের জবাব নেয়। বাড়তি কোনো কথা না বলে তিনিও চলে যান কামরার দিকে। সে চলে যেতেই সুরেলা মেইন ফটকের দিকে উঁকি দিয়ে চোরা চোখে কাউকে খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু হায় তাঁর ভদ্রলোকের খবর নেই। ওই তো নওরিন আপা, বড় দুলাভাই আর দুই পিচ্চি ইকরা, ইয়ামিন আসছে। সে খুশি মনে সালাম পেশ করে বলে,
"আপা রূপসার কি খবর? সব ঠিকঠাক?"
একটু দোনামোনা মনেই শুধালো। নওরিন আপু জবাব দিলে হয়। নাকি মায়ের মতোই দু'টো কথা শুনিয়ে দিবে? নওরিন গম্ভীর মুখে বলে, "আলহামদুলিল্লাহ। ডাক্তার তো বললো আর কোনো চিন্তার কারণ নেই। কয়েকদিনের মধ্যেই রিলিজ দিবে।"
সুরেলা ঠোঁট চোখা করে 'ওহ্' বলে। নওরিন ব্যাগ হাতে চলে যায় উত্তর মুখী দরজার দিকে। ইকরাম উল্লাহ রয়ে সয়ে সুরেলার সম্মুখে দাঁড়ায়। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
"জনাবা আপনার ওই আকুল নয়ন যার খোঁজে ব্যাকুল হচ্ছে সে আসে নি। ডাক্তার বাবু তাকেও আঁটকে রেখেছে। বেচারা বউ বউ বলে মুখের ফ্যানা তুলে ফেললো কিন্তু ডাক্তারের মায়া দয়া কিচ্ছুটি হলো না। সত্যিই দুঃখজনক ঘটনা।"
সুরেলার আগ্রহী উজ্জ্বল মুখে আঁধার ভিড় জমায়। তবুও লাজুক হাসি ঝুলিয়ে প্রশ্ন করে,
"উনার শরীর কেমন?"
"নতুন বিয়ে করা নতুন বউ ঘরে ফেলে হাসপাতালের শক্ত বিছানায় আর কেমন থাকবে জনাবা? আমি ডাক্তারকে কত করে বললাম, এসব ওষুধে কিচ্ছু হবে না। বউ পেলেই রিজবাবু ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তার কানেই তুললো না।"
ইকরাম উল্লাহর কথায় সুরেলার কান ভারী হয়ে আসে। কোনোরকম নজর লুকিয়ে সামনে হাঁটা দেয় আর বলে,
"ধ্যাত কি যে বলেন না বড় দুলাভাই!"
"আরে জনাবা শুনে তো যান? আপনার তিনি আসতে না পারলেও তাঁর বুক ভরা ভালোবাসা পার্সেল করে পাঠিয়েছে। হেব্বি ভারী পার্সেলটা।"
সুরেলা থেমে যায়। লজ্জায় পড়ে বেশ। তবে খুতখুইত্যা লাট সাহেব কি পাঠিয়েছে জানার কৌতুহল আকাশচুম্বী। সে লাজুক বদনে ফিরে আসে। ইকরাম উল্লাহ ঝিকিমিকি কাগজে মোড়ানো একটা প্যাকেট বাড়িয়ে বলে,
"আপনার জনাব বলেছেন, চিন্তা না করতে। পরিবারের জন্য খারাপ লাগলে সেখানে ঘুরে আসতে তবে একা যাওয়ার পারমিশন দেন নি। বাকি আপনিই কথা বলে নিবেন!"
সুরেলা কোনোমতে মাথা কাত করে তড়িঘড়ি পা চালালো। তবে বাঁধ সাধলো ইকরা ইয়ামিন। দু'জন দুহাত টেনে ধরেছে। ইকরা কৌতুহলী মনে প্রশ্ন করে,
"মামী? তুমি মামার কি হও বলো তো?"
সুরেলা পিটপিট করে চায়। আশেপাশে নজর বুলিয়ে ধীমান কন্ঠে বলে, "বউ!"
ইয়ামিন তৎক্ষণাৎ অস্বীকৃতি জানিয়ে বলে,
"না না না হয় নি। বউ হও না। তুমি তো মামুজানের ডার্লিং হও।"
সুরেলার চোখ কপালে। ইকরা হেসে সুরেলাকে ঝুঁকতে বলে। সুরেলা ঝুঁকে এলে তাঁর দু গালে নিজ গাল ঘষে দিয়ে বলে,
"মামা তোমার গালে গাল ঘঁষে দিতে বলেছে।"
"কেন?"
"কি জানি!"
কাঁধ উঁচিয়ে বলে ইকরা। মামা তাঁর গালে চুমু দিলো আর বললো মামীর গালে আলতোভাবে গাল ঘষে দিতে।নওরিনের হাকে বাচ্চা দু'টো ছুটে যায়। সুরেলা চিন্তা ঝেড়ে নিজ কামরায় যায়। প্যাকেট খুলতেই একটা মোবাইল ফোন আর একটা সাদা চিরকুট নজরে আরে। সুরেলার চোখ মুখ হা হয়ে আসে। মোবাইল ফোন? সুরেলা ফোনটা হাতে নেয়। সব সেট করাই আছে। সিমটাও ভরা আছে দেখছি। সুরেলা ফোনের বাটন চেপে হাসে মুচকি মুচকি। কললিস্টে যেতেই একটি মাত্র নম্বর নজরে আসে। নওরিজ দিয়ে সংরক্ষণ করা আছে। সে কল করবে তখনি চিরকুটটা চোখে ভাসে। চিরকুট সহ নোকিয়া ফোনটা নিয়ে বেলকনিতে আসে। বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে চিরকুটের ভাঁজ খোলে। পড়ার আগে ঘ্রাণ শুঁকে। কামিনী ফুলের কড়া ঘ্রাণ নাকে বাজে। সে চিরকুটে চোখ বুলায়।
"ডার্লিং, তোমার ডান গালে একটা চুমু। বাম গালে আরেকটা চুমু। ভ্রু যুগলের মাঝে ওই ছোট্ট তিলে ছোট চুমু। সুঁচালো সরু নাকের ডগায় আরেকটা চুমু। আপেল আকৃতির থুতনিতে ভেজা চুমু। তুলতুলে জেলির মতো ওই ওষ্ঠাপুটে আগ্রাসী চুমু..."
আর পড়ার সাহস করে না সুরেলা! চিরকুটধরে রাখা হাত কাঁপে। মনে হলো চিরকুটের শব্দ গুলোতে জান আছে। তাঁর কপোল,ললাট, নাক সব ছুঁয়ে দিচ্ছে উষ্ণ স্পর্শে। সে চিরকুট ভাঁজ করে রেখে দিলো। আজকের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। না জানি আরও কত কী লিখে রেখেছে লুইচ্চ্যা লোক। হঠাৎ অদ্ভুত শব্দে ফোনটা বেজে ওঠে। সুরেলা চমকে ওঠে ক্ষীণকায়। ফোনটা পড়তে পড়তে বেঁচেছে। সে রিসিভ করে ডাকে,
"হ্যালো রিজ ভাই?"
"দু দুবার বিয়ে করলাম ভাই ডাক শোনার জন্য?"
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সুরেলা ভড়কে ওঠে। জিভে কামড় বসিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
"হ্যাগো শুনছেন? সাইমুমের আব্বা?
ওপাশের ব্যাক্তির অধরকোণে মিষ্টি হাসি লেপ্টে গেল। তবে স্বীয় গাম্ভীর্য ঠাঠ বজায় রেখে জবাব দেয়,
"হ্যাঁ শুনছি। পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে দেখছি আপনার খুব আগ্রহ! বলে রাখছি নভ্যরিজ, নওশিন, নম্রতা, নদী, নায়রা, নিভ্রান এই পাঁচ জনের সিরিয়াল আগে আসবে।"
সুরেলার মুখ হা হয়ে আসে। এ লোক দেখছি তারও এক কাঠি উপরে। কি কি নাম বললো? ধ্যাত! লাজে গাল রক্তিম হয়ে আসে। কণ্ঠে জড়তা কুন্ডুলী পাকায়। তবুও দাঁত কেলিয়ে বলে,
"বলছি কম হলো না? আরো কিছু নাম ঠিক করে রাখতেন!"
"নাওয়াফ, নুরিয়া, নাজিফা,নওশাদ..."
"হয়েছে হয়েছে ব্রেক কষেন! শখ কতো জনাবের!"
নওরিজকে থামিয়ে সুরেলা ব্যাঙ্গ স্বরে বলে ওঠে। নওরিজ মাহবুব মুচকি হেসে বলে,
"আপাদত কিছু লুচ্চা টাইপ শখ জাগছে মনে।"
"কিহ্?"
অবাক সুরে শুধায় সুরেলা। চিঠির শব্দ গুলো কানে বাজে। তখনই ওপাশ থেকে লোকটার গমগমে রাশভারী আওয়াজ ভেসে আসে কর্ণ গহ্বরে।
"ডার্লিং, তোর ডান গালে চুমু। বাম গালে আরেকটা চুমু। কপালে তিলের উপর ছোট ছোট চুমু। নাকের ডগায়, থুতনিতে আর ওই জেলির ন্যায় নরম নরম ঠোঁটে চুম...এক মিনিট এই ব্রাশ করেছিস তো?"
সুস্বাদু বিরিয়ানির মাঝে এলাচের কামড়। সুরেলা চরম মাত্রায় হতাশ। বুঝতে বাকি থাকে না এই খুঁতখুঁইত্যা লাট সাহেব তার বাকিটা জীবন ব্রাশময় বানিয়ে দিবে।
·
·
·
চলবে........................................................................