“কোথায় পালাচ্ছো হুসনাত খাতুন? নিজের ভবিষ্যত দেখে কি ভয়ে পালাচ্ছো?”
হুসনাতে গায়ে হিম ধরে গেলো। লোম দাঁড়িয়ে গেলো ভয়। নিজেকে ইরহানের বাহুডোর থেকে ছাড়ানোর জন্য উদগ্রীব হলো সে। কিন্তু শক্ত পাথরের মতো দৃঢ় হাতজোড়া থেকে নিজের পেলব দেহটা ছাড়াতে পারলো না। ইরহান হুসনাতের অস্থিরতা দেখে হাসলো যেন। তারপর তার গালজোড়া শক্ত করে ধরে বললো,
“তোমার মুনিবের এমন দশা কি করে শুধাবে না?”
হুসনাতের চোখ ছলছল করে উঠলো ব্যথায়। ইরহানের হাতের চাপে চোয়াল খসে পড়ার মত হাল। কিন্তু সেই ব্যথা গিলে কোনোমতে বললো,
“হুজুর, আপনি আমাকে ভুল ভাবছেন”
“কি ভুল ভাবছি হুসনাত খাতুন? আমিও জানতে চাই”
হুসনাতের চোখে মুখে তীব্র ভয়ের ছাপ। সে কাঁপা স্বরে বললো,
“আমি কোনো অপরাধ করি নি, হুজুর”
“ছিঃ ছিঃ, এভাবে বলতে আছে। আমি কখন বলেছি তুমি অপরাধ করেছো। তবে তুমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছো। যে একবার বিশ্বাসঘাতকতা করে, সে বারবার বিশ্বাসঘাতকতা করে”
হুসনাত বুঝতে পারছে না, ঠিক কোন বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলছে ইরহান। যদি সম্ভ্রম রক্ষা করা বিশ্বাসঘাতকতা হয় তবে সেই বিশ্বাসঘাতকতা সে করেছে। হুসনাতের ছলছল নয়নে ভ্রান্ত নয়নে তাকালো। ইরহানের হাত তার গলা অবধি নেমে এসেছে। তার কানের কাছে মুখ চেপে শীতল স্বরে বললো,
“তোমার মুনিবের শহরে আসার উদ্দেশ্য ছিলো সুলতানকে হত্যা! কি হুসনাত খাতুন? তুমি জানতে না?”
হুসনাত চমকে উঠলো। তার ভ্রান্ত দৃষ্টির বিহ্বলতা বৃদ্ধি পেলো। বণিকদের দলের সাথে তার যাত্রাটা শুরু হয়েছিলো যখন হাকেম মারা যান। হাকেমের ছেলে তাকে মুক্ত করার বদলে বণিকের সাথে বেঁচে দেয় তিন তাম্রমুদ্রার বিনিময়ে। হুসনাতের রুপ দেখে বিমোহিত হয়েই বণিকের দল তাকে কিনতে রাজী হয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো উপঢৌকন হিসেবে তাকে পেস করবে সুলতান মালেক শাহর কাছে। নাফিসা নামে হুসনাতের যাত্রা শুরু হয় বণিকদের সাথে। বণিকের সাথে কম অত্যাচারিত হয় নি সে। সামান্য দাস হয়ে মালিকের উদ্দেশ্য জানা সম্ভব নয় হুসনাতের পক্ষে। তাকে যা বলা হয়েছে সে শুধু সেটাই করেছে। হুসনাত কাঁপা স্বরে বললো,
“হুজুর আমি জানতাম না। আমি সত্যি জানতাম না”
তার কথাগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। ইরহানের ধূসর সাঁড়াশির ন্যায় নয়নজোড়া সেই কাঁপা পেলব মুখখানা দেখলো। ঠোঁটে এক হিংস্র হাসি ছড়িয়ে বললো,
“মিথ্যে কথা বলা মহাপাপ হুসনাত খাতুন। আমি কি করে বিশ্বাস করি তুমি কোনো গুপ্তচর নও? বণিক তোমাকে এখানের সকল খবরাখবর জানতে তোমাকে এখানে পাঠায় নি? সুলতানের নাকের ঢগায় থেকে এক বিশাল মাকড়সার জাল বিছানো হয়েছে যা তুমি বুনেছো। আমার কাছে আসার উদ্দেশ্যও হয়তো তাই? বছর দুই পূর্বেও তুমি সেই উদ্দেশ্য নিয়েই আমার শিবিরে প্রবেশ করেছিলে, তাই না? আমি কি ভুল ভাবছি হুসনাত খাতুন? অনেক সূক্ষ্ণ পরিকল্পনা। কিন্তু ইরহান আলী শাহর কাছে এসব পরিকল্পনা নস্যি।”
“হুজুর বিশ্বাস করুন, আমি কিছু জানি না”
“আমি পৃথিবীর কাউকে বিশ্বাস করি না। কাউকে না”
হুসনাতের শিরদাঁড়া বেয়ে হিমস্রোত নেমে গেলো। শ্বাস আটকে আসছে। ইরহানের বিশালের হাতখানা তার ছোট গলাকে ধরে আছে। সামনে বণিকের অর্ধচেতন দেহ। ইরহানের মুখশ্রীতে কোনো ভাবের পরিবর্তন নেই। সে হুদকে নির্দেশ দিলো,
“শেকল খুলে দাও বণিকের”
হুসনাতের শুভ্র মুখখানা রক্তশূন্য হয়ে গেলো। ইরহান ঠিক কি চাইছে, বোধগম্য হচ্ছে না যেন। তার চোখ থেকে অনর্গল অশ্রু বইছে। ছটফট করছে সে। মস্তিষ্ক কাজ করছে না। হাত পা থরথর করে কাঁপছে।
ইরহান হুসনাতকে একপ্রকার ছুড়ে মারলো মেঝেতে। হাটু গেঁড়ে বললো,
“আমার তলোয়ার তোমার গর্দান নিতে পারতো। কিন্তু আমি তোমাকে আরোও কঠিন শাস্তি দিতে চাই হুসনাত খাতুন। তোমার আত্মাও যেন দেহ ছাড়ার আগে হাজারবার মিনতি করে। আর তোমার মৃত্যুও যেন এই ইরহান আলী শাহকে না ভুলে”
বণিকের মুখে পানি ছিটালো ইরহান। হুস ফিরলো বণিকের। শেকল ছাড়া অবস্থায় নিজেকে আবিষ্কার করে কিছুক্ষণ হা করে চেয়ে ছিলো সে। ইরহান তার চুলগুলো মুঠোবন্দি করে বললো,
“ওই যে তোমার বিশ্বাসঘাতক, যার কারণে আজ তোমাকে মরতে হচ্ছে। তোমার কাছে দুটো পথ, হয় আমার তলোয়ার নয় তোমার বদলা”
বণিকের দৃষ্টি হুসনাতের দিকে পরতেই হুসনাতের আত্মা কেঁপে উঠলো। সে কোনো মানুষকে দেখছে না। মনে হচ্ছে কোনো ক্ষুধার্ত জানোয়ার তার হিংস্র চোখে শিকারকে দেখছে। বদ্ধ থাকতে থাকতে যেন নিজের মানসিক সম্ভ্রম হারিয়ে ফেলেছে বণিক। নিজের অপূর্ণ প্রতিশোধ এবং নিজের দলের মানুষগুলোর মৃত্যু মস্তিষ্কে ভেসে উঠতেই হিংস্র হয়ে উঠলো সে। হুসনাতের একটা ভুলের কারণে আজ সে ইরহানের কাছে বন্ধি। তাই তাকে হত্যা করলে বণিকের ব্যথিত হৃদয় ক্ষান্ত হবে।
হুসনাত বণিকের চোখে নিজের মৃত্যুকে দেখতে পেলো। ইরহান একটা ছোট ছুরি ফেললো বণিকের সম্মুখে। হুদ নিজের মনিবের ক্রুরতা দেখে শুকনো ঢোক গিললো। লোকটির মস্তিষ্কে কখন কি চলে সে বুঝতে পারে না। এই ছোটখাটো মেয়েটিকে পথ থেকে সরানো খুব কঠিন কিছু নয়। এটা সত্য যে হুদও তাকে বিশ্বাস করে না। মহলে মেয়েটির আগমণের পর থেকেই কেমন অদ্ভুত তার আচারণ। তার চোখে মুখে কেমন নির্লিপ্ততা। মস্তিষ্কে কি চলছে বোঝা যায় না। হুদ অবাক হবে না যদি বণিকের পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্রে মেয়েটি জড়িত থাকে। বণিকের পরিকল্পনা ছিলো সুলতানকে হত্যা, হয়তো মেয়েটি তার একটা পেয়াদা মাত্র। সে এই হারেমে থেকে বণিককে তথ্য আদান প্রদান করতো। অসম্ভব নয়। গুপ্তচর হিসেবে অসহায় নারী সবচেয়ে শ্রেয়। কিন্তু তাকে এতোটা ক্রুর শাস্তি দেবার মানেই নেই। বণিক এখন স্বাভাবিক অবস্থাতে নেই। বিগতদিনের কঠিন শাস্তি তার মস্তিষ্ককে বিকৃত করে তুলেছে। বণিক গত পরশু হিংস্র করে আক্রমণ করে বসেছিলো হুদকে। কামড়ে তার হাত জখম করে দিয়েছে। মানসিকভাবে সে একেবারেই পাশবিক প্রবৃত্তির হয়ে গেছে। এমন ব্যক্তির কাছে ছুরি দেওয়াটা কতটা নিরাপদ? মনিব ঠিক কি চাইছেন?
হুসনাত নিজের ভবিতব্য কল্পনা করতেই একপ্রকার হামাগুড়ি দিয়ে ইরহানের কাফতান খামছে ধরলো। দিগ্বিদিক শূণ্য চোখে বললো,
“হুজুর, আমি আপনার দাস। আপনার সেবাই আমার ধর্ম। আমাকে বিশ্বাস করুন। আমি আপনাকে এক মুহূর্তের জন্য ঠকাই নি। হুজুর বিশ্বাস করুন”
ইরহান হাটু ভাঙ্গলো, হুসনাতের গালজোড়া চেপে ধরে অনুভূতিশূন্য স্বরে বললো,
“আফসোস হুসনাত খাতুন, তোমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। কি করে বিশ্বাস করি তোমাকে?”
হুসনাত মরিয়া স্বরে বললো,
“আমি আপনার উপপত্নী হুজুর”
ইরহান হাসলো। তার বক্রহাসিতে আশার কিরণটুকু শেষ হয়ে গেল যেন। হুসনাত নিজের মৃত্যুকে দেখছে। এই পৃথিবীর কাছে তার একটাই চাওয়া ছিলো, জীবন। বোধশক্তি প্রখর হওয়া থেকে তাকে একটা জিনিস বোঝানো হয়েছে,
“এই পৃথিবী খুব নিষ্ঠুর, নিষ্ঠুর পৃথিবীতে সবচেয়ে নিষ্ঠুরতা জীবন”
তবুও সেই জীবনকেই বারবার বেছে নিয়েছে হুসনাত। বোধ হবার পর থেকে সে বারবার এই জীবনের জন্য লড়াই করে এসেছে। নিজের পরিবার কে? নিজের পরিজন কে? জানে না হুসনাত। শুধু একটা পরিচয় তাকে দেওয়া হয়েছে, সে দাস। তার মনিব বদলেছে। কিন্তু জীবনের নিষ্ঠুরতা কমে নি। এই নিষ্ঠুর জীবনকেই সে মেনে নিয়েছে। বারবার মেনে নিয়েছে। কারণ মৃত্যু নিসঙ্গ, ভয়ংকর, চির নিস্তব্ধতা। হুসনাত নিসঙ্গতাকে ভয় পায়। মৃত্যুর সেই ভয়ংকর তীব্র কালো থাবাকে ভয় পায়। হয়তো আগামীকালটা সুন্দর হবে। হয়তো আগামীকালের সূর্যের আলোটা অন্যরকম হবে। তাইতো অত্যাচার সহ্য করেও তার একটাই কামনা, জীবন। হুসনাতের এই জীবনের কোনো উদ্দেশ্য নেই। যে জীবনের কোনো স্বাধীনতা নেই সেই জীবনের মূল্য নেই। এই জীবন তাকে কিছুই দিতে পারবে না। অথচ এই মূল্যজীবনটাকেই সে চায়। সে বাঁচতে চায়। নিষ্ঠুর জীবনের স্বাদ নিতে চায়। মস্তিষ্ক থেকে একটা পরিচিত স্বর কানে বাজলো,
“তোমাকে বাঁচতে হবে হুসনাত। তোমাকে বাঁচতেই হবে। আমার জন্য বাঁচতে হবে। আমার ফেরা অবধি তোমাকে বাঁচতে হবে। আমি তোমাকে মুক্তি দিব এই যন্ত্রণাময় জীবন থেকে”
ইরহান তার দিকে একটা ছুরি ছুড়ে ফেললো,
“আমার আনুগত্যের ছোট উপহার”
বলেই পাতালঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে এবং হুদ। হুসনাত ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো তার যাবার পানি। কাঁপা হাতে ছুরিটা হাতে নিল সে। সেই মুহূর্তেই ক্ষুধার্ত হায়েনার মত ছুরি নিয়ে বণিক হামলে পরলো হুসনাতের উপর। ভাঙ্গা পা দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সে আক্রমণ করে বসলো হুসনাতকে। হুসনাতের হাত থেকে ছুরিটা পরে গেল। সে দু হাত দিয়ে সে আক্রমণ ঠেকাবার চেষ্টা করলো। ছুরির ধারে হাত কেটে রক্ত পড়তে লাগলো অঝরধারায়।
হুসনাতের হৃদয়বিদারক চিৎকার গুঞ্জছে পাতালঘরে। দরজার বাহিরে নির্বিকারভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ইরহান। হুদ কিঞ্চিত উদ্বিগ্ন স্বরে বললো,
"হুজুর, মেয়েটা ম'রে যাবে"
ইরহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইলো তার দিকে। হুদের আত্মা কেঁপে উঠলো। আর কথা বাড়ানোর সাহস করলো না সে। হয়তো হুসনাতের পরিণত এটাই। ভেতরে কি হচ্ছে জানা নেই। ইরহান নির্বিকার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে কেন দাঁড়িয়ে আছে? এই প্রশ্নটাও করতে পারছে না হুদ। সে দাঁড়িয়ে আছে তার মনিবের সাথে। একটা সময় ক্ষীণ হয়ে এলো হুসনাতের স্বর। আর্তনাদ মিয়ে গেলো। ইরহান সাথে সাথেই প্রবেশ করলো পাতালঘরে। মশালের ধিক ধিক আলো বাতাসে কম্পিত হচ্ছে। সেই কম্পিয়মান আলোয় হুসনাতের নিষ্প্রাণ রক্তাক্ত দেহটি দেখলো সে। বণিক তখন তার বুক বরাবর ছোরাটা বসাতেই যাবে ইরহান তাকে লাথি দিয়ে সরিয়ে দিলো। হাটু ভেঙ্গে সে হুসনাতের কাছে বসলো। নিপুণ চোখে দেখলো নিষ্প্রাণ শুভ্র দেহটাকে। হুসনাতের বাহু, ঘাড়, গলা এমন স্থান নেই যেখানে সে আঘাত করে নি। বণিক ইরহানের লাথিতে ছিটকে গেলেও আক্রমণ করতে তেড়ে আসলো। ছোরাটা বসিয়ে দিলো ইরহানের বাম কাঁধে। হুদ সাথে সাথেই তাকে ধরে তার হাত থেকে ছোরাটা নিয়ে ফেলে দিলো। বণিক অপ্রকৃতস্থর মত হাসতে হাসতে বললো,
“এভাবেই তোদের মৃত্যু হবে। এভাবেই তোদের মৃত্যু হবে”
সাথে সাথেই ইরহান তলোয়ারের এক আঘাতে বণিকের হাতের কবজি আলাদা করে দিল। বণিক চিৎকার করে উঠলো। তার চিৎকার পাতালঘরের প্রতিটি দেওয়ালে বাড়ি খেলো। ইরহান তার কাফতানের উপর চাঁদরটা দিয়ে হুসনাতের দেহকে আগলে ধরলো। হুদকে নির্দেশ দিলো,
“বণিককে বন্দি করে রাখো। আর হাকেমকে খবর দাও”
হুদ অবাক হলো মনিবের কাছে। কিন্তু প্রশ্ন করলো না। কারণ তার দায়রা সে জানে। বণিক আবার বন্দি হলো বটে কিন্তু তার চোখে মুখে তীব্র প্রশান্তির লহর। অবশেষে সে ইরহানের রক্তপাত করতে পারলো।
!!১৭!!
ইরহানের খাস কামরার বিছানাতে শুইয়ে রাখা হয়েছে হুসনাতকে। হারেম প্রধান উসমাকে হুদ জানিয়ে দিয়েছে হুসনাত সুস্থ হওয়া আগ পর্যন্ত এখানেই থাকবে। কেউ জিজ্ঞেস করলে যেন সেভাবেই উত্তর দেয় সে। উসমা ইরহানকে খুব ভয় পায় তাই সে “জ্বি হুজুর” বলেই পালিয়ে গিয়েছে। হাকেম হুসনাতের দেহে পট্টি বেঁধে দিয়েছে। তাকে সংকিত দেখাচ্ছিলো। এতোটা জখমি অবস্থাতে তাকে কি করে বাঁচাবে সেটাই যেন তার আশংকা। কিন্তু ইরহানের একটাই হুকুম,
“মেয়েটাকে সুস্থ দেখতে চাই নয়তো তোমার গর্দান নিব আমি”
হাকেম অসহায়ভাবে চাইলো হুদের দিকে। হুদ নিজেও অসহায়। মেয়েটাকে সেই মৃত্যু দিয়েছে, তাহলে বাঁচানোর আগ্রহ কেন? হাকেম চলে যাবার পর হুদও বিদায় নিল। ঘরে কেবল হুসনাত এবং ইরহান। ইরহানের ধূসর চোখ অপলক চেয়ে রয়েছে হুসনাতের দিকে। তার দেহটা যেন আরোও ছোট মনে হচ্ছে। ইরহানের মনে হচ্ছে তেইশ বছর পূর্বে ঠিক এমনভাবেই জখমি হয়ে পাতালঘরের বদ্ধ ঘরে সেও পরে থাকতো। তাকেও এমন মানসিক অপ্রকৃতস্থ মানুষের কাছে একপ্রকার ছুড়ে দেওয়া হতো মৃত্যুকে বরণ করার জন্য। চোখ সরিয়ে নিল ইরহান। বাহিরে তারাখচিত আকাশের পানে চাইলো সে। আজকের রাতটা হয়তো দীর্ঘ হতে চলেছে।
******
মশালের প্রজ্বলিত আলো মিইয়ে এসেছে। মৃদু বাতাসে আলোটা কাঁপছে। মরুর দেশে বৃষ্টি হয় না, তবে রাতে শীতল বাতাস বয়। ইরহান চোখের উপর হাত দিয়ে শুয়ে রয়েছে হুসনাতের পাশে। তখন মৃদু স্বর কানে এলো। নড়ে চড়ে উঠলো সে। নির্লিপ্ত চোখে চাইলো শায়িত হুসনাতের দিকে। ঈষৎ কাঁপছে মেয়েটি। তার কি জ্ঞান ফিরেছে? ইরহান একটু ঝুঁকে দেখলো। না জ্ঞান এখনো ফিরে নি। তার শুষ্ক মুখের দিকে চেয়ে রইলো ইরহান। মেয়েটি একটু পর পর কাঁপছে। চোখের কোন ভেজা? দুঃস্বপ্ন দেখছে কি? ইরহানের নিলীন আঁখি তাকে দেখছে। একসময় নিজের ডানহাতখানা বাড়িয়ে দিলো সে। মেয়েটির গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। হাকেম বলেছিলেন রাতে জ্বর আসবে। ঔষধও দিয়ে গিয়েছেন। ইরহান উঠে ঔষধির বাটিখানা তার মুখে ধরলেও খাওয়ানো সম্ভব হলো না। অচেতন হুসনাতের ঠোঁট বেয়ে ঔষধ পড়ে যাচ্ছে। ফলে ইরহান নিজের মুখে ঔষধখানা নিয়ে তার ঠোঁটে চেপে ধরলো। ঔষধ গলধিকরণের পর তার মুখখানা মুছিয়ে শুইয়ে দিলো। হুসনাতের চোখকোনটা এখন সিক্ত। মশালের ক্ষীণ আলোয় তার শুভ্র শুষ্ক মুখখানার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ইরহান। তারপর তার চোখের কোনে ঠোঁট চেপে ধরলো। শুষে নিলো তার অশ্রু। তার পাশে শুইয়ে তার অচেতন দেহটাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। এতোটা দয়া কেন? সে নিজেও হয়তো জানে না।
******
হুসনাতের জ্বর ভোরে আবার এলো। অচেতন হয়ে পড়ে রইলো সে গোটা দু দিন। এর মধ্যে এক অদ্ভুত কান্ড ঘটেছে। পাতালঘরে বণিক মারা গেছে। কিন্তু তার মৃত্যুটা হয়েছে একেবারে স্বাভাবিকভাবে।
·
·
·
চলবে....................................................................................