তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো - পর্ব ২৮ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          নিহিন ক্লাস শেষ করে বাসার দিকে ফিরছিল। ফোনটা তখনই এলো। নম্বরটা দেখেই ভয়ে নিহিনের হাত পা কাঁপা শুরু হয়ে গেল! অনেকবার ফোন নম্বর বদলেছে কিন্তু তবুও কীভাবে যেন এই লোকটা নম্বর পেয়েই যায়। ধরবে নাকি ধরবে না ভাবছে। অবশ্য না ধরলে ফোন করতেই থাকবে। জীবন অতিষ্ট করে ফেলবে। ভয়টাকে যথাসম্ভব দমিয়ে রেখে ফোন ধরল নিহিন।

“হ্যালো।”

“সুন্দরী এতবার ফোন করালে কেন? প্রথমবার ধরতে পারলে না? এত অপেক্ষা আমার পছন্দ না জানোই তো।”

“ফোন বাজছিল শুনতে পাইনি। কী বলবেন বলুন।”

“শুনলাম তোমার নাগর নাকি ফিরে এসেছে। তার সাথে নাকি বিবাহ বসবা?”

এ কথা বলে বিশ্রীভাবে হাসছিল ‘জিকো। নিহিন ভয়ে কুঁকড়ে গেল! শওকত সাহেব ও কলরব নিহিনের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল। আলতাফ সাহেব শুধু যে বিয়েতে রাজি হয়েছেন তাই নয় উলটো কলরবের সাথে যে অন্যায় তিনি করেছেন তার জন্য ক্ষমাও চেয়েছেন। সেদিনই ওদের বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়েছে। সপ্তাহখানেক পর ওদের বিয়ে। বিয়েটা তেমন ঘটা করে হবে না। নিহিনদের বাসায় একদম ঘরোয়াভাবে শুধু পরিবারের মানুষদের নিয়ে বিয়ে হবে। আত্মীয়স্বজনদেরও এখন জানানো হবে না। এ খবর এত তাড়াতাড়ি জিকো জানল কীভাবে?

“একি! সুন্দরী চুপ কেন?”

“আপনার সাথে তো আমার ডিভোর্স আরো ৬ বছর আগে হয়েছে। তাহলে এখন আমি আবার বিয়ে করি বা না করি তাতে আপনার কী?”

“ওরে বাবা! মেয়েটা কত চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শিখেছে দেখো! ওহহো আমি তো ভুলেই গেছি তুমি তো আবার এখন লেকচারার। সারাদিন লেকচার দিয়ে দিয়ে স্বভাব খারাপ হয়ে গেছে। সবার সাথেই লেকচার দিতে মন চায়!”

এ কথা বলে জিকো আবার তার সেই বিশ্রী হাসিটা দিলো। নিহিন চুপ করে রইল। ঘৃণায় ওর গা গোলাচ্ছে। ফোনটা রাখারও সাহস হচ্ছে না। জিকো আবার বলল,

“বুঝলা নিহিন, এজন্যই বলি মেয়ে মানুষের অত পড়ালেখার দরকার নাই। তোমার বাপটা আসলে বুঝল না!”

“এত আবোল-তাবোল কথা না বলে আপনি কেন ফোন করেছেন সেটা বলেন।”

“ওমা একসময় কত ভালোবাসা ছিল আমাদের। আমি কি তোমাকে ফোন করতে পারি না?”

“না পারেন না। আমার ওপর আপনার সব অধিকার ৬ বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে।”

“শোনো নিহিন, আমি কিন্তু তোমাকে ইচ্ছায় ছাড়ি নাই। তোমার বাপটা এমন প্যাঁচ খেললো শালার!”

“আমি রাখছি।”

“আরে পাগল শোনো শোনো।”

“তাড়াতাড়ি বলুন। এত সময় নেই।”

“তোমার পেয়ারের নাগরকে বলছো আমার কথা? কত ভালোবাসতাম সেসব বলছো?”

“সেসব জানার প্রয়োজন মনে করেনি সে।”

“আহহা! পুরুষ মানুষ আবার এসব জানার প্রয়োজন মনে করবে না তাই কি হয়?”

“সবাইকে নিজের মতো ভাববেন না।”

“আমিই তোমার হয়ে বলে দেই কি বলো?”

এ কথা বলে জিকো আবার সেই বিশ্রী হাসিটা দিলো। অসহ্য লাগছিল নিহিনের।

“আমার এখন ক্লাসে যেতে হবে, রাখি।”

“ওমা সন্ধ্যাবেলায় ক্লাস থাকে নাকি তোমার?”

“থাকে ইভনিং মাস্টার্সের ক্লাস। রাখছি।”

ফোন রাখার জন্য বাধ্য হয়ে মিথ্যে বলল নিহিন। এই লোকটাকে সে

কখনোই ক্ষ্যাপাতে চায় না। ক্ষেপলে যে এ লোকটা কতটা ভয়ংকর হয় তা ওর থেকে ভালো পৃথিবীর আর কেউ জানে না।

নিহিন বাসায় ঢুকেই আলতাফ সাহেবের এ কাছে চলে গেল। এবং তাকে জিকোর ফোন করার কথা বলল। নিহিন তখনো ভয়ে কাঁপছিল। আলতাফ সাহেব মেয়েকে পাশে বসিয়ে বলল,

“তুই এখনো ওকে এত ভয় পাস কেন মা?”

“বাবা সে একটা ভয়ংকর মানুষ। আমার মনে হয় না সে আমাকে কখনো শান্তিতে থাকতে দেবে। শুনলে তো সে এখন আমাকে হুমকি দিচ্ছে করলবকে সব বলে দেবে।”

“আমি বলি কি মা কলরবের কাছে আমরাই সবটা বলে রাখি। নাহয় জিকো যে ধরনের ছেলে কখন কী হয়!

“আমি অনেকবার বলতে চেয়েছি বাবা সে শুনতে চায় না।”

“যদি আমি বলি?”

“সে শুনতে চাইবে না বাবা।”

“তবু চেষ্টা করে দেখি। জিকো বলতে গেলে তো বিয়েই ভেঙে যাবে। নিহিন আর কোনো কথা না বলে নিজের ঘরে চলে এলো। ভালো লাগছে না। কিছু ভাল লাগছে না। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে যাচ্ছে। নিহিনের এমন কোনো অতীত নেই যেটার জন্য ভয় পেতে হবে কিন্তু ওর সব ভয় জিকোকে নিয়ে! ওর মত খারাপ মানুষেরা সব করতে পারে।

লাঞ্চ শেষে কলরব নিজের চেম্বারে যাচ্ছিল, ঠিক সে সময়েই খবর এলো এক ভদ্রলোক তার সাথে দেখা করতে এসেছেন, ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছেন। লোকটিকে দূর দেখে চিনতে পারল না কলরব। একটু দূর থেকেই লক্ষ করল পোশাকে ভদ্রলোক হলেও চোখ দেখে মনে হচ্ছে জব্বর মাল টেনে এসেছে। নেশাখোর কারো ওর সাথে অফিসে দেখা করতে আসার কথা না! কলরব লোকটার বাকি সবকিছুর দিকে আরেকটু নজর দিলো। বিদেশি দামি ব্যান্ডের স্যান্ডেল, ঘড়ি ও সানগ্লাস, জিন্স, শার্ট পরে আছে সে। দু লাখ টাকা দামের ঘড়ি যে লোকটার হাতে সে ওর সাথে কী উদ্দেশ্যে দেখা করতে আসতে পারে? এসব ভাবতে ভাবতে কলরব লোকটির সাথে দেখা করতে গেল। লোকটি ওকে দেখেই হ্যান্ডশেক করার জন্য উঠে দাঁড়াল। হ্যান্ডশেক করে দুজনে কোনাকুনি দুটো সোফায় বসলো। কলরব বলল,

“সরি আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।”

লোকটি অদ্ভুতভাবে হেসে বলল,

“আমি জিকো, নিহিনের হাজব্যান্ড।”

কলরব কিছুটা অবাক হলেও সামলে নিয়ে বলল,

“এক্স হাজব্যান্ড!”

“ওহ হ্যাঁ এক্স, তবে ব্রাদার ডিভোর্স টা কিন্তু ওই বুড়ো জোর করে করিয়েছে। আমরা কিন্তু দুজন দুজনকে প্রচণ্ড ভালোবাসতাম। এমনকি এখনো বাসি। এজন্য আজ অবধি অন্য কাউকে বিয়েও করিনি।”

“আচ্ছা। তা আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?”

“কিছুই না। এই একটু দেখতে আসলাম বউটার কার সাথে বিয়ে হচ্ছে!”

কী অদ্ভুত কথা! ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পরেও বউ বউ করছে। কলরবের ইচ্ছে করছে লোকটার জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। সেদিন নিহিনের কাছে পুরো কাহিনি শুনলে আজ এই লোকটার সব কথার জবাব দিতে পারতো। কিন্তু কিছুই জানে না আন্দাজে কী বলবে! কলরব যথাসম্ভব মাথা ঠাণ্ডা রেখে বলল,

“তা কেমন দেখলেন?”

জিকো কলরবের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বলল,

“নিহিন আপনাকে আমাদের বাচ্চার কথা বলেছে?”

কলরব এবার আকাশ থেকে পড়ল। নিহিনের বাচ্চা আছে? নিহিনের বাসায় তো কোনো বাচ্চা দেখেনি। তাহলে কি বাচ্চা এই লোকের কাছে থাকে? নিহিন কথাটা ওকে বলল না কেন? পরক্ষণেই মনে পড়ল ও নিজেই তো কিছু জানতে চায়নি। কিন্তু এখন কী উত্তর দেবে? কলরব আর যাই হোক না কেন এ লোকটার কাছে ছোটো হতে চায় না। নিহিনকেও ছোট করতে চায় না। তাই মৃদু হেসে বলল,

“দেখুন মিস্টার জিকো, নিহিন আমার প্রেমিকা, হবু স্ত্রী। সে আমাকে কী বলেছে কী বলেনি সেসব আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেসব নিয়ে আমি নিশ্চয়ই আপনার সাথে কথা বলব না?”

“অন্ধ! একেই বলে প্রেমে অন্ধ! আমিও ছিলাম! তবে ব্রাদার আমি আপনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বলছি ওর তো দ্বিতীয় বিয়ে, আপনার তো প্রথম! একটু ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে নিন। নিহিন কিন্তু প্রচুর নেশা করে। ইয়াবা খায়! ইয়াবাখোর বউ চলবে তো?”

এ কথাটা বলে জিকো খুব বিশ্রীভাবে হাসলো। রাগে কলরবের শরীর ফুটছে। অফিস না হলে কলরব এ লোকটাকে মেরে বাপের নাম ভুলিয়ে দিত। কলরব হেসে বলল,

“আমিও ইয়াবা খাই। আমরা দুজন মিলেই খাই।”

এ কথা শুনে জিকো একটু ভরকে গেল। কলরব তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল,

“এ ব্যাপারে আপনার নিশ্চয়ই কিছু বলার নেই? থাকলেও সেসব শোনার সময় আমার নেই। এটা আমার অফিস, আমার কাজ আছে। আপনি এখন আসতে পারেন।”

‘পরে কিন্তু আফসোস করেও কূল পাবেন না।”

জিকো তার বিশ্রী হাসিটা দিয়ে চোখ মেরে বেড়িয়ে গেল!
·
·
·
চলবে....................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp