অভিমানিনী - পর্ব ২০ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          আমি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। নতুন চাকরিতে জয়েন করলাম। এখানে কাজের চাপ বেশি। একা অনেক কিছু সামলাতে হয়। তবে আগের হসপিটালের চেয়ে এই হসপিটালে আমার বেশি ভালো লাগতে শুরু করল। কাজেও মন বসাতে পারলাম। একদিন দুপুরের ওটি করে আমার চেম্বারে ঢুকলাম লাঞ্চ করতে। ঢুকেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। মানসী বসে আছে, পরনে আমার আর ওর বিয়ের দিনের সেই লাল জামদানি শাড়িটা। লম্বা চুলগুলো বেনি করে তাতে বেলি ফুলের মালা লাগিয়েছে। কপালে লাল টিপ, হাতভর্তি কাচের চুড়ি। আর বিয়ের দিন আমার দেয়া সেই নাকফুলটা, ডিভোর্সের দিন খুলে ফেলেছিল। তারপর ওকে আর ওটা পরতে দেখিনি। বিয়েতে নাকি বউকে নাকফুল দিতে হয়। তখন ইনকাম ছিল না কোনো, তবু জমানো টাকা দিয়ে ওটা আমি ওর জন্য কিনেছিলাম। দিয়ে বলেছিলাম, “আমার যখন অনেক টাকা হবে আমি তোকে গয়না দিয়ে ঢেকে ফেলব।” ও বলেছিল, “তখনো তোমার সেই অনেক গয়নার চেয়ে এই নাকফুলটা আমার কাছে সবচেয়ে দামি থাকবে।”

যাই হোক সব মিলিয়ে মনে হলো স্বপ্ন দেখছি। আমাকে ঢুকতে দেখেই ও হেসে দিল। আমি বললাম,

“তুই হঠাৎ? এত সাজগোজ?”

“বাজে লাগছে?”

“না, সাজিস না তো সচরাচর। তাই হঠাৎ সাজলে অবাক হতে হয়।”

ও হাসল। আমি আবার বললাম,

“কিন্তু আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না যে মেয়েটা আমার সামনেও আসতে চায় না। এমনকি বাড়িতে আসলে তখনই আসে যখন আমি বাসায় থাকি না। আজ কিনা সে আমার অফিসে! সূর্য কোনদিকে উঠেছে বল তো?”

“সূর্য তো পূর্বেই উঠেছিল।”

একথা বলে ও আবার হাসল। আজ প্রথম থেকেই ওর মুখটা হাসি হাসি দেখে নিঃশ্বাস নিতেও কেমন যেন স্বস্তি বোধ করছি। হঠাৎ ও উঠে এসে আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। ও সব সময়ই টিপিক্যাল ব্যাকডেটেড মহিলাদের মতো বিশেষ দিনে আমাকে শুয়ে হাত দিয়ে সালাম করত। প্রথম প্রথম আমার খুব অস্বস্তি আর লজ্জা লাগত। পরে একসময় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ওর মাথায় হাত রেখে বললাম,

“কিরে হঠাৎ সালাম? বিয়েটিয়ে করতে যাচ্ছিস নাকি?”

মানসী আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল,

“আমাকে উইশ করো, আজকে আমি ২০ বছরে পা দিলাম।”

আমি জিভ কেটে বললাম,

“ইশ, আমার মতো অমানুষ দুনিয়ায় আর একটা নেই। আমি তোর বার্থডে ভুলে গেলাম! ভেরি সরি। আমাকে ভুল বুঝিস না। শুভ জন্মদিন।”

একথা বলে আমি ওর কপালে একটা চুমু দিলাম। ও বলল,

“ভুল বুঝবো কেন? এখন তুমি কত ব্যস্ত থাকো! তাছাড়া কত রকমের ঝামেলার মধ্যে দিন কাটাচ্ছ! মনে না থাকলেও সেটা দোষের কিছু হবে না। আর আমার জন্মদিন ভুলে গেলেও আমাকে যে এক মুহূর্ত ভুলতে পারো না, তা আমি খুব ভালোভাবে জানি।”

আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। ও বলল,

“দরজাটা লক করে দেবে একটু?”

“কেন?”

“সমস্যা হবে?”

আমি দরজার কাছে যেতে যেতে বললাম,

“নাহ, এম্নিতেও লাঞ্চ টাইম। না ডাকলে কেউ আসবে না।”

একথা বলে ঘুরতেই ও দ্রুত হেঁটে আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। সাথে সাথে আবেশে আমার চোখটা বন্ধ হয়ে গেল। কী শান্তি! কী শান্তি! পৃথিবীর আর কোথাও নেই, আর কিছুতে নেই। একসময় ও আমাকে ছেড়ে দিল। তারপর বলল,

“দেখো, আজ আমি নিজ হাতে তোমার জন্য রান্না করে এনেছি। তোমার পছন্দের সব খাবার।”

আমি বললাম,

“বাহ! বার্থডে তোর আমার উচিত তোকে খাওয়ানো, গিফট দেয়া। উইশ তো করিইনি, মনে ছিল না তাই গিফটও কেনা হয়নি। এখনই ভাবছিলাম ছুটি নেব। তারপর তোকে নিয়ে বের হব, বাইরে লাঞ্চ করব। এখন দেখছি এটাও করতে দিবি না। তাহলে আজকের এই বিশেষ দিনে আমি কী করব বল তো তোর জন্য? কী গিফট চাস বল?”

ও আমার কাছে এসে এমন এক অদ্ভুত মাদকময় চাহনি দিল যে আমার বুকের ভেতর উথালপাথাল ঢেউ খেলতে লাগল। তারপর বলল,

“বিশেষ দিনের বিশেষ গিফট আমি নিয়ে নিতে জানি!”

বলেই আমার গলা জড়িয়ে ধরে আমার ঠোঁটে চুমু খেলো। মনে হচ্ছিল পুরো পৃথিবীটা আমার হাতের মুঠোয়। ও একটু থামল, সরে যেতে চাইল, আমি তো তখন নাছোড়বান্দা। ও বলল,

“শোনোই না…

অগত্যা আমি ওকে ছাড়লাম ঠিকই কিন্তু কোমর জড়িয়ে ধরে রইলাম। বললাম,

“বল…”

“আরেকটা গিফট চাই আমার।”

ততক্ষণে নেশা ধরে গেছে আমার। আর কোনো কথা বলতে বা শুনতে ইচ্ছে করছিল না। তবু যখন ও গিফট-এর কথা বলছে, সেটা তো শুনতেই হবে। জিজ্ঞেস করলাম,

“কী?”

“এত সুন্দর করে আদর করো তুমি। নিজেকে ধন্য মনে হয়। এতদিন আমি তা বেহিসাবি পেয়েছি।”

“আদর আবার হিসাব করে করা যায় নাকি? আর শুধু আমি কেন সবার স্বামীই তাদের বউদের এত সুন্দর করেই আদর করে।

“নাহ, দিতিয়ার স্বামী তো ওকে আদর করে না।”

অন্য সময় হলে হয়তো একথায় রাগ করতাম। কিন্তু কেন যেন রাগ উঠল না। মাথায় দুষ্টমি ভর করল। বললাম,

“এই চার মাসে এতগুলো রাত এক ঘরে, এক বিছানায় কাটিয়েছি। তার ওপর বিয়ে করা বউ। তোর কি মনে হয় ওর সাথে কিছুই করিনি আমি?”

“ঢং করো না, ও আমাকে বলেছে ওকে একবারের জন্য স্পর্শও করোনি তুমি।”

“ধুর, বলে দিল! মেয়েটা বড্ড বোকা।”

“বোকা নয় বলো ভালো। আমাকে ইনিয়েবিনিয়ে অনেক কিছু বলতে পারত কিন্তু বলেনি।”

“আচ্ছা, তুই তো গিফটের কথা বলছিলি।”

“হ্যাঁ, আমি এটাই গিফট হিসেবে চাই যে তুমি দিতিয়াকে ওর প্রাপ্যটা দাও। এসব আদর তো ওরই প্রাপ্য।”

“ওকে আদর করলে তোর লাভ কী?”

“লাভ অনেক আছে। তোমাকে বোঝাতে পারব না। দেখো আমরা তো আর এক হতে পারব না। কোনো উপায় নেই। আর তোমাদেরও তো বিয়েটা হয়েছে। এভাবে আর কতদিন চলবে বলো তো?”

কী বলব ওকে বুঝতে পারছিলাম না। ও বলল,

“জানো, ডিভোর্সের পর থেকে আমার কেমন জানি মনে হয় তোমার কাছে আসলে আমার পাপ হবে। এখন তো আমরা আর স্বামী-স্ত্রী নেই। আর তুমিও বিবাহিত। তাই এখন আরো আসতে পারি না। শুধু আজই কেন জানি পারলাম এসব কোনো অনুভূতিকে পাত্তা না দিতে। তুমিই বলো আমাদের সম্পর্ক আর কোনো দিকে টেনে নেয়ার মতো অবস্থায় কি আছে? এটা নিয়ে বসে না থেকে

আমাদের কি উচিত না সব ভুলে সামনের দিকে আগানো? যে কারণেই হোক, বিয়েটা তো হয়েছে, সেটা তো আর মিথ্যে নয়। দিতিয়ার মতো মেয়ে পাশে আছে তোমার। দেখবে তুমি পারবে।

আমি খুব সিরিয়াস হয়ে বললাম,

“আমি অন্য কাউকে কখনো ভালোবাসতে পারব না।”

“আমাদের চারপাশে যত হাজবেন্ড-ওয়াইফ আছে তারা সবাই কি সবাইকে ভালোবাসে?”

“সেটা আমার দেখার দরকার নেই।”

“আছে, অনেক সম্পর্কের মধ্যেই ভালোবাসা নেই। তারা কি একসাথে থাকছে না বছরের পর বছর?”

“তুই আমাকে আপোষ করতে বলছিস?”

“হ্যাঁ, একটু করেই দেখো দিতিয়া তোমার জন্য কী করে। আমি অলরেডি ওর চোখে তোমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি। দেখো আমার যদি তোমাকে ফেরত পাওয়ার কোনো চান্স থাকত তাহলে আর এসব বলতাম না। যেহেতু নেই তাই আমি চাই তুমি দিতিয়ার সাথেই ভালো থাকো। অন্য কোনো মেয়ে হলে বলতাম না, কিন্তু দিতিয়ার ওপর ভরসা করে তোমাকে দেয়া যায়। ও তোমার অনেক যত্ন করবে।

“তুই পারবি আমি ছাড়া অন্য কারো সাথে বিয়ে করে তার সাথে সুখে সংসার করতে?”

“হুম, পারব। সময় সব ঘা শুকিয়ে দেয়।”

“দাগটা কিন্তু রয়ে যায়।”

“চাঁদেরও তো কলংক থাকে।”

এ ব্যাপারে আর কথা বাড়ালাম না। বললাম,

“আমরা আজ এই মুহূর্তে এই আলাপ বাদ দিই? আজ তো তোর পাপ বোধ হচ্ছে না তাই না?”

মানসী মিষ্টি করে হাসল। আমরা সেদিন ওইটুকু সময়ের মধ্যেই ঝড়ের বেগে পাপবোধহীন অনেকটা পাপ করলাম।

—————

সেদিন আমাকে ও নিজের হাতে খাইয়ে দিয়েছিল। যাওয়ার সময় আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলেছিল “তোমার জন্য একটা বিশাল সারপ্রাইজ আছে।”

“জন্মদিন তোর আর সারপ্রাইজ আমার জন্য?”

“হ্যাঁ।”

“কী সারপ্রাইজ?”

“যখন পাবে তখনই বুঝতে পারবে।”
·
·
·
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp