সেদিন মানসী চলে যাওয়ার পর বিকেলে হসপিটাল থেকে কয়েক ঘণ্টার ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে ব্যাংকে গেলাম টাকা তুলতে। কত টাকা তুলব বুঝতে না পেরে এক মাসের পুরো স্যালারিটাই তুলে ফেললাম। তারপর মার্কেটে গেলাম। মানসীর জন্য একটা উপহার কেনা দরকার। কী কিনব বুঝতে পারছি না। তাই আন্দাজে ঘোরাঘুরি করছি। তারপর মনে হলো ওর শাড়ি খুব পছন্দ। শাড়ির দোকানে ঢুকলাম। কিন্তু কোনো শাড়ি পছন্দ হলো না। বেরিয়ে এলমেলো হাটাহাটি করছি। শাড়ি ছাড়া কি নেয়া যায় ভাবছি এরই মধ্যে একটা শাড়ি চোখে পড়ল। সোনালী রঙের জামদানি শাড়ি। মানসী জামদানি শাড়ি খুব পছন্দ করে। এই আমাকে নিয়েই শপিং করতে এসে এই রঙের জামদানি অনেক খুঁজেছিল, কিন্তু পায়নি। আজ যদি এটা আমি ওকে উপহার দেই নিশ্চয়ই খুব সারপ্রাইজড হবে আর খুশিও হবে। শাড়িটা একরকম লুফে নিলাম। তারপর মনে হলো দিতিয়ার জন্য একটা নিই। নিশ্চয়ই খুশি হবে। মানুষ অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু পেলে তো খুশি হয়ই। ভালোবাসা তো আর কখনো দিতে পারব না। নাহয় একটা শাড়িই দিলাম। হুবহু একরকম দুটো শাড়ি নিলাম। পুরো এক মাসের স্যালারি থেকে মাত্র ১০০ টাকা রইল দুটো শাড়ি কিনে। জামদানি শাড়ি যে কেন এত দাম! যাই হোক বউটাও তো দামি। এসব ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেল যে আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। তারপরেও মানসীকে বউ বলে ভাবছি। সারা জীবনই হয়তো ভাবব। ভাবনার রাজ্যে বাধা দেয়ার সাধ্য কারো নেই।
মার্কেট থেকে বের হয়ে ফুল, কার্ড আর চকলেট কিনলাম। কার্ডে লিখলাম,
“এরকম আরো ১০০০ জন্মদিন আসুক তোর জীবনে, যাতে ততবার আজকের মতো আদর পাই! ভালোবাসি…”
তারপর টেলিফোন বুথে ঢুকে বাসায় ফোন করলাম। রিং হচ্ছে… “হ্যালো।”
“কে মা?”
“হ্যাঁ।”
“সৌরভ আছে বাসায়?”
“না ও তো হসপিটালে। কেন কী হয়েছে?’
“তেমন কিছু না। ওর সাথে একটু দরকার ছিল। আচ্ছা তুমি অনন্যাকে দাও।”
“আচ্ছা, দিচ্ছি ধর…”
মায়ের গলাটা অনন্যা অনন্যা ডাকতে ডাকতে দূরে সরে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনন্যার গলা পাওয়া গেল।
“দাদা…বলো।”
“মা আছে সামনে?”
“না।”
“যাক বাঁচা গেল। আমার কথা শোন…মানসীর জন্য আমি একটা শাড়ি কিনেছি। ওটা তোকে ওর বাসায় পৌঁছে দিতে হবে।”
“আচ্ছা।”
“আজই।”
“হুম সেটা তো বুঝতেই পারছি। জন্মদিন বলে কথা! দাদাও তো আমাদের বাসায়ই এখন।”
“তাই? কখন এসেছে?”
“কিছুক্ষণ আগে। তুমি আসবে কখন?”
“আমার দেরী হবে। কিন্তু শাড়িটা আজই পাঠাতে হবে। তুই একটু বের হতে পারবি? আমি রাস্তার মোড়ে থাকব। তুই এসে নিয়ে যাবি।”
“পারব। কিন্তু মাকে কী বলে বের হব?”
“জানি না, তোকে বের হতেই হবে।”
“আচ্ছা, এক কাজ করি। বলি যে সৌরভ আমাকে রাস্তার মোড়ে যেতে বলছে ওর কোনো একটা জিনিস নিয়ে। আর ওকেও ফোন করে বলে দিই যাতে এর মধ্যে ও ফোন না দেয়।”
“ওকে, থ্যাংকস।”
“শুকনো থ্যাংকস বললে হবে না। আইসক্রিম চাই।”
আমি হেসে বললাম,
“আচ্ছা, আয়…কিনে দিচ্ছি।”
অনন্যাকে শাড়ি দিয়ে আবার হসপিটালে চলে গেলাম। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে বারোটা বেজে গিয়েছিল। ভেতরে ঢুকে দিতিয়াকে দেখে চোখ সরাতে পারছিলাম না। মানসী যেভাবে সেজে আজ আমার অফিসে গিয়েছিল ঠিক সেভাবে সেজে আছে দিতিয়া। সেই লাল জামদানি শাড়িটা পরেছে। সেভাবেই চুল বেনি করে বেলি ফুল লাগিয়েছে। কপালে লাল টিপ, হাতভর্তি কাচের চুড়ি। দিতিয়া এমনিতেই আমাকে ভয় পেত। আর ঐভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওর ভয়টা আরো বেড়ে গেল। কাঁচুমাচু হয়ে বলল,
“আমি এরকমটা করতে চাইনি। মানসী আমাকে জোর করে এভাবে সাজিয়ে দিল।”
আমি হাসলাম। তারপর নিজের ঘরে ঢুকলাম। আমার হাসি দেখে ও বুঝি একটু স্বস্তি পেল। আমার পেছন পেছন ঘরে ঢুকে বলল,
“হাসছ যে?”
আমি শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললাম
“শাড়িটা কি তোমার?”
“না। আবার হ্যাঁ…মানসী এটা দিয়ে বলল আজ রাতে যেন এটা পরি। তারপর আবার নিজেই পরিয়ে দিয়ে গেল। সেই রাত ৯টায় আমাকে এভাবে সাজিয়ে দিয়ে গেছে। মেয়েটা খুব নাছোড়বান্দা। তখন থেকে এভাবে বসে আছি।”
আমি আবারও হাসলাম। তারপর শার্টটা খুলে ফ্লোরে ফেললাম আর ও সেটা কুড়িয়ে ঝুড়িতে রাখল। আমি বাইরে থেকে ফিরে ডেইলি এই অকাজটা করি আর ও প্রতিদিন এভাবেই কাজটা করে। ও বলল,
“এত হাসছ কেন? এটা কি কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস?”
“দুপুরে যা দেখেছি, এখন আবার তার ডুপ্লিকেট দেখছি তো তাই হাসছি।”
“মানে?”
“মানসী আজ আমার হসপিটালে গিয়েছিল। এই শাড়িটা পরে এভাবেই সেজে গিয়েছিল।”
হঠাৎ আমার চোখ পড়ল দিতিয়ার নাকফুলটার দিকে। এটাই সেই নাকফুলটা যেটা আমি মানসীকে দিয়েছিলাম। কী আশ্চর্য! আমার স্মৃতিগুলো কি রাখতে চায় না নাকি? আমি নিজেই অজান্তেই বলতে নিলাম,
“নাকফুলটা…”
তারপর আবার থেমে গেলাম, বললাম না। দিতিয়া বলল,
“এটা মানসী আমাকে দিয়েছে। কি একটা ব্যাপার বলো তো। ওর জন্মদিন কই আমি ওকে উপহার দেব তা না ওই এসব দিয়ে গেল।”
“এই নাকফুলটা আর শাড়িটা আমি ওকে আমাদের বিয়ের সময় দিয়েছিলাম। ও বোধহয় আমার কোনো স্মৃতি নিজের কাছে রাখতে চায় না। অথচ এতদিন বলেছিল এগুলো ওর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস। এগুলোকে ও মরণের আগ পর্যন্ত কাছছাড়া করবে না।”
দিতিয়া আমার একটু কাছে এসে বলল,
“অভিমান হয়েছে? থাক, আর অভিমান করতে হবে না। এবার আসল ঘটনাটা শোনো।”
“আসল ঘটনা আবার কী?”
“এই নাকফুলটা আজ আমি ওর নাকে দেখে বললাম, ‘বাহ খুব সুন্দর তো। কোত্থেকে কিনেছ?’ ও ঠিক তখনই ওর ব্যাগ থেকে হুবহু আরেকটা নাকফুল বের ‘এটা করে আমাকে দিল। সাথে এই শাড়িটাও। আমি তো অবাক! বললাম, কার?” বলে, ‘তোমার জন্য এনেছি।’ আমি কিছুতেই নিতে চাচ্ছিলাম না। কারণ জন্মদিনটা ওর। আমারই কিছু দেয়া উচিত। তখন ও কী বলল জানো?”
“কী?”
“একটা শাড়ি দেখিয়ে বলল, ‘এটা তোমার বর আজ আমাকে দিয়েছে। ও যখন দিয়েছে তখন তোমাকে আর দিতে হবে না। আর এটা আমার কাছে অনেক স্পেশাল। অনেক দিন ধরে খুঁজেছি এই শাড়িটা। আর আজ ও আমাকে দিল। আজ আমি খুব খুশি।’ তারপর জোর করে এগুলো আমাকে দিয়ে গেল। শুধু যে দিল তা না একেবারে পরিয়ে সাজিয়ে দিয়ে গেল। খুব অদ্ভুত একটা মেয়ে। আর খুব ভালো।”
আমি হেসে বললাম,
“হুম, সেকথা আমি ছোটবেলা থেকেই জানি।”
ওর জন্য কেনা শাড়ির প্যাকেটটা ঘরে ঢুকেই বিছানার ওপর রেখেছিলাম সেটা উঠিয়ে ওর হাতে দিয়ে বললাম,
“দ্যাখো তো এটা একটু।”
ও শাড়িটা দেখে চমকে উঠল,
“ওমা, এই শাড়িটাই তো ওকে দিয়েছ! এটাই তো দেখাল।”
“এটা না, এরকম দেখতে অন্য আরেকটা। ওটা মানসীর আর এটা তোমার।”
খুশিতে দিতিয়ার চোখে জল এসে গেল। অন্যমনস্কভাবেই বলে ফেলল,
“আমার! আমার জন্য এনেছ?”
“হ্যাঁ, কিনতে গিয়ে একটা কিনতে পারলাম না।”
“কিন্তু এত দামি শাড়ি এখন দেয়ার কী দরকার ছিল? আমার তো আর জন্মদিন না।”
“সমস্যা নেই, তোমার জন্মদিনে আবার দিব, দুজনকেই।”
বলেই হেসে ফেললাম। ও কিছু বলল না। আমি দুষ্টুমি করে বললাম,
“কী করব বলো দুটো বউ থাকলে এই হয় সমস্যা।”
ও অবাক হয়ে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। তারপর বলল, “তুমি আমাকে বউ মানো?”
দিতিয়ার চোখে জমে থাকা জলটা এবার গড়িয়ে পড়ল। মায়া হলো আমার। আমি কাছে গিয়ে ওর চোখের জল মুছে দিয়ে বললাম,
“এটুকুতেই এত খুশি?”
“এটা এটুকু ছিল না, অনেকটা ছিল। একবারের জন্য হলেও বউ তো বলেছ।”
আমি বললাম,
“দেখো, মানসী খুব কাঁদত। আর মাও কান্নাকাটিতে ওস্তাদ। কিন্তু কান্না জিনিসটা খুব অস্বস্তি দেয় আমাকে। আর কখনো কাঁদবে না।”
ও চোখ মুছে হাসল। আমি গোসল করতে ঢুকলাম। আমি প্রতিদিন হসপিটালে যাওয়ার সময় গোসল করে যাই, আবার যত রাতই হোক ফিরেও গোসল করি। প্রতিদিনের অভ্যাস। কিন্তু আজ গোসল করতে গিয়েই মনে হলো, মানসীর স্পর্শ লেগে আছে গায়ে। আজ নাইবা গোসল করলাম। ফ্রেশ হয়ে বের হলাম। তারপর বিছানায় শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ মনে হলো, আজ আমি দিতিয়ার সাথে অনেক ভালো ব্যবহার করলাম। ওর জন্য কষ্টও হলো কিন্তু কেন? মানসী বলেছে বলেই? নাকি আজ আমি নিজে অনেক শান্তিতে আছি তাই! নাকি ওর জন্য আমার মনে কোনো জায়গা হতে শুরু করেছে? না না সেটা কী করে হয়? আমি নিজেই নিজেকে নিয়ে কনফিউজড হয়ে গেলাম। কিন্তু আমার মনে তো দিতিয়ার জন্য কোনো জায়গা নেই। সবটা জুড়েই তো মানসী। নাকি নিজের অবচেতন মনেই দিতিয়াকে জায়গা দিয়ে ফেলেছি! কিন্তু এক সাথে কি দুজনকে ভালোবাসা যায়? দিতিয়াকে ছাড়তে পারব না ফ্যামিলির জন্য। আর ছাড়লে মেয়েটা যাবেই বা কোথায়? আর মানসীকে ছাড়া বেঁচে থাকাটা দূর্বিষহ। কী করা উচিত এখন আমার?
এসব আবোলতাবোল ভাবনার অবসান ঘটাল দিতিয়া,
“কী হলো? না খেয়ে শুয়ে পড়লে যে?”
আমি কিছু না বলে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটা সত্যি অনেক সুন্দর। ও বলল,
“প্লিজ, আজ না খেয়ে ঘুমিয়ো না। আজ একটা ভালো দিন। আর আজ মানসী তোমার জন্য রান্না করেছে।”
“মানসীর রান্না বলে খাওয়াতে হবে না। আজ খুব ক্ষিদে পেয়েছে, এমনিতেই খাব। রেডি করো, আমি আসছি।”
খেতে বসে অবাক হলাম। গরম ধোঁয়া উঠছে ভাত থেকে। বললাম,
“এত রাত্রে গরম ভাত কোথায় পেলে?”
“রান্না করেছি কিছুক্ষণ আগেই।”
“এত রাত্রে রান্না করতে গেলে কেন? রাতের ভাত ছিল না?”
“আমি জানতাম না যে তুমি গরম ভাত পছন্দ করো। জানলে প্রতিদিন রান্না করে দিতাম। আজ মানসী বলে গেল গরম ভাত তোমার খুব পছন্দ।”
আমি হেসে বললাম,
“ওর সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। সেটা তোমার মধ্যে ট্রান্সফার করার চেষ্টা করছে।”
“ভালো কিছু ট্রান্সফার হলে ক্ষতি কী? সত্যি হঠাৎ চকলেট পেলে বাচ্চাদের চেহারার যে অবস্থা হয় তোমার চেহারারও এখন সেই অবস্থা হয়েছে।”
আমি খেতে খেতে বললাম,
“তোমার আর মানসীর কথাবার্তা শুনলে মনে হয় তোমাদের যেন কতদিনের বন্ধুত্ব। অথচ তোমাদের যে সম্পর্ক আর যে পরিস্থিতি তাতে তোমাদের একজন আরেকজনের চুল ছেঁড়ার কথা।”
“হয়তো তাই করতাম যদি মানসী এমন না হতো।”
“ও তো বলেছে, তুমি না হলে ও অন্য কারো কাছে আমাকে ছাড়তে পারতো না।”
একথা শুনে দিতিয়া আমার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। আমি বললাম,
“বাই দ্য ওয়ে…মিথ্যে বলার দরকার ছিল না। আমি এমনিতেই খেতাম আজ। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল।”
“কী মিথ্যে বললাম আবার?”
“ওই যে বললে মানসী রান্না করেছে। সব তো মানসী করেনি। শুধু মাংসটা
মানসী করেছে। ভর্তাগুলো মা করেছে, বাকিগুলো তুমি বা অনন্যা কেউ হবে।
“বাপরে! রান্না খেয়েই বলে দিতে পারো রাঁধুনি কে?”
“সবারটা পারি না।”
“বাকিগুলো আমি করেছি।”
“বাহ, তোমার রান্না তো বেশ ভালো।”
“আমি কিছুই পারতাম না। মা শিখিয়েছে, এখনো শিখছি।”
“কেন, বাড়িতে কখনো রান্না করোনি?”
“না, চাচি রান্নাঘরে ঢুকতে দিত না। বলত আমি অপয়া। আমি বাড়ির অন্য কাজ করতাম।”
কথাটা শুনে খারাপ লাগল, ওরও হয়তো বলে খারাপ লাগছে। প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললাম,
“রান্না শিখছ ভালো করছ। স্বামী যার এত পেটুক, রান্না তো তাকে শিখতেই হবে।”
কথাটা বলেই বোকা হয়ে গেলাম। কী বলছি এসব? আমি তো নিজেকে ওর স্বামী বলে স্বীকারই করি না। ওর চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ল। বলল,
“তুমি বুঝি পেটুক! প্রায় রাতেই তো খাও না।
“আসলে মন মেজাজ ভালো না থাকলে কিছুই খেতে ইচ্ছে করে না। আগে তো প্রচুর খেতাম। মানসী বলেনি?”
“বলেছে তুমি খেতে ভালোবাস, পেটুক তো বলেনি।”
“আমার সম্পর্কে কখনো ও নেগেটিভ কিছু বলবে না, নেগেটিভ হলেও পজেটিভ শব্দ ব্যবহার করে বলবে। তাই পেটুকটাকেই শ্রুতিমধুর করে খেতে ভালোবাসে বলেছে।”
কথা বলতে বলতেই খেয়াল করলাম ও মুগ্ধ চোখে দেখছে আমাকে। তাই ওর দিকে তাকিয়ে আমি আর ওর মুগ্ধতা নষ্ট করলাম না। ও বলল,
“মানসী তো তোমার সম্পর্কে আরো অনেক কথা বলেছে আমাকে। তুমি নাকি সারাক্ষণ দুষ্টুমি করো, হাসতে থাকো, হাসাতে থাকো। আমি তো ভাগে পেলাম শুধু রাগটা।”
আমি বললাম,
“ভুল বললে, আমার অনেক রাগ এটা ঠিক, কিন্তু সবচেয়ে বেশি রাগ দেখিয়েছি আমি মানসীর সাথে। আর ওরকম রাগ ইহজনমে আরো কারো সাথে দেখাতে পারব না। আরেকটু ভাত দাও তো।”
ভাত দিতে দিতে দিতিয়া বলল,
“কেন পারবে না?”
“রেগে গেলে আমি হিংস্র হয়ে যাই। সেই হিংস্রতা মানসী ছাড়া আর কেউ সহ্য করতে পারবে না।”
“হিংস হয়েই দেখো না, সহ্য করতে পারি কিনা।”
“পারবে না। একটু ধমক দিলেই তো সারারাত ধরে কাঁদো।”
“আমি তোমাকে ঠিক বুঝতে পারি না। তবে এটা ঠিক এতদিন তোমাকে যেরকম দেখেছি আজ তার সাথে কোনো মিল পাচ্ছি না।”
আমি হঠাৎ খেয়াল করলাম ও খাচ্ছে না। বললাম,
“তুমি খাচ্ছ না যে?”
“ও হ্যাঁ, খাচ্ছি।”
—————
বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। একটু পর খেয়াল করলাম দিতিয়া কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকছে। আমি বললাম,
“শাড়ি পরে ঘুমাতে পারো না?”
“না, কেন?”
“এই শাড়িটাতে তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। আজকে নাহয় নাইবা চেঞ্জ করলে। অনেক মেয়েই তো শাড়ি পরে ঘুমায়। তুমিও চেষ্টা করে দেখতে পারো।”
।দিতিয়া চেঞ্জ করল না। ফিরে এসে বিছানার অন্য প্রান্তে আমার পাশে বসেই চুলের বেনীটা খুলতে খুলতে বলল,
“তোমায় আজ বড্ড অচেনা লাগছে।”
আমি দুষ্টুমি করে বললাম,
“কেন সিগারেট তো রোজই খাই।”
একথা শুনেই ও হেসে ফেলল। হাসির শব্দ শুনে ওর দিকে তাকাতেই দেখলাম চুল খোলার পর ওকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। কেমন ভয় হলো নিজেকে নিয়ে। আমি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি না তো?”
তাড়াতাড়ি সিগারেটটা নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম,
“গুড নাইট, লাইটটা অফ করে দাও, ঘুম পাচ্ছে।”
মুখে ঘুম পাচ্ছে বললেও খুব বুঝতে পারছিলাম আজ রাতে আর ঘুম হবে না আমার। মানসীর ওপর রাগ হচ্ছিল। ও কেন দিতিয়াকে এভাবে প্রেজেন্ট করল আমার সামনে? আর কেনই বা আমার কাছে এসে আমার ভেতরের মানুষটাকে জাগিয়ে দিয়ে গেল!
দিতিয়া লাইট অফ করে আমার পাশে শোয়ামাত্র জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলো ওর মুখে পড়ল। আরো মায়াবী লাগল ওকে। ওর কাছে এগিয়ে ওর গালে একটা হাত রাখলাম। চোখে চোখ রাখলাম। ওর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেল। চোখ ভরে উঠল জলে। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পারছিলাম দুজন দুজনকে। তারপর হঠাৎ আমি ওর ঠোঁটে চুমু খেলাম, অনেকক্ষণ ধরে! ও জড়িয়ে ধরল আমাকে। হঠাৎ মনে হলো মানসীর স্পর্শ পেলাম। মানসীর মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। স্পষ্ট দেখলাম যেন মানসী কাঁদছে। সাথে সাথে ওকে ছেড়ে দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব বারান্দায় চলে গেলাম। আরেকটা সিগারেট ধরালাম। কিছুক্ষণ পর দিতিয়াও বারান্দায় এল। বলল,
“এত প্রেশার নিচ্ছ কেন? তোমার যা ইচ্ছে হবে তাই করবে, যা ইচ্ছে হবে না তা করবে না। কেউ তো তোমাকে জোর করেনি।”
আমি কিছু বললাম না। ও বলল,
“আমি জাস্ট আজকের হাসিখুশি নীরবকে দেখতে চাই। তাতে যদি আমাকে দূরে থাকতে হয় তবে তাই থাকব। শুধু তুমি ভালো থাকো।”
আমি আকাশের চাঁদটার দিকে তাকিয়ে সিগারেট টেনে গেলাম। ওর দিকে তাকানোর আর সাহস পেলাম না। নিজেকে আমার অচেনা লাগছে।
নীরব ইশতিয়াক
২৪ এপ্রিল, ২০১৬
·
·
·
চলবে..........................................................................