রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর অদ্রি অর্পি লাইব্রেরিতে গেল। রুমে ঢুকেই অৰ্পি বলল,
“আবার চাবি খুঁজতে গিয়ে কত কাহিনী করা লাগবে কে জানে!”
“যেখানে রেখে গেছি, সেখানেই দেখি আগে।”
কিন্তু পেনহোল্ডারে চাবি পাওয়া গেল না। অৰ্পি বলল,
“উফ! দেখ চাচ্চু আবার চাবি নিয়ে গেল কিনা। তাহলে আমি মরেই যাব রে আপ্পি। মানসী আন্টি কানাডা চলে গেল কেন? আর চাচ্চু চাচিকে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলল তারপর কী হলো? পুরোটা জানতেই হবে আমার।”
অদ্রি এবার ড্রয়ারে খুঁজতে খুঁজতে বলল,
“অর্পি একটু চুপ থাকতে পারিস না?”
অর্পি চুপ করল কিন্তু অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগল। অদ্রি চাবিটা ড্রয়ারেই পেয়ে গেল,
“গট ইট।”
অর্পি দৌড়ে এল। ডায়েরির ড্রয়ারটাতে চাবি ঘোরাতেই অর্পি অদ্রির হাত ধরে বাধা দিল।
“আপি ড্রয়ারটা খুলিস না প্লিজ।”
“কেন?”
“যদি দেখি ডায়েরিটা নেই তাহলে আমি মরেই যাব।”
অদ্রি বিরক্ত হয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিল। তারপর ড্রয়ারটা খুলতেই ডায়েরিটা পেয়ে গেল। অর্পির মুখে হাসি ফুটে উঠল। অর্পি ডায়েরিটা হাতে নিয়ে খুলতেই অদ্রি বলল,
“এখানে পড়াটা রিস্কি মনে হচ্ছে আজ। ডায়েরিটা নিয়ে আমাদের ঘরে চলে যাই চল।”
“ঠিক বলেছিস।”
ডায়েরি নিয়ে ড্রয়ার তালা মেরে ওরা চাবি জায়গামতো রেখে দিল। তারপর চোরের মতো নিজেদের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে ডায়েরিটা খুলল। অদ্রি বলল,
“কোন পর্যন্ত যেন পড়েছিলাম? একটা পৃষ্ঠার মাঝখানে ছিলাম না?” অদ্রি খুঁজতে লাগল। অর্পি মনে করিয়ে দিল,
“হ্যাঁ, ওই যে চাচ্চু বলছিল…অধিকার ফলাতে আসছ? ঘর থেকে বের হয়ে যাও না যেন কী!”
“এই তো পেয়েছি।”
যেখানে রেখেছিল সেখান থেকেই দুজনে পড়তে শুরু করে দিল…
“অধিকার ফলাতে আসছ? টেক কেয়ার করা হচ্ছে? খবরদার বলে দিচ্ছি দিতিয়া আমার কোনো ব্যাপারে নাক গলাতে আসবে না।”
দিতিয়া কোনো কথা বলল না। দৃষ্টি নামিয়ে নিল। আমি বললাম,
“আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও।”
ও ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমার কিছু ভালো লাগছিল না। খুব অস্থির লাগছিল। আমার সুন্দর করে গোছানো জীবনটা নিমিষেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আর আমি কিছুই করতে পারলাম না।
দিতিয়া আর ঘরে এল না। রাতের খাবারের সময় মা এসে খাইয়ে দিয়ে গেল। মাকে কেন যেন না করতে পারতাম না। মা যা করেছিল তার জন্য খুব অনুশোচনায় ভুগত আর সেটা আমাকে খুব কষ্ট দিত। তাই সব জানার পর থেকে আমি তার সামনে স্বাভাবিকই থাকার চেষ্টা করতাম, তার মুখের দিকে চেয়ে সবই করতে পারতাম। শুধু পারতাম বলছি কেন এখনো পারি।
যাই হোক, রাত প্রায় ১টা বেজে যাচ্ছিল কিন্তু দিতিয়া ঘরে আসছিল না। ও কি ভয় পেল? নাকি ঘৃণা? তা যেটাই হোক পরের মেয়েকে বারবার ঘর থেকে বের করে দেয়াটা ছোটলোকি কাজ, যেটা মাথা গরম হয়ে গেলেই আমি করতাম। আমার ইচ্ছেয় হোক অনিচ্ছায় হোক, আমার সাথে বিয়ে হয়ে ও এ বাড়িতে এসেছে। তাই এখন এ ঘরের অর্ধেকটা ওরও। আমি ঘর থেকে বের হয়ে ওকে খুঁজতে লাগলাম। সবাই সবার ঘরে বোধহয়, কারণ কাউকেই ড্রয়িং ডাইনিং রুমে দেখতে পেলাম না। অদ্ভুত মেয়েটা গেল কোথায়! খারাপ কিছু হলে তো আবার আমার ঘাড়ে এসে পড়বে। খুব বিরক্ত লাগছিল। এখনকার মতো মোবাইল থাকলে তো ফোন করেই খুঁজে নিতে পারতাম। কিন্তু তাও তখন ছিল না। হঠাৎ মনে হলো ছাদে যায়নি তো? আমি ছাদে গেলাম কিন্তু না এখানেও নেই। উফ তখন বিরক্তিতে মনে হচ্ছিল মেয়েরা খালি গ্যাঞ্জাম পাকাতেই জানে! ছাদ থেকে নেমে আসব তখন ছাদ থেকেই দিতিয়াকে দেখতে পেলাম বাগানে দাঁড়িয়ে আছে। ডাকতে গিয়েও ভাবলাম এত রাতে এখান থেকে ডাকলে মা যদি জেগে যায়! নিচে নেমে দেখলাম ও পায়চারি করছে। পেছন থেকে ডাক দিলাম।
“দিতিয়া…”
ও ফিরে তাকালো। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম,
“সাহস কি বেশি নাকি? এত রাতে বাগানে কী?”
ও অপরাধীর মতো চুপ করে মাথা নিচু করে রইল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“কী সমস্যা? কথা বলো না কেন?”
“এমনি হাঁটছিলাম।”
“হাঁটার কী আছে? তুমি তো স্লিমই আছ!”
ও চুপ করে রইল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“আমি কি তোমাকে ঘরে ঢুকতে নিষেধ করেছিলাম?”
“না।”
“তো বাইরে বাইরে ঘুরছ কেন?”
ও চুপ। আমি এবার বললাম,
“ঘরে এসো।”
ও আমার পেছন পেছন এসে ঘরে ঢুকল। আমি দরজাটা লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম। ও লাইট অফ করে দিল। তারপর জানালার কাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরে চেয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর বললাম,
“আমি কি তোমাকে আমার বিছানায় শুতে নিষেধ করেছি?”
“না।”
“তো দাঁড়িয়ে আছ কেন ওখানে?”
ও কোনো কথা বলল না। আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ল। আমি আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর বললাম,
“দিতিয়া…ঘুমিয়ে পড়েছ?”
“নাহ।”
“আমার বিকালের ব্যবহারের জন্য আমি লজ্জিত। আসলে…”
আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে ও বলল,
“রাগ উঠলে তোমার হুঁশ থাকে না।”
“এক্সাক্টলি।”
“আমি কিছু মনে করিনি।”
“থ্যাংকস!”
কেউ কোনো কথা বললাম না আর। কিন্তু আমার ঘুম আসছে না। আমি উঠে বালিশে হেলান দিয়ে বসলাম। তারপর হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বালালাম। আলো জ্বালাতেই দিতিয়া তাকালো। চোখাচোখি হতেই আমি বললাম,
“আমি তোমার কাছে কিছু চাই।”
ও কখনোই বেশিক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারত না। ইভেন এখনো পারে না। চোখ নামিয়ে সরিয়ে উঠে বসে বলল,
“বলো?”
“আমাকে ডিভোর্স দেবে?”
একথায় ও চমকে তাকালো আমার দিকে। মুহূর্তের মধ্যে ওর দুচোখ জলে ভরে উঠল। হয়তো চোখের জল লুকানোর জন্যই চোখ নামিয়ে নিল এবার। বলল,
“দিলে?”
“আমি মানসীকে ছাড়া থাকতে পারছি না। শুধু একটা প্রেম ছিল না আমাদের মধ্যে। অনেক কিছু ছিল। সবটা তোমাকে বলে বোঝাতেও পারব না।”
“আমি বুঝি। কিন্তু আমি তোমাকে ডিভোর্স দিলেই কি তুমি ওকে পেয়ে যাবে?”
“চেষ্টা করব। তাছাড়া তোমার সাথেও আমি প্রতিনিয়ত অন্যায় করছি। এটাও তো ঠিক না। বিশ্বাস করো আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না।”
দিতিয়া চুপ করে রইল। আমি বললাম,
“তখন মা কী কারণে তোমার আমার বিয়েটা দিয়েছিল তা তো আমরা এখন সবাই জানি। এখন তো আর ওসব নিয়ে মায়ের মনে কোনো ভয় নেই।”
ও এবারও কিছু বলল না। আমি বললাম,
“দেখো, তোমার আমার সম্পর্কটা এভাবেই চলতে থাকবে। তুমিই বলো এর কি কোনো মানে হয়? তোমার মতো একটা মেয়ের জীবন এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে কেন?”
ও এবারও কিছু বলছে না দেখে আমি বললাম,
“কিছু তো বলো। না বললে বুঝব কী করে যে তোমার মনের মধ্যে কী চলছে? তোমার মনের সব কথা আমাকে খুলে বলো। কোনো সংকোচ করো না প্লিজ। আমাদের এসব নিয়ে কথা বলা উচিত।”
ও আমার দিকে না তাকিয়ে বলল,
“একটা মানুষের তো দুটো বউ থাকতেই পারে। তুমি মানসীকে আবার বিয়ে করে নিয়ে এসো। আমি কোনো আপত্তি করব না।
“সেটা কী করে হয়?”
“কেন হবে না? হবে, আমি কালকেই মায়ের সাথে কথা বলব। যেভাবে পারি আমি মাকে রাজি করাব।”
এবার বোধহয় আমার অবাক হবার পালা। মেয়েটা বলে কী? আমি বললাম,
“কিন্তু তুমি এখানে পড়ে থাকতে চাচ্ছো কেন? কী পাবে? নতুন করে শুরু করো না লাইফটা।”
প্রাণপণে কান্নাটা চেপে রাখতে চেষ্টা করেও আর পারল না দিতিয়া। বারবার নিজের হাত দিয়ে চোখ মুছে নিচ্ছে। কিন্তু যতই চোখ মুছছে ততই আবার চোখের পানিতে গাল ভিজে একাকার অবস্থা।
“প্লিজ, কান্নাকাটি করো না। এভাবে কান্নাকাটি করলে তো কথাই বলতে পারব না।”
দিতিয়া চোখ মুছে নিচ্ছে ঠিকই কিন্তু কান্না থামাতে পারছে না। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
“ছোটবেলা থেকে আমি কখনো আমার বাবা-মাকে পাইনি। এ বাড়িতে এসে বুঝেছি বাবা কেমন হয়, মা কেমন হয়। তোমার ভালোবাসা না পেলেও বাবা, মা, সৌরভ, অনন্যা, মোনা সবার ভালোবাসা পেয়েছি। এদেরকে পেয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো মনে হয়েছে আমিও একটা মানুষ। এদের থেকে আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না প্লিজ।”
আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। ও একটু থেমেই বলল,
“তোমার কাছে কোনোদিন কিচ্ছু চাইব না। কাজের লোকের মতো থাকব এ বাড়িতে।”
“আরে! কী যা তা বলছ! স্টপ ক্রাইং!”
“না না শোনো, তোমার ধারেকাছেও আসব না। কাল থেকে তোমার বিছানায়ও শোব না। এমনকি এ ঘরেও থাকব না আমি। তোমার চোখের সামনেই আর আসব না। এবাড়িতে তো আর কোনো ঘর খালি নেই, আমি নাহয় মোনার সাথেই থাকব। আর মোনার যদি কোনো আপত্তি থাকে তাহলে আমি রান্নাঘরে শোব। তাও তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিও না প্লিজ।”
মেয়েটা পুরো পাগল হয়ে গিয়েছিল। এমনভাবে কাঁদছিল যে আমারও খারাপ লাগছিল। কী করব আমি? মানসীকে ছাড়াও থাকতে পারছি না। আবার দিতিয়ারও একটা ব্যবস্থা করতে পারছি না। ও থাকতে তো মানসীকে কখনো পাব না। মেয়েটা কেঁদেই চলেছে। আমি কখনোই মানুষের কান্না সহ্য করতে পারি না। আর আল্লাহ আমার কাছেই সবাইকে কাঁদতে পাঠায়। কী করব আমি? কী বলে সান্তনা দেব? কিছু ভেবে না পেয়ে বললাম,
“আচ্ছা আচ্ছা…এখন এসব বাদ দাও, ঘুমাও।”
আমি লাইট অফ করে শুয়ে পড়লাম। ও একইভাবে কাঁদতে থাকল। অদ্ভুত তো! এই মেয়ে কান্না থামায় না কেন? কী হবে কী না হবে তা না ভেবে আমি ওর হাতটা ধরে ওকে কাছে টেনে এনে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। কিছু বললাম না। শুধু ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম অনেকক্ষণ ধরে। এটুকু আমি করলাম শুধুমাত্র একজন মানুষ হিসেবে। ও আমাকে ধরল না। কেমন জড়োসড়ো হয়ে রইল। একসময় ওর কান্নাটা থেমে গেল। পুরুষ মানুষকে আল্লাহ দুটো ক্ষমতা অনেক বেশি করে দিয়েছেন। এক নারীকে কাঁদানোর ক্ষমতা আর দুই নারীর কান্না থামানোর ক্ষমতা!
·
·
·
চলবে..........................................................................