দিতিয়াকে ওভাবে জড়িয়ে ধরেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ও কখন উঠেছে টের পাইনি। নাশতার টেবিলে দেখা হলো। প্রচণ্ড কান্নার জন্যই বোধহয় ওর চোখ ফুলে আছে। আর পুরো মুখটা অস্বাভাবিক লাল হয়ে আছে। ব্যাপারটা নিশ্চয়ই সবাই খেয়াল করছে! কী ভাবল সবাই কে জানে! ওকে দেখে মনে হচ্ছিল ওর মধ্যে অন্যরকম একটা জড়তা কাজ করছিল। তারপর হসপিটালে যাওয়ার জন্য যখন আমি রেডি হচ্ছি তখন ও ঘরে এল। আমি বেল্ট খুঁজছিলাম, পাচ্ছিলাম না। ও বলল,
“কী খুঁজছ?”
“বেল্ট পাচ্ছি না একটাও।”
ও আলমারি থেকে একটা বেল্ট এনে দিল। বললাম,
“আমি খুঁজেছিলাম ওখানে।”
ও একটু হাসল। হাসিটা মলিন ছিল। ও দাঁড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাচ্ছে। আমি বললাম,
“কিছু বলবে?”
ও মৃদু স্বরে বলল,
“হ্যাঁ।”
“বলো।”
“আমি পড়াশোনা করেছি ঠিকই কিন্তু সবসময় তো বাসায়ই থাকতাম। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি আর বাসা ছাড়া কোথাও যাইওনি কখনো। তেমন কিছুই চিনি না, জানি না।”
“আচ্ছা, কোথাও গেলে মা বা অনন্যাকে নিয়ে যাও। আমি তো ব্যস্ত থাকি, সময় দিতে পারব না।”
“না, আমি কোথাও যাব না।
“ও তাহলে?”
“ডিভোর্সের ব্যবস্থাটা তুমিই করো, আমি রাজি আছি। কীভাবে কী করতে হয় আমি তো জানি না।”
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও অবশ্য অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল। আমি বললাম,
“ভেবে বলছ?”
“হ্যাঁ।”
“কাল রাতেই তো কত কিছু বললে!”
“হুম। আসলে তখন হঠাৎ শুনে মেনে নিতে পারছিলাম না। পরে অনেক ভেবে দেখলাম আমি থাকলে মানসীর বাবা-মা তো আর তোমার সাথে ওকে বিয়ে দেবে না। আর মানসীও বোধহয় চাইবে না। আর যেভাবে চলছে সেভাবে চললে আমরা তিনজনের কেউই সুখী হতে পারব না।”
আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। ও আবার বলল,
“আর ডিভোর্সের পর এ বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেও মানুষগুলোর সাথে আমার সম্পর্ক রাখতে তো কোনো বাধা নেই।”
“হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কোথায় যাবে? চাচার বাড়িতে?”
“এখনো ঠিক করিনি কোথায় যাব তবে ওবাড়িতে যাব না।”
“দিতিয়া তুমি কীভাবে চলবে সেটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমি প্রতি মাসে তোমার পুরো খরচ দেব।”
“না না। তা কেন করবে? যদি পারো আমাকে একটা চাকরি জোগাড় করে দিও। তাহলেই আমার খুব উপকার হবে।
“আচ্ছা তবে তাই হবে। কিন্তু তুমি কি একা থাকবে?”
“আমার একা থাকার অভ্যাস আছে। চাচা-চাচি, চাচাতো ভাই-বোনদের মধ্যে থাকলেও ছোটবেলা থেকেই আমি তো একাই ছিলাম। আমার একা থাকতে অসুবিধা হয় না।”
“বিয়ে করো। আমি তো বিয়ে করার জন্যই ডিভোর্স নিচ্ছি।”
“আপাতত ইচ্ছে নেই, যদি কোনোদিন মনে হয় তবে করব।”
“কিন্তু এই ৯০ দশকেও আমাদের সমাজে একটা মেয়ের একা থাকাটা প্ৰায় ইম্পসিবল।”
“বাদ দাও না এসব কথা। বরং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুমি ডিভোর্সের ব্যবস্থা করো। আর হ্যাঁ, ব্যাপারটা মাকে কিছুতেই জানতে দিও না। তাহলে মা এটা হতে দেবে না।”
দিতিয়া চলে যাচ্ছিল ঘর থেকে। আমি ডাকলাম,
“শোনো…”
ও ফিরে তাকালো। আমি বললাম,
“আমি বোধহয় অমানুষের মতো একটা কাজ করতে চলেছি। আমাকে ক্ষমা করো, মানসীকে ছাড়া আমি….”
“ছি ছি একথা কেন বলছ? আমি তোমার অবস্থাটা বুঝি। ভালোবাসার মানুষকে না পেলে কতটা কষ্ট হয় তা আমি খুব ভালো করে জানি।”
“মানে? তুমিও কাউকে ভালোবাস?”
দিতিয়া মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। আমি বললাম,
“তাহলে তার কাছেই যাও। আর তখন চাচা-চাচির জোরাজুরিতে বিয়ে না করে তার কাছেই চলে যেতে পারতে।”
“বিয়ের আগে তো ভালোবাসিনি। ভালোবেসেছি বিয়ের পরে। কেমন করে, কবে থেকে তা জানি না।”
ওর একথার পর কিচ্ছু বলতে পারিনি। শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। একটা ম্লান হাসি মুখে নিয়ে ও ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
·
·
·
চলবে.........................................................................