যুবকটি হাত-পায়ের বাঁধন থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ছটফট করতে করতে বলল, “এবার কি করবি আসিফ? এ কোন ফাঁদে পড়লি তুই? তোকে কি বন্যা কিডন্যাপ করেছে নাকি অন্য কেউ?”
কিছুক্ষণ আগের ঘটনা—বরযাত্রী নিয়ে আসিফ আর এক ঘন্টা পরেই রওনা দেবে মির্জা বাড়ির উদ্দেশ্যে। সে সবে শেরওয়ানিটা গায়ে দিয়েছে। এর মাঝে ফোনটা বেজে ওঠে তার। ফোনের স্ক্রিনে “বন্যা” নামটা দেখা মাত্রই আসিফের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। এই মেয়ে তার পেছনে আটার মতো লেগে আছে। কত মেয়েকে সে নাচিয়েছে তার আঙুলের ইশারায় অথচ এই মেয়েটা উল্টো তাকে নাচিয়ে যাচ্ছে। রুমে মানুষ থাকার কারণে আসিফ বেলকনিতে গিয়ে কলটা ধরে ধীর কণ্ঠে বলল, “কি হয়েছে, ফোন দিচ্ছো কেন?”
ওপাশ থেকে ভেসে আসে বন্যার কণ্ঠস্বর, “তুমি এখনই আমার সঙ্গে দেখা করবে আমি বটতলায় আসছি। যদি না আসো তাহলে এর পরিণাম কিন্তু ভয়ংকর হবে বলে দিলাম। তুমি খুব ভালো করেই জানো আসিফ আমি ঠিক কী কী করতে পারি।”
আসিফকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বন্যা আসিফের মুখের উপর ধুম করে কল কেটে দেয়। আসিফ কল করে বন্যাকে কিন্তু ফোন বন্ধ করে দিয়েছে বন্যা। আসিফ কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। এই মেয়েটা তাকে পাগল করে দিচ্ছে। যদি সে এখন এই মেয়ের সাথে দেখা না করে, তাহলে হয়তো তার বিয়েতে গিয়ে হাজির হবে এই মেয়ে যেটা সে একদম চায় না। তাই বিয়ে বাড়িতে যাতে এই মেয়ে হাজির না হতে পারে তার জন্য বন্যার সাথে তাকে দেখা করতেই হবে এই মুহূর্তে। কিন্তু বন্যার সাথে এই দেখা করাটাই আসিফের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। বাড়িতে ভুজুং-ভাজুং বুঝিয়ে আধ ঘন্টার জন্য বেরিয়েছে সে। আর বটতলায় আসার পাঁচ মিনিট পরেই সে কিডন্যাপ হয়।
আকস্মিক দরজা খোলার শব্দ শুনে আসিফ চমকে তাকালো সামনের দিকে। ফিরে আসে বর্তমানে। দরজা খোলার সাথে সাথেই চোখ-মুখ কুঁচকে নেয় আসিফ বাইরের আলো চোখে-মুখে এসে লাগার জন্য। আসিফের চোখে আলো সয়ে গেলে পিটপিট করে তাকায় সামনের দিকে। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামানব— প্যান্টের পকেটে দু হাত গুঁজে রেখে। শরীরের গড়ন বোঝা গেলেও মুখ স্পষ্ট নয়। আসিফ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, “কে তুমি? কী চাও আমার কাছে? আমাকে এখানে ধরে এনেছো কেন?”
ছায়ামানবটা পকেট থেকে হাত বের করে ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে এলো। ছায়ামানবের মুখ দেখা মাত্রই আসিফ হতভম্ব হয়ে উঠে বলল, “শেরাজ ভাই! তুমি এখানে?”
শেরাজ ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি টেনে বলে, “হ্যাঁ আমি। আমাকে তুই এখানে ঠিক আশা করিস নি তাই না আসিফ মর্তু্জা?”
আসিফ হতবিহ্বল কণ্ঠে বলে, “তুমি… তুমি আমাকে কিডন্যাপ করেছো?”
শেরাজ আসিফের চারপাশে চক্কর দিতে দিতে বলে, “হুম কেন তাতে কি কোনো সন্দেহ আছি নাকি তোর?"
আসিফ বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে, “কিন্তু কেন?”
শেরাজ একটু ঝুঁকে এসে চেয়ারের হাতলে ভর দিয়ে আসিফের চোখে চোখ রেখে বলে, “কারণ, মেহুল আমায় ভালোবাসে। ও তোকে নয়, ও আমায় বিয়ে করতে চায়।”
আসিফ স্তব্ধ। কাঁপা গলায় বলল, “মানে…”
শেরাজ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে 'চ' সূচক শব্দ উচ্চারণ করে বলল, “শালা এই বাঙালিরা একটা অভিনব কথা শুনার পর যখন মানে কথাটা বলে তখন মাথামোথা গরম হয়ে যায় আমার। তুই কিন্তু আমার কথাটা পুরোপুরি শুনছোস কিন্তু তারপরও তুই মানে কথাটা কেরে কইলি হুদাই?”
আসিফ ধীরে বলে, “তুমি কিভাবে নিশ্চিত হলে যে মেহুল তোমায় ভালোবাসে?”
শেরাজ ঠোঁট বাঁকা করে হেসে বলে, “কারণ আমাদের ইয়ে হয়েছে।”
আসিফ চমকে উঠে, “ইয়ে হয়েছে মানে?”
শেরাজ ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে বলে, “চিন্তার কিছু নেই বড় ইয়েটা এখনও হয় নি, তবে হবে বিয়ের পর। আপাতত আমাদের ছোট ইয়েটা হয়েছে শুধু দুজনের ঠোঁটে ঠোঁট আলিঙ্গন একটু.... না একটু না অনেকটাই হয়েছে।”
আসিফ স্তব্ধ। নিজেকে সামলে বলল, “তাহলে বিয়ের এত আয়োজন! নিজের হাতে করলে সেটা কি?
শেরাজ দৃঢ় কণ্ঠে বলে, “নিজের বিয়েতে রাজকীয় আয়োজন করব না তো কার বিয়েতে করব? এই সব আয়োজন মেহুল আর আমার বিয়ের জন্য… তোর বিয়ের জন্য নয়।”
আসিফ কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কথার ভারে তার মুখ থমকে গেছে। আসিফকে নীরব দেখে শেরাজ চোখ ছোট করে বলে, “কী হলো? বিশ্বাস হচ্ছে না তোর আমার কথা? ভিডিও আছে আমার কাছে দেখবি?”
এক মুহূর্ত থেমে শেরাজ আবার বলে, “আসলে গাড়িতে হয়েছিল তো ‘ইয়েটা’, তাই ড্যাশ ক্যামেরায় সবটা রেকর্ড হয়ে গেছে নিজের অজান্তে।”
আসিফ ধীরে গলায় বলে, “তুমি ভালোবাসো মেহুলকে?”
শেরাজ থমকে যায়। ঢোক গিলে কণ্ঠ কঠিন করে বলে, “আমি ভালোবাসি নাকি ভালোবাসি না সেটা মুখ্য কথা নয়। আসল কথা হলো, মেহুল আমায় ভালোবাসে আর ও আমাকে বিয়েই করতে চায়।”
আসিফ চুপচাপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “তুমি চাও না?”
শেরাজের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। রুক্ষ স্বরে বলে, “তোকে এত প্রশ্ন করতে কে বলেছে রে?”
আসিফ শান্ত গলায় বলে, “মেহুল যখন তোমায় বিয়ে করতে চায় তাহলে মেহুলকে বিয়ে না করে তুমি এখানে থেকে সময় নষ্ট করছো কেন শুধু শুধু?”
শেরাজ হালকা হেসে বলল, “গুড কোয়েশ্চন! এবার একটা ঠিকঠাক প্রশ্ন করেছিস তুই। দেখ, তোর বাপ এমন একটা মিথ্যা কথা রটিয়েছে মেহুলের মরহুম বাবাকে নিয়ে—যেটা সবাই সত্যি ভাবছে। তোর বাপ বড্ড লোভী রে ভাই। আমার দাদা তো এই কথাটার জন্যই মেহুলকে তোর সাথেই বিয়ে দিবে আর অন্য কারোর সাথে দিবে না। তাই তোকে সুন্দর করে একখান চিঠি লিখে দিতে হবে। যেটা পড়ে আমার দাদা তোর সাথে মেহুলকে আর বিয়ে দিতে চাইবে না।”
আসিফ ভ্রু কুঁচকে বলল, “কিসের চিঠি? কী লিখতে হবে?”
শেরাজ বিকাশকে ইশারা করতেই সে একটা মাঝারি আকারের টেবিল এনে রাখে আসিফের সামনে। তার উপর রাখা হয় সাদা কাগজ আর একটি কলম। আসিফের হাতের বাঁধন খুলে দেয় বিকাশ। আসিফ শেরাজের দিকে তাকাতেই শেরাজ হেসে বলে, “নে, লেখা শুরু কর। আমি যা যা বলব, হুবহু তাই তাই-ই সুন্দর করে লিখবি। লেখা যেন স্পষ্ট হয়। আমার দাদা আবার কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং লেখা সহ্য করতে পারে না। ছোট বেলায় এটার জন্য বহুত কেলানি খেয়েছি দাদার হাতে।”
আসিফ কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীরে বলল, “তার মানে, আমার লেখা একটা চিঠিই পারে তোমার আর মেহুলের বিয়ে নিশ্চিত করতে তাই তো।”
শেরাজ চ-সূচক একটা শব্দ উচ্চারণ করে বলল, “তেমনটা নয়, কিন্তু আবার তেমনটাও। আসলে তোর বাপের ওই একটা মিথ্যা কথার জন্যই যত গণ্ডগোল। আর আমার দাদাও সেই মিথ্যা কথাটা বিশ্বাস করছে।”
শেরাজ একটু থেমে জিজ্ঞেস করল, “তুইও তো জানিস, তোর বাপ যে কথাটা বলছে সেটা মিথ্যা কথা, তাই না?”
আসিফ চমকে উঠে বলে, “না! এটা মিথ্যা কথা না। এটা একদম সত্যি কথা। চাচ্চু তো সত্যিই চেয়েছিলেন আমার সঙ্গে মেহুলের বিয়ে দিতে।”
শেরাজের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো এই বাপ-ছেলে দুইটাই মিথ্যার ফুলঝুরি! মন চাইছে এখানেই এটাকে মে রে পুঁতে ফেলতে, কিন্তু পারছে না। কারণ একটাই, যদি এর কিছু হয়, দাদা ভাই সরাসরি তার ওপর আঙুল তুলবে। তাই তো চিঠির এই নাটক।
শেরাজ হঠাৎ এগিয়ে এসে আসিফের চুল মুঠোয় ধরে, মুখটা উপর দিকে তুলে দন্তকষে বলে, “একদম মিথ্যা কথা বলবি না আমি সবটা জানি তাই আমার সামনে মিথ্যা কথা বলার চেষ্টা করিস না।”
কথাটা বলে এক ধাক্কায় মাথাটা ছেড়ে বলে, “নে, লেখা শুরু কর!"
আসিফ জেদ ধরে বলল, “লিখব না! আর মেহুলের সঙ্গে তোমার বিয়েও আমি কিছুতেই হতে দেব না।”
শেরাজের পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়। চোখে-মুখে রাগ ফুটে ওঠে। মন চাইছে এই মাছিটাকে এক থাবায় শেষ করে দিতে কিন্তু পারছে না শুধু দাদা ভাইয়ের জন্য। দাদা ভাই তাকে আগে ওয়ার্নিং দিয়ে রেখেছে যদি আসিফের কিছু হয় তাহলে সবটা দোষ তার উপরে এসে পড়বে। শেরাজ হঠাৎ কোমরের পেছন থেকে রিভলভার বের করে গুলি ছুঁড়ে মারে— আসিফের পায়ের ঠিক পাশে! আসিফ ভয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে।
শেরাজ আসিফের সামনে রাখা চেয়ারটাতে বসে ঠান্ডা গলায় বলে, “বেশি তেড়িবেড়ি করলে, দ্বিতীয় গুলিটা তোর কপালের ঠিক মাঝখানে ঢুকবে। তাই যা বলছি, তা-ই কর।
ভয়ে আসিফের শরীর কাঁপছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। কম্পিত কণ্ঠে বলে, “লিখছি... লিখছি...”
শেরাজ হাসে, “গুড বয়। নে, লেখা শুরু কর।”
আসিফ ধীরে কলমটা হাতে তোলে নিচু গলায় বলল, “কি লিখব?”
শেরাজ চেয়ারে হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসে বলল, “লিখ, ‘শ্রদ্ধেয় নানা ভাই, আগেই আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি— এই বিয়েটা আমি করতে পারব না। এই বিয়েটা করা আমার জন্য খুব লজ্জাজনক বিষয়। আমার বাবা, চাচ্চু সম্পর্কে যেই কথাটা বলেছে, সেটা সম্পূর্ণ বানোয়াট, মিথ্যা। চাচ্চু কখনো এমন কিছু বলেন নি। আমার বাবা চাচ্চুর সম্পত্তি হাতিয়ে নেবার জন্য এই মিথ্যা কথা বলেছে। আর সাথে আমিও একটা ভয়ংকর মিথ্যা লুকিয়েছি— আমি HIV পজিটিভ’।”
আসিফ শেরাজের শেষ কথাটা শুনে থমকে যায়। বিস্ময়ে তাকায় শেরাজের দিকে। শেরাজ দুই ভ্রু নাচিয়ে হেসে বলল, “কি হলো? লিখ।”
আসিফ বিস্মিত কণ্ঠে বলে, “আমার HIV মানে...?”
শেরাজ ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলে, “কেন? তুই জানিস না, তোর শরীরে HIV ভাইরাসের বসবাস?”
আসিফ চেঁচিয়ে উঠে, “না! এটা হতে পারে না!”
শেরাজ চোখ সরু করে বলে, “প্রমাণ আছে আমার কাছে।”
এই বলে শেরাজ বিকাশকে ইশারা করে। বিকাশ একটা হলুদ খাম এগিয়ে দেয়। শেরাজ খামটা আসিফের সামনে রেখে বলে, “বিশ্বাস না হলে নিজেই রির্পোটটা দেখ।”
আসিফ খামটা ছিঁড়ে তড়িঘড়ি করে রিপোর্টটা দেখে। চোখ ছানাবড়া তার। সত্যিই রিপোর্টে HIV পজিটিভ লেখা! মাথার মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে আসিফের — এটা কিভাবে সম্ভব? সে তো সবসময় সর্তক থাকত! তাহলে এটা হলো কী করে?
আসিফ চেঁচিয়ে বলে উঠল, “এই রিপোর্ট মিথ্যা।”
শেরাজ ঠান্ডা গলায় বলল, “মিথ্যা রিপোর্ট। তুই যে প্রতি রাতে বিভিন্ন মেয়েদের সাথে হোটেলে গিয়ে শুয়েছিস সেটা কি মিথ্যা। তুই যেমন তোর বাপও তেমন। তুই ভাবলি কি করে মেহুলের এতো বড় একটা সর্বনাশ করার কথা।”
আসিফ অস্বস্তি গলায় গরগর শব্দ তুলে বলতে থাকে, “না... না... এটা মিথ্যা... আমি এই রোগে আক্রান্ত না... এই রিপোর্ট মিথ্যা...”
শেরাজ গম্ভীর গলায় বলল, “ঠিক আছে, নিজে গিয়ে পরীক্ষা করে নিস। এখন আগে চিঠিটা লিখে শেষ কর।”
আসিফ চুপচাপ শেরাজ যা যা বলছে, তাই তাই লিখে যাচ্ছে। সব লেখা শেষে নিজের সিগনেচার করে চিঠিটা শেরাজের হাতে তুলে দেয়।
শেরাজ চিঠিটাতে চোখ বুলাচ্ছে। চোখে-মুখে তর অদ্ভুত এক তৃপ্তির হাসি। শেরাজ উঠে দাঁড়াতেই বিকাশ এগিয়ে এসে আসিফের হাত চেয়ারের হাতলে বাঁধতে শুরু করে। আসিফ চিৎকার করে উঠল, “আমায় আবার বাঁধা হচ্ছে কেন? আমি তো চিঠি লিখে দিয়েছি!”
শেরাজ ঠান্ডা গলায় বলল, “বিকাশ, ওর মুখে স্টেপলার মেরে আটকে রাখ। বেশি চিৎকার পারে শালায়।”
আসিফ আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠে, “না, শেরাজ ভাই! এটা কোরো না। আমায় যেতে দাও, প্লিজ! আমার জানতে হবে সত্যি কি আমার HIV পজিটিভ কি না।”
কিন্তু শেরাজ আসিফের কথার কোনো গুরুত্ব দিলো না। শেরাজ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে নিলে হঠাৎ থেমে আসিফের দিকে ঘুরে বলল, “ও হ্যাঁ, একটা কথা বলা হয় নাই তোকে। বন্যা যে ফোন করেছিল, সেটা আমার কথায়। মেয়েটা খুব ভালো… তোর সম্পর্কে যা যা জানার দরকার ছিল, সব বলেছে ও আমায়। তুই যে কয় ঘাটারে পানি খেয়েছিস সব বলেছে।”
এই বলে শেরাজ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর বিকাশও ঘর থেকে বের হয়ে এসে শেরাজের পাশে দাঁড়ায়। শেরাজ হাতের কাগজগুলো বিকাশের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “সময় মতো যেন ঠিক জায়গায় পৌঁছে যায় কাগজগুলো।”
বিকাশ মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, “জি স্যার। আর ওটাকে কি করব? মানে… কখন ছেড়ে দেব?”
শেরাজ নির্দ্বিধায় বলল, “আগে ওই দিকটা সামলাই তারপর ওকে নিয়ে ভাবা যাবা।”
বিকাশ মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক আছে, স্যার,”
“আমি বাড়ি যাচ্ছি। বেশিক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকলে সন্দেহ করবে আমায়।”
শেরাজ গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। গাড়িতে উঠে ইগনিশনে চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সে রওনা দেয় মির্জা বাড়ির উদ্দেশ্যে।
—————
মির্জা বাড়িতে হুলুস্থুল কাণ্ড। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বরযাত্রীর দেখা নেই। সেই যে আমিনুল মতুর্জা বলেছে তারা আসছে এখনও আসাতেই আছে এসে আর পৌঁছছে না। আতাউর মির্জা বারবার ফোন করে যাচ্ছেন আমিনুল মতুর্জাকে। কখনও বলছে ব্যস্ত, কখনওবা রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে কল। কি যে হচ্ছে আতাউর মির্জা কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না? তবে একটা বিষয় পরিষ্কার ওনার কাছে, আমিনুল মতুর্জা ফোনের কাছেই আছেন আর ইচ্ছা করেই কলটা ধরছে না ওনার।
আতাউর মির্জা নিজ মনে বিড়বিড় করে উঠলেন, “আমি কি ভুল করলাম এই বিয়েতে মত দিয়ে? আমিনুল তো নিজেই সেধে এসে বলেছিল মেহুলকে তার ছেলের বউ করার জন্য, এখন এভাবে খেলা করছে কেন?”
কথাটা বলে কিছুটা সময় মৌন থাকে। হঠাৎ করেই কণ্ঠে সন্দেহের আভাস মিশিয়ে বলে উঠলেন, “এটার পেছনে শেরাজের কোনো হাত নেই তো? ও কোথায় আছে এখন?”
ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়। ইফা এসেছে হাতে একটা হলুদ রঙের খাম, “দাদাভাই, একজন এই খামটা দিয়ে গেলো। তোমাকে দিতে বলেছে।”
আতাউর মির্জা খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কে দিয়েছে?”
ইফা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “তা তো জানি না। কিন্তু তোমার হাতেই দিয়ে বলেছে এটা নাকি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়।”
আতাউর মির্জা নাতনির কাছ থেকে খামটা নেয়। ইফা ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে বলল, “বর যাত্রী কখন আসবে দাদা ভাই? সবাই বলাবলি করছে এটা নিয়ে।”
আতাউর মির্জা থমকে যায়। কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে বলল, “এসে যাবে একটু পরেই এসে যাবে। তুমি মেহুলের কাছে যাও ওকে সঙ্গ দাও।”
ইফা মাথা নাড়িয়ে ‘আচ্ছা’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নিলে আতাউর মির্জা বলে উঠেন, “শেরাজ কই। ওকে বলো এক্ষুনি এখানে আসতে।”
ইফা "হ্যাঁ" বোধক মাথা নেড়ে চলে যায়। আতাউর মির্জা গম্ভীর মুখে খামটার দিকে তাকালে। কি আছে এটার ভেতরে?
—————
মেহুল চুপচাপ একটা কাঠের পুতুলের মতো বসে আছে স্টেজে, বউয়ের জন্য রাখা রাজকীয় চেয়ারে। একে একে অনেকেই এসে নতুন বউ দেখে যাচ্ছে, কিন্তু নতুন বউয়ের মুখে নেই কোনো হাসির ছোঁয়া। ঘিরে আছে একরাশ অন্ধকার। কিচ্ছু ভালো লাগছে না মেহুলের—না এই সাজ, না এই বিশাল রাজকীয় আয়োজন। হাঁসফাঁস করে উঠছে বুকের ভেতরটা।
তার পাশেই লামিয়া বসে আছে। কলি, ইকরা ছবি তুলতে ব্যস্ত। লামিয়া ফোনের পাওয়ার অন করে দেখে নিল ক’টা বাজে—তিনটা সতেরো বাজে। অথচ বিয়ে হওয়ার কথা ছিল দুইটার পরেই। এখনো বরযাত্রীর কোনো খোঁজ নেই। মেহমানেরাও কানাঘুষা করছে তা নিয়ে।
হঠাৎ করেই লামিয়ার কচি মন অস্থির হয়ে উঠল। কি ঝড় বয়ে আসছে বান্ধবীর জীবনে তা সে জানে না। শুধু এতটুকুই মনে প্রাণে দোয়া করে যাচ্ছে সামনে যা কিছুই হোক না কেন সেটা যেন বান্ধবীর জীবনে ভালো কিছু বয়ে আনে খারাপ কিছু যেন না হয়। লামিয়া ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “মেহুল…”
মেহুল কোনো উত্তর দিল না। চুপচাপ বসে রইল। লামিয়া আবার বলল, “মেহুল মন খারাপ করিস না। আমার কেন জানি মনে বলছে তোর বিয়েটা হবে না।”
মেহুল চমকে উঠল, “সত্যি বলছিস? বিয়েটা হবে না?”
মেহুলের এমন প্রতিক্রিয়ায় লামিয়া অবাক হয়, “তুই চাস না এই বিয়েটা হোক?”
মেহুল মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে ধরে। লামিয়া এবার একটু জোর গলায় বলল, “কি হলো বল, তুই চাস না এই বিয়েটা করতে?”
মেহুল শান্ত গলায় বলল, “না, চাই না।”
“সত্যি চাস না?”
মেহুল বান্ধবীর দিকে ফিরে করুণ মুখে বলল, “না, আমি চাই না আসিফ ভাইকে বিয়ে করতে। আমি তো শেরাজ.... ।”
মেহুল থেমে যায়। বান্ধবীকে এভাবে চুপ মেরে যেতে দেখে লামিয়া বলল, “কি হলো বল?”
মেহুল ঢোক গিলে বলল, “কিছু না।”
লামিয়া জোর গলায় বলল, “তুই কিছু লুকাচ্ছিস তাই না মেহুল! কি লুকাচ্ছিস বল আমায়?”
মেহুল কপট চেঁচিয়ে বলল, “বলছি তো কিছু লুকাছি না।”
লামিয়া হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মেহুলের দিকে। আকস্মিক সে বলে উঠে, “তুই কি শেরাজ ভাইকে ভালোবাসিস?”
মেহুল চমকে তাকায় লামিয়ার দিকে। লামিয়া মাথা নাড়িয়ে বলল, “ঠিক বলছি আমি তাই না।”
মেহুল অভিমান ভরা কণ্ঠে বলল, “না ভালোবাসি না আমি শেরাজ ভাইকে, ভালোবাসি না।”
লামিয়া আর একটাও কথা কয় না। বান্ধবীর চোখ মুখ সবটা সত্যি বলে দিচ্ছে। বান্ধবীর মনের ভেতর কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে সেটা লামিয়া একটু হলেই টের পাচ্ছে।
·
·
·
চলবে.................................................................................