অভিমানিনী - পর্ব ২৩ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          চাচিকে দেখে অদ্রি নার্ভাস হয়ে গেল। কিন্তু সাহস রাখল অৰ্পি ছোট হলেও, কম বুঝলেও সাহস বেশি। কোনো অকাজ করে ধরা পড়লে মিথ্যে বলে এমনভাবে সামলায় যে কেউ কিচ্ছু বুঝতে পারে না। ও নিশ্চয়ই কিছু বলে এই পরিস্থিতিটাও সামলে নিতে পারবে। অৰ্পি বলল,

“এই তো, আপ্পি আর আমি গল্প করছিলাম।”

হঠাৎ চাচির নজর পড়ল ওই ডায়েরিটাতে। বলল,

“ডায়েরিটা, এটা তোদের চাচ্চুর না?”

অর্পি অবাক হওয়ার ভান করে বলল,

“চাচ্চুর ডায়েরি? এটা তো আপ্পির ডায়েরি।”

“ওহ। এরকম একটা ডায়েরি তোদের চাচ্চুরও আছে। আমি ওকে লিখতে দেখেছিলাম বোধহয়।”

অর্পি ডায়েরিটা রেখে চাচির কাছে যেতে যেতে বলল,

“ও হতে পারে!”

তারপর চাচিকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“জানো সুইটহার্ট, এটাতে আপ্পি লাভস্টোরি লিখেছে।”

বলেই অর্পি হেসে দিল। চাচি বলল,

“ওমা তাই আমাদের অদ্রি এত বড় হয়ে গেল কবে! এর মধ্যেই লাভস্টোরি?”

অদ্রি কিছু বলতেও পারল না। সইতেও পারল না। তাও ভালো মানুষটা দিতিয়া চাচি। কাউকে কিছু বলবে না। চাচি আবার বলল,

“ছেলেটি কে হুম?”

“বলব চাচি। সময় হলেই বলব।”

অৰ্পি বলল,

“আরে ওর কথা আর বোলো না। সেই কবে ছেলেটা ওকে প্রোপজ করেছে আর ও তাকে কিছুই বলেনি। এদিকে ডায়েরিতে তার কথা লিখে ভরে ফেলছে।

“তার মানে এখনো কিছু শুরু হয়নি?”

“ওই আর কি! শুরু হয়েছে তবে মনে মনে।”

“তাহলে এখন মনে মনেই রাখ। আরেকটু বড় হ তারপর দেখা যাবে, কেমন?”

একথা বলে চাচি একটা বইয়ের আলমারির দিকে গেল। তারপর চাচ্চুর একটা বই বের করতে দেখে অর্পি জিজ্ঞেস করল,

“এই বই তুমি পড়বে?”

“নাহ, তোমার চাচ্চু পড়বে।”

“চাচ্চু এত তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসেছে?”

“হ্যাঁ।”

চাচি বইটা নিয়ে বের হয়ে গেল। অদ্রি যত দ্রুত সম্ভব ডায়েরিটা জায়গামতো রেখে দিল। তারপর ড্রয়ার লক করে চাবি যেখানে ছিল সেখানেই রেখে বেরিয়ে গেল লাইব্রেরি থেকে। নিজেদের ঘরে গিয়ে অর্পি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল,

“চাচির জায়গায় চাচ্চু এলে কী হতো বল তো?”

“এক চড় মারব তোকে। এখন এই কথা মনে পড়ছে? যখন তোকে বলেছিলাম দরকার নেই এসবের মধ্যে যাওয়ার তখন শুনেছিলি?”

“বকছিস কেন? তুইও তো পড়েছিস।”

“তোর জেদের জন্যই তো এই ডায়েরি পড়ার শুরু।”

“না পড়লে কি আর জানতে পারতাম এত কিছু?”

“না জানলেই ভালো হতো। উফ কী কষ্ট!”

“আচ্ছা আপি তোর কার জন্য বেশি কষ্ট হচ্ছে?”

“চাচ্চুর জন্য।”

“ওহ, আর আমার প্রথমে কষ্ট হচ্ছিল মানসীর জন্য আর এখন কষ্ট হচ্ছে চাচির জন্য।”

“চাচির জন্য কষ্ট হবে কেন, চাচি তো চাচ্চুর সাথেই থাকতে পারছে। আর বেচারা মানসী আন্টি সেই কত দূরে কানাডায় থাকে। চোখের দেখাও দেখতে পায় না। সবচেয়ে বেশি কষ্ট চাচ্চুর। লেখাগুলো পড়েও বুঝিস না?”

“হুম, তা ঠিক। কিন্তু আপ্পি…এখন বাকিটা জানব কী করে?”

“রাত হলে গিয়ে পড়তে হবে। এছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই।”

হঠাৎ অৰ্পি বলল,

“চল দুধের সাধ ঘোলে মিটাই।”

“কী?”

“সিনেমার মতো ফ্ল্যাশব্যাকের পর আবার প্রেজেন্ট টাইম দেখি।”

“কী বলতে চাচ্ছিস?”

“আমাদের এই ঘরটা আগে কার ঘর ছিল বল?”

“মোনা ফুপির ঘর ছিল।”

“তাহলে এই ঘরেই মানসী আন্টি থাকত। সেই জয়েন্ট বারান্দাটা কিন্তু এখনো আছে।”

“এই অৰ্পি, তুই কি চাচ্চু-চাচির ঘরে উঁকি মারার প্ল্যান করছিস?”

অর্পি অদ্রিকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“এজন্যই আমি তোকে এত্ত ভালোবাসি আপ্পি।”

অদ্রি অর্পিকে সরিয়ে দিয়ে বলল,

“দূর হ…ছিঃ”

“ছিঃ বললে পরে বলিস, এখন চল। আমি একা উঁকি মারব তা হবে না।”

অর্পি একরকম জোর করে নিয়ে গেল অদ্রিকে।

বারান্দায় গিয়ে দেখল যথারীতি চাচ্চুদের দরজাটা লাগানোই আছে। জানালার পর্দার ফাক দিয়ে তাকালো…

চাচ্চু ঘরে নেই। চাচি একটা সুটকেস গোছাচ্ছে। অদ্রি ফিসফিসিয়ে বলল,

“চাচ্চু বোধহয় যাবে কোথাও।”

“হুম।”

চাচি সুটকেসটা গুছিয়ে বিছানা থেকে নামিয়ে আলমারির পাশে রাখল। এর মধ্যেই চাচ্চুকে দেখা গেল টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বের হলো। চাচি বলল,

“তোমার সুটকেস গুছিয়ে দিয়েছি। যা যা বলেছ সব দিয়েছি। আর কিছু মনে পড়লে বলো।”

“মনে পড়লে বলব। আর না মনে পড়লেও ওখানে মার্কেট আছে তো! কিনে নিতে পারব। তুমি অযথাই টেনশন করো।”

চাচি চুপ করে রইল। চাচ্চু টাওয়ালটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে বলল,

“কি মন খারাপ করছ কেন?”

চাচি বলল,

“মন খারাপ কেন করব?”

চাচ্চু চাচির হাত ধরে কাছে নিয়ে কপালে একটা চুমু দিল, তারপর জড়িয়ে ধরলো। চাচিও চাচ্চুর বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরল। চাচি খুব বেশি লম্বা না। অপরদিকে চাচ্চুর উচ্চতার কারণে চাচির মাথাটা ঠিক চাচ্চুর বুকের ওপর পড়ে আছে। আহা! অদ্রির মনে হলো এর চেয়ে মধুর দৃশ্য ও কখনো দেখেনি।

চাচ্চু বলল,

“আমি নিজেই আগে জানতাম না, তোমাকে কীভাবে বলব বলো? এই সেমিনারে আমার যাওয়ার কথা ছিল না। ড. কবিরের যাওয়ার কথা ছিল। এখন হঠাৎ সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমার যেহেতু ভিসার মেয়াদ আছে হসপিটাল অথরিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমাকে পাঠাবে। পরশুর পরের দিন সেমিনার শুরু। আজকে রওনা না দিলে হবে কীভাবে বলো?”

“আমি কি কিছু বলেছি?”

“বলেছ আর কবে? কখনোই তো কিছু বলো না। কিন্তু আমি তো বুঝি। হঠাৎ করে বিনা নোটিশে এত দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি এটা তোমার মন মানতে চাইছে না।”

চাচি চুপ করে রইল। চাচ্চু বলল,

“আমি অনেক টায়ার্ড। একটু শুতে চাচ্ছিলাম। ছাড়বে না নাকি?”

চাচি লজ্জা পেয়ে সরে গিয়ে বলল,

“চা বা জুস কিছু খাবে?”

“কফি দাও।”

“আচ্ছা।”

চাচি বেরিয়ে যেতেই অর্পি নিজের দুই গালে হাত দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

“ওহ মাই গড! চাচ্চু এখনো কি রোমান্টিক!”

“উফ তুই একটু চুপ করবি?”

“কেন চুপ করব?”

“কারণ, আমরা যেটা করছি সেটা ঠিক করছি না। ওরা আমাদের চাচা-চাচি।”

“নো আপ্পি, ওরা এখন আর আমাদের কাছে চাচা-চাচি না। একটা ট্রায়াঙ্গল লাভস্টোরির হিরো হিরোইন।”

অর্পির এসব আবোলতাবোল তর্কের শেষ না হতেই চাচি কফি নিয়ে এল। চাচ্চু এতক্ষণ শুয়ে ছিল। এবার উঠে বসে কফির মগটা হাতে নিল। চাচি বলল,

“আচ্ছা তোমার একটা নীল রঙের ডায়েরি আছে না?”

“নীল রঙের তো কতগুলো ডায়েরিই আছে। কেন বলো তো?”

“নীল মানে নেভি ব্লু!”

চাচ্চু কী যেন একটু ভাবল। অদ্রি অৰ্পি ভয়ে চুপসে গেল। চাচ্চু বলল, “কেন কী হয়েছে ওটার?”

“তেমন কিছু না। কদিন আগে তোমাকে কী যেন লিখতে দেখলাম। আজ আবার অদ্রির কাছে দেখলাম ওরকম একটা ডায়েরি। তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

“ওহ, তাহলে ঠিক আছে। ওটা সৌরভের হসপিটালের ডায়েরি। ওই আমাকে দিয়েছিল। হয়তো ওর মেয়েকেও দিয়েছে। আর আমারটা তো তালা মারা আছে।”

“ও।”

“আচ্ছা, বললে না তো প্যারিস থেকে তোমার জন্য কী আনব?”

“আমার কিচ্ছু লাগবে না। তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।”

“বাপরে! এখন তো মাত্র এক মাস, যখন সাত বছর আমি ইউএসএ ছিলাম তখন কী করে থেকেছিলে?”

“তখনকার কথা আলাদা।”

“তো?”

“কিছু না।”

“তখন তো কোনো আশা ছাড়া সাতটা বছর বিনাবাক্যে কাটিয়েছ, আর এখন তো মাত্র এক মাস।”

চাচি এবারও শুধু বলল,

“হুম।”

“আর এখন তো আরো সহজ হওয়ার কথা। কারণ, এখন দিহান আছে তোমার কাছে। ওকে নিয়ে সময় কেটে যাবে।”

চাচি বলল,

“হুম, খুব ভালো সময় কাটবে।”

“এই দেখো, আবার মন খারাপ করছে। আচ্ছা…তোমার স্বামী পৃথিবীর কত বড় বড় ডাক্তারদের সামনে স্পিচ দেবে। তোমার প্রাউড ফিল হচ্ছে না?”

“হ্যাঁ তা তো হচ্ছেই। তোমাকে নিয়ে সব সময়ই আমি প্রাউড ফিল করি।”

“অন্য কোনো লোক তোমার স্বামী হলে তোমাকে নিয়েও প্রাউড ফিল করত।”

“কেন? আমি আবার এমন কী!”

“তুমি সুন্দরী।”

“সুন্দর দিয়ে দুনিয়ায় কিছু হয় না।”

“হয় তো। অনেক পুরুষদের কাছে সৌন্দর্যটাই সব।”

“কার কাছে কী তা দিয়ে আমার কী যায় আসে?”

চাচ্চু কী ভেবে যেন হাসল। চাচি বলল,

“হাসছ যে?”

“এমনি।”

চাচ্চু একটু আগে যে ভেজা তোয়ালেটা বিছানায় ছুড়ে ফেলেছিল, চাচি সেটাকে তুলে বারান্দার দিকে আসছে দেখে অদ্রি অর্পি দৌড়ে ওদের ঘরে ঢুকে গেল।

রাত্রেই ফ্লাইটে নীরব প্যারিস চলে গেল। অদ্রি অর্পি রাত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। ওরা খুব ভয়ে ভয়ে আছে, চাচ্চুকে লাইব্রেরিতে ঢুকতে দেখেছিল। ডায়েরিটা নিয়ে যায়নি তো আবার? যদি নিয়ে যায় তাহলে তো এক মাস অপেক্ষা করতে হবে তারপর কী হয়েছিল জানার জন্য।
·
·
·
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp