অনন্যা বাসায় ফিরে কতক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিল। কৌশিক স্যারের সাথে কথা তো হলো কিন্তু। বাকি কথা আর ভাবতে পারলো না অনন্যা।হঠাৎ পেটটা মোচড় দিয়ে উঠলো। প্রচণ্ড ক্ষুধা লাগলেও মনটা কিছুতেই শান্ত হচ্ছিল না। ধীরে ধীরে উঠে বাইরের জামাকাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসল সে। খাবারের প্যাকেটটা খুলে দু-চার চামচ খাবার মুখে তুললো। প্রথমে তো বেশ তৃপ্তি ভরে খাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ করেই অস্বস্তিটা বেড়ে গেলো। মাথাটা ঘুরতে লাগলো। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসতে লাগলো অনন্যার।
অনন্যা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলো। ওর মনে হচ্ছিল চারপাশের সবকিছু দুলছে। অনন্যা টেবিল আঁকড়ে ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকলো তারপর অনেক কষ্টে উঠে বাথরুমে ছুটে গেল। অল্প আগেই খাওয়া খাবারগুলো বেরিয়ে এলো বমির সঙ্গে। শ্যামল মুখটা লাল হয়ে উঠেছে শরীর খারাপের চোটে। চোখ দুটো জ্বলছে বেশ। হাত ধুতে গিয়ে তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। অনন্যা হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো মা ফোন করেছে। অনন্যা পাশ থেকে টিস্যু নিয়ে তাড়াতাড়ি করে মুখ মুছতে লাগলো। অনন্যাকে এই অবস্থায় দেখে নিশ্চয়ই মা চিন্তা করবে। তাই নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে লাগল অনন্যা। কিন্তু দেখতে দেখতে ফোনটা কেটে গেলো। তাই অনন্যা কে পাল্টা ফোন করতে হলো।
পল্লবী শিকদার সঙ্গে সঙ্গেই ফোন ধরলেন। কণ্ঠে একটুখানি ক্লান্তি ছিল। এতোক্ষণ কাজ করছিলেন তিনি। কোনো স্থানেই মায়েদের স্বস্তি নেই। সবসময় কাজের মধ্যেই থাকতে হয় ওনাদের কে।
তবুও তিনি মমতামাখা সুরে বললেন,
"কি করছিলি রে?"
অনন্যা হালকা হেসে চোখে মুখের অবসন্ন ভাব লুকিয়ে ফেললো। বলল,
"কি আর করবো মা! এখনই বাসায় এলাম। তোমরা কখন ফিরলে? বাবা কোথায়?"
পল্লবী শান্ত স্বরে জানালেন,
"আমরা তো আগেই এসে গেছি। জিনিসপত্র গুছাতে গুছাতেই সময় কেটে গেলো। তারপর ঘরদোর পরিষ্কার, রান্নাবান্না করে এই একটু ফুসরত মিললো।"
"ওহ, আচ্ছা।"
"হ্যাঁ, তোর বাবা কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে। কিন্তু তোর ফিরতে এত দেরি হলো কেন?"
অনন্যা চুলে হাত বুলিয়ে একটুখানি ইতস্তত করে বলল,
"অনুষ্ঠান ছিল মা, তারপরে হঠাৎ খুব জোরে বৃষ্টি এল। তাই একটু দেরি হয়ে গেলো।"
"ওহ আচ্ছা। তো খাওয়াদাওয়া করেছিস? পেটের কি অবস্থা? ব্যথা করে?"
হাতের কাজ থামিয়ে অনন্যার দিকে তাকিয়ে পল্লবী শিকদারের মুখে এবং কণ্ঠে চিন্তা বেড়ে গেল।
অনন্যা হাত নাড়িয়ে ধীরে ধীরে উত্তর দেয়।
"না মা, ব্যথা করে না। হঠাৎ হঠাৎ মাথা ঘোরায় এই আর কি! এমনি সব ঠিক আছে। "
"কি বলিস! ডাক্তারকে আসতে বলবো?"
"আরে না মা, ডাক্তার কেন আসবে? এসব তো নরমাল। তাছাড়া কাল উনি নিজেই এসেছিলেন। কী যেন একটা ওষুধ দিয়ে গেছেন। আমি এখনো খাওয়া শুরু করিনি।"
পল্লবী কণ্ঠে হালকা রাগ মেশানো উদ্বেগে বললেন,
"খাসনি কেন? ঠিকমতো ওষুধ খেয়ে খাওয়াদাওয়া কর। আচ্ছা, ঈরাকে বলবো তোর সাথে থেকে যেতে?"
"না মা, থাক। মামী পছন্দ করবে না।"
অনন্যা মৃদু গলায় উত্তর দিলো।
"তাহলে নোহারা? ওকে বল না। এই অবস্থায় তুই একা একা থাকবি। আমরাও তো তাড়াতাড়ি আসতে পারছি না। কিন্তু চেষ্টা করবো। তুই একটু বলে দেখ ওকে।"
"থাক। আমি ঝামেলা বাড়াতে চাই না। আমি একাই পারবো, মা। এই যে অনুষ্ঠানে খাবার পেয়েছি আজ চলে যাবে। তারপর রান্না করবো।"
"পারবি তো তুই? আচ্ছা আগের দিনের কিছু খাবার তো ফ্রিজে আছে ওগুলো গরম করেও খেতে পারিস। আর দেখ কোনো কাজের লোক পাস কিনা যাতে ঘরদোর পরিষ্কার আর খাবারটা রান্না করে দিতে পারে।"
"মা? টাকা কোত্থেকে আসবে?"
অনন্যার মা বিরক্তের সাথে বললেন,
"তোকে টাকার চিন্তা করতে কেউ বলেছে? তুই শুধু নিজের চিন্তা কর। তোর বাবা তো আছেই! কয়েক দিন পর তোর বাংকে টাকা পাঠাবে। আর কিছু দিন আগে না তোর মামা টাকা ফেরত দিয়েছিল ওগুলো ব্যবহার করতে থাক তাহলেই তো হয়। সেগুলো তো ঢের ছিল দেখেছিলাম। এমনি এমনি সব ম্যানেজ হয়ে যাবে। এতো চিন্তা করিস কেন শুধু শুধু?"
অনন্যা মাথা নিচু করে বললো ,
"মামার দেওয়া টাকা আমি খরচ করে ফেলেছি।"
পল্লবী চমকে উঠলেন,
"কি? কীভাবে এতো টাকা খরচ করলি?"
" হয়ে গেছে কিছু দরকারি কাজে। আর বাকি সেমিস্টার ফিতে চলে গেছে।"
পল্লবী ধমক দিয়ে উঠলেন,
"অনন্যা? এগুলো কি বলছিস? টাকা কি গাছ থেকে পড়ে? এগুলো তোর বাবার টাকা ছিল যা আমার ভাই এতো দিন পর ফেরত দিলো আর তুই এগুলো খরচ করে ফেলেছিস? ফাজিল!"
পল্লবী আরো কতক্ষন কথা শোনালেন। অনন্যা মুখ ফুলিয়ে ফোন কেটে দিলো। ধীরে ধীরে টেবিলের উপর আলতো করে মাথা রেখে দিলো। এই তো কয়েক দিন আগে প্রিয় মানুষটির জন্য রিং কিনেছিল সেখানেই টাকা গুলো খরচ গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। অনন্যার মা আবার ফোন করলেন। অনন্যার ধরতে ইচ্ছে হলো না। কি বলবে সে! ভালো লাগছে না কিছুই। খাবারটা আরেকটু খেয়ে বিছানার দিকে চলে গেলো সে।
কৌশিক স্যার চলে যাওয়ার পর লারা আর তামংকে আর দেখেনি অনন্যা। নিক ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করেছিল। সে বলেছিল,
কৌশিকের জন্য তাদের জীবন তো থেমে থাকবে না। কয়েক দিন খুব শোকে কান্নাকাটি করেছিল। তারপর বাড়িটাকে আর রিডোকে বিদায় দিয়ে নিজেদের জায়গায় ফিরে যায় ওরা। যদিও সে-ই বাধ্য করেছিল ওদেরকে যেতে। লারা আর তামং কৌশিককে নিজের ছেলের মতো দেখতো। এজন্যই খুব কষ্ট পেয়েছিল। ওরা দুজনে এখানে প্রথমে টাকার লোভে এলেও একসময় কৌশিকের মায়ায় আটকে যায়।
অনন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সত্যি মানুষ চলে যায়, কিন্তু ওদের রেখে যাওয়া স্মৃতি এবং ভিতরে তৈরি করা টান কখনো শেষ হয়ে যায় না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তা মনের গভীরে বিদ্যমান থাকে। যেমনটা কৌশিক স্যার কিছু কিছু মানুষের মনে নিজের জায়গা এতো গভীরভাবে দখল করে নিয়েছেন যে তারা কেউ তাকে ভুলতে পারছে না। তাদের মধ্যে অনন্যাও তো পড়ে।
গভীর রাতে অনন্যার শরীর হঠাৎ করেই বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। প্রচণ্ড জ্বর গা ঝিমঝিম করে উঠলো। সারা শরীরে অস্বস্তির ঢেউ। বারবার বাথরুমে যেতে হলো তাকে। স্থিরতা দেহ মেনে নিতে পারছিল না। শরীরটা কেমন শূন্য শূন্য মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল শরীরে কোনো শক্তি নেই। শেষরাতের দিকে জ্বর খানিকটা কমলে কিছুটা ঘুম এল। কিন্তু সেটা ছিল টুকরো টুকরো স্বস্তির মতো। ভোরের আলো ফুটতেই অনন্যার আবার ঘুম ভেঙ্গে গেল। কিন্তু শরীরে প্রচন্ড ব্যথা যা সহ্য হচ্ছিল না অনন্যার। হাত-পা নড়াতে গেলে যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ছে সারা গায়ে। মনে হচ্ছিল একটু নাড়াচাড়া করলে সব কিছু ভেঙে যাবে।
নোহারা ফোন করেছিল। অনন্যা শান্ত গলায় জানিয়ে দিলো, আজ ভার্সিটিতে যাওয়া সম্ভব নয়। শরীর ভালো নেই। নোহারাও বললো বিকেলের দিকে নিককে সঙ্গে নিয়ে আসবে। এতোক্ষণ একটু নিজের খেয়াল রাখতে আর ঠিকমতো ওষুধ সেবন করতে।
******
কৌশিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে গিয়েছিল বেশ সকালেই। রাতটা প্রায় জেগেই কেটেছে তার। চিন্তায় ঘুমই আসেনি। ভোর হতে না হতেই পড়াশোনা আর প্রস্তুতির ভেতর নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছে। সকালবেলায় তার একটা ক্লাস ছিল। আর নিয়মমতো শিক্ষকদের নয়টার মধ্যে ক্যাম্পাসে উপস্থিত হওয়াটা বাধ্যতামূলক। তাই আগে যাওয়া ওর।
টানা কয়েকটা ক্লাস নেওয়ার পর অবশেষে একটা স্বস্তির মুহূর্ত মিললো। দুপুরের ব্রেক টাইম। একটু হালকা হতে কফির কাপ হাতে নিয়ে ক্যান্টিনের দিকে হাঁটা দিলো কৌশিক। মেহজাবিন বেগম সকালে জোর করেই কিছু খাবার দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কৌশিক তা বিনীতভাবে না করে দিয়েছিল। শুধু শুধু মাকে ভোরবেলা জাগিয়ে কষ্ট দেওয়াটা তার একদমই পছন্দ নয়। তাই আপাতত ক্যান্টিন থেকেই কিছু খাওয়ার চিন্তা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সে।
ক্যাম্পাসজুড়ে তখনো হালকা রোদ। হাওয়ায় ভেসে ছিল কাল রাতের বৃষ্টির ছিটেফোঁটা এবং সকালে জমে থাকা ভাবনার শীতলতা। কফি শেষ করে কাপটা ডাস্টবিনে ফেলে দিলো কৌশিক। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাচ্ছিলো সামনের দিকে। হঠাৎ কানে গেল অনন্যার নাম। কৌশিক চোখ ঘুরিয়ে দেখলো কালকের ক্লাসের অনন্যার পাশের সেই মেয়েটা যে নিজেকে অনন্যার বান্ধবী দাবি করছিলো। কৌশিক নাম মনে করার চেষ্টা করলো। হ্যাঁ নোহারা বলেছিলো মেয়েটা।
নোহারা কারো সাথে ফোনে কথা বলছিলো। কাউকে জোর গলায় বললো,
"অনন্যার তো শরীর খারাপ!"
বিপরীত পাশের মানুষটা কি যেন বললো। কৌশিক শুনতে পেলো না। নোহারার টেবিলের সামনে কৌশিক ঠাঁই মেরে দাঁড়িয়ে ছিল। নোহারা বুঝতে পেরে চোখ ঘুরিয়ে স্যারের দিকে তাকালো। কৌশিক পড়ে গেলো অস্বস্তিতে। মাথা চুলকে দ্রুত সামনে হাঁটা ধরলো। নোহারা আবার কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
কৌশিক ক্যান্টিনের সামনে গিয়ে খাবার অর্ডার করলো। কিন্তু চোখ পড়েছিল নোহারার দিকে। অনন্যা নামে কি যেন বলছিল মেয়েটা। অনন্যার শরীর খারাপ কথাটা শুনেই কেন জানি খারাপ লাগলো কৌশিকের। আচ্ছা ওর জন্য শরীরটা খারাপ হয়ে যায়নি তো? নাকি বৃষ্টিতে ভিজেছে বলে অসুখ করেছে? চিন্তা হলো কৌশিকের।
অতঃপর ফোন দেখার বাহানা করে হাঁটতে হাঁটতে নোহারার পেছনের টেবিলে বসে পড়লো কৌশিক। যদিও শিক্ষকদের জন্য আলাদা টেবিল ফিক্সড করা তাও সে এসে বসলো সেখানে। নোহারা নিকের সাথে কথা বলছিলো।
নিক বললো,
"কি আবার হয়েছে ওর?"
"আরে তোমাকে না বলেছিলাম অনন্যা প্রেগন্যান্ট? এর জন্য ই হয়তো শরীর খারাপ করছে।"
"কি যা তা বলছো! অনন্যা প্রেগন্যান্ট কীভাবে হবে?"
নোহারা কঠোর গলায় বললো,
"কীভাবে হবে মানে কি আবার? কৌশিক স্যার আকাম করে হাওয়া হয়ে যাবে তারপর তুমি ওনার বন্ধু হিসেবে তা মানতেও পারবে না। এতো নির্লজ্জ কেন তোমরা?"
"আমাকে উল্টাপাল্টা বলছো কেনো? আমি কি করেছি?"
"কি করোনি সেটা বলো! তোমার সাথে আমি তো ব্রেকাপ করেই ফেলেছি। তারপর গ্রামে গিয়ে বিয়ে করে আসবো। এখনো ফোন করতাম না শুধু আমার প্রিয় বান্ধবী কষ্ট ভোগ করছে আর আমি চেয়ে চেয়ে তা দেখবো? তা হয় নাকি এজন্য ফোন করা নাহলে তোমাকে আবার কে ফোন করে?"
নোহারা ভেংচি কেটে কথাগুলো বলতে লাগলো। নিক ও পাল্টা উত্তর দেওয়া শুরু করছিলো কিন্তু বিপরীত পাশ থেকে কারো আওয়াজ শুনে থেমে গেলো। কোনো মেয়েলী কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো নোহারা।
মেয়েটা বললো,
"এক্সকিউজ মি! আমি একটা হট চকলেট নিবো। আম... উইথ এক্সট্রা ক্রিম এন্ড সুগার। হবে কী? "
নোহারা তো চমকে উঠলো মেয়েটার কথা শুনে। নিক ফোনটা নামিয়ে নিলো। কিছু সময় পর ফোনটা আবার কানে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
"রাখছি, লিটেল গার্লফ্রেন্ড। পরে কথা হবে।"
ফোনটা হঠাৎ করেই কেটে গেলো। আর সেই মুহূর্তেই সময় থেমে গেলো নোহারার জন্য। সে স্থির হয়ে বসে রইল। এক দৃষ্টিতে ফোনের পর্দার দিকে তাকিয়ে রইল কতক্ষণ। মনটা এলোমেলো হয়ে গেছে। সন্ধ্যা ভাইয়া কি তাহলে কোনো জব করছে? ভাইয়ার সাথে কতদিন দেখা হয় না! তারপর হঠাৎ একদিন খবর শোনা গেলো, নোহারার বিয়ে ঠিক হয়েছে। পরিবার বারবার ওকে যেতে বলছে। কিন্তু সে কোনো না কোনো অজুহাতে আটকে রেখেছে নিজেকে। সন্ধ্যা ভাইয়ার কথাও জানিয়েছে। ওরা মেনে নেয়নি। নোহারা জানে একবার গেলে ফিরে আসা কঠিন হবে। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া সহজ কাজ হবে না। সন্ধ্যা ভাইয়াকে ওরা তো মেনে নেয়নি। নিশ্চয় গেলেই নোহারার বিয়ে দিয়ে দেবে। আর আজ জানা গেলো সন্ধ্যা ভাইয়া জব করছে! এত বড় কথা কিন্তু নোহারা কিছুই জানত না।
মনের ভেতর কেমন একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল। একরাশ অজানা ভয় আর না বলা কথার ভার বুকের ভেতর পাথর হয়ে বসে রইল। কিন্তু ওর ই বা কি দোষ? সন্ধ্যা ভাইয়া নিজে যদি এগিয়ে আসতো নোহারা কি না করতো কখনো? সে তো নিজেই নোহারাকে জানায়নি জবের কথা।
পেছনের সিটে বসে থাকা কৌশিক ফোনে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু তার কান দুটো নোহারার কথায় সীমাবদ্ধ ছিল। নোহারার কথা অনুযায়ী অনন্যা প্রেগন্যান্ট আর এর কারণ কৌশিক নিজে। কৌশিক নিজের মুখ চেপে ধরলো। কি সব কথা শুনতে হচ্ছে তাকে! এখন এইসব প্রশ্ন কাকে জিজ্ঞেস করবে আর কার থেকেই বা উত্তর পাবে? দ্বিতীয়ত বিশ্বাস ও হচ্ছে না মেয়েটা প্রেগন্যান্ট। এই তো কালকেই কত চড়া গলায় কথা বলছিল তার সাথে। দেখে তো মনে হচ্ছিল না যে পেটে! কৌশিক আর ভাবতে পারছে না প্রথম প্রথম কাকে দেখেই বা বোঝা যায় যে সে প্রেগন্যান্ট নাকি না। কৌশিকের খাবার এসে পড়েছে। নোহারাও উঠে চলে গেছে। কৌশিক সেদিকে একবার লক্ষ্য করে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। কিন্তু খেতে পারছিল না। বারবার অনন্যার কথা মাথায় এসে চেপে বসেছে। কি ঝামেলা!
খাওয়াদাওয়া শেষে কৌশিক ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো তখন দেখা হয়ে গেলো আরণ্যকের সাথে। আরণ্যক স্যারকে হাসি দিয়ে এগিয়ে গেলো। মুখে কিছু বলার ইচ্ছে ছিল যদিও কিন্তু পিছনে আরো কয়েকজন স্যারকে দেখে সে আর কিছু বললো না। কিন্তু কৌশিক কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে নিজেই থেমে দাঁড়ালো। পিছনে ঘুরে আরণ্যককে দাঁড়াতে বললো। আরণ্যক ও দাঁড়িয়ে কৌশিক স্যারের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো।
কৌশিক বললো,
"ক্লাস শেষে আমার সাথে দেখা করে যেও।"
আরণ্যক মাথা নাড়িয়ে উত্তর করলো,
"জ্বি, স্যার!"
কৌশিক নিজের কাজে চলে গেলো। এদিকে আরণ্যকের মাথায় চিন্তা ভর করলো। কি কথা? আর কার ক্লাস শেষে দেখা করবে? নিজের নাকি স্যারের? এটাও জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলো সে! তাই চিন্তা করলো ওর আজকের ক্লাস শেষ হলে টিচার্স রুমে গিয়ে দেখে আসবে।
*****
বিকেল হয়ে এসেছে। ঘড়িতে পাঁচটার মতো বাজে। এবারের রুটিন একদম বাজে লেগেছে নোহারার কাছে। অনেকক্ষণ গ্যাপ দিয়ে একেকটা ক্লাস। এতোক্ষণ বসে থাকতে কারই বা ভালো লাগে? অনন্যা থাকলে অতোটা বোরিং লাগতো না। ক্লাস শেষ করতেই কতটা দেরি হয়ে গেলো। এখন নোহারা অনন্যার বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে নিকের অপেক্ষায়। নিককে মেসেজ করেছিল এই সময়ে অনন্যার বাসার নিচে এসে দাঁড়াতে। এতোক্ষণে তো এসে পড়ারই কথা। নোহারা ফোন বের করে কল করলো।
নিক কল ধরলো,
"হ্যালো, লিটেল গার্লফ্রেন্ড!"
নোহারা পিছনে ঘুরে তাকালো। কারণ আওয়াজটা একি সাথে পেছন হতেও শোনা যাচ্ছিল। নিকের মুখে বিস্তৃত হাসি দেখা গেলো। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নোহারার সন্ধ্যা ব্রোকে বেশ অন্যরকম লাগছে আজ। অনেক দিন পর দেখে নোহারার মনে হলো নতুন একজন মানুষকে দেখছে সে। নিকের চুলগুলো সম্পূর্ণ কালো।আর চুলের স্টাইলটাও পরিবর্তন করেছে সে। শরীরে পরিধানকৃত অফ হোয়াইট চেক শার্ট আর কালো প্যান্ট। নোহারার আজ মনে হচ্ছে ছেলেটাকে অতিরিক্ত হ্যান্ডসাম লাগছে। নিক কল কেটে এগিয়ে গেলো। চুলে হাত বুলিয়ে বললো,
"আই নো আই এম আ হ্যান্ডসাম বয়!"
নোহারা সম্বিত ফিরে পেয়ে বিল্ডিংয়ের ভিতরে হাঁটতে লাগলো। মাথা নাড়িয়ে বললো,
"নো! ইউ আর নট!"
নিক হাসলো। হাত ভাঁজ করে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
"নোহারা! "
নোহারা কোনো উত্তর দিলো না। লিফটে উঠে গেলো। লিফট বন্ধ হতেই নিক নোহারাকে সামনে থেকে জড়িয়ে ধরলো। হতভম্ব হয়ে গেলো নোহারা। শরীরে শিরশির অনুভব করলো সে। হঠাৎ এভাবে একা পেয়ে জড়িয়ে ধরা সন্ধ্যা ব্রো এর কাছ থেকে একদমই আশা করেনি সে। নিককে জোর করে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু নিক ছাড়তে দিলো না।
ফিসফিসিয়ে বললো,
"রাগ করেছ?"
নোহারার মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে। ওর ছোট চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়েছে। নোহারার খারাপ লাগছিল না। কিন্তু এটা তো ঠিক নয়। সে আর ভুল করতে চায় না। আর ভুল সম্পর্কে থাকতে চায় না। সে সহ্য করতে না পেরে হাঁটু দিয়ে নিকের পায়ে আঘাত করলো। অতঃপর ছাড়লো নিক। নোহারার থেকে আঘাত পেয়ে নিক দুই কদম সরে গেলো।
নোহারা চেঁচিয়ে উঠলো,
"ওয়াট ইজ ইউর প্রবলেম? তোমাকে বলেছিলাম না আমাদের মধ্যে সব শেষ!"
নিক ও চুপ রইলো না। সে কয়েক কদম এগিয়ে এক হাত নোহারার গালে রেখে বললো,
"আমি বিজি ছিলাম। তাই এতো দিন তোমার সাথে কন্টাক্ট করতে পারিনি। আই এম সো স্যরি, লিটেল গার্লফ্রেন্ড!"
"একদম গার্লফ্রেন্ড বলবে না। আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড না। আমার কয়েক দিন পর বিয়ে হবে। তুমিই বলেছিলে বিয়ে করে নিতে। হ্যাঁ, আমি বিয়েই করবো।"
রাগে নোহারার নাক লাল হয়ে গেছে। ভিতর থেকে কান্নারা এসে জড়ো করছে। কিন্তু সে কাঁদবে না। এই ছেলেটাকে দেখিয়ে দেবে সে কতটা শক্তিশালী মনসম্পন্ন মানুষ।
নিক ঠোঁট টেনে হাসলো,
"জাস্ট মজা করেছিলাম, বেবি। আমি জানি তুমি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে তো দূর পছন্দই করতে পারো না।"
লিফট এসে থামলো চার নম্বর ফ্লোরে। ধীরে ধীরে খুলে গেলো দরজা। নোহারা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেলো লিফট থেকে। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারলো না। নিক লিফট থেকে বেরিয়ে ঘন আওয়াজে বলে ফেললো সেই তিনটি শব্দ। তাতেই নোহারার নাজেহাল অবস্থা। বুকের ধড়ফড়ানি আরম্ভ! নোহারা পিছনে ঘুরলো না। রেগে আছে সে এই ছেলেটার উপর। প্রথমত তাকে বলেছিল বিয়ে করে ফেলতে। দ্বিতীয়ত নোহারাকে দ্বিতীয় বার ফোন করার ও চেষ্টা করেনি। এরকম করলে কোন মেয়ে এতো সহজে মেনে নেয়? নোহারাও আজ মানবে না। সে ধীরে ধীরে পা ফেলে অনন্যার বাড়ির দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিকের দিকে না তাকিয়েই কলিং বেল বাজায়।
নিক এখনো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। নিজের মাথায় নিজের ই বারি মারতে মন চায় তার। কপালে এমন একটা মেয়ে জুটেছে যে সহজে পটেও না, কথাও শোনে না, রাগ করে বসে থাকে আবার ভালোবাসি বললে সাড়াও দেয় না।এই জীবনে কোনো মেয়ের থেকে রিজেক্টেড না হওয়া নিক এই পর্যন্ত কয়েক বার নোহারার থেকে রিজেকশন খেয়ে হতাশ অনুভব করছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিক। বিরক্তের সাথে সামনের দিকে হেঁটে গেলো সে।
অনন্যা দরজা খুলে দুজনকে বসতে দিয়েছে। নোহারা অনন্যার পাশে বসে আছে। হাত বাড়িয়ে অনন্যার জ্বর আছে কিনা দেখে নিচ্ছে। বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞেস করছে আর এদিকে নিক হাত ভাঁজ করে নিজের গার্লফ্রেন্ডের কেয়ার দেখছে তাও বেস্ট ফ্রেন্ডের প্রতি অথচ নিজের বয়ফ্রেন্ডের প্রতি একটুও কেয়ার নেই মেয়েটার। কিন্তু তাও চোখ দুটো এই মেয়েটাতেই আটকে আছে।
নোহারা উঠে দাঁড়ালো। অনন্যা প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি নিয়ে তাকালো ওর পানে। চোখে চোখেই জিজ্ঞেস করলো,
"কোথায় যাচ্ছিস?"
নোহারা হেসে বললো,
"তোর জন্য কিছু রান্না করবো ভাবছি।"
অনন্যা হেঁচকা টানে নোহারাকে বসালো। কটমট করে তাকিয়ে বলে উঠলো,
"তোকে কি রান্না করার জন্য আসতে বলছি আমি? "
নিক এই ফাঁকে ফোন বের করে নম্র স্বরে শুধালো,
"কে কী খাবে? আমি খাবার অর্ডার করছি।"
"সত্যিই?"
নোহারা খুশিতে জ্বলজ্বল চক্ষুযুগল নিয়ে তাকালো নিকের পানে। নিক ফোন থেকে চোখ তুলে নোহারার খুশি হওয়া পর্যবেক্ষণ করে প্রশান্তির হাসি দিয়ে মাথা নাড়লো।
অনন্যা কিছুই বললো না। যা খাবার অর্ডার দেওয়ার নোহারাই বলে দিলো। অনন্যা কি খাবে বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে নোহারা ভালো করেই জানে। তাই যা বলার সে-ই বললো।
সবশেষে অনন্যা আসল কথায় আগালো। নিকের দিকে সরাসরি দৃষ্টি রেখে বললো,
"কৌশিক স্যারের খবর কি জানো তুমি?"
নিক হাত ভাঁজ করে অনন্যার দিকে একবার তাকালো আর একবার নোহারার দিকে। নোহারাও এক ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে আছে নিকের উত্তর শোনার জন্য।
নিক বললো,
"আমি ঠিক জানি না। ভেনোরা জানে যা জানার। ও শুধু বলেছিল কিয়ান আবারো আসবে।"
নোহারা আগ বাড়িয়ে বললো,
"আমাদের ভার্সিটিতে কৌশিক স্যারের আগমন ঘটেছে।"
"তো এটা সত্যিই?"
নিক জিজ্ঞেস করলো।
অনন্যা, নোহারা দুজনেই মাথা নাড়লো। নিক চিন্তিত হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল।
নোহারাই বললো,
"কিন্তু এই কৌশিক স্যারের আচরণ ভিন্ন। সে আমাকে তো দূরের কথা অনন্যাকেই চিনতে পারছে না।"
নিক মাথা নিচু করে ভাবতে লাগলো। মুখ দিয়ে বের হলো,
"তাহলে ও আমাকেও চিনতে পারবে না।"
অনন্যার কৌতুহল ধীরে ধীরে আরো বেড়ে যাচ্ছে। সে ঢোক গিলে বললো,
"তাই? তার মানে তুমি বলতে চাইছো এটা সেই কৌশিক স্যার নয়?"
"আসলে আমিও বলতে পারছি না। আমি যতদূর জানি কিয়ান হার্ট! আই মিন যখন কৌশিকের সাথে আমার দেখা হয় তখন ওর নাম ছিল কিয়ান। এই নামটা ওর নিজস্ব তৈরি কৃত নাম ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে এসে ও হুট করে নাম পরিবর্তন করে ফেলেছিল। কেনো করেছিল আই ডোন্ট নো। কিয়ান নাম দিয়ে ওর সবকিছু ছিল কিন্তু বাংলাদেশে এসে এই নাম পরিবর্তন করার পেছনের কাহিনী আমিও জানি না। কিয়ান অনেক দেশেই ভিন্ন ভিন্ন নাম নিয়ে ছিল অনেক বছর ধরে। শুধু ইউরোপীয় দেশগুলোয় কিয়ান নামটা ব্যবহার করেছিল। এছাড়া আমি শুধু জানতাম কায়েরীথ আলেকজান্ডার ক্রুশ! এই নাম ইতিহাসে লেখা হয়ে গেছে। একজন কুখ্যাত বিশ্বাসঘাতক হিসেবে পরিচিত কায়েরীথ। এজন্যই ও বলতো যেখানে ও নিজেকে যেই নাম দিয়েছে সেই নামে ডাকতে। কিন্তু বাংলাদেশে এসে ওর আইডেনটিটি পরিবর্তন হয়ে গেছে। এর পেছনের প্রশ্নের উত্তর শুধু ওই দিতে পারবে।"
নিক নিজের মাথা চেপে ধরে বললো,
"কৌশিক অনেক জেদী ছিল। সবকিছুর উত্তর ও দিতো না। কিন্তু ভেনোরা জানতো কারণ ভেনোরা ভবিষ্যৎ দেখতে পারতো।"
অনন্যা আশার আলো দেখতে পেলো। নোহারাকে ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলল সে। নোহারা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে নিকের দিকে চক্ষু ফেরালো।
"ভেনোরা! ওনাকে আমাদের সামনে নিয়ে আসো। আমাদের কিছু প্রশ্ন আছে। সেগুলোর উত্তর মিললেই আমাদের মন শান্ত হবে। যেহেতু উনি জানে তো উনাকে আসার জন্য বলতে পারবে, সন্ধ্যা ব্রো?"
নোহারা নিজের কাপড় শক্ত করে ধরে নিকের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললো। অনন্যাও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিকের উত্তর শোনার জন্য। কিন্তু....
·
·
·
চলবে..................................................................................