রেহতাব মাতবরের বউ - পর্ব ০১ - নাবিলা ইষ্ক - ধারাবাহিক গল্প


১৯৯০, বৈশাখ মাস। 
প্রতাবপুর গ্রাম।
          গ্রীষ্মের কড়া রোদ্দুরের এক উদাস দুপুর। প্রাণহীন বাতাসে শান্তি নেই। পথের দু'পাশের বটগাছ গুলো থমথমে হয়ে আছে—যেন রোদে পুড়ে ঝিমিয়ে পড়েছে। মাতবরদের পঞ্চাশ একর জমিতে শীতের শেষের দিকে রোপণ করা হয়েছিলো বোরো ধান। এখন গ্রীষ্মের প্রখর রোদে খেতভরা পাকা সোনালি ধান দেখতে অপূর্ব লাগছে। গত পরশু থেকে ফসল কাটায় ব্যস্ততা বেড়েছে কৃষকদের। মাতবর বাড়িও ব্যতিক্রম নয়। তাদের নিজের তাঁত কারখানার সকল মজুরদের খেতের ফসল কাটানোর কাজে লাগানো হয়েছে। মস্তিষ্ক গলিয়ে ফেলার ক্ষমতা রাখা সূর্যটা ঠিক ওসমানের মাথার ওপরে। রোদের খরতাপে ওর শ্যামলা গায়ের রংটা সূর্যের আলোয় পাকা গমের মতনই উজ্জ্বল, জ্বলজ্বল করছে। ঘেমে একাকার অবস্থা, মনে হচ্ছে মাত্রই গোসল সেরেছে। থ্যাতলানো নাকটা দুর্বলভাবে শ্বাস ফেলছে। পাকা ধান কাটতে থাকা ওর কর্মঠ হাত দুটো আর চলছে না। থেমে যেতে চাচ্ছে বার বার। হালকা-পাতলা শরীরটা আর চলতে চাইল না। মস্তিষ্ক কিচ্ছুটি ভাবার সময়টুকুও পেলো না–ওর শরীরটা কেমন ছেড়ে দিলো। চোখদুটো মুহূর্তে বুজে এলো। অস্পষ্ট আর্তনাদটুকু গলায় থমকে থাকল। মৃদু বাতাসে উড়ে বেড়ানো পাতার মতন —শরীরটা নিমিষেই জমির শেষপ্রান্ত ডিঙিয়ে পার্শ্ববর্তী খেতে গিয়ে পড়ে। সোনালি রঙের পাকা ঘন ধানের মধ্যে শরীরটা আড়াল হয়ে রয়। বাঁশের উপর মানুষের মতো আকৃতি তৈরি করে পুরোনো জামাকাপড় পরিয়ে দেওয়া, কাকতাড়ুয়াটা ওসমানের জ্ঞানহীন শরীরের ঠিক পাশে। ওর ওপর সূর্যের সোনালি রশ্মি এসে পড়েছে। সেই রশ্মিটা ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকে। একসময় সূর্য ডোবে, আঁধার নামে, দেখা মেলে উজ্জ্বল এক চাঁদের। 

তাঁত কারখানার হিসাব ঘরের সামনে মজুরদের দীর্ঘ সারি। আজকের ফসল কাটার পারিশ্রমিক দেয়া হচ্ছে তাদের। পারিশ্রমিক দিচ্ছেন রায়বাহাদুর। বয়সটা এসে ছুঁয়েছে চুয়াল্লি্শের দোরগোড়ায়। গায়ের রঙটা রোদে পোড়া। মুখে বয়সের হালকা ছাপ। চুল, দাড়িতে অল্প পাক ধরতে শুরু করেছে। গম্ভীরমুখের সরু নাকের ডগায় চশমাটা ঝুলছে। হিসেব খাতায় মনোযোগ রেখে একেক করে ডাকছেন মজুরদের নাম। মজুরদের মধ্যে অল্পবয়সী তরুণদের উপস্থিতি শ’খানেক। ওরা উৎসাহিত। চাপা গুঞ্জন তুলছে। হৈচৈ করতে চাইছে বুঝেই রায়বাহাদুর গম্ভীর কণ্ঠে হুশিয়ারি ধমক ছুঁড়েন। মুহূর্তে নিস্তব্ধতা বিরাজ করে কিছুক্ষণের জন্য। রায়বাহাদহিসেব খাতায় নামটা তুলে এইবারে ডাকেন বিরক্ত নিয়ে,

‘ওসমান!’

নিত্যদিনের আপ্লূত কণ্ঠের প্রত্যুত্তর না শুনতে পেতেই রায়বাহাদুরের কপালের মধ্যিখানে ভাঁজ পড়ে চারেক। মাথা তুলে দৃষ্টি ফেলেন সারিতে। নজর বোলান দীর্ঘ সারি জুড়ে। নিত্যদিনের মতন আজ আর তার বেয়ারা ছেলেটাকে এক নজরে খুঁজে পেলেন না। দৃষ্টির ভুল ভেবে ফের নিখুঁতভাবে চাইতে চাইতে ডাকেন,

‘ওসমান! ওসমান!’

ছেলেটা তার নেই, এখানে নেই। রায়বাহাদুর চিন্তিত হোন। মজুরদের মধ্যেও চলছে অনিশ্চয়তা, মৃদু স্বরের জিজ্ঞাসাবাদ। তরুণদের মধ্যে অনেকেই ওসমানের কাছের বন্ধু। ওদের দিকে চেয়েই রায়বাহাদুর চিন্তিত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে,

‘ওসমান কই? ও যে নাই! কিছু জানো, কই গেছে?’

ইউসুফ তখন তুষারের দিকে চেয়ে আছে। দৃষ্টিতে প্রশ্ন! তুষারও মাথা নাড়িয়ে বোঝায় জানে না। রানা দুই বন্ধুর চিন্তিত মুখ দেখে চতুর গলায় বলে,

‘সরদার, দুপুরে একসাথে খাইছিলাম আমরা। পরে যে যার মতন ধান কাটতে শুরু করলাম। গরমে অবস্থা খারাপ হইয়া গেছিলো। কিছু ভাবিও নাই, দেখিও নাই। খালি হাত চালাইছি। ওয় কি বাসায় চইলা গেলো?’

রায়বাহাদুর সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। বাসার চাবিটা তার কাছে। কাজ শেষে বাবা-ছেলে সবসময়ই একসাথে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হোন। তার একটিমাত্র সন্তান, এই একটিমাত্র ছেলে ওসমান। ওর মায়ের মৃ ত্যুর পর একা হাতে লালনপালন করে বড়ো করেছেন। যেমন খুব আহ্লাদ ছেলেকে নিয়ে, তেমনি ভয়। একটু চোখের আড়াল হলেই তার অশান্তি লাগে, চিন্তা হয়। ছেলেটা এমন রাত করে কোথায় গেলো না জানা অবধি যে শান্তি পাবেন না। বাবার বাধ্য ছেলে ও। না বলেকয়ে এমনতো করে না। রায়বাহাদুর মজুরদের পারিশ্রমিক দেবার দায়িত্বটা তুষারকে দিলো। তুষার পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। অংকে ভালো। ওকে দায়িত্বটা দিয়ে তিনি টর্চ লাইট হাতে বেরুলেন কারখানা ছেড়ে। তার পেছনে… রানা, ইউসুফ, হোসেন আর মোজাহিদও বেরিয়েছে। ওদের হাতে লণ্ঠন। লণ্ঠনের আলোর চেয়েও হলুদচে ও দুর্বল আলো রায়বাহাদুরের টর্চের। আজ ওসমান ফেরেনি, টর্চটা চার্জেও দেয়া হয়নি। এসব গুরুত্ব দিয়ে তার ছেলেটাই করে।
ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা ডাক ভেসে বেড়াচ্ছে। অদূরের কুঁড়েঘর থেকে জ্বলজ্বল করছে কেরোসিন বাতির আলো। সেই সুদূরের খুটির মাথায় বৈদ্যুতিক একটিমাত্র বাল্ব, তাও মাঝে মাঝে জ্বলছে তো নিভছে। চাঁদের আজ তেমন আলো নেই। ভারী অন্ধকার চারিপাশটা। ভূতের মতন দুলতে থাকা গাছগাছালির দুর্লভ ছায়া মাড়িয়েই হেঁটে চলেছেন রায়বাহাদুর। উনার সামনে ওসমানের বন্ধু গুলো। এদিক-ওদিক দৌড়ে ডাকছে, খুঁজছে ওসমানকে। একপর্যায়ে রায়বাহাদুর নিজের বাড়ির সামনেও ঘুরে এসেছেন। দরজায় তখনো মেটেলের বড়ো তালাটা ঝুলছে। সময় গড়াচ্ছে, বাড়ছে রায়বাহাদুরের চিন্তা। ওদিকে গ্রামজুড়ে বিচরণ চালিয়ে ফিরেছে ইউসুফ, রানা.. ওরা সব। রায়বাহাদুর তখন বিচলিত, আতঙ্কিত। তিনি কোনোরকমে বললেন,

‘ও ধান কোনদিকে কাটতেছিল?’ 

মোজাহিদ তখন রীতিমতো গরমে ঘামছে। শ্বাসপ্রশ্বাস রুদ্ধ। দুর্বল ভাবে শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে,

‘সরদার, ও খেতের শেষ মাথাতে ছিলো। ওর দিকের ধান কাটা আজই শেষ হইয়া যাইবার কথা ছিলো। ওসমান নিজেই কইতেছিল দুপুরে।’

রায়বাহাদুর আর একমুহূর্ত দেরি করলেন না। ছুটলেন মাতবরদের খেতের দিকে। পাশাপাশি ছুটল ছেলেগুলোও। পূর্ব দিকের শ্মশানঘাট পেরুতেই সরু পথের দু’পাশে ধানক্ষেত, বাঁশঝাড়। নীরব কাঁচা মাটির রাস্তা ধরে ছোটা রায়বাহাদুর মনেপ্রাণে শুধুই বিধাতাকে ডেকে যাচ্ছিলেন সমানে। তার ছেলেটাকে যেন সুস্থসবল খুঁজে পান। তা..তার ছেলেটা…রায়বাহাদুর আর ভাবতে পারল না। ছোটার গতি বাড়াল। শূন্য মস্তিষ্কে যখন খেতের পশ্চিম দিকে এসে পৌঁছালেন —সজোরে এক চিৎকার করে মাটিতে বসে পড়লেন। মাতবর আর খানদের খেতের মাঝ বরাবর উঁচু হয়ে দাঁড়ানো প্রাচীন বটগাছটায় র ক্তাক্ত ওসমানকে বেঁধে রাখা হয়েছে। ম রা দেহের মতোই ঝুলে ছিলো ছেলেটা। অথচ এমন বিভৎস চিৎকার শোনে সামান্য নড়েচড়ে ওঠে ওর শরীর। ইতোমধ্যে মোজাহিদ, ইউসুফ লণ্ঠন ফেলে ছুটেছে বটগাছের কাছে। ওসমানের প্রাণ আছে, ও জীবিত। এতটুকু বুঝতেই চিৎকার করে বলে ওঠে,

‘ওসমান বাঁইচা আছে, সরদার। তাড়াতাড়ি ওরে হাসপাতালে নিতে হইবো।’

রায়বাহাদুর কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়েছেন। 'আমার বাবাটা’ বলেই ছুটে এসেছেন বেঁধে রাখা ছেলের সামনে। ওসমানকে বেধড়ক মা রা হয়েছে। শরীর জুড়ে জখম, মুখে থোকা থোকা র ক্ত। দড়ি দিয়ে বাঁধা ওসমানকে সমানে, পাগলের মতন ডাকতে-ডাকতে —দড়ি গুলো খুলতে শুরু করলেন রায়বাহাদুর। 
ইউসুফের চোখজোড়া উষ্ণ। রক্তিম রানার চোখদুটোও। ইতোমধ্যে রায়বাহাদুরের মতো গম্ভীর, ভারিক্কি মানুষ কাঁদতে শুরু করেছেন। দড়ি গুলো খোলা হতেই ওসমানের শরীরটা দুলে পড়ে যেতে নিলেই আষ্ঠেপৃষ্ঠে ছেলেকে জড়িয়ে নেন রায়বাহাদুর। হাঁটুতে বাম হাত আর ঘাড়ে ডান হাত রেখে কোলে তুলে ছুটলেন মাতবর বাড়ির উদ্দেশ্যে। 

—————

রাজবংশের উত্তরসূরী হিসেবে এখনো বিদ্যমান আজকের বিলাসবহুল তবে পুরাতন আমলের রাজবাড়িটা। যা প্রতাবপুর গ্রামের দক্ষিণে অবস্থিত—মাতবরদের বর্তমান বসতভিটা। বসতভিটেটাই মাতবরদের প্রভাবশালীত্বের নীরব জবাবের পরিষ্কার উত্তর বহন করছে। রাজবাড়ির উঁচু পিলার ঘেঁষে উঠেছে নাম না জানা সহস্র রকমের গাছ। মোটা ইটের দেয়ালের অনেক জায়গায় মেরামত করা হয়েছে বলেই— এসে জুড়েছে নতুনত্বের সামান্য ছোঁয়া। রাজকীয় ধাঁচের বিশাল প্রধান ফটকের পাশেই আছে ইটের ছোটো দারোয়ানের ঘর। যেখান থেকে ফটক ও সামনের রাস্তা নজরে রাখা যায় সহজে। ঘরটির ভেতরে হলদে বাতি জ্বলছে। দেয়াল জুড়ে পত্রিকা লাগানো। এককোণে পিতলের ঘড়ি। শব্দ করে চলছে। বাম দিকে ঝুলানো কাঠের লাঠি। বাঁশের চকিতে শুয়ে থাকা রঞ্জত মিঁয়ার চোখমুখে বয়সের ছাপ। বয়স এসে ছুঁয়েছে পঞ্চাশের দোরগোড়ায়। চোখদুটো বন্ধ হলেও, দু’কান সচেতন। অদূর থেকেই মৃদু চিৎকার-চ্যাঁচামেচির প্রতিধ্বনি শুনতে পেতেই তরাক উঠে বসেন। চোখমুখ কুঁচকে রেখে দেয়ালে ঝুলোনো লণ্ঠন হাতে তুলে নেন। মাথাটা বের করে দেখেন পথের মোড়টা। চাঁদের মৃদু আলোয় অগুন্তুকদের ছুটে আসতে থাকা ছায়া দেখা যাচ্ছে। আর্তনাদ ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হচ্ছে। রঞ্জত এবারে খ্যাঁকিয়ে ওঠে,

‘কে? কে এই রাতবিরেত গ্যাঞ্জাম করতেছে? প্রাণের ভয় নাই?’

ছেলের র ক্তাক্ত শরীর নিয়ে দৌড়াতে থাকা রায়বাহাদুর আর্তচিৎকার করে, ‘ভাইজান, ভাইজান…আমার ওসমান, আমার ওসমান..বাঁচান আমার পোলারে।’

চাচাতো ভাইয়ের কণ্ঠ চিনেই তার শিরদাঁড়া বেয়ে অনুভূতির স্রোত বয় রঞ্জতের। লণ্ঠন নিয়ে দ্রুতপায়ে বেরোয় ঘর ছেড়ে। ‘পুরুষ মানুষ কাঁদে না’ এই কথাটি সারাজীবন মেনে এসেছিলেন রায়বাহাদুর। অথচ আজ ছেলের এই অবস্থা তার হৃদয়কে ক্ষ ত বিক্ষিত করে রেখেছে। অঝোরে কাঁদতে বাধ্য করেছে। রঞ্জুত চিৎকার করে ওঠে ওসমানের ম রার মতন দেহটা দেখে। 

‘ক…কী হইছে ওর? কী করে হইছে এমনডা?’

মোজাহিদ দুর্বল কণ্ঠে সবকিছু খুলে বলে। এও জানায়, কে ওসমানের সাথে এমনটা করেছে জানে না। তবে উপস্থিত সবাই অনুমান করতে পারছে, কাদের স্পর্ধা হতে পারে এমন কাজের। বাকরুদ্ধ রঞ্জত। রায়বাহাদুর করুণ গলায় বলে,

‘মা..মালিককে একটু জানান। একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দেন। ওরে অতিসত্বর হাসপাতালে নিতে হইব।’ 

রঞ্জত কাঁপা কাঁপা হাতে ছুঁয়ে দেয় ওসমানের র ক্তাক্ত মুখ। ভাইপুতের এমন অবস্থায় থরথর করে কাঁপছে ভেতরটা। চিন্তিত চেহারা তুলে কোনোরকমে বলে,

‘মালিক গ্রামে নাই। শহরে গেছেন।’

হতাশ হয় না রায়বাহাদুর। ফট করে বলে বসে, ‘মা..মালকিন তো আছেন। তারে –তারে জানাই। তারে জানান। তারে জানান, ভাইজান। দরজা খোলেন। দরজা খোলেন।’

পাগলের মতো বিলাপ শুরু করেছেন রায়বাহাদুর। রঞ্জুর অসহায়। কী করবেন এমতাবস্থায়? মালকিন… তাদের মালকিন.. উনাকে কীভাবে জানাবেন এসব? জানানো কী ঠিক হবে? মালিক থাকলে একটা ব্যবস্থা করা যেতো! এমন রাত করে এই ব্যাপার নিয়ে রাজবাড়ির ভেতর ঢোকা কতটা সঠিক? অন্যদিকে ভাইপো, ভাইয়ের অবস্থা দেখে আর কিচ্ছুটি ভাবতে পারছেন না। কিছু যদি হয়ে যায় তার মানিকের? মুহুর্তেই ঘর থেকে চাবি বের করে খুলে দেন রাজবাড়ির বিশাল দরজাটা। যা আছে কপালে, তাই হবে। 

—————

নিঃস্তব্ধতা বিরাজমান মাতবর বাড়ির ভেতরটায়। গ্রামের সাধারণ মানুষের বাড়িতে বিদ্যুৎ না থাকলেও মাতবর বাড়ির মতন প্রভাবশালী বাড়িতে আছে। তবে এই মুহূর্তে অন্ধকার সবটা। কোথাও একটু আলো নেই। আঁধারেই ছেলেকে নিয়ে হাঁটু ভেঙে ফটকে বসে পড়ে রায়বাহাদুর। নিঃস্তব্ধতা চিঁড়ে আর্তনাদ করে ওঠে। সেই করুণ কণ্ঠের আর্তনাদের ধ্বনি দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে পড়ে, নিঃস্তব্ধতা ভাঙে, বাতি জ্বলে ওঠে বিশাল বসবার ঘরের সব কয়টা। নিচতলার ভেতর থেকে আতঙ্কে হুড়মুড়িয়ে কদমে বেরিয়ে এসেছে নুহুল। আসতে-আসতেই কঠিন গলায় গর্জন ছুড়ে,

‘কার এতোবড়ো স্পর্ধা! কার? রঞ্জত! রঞ্জ…..ত’

ফটকে চেনাপরিচিত মুখ গুলো থমকায় নুহুল। রায়বাহাদুরের দু’হাতের ওপর ওসমান। পেছনেই রঞ্জত দাঁড়িয়ে। চোখ দুটো রক্তিম। মুখ, বদন জুড়ে ভীতি। রঞ্জতকে ঘিরে মোজাহিদ, ইউসুফ, রানা, হোসেন রীতিমতো ভয়ে কাঁপছে। তবে সাহস করেঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। পালানোর চেষ্টা করেনি। রায়বাহাদুর কান্নায় ভেঙে পড়ে,

‘নুহুল ভাই, আমার পোলাডারে বাঁচাও, বাঁচাও আমার মানিকরে। ওরে হাসপাতালে নিতে হইব। এ..একটু মালকিনরে ডাকো, একটু জানাও তারে।’

নুহুল একপলক দেখে র ক্তাক্ত ওসমানকে। তার মায়া কাজ করে। খারাপ লাগে। কিন্তু, দিনশেষে সেওতো কাজের লোক। তার দায়িত্ব মায়া-দয়া দেখানোর স্পর্ধা দেয়নি। চোখমুখ কঠিন করে সে তাকায় রঞ্জতের দিকে। শক্ত গলায় ধমকে ওঠে,

‘নিয়মনীতি কি ভুইলা গেছো, রঞ্জত? গভীর রাইতের বেলায় তুমি ভেতরে ওদের ঢুকতে দিছো কোন সাহসে? কার অনুমতিতে? এতো বড়ো স্পর্ধা কই পাইছো?’

রঞ্জত শব্দ করে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে। সেই দেখাদেখি বসে পড়ে ওসমানের বন্ধুগুলোও। রানার প্যান্ট ভিজে গেছে। ইউসুফ তখন রানার পেছনে। আতঙ্কে এইটুকুন হয়েছিল। নগ্ন পায়ে গরম কিছুর স্পর্শে আঁতকে ওঠে। চেয়ে যা দেখে তাতে চেহারার রং পাল্টায়। নাকমুখ কুঁচকে তারপরও চুপ রয়। সাহস করে না বিন্দুমাত্র নড়বার। গন্ধে তার মুখের অবস্থা অবর্ণণীয়। রঞ্জত নিজের ভুল স্বীকার করে দুর্বল গলায়,

‘নুহুল ভাই, মাফ কইরা দেন আমারে। ভাইপোর এই অবস্থা দেইখা আমি ঠিক থাকতে পারিনাই। আমি আমার শাস্তি মাথা পাইতা নিমু। মালিক নাই, তাই মালিকনই একমাত্র ভরসা। তারে একটু জানান। একটু মেহেরবানি চাই, একটু। নাইলে ওয় বাঁচব না।’

নুহুল কঠিন থাকতে পারে না। অসহায় হয়, অপ্রস্তুত হয়। মালিকের অনুপস্থিতির সাথে তার কড়া এক নিষেধাজ্ঞা জারি করা থাকে। তা হচ্ছে,

‘কেয়ামত হয়ে গেলেও এই বাড়ির ফটক পেরিয়ে কোনো বাইরের মানুষ ঢুকতে পারবে না।’ 

এমন নিষেধাজ্ঞা ভেঙে কিছু বলার সাধ্য তার নেই, নেই, নেই। নুহুল মুখ খোলে। কিছু বলবে। তখুনি —ওপর থেকে এক নারী কণ্ঠ কর্ণগোচর হয়,

‘কী হচ্ছে এইখানে?’

ওই কণ্ঠে সুর নেই, আছে দৃঢ়তা। ভয়ও নেই, নেই বিনয়…আছে এক অদ্ভুত আশ্বাস। চারদিক থমকে গেল একমুহূর্তের জন্য। নুহুল কিছু বলতে চাইল, কিন্তু তার আগেই হাউমাউ করে ওঠে রায়বাহাদুর। ছেলের দেহটা জমিনে শুইয়ে দিয়ে মিনতি করে করুণ স্বরে,

‘মালকিন, আমার পোলাডারে বাঁচান। আমি সারাজীবন গোলামি করমু।’

ওপর থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকা নারীর দেহে সিল্কের শাড়ি। পরিপাটি ভাবে পরা শাড়ির ভাঁজেভাঁজে আভিজাত্য। নামতে নামতে প্রশ্ন করে শক্ত কণ্ঠে, 

‘কে করেছে ওর এই অবস্থা? কার এতো বড়ো স্পর্ধা হয়েছে, শুনি!’

রায়বাহাদুর ডুকরে ওঠে। ভাঙা কণ্ঠে খুলে বলে সব। মোজাহিদ মাথা নত করে ছিল। এইমুহূর্তে মাথা তুলে চায়। ভয়ার্ত মুখ, তবে কণ্ঠে স্পষ্ট দৃঢ়তা,

‘মালকিন, ওসমান অস্পষ্ট কণ্ঠে বারবার মাফ চাইতেছিল। বার বার করে কইতেছিল, আমারে মাইরেন না। আমি ইচ্ছা কইরা খেতে পড়িনাই। আমারে ছাইড়া দেন।’

রায়বাহাদুর ভেঙে গুড়িয়ে পড়েন একেবারে। রঞ্জুত দু'হাতে চেপে ধরে ভাইয়ের বাহু। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে ডাক পড়ে তখুনি,

‘নুহুল!’

নুহুল দ্রুত কদমে এগোয় প্রত্যুত্তরে, ‘জি, মালকিন।’

আদেশ করে, ‘ওরে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা কর। আমাদের লোকজন কই সব? ডাক।’

নুহুল দাঁতে দাঁত চেপে কিছু বলতে চায়, কিন্তু পারে না। রাগান্বিত ওই দৃষ্টি তাকে আর কিচ্ছুটির বলার সাহস দেয় না। ততক্ষণে ট্রাক্টর বের করা হয়েছে। রায়বাহাদুর ছেলেকে নিয়ে ছুটেছেন বাইরে। ট্রাক্টরে চড়ে তখুনি রওনা দেন মফস্বলের উদ্দেশ্যে। 

—————

মাঠের শেষ প্রান্তে, ধান গাছের ফাঁকে জ্যোৎস্নার আলো পড়েছে। বাতাস নেই। নিঃস্তব্ধ নিশুতি রাতের খেত যেন এক বিশাল অমাবস্যার পৃথিবী। মাথার ওপরে ঝুঁকে থাকা কালো আকাশে জ্বলজ্বল করছে কয়েকটা তারা, দূরে কোথাও অর্ধচাঁদ ঝুলে আছে অলসভাবে। দূরের কোনো গাছে হয়তোব-বা প্যাঁচা বসে আছে। সমানে ডেকে যাচ্ছে। খেতের ধারের বাঁশঝাড়ের পাতাগুলো কাঁপলে মনে হয়, কেউ বুঝি হেঁটে যাচ্ছে। পেছনে গ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছে। আলো নেই, শব্দ নেই। অথচ এসময়ে ক্রমান্বয়ে শব্দ তুলে খেতে আগমন ঘটে অনেকের। বেশ কিছু লণ্ঠনের আলোয় কিছুটা অন্ধকার কেটে যায়। খেতের থেকে বেশ দূরত্ব নিয়ে বসানো হয়েছে সেগুন কাঠের তৈরি চেয়ারটা। চেয়ারের পেছনে সুঠাম দেহি রণবীর সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাতে বাঁশ। বাঁশের মধ্যে লণ্ঠন ঝোলানো। আভিজাত্যে মোড়ানো ওই নারীর চোখ দুটোর দৃষ্টি অদূরের বিশাল খেতের দিকে। এযাত্রায় চেয়ারে বসতে-বসতে ঝিম করা কণ্ঠে হুকুম ছুঁড়ে,

‘কেরাসিন ঢাল। এক কোণাও যেন ছাড় না পায়।’

একমুহূর্তে বারোজন লোক ছড়িয়ে পড়ে খেতের সর্বত্রে। কেরাসিনের ছোটো ড্রাম হাতে। তরল পদার্থটি ঢালা হচ্ছে খেতের সবখানে। নুহুল ঘামছে, কাঁপছে, ধড়ফড় করছে তার ভেতরটা! মুখ ফুটে কিছু বলতে নিয়েও সাহস পায় না। চায় রণবীরের দিকে। রণবীর ফিরেও তাকায় না। একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে খেতের দিকে। কেরাসিন ঢালা শেষ হতেই মালকিনের হাতের ইশারায় সে বাঁশ হাতে এগোয়। আলগোছে খেতের মাথাতে ছোঁয়ায় লণ্ঠের আগুন। ছোঁয়াতে দেরি, তবে এক বিন্দু আগুন ছড়িয়ে পড়তে সময় নেয়নি। চোখের পলকে পুড়তে থাকে সোনালি, পাঁকা ধানগুলো। ফোঁটা ফোঁটা আগুন একে একে রূপ নিচ্ছে লকলকে শিখায়। মৃদু বাতাসের সঙ্গী যেন ছড়িয়ে পড়তে সাহায্যের হাত বাড়ায়। নিস্তব্ধতা চিড়ে ভেসে বেড়ায় শুধু আগুনের গর্জন। শুকনো পাতার কড়কড় শব্দ, আগুনে ভাজা ধানের ফাটাফাটি। ধোঁয়ার পুরু স্তর আকাশের দিকে ধীরে ধীরে উঠছে। নিচে আগুনের লালচে আলোয় গোটা খেত যেন এক অদ্ভুত নরককুণ্ড। বহু দূর থেকে কেউ একজন চ্যাঁচাল। রুদ্ধ স্বরে ডেকে উঠছে,

‘খেত পুইড়া যায়! আগুন লাগছে! আগুন! মালিক, মালিক!’ 

কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। বড্ড যে দেরি হয়ে গেছে। আগুনে পুড়ে ছারখার পুরো খেত। নুহুল চাপাস্বরে বলে এবারে,

‘মালকিন, ফিরে যাওয়া যাক।’

চেয়ারে বসা শীর্ন দেহটা আরও আরাম করে বসল। নারীত্বের স্পর্শ থাকে তার পায়ের ওপর রাখার কাণ্ডে এক আশ্চর্যজনক দৃঢ়তা। নুহুলের কথার বিপরীতে কোনো প্রত্যুত্তর করে না। নীরবে শুধু চেয়ে থাকে জ্বলজ্বল করা খেতের দিকে। ইতোমধ্যে অদূর থেকে ভেসে আসছে অনেকগুলো হন্তদন্ত পদচারণের শব্দ, চিৎকার, হাহাকার। আকাশ, জমিন কম্পন তোলার মতন এক ভারিক্কি, গম্ভীর কণ্ঠ অদূর থেকেই হুংকার ছাড়ল,

‘*****! কলিজা কতো বড়ো আমি দেখবার চাই। কার এতোবড়ো দুঃসাহস! এতো বড়ো স্পর্ধা!’

লোকগুলো কাছাকাছি এলো। মৃদু লণ্ঠনের আলোতে চেহারা গুলো অস্পষ্ট। এবারে আলগোছে ফিরে তাকাল চেয়ারে বসা নারী। সম্মুখের ব্যক্তিটির উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত স্বীকারোক্তি,

'আমার!’

ক্ষণিকের নীরবতা বয়। যেন কণ্ঠ চেনার প্রয়াস। পরমুহূর্তেই তেড়ে আসে ভদ্রলোক। রুক্ষভাষী চিৎকারে জানতে চায়,

‘কে? কেএ?’

শান্ত, স্থির কণ্ঠে যেন কৌতুক। প্রত্যুত্তরটি স্পষ্ট, দৃঢ়…হিমালয়ের সমান উঁচু শোনায়,

‘আমি। আমি রেহতাব মাতবরের বউ।’
·
·
·
চলবে......................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp